বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের স্বৈরশাসন এবং স্বৈরাচার নির্মূল প্রসঙ্গ

স্বৈর মহলে আতংক 

স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার মূল উৎসটি সন্ত্রাস। সন্ত্রাসের অর্থ, ত্রাস সৃষ্টির রাজনীতি এবং সে ত্রাসের মাধ্যমে জনগণের অধিকার হনন। স্বৈরশাসকগণ সে সন্ত্রাসে ব্যবহৃত করে যেমন দলীয় ক্যাডার বাহিনী, তেমনি দেশের পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, এমন কি দেশের আইন-আদালত।  জনগণকে সন্ত্রস্ত ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে তবে সরকার নিত্য-নতুন আইনও তৈরী করে। তবে তারা নিজেদেরকে যতই শক্তিশালী ভাবুক না কেন, সেটি বাইরের খোলস। মনের গভীরে তারা অতি দুর্বল তাদের প্রতিটি মুহুর্ত কাটে নির্মূলের ভয়ে। নিরস্ত্র জনগণের ধাক্কায় তাদের গদি যে সহজেই উল্টে পড়ে সে ইতিহাস তো আনেক। নিরস্ত্র কিশোর-বিদ্রোহেও যে তারা কতটা শিউরে উঠে -সেটি তো গত বছর (২০১৮) ঢাকার রাস্তায় দেখা গেল। সে দুর্বলতার আরো প্রমাণ মেলে সশস্ত্র সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও দলীয় গুণ্ডাবাহিনীর উপর স্বৈরশাসকদের সদা নির্ভরতা। অপর দিকে সরকার বৈধতা পায় এবং জনগণের মাঝে শক্ত ভিত্তি পায় জনপ্রিয়তার শিকড় থাকাতে সে শিকড়টি মজবুত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসাতে এরূপ গণতান্ত্রিক সরকারগুলো হলো জনগণের নিজস্ব সরকার; সে সরকারগুলিকে পাহারা দেয় খোদ জনগণ। এমন একটি নির্বাচিত সরকারকে হঠাতে যখনই কোন অশুভ শক্তি আঘাত হানে, তারা শুধু সরকারের নয়, জনগণেরও শত্রু রূপে গণ্য হয় কারণ সেরূপ হামলায় মারা পড়ে জনগণের নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতান্ত্রিক সরকারের উপর সন্ত্রাসী হামলা তাই সভ্য সমাজে বৈধতা পায় না। সমর্থণও পায় না। তাই তুরস্কের নির্বাচিত সরকারের উৎখাতে যখন সামরিক ক্যুর চেষ্টা হয় তখন জনগণের অধিকারের উপর সে ডাকাতি রুখতে হাজার হাজার জনগণ রাস্তায় নেমে আসে অনেকে কামানের গোলায় এবং টাংকের নীচে শুয়ে প্রাণও দিয়েছে। প্রতিবাদি জনগণ ক্ষমতা ছিনতাইয়ের সে অপচেষ্ঠা এভাবেই ব্যর্থ করে দেয়।

গণতন্ত্র লাশ হয় এবং জনগণের ঘাড়ে অবৈধ সরকার চেপে বসে মূলতঃ দুই ভাবে। এক). সামরিক অভ্যুত্থানে; দুই). ভোটারহীন নির্বাচনে। বস্তুতঃ দুটি পদ্ধতিই হলো, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। বাংলাদেশে জনগণের অধিকার ছিনতাই হয়েছে উপরুক্ত দুই ভাবেই। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর গণতন্ত্রকে প্রথমে কবরে পাঠান খোদ শেখ মুজিব। সেটি হয় সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করে এবং  একদলীয় বাকশালী শাসন প্রক্রিয়া চালু করে তিনি নিষিদ্ধ করেন সকল বেসরকারি ও বিরোধীদলীয় পত্রিকা। এভাবে কেড়ে নেয়া হয় জনগণের স্বাধীন ভাবে দলগড়া, কথা বলা ও পত্রিকা প্রকাশ করার সকল গণতান্ত্রিক অধিকার। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের পক্ষে বড় বড় কথা বল্লেও নিজেকে শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠিত করেন একজন ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরাচারি শাসক রূপে। এটি ছিল তার ঘোষিত ওয়াদার সাথে অতি কলংকজনক ডিগবাজি। যে কোন সভ্য সমাজেই এটি অতি নিন্দিনী বিষয়। কিন্তু ডাকাত দলে ডাকাত সর্দারের নৃশংস নিষ্ঠুরতা কখনোই নিন্দিত হয় না; বরং সেটি প্রশংসিত হয়। তেমনি বর্বর স্বৈরাচারও প্রশংসিত হয় ফ্যাসিবাদী দলে। ফলে শেখ মুজিব আওয়ামী বাকশালীদের কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর কাজটি করেন জেনারেল এরশাদ। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এ ছিল আরেক ডাকাতি। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুর সাত্তারকে হঠিয়ে এ ক্ষমতালিপ্সু দুর্বৃত্ত জেনারেল দেশের শাসন ক্ষমতা নিজ হাতে নেন তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক সন্ত্রাসী জেনারেল মঈন। এ সামরিক স্বৈরশাসক দরজা খুলে দেয় সিভিল স্বৈরাচারের; এবং তারই জের রূপে শুরু হয় শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরশাসন। ২০১৪ সালে নির্বাচনে জনগণের রায় না নিয়েই তিনি ৫ বছর অবৈধ ভাবে ক্ষমতায় থাকেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সে অবৈধ শাসনকে আবার বর্ধিত করে নেন নিরেট ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মাধ্যমে। সে ভোট-ডাকাতির প্রমাণ, নির্বাচনের আগের ব্যালট বক্স পূর্ণ করা হয় দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে। যে কোন সভ্যদেশেই এরূপ ভোট-ডাকাতি একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজাদারি অপরাধ। অথচ বাংলাদেশে সে বিচার হয়নি; বরং চলছে সে অপরাধীদেরই দুঃশাসন। উল্টো, চাকর-বাকরদের ন্যায় আদালত ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিবাদী নাগরিকদের শাস্তি দিতে।

স্বৈরশাসকের লক্ষ্য, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো নয়; বরং সেটি হলো সরকার নির্বাচনে জনগণের বৈধ অধীকারকে কেড়ে নেয়া। সেটিই সুস্পষ্ট দেখা যায়, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বচনে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকার শতকরা ৫ ভাগ ভোটারকেও ভোটকেন্দ্রে হাজির করতে পারেনি। ভোট যখন মূল্য হারায়, ভোটারগণও তখন আগ্রহ হারায় ভোট দেয়ায়। অথচ ভোট গুরুত্ব পেলে বৃদ্ধ নারী পুরুষ নানারূপ অসুস্থ্যতা সত্ত্বেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভোট কেন্দ্রে আসে এবং লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়। অথচ ভোটের সে মূল্য ভোট ডাকাতির নির্বাচনে থাকে না। সাংসদ রূপে কারা নির্বাচিত হবে -সে বিষয়টি ভোটাদের হাত থেকে ছিনিয়ে স্বৈর সরকার নিজ হাতে নিয়ে নেয়। নির্বাচন তখন প্রহসনে পরিণত হয়। ডাকাত যেমন গৃহস্থের অর্থ নিজ পকেটে পুরে, সন্ত্রাসী সরকারও তেমনি জনগণের ভোট ইচ্ছামত হাতিয়ে নেয়। এজন্যই এমন নির্বাচনকে বলা হয় ভোট ডাকাতির নির্বাচন ২০১৪ সালে নির্বাচন এতটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে যে, সরকার সংসদের ১৫৩ সিটে কোনরূপ ভোটকেন্দ্রই খোলেনি। নিজ ঘরে ডাকাতি করেছে এমন চোর-ডাকাতদের সাথে কেউই বন্ধুত্ব করে না; বরং সুযোগ খোঁঝে তাকে শাস্তি দেয়ার। চোর-ডাকাতগণও সেটি বুঝে। এজন্যই যে গৃহে ডাকাতি করে সে গৃহের মালিকের সামনে তারা যায় না। এরূপ অপরাধীগণ সাধারণতঃ নিশাচর হয়। একই অবস্থা স্বৈরশাসকদেরও। চোর-ডাকাতদের ন্যায় তাদের মনেও যে ভয়টি প্রতি মুহুর্তে বিরাজ করে -সেটি হলো গণপিটুনিতে মারা পড়ার । সেটি কল্পিত ভয় নয়, নিরেট বাস্তবতাও। চোর-ডাকাতদের ন্যায় বহু স্বৈরশাসকও যে জনগণের চপথাপ্পড়ে মারা পড়ে সেটি তো ইতিহাসের নতুন বিষয় নয়। রাশিয়ার সর্বশেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাস, লিবিয়ার মোয়াম্মার গাদ্দাফি,আফগানিস্তানের নজিবুল্লাহ  এবং রোমানিয়ার চশেস্কুর ন্যায় বহু স্বৈরশাসক তো এভাবেই মারা পড়েছে। অথচ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে পরবর্তী নির্বাচনে গদি গেলেও গণপিটুনিতে প্রাণ যায়না। বরং আরেক নির্বাচনে আবার নির্বাচনের সম্ভাবনাও থাকে। শান্তিপূর্ণ ভাবে যেমন গদিতে উঠতে পারে, তেমনি নামতেও পারেন। কিন্তু স্বৈরশাসকের ক্ষেত্রে ক্ষমতা থেকে নামাটি আদৌ নিরাপদ হয় না। কারণ, নামার সিঁড়িটি তারা নিজেরাই ধ্বংস করে দেয়। ক্ষমতা থেকে তাদেরও যে নামতে হতে পারে সে সামান্য বোধটুকুও তাদের থাকে না। অবৈধ শাসকদের জীবনে এজন্যই আসে মহা বিপদ। সে বিপদের রূপটি নিজ চোখে দেখে গেছেন শেখ মুজিব। সে ভয়ে শেখ হাসিনা এতটাই আতংকগ্রস্ত যে রাস্তায় নিরস্ত্র কিশোরদের আওয়াজেও তিনি আঁতকে উঠেন। সম্প্রতি স্কুলের কিশোর-কিশোরীদের মিছিল থামাতে হাজার হাজার পুলিশের পাশে সশস্ত্র দলীয় গুণ্ডাদের নামানোর কারণ তো সে ভয়। একই কারণে ব্যর্থ করে দেয় ২০১৮ সালের নির্বাচন।

নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের স্তরে স্বৈরশাসকদের শিকড় থাকে না। নিপাতগ্রস্ততার ভয়ে চারিদিকে তারা শুধু শত্রুই দেখতে পায় ভয়ের কারণে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তারা দেশের কারাগারগুলি পূর্ণ করে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ দিয়ে। যে বিমানে বা ট্রেনে সাধারণ জনগণ চড়ে, প্রাণভয়ে সেখানে তারা উঠে না। তারা রাস্তায় নামে পুলিশ দিয়ে রাস্তা খালি করে। এটি সত্য, স্বৈরশাসকদের নির্বাচনে হারানো যায় না হারানো যায় না অস্ত্রবলেও। কিন্তু তারপরও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যতটা স্থিতিশীলতা থাকে, স্বৈরাশাসনে সেটি থাকে না। প্রচুর পুলিশ-প্রহরা সত্ত্বেও তারা ধরাশায়ী হয় গণঅভ্যুত্থানে কারণ পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়ে আর যাই হোক গণঅভ্যুত্থান থামানো যায় না।  বিপুল অর্থ ব্যয়ে চাকর-বাকরের গোলামী কিছু দিনের জন্য কেনা সম্ভব হলেও বেশী দিনের জন্য কেনা যায় না। ফলে রাশিয়ার জার, ইরানের শাহ, ফিলিপাইনসের মার্কোস, মিশরের হোসনী মুবারক, তিউনিসার বিন আলী এবং বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদের ন্যায় অসংখ্য স্বৈরশাসকের নিপাত ঘটেছে নিরস্ত্র মানুষের গণঅভ্যুত্থানে, ভোটে নয়

 

 

শেখ হাসিনার অধীনে অসম্ভব কেন নিরপেক্ষ নির্বাচন?

ভাল কাজের সামর্থ্য থাকলেই চলে না। সে জন্য নেক নিয়েতও অতি জরুরী। মহান অআল্লাহতায়ার দরবারে আমল কবুল হয় নিয়েত অনুসারে তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চোর-ডাকাত ধনী হতে পারে কিন্তু তাদের দ্বারা মানুষের ক্ষতি ছাড়া ভাল কাজ হয়না। বিষয়টি তেমনি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা কোন হাইটেক রকেট সায়েন্স নয়। এমন কি নেপালের মত অনুন্নত দেশেও সুষ্ঠ ও নিরেপক্ষ নির্বাচন হয়। দেশের সকল দলের কাছেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও তা গ্রহণযোগ্য হয়। এমন কি বাংলাদেশের মাটিতে আজ থেকে ৬৪ বছর আগে সর্বজন সমাদৃত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। সেটি সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম লীগের জনাব নূরুল আমিন ভোটডাকাত ছিলেন না। বাকশালীও ছিলেন না। তিনি ছিল গণতন্ত্রি। যোগাযোগ ব্যবস্থা টেকনিকাল সামর্থ্যের দিক দিয়ে আজকের চেয়ে সে আমলের প্রশাসন দুর্বল হলেও সরকার প্রধানের সৎ নিয়েত ছিল। ফলে সম্ভব হয়েছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন। জনাব নূরুল আমিন হেরে গিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তার সৎ নিয়েত ছিল।

কিন্তু শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমস্যাটি হলো, তাঁর নিয়েত ভোট ডাকাতির, নিরপেক্ষ নির্বাচন নয়। তিনি প্রশাসনের কর্মচারিদের ব্যবহার করতে চান তার পক্ষে ভোট ডাকাত রূপে। ফলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব -এটি যারা বলে বেড়ায় তারা হয় হাসিনার দলীয় ভাঁড় অথবা মস্তিষ্ক বিকৃত আবাল। শেখ হাসিনার কুৎসিত মনানসিকতার সাথে যাদের সামান্যতম পরিচিতি আছে -এমন সুস্থ্য মানুষ সেটি কল্পনাও করতে পারে না। কারণ, কল্পনার জন্যও তো বিশেষ প্রেক্ষাপট লাগে। হাসিনার এজেন্ডা তো তাঁর পিতার ন্যায় বিরোধীদলমুক্ত বাকশালী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা মুজিবের আদর্শ কখনোই বহুদলীয় গণতন্ত্র ছিল না, সেটি ছিল সকল বিরোধী দল ও সকল বিরোধী মতের নির্মূল। হাসিনার গর্ব শেখ মুজিবের আদর্শ নিয়ে। ফলে বিরোধী দল ও বিরোধী মতের নির্মূল না হলে শেখ মুজিবের আদর্শের প্রতিষ্ঠা হয় কি করে? লক্ষ্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তিনি বিলুপ্ত করবেন কেন? বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন বা গুমই বা করবে কেন? মাঠে-ময়দানে মিছিল-মিটিংই বা নিষিদ্ধ করবেন কেন? ভোট-ডাকাতি কি শুধু ভোট কেন্দ্রে হয়? ডাকাতির কাজে শুরু তো জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনতাই করার মধ্য দিয়ে। এবং সেটি লাগাতর চলছে বিগত হাসিনার ১০ বছরের শাসনকাল ধরে।

হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অর্থই হলো, তাকে বিজয়ী করার ভোট ডাকাতিতে শরীক হওয়া এবং তাঁর অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া। দেশবাসীর বিরু্দ্ধে সেটি তো অমার্জনীয় গাদ্দারি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সেটিই পুণরায় প্রমাণ করলো। সে অপরাধ থেকে বাঁচতেই ২০১৪ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনে কোন সভ্য ব্যক্তি অংশ নেয়নি। সে সিদ্ধান্তটি শতভাগ সঠিক ছিল। এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ শতভাগু ভূল ছিল।  শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে ৩০০ সিটের সংসদের মাঝে ১৪৯ সিট পেলেও কি কোন লাভ হতো? তাতেও কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেত? স্বৈরশাসককে ক্ষমতায় রেখে তার নীতিতে পরিবর্তন দূরে থাক, তার গায়ের একটি পশমও খসানো যায় না এরশাদের অধীনে তাই সংসদে গিয়ে লাভ হয়নি। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে গদি থেকে নামাতে হয়েছে। সংসদে বসে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলে কি স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? এটি শিশু-সুলভ কল্প বিলাস মাত্র। যারা রাস্তায় কিশোরদের শান্তিপূর্ণ মিছিল করতে দেয় না, তারা সংসদে আওয়াজ তুলতে দিবে? সড়কের আওয়াজ তো সড়কেই হারিয়ে যায়। কিন্তু সংসদের আওয়াজ তো দেশময় ছড়িয়ে যায়। স্বৈর শাসক কি সেটি সহ্য করে?

স্বৈরশাসকের কাছে অতি অসহ্য হলো কারো মুখ থেকে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা সেটি যেমন রাজপথে তেমনি সংসদে বা মিডিয়াতে। যারা হাসিনার অধীনে সংসদে বসে আওয়াজ তোলাকে গণতন্ত্র বলে -তারা নিশ্চয়ই পরিচিত নয় হাসিনার নৃশংস মানসিকতার সাথে। সংসদে বেশী হৈচৈ করলে হাসিনার চাকর-বাকরদের হাতে জুতাপেটা বা লাঠিপেতা হয়ে সংসদের ভিতরে বা বাইরে মারা পড়াটা স্বাভাবিক। সে কাজে আওয়ামী লীগের হাত কতটা পাকা -সে প্রদর্শনী তারা অতীতে করেছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি বিজয়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক-প্রজা পার্টির সদস্য সংখ্যা আওয়ামী লীগের চেয়ে অধীক ছিল। তখন শেরে বাংলা ফজলুল হক নিজে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দল থেকেই ডিপুটি স্পীকার ছিলেন জনাব শাহেদ আলী। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের সদস্যদের গুণ্ডামী থেকে জনাব শাহেদ আলী প্রাঁণে বাঁচেননি। সংসদের মধ্যেই তাঁকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয় এবং হাসপাতালে নেয়ার পর নিহত হন। সে খুনের বিচারও খুনিরা হতে দেয়নি। এখন তো সে খুনের রাজনীতি আওয়ামী দলীয় কালচার হয়ে গেছে। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে গুম ও খুনের নৃশংসতা এখন সংসদের বাইরে চলছে, সেটি তখন সংসদের ভিতরে হবে। ফলে শাপলা চত্ত্বর সৃষ্টি হবে সংসদের অভ্যন্তরে।

বিরোধী দল ও বিরোধী মতের নির্মূলের কাজে হাসিনার চাকর-বাকর কি শুধু তাঁর দলীয় ক্যাডারগণ। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে চাকর-বাকরে পরিণত হয়েছে তো সেনাবাহিনীর সদস্যগণও। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিলুপ্ত হয়েছে দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাও। এ সন্ত্রাসীরা গৃহবন্দী করেছে এমনকি দেশের প্রধান বিচারপতিকে। এভাবে বাংলাদেশের কলংকিত ইতিহাসে যোগ করলো আরেক নতুন কলংক। সম্প্রতি হাসিনার চাকর-বাকরদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন রাস্তার কোন সাধারণ মানুষ নন, বরং দিয়েছেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শ্রী সুরেন্দ্রকুমার সিনহা। শেখ হাসিনাকে তিনি অতি কাছে থেকে দেখেছেন। এক কালে তিনি তারই দলের লোক ছিলেন। হাসিনাকে এখনো যারা পুরাপুরি চিনেনি তাদের উচিত শ্রী সিনহার লেখা এবং সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনী মূলক বই এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসিটি পড়া।

শ্রী সুরেন্দ্রকুমার সিনহা ভূমিকায় বলেছেন, সরকারের চাপ এবং হুমকির মুখে তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। কীভাবে তাকে দেশত্যাগ বাধ্য করা হয়েছে -সে বিষয়ে তাঁর বইতে থেকে কিছু তুলে ধরা যাকঃ প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের অন্যান্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাবার জন্য আমার কঠোর নিন্দা করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে বদনাম করতে শুরু করেন।’‘আমি যখন আমার সরকারি বাসভবনে আবদ্ধ, আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না, তখন সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় – আমি অসুস্থ. আমি চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি।’‘

একাধিক মন্ত্রী বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবো।’‘অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যখন আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই – তখন একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমি পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টায় একটি বিবৃতি দেই যে, “আমি অসুস্থ নই এবং আমি চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না।’‘ আমি আশা করছিলাম যে আমার প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত ছুটি – এ দুটো মিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে, এবং শুভবুদ্ধির উদয় হবে, সরকার ওই রায়ের যে মর্মবস্তু – অর্থাৎ বিচারবিভাগের স্বাধীনতা যে জাতি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকরতা বুঝতে পারবে।’‘শেষ পর্যন্ত দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা – যার নাম ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স – তাদের ভীতি প্রদর্শন এবং আমার পরিবারের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিদেশ থেকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেই।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিষয়টি নিয়ে বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। গত বছরের নানা নাটকীয় ঘটনাবলীর পর কোন গণমাধ্যমে এটিই ছিল তার প্রথম সাক্ষাৎকার। তিনি সাক্ষাতকারে বলেনআমাকে যখন পুরাপুরি হাউজ এ্যারেস্ট করা হলো, …তখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন একজন করে ডাক্তার আমার কাছে পাঠানো হতো। আমি নি:শ্বাস নিতে পারছিলাম না।’‘এর মধ্যে ডিজিএফআইয়ের চিফ এসে বললেন, হ্যাঁ আপনাকে বলা হলো আপনি বিদেশ যাবেন, আপনি যাচ্ছেন না।’‘আমি বললাম: কেন যাবো আমি বিদেশে?’‘আপনি চলে যান, আপনার টাকা পয়সার আমরা ব্যবস্থা করছি।’‘আমি বললাম, এটা হয় না, আমি আপনাদের টাকা নেবো না। আর আপনারা বললেই আমি ইয়ে করবো না। আমি চাই সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমি আলাপ করি । ব্যাপারটা কি হয়েছে আমি জানতে চাই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে কথা বলবেন না।

বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের ইমপিচ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে পার্লামেন্টের সদস্যদের দেবার পর ২০১৬ সালের ৫ই মে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়। সরকার এর বিরুদ্ধে আপীল করে, এবং সাত সদস্যের একটি বেঞ্চে আপীলের শুনানী হয়। সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বইতে লেখেন, জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ আপীল খারিজ করে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ সর্বসম্মত রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়। তিনি লেখেন, ওই সিদ্ধান্তের পর সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে – যাতে সেই রায়কে বাতিল করার জন্য আইনী পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়।

বইটি প্রকাশের পর থেকেই সরকারি দলের পক্ষ থেকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলা, তবে কি শেখ হাসিনা এরূপ পাগল-ছাগলকে বিচারপতি রূপ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিয়োগ দিয়েছেন? আরো যারা দেশের উচ্চ আদালতে ও প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ পেয়ে বসে আছে -তারা যে পাগল-ছাগল নয় -সে নিশ্চয়তা কে দিবে? ওবায়দুল কাদের যে নিজে মানসিক ভাবে সুস্থ্য -সে রায়টিই বা কোত্থেকে পাওয়া যাবে? সরকারের বিরুদ্ধে গেলেই পাগল, আর পক্ষে থাকলে সে সুস্থ্য এটি কি কোন ব্যক্তির মগজের সুস্থ্য বিচারের মানদণ্ড হতে পারে?

সম্প্রতি সরকারি দলের পক্ষ থেকে ড. কামাল হোসেনের ডিগবাজী নিয়ে বিজ্ঞাপণ ছাপা হয়েছে। অথচ মুজিব ও হাসিনার ডিগবাজিগুলি নিয়ে তারা নিশ্চুপ। মানুষ কি ভূলে গেছে মুজিবের এক ডিগবাজিতেই গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র।এবং হাসিনার ডিগবাজিতে বিলুপ্ত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি। যারা এরূপ ডিগবাজিতে পটু তারা কি নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়েও ডিগবাজি না দিয়ে পারে? এখন এটি আর কোন গোপন বিষয় নয় যে, হাসিনার মাঝে নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু নাই। যা আছে তা হলো, যে কোন রূপে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অদম্য নেশা। এরূপ নেশাতে নিরাপদ মানুষদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা, গুম করা বা কারারুদ্ধ করা -কোন ব্যাপারই নয় কোন ব্যাপার নয় ভোট ডাকাতি করা। হাসিনার সরকার বছরের পর বছর সেটি করছে। এরূপ নেশাগ্রস্তের কাছ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন একমাত্র তারাই আশা করতে পারে যারা নিজেরাও হারিয়েছে নীতি জ্ঞান ও মানসিক সুস্থ্যতা।

 

একমাত্র পথ গণঅভ্যুত্থান

স্বৈরশাসকদের হাতে থাকে ভোট-ডাকাতির সকল কলাকৌশল। সংসদের অধিকাংশ সিট দখল করা তাদের জন্য কোন ব্যাপারই নয়। ভোট ডাকাতির সে সামর্থ্য স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ যেমন প্রমাণ করেছেন, তেমনি শেখ হাসিনাও প্রমাণ করেছেন। এরজন্যই তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দিতা সুফল দেয় না। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে নেমেছে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন, জাসদ, ফ্রিডম পার্টি এবং আরো কিছু দল; কিন্তু তাতে স্বৈরাচারি শাসকের পতন দূরে থাক তার গায়ে আঁচড়ও লাগেনি। বরং তাদের অংশগ্রহণ এরশাদের অবৈধ সরকারকে দীর্ঘকাল বৈধতা দিয়েছে। এরশাদের পতন ঘটেছে গণঅভ্যুত্থানে। নির্বাচনে না গিয়ে সকল দল মিলে গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরলে এরশাদের আগেই পতন হতো। এক শৃগাল আরেক শৃগালের নিপাত চায় না। সেটি স্বৈরাচারিদের ক্ষেত্রেও। তাই হাসিনা অতীতে এরশাদের নিপাত চায়নি; একই কারণে এরশাদও আজ চায় না হাসিনার নিপাত। বরং এরশাদ যখন এক গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তখন যে দলটি তাকে স্বাগত জানায় -সেটি হলো আওয়ামী লীগ। এতে বুঝা যায় দলটির স্বৈরাচার প্রেম। আরো বাস্তবতা হলো, নির্বাচনের ন্যায় অস্ত্রবলেও স্বৈরশাসকদের হারানো যায় না। কারণ তাদের হাতে থাকে অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার। থাকে সেবাদাস চরিত্রের বিশাল প্রশাসন, ক্যাডার বাহিনী, পুলিশ ও সেনাবাহিনী। স্বৈরশাসকদের কাজ, জনগণের পকেট থেকে অর্থ নিয়ে অনুগত চাকর-বাকর প্রতিপালন। এরূপ বেতনভোগী দাসদের সাহায্য নিয়ে সিরিয়ার স্বৈরাশাসক  বাশার আল-আসাদ প্রায় ছয় লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ৬০ লাখের বেশী মানুষকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে তাড়িয়ে রিফিউজি বানিয়েছে। এবং সেটি  স্রেফ গদিতে টিকে থাকার স্বার্থে।


গদিরক্ষার কাজে প্রতিটি স্বৈরাচারি শাসকই অতিশয় বর্বর ও নৃশংস হয়। সে নৃশংস বর্বরতা বাংলাদেশের মানুষ ১০১৩ সালের ৫ মে
 ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে দেখেছে। সেটি মিশরের মানুষ দেখেছে ২০১৩ সালে কায়রোর রাবা আল আদাবিয়া ময়দানে। দুটি স্থানেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেয়া শত শত নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানব হত্যায় ট্যাংক, কামান, মেশিনগান ও ভারি গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে। রাজপথ পরিণত হয়েছে বধ্যভূমিতে। ময়লা সরানোর ন্যায় সেখান থেকে নিহতের লাশ সরানো হয়েছে। জনগণের রাজস্বে পালিত পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে সরকার এভাবে নিজেদের কুমতলব পূরণে চাকর-বাকরের ন্যায় ব্যবহার করেছে। তবে ইতিহাসের আরেক সত্য হলো, স্বৈরশাসকদের হাতে এরূপ দুর্বৃত্ত শ্রেণীর বেতনভোগী চাকর-বাকর বিপুল সংখ্যায় থাকলেও তাদের প্রকৃত বন্ধু বা আপনজন বলে কেউ নেই প্রতি সমাজেই সুযোগসন্ধানী নানারূপ দুর্বৃত্ত থাকে। তারা সহজেই স্বৈরশাসকদের চাকর-বাকরে পরিণত হয় নিছক নিজেদের সুবিধা হাছিল ও অর্থপ্রাপ্তির লোভে। এমন লক্ষ লক্ষ সেবাদাস পেয়েছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকগণও। স্বৈরশাসকদের ন্যায় এরূপ সেবাদাসদের কাছেও তাদের নিজেদের স্বার্থটাই বড়স্বৈরশাসকের স্বার্থ বাঁচাতে  নিজেদের জান দেয়াতে তাদের নিজেদের স্বার্থ যে বাঁচে না সেটি তারা বুঝে। তাছাড়া স্বৈরশাসক বাঁচানোর কাজটি জিহাদ নয় যে একাজে মরলে জান্নাত মিলবে। বরং তাতে যে জাহান্নামে যাওয়াটিই সুনিশ্চিত হয় সেটি বুঝে উঠা কি এতই কঠিন? ফলে গণঅভ্যুত্থানের বেগ দেখলে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়ান্দা বিভাগের লোকেরা স্বৈরশাসকের পাশে দাঁড়ায় না, সরকারের পক্ষ ছেড়ে দ্রুত জনগণের পক্ষে যোগ দেয়। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে জনগণের উপর গুলি চালানোর হুকুম দেয়া হলেও তাতে রাজী হয় না। স্বৈর শাসকের সে বিপদের মুহুর্তে তাদের লক্ষ্য হয়, নিজেদের পিঠের চামড়া বাঁচানো, স্বৈরশাসককে বাঁচানো নয়। এভাবে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও শুরু হয় স্বৈর-সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিশ্বের সকল স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানেই সেটি দেখা গেছে।

স্বৈরসরকারের চাকর-বাকরেরাও জানে, তাদের বেতন স্বৈরশাসক নিজের পকেট থেকে দেয় না, দেয় জনগণ। এবং বেতন দেয় যে জনগণ, তাদেকে হত্যা করা যে অমার্জনীয় অপরাধ সেটি কে না বুঝে? সে অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচতেই পরাজয় দেখলে দলে দলে স্বৈরাচারের পক্ষ ছাড়ে মোসাহেবী চরিত্রের পত্র-পত্রিকা, টিভি ও মিডিয়ার লোকজনও। গণরোষ থেকে প্রাণ বাঁচাতে এজন্যই স্বৈরশাসকদের হয় একাকী দেশ ছাড়তে হয়, নতুবা গণরোষে একাকী লাশ হতে হয়। বিপদের দিনে তাদের পাশে কেউ থাকে না। তখন লাশ মাটিতে পড়ে থাকলেও জানাজা পড়া ও দাফন করার লোক থাকে না। ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলে তাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ থাকে না। বরং এক কালের সাথীরাই উল্টো সুরে কথা বলা শুরু করে। তাই শেখ মুজিবের পতনের পরক্ষণেই এককালের আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আব্দুল মালেক উলিক বলেছিলেন, ফিরাউনের পতন হয়েছে আওয়ামী লীগের দলীয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকতার মৃত্যুতে সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ করেনি। কোন সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয়ও লেখেনি। যারা এক কালে তাকে নেতা রূপে মাথায় তুলেছিল, তাঁরাও তাঁর মৃত্যুতে কোন শোক সভা করেনি। জানাযা বা গায়েবানা জানাযাও পাঠ করেনি। স্বৈরশাসকেরা এভাবে ইতিহাসে বেঁচে থাকে গভীর ঘৃণা নিয়ে। বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরশাসকের ক্ষেত্রেও কি ভিন্নতর হবে?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *