বাংলাদেশে ভারতীয় প্রকল্প এবং চ্যালেঞ্জের মুখে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ (দুই)
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 27, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ভারতীয় অধিকৃতি এবং শয়তানী প্রকল্প
কম্যুনিজম নিয়ে বাঁচার জন্য অবশ্যই কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র চাই। তেমনি পুঁজিবাদ নিয়ে বাঁচার জন্য চাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে যেমন কম্যুনিজম নিয়ে বাঁচা যায়না, তেমনি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে পুঁজিবাদ নিয়ে বাঁচা যায়না। কম্যুনিস্টগণ তাই রাশিয়া, চীন ও কিউবার বুকে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তির ফলে সে ভূমিতে বিলুপ্ত হয়েছে কম্যুনিজমও। একই কারণে ইসলামী রাষ্ট্র না থাকাতে বাঁচেনি নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত সে কুর’আনী ইসলাম -যাতে ছিল শরিয়তী আইনের বিচার, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব,শুরা ভিত্তিক শাসন, প্যান-ইসলামিক মুসলিম ঐক্য এবং দুর্বৃত্তির নির্মূলে ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ। কিন্তু আজ এর কোনটিই বেঁচে নাই। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্র না থাকলে এগুলি বাঁচাবে কে? ইসলামশূণ্য স্বৈরাচারী শাসকগণ?
ইসলাম নিয়ে বাঁচার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র এতোই অপরিহার্য যে, নবীজী (সা:)কে একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠ দিতে হয়েছিল। সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায় অর্ধেকের বেশী সাহাবাকে শহীদ হতে হয়েছিল। সে রকম একটি তাড়না নিয়েই উপমহাদেশের মুসলিমগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। এজন্যই মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল: পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অর্থাৎ মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইনের প্রতিষ্ঠা। তবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাঝে কাফিরগণ নিজেদের মৃত্যুর ভয় দেখে। ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ রুখতে পারিনি বলেই নবীজী (সা:)’র আমলের পারস্য সাম্রাজ্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায় দু’টি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত এবং বিলুপ্ত হতে হয়েছে। সে ভয়টি দেখা যায় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদেরও। এজন্যই তারা চায়নি, পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হোক। বাংলাদেশকে নিয়েও তাদের একই নীতি। তারা চায় না বাংলাদেশও একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হোক। কারণ, কোন দেশ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণ হলে সে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক স্রেফ নাগরিক থাকে না, সার্বক্ষণিক মোজাহিদে পরিণত হয়। তখন সমগ্র দেশ ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়। প্রতিটি নাগরিক তখন একাত্ম হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে। তখন জিহাদ তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। সেরূপ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয়া মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায় -সে ওয়াদা বার বার দেয়া হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। তখন সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় ফিরেশতারা নেমে আসে। নবীজী (সা:)’র আমলে সেটি বার বার দেখা গেছে। ইসলামী রাষ্ট্র তখন অপারেজয় হয়।
শয়তান ও তার অনুসারীগণ এ বিষয়টি ষোল আনা জানে। এজন্যই কোন দেশে মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা বন্ধ করা শয়তানের এজেন্ডা নয়, বরং তার এজেন্ডা হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে যে কোন মূল্যে প্রতিহত করা। এটিই বাংলাদেশের বুকে ভার তের এজেন্ডা। এজন্য ভারতের একাত্তরের যুদ্ধটি স্রেফ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল না, সেটি ছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধেও। ভারতের সে যুদ্ধটি আজও বাংলাদেশে দেখা যায়। এজন্যই ইসলামপন্থীদের শাপলা চত্বরে গণহত্যার শিকার হতে হয়, ফাঁসিতে ঝুলতে হয়, রাজপথে লগি বৈঠার সন্ত্রাসে মারা যেতে হয় এবং দলে দলে কারাবন্দী হতে হয়। ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্যই ভারত ১৯৭২ সালে তার সেনা বাহিনীকে তুলে নিলেও তুলে নেয়নি সিভিল পোষাকধারী হাজার হাজার এজেন্টদের। বরং বাঁচিয়ে রেখেছে তার রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও কৌশলগত অধিকৃতি। ভারতীয়দের বিজয় দেখা যায় বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, শিক্ষানীতি ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলির দিকে নজর দিলে।
ভারতীয়দের অধিকৃতির কারণেই বাংলাদেশের সংবিধান হলো একটি নির্ভেজাল শয়তানী প্রকল্প -যা শয়তানের পৌত্তলিক অনুসারীগণ শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদের দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। শয়তানের এজেন্ডাই বাংলাদেশের সংবিধানের এজেন্ডা। এ সংবিধানের মূল লক্ষ্য, বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করা। সে সাথে এ মুসলিম ভূমিতে মুসলিম শক্তির উত্থান এবং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সকল সম্ভাবনাকে নির্মূল করা। তারই প্রমাণ হলো, ক্ষমতায় এসেই শেখ মুজিব যুদ্ধ শুরু করেন ইসলামপন্থী সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তিনি নিষিদ্ধ করেন সকল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে। এবং কারাবন্দী করেন সেসব রাজনৈতিক দলের সকল নেতাদের। শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিম জনসংখ্যার এ দেশটিতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কোন দল প্রতিষ্ঠা পেলে – সে দলকে সংবিধান-বিরোধী আখ্যায়ীত করে তার নিবন্ধন ত্বরিৎ বাতিল করা হয়; এভাবে কেড়ে নেয়া হয় সে দলের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার।
শেখ মুজিব বিচার বহির্ভুত মানব হত্যা (যেমন সিরাজ শিকদার হত্যা), গণতন্ত্র হত্যা, নির্বাচনে ব্যালট ডাকাতি, ভারতের স্বার্থসেবা, দুর্বৃত্ত প্রতিপালন, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির ন্যায় বহু গুরুতর অপরাধের নায়ক। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধই হলো শেখ মুজিবের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। কারণ তাঁর সে যুদ্ধটি ছিল মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। সেটি ছিল সর্বশক্তি মহান প্রতিপালকের আযাবে ডেকে আনার অপরাধ। পাকিস্তান আমলে দ্বীনিয়াত নামে একটি বই স্কুলে পড়ানো হতো -তাতে ছিল ইসলামের বুনিয়াদী আক্বীদাগত বিষয়। শেখ মুজিব সেটি পড়ানো বন্ধ করে দেন। বেতার কেন্দ্রগুলি থেকে বিসমিল্লাহ ও কুর’আন পাঠের বলে প্রগ্রাম শুরু করা হতো -সেটিই মুজিব বন্ধ করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে কুর’আনের আয়াত “ইকরা বিসমে রাব্বিকাল্লাযী খালাক” লেখা থাকতো সেটিও তিনি বিলুপ্ত করেন। জাহাঙ্গির নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ -এধরণের যে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে মুসলিম ও ইসলাম নাম জড়িত ছিল সে নামগুলিও বিলুপ্ত করেন। মুজিব মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বল্লেও তিনি নিরপেক্ষ থাকেননি। তাঁর যুদ্ধটি ছিল মূলত ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে। কারণ তার মদদদাতা ভারত সেটিই চাইতো। তাই শেখ মুজিব ইসলামপন্থীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেলেও পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার দিয়েছেন নাস্তিক কম্যুনিস্টদের। ইসলামবিরোধী সেসব বামপন্থী দলগুলির হাতে তুলে দেন অবাঙালিদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া বহু দফতরি স্থাপনা। । মুজিবের শুরু করা সে যুদ্ধটি শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শুধু বেঁচেই নেই বরং তীব্রতর হয়েছে।
বিজয় বেঈমানীর রাজনীতির
রাজনীতির মধ্যেই প্রকাশ পায় ব্যক্তির বিশ্বাস (faith, philosophy and ideology) এবং তাঁর বাঁচার লক্ষ্য, ভিশন ও মিশন। ঈমানদার ও বেঈমানের বিশ্বাস কখনোই একই রূপ হয়না। ফলে একই রূপ হয় না উভয়ের জীবন-লক্ষ্য, ভিশন ও মিশন। সে ভিন্নতা প্রকট ভাবে ধরা পড়ে ঈমানদারের ও বেঈমানের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে। ঈমানদারের জীবনে সার্বক্ষণিক তাড়না থাকে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর হওয়ার। লক্ষ্য হয়, তাঁর মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করা। সে তাড়নার কারণেই সে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার লড়াইয়ে নামে। সে বিরামহীন লড়াইটি দেখা যায় তাঁর রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে। তাঁর অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো সে লড়াই। কিন্তু বেঈমানের জীবনে সে তাড়না থাকে না। আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে সে লড়াইও থাকে না। ফলে বেঈমানের রাজনীতি ঈমানদারের রাজনীতি থেকে অবশ্যই ভিন্নতর হয়। তেল ও পানি যেমন মেশে না, তেমনি মেশে না বেঈমানের রাজনীতির সাথে ঈমানদারের রাজনীতি। সেটি যেমন নবীজী (সা:) আমলে দেখা গেছে, তেমনি দেখা যায় আজও।
বেঈমান তার বেঈমানীতে সব সময়ই আপোষহীন হয় -সেটিই শয়তান ও তার অনুসারীদের নীতি। তাই কোন বেঈমানই মুসলিমদের সাথে একতা গড়তে কখনোই ঈমানদার হয়না।। বরং উল্টোটি ঘটে। ঈমানদারকে বেঈমান হতে হয় তাদেরকে খুশি করতে ও তাদের সাথে একতা গড়তে। তখন ইসলাম থেকে দূরে সরা মুসলিম নামধারী সে বেঈমানের রাজনীতিতে ইসলামের প্রতি কোন অঙ্গীকার দেখা যায় না, বরং সে কাফিরদের সাথে একাত্ম হয়ে লড়াইয়ে নামে সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও কম্যুনিজমের ন্যায় হারাম মতবাদের পক্ষে। এমন ব্যক্তিগণ হিন্দুত্ববাদীদের এজেন্ডা পূরণে মুসলিম শক্তির বিনাাশে নামে। কাফিরদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুসলিমদের হ্ত্যা করাও তাদের কাছে গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একাত্তরের যুদ্ধে মুসলিম নামধারী সেক্যলারিস্ট বাঙালিদের জীবনে তো সেটিই দেখা গেছে। তাতে বিজয়ী হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের সাথে বেঈমানীর রাজনীতি। এবং আজও তা নিয়ে বিজয়ের উৎসব দেখা যায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী শিবিরে।
লক্ষণীয় হলো, ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলার বাঙালি মুসলিমদের সাথে একতা গড়তে কোন হিন্দুই তার হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা পরিত্যাগ করে না। এবং কোন নাস্তিকও তার নাস্তিকতা ছাড়ে না। সেটি ভারতীয় কংগ্রেসে যোগদানকারী হিন্দুদের জীবনে দেখা গেছে তেমনি দেখা এজন্যই যখন কোন মুসলিম নামধারী ব্যক্তিকে হিন্দুত্ববাদীদের সাথে একই রাজনৈতিক শিবিরে একাত্ম হতে দেখা যায় -তখন বুঝতে হবে সে মুসলিম নামধারী ব্যক্তিটি ইসলামের উপর আর টিকে নাই। সে তার পূর্বের বিশ্বাস থেকে সরে গেছে। সেরূপ সরেছিলেন শেখ মুজিব ও তার অনুসারীগণ। সেরূপ না সরলে শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীগণ কখনোই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এতো প্রিয় হতে পারতেন না। ইসলামে অঙ্গীকার আছে এমন কোন মুসলিমকে ক্ষমতায় বসাতে কোন কাফির সেনাবাহিনী কোন কালেই কোন যুদ্ধ করেনি; ১৯৭১’য়েও করতো না। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, একাত্তরের ৯ মাসের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী নিজ শক্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা বা মহকুমা দূরে থাক একটি থানাও মুক্ত করতে পারিনি। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনাবাহিনীকের পরাজিত করে মুজিবের হাতে তুলে দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।
জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও আঞ্চলিকতার রাজনীতিতে ইসলামকে বিজয়ী করার কোন অঙ্গীকার থাকেনা। অথচ ব্যক্তির প্রতিটি সামর্থ্যই হলো মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া আমানত। সে আমানতের খেয়ানত হয় যদি সেটির বিনিয়োগ হয় এমন রাজনীতিতে যে রাজনীতির লক্ষ্য ইসলামকে বিজয়ী করা নয়, বরং হারাম মতবাদকে বিজয়ী করা। আর আমানতের খেয়ানতকারীকে নবীজী (সা:) মুনাফিক বলেছেন। এজন্যই ইসলামে অঙ্গীকারহীন রাজনীতিতে একজন হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, কম্যুনিস্ট ও নাস্তিক মনের আনন্দে অংশ নিতে পারে, কিন্তু যার মনে সামান্যতম পরিমাণ ঈমান আছে সে কি অংশ নিতে পারে? অংশ নিলে সে কি মুসলিম থাকে? মুসলিমের রাজনীতিতে কি কখনো সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ববাদ গুরুত্ব পায়? ঈমানদারের রাজনীতি তো পবিত্র জিহাদ -তথা সর্বোচ্চ ইবাদত। এ রাজনীতির মূল এজেন্ডা হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয়া। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে নিরাপত্তা পায় মুসলিমদের জান, মাল ও ইজ্জত-আবরু। সে জিহাদের রাজনীতি দেখা গেছে নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের জীবনে। অথচ সেক্যুলার রাজনীতিতে অংশ নেয়ার অর্থ, ইসলামের শত্রু শিবিরে শরীক হওয়া। তখন যুদ্ধ শুরু হয় ইসলামী রাষ্ট্র এবং শরিয়তী বিধান প্রতিষ্ঠার প্রতিরোধে। তেমন একটি যুদ্ধ দেখা যায় বাংলাদেশের সেক্যুলার শিবিরে।
কুর’আন থেকে দূরে সরানোর স্ট্রাটেজী
মুসলিম উম্মাহর শক্তির মূল উৎস, ওহীর জ্ঞানপুষ্ট দর্শন। নবীজী (সা:)’র যুগে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজের শুরু এখান থেকেই। দর্শনের বলের কারণেই আফগান মুসলিমগণ পরাজিত করেছে ব্রিটিশ, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় তিনটি বিশ্বশক্তিকে । দর্শনের সে বলের কারণেই প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ পরাজিত করেছিল রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে। একই কারণে ক্ষুদ্র হামাস বাহিনী ৬ মাসের বেশী যুদ্ধ করে যাচ্ছে অত্যাধুনিক ইসরাইলী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পৌত্তলিক ভারত শক্তিশালী নয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিক ভারতের একমাত্র বিজয়টি ছিল ১৯৭১’য়ে; এবং সেটি পৌত্তলিকদের পক্ষে বাঙালি মুসলিমের অস্ত্র ধরার কারণে। ভারত সেটি বুঝে। তাই ভারত চায়, শক্তির মূল পাওয়ার হাউস তথা কুর’আন থেকে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করতে।
পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানদানের কাজটি বন্ধ হলে মৃত্যু ঘটে ঈমানের। পানি ছাড়া যেমন ফসল বাঁচে না, তেমনি কুর’আনী জ্ঞান ছাড়া ঈমান বাঁচে না। তখন ঈমানশূণ্য সে ব্যক্তিটি বাঁচে কেবল নামেমাত্র মুসলিম রূপে। কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতা থেকেই ঈমানশূণ্যতার জন্ম; তেমনি ঈমান শূণ্যতা থেকে জন্ম জিহাদশূণ্যতার। এ পথ বেয়েই মুসলিম জীবনে বিপর্যয় ও পরাজয় আসে। এ জন্যই বাংলাদেশের ন্যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রে পতনের সেরূপ একটি প্রক্রিয়া বলবান করাই হলো ভারতের মূল এজেন্ডা। এবং সে ভারতীয় এজেন্ডা পূরণে শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীগণ কাজ করেছিল অনুগত কলাবোরেটর তথা সহযোগী রূপে। এখন সে অভিন্ন কাজটি করছে শেখ হাসিনার ও তাঁর অনুসারীগণ। শেখ মুজিব বাঙালি মুসলিমদের ইসলামশূণ্য করার কাজটি করেছিল শিক্ষাঙ্গণ, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণ ও মিডিয়া থেকে ইসলামকে বিদায় দেয়ার মধ্য দিয়ে। সত্যকে দমাতে এবং মিথ্যাকে গ্রহণযোগ্য করতে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয় রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদের। বন্ধ করা হয় ইসলামপন্থীদের কথাবলা, বই লেখা ও প্রকাশনাকে। সে সাথে প্লাবন আনা হয় কলকাতা থেকে প্রকাশিত সেক্যুলার ও হিন্দুত্ববাদী সাহিত্যের। এজন্যই ১৯৪৭, ১৯৫২ এবং ১৯৭১ নিয়ে বাংলাদেশীদের চেতনালোকে যে বয়ান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটি হলো ভারতসেবী আওয়ামী বাকশালীদের সত্য বিবর্জিত বয়ান।
ভারত কই’য়ের তেলে কই ভাজছে
বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রোধে ভারত “কই’য়ের তেলে কই ভাজা”র নীতি গ্রহণ করেছে। এটিই হলো ভারতের একাত্তরের নীতি। তার প্রমাণ, বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের পক্ষে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রোধে যারা যুদ্ধ লড়ছে -তারা কেউই ভারতীয় নাগরিক নয়; তারা বাংলাদেশী। এরা হলো ইসলাম থেকে বহু দূরে সরা সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, কম্যুনিস্ট, সোসালিস্ট ও নাস্তিক। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো এদের কাছে অপরাধ। এমনকি ভারতের নিহত, ধর্ষিতা ও নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কথা বলাটিও তাদের কাছে অপরাধ। সেটিকে তারা একাত্তরের চেতনা বিরোধী রাজাকারের চেতনা বলে অভিহিত করে। তাদের কাছে প্রগতিশীলতা হলো এসব বিষয়ে প্রতিবাদ না করা। নিরস্ত্র মুসল্লীদের বিরুদ্ধে শাপল চত্বরে যারা গণহত্যা ঘটালো, ইসলামপন্থী নেতাদের যারা ফাঁসিতে চড়ালো, যাদের হাতে শত শত আলেম আজও কারাবন্দি, যারা পবিত্র কুর’আনের তাফসির ও জিহাদের বই নিষিদ্ধ করে -এরাই হলো একাত্তরের চেতনাধারী সৈনিক। একাত্তরে এরাই ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। একাত্তরের ন্যায় আজও ভারতীয়দের সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে একই যুদ্ধ লড়ছে। ভারতে ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে, সে অভিন্ন নৃশংতা চালানো হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করতে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো ভারত জরুরি মনে করে। কারণটি বোধগম্য। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বাঁচলে জনগণের ভোটেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা পাবে, সে লক্ষ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে না। গণতন্ত্র থাকাতেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে সশস্ত্র যুদ্ধ লড়তে হয়নি। ভারত সেটি বুঝে। তাই গণতন্ত্রের সে শান্তিপূর্ণ পথটি ,রোধ করতেই বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন ভোট ডাকাতি হয়ে যায়। এবং নির্বাচনে যারা নামতে চায় তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে কারাগারে তোলা হয়। এবং যেসব ইসলাামী দল ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে কথা বলে তাদেরকে সংবিধান বিরোধী আখ্যায়ীত করে নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়। ভারতের জন্য প্রচণ্ড সুবিধা হলো সাধারণত ভারতীয়দের চেয়ে অধিক ভারতীয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করছে। এরাই বাংলাদেশে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গণ থেকে ইলিয়াস আলী ও আবরার ফাহাদের মত দেশপ্রেমিকদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করছে।
পরিত্যক্ত হয়েছে নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত
নবীজী (সা:) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন; এবং ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। নবী (সা:)’র জীবনের এবং ইসলামের সমগ্র ইতিহাসের এটি এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুসলিমগণ যে ভাবে বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা পেল, মুসলিমদের জান,মাল ও ইজ্জত যে কারণে নিরাপত্তা পেল এবং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে যেরূপ দ্রুত প্রসার পেল -তার মূলে ছিল নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র। সেদিন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না পেলে এসবের কোনটিই অর্জিত হতো না -যেমন আজ হচ্ছে না। তাই যারা নবীজী (সা:)’র সূন্নতের পূর্ণ অনুসরণ চায় এবং পালন করতে চায় পূর্ণ ইসলাম -তাদের জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদও এসে যায়। নইলে পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজটি হয়না। কিন্তু নবীজী (সা:)’র সে সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নতটি পালনে আগ্রহ হারিয়েছে শুধু সাধারণ মুসলিমগণই নয়, এমনকি আলেমগণও।
উপমহাদেশের মুসলিমদের জীবনে নবীজী (সা:)’র সে সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নতটি পালনের এবং ইসলামের মূল এজেন্ডা নিয়ে বেড়ে উঠার সবচেয়ে বড় সুযোগটি আসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর এমন একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ছিল। পাকিস্তান আন্দোলন চলা কালে মুসলিম লীগের স্রোগান ছিল, পাকিস্তানের কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। সে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানকে একটি ইসলামী আদর্শিক রাষ্ট্র বানানো। এবং লক্ষ্য ছিল, ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ভিত্তিক চেতনার উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামিক চেতনাভিত্তিক একটি ইসলামী জনকল্যাণ মূলক ( welfare) রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
কিন্তু উপমহাদেশের মুসলিমদের পাকিস্তন প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যায়। ব্যর্থতার কারণ যেমন পাকিস্তানের ঘরের শত্রু, তেমনি বিদেশী শত্রু। এ ব্যর্থতা যেমন দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের, তেমন আলেম, বুদ্ধিজীবী ও জনগণের। তারা পাকিস্তানে গুরুত্বই বুঝতে পারিনি। অথচ উসমানিয়া খেলাফতের ধ্বংসের পর পৃথিবী পৃষ্ঠে একটি civilisational state রূপে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর এটিই ছিল সর্বশেষ সুযোগ। ভারত, ইসরাইল ও সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় ইসলামের চিহ্নিত শত্রুগণ পাকিস্তানীদের সে সুযোগ দিতে রাজী ছিল না। রাজী ছিল না জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম ও সেক্যুলারিজমের স্রোতে ভেসে যাওয়া ঘরের শত্রুগণও। এরাই দেশটির বিনাশে ভারতের সাথে কোয়ালিশন গড়ে। একাত্তরে তারাই বিজয়ী হয়।
আলেমদের ব্যর্থতা
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি আলেমদের। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি ছিল তাদেরই। তারাই তো মুসলিম উম্মাহর ইঞ্জিন। কিন্তু সে ইঞ্জিন সঠিক কাজ দেয়নি, বরং ধর্মের নামে মুসলিমদের ভূল পথে নিয়েছে। সেটি রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিজ্ঞানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের অজ্ঞতার কারণে। এবং তাদের সে অজ্ঞতার কারণ, দ্বীনী মাদ্রাসাগুলিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলিতে জ্ঞানদানের কোন ব্যবস্থাই নাই। এরই ফল হলো, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে বসবাসের বিপদ এবং পাকিস্তানের প্রয়োজনীয়তা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা আল্লামা ইকবাল, মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় মুসলিমগণ যতটা সহজে বুঝতে পেরেছিলেন তা দ্বীনী মাদ্রাসায় লেখাপড়া আলেমগণ বুঝতে পারেনি। এটি তাদের শিক্ষাগত অপূর্ণতা ও ব্যর্থতার দলিল। ইসলামে তাই শুধু কুর’আন-হাদীস শিক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিজ্ঞানের ন্যায় বিষয়গুলি থেকে শিক্ষা নেয়া। নইলে ভয়ানক ভূল হয় রাজনীতির অঙ্গণে। আলেমদের সে ভয়ানক ভূল যেমন ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধীতার মধ্যে দেখা গেছে, তেমনি ১৯৭১’য়ে দেখা গেছে দেশটির সুরক্ষায় তাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার মাঝে।
দক্ষিণ এশিয়ার বুকে আলেমদের বশীর ভাগই হলো দেওবন্দী ফেরকার। পরিতাপের বিষয় হলো, দেওবন্দী আলেমদের সবচেয়ে বড় অংশটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই চায়নি। মাওলানা হোসেন আহমেদ মাদানীর নেতৃত্বে তারা যোগ দেয় হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বাধীন কংগ্রসী শিবিরে। মনযোগী হয় অখণ্ড ভারত নির্মাণে। তাদের অনেকে মনে করে, অখণ্ড ভারত নির্মিত হলে তারা আবার ফিরে পাবে হারানো মুসলিম শাসন। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে সে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় সব সময়ই থাকবে হিন্দুগণ। তখন অসম্ভব হবে আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া। অসম্ভব হবে বিদ্যালয়ে কুর’আন শিক্ষাদান। এবং অসম্ভব হবে দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জিহাদ। প্রশ্ন হলো, এগুলি না হলে কি পূর্ণ ইসলাম পালন হয়? তখন বাঁচতে হয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির সৃষ্ট রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জোয়ারে ভেসে। আজকের ভারত তো তারই দৃষ্টান্ত। ভারতীয় মুসলিমগণ আজ সেখানে হিন্দুত্ববাদী গুন্ডাদের হাতে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭’য়ের আগে ভারতে হিন্দু শাসনের বিপদ সম্মন্ধে যা বলেছিলেন, আজকের ভারতে তো সেগুলিই হচ্ছে। একারণেই পূর্ণ ইসলাম পালনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। কাফিরদের অধিকৃত রাষ্ট্রে পূর্ণ ইসলাম সম্ভব যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হলো জান ও মালের নিরাপত্তা নিয়ে বাঁচা। সে বিপদ থেকে বাঁচতেই অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো সে রাষ্ট্র থেকে হিজরত করা।
দেওবন্দী আলেমদের আরেক গুরুতর অপরাধ হলো, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ থেকে দূরে সরাতে তারা তাবলিগ জামায়াতের জন্ম দিয়েছে। তাবলিগ জামায়াতের কাছে মুসলিমদের নামাজের দিকে ডাকা গুরুত্ব পায়, কিন্তু তারা পূর্ণ ইসলামের দিকে ডাকে না। পূর্ণ ইসলামের দিকে ডাকলে তো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদের দিকেও তারা ডাকতো। শরিয়তী আইনের বিচারের দিকেও গুরুত্ব দিত। এমন কি তাদের বৈঠকে কুর’আন থেকে পাঠ না করে ফাজায়েলে আমলের ন্যায় এক বই থেকে পাঠ করে শুনায়। তাদের অপরাধ তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমদের ইসলামের মূল এজেন্ডা থেকে দূরে সরাচ্ছে।
পরিতাপে বিষয় হলো, আলেমগণ যে ইস’লাম পালন করে, সে ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ নাই। আদালতে শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠাও তাদের এজেন্ডা নয়। তাদের কাছে নবীজী (সা:)’র বহু ছোট খাটো সূন্নত গুরুত্ব পেলেও গুরুত্ব পায়নি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের ন্যায় সবচেয়ে বড় সূন্নতটি। তারা বরং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ এবং সেসব মসজিদ-মাদ্রাসায় ইমাম, মোয়াজ্জিন ও শিক্ষকের চাকুরি পেলেই খুশি। এবং সে কাজে লেগে থাকাকেই তারা ইসলামের সবচেয়ে বড় খেদমত মনে করেন। রাজনীতির ন্যায় জিহাদের ময়দান তারা খালি ছেড়ে দিয়েছেন ইসলামের শত্রু পক্ষের হাতে। তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই মুসলিম দেশগুলি অধিকৃত হয়ে গেছে শত্রুপক্ষের হাতে। ফলে যে জিহাদে নবীজী (সা:) আহত হলেন এবং অর্ধেকের বেশী সাহাবী শহীদ হলেন -তাদের জীবনে সে জিহাদ দেখা যায়না।
পাকিস্তান কেন ব্যর্থ হলো?
ইসলামী রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পাকিস্তানের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, দেশটির ইসলামী চেতনাশূণ্য জনগণ। জনগণের সে ব্যর্থতার মূল কারণ, তাদের শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা। তারা নিজেরাই ব্যর্থ হয়েছে পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে। ফলে তারা কিরূপে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিবে? তারা ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের ও দেশের শত্রুদের চিনতে। ফলে নিজেদের ভোটে তারা নির্বাচিত করেছে গণতন্ত্রের খুনি ফ্যাসিস্টদেরকে। নবীজী (সা:)’র যুগে সাধরণ মুসলিমদের মাঝেও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ, সে রাষ্ট্রের সুরক্ষা, আদালতে শরিয়তের প্নতিষ্ঠা এবং প্রশাসনে ইসলামের সমাজ কল্যাণমূলক নীতির প্রয়োগে বিপুল আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেরূপ আগ্রহ পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক দূরে থাক, বড় বড় আলেমদের মাঝেও ছিলনা। আগ্রহ না থাকার কারণে তারা রাজনীতির ময়দানে নামেননি। ফলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটি তাদের চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন এর আগে ধ্বংস হয়েছে উসমানিয়া খেলাফত।
ঝড়ে ঘর ভেঙ্গে গেলে পরিবারের নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাসহ সবাই নিরাপত্তা হারায়। আর মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙ্গে গেলে নিরাপত্তা হারায় মুসলিম উম্মাহ। মুসলিম উম্মাহ আজ প্রতিরক্ষাহীন, ইজ্জতহীন ও স্বাধীনতাহীন তো শক্তিশালী রাষ্ট্র না থাকার কারণে। তাই ইসলামে ইবাদত শুধু মজবুত গৃহ নির্মাণ নয়, বরং সর্বোচ্চ ইবাদত হলো শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণ। নবীজী (সা:)’র মহান সাহাবাগণ নিজেদের অর্থ, শ্রম ও রক্তের সবচেয়ে বড় কুরবানী পেশ করেছেন এ ইবাদতে। কিন্তু বাঙালী মুসলিমদের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ এ ইবাদতটি গুরুত্ব পায়নি। নবীজী (সা)’র আমলে রাজনৈতিক এ ইবাদত মসজিদে নববীর মেঝেতে বসে হয়েছে। মসজিদই ছিল তখন প্রশাসনিক কেন্দ্র। এছাড়া আর কোন দফতরই ছিল না। বিদেশী দূতগণ সেখানে এসে নবীজী (সা:)’র সাথে দেখা করতেন। অথচ আলেমগণ এ পবিত্র ইবাদতকে দুনিয়াদারী বলে মসজিদে তার চর্চাকে নিষিদ্ধ করেছে।
পাকিস্তানের ঘরের শত্রুদের সংখ্যাটি ছিল বিশাল। সরকারের গভীরে (deep state) ছিল ব্রিটিশদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উগ্র সেক্যুলার আমলা বাহিনী, সেনাবাহিনী ও আদালত বাহিনী। ইসলামের প্রতি এবং পাকিস্তানের প্রতি এসব সেক্যুলারিস্টদের কোন দরদ ছিলনা। মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা ও ইজ্জতের সুরক্ষা নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ বা ভাবনা ছিলনা। তারা পরিচালিত হতো নিছক নিজ স্বার্থ হাছিলের নেশায়। ক্ষমতাসীন স্বার্থান্বেষী মহল রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে লুটপাটের হাতিয়ার রূপে। পাকিস্তানকে সুরক্ষিত করা তাদেরও এজেন্ডা ছিল না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে ছিল না ইসলামী চেতনা-সমৃদ্ধ যোগ্য নেতৃত্ব। ছিল না চেতনায় পুষ্টি জোগানোর মত জ্ঞান-সমৃদ্ধ ইসলামী সাহিত্য। আল্লামা ইকবালের পর দেশটিতে আর কোন দ্বিতীয় ইকবাল জন্মায়নি। এ বিচারে বাংলা ভাষার দৈন্যতাটি ছিল আরো প্রকট। এ ভাষায় কোন কালেই কোন ইবকাল জন্ম নেয়ে। বরং এ ভাষায় আধিপত্য ছিল পৌত্তলিকদের।
ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজমের ন্যায় হারাম মতবাদগুলির সবচেয়ে প্রবল জোয়ারটি শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তখন সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন থেকে আসা শুরু করে মার্কসীয় সাহিত্যের স্রোত। সে স্রোতে ভেসে যায় ঝরে পড়া পাতার ন্যায় ইসলামী জ্ঞানশূণ্য বাঙালি মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীগণ। ভেসে যাওয়া সেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ পাকিস্তানপন্থী বা ইসলামপন্থী হওয়ার বদলে ভারতপন্থী, রুশপন্থী, চীনপন্থী বা বামপন্থী যোদ্ধায় পরিণত হয়। তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা হয় পাকিস্তানের বিনাশ। তাদের সে লক্ষ্য পূরণে সাহায্যকারী রূপে আবির্ভূত হয় ভারত। ভারত সে ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৪৭ সাল থেকেই প্রস্তুত ছিল। একাত্তরের যুদ্ধে ভারত সুযোগ পায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর সামরিক অধিকৃতি স্থাপনের। এভাবেই ভারত ও ভারতপন্থীরা বানচাল করে দেয় দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন। মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া বিশাল নিয়ামত এ ভাবেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
নন্দিত হয় দেশ ভাঙ্গার কবিরা গুনাহ
মহান আল্লাহতায়ালা ইসলামী রাষ্ট্র গড়া এবং সে রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও ভূগোলে লাগাতর বৃদ্ধি আনাকে জিহাদের মর্যাদা দিয়েছেন। সে জিহাদকে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খলিফাগণ -তাদের নানারূপ চারিত্রিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও চালু রেখেছিলেন। সে জিহাদের ফলেই ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে। কোটি কোটি মানুষকে মুক্তি দেন জাহান্নামের পথ থেকে। এরূপ বিপুল সংখ্যক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো কাজ আর কোন কালেই হয়নি। তাই কোন সভ্য, বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক জনগণ কখনো রাষ্ট্র ভাঙ্গে না, বরং নিজ দেশের ভূগোলে বৃদ্ধি আনে। কারণ ভূগোল বাড়লে দেশের শক্তি, স্বাধীনতা এবং ইজ্জত বাড়ে। অপর দিকে ভূগোল ভাঙ্গলে পরাধীনতা ও অপমান বাড়ে। এজন্যই ইসলামে দেশভাঙ্গা ও বিভক্তি হারাম। সে নিষধাজ্ঞা এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে। হুকুম এসেছে একতাবদ্ধ হওয়ার। তাই হারাম হলো অকারণে এমন কি একটি গাছের ডাল ভাঙ্গা -এমন কি যুদ্ধ কালেও। কারণ এতে ক্ষতি হয় মহান আল্লাহতায়ালার এক নিরপরাধ সৃষ্টির। ফলে মুসলিমদের গৌরব যুগে অসংখ্য যুদ্ধে হয়েছে স্রেফ দেশের ভূগোল বাড়াতে, ভাঙ্গতে নয়। ভুগোল বাড়ানোর সে ধারাবাহিকতায় মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে বিশ্বময় বেড়েছে তাদের প্রভাব, সুনাম ও সুকীর্তি।
অপর দিকে মুসলিমগণ তাদের নিজ দেশের ভূগোল ক্ষুদ্রতর করার ধারাবাহিকতায় আজ শক্তিহীন, স্বাধীনতাহীন ও ইজ্জতহীন। তারা ইসলাম থেকে এতটাই দূরে সরেছে যে দেশ ভাঙ্গার কবিরা গুনাহও তাদের কাছে উৎসবের বিষয়। বাঙালি মুসলিমের জীবনে সেরূপ একটি উৎসব দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। একাত্তরে বাঙালি মুসলিমগণ যুদ্ধ করেছে দেশ ভাঙ্গতে এবং নিজ দেশের অভ্যন্তরে হিন্দুত্ববাদী শত্রুদের আনতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কখনোই সংখ্যালঘিষ্ঠদের থেকে আলাদা হয়না, বরং দেশের সংহতি বাঁচাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু সেক্যুলারিস্ট বাঙালি মুসলিমদের দ্বারা ঘটেছে উল্টোটি। তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে সংখ্যালঘু অবাঙালিদের থেকে। তারা ইতিহাস গড়েছে আরেক ক্ষেত্রে। রাজনীতির অঙ্গণ থেকে তারা দুর্বৃত্তদের না সরিয়ে বরং মুজিবের ন্যায় ফ্যাসিস্ট, গণতন্ত্রের খুনি ও ভারতপ্রেমীকে বিজয়ী করেছে। আরব মুসলিমদের জীবনে আত্মঘাতী বিভক্তি দেখা গেছে ১৯১৭ সালে। বিভক্তর হারাম পথ ধরেই আবব মুসলিমগণ ২২টি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। তারা লড়াই করেছে রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়তে, আরবদের শক্তি, ইজ্জত ও স্বাধীনতা বাড়াতে নয়। ফলে প্রায় ৪০ কোটি আরব মুসলিম লাগাতর মার খাচ্ছে ৭০ লাখ ইসরাইলীর হাতে। মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির কারণেই অধিকৃতি ও গণহত্যার শিকার কাশ্মীর, আরাকান, জিংজিয়াং’য়ের মুসলিমগণ। অধিকৃত এ মুসলিম ভূমিগুলি হলো উম্মুক্ত জেলখানা।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018