বাংলাদেশে বিজয় গুন্ডাতন্ত্রের এবং মৃত আইনের শাসন
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 20, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
বিজয় অসভ্যতার
প্রতিটি সভ্য সমাজই সুস্পষ্ট কিছু আলামত নিয়ে বেঁচে থাকে। সে আলামতগুলি হলোঃ এক). আইনের শাসন; দুই). নাগরিকদের জান, মাল ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার অধিকার, তিন).রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের অংশ গ্রহণের অধিকার, এবং চার) ধর্ম-পালন, সংসার-পালন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মত-প্রকাশের স্বাধীনতা। দেহে হৃপিণ্ড, ফুসফুস ও মগজের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কোন একটি কাজ না করলে মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি সভ্য সমাজের মৃত্যুও অনিবার্য, যদি উপরের চারটি উপাদানের কোন একটি বিলুপ্ত হয়। তখন জোয়ার আসে অসভ্যতার। এজন্যই প্রতিটি সভ্য সমাজে শুধু লিপিবদ্ধ আইনই থাকে না, থাকে আইনের শাসনও। থাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ। প্রতিটি নাগরিকের থাকে প্রাণে বাঁচার অধিকার। আইনের শাসনের অর্থ হলো কেউই বিচারের উর্দ্ধে নয়। অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী শাস্তি পাওয়াটি অনিবার্য। দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টও সে শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে না। সে শাস্তি না হওয়াটা তাই অনিয়ম এবং সেটি অসভ্যতার আলামত।
ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনের শাসন। কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা -সে নির্ণয়টি কখনোই উন্নত পোষাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-বাড়ি ও পানাহার দিয়ে হয় না। বরং সেটি হয় ন্যায়নিষ্ঠ আইন এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সে আইনের কতটা সুষ্ঠ প্রয়োগ হলো তার ভিত্তিতে। বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে মহান আল্লাহতায়ালা শুধু উত্তম খাদ্যপানীয়ই দেননি, বরং আইন প্রণয়নের দায়িত্বটি তিনি নিজ হাতে রেখেছেন। সে আইনের নাম হলো শরিয়ত। তাই ইসলামে অপরিহার্য শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাতের প্রতিষ্ঠা নয়, বরং অপরিহার্য হলো শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠাও। কাফের হওয়ার আলামত তাই শুধু মহান আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাঁর আইনের প্রয়োগে অবাধ্য হওয়া। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণাটি হলোঃ “… যারা নাযিলকৃত আইন আনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করে না, তারাই কাফের। …তারাই জালেম। …তারাই ফাসেক।” –(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৪, ৪৫, ৪৭)। প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ যে সভ্যতাটির জন্ম দিয়েছিলেন তার মূলে ছিল শরিয়তি আইন প্রতিষ্ঠায় অটুট অঙ্গিকার। খলিফা ওমর (রাঃ)ও তাই বিচারকের সামনে হাজির হয়েছেন এবং কাজীর রায় বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছেন।
আইনের শাসন থাকায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বিচারে শাস্তি হয়েছে। এবং অর্থচুরির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে গদি ছেড়ে জেলে যেতে হয়েছে। একটি মাত্র এ রায়ই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিপ্লব এনে দিয়েছে। ফলে গদি থেকে চোরকে সরাতে সেদেশের মানুষদের রাজপথে বিপ্লবে নামতে হয়নি। রাজনীতিতে সুস্থ্যতা আনতে ন্যায় বিচার যে কীরূপ শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে -এ হলো তার প্রমাণ। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বিশ্ব-নন্দিত রায় দিয়েছে, অপরাধীদের জন্য রাজনীতিতে অংশ নেয়া নিষিদ্ধ। রাজনীতি হলো দেশগড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার; এটি কখনোই দেশভাঙ্গা, চুরি-ডাকাতি ও নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হতে দেয়া যায় না। এ রায়ে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণ বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতির অঙ্গণ কখনো অপরাধীদের হাতে জিম্মি হতে দেয়া যায় না। কারণ, তাতে সমগ্র দেশ অধিকৃত হয় এবং জনগণ জিম্মি হয় ভয়ানক অপরাধীদের হাতে। তখন বর্বর অসভ্যতা নেমে দেশের গ্রামগঞ্জে, রাজপথে, জনপদে -এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়েও। হিংস্র পশুকে জনপদে মুক্ত ঘুরতে দিলে কি জনজীবনে নিরাপত্তা থাকে? তেমনি শান্তি বিঘ্নিত হয় খুনি, গুন্ডা ও সন্ত্রাসীদের রাজনীতির অঙ্গণে মুক্ত ছেড়ে দিলে। তাদেরকে কারাগারে বন্দী রাখা তাই সভ্য সমাজের রীতি। সমাজের বুকে আইনের শাসন তো এভাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটি। দেশটি অধিকৃত অপরাধীদের হাতে। ভয়ানক খুনি, গুণ্ডা, ও ধর্ষণকারীদের মুক্ত ছেড়ে দেয়া হয়েছে রাজপথে। সম্প্রতি তাদের ঢাকার রাজপথে দেখা গেল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলে হামলা করতে। এবং সেটি পুলিশের সামনে। কোন সভ্যদেশেই বিনাবিচারে হত্যার অধিকার সরকারের থাকে না। সরকারেরর দায়িত্ব হলো প্রশাসন চালানো, দেশে উন্নয়ন আনা, দেশের প্রতিরক্ষাকে মজবুত করা ও নাগরিকদের জীবনে নিরাপত্তা দেয়া। কখনোই সেটি নাগরিক হত্যা নয়, নাগরিকদের উপর জুলুম করাও নয়। কাউকে হত্যাদণ্ড দেয়ার অধিকার একমাত্র আদালতের। সেটি এক বিশাল বিচার প্রক্রিয়ার পর। কিন্তু কোন দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা পেলে এরূপ ন্যায়নিষ্ঠ বিচারের মৃত্যু ঘটে। তখন বিচারকদেরও স্বৈরশাসকের আজ্ঞাবহ হতে হয়। এরূপ বিচারকগণই মিশরে স্বৈরশাসক বিরোধী মিছিলে যোগ দেয়ার অপরাধে ৭৫জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির হুকুম শুনিয়েছে। বাংলাদেশে বিচারের নামে চলছে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও নির্যাতন। ন্যায় বিচার লাভের অধিকার হারিয়েছে শুধু জনগণ নয়, দেশের উচ্চ আদালতর বিচারকগণও। বিচারকগণও হারিয়েছেন এমন কি জীবনের নিরাপত্তাও। তাদের নিরাপত্তাহীনতা যে কতটা গভীর তা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রাণ ভয়ে হঠাৎ চাকুরি ছেড়ে ও দেশ ছেড়ে প্রমাণ করেছেন।
বিজয় গুণ্ডাতন্ত্রের
জীবনে বেঁচে থাকার অধিকারটি প্রতিটি নাগরিকের সবচেয়ে পবিত্র সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার। কিন্তু সে অধিকার কেড়ে নেয় স্বৈরাচারি সরকার। সন্ত্রাসীদের ন্যায় মানুষ খুন করে স্বৈরাচারি সরকারের পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারগণ। তখন প্রতিষ্ঠা পায় জঙ্গলের অসভ্যতা। গভীর জঙ্গলে হিংস্র পশুদের শিকার ধরায় যে অবাধ স্বাধীনতা, অধিকৃত দেশের জনপদে সে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে স্বৈরাচারি সরকারের পালিত গুণ্ডাগণ। ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে যেভাবে শত শত মানুষকে হত্যা করা হলো -সেটি কি কোন জঙ্গলেও সচারচর ঘটে? বিনা বিচারে হত্যার সে অসভ্যতার শুরুটি শেখ মুজিবের হাতে। পুলিশের হাতে বন্দী সিরাজ সিকদারের হত্যার পর তিনিই সংসদে দাঁড়িয়ে অতি দর্পের সাথে ঘোষণা দেন, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার।” বিনা বিচার মানুষ হত্যার সে জঘন্য কাজটিকে সেদিন তিনি গর্বের এবং সে সাথের উৎসবের কাণ্ডে পরিণত করেছিলেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় সরকার প্রধানের এমন আচরণকে বলা হয় নিরেট ফ্যাসিবাদ। বাংলাতে যাকে বলা যায় নির্ভেজাল গুণ্ডাতন্ত্র। এরূপ গুণ্ডাতন্ত্রে যা সবচেয়ে গুরুত্ব পায় তা হলো বিরোধীদের নির্মূল –তা যতটা নৃশংস বা বেআইনী ভাবেই হোক।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার শেখ মুজিবের প্রবর্তিত গুণ্ডাতন্ত্র তথা ফ্যাসিবাদকেই ষোলকলায় পূর্ণ করেছে। ফলে তাঁর সরকার পরিণত হয়েছে গুণ্ডাদের লালনকর্তা। ফলে পুলিশের সামনে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের অস্ত্রহাতে ঘুরাফেরা ও নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের পেটানোর ন্যায় বর্বরতার ঘটনাও ঘটছে। কোন সভ্য দেশে পুলিশের সামনে এমন কাণ্ড অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশ ও সরকারি দলের গুণ্ডাগণ যেহেতু একই ঘরানার, ফলে রাজপথে উভয়েরই ঘটে সহযোগিতামূলক সহ-অবস্থান। ফলে যে অসভ্যতা এককালে ডাকাতপাড়া ও নিষিদ্ধ পল্লির বিষয় ছিল, তা এখন উঠে এসেছে রাজপথে -এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গণেও। ফলে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যলয়ের অঙ্গণে শুধু খুন-ধর্ষণই হয় না, ধর্ষণে সেঞ্চুরির উৎসবও হয়। যেমনটি শেখ হাসিনার প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হয়েছিল। সে খবর বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও হাসিনার সরকার অপরাধীকে ধরতে কোন আগ্রহ দেখায়নি। যেমন তিনি আজ আগ্রহ দেখান না পুলিশের সামনে গুন্ডামীতে লিপ্ত সন্ত্রাসীদের ধরতে। সরকার যখন গুন্ডামীর পালন ও লালন কর্তায় পরিণত হয় -তখন তো এমনটিই ঘটে।
সভ্য সমাজের আরেক আলামত হলো, প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকার। সে অধিকার বলে সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরা ও মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলা কোন অপরাধ গণ্য হয় না। সে অধীকারের প্রকাশ যেমন রাজপথের মিছিল বা জনসভায় হয়, তেমনি হয় দেশের পত্র-পত্রিকায় ও টিভিতে। কিন্তু স্বৈরাচারি শাসকগণ জনগণকে সে অধিকার দেয় না। সত্য কথা বলা তখন শাস্তি যোগ্য অপরাধে পরিণত হয়। প্রখ্যাত আলোক চিত্র শিল্পী ডক্টর শহীদুল আলম সম্প্রতি আল জাজিরা টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাতকারে কিছু সত্য কথা বলেছিলেন। ঢাকার রাজপথে যা দেখেছেন সেটিই বলেছেন। এর মধ্যে কোন মিথ্যা বা অতিরঞ্জণ ছিল না। অথচ সেটিই অপরাধ গণ্য হয়েছে সরকারের কাছে। রাতের আঁধারে বাসায় ডাকাতের ন্যায় হামলা করে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তাঁর উপর দৈহিক নির্যাতনও করা হয়। ফলে আদালতে তিনি সোজা ভাবে হাঁটতেও পারছিলেন না।
ড. শহিদুল আলমের সাথে যা ঘটেছে তাকে নিছক গুন্ডামী ছাড়া আর কি বলা যায়? এর মধ্যে কোন নীতি নাই, ন্যায়বিচার নাই, দর্শনও নাই –বরং আছে বর্বর পেশী শক্তির প্রয়োগ। এমন গুন্ডামী তো নিরেট অসভ্যতা। হাসিনার সরকার একই রূপ অসভ্য কাণ্ড ঘটিয়েছে “আমার দেশ” পত্রিকার সম্পাদক জনার মাহমুদুর রহমানের সাথে। এরূপ অসভ্যতা মুজিবের আমলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বলে শুধু সিরাজ সিকদারকে নয়, ৩০ হাজারের বেশী মানুষকে বিনাবিচার মরতে হয়েছে। আজ সে অসভ্যতাকেই তাঁর অনুসারিগণ প্রবলতর করেছে। প্রশ্ন হলো, সত্য কথা বলা কোন দেশে এভাবে অসম্ভব করা হলে সে দেশে কি মানবতা বাঁচে? তখন তো সুনামীর ন্যায় ধেয়ে আসে অসভ্যতার তাণ্ডব। এমন দেশ খুন, গুম, ধর্ষণ ও দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়বে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে তো সেদিকেই ধাবিত করছে। কোন সভ্য মানুষ কি সরকারের এরূপ অসভ্য প্রকল্পে সমর্থণ ও সহায়তা দিতে পারে?
মৃত গণতন্ত্র ও ব্যর্থ নির্বাচন-প্রক্রিয়া
সভ্য সমাজের অপর আলামতটি হলো, সেখানে সরকার নির্বাচিত হয় জনগণের রায়ে, শক্তির জোরে নয়। মানব ইতিহাসে সে সভ্য রীতি সর্বপ্রথম চালু করে ইসলাম। জনগণ তখন রায় প্রকাশ করতো প্রকাশ্যে সমর্থণ দিয়ে। সে প্রকাশ্য সমর্থণের ইসলামি পরিভাষা হলো “বাইয়াত”। ফলে বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণের চেয়ে বৃহৎ রাষ্ট্রের শাসক হতে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত আলী(রাঃ)কে রাজপুত্র বা শাসকপুত্র হতে হয়নি, শক্তির প্রয়োগও করতে হয়নি। ইসলামের আগে গ্রীকবাসী গণরায় নেয়ার সে রীতি প্রচলন করলেও সেটি ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর-ভিত্তিক, বিশাল রাষ্ট্রভিত্তিক নয়। কিন্তু গণরায় নেয়ার সে প্রক্রিয়ায় আধুনিকরণ এসেছে। জনগণ এখন তাদের রায় জানিয়ে দেয় ভোটের মাধ্যমে। জনগণের সে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন জরুরী। সেটি অনুষ্ঠিত করতে হয় নিরপেক্ষ নির্বাচনি কর্তৃপক্ষের অধীন। নির্বাচনি কর্তৃপক্ষের অপরিহার্য ক্ষমতাটি হলো নির্বাচনে যারা কারচুপি করে তাদের শাস্তি দেয়ার বা অযোগ্য ঘোষণার।
গণতন্ত্রে বহু দলীয় রাজনীতি থাকে। সে রাজনীতিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন থাকে। সে নির্বাচনে জনগণের অবাধ অংশগ্রহনও থাকে। থাকে মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। থাকে মাঠে ময়দানে সকল দলের মিছিল-মিটিংয়ের অবাধ অধিকার। অথচ বাংলাদেশে এর কোনটাই নাই। রাজপথে দূরে থাক, জামায়াতের নেতাকর্মীগণ ঘরের চার দেয়ালের মাঝে মিটিং করলেও তাদের গ্রেফতার করা হয়। এমন কি খেলাধুলাতেও অপরিহার্য হলো নিরপেক্ষ রিফারী। খেলার মাঠে সমান সুযোগ দিতে হয় উভয় পক্ষকেই। রিফারীর ক্ষমতা থাকে দুষ্ট খেলোয়ারকে লাল কার্ড দেখানোর। ক্ষমতা থাকে অপরাধী খেলোয়াড়কে পেনাল্টির শাস্তি দেয়ার। রিফারীর হাতে সে ক্ষমতা না থাকলে তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয় খেলাকে সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনা করা। তখন ফাউল খেলেও দুষ্ট দল বিজয়ী হয়। এরূপ দুর্বৃত্তি ঘটে স্বৈর-সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটি গোপন নয়, ভোটকেন্দ্রে ঢুকে সরকারি দলের ক্যাডারগণ যখন ব্যালট পেপারে ইচ্ছামত সিল মেরে ভোট বাক্স পূর্ণ করে তখন তাদেরকে বাধা দেয়া বা লাল কার্ড দেখনোর সামর্থ্য বা অধিকার কোনটাই নির্বাচনি কমিশনরের থাকে না। যত রকম অনিয়ম বা কারচুপিই হোক –সে কারণে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করার ক্ষমতাও তার নেই। তাঁর হাতে ক্ষমতা শুধু সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা দেয়া এবং নির্বাচন যে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হয়েছে -সেটি মিডিয়ার সামনে জোরেশোরে প্রচার করা। নির্বাচনি কমিশনরের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব শুধু সেটুকুই।
অথচ সংসদ নির্বাচন কোন খেলাধুলা নয়, জাতির জীবনে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতির ভাগ্য নির্ধারণ হয় এবং আগামীতে দেশ কোন দিকে যাবে -সেটি নির্ধারিত হয় নির্বাচনের ফলাফল থেকে। নির্বাচন হলো জনগণের হাতে ন্যস্ত অতি শক্তিশালী হাতিয়ার। ভোট দিয়ে জনগণ অপরাধী ও অসৎ রাজনীতিবিদদের পরাজিত করে শাস্তি দেয়। এবং পুরস্কৃত করে সৎ ও যোগ্যবানদের বিজয়ী করে। কিন্তু স্বৈরাচারি শাসকগণ শাস্তিদান ও পুরস্কারদানের এ অধিকার ভোটারদের হাতে দিতে রাজী নয়। সে অধিকারকে তারা নিজ হাতে রাখতে চায়। ফলে আবিস্কার করে ভোট ডাকাতির এমন এক প্রক্রিয়া যা দিয়ে নিজ দলের বিজয়কে সুনিশ্চিত করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তো সেটিই হয়েছে। এরূপ নির্বাচন বার বার হলেও তাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় না; বরং প্রতিফলন হয় সেটিরই যা স্বৈরশাসক চায়।
শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচন ঠিকই হয়েছে। কিন্তু সেসব নির্বাচনে নিরপেক্ষ রিফারী, সবদলের অংশগ্রহণ এবং জনগণের কাছে পৌঁছার সব দলের সমান সুযোগ-সুবিধা -এ বিষয়গুলি কখনোই গুরুত্ব পায়নি। সেগুলি নিশ্চিত করা শেখ হাসিনার হাতে নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচনি কমিশনের এজেন্ডায় স্থান পায়নি। সেটি যেমন ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের ক্ষত্রে, তেমনি আজও। সেটি বুঝা যায় সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনগুলিতে। ফলে পুরা অকার্যকর হয়ে পড়েছে নির্বাচনি প্রক্রিয়া। কারা সংসদের সদস্য হবে -সেটি নির্ধারণ করেন শেখ হাসিনা নিজে এবং জনগণ পরিণত হয়েছে নিছক দর্শকে। জনগণ ভোট দিল কি দিল না -সেটিও তাঁর কাছে কোন বিচার্য বিষয় নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মাঝে ১৫৩ সিটে কোন নির্বাচন হয়নি। যেগুলিতে ভোটকেন্দ্র খোলা হয়েছে সেখানেও শতকরা ৫ জনের বেশী ভোট দেয়নি। কারণ, যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই সেখানে জনগণ ভোট দিতে যাবে কেন? কিন্তু তারপরও নির্বাচনকে সুষ্ঠ ও আইনসিদ্ধ বলা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি দলের একটি মাঠে না নামলে যে খেলাই পরিত্যক্ত হয়। এটিই সভ্য সমাজের রীতি। সে রীতি স্বৈরাশাসকদেরও। তারাও প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচনি ময়দানে দেখতে ভয় পায়। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ও ভোটারহীন নির্বাচন নিয়েই তারা অধীক স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। ফলে স্বৈরশাসকের পাতানো নির্বাচনে মূল কৌশলটি হয়, নির্বাচনের ময়দান থেকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের দূরে রাখা।
সোসাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিবেক ধ্বংসে
বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরশাসনকে গণতান্ত্রিক বললে প্রচণ্ড অবমাননা হয় গণতন্ত্রের। তাতে প্রচণ্ড মিথ্যাচারও হয়। এবং গাদ্দারি হয় নিজের বিবেকের সাথে। কারণ, কোনটি আলো আর কোনটি আঁধার –এ বিচারবোধ সুস্থ্য মানুষ মাত্রেরই থাকে। তেমনি থাকে কোনটি গণতন্ত্র আর কোনটি গুন্ডাতন্ত্র -সেটুকু বোঝার সামর্থ্যও। ফলে একজন সুস্থ্য মানুষ কি করে নিরেট গুন্ডাতন্ত্রকে গণতন্ত্র বলে? এতে অবমাননা হয় নিজের বিবেক ও বিচারবোধের। কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজের বুকে যখন নানারূপ দুষ্ট শক্তির পক্ষ থেকে বিবেকধ্বংসী ব্যাপক সোসাল ইঞ্জিনিয়ারিং চলে তখন বহু বয়স্ক মানুষের মাঝেও সে সামান্য সামর্থ্যটুকু লোপ পায়। দেশে দেশে সেরূপ বিবেকধ্বংসী নাশকতা যেমন ধর্মের নামে হয়, তেমনি রাজনীতি ও শিক্ষাসংস্কৃতির নামেও হয়। ধর্মের নামে সে নাশকতা ব্যাপক ভাবে ঘটায় লক্ষ লক্ষ মন্দির ও তার পুরোহিতগণ। বিবেকের অঙ্গণে সে ব্যাপক নাশকতার কারণে ভারতে একশত কোটিরও বেশী মানুষের কাছে মুর্তি, পাহাড়-পর্বত, গরু-ছাগল, শাপ-শকুন –এমন কি লিঙ্গও পূজনীয় গণ্ড হয়। মিশরে ফিরাউনগণও ভগবানে পরিণত হয়েছে।
ধর্মীয় অঙ্গণের বাইরে রাজনীতির ময়দানে বিবেকবিধ্বংসী সে নাশকতাটি ব্যাপক ভাবে ঘটায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সেসব দলের নেতা-কর্মীগণ। তখন হিটলার, স্টালিন, মাও সে তুং ও শেখ মুজিবের ন্যায় নৃশংস স্বৈরাচারি শাসকগণও নেতা রূপে গৃহিত হয়। এসব স্বৈরাচারি শাসকগণ ক্ষমতায় গিয়ে শুধু যে গণহত্যা ঘটায় তা নয়, তাদের হাতে রাজনৈতিক দলগুলো পরিণত হয় বিবেক-বিধ্বংসী বিশাল বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ব্যাপক ভাবে বিবেকশূণ্য হওয়ার কারণ তো এটিই। সে বিবেকশূণ্যতার কারণে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার নিরেট গুন্ডাতন্ত্রও তাদের কাছে নির্ভেজাল গণতন্ত্র মনে হয়। তাদের কাছে রাজনীতি করার অধিকারটি যেন স্রেফ হাসিনার। ফলে অপরাধ গণ্য হয় নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামা ছাত্র-ছাত্রীদের সমর্থণ করাকে। সেটি চিত্রিত হচ্ছে ছাত্রদের রাজনীতিতে উস্কে দেয়ার অপরাধ রূপে। অথচ ছাত্রদের উস্কে দেয়ার রাজনীতি শুধু শেখ হাসিনার একার নীতি নয়, সেটি তাঁর পিতার নীতিও। রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণে তিনিই স্কুলের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে ক্লাসরুম থেকে বের করে শাহবাগ ময়দানে জড় করতে উৎসাহ দিয়েছেন। সেটি ছিল তাদের মুখ থেকে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবী ধ্বনিত করার প্রয়োজনে। তাদের মুখে তখন গুঁজে দেয়া হয়েছিল, “বিচার চাই না, ফাঁসি চাই” স্লোগান। এভাবে বিচারকদের বাধ্য করা হয়েছিল জেলের হুকুম পাল্টিয়ে ফাঁসির হুকুম দিতে। রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে ছাত্রদেরকে এরূপ নগ্ন ব্যবহারের নমুনা আর কি হতে পারে?
বিদ্রোহ সংবিধানের বিরুদ্ধে
প্রতিটি সরকারেরই কিছু সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব থাকে। গদিতে বসার আগে সরকার প্রধানকে সে দায়িত্ব পালনের কসম খেতে হয়। সংবিধানের কোন একটি বিধানের বিরুদ্ধে যে কোন বিদ্রোহই হলো একটি দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ। অথচ বাংলাদেশে সে অপরাধে লিপ্ত খোদ সরকার প্রধান। সে অপরাধের শাস্তি দিতে দেশের উচ্চ আদালতও নির্লপ্ত। সে বিচারটি না হওয়ায় সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এখন বিশেষ কোন ব্যক্তির মাঝে সীমিত নয়, সেরূপ বিদ্রোহ বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিতে পরিনত হয়েছে। উদাহরণ দেয়া যাক। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্বটি দেশের পুলিশ বিভাগ ও আদালতের। এটি তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বও। আইনের শাসনের অর্থ, আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ। সে জন্য জরুরী হলো, বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে সরকারের প্রভাবমুক্ত রাখা এবং স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেয়া। এবং তাদেরকে প্রভাব মুক্ত রাখার দায়িত্বটি মূলতঃ সরকার-প্রধানের। বস্তুতঃ সরকারের উপর অর্পিত এটিই হলো অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব। অথচ বাংলাদেশের স্বৈরসরকার এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের লোকদের চাকর-বাকরে পরিণত করেছে। পুলিশ বিভাগ ও দেশের আদালত কাজ করছে সরকারের নির্যাতনের হাতিয়ার রূপে।
শেখ হাসিনা নিজেও সংবিধান রক্ষা ও আইনের শাসনের কথা বলেন। সংবিধান যে কোন ব্যক্তিকে স্বাধীন ভাবে চলাচলের অধিকার দেয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সে স্বাধীনতা বিরোধী দলীয় নেত্রীকে দেননি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বাসার দরজার সামনে সারিবদ্ধ বালিভর্তী ট্রাক দিয়ে যেভাবে তার ঘর থেকে বেরুনো অসম্ভব করেছিল তাতে কি সংবিধান বেঁচেছিল? একাজ তো অসভ্য গুন্ডাদের। কোন সভ্য ও ভদ্র মানুষ কি সেটি ভাবতে পারে? কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ সেটি যেমন ভাবতে পারে, তেমনি তা করে দেখাতেও পারে। দেশের আইনের শাসন থাকলে এ নিয়ে আদালেত বিচার বসতো এবং বিচারে অপরাধীর শাস্তি হতো। কিন্তু বাংলাদেশ তার কোনটাই হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামলে পুলিশ যেমন রাস্তায় পিটায়, তেমনি আদালতও দিনের পর দিন অত্যাচারের সুযোগ করে দেয়। সেটি পুলিশের হাতে রিমান্ডে দিয়ে। এবং পুলিশের রিমান্ডে অত্যাচারটি রাস্তার গুন্ডাদের চেয়েও নৃশংসতর হয়। অথচ রাস্তায় প্রতিবাদে নামাটি প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের সংবিধান দেশবাসীকে নিজ মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। অথচ স্রেফ গদি বাঁচানোর স্বার্থে সে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এভাবে সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে খোদ সরকার। অথচ সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো সংবিধানকে প্রতিরক্ষা দেয়া, অমান্য করা নয়। এই একটি মাত্র অপরাধেই শেখ হাসিনার সরকার বৈধতা বিলুপ্ত হয় দেশ শাসনের। দেশে স্বাধীন আদালত ও আইনের শাসন থাকলে, এ গুরুতর অপরাধে শেখ হাসিনাকে বহু আগেই জেলে জেলে হতো।
স্বৈরশাসকদের লক্ষ্য কখনোই সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাও নয়। সংবিধান কি বলে না বলে -সেটিও তাদের বিচার্য বিষয় নয়। তাদের লক্ষ্য, স্রেফ নিজেদের গদির নিরাপত্তা। সে লক্ষ্যে স্বৈরশাসকগণ শুধু তাঁবেদার প্রশাসন, পুলিশ ও আদালতই পালে না, হাজার হাজার গুন্ডাও পালে। এরা সবাই তখন প্রতিবাদি ছাত্রছাত্রী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও জনগণের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে ময়দানে নামে। এভাবেই এরা সংঘবদ্ধ ভাবে পদদলিত করে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী সংবিধান ও আইন অমান্যকারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সরকার ও সরকারি দল। যে কাজ আগে চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীগণ করতো, সে কাজে নেমেছে খোদ সরকার ও সরকারি বাহিনীগুলি। বাংলাদেশের রাজপথ, প্রশাসন ও আদালতে সেটিরই প্রদর্শনী চলছে। ফলে সরকারি দলের গুন্ডাগণ যখন পুলিশের সামনে রামদা ও লাঠি হাতে নিরস্ত্র স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলা করে, পুলিশ তখন নীরবে দেখে। চোখের সামনে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা করতে দেখেও পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করেনি। বরং পুলিশের কাজ ছিল, সরকারি দলের গুন্ডাদের সহায়তা ও নিরাপত্তা দেয়া। গুন্ডাদের বিরুদ্ধে পুলিশের নীরব ভূমিকা দেখে এ বিশ্বাসও অমূলক নয়, রামদা ও লাঠি হাতের গুন্ডাগুলি ছিল সিভিল পোষাকে পুলিশেরই লোক! কায়রো ও দামস্কোর রাজপথে গুন্ডাবেশী পুলিশদের দেখা গেছে রাজপথে মিছিল থামাতে।
মৃত আইনের শাসন
সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলে সেদেশে আইনের শাসন বাঁচে না। অথচ সভ্যদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজে সরকার ইঞ্জিনের কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে আইনের শাসন কি এই, মাঝ রাতে একপাল পুলিশ গিয়ে একজন নিরস্ত্র মানুষকে হাইজ্যাক করতে হাজির হবে এবং তার ঘরের দরজা ভাঙ্গবে? এবং তারপর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তার উপর অত্যাচার করবে? অথচ সরকারের উপরের সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি হলো জনগণের জানমাল ও ইজ্জতের হেফাজত। কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টোটি। তাছাড়া সমস্যা শুধু পুলিশ বা রাজপথের গুন্ডাদের নিয়ে নয়; দুশ্চিন্তার কারণ, আদালতের বিচারকদের বিবেকশূণ্যতাও নিয়েও। সেটিও প্রকাশ পেয়েছে পুলিশের হাতে সদ্য গ্রেফতার হওয়া ফটো সাংবাদিক ড. শহীদুল আলমের সাথে বিচারকের আচরণে। আদালতের মেঝেতে বিচারক তাঁকে খোঁড়াতে দেখেছেন। গ্রেফতারের পর তাঁর উপর যে নির্মম নির্যাতন হয়েছে -তার আলামত ছিল সুস্পষ্ঠ। এক দিন পূর্বে যে ব্যক্তি সুস্থ্য ছিলেন, সে ব্যক্তি পুলিশের হাতে এক রাত থাকাতেই স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিলেন না। তিনি অন্যের ঘাড়ে ভর দিয়ে আদালতে আসেন। আশু চিকিৎসার জন্য বিচারক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু হাসপাতালে পাঠালেই কি বিচারকের দায়িত্ব শেষ হয়? তাঁর উপর যে বর্বর জুলুম হয়েছে সেটির বিচার কে করবে? জুলুম যে হয়েছে -তার সাক্ষি তো বিচারক নিজে। সুতরায় তাঁর দায়িত্ব ছিল সুবিচার নিশ্চিত করা। অথচ বিচারে তিন কোন আগ্রহ দেখাননি। সেদিন আদালত প্রাঙ্গণে আইনকে মৃত দেখা গেছে। ফলে আদালত প্রাঙ্গণে এবং খোদ বিচারকের চোখের সামনে অপরাধ ঘটলেও বিচার জুটবে -সে সম্ভাবনা নেই। অথচ সুবিচার নিশ্চিত করাটি প্রতিটি বিচারকের সাংবিধানিক দায়িত্ব। যে কোন স্বৈর-সরকারের ন্যায় শেখ হাসিনাও চায়, জনগণ ততটুকুই বলবে যাতে সরকারের ভাবমুর্তির বিনষ্ট না হয়। এর অতিরিক্ত বললে তখন অভিযুক্ত রাষ্ট্রদ্রোহ রূপে। সদ্য গ্রেফতারকৃত ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তো সরকার সে অভিযোগই এনেছে। সরকারের কাছে নিরস্ত্র শহিদুল আলম অপরাধী গণ্য হলেও, সশস্ত্র গুন্ডাগণ অপরাধী গণ্য হয়নি। কারণটি সুস্পষ্ট, গুন্ডাগণ ছাত্রছাত্রীদের পিটালেও তারা সরকারের শত্রু নয়। বরং গুন্ডাগণ চায় সরকারকে প্রতিরক্ষা দিতে।
প্রকল্পঃ চোর-ডাকাত প্রতিপালন ও নাশকতা
শেখ হাসিনার সৃষ্ট সংকট স্রেফ বর্বর স্বৈরশাসন বা গণতন্ত্রের বিনাশ নয়। তাঁর হাতে ভয়ানক নাশকতাটি ঘটেছে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে। সে নাশকতার মূলে হলো, তাঁর ও তাঁর দলের চোর-ডাকাত প্রতিপালন প্রকল্প। সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কোয়ান ইউ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক চুঙ্গ হি স্বৈরশাসক ছিলেন। কিন্তু তাদেরকে কেউ চোর-ডাকাত বলে নাই। তাদের হাতে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার, সরকারি ব্যাংক, বাজেটের অর্থ বা শেয়ার মার্কেট লুণ্ঠিত হয়নি। তারা চোর-ডাকাতদের নিজ দলে আশ্রয় দিয়েছেন এবং চুরি-ডাকাতিতে তাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন –সে প্রমাণও নাই। ফলে তাদের আমলে দেশবাসীর কষ্টার্জিত সম্পদ বেঁচে গেছে লুণ্ঠন থেকে। ফলে দ্রুত সম্পদশালী হয়েছে সে দেশের জনগণ। ফলে সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় পৌঁছে গেছে ৫৭ হাজার ৭০০ ডলারে। দেশটি প্রতি বছর বিদেশে রপ্তানি করে ৩২৯.৭ বিলিয়ন ডলার। অপর দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র রাশিয়ার চেয়েও বৃহৎ।
কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি ভিন্ন। দেশটিতে স্বৈরশাসকের আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে বিশাল এক পাল চোর-ডাকাত। তাদের হাতে লাগাতর ডাকাতি হচ্ছে জনগণের অর্থভাণ্ডারে। কোন গৃহে বার বার চুরি-ডাকাতি হলে কি সে গৃহের অর্থভাণ্ডারে কিছু বাঁকি থাকে? তখন সে গৃহের বাসিন্দাগণ তো অভাবে মারা পড়ে। সেটি ঘটে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের বেলায়ও। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে। চোর-ডাকাতদের অবাধ লুণ্ঠনে ধ্বসে গেছে দেশের অর্থনীতির তলা। এতে রাষ্ট্রের সম্পদ রাষ্ট্রে না থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশ, শেখ হাসিনার গত নয় বছর শাসনে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলির খেলাপি ঋণ ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ কোটি টাকা। শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট হয়ে গেছে আশি হাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উধাও হয়েছে গেছে নব্বই মিলিয়ন ডলার। আরো খবর, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনা ‘তামা’ হয়ে গেছে। এবং উধাও গেছে কয়লা খনির এক লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। সরকারের ডিবি ও পুলিশ বাহিনীর লোকেরা রাতের আঁধারে হাজার হাজার শহীদুল আলমদের গ্রেফতার করে এবং তাদেরকে রিমান্ডেও নয়। কিন্তু যারা হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছে, তাদের কাউকে কি গ্রেফতার করেছে? এখানেই ধরা পড়ে সরকারের প্রায়োরিটি। চোর-ডাকাতগণ রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ চুরি করলেও সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে না। তারা দেশের শত্রু হলেও শেখ হাসিনার শত্রু নয়। ফলে তাদের গ্রেফতার করা ডিবি, RAB ও পুলিশ বাহিনীর এজেন্ডা নয়।
লক্ষ্যণীয় হলো, এতো চুরি-ডাকাতির পরও শেখ হাসিনার জৌলুস কমেনি, বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রের খরচ বাঁচাতে পাশ্ববর্তী পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বানার্জি সরকারি প্রাসাদে উঠেননি। খরচ বাঁচাতে ইমরান খানও প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদে উঠছেন না। তিনি উঠছেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মচারিদের স্টাফ কোয়ার্টারে। অথচ পত্রিকায় প্রকাশ, শেখ হাসিনার অফিসের বাৎসরিক খরচ বেড়ে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকাতে পৌঁছেছে। একই অবস্থা ছিল মুজিব আমলে। তখন বিশ্বমাঝে বাংলাদেশ পরিচিতি পায় ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ি রূপে। তলাটি খসিয়ে দিয়েছিল শেখ মুজিবের ছত্রছায়ায় পালিত চোর-ডাকাতেরা। ফলে দেশের সম্পদ এবং সে সাথে বিদেশীদের দেয়া ত্রাণসামগ্রী দেশে থাকেনি, তলা দিয়ে বেরিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে তলাহীন বলার প্রেক্ষাপট তো এটিই। সে লুটপাটের ফলে ধেয়ে এসেছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং তাতে মৃত্যু ঘটে বহু লক্ষ মানুষের। কিন্তু তাতে শেখ মুজিবের জৌলুস কমেনি। তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন সোনার মুকুট পড়িয়ে।
তবে এতো চুরি-ডাকাতির পরও মুজিবামলের ন্যায় দুর্ভিক্ষ না আসার কারণ, হাসিনা সরকারের কিরামতি নয়। সেটি হলো, বিদেশের শ্রম বাজার থেকে প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীর কষ্টার্জিত অর্থ এবং দেশের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রির বহু লক্ষ দরিদ্র শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা মেহনত। মুজিবামলে সে সুযোগটি ছিল না। চুরিডাকাতি না থাকলে বাংলাদেশ আজ সিঙ্গাপুর না হলেও দেশবাসীর জীবনে যে অনেক স্বাচ্ছন্দ আসতো –তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? পদ্মার সেতুর একটি নতুন পিলার বসানো হলে সেটির ছবি ফলাও করে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে বাজারে গুজব ছাড়া উন্নয়নের জোয়ারের। অথচ এ সত্যটি লুকানো হয়, সরকার দলীয় চোর-ডাকাতদের উপদ্রুপে বিশ্বব্যাংক তার অনুমোদিত ঋণ গুটিয়ে নিয়ে না ভাগলে আজ থেকে ৫ বছর আগেই কম খরচে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়ে যেত। এবং ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চলতো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণই শুধু নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথেও শেখ হাসিনার স্বৈর-সরকার যে কতবড় বাধা সেটি কি বুঝতে এরপরও কিছু বাঁকি থাকে? ১৩/০৮/২০১৮ Tweet:@drfmkamal; facebook.com/firozkamal
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018