বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ও মুসলিমদের ঈমানী সংকট

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 অধিকৃত দেশ

যুদ্ধ শুধু আগ্নেয়াস্ত্রে হয় না। স্রেফ রণাঙ্গনেও হয় না। বরং সবচেয়ে বড় ও বিরামহীন যুদ্ধটি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ময়দানে। এ যুদ্ধে হেরে গেলে পরাজয়টি তখন নীরবে ঘটে। তখন বিলুপ্ত হয় সাংস্কৃতিক পরিচয়। রণাঙ্গণের যুদ্ধ তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে গেছে এবং পোলান্ড, পূর্বজার্মান, চেকেস্লাভিয়া,ক্রয়েশিয়া, সার্বিয়া, আলবানিয়া, বুলগারিয়ার ন্যায় বহু জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত হয়েছে এবং সে সাথে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে কোন সামরিক পরাজয়ের কারণে নয়। বরং সোভিয়েত রাশিয়ার সে পরাজয়টি এসেছে সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে। এমন একটি  যুদ্ধকেই বলা হয় স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার।  এ যুদ্ধে পরাজিত হলে বিলুপ্ত হয় পরাজিত জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। বাংলাদেশে তেমনি একটি আরোপিত যুদ্ধ চলছে। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান, ডাচ, আইরিশ, স্পেনিশ, আফ্রিকান –এরূপ নানাভাষী মানুষের বসতি ছিল। কিন্তু এখন সব মিলে মিশে মার্কিনী হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে গেছে কালচারাল মেল্টিং পট। এখানে সংস্কৃতির সে মূল ধারাটি হলো গ্রীকো-রোমান সভ্যতার। ভারতে সেটি পৌত্তলিক হিন্দুত্বের।  হিন্দুত্বের সে রূপটি নিছক ধর্মীয় নয়,বরং তাতে রয়েছে সাংস্কৃতিক শক্তিও। সে শক্তির বলেই অতীতে শক, হুন, জৈন –এরূপ বহুজাতি হিন্দুত্বের সাথে মিশে গেছে। ধর্মীয় ভাবে হিন্দু না হলেও সাংস্কৃতিক ভাবে তারা হিন্দুতে পরিণত হয়। প্রতিদেশেই এভাবে বিজয়ী শক্তির হাতে নীরবে সাংস্কৃতিক কনভার্শন ঘটে। বাংলাদেশে হিন্দু ধারায় এমন সাংস্কৃতিক কনভার্টদের সংখ্যা আজ লক্ষ লক্ষ।

সাংস্কৃতিক শক্তি প্রবল বল পায় রাজনৈতিক বিজয়ের ফলে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শক্তি তখন সাংস্কৃতিক শক্তির বিকাশে দুয়ার খুলে দেয়। তখন শুরু হয় বিজয়ী শক্তির সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বস্তুত এক সফল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যেই প্রয়োজন পড়ে রাজনৈতিক বিপ্লবের। মুসলিম শাসনামলে ভারতীয় হিন্দুগণ সে শক্তি পায়নি। তাদের সে শক্তিটি বিলুপ্ত হয়েছিল মুসলিমদের রাজনৈতিক বিজয়ে। ইসলাম তখন শুধু রাজনৈতিক শক্তি রূপে নয়, প্রবল সাংস্কৃতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে শক-হুন-জৈনগণ যেভাবে হিন্দু সংস্কৃতিতে হারিয়ে গেছে, মুসলিমগণ সেভাবে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু হাজার বছর পর হিন্দুগণ ভারতে এখন সে রাজনৈতিক শক্তিটি ফিরে পেয়েছে। ফলে হিন্দুদের মাঝে জেগে উঠেছে হিন্দু আচারে সাম্রাজ্য নির্মাণের প্রেরণা। ফলে তাদের রাজনীতিতে এসেছে প্রচণ্ড সাম্রাজ্য লিপ্সা। ১৯৪৭’য়ে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৮য়ে কাশ্মীর ও হায়দারাবাদ দখল, ১৯৭১’য়ে পূর্ব-পাকিস্তানে দখল এবং ১৯৭৪ সালে সিকিম দখলের ন্যায় ঘটনা ঘটেছে একই ধারাবাহিকতায়। ১৯৭১ সালে সামরিক বিজয়ের পর তাদের সে প্রভাব-বলয়ের অধীনে এসে গেছে বাংলাদেশও। ১৯৭২’য়ে ভারতের সামরিক অধিকৃতি শেষ হলেও সাংস্কৃতিক অধিকৃতি শেষ হয়নি। বরং সেটি আরো তীব্রতর হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য মহা বিপদের কারণ. ভারতের এ সাংস্কৃতিক অধিকৃতি।

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর হিন্দুদের হাতে অখন্ড ভারতের শাসনক্ষমতা গেলে মুসলিমদের জন্য যে ভয়ানক বিপদ নেমে আসবে সেটি বহু আলেম, মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ টের না পেলেও সেটি টের পেয়েছিলেন দার্শনিক আল্লামা মহম্মদ ইকবাল। সে বিপদটি যে শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হবে না, বরং ভয়ানক রূপে নিবে সংস্কৃতির ময়দানে –তা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র সংন্দেহ ছিল না। সে বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল হিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্যের বাইরে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টি। তাঁর সে দুর্ভাবনার সে চিত্রটি ফুটে উঠে ১৯৩৭ সালের ২০ শে মার্চ কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে লেখা তাঁর এক চিঠিতে। তিনি লিখেছিলেন, “ভারতীয় মুসলিমদের মূল সমস্যাটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং বড় সমস্যাটি হলো সাংস্কৃতিক। মুসলিমদের সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান অখণ্ড ভারতের কাঠামোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু শাসনাধীনে থেকে সম্ভব নয়।” (সূত্র: জিন্নাহর প্রতি আল্লামা ইকবালের পত্রাবলী)। এ ভাবনা নিয়েই ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তানে গড়ার প্রস্তাব দেন। একজন মুসলিম তার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যকোন সমৃদ্ধ দেশে চাকুরি নিয়ে মেটাতে পারে। কিন্তু তাতে তার সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটে না। সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধানে ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে হয়। কারণ সংস্কৃতি খাদ্য-পানীয়, আলো-বাতাস, ভূমি বা জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে উঠে না। সেটি সম্ভব হলে একই ভূখন্ডে বসবাসকারি হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান ও বৌদ্ধদের সংস্কৃতি এক হতো। এখানে কাজ করে একটি দর্শন। আর সে দর্শনের পিছনে কাজ করে ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনা। সে ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র শুধু জরুরি নয়, অপরিহার্য। শত বাধা অতিক্রম করে ও বহু রক্ত ব্যয় করে এমন একটি রাষ্ট্র নবীজী (সাঃ) নিজে নির্মাণ করে সেটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

 

সংস্কৃতির শক্তি

প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতি কি? সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপদই বা কি? মানুষ যেভাবে বাঁচে সেটাই তার সংস্কৃতি। বাঁচবার মধ্যে সভ্য মানুষের জীবনে আসে লাগাতর সংস্কার, এবং সে সংস্কার থেকেই তার সংস্কৃতি। পশুর জীবনে সেরূপ সংস্কার নাই, তাই সংস্কৃতিও নাই। সেটি না থাকার কারণে হাজার বছর আগের পশুটি যে ভাবে বাঁচতো আজকের পশুটিও সে ভাবেই বাঁচে। সংস্কারের সে প্রক্রিয়াকে ইসলাম তীব্রতর করে, এখানেই ইসলামের শক্তি। সে শক্তির বলে মরুর অসভ্য মানুষগুলো ফেরেশতাতূল্য হতে পেরেছিলেন।  সমগ্র মানব ইতিহাসে আর কোন কালেই এরূপ শক্তিশালী সাংস্কৃতিক শক্তির জন্ম হয়নি। ইসলামের হাতে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক সভ্যতা গড়ে উঠার কারণ তো এটাই। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ গড়ে উঠে তো সংস্কৃতির গুণে। বিশ্বাসী মুসলিম এবং মুর্তিপুজারি হিন্দু একই লক্ষ্যে এবং একই সংস্কার নিয়ে বাঁচে না, তাই তাদের সংস্কৃতিও এক নয়। বাঙালীর হিন্দু ও বাঙালী মুসলিম একই গ্রামে বা একই মহল্লায় বাস করলেও উভয়ের সংস্কৃতি এজন্যই এক নয়। উলঙ্গ ও অশ্লিল মানুষটির মাঝে সংস্কার নেই, সে বাঁচে আদিম প্রস্তর যুগের আচার নিয়ে। ফলে তার সংস্কৃতিও নেই।

সংস্কৃতি হলো মানুষের বাঁচাকে সভ্যতর করার এক লাগাতর প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াকেই আরবী ভাষায় তাহজিব বলা হয়। এটি হলো ব্যক্তির কর্ম,রুচী,আচার-আচারণ, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সার্বিক জীবন যাপনের প্রক্রিয়ায় পরিশুদ্ধিকরণ। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ রিফাইনড হয় তথা পরিশুদ্ধি পায়। দিন দিন সুন্দরতম হয় তার রুচিবোধ, আচার-আচরণ, কাজকর্ম ও চরিত্র। মুসলিমের ইবাদত ও সংস্কৃতি -এ দুটোর মূলে হলো তার ঈমান। ঈমানের বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে তার ইবাদত ও সংস্কৃতিতে। যেখানে ঈমান নেই, সেখানে ইবাদত যেমন নাই তেমনি সংস্কৃতিও নাই্। অপরদিকে যখন ঈমানে জোয়ার আসে তখন শুধু আল্লাহ তায়ালার ইবাদতই বাড়ে না, সংস্কৃতিও সমৃদ্ধতর হয়। ঈমান শুধু তার আত্মীক পরিশুদ্ধি দেয় না,বরং পরিশুদ্ধি আনে তার রুচি, আচার-ব্যবহার, পানাহার, পোষাক-পরিচ্ছদ এবং চেতনা ও চৈতন্যে। পরিশুদ্ধি আসে তার অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও। এভাবেই মুসলিমের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে শুরু হয় উচ্চতর সংস্কৃতির নির্মাণ।

রাষ্ট্রের কাজ স্রেফ রাস্তাঘাট,স্কুল-কলেজ ও কলকারাখানা গড়া নয়। দেশ-শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনাও নয়। বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, জনগণকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচানো ও তাদেরকে জান্নাতে নেয়া। হাজার কোটি টাকা দানেও এতো বড় উপকার হয়না। এবং সে লক্ষ্যে জরুরি হলো, জনগণের ঈমান-বৃদ্ধি ও ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির নির্মাণ। সে কাজে কোর’আনী জ্ঞানের প্রসার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও পাপাচারের নির্মূল। সমাজে পাপাচার বাঁচিয়ে যেমন সমাজে সংস্কার আনা যায় না, তেমনি ব্যক্তির জীবনেও তাতে পরিশুদ্ধি আসে না। তাই মুসলিমগণ যেখানে রাষ্ট্র গড়েছে সেখানে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসাই গড়েনি, সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করেছে।এবং দূর করেছে অপসংস্কৃতিকে। এভাবে সভ্যতার নির্মাণে লাগাতর ভূমিকা রাখতে হয়েছে। নবীজী(সাঃ)র এটাই বড় সূন্নত। সাহাবাদের জানমালের সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে একাজে। এমন এক মহৎ লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের নির্মাণ উপমহাদেশের মুসলিমদের কাছে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু সেটি অনাসৃষ্টি গণ্য হয় ইসলামের শত্রুপক্ষের কাছে।

মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যদের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে কোর’আনের জ্ঞান ও আল্লাহর শরিয়তী বিধানই যে শুধু অবহেলিত হয় -তা নয়; বরং উলঙ্গতা,অশ্লিলতা এবং নাচগানের ন্যায় পাপাচারও তখন শিল্পকলা রূপে গণ্য হয়। জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য গড়া হয় শত শত পথ।  শয়তানের মিশন তখন ষোল কলায় পূর্ণ হয়। মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্য শক্তিটি মুসলিমদের হাত থেকে যে শুধু কোর’আন কেড়ে নেয় -তা নয়। বরং কেড়ে নেয় সত্যিকার মুসলম রূপে বেড়ে উঠার সকল পদ্ধতি। মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার সে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়াটিই হলো সংস্কৃতি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনগণ যেভাবে নিষ্ঠাবান মুসলিম রূপে বেড়ে উঠেছে -সেটি কি কোন মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কারণে? বরং সেটি মুসলিম রাষ্ট্রে বিদ্যমান ইসলামী সংস্কৃতির কারণে। ইসলামি রাষ্ট্র বিলুপ্ত হলে বা ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলো বিলুপ্ত হয় সে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির ময়দানে তখন শুরু হয় উল্টো স্রোত। ইসলামের শত্রুশক্তি এজন্যই ইসলাম থেকে মুসলিমদের ফেরাতে মুসলিম দেশের রাজনীতির উপর দখলদারি চায়। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির রাজনীতিতে কাফের শক্তির বিনিয়োগটি এজন্যই অধিক। আজকের বাংলাদেশ মূলত তাদের হাতেই অধিকৃত। যারা এ দেশটির শাসক তারা স্বাধীন নয়, বরং বিজয়ী বিদেশীদের পদসেবী এজেন্ট বা প্রতিনিধি মাত্র। বাংলাদেশের উপর ভারত সে বিজয়টি পেয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭২’য়ে তারা সৈন্য সরিয়ে নিলেও তাদের এজেন্টদের অপসারণ করেনি। বরং এজেন্ট প্রতিপালনে প্রতি বছর যেমন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে, তেমনি বহুশত কোটি টাকা ব্যয় করে প্রতিটি নির্বাচনে তাদেরকে বিজয়ী করতে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভারত তার আওয়ামী বাকশালী এজেন্টদের বিজয়ে যে বিপুল অর্থব্যয় করেছিল সে খতিয়ানটি দিয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা “দি ইকোনমিসস্ট”। আর এখন সে দখলদারীটি স্থায়ী করতে জনগণের ভোটের অধিকারও কেড়ে নিয়েছে।

 

শত্রু শক্তির বিনিয়োগ ও ইসলাম-বিনাশী নাশকতা

মুসলিম দেশেও অমুসলিমদের বিনিয়োগ প্রচুর। তবে সেটি অর্থনীতির ময়দানে নয়। সেটি বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির ময়দানে। সে বিনিয়োগের অর্থে বাংলাদেশের মত দেশে ফুলে ফেঁপে উঠেছে বহু হাজার এনজিও। উঁই পোকার মত এরা ভিতর থেকে শিকড় কাটে। বাংলাদেশের মুসলিমদের উপর ভারতের সে বিনিয়োগটির শুরু একাত্তর থেকে নয়, বরং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরের দিন থেকে। সে বিনিয়োগটিই প্রকাণ্ড ফল দেয় ১৯৭১ সালে এসে। বাংলাদেশের ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টদের কাছে ইসলামের প্রতি অঙ্গিকার হলো সাম্প্রদায়িকতা। সে যুক্তিটি দেখিয়ে ভারতীয় হিন্দুরা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রুখতে চেয়েছে। এখনো সে কথাটিই বাংলাদেশী সেক্যুলারিস্টগণ ভারতীয়দের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে। অথচ ভারতে উগ্র হিন্দুদের হাতে হাজার হাজার মুসলিম যে গণহত্যা ও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে এবং বিধ্বস্ত হচ্ছে মসজিদ -তার বিরুদ্ধে তারা কথা বলে না।

তাদের কাছে রাষ্ট্র নির্মাণে প্যান-ইসলামী চেতনা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি গ্রহণযোগ্য নয় ইসলামী শরিয়তের প্রতিষ্ঠাও। প্যান-ইসলামী চেতনা গুরুত্ব পেলে অবাঙালী মুসলিমগণও তো তখন বাঙালী মুসলিমের কাছে ভাই রূপে গৃহীত হয়। তখন মৃত্যু ঘটে বাঙালী জাতীয়তাবাদের হারাম রাজনীতির। আর দেশের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পেলে তো তাদের ন্যায় হারাম রাজনীতির অপরাধীদের স্থান হতো কারাগারে অথবা কবরস্থানে। কারণ, তাদের অপরাধ তো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধের। গুরুতর অপরাধ এখানে মানুষকে জাহান্নামে নেয়ার। শরিয়তী আইনে এটি হত্যাযোগ্য অপরাধ। একাত্তরের চেতনাধারিদের লক্ষ্য শুধু পাকিস্তানের ধ্বংস ছিল না। মূল লক্ষ্যটি ছিল ইসলামী চেতনার বিনাশ। লক্ষ্য ছিল যেমন জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো; তেমনি রাষ্ট্রকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো। ক্ষমতা হাতে পাওয়ায় তারা রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনিক শক্তিকে পরিণত করেছে ইসলামি চেতনা নির্মূলের হাতিয়ারে। একাত্তরের চেতনাধারিরা তাদের এ মিশনে সবচেয়ে বড় সাহায্য্যটি যে শুধু ভারত থেকে পায় তা নয়, বরং পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বিশ্বের তাবত ইসলামবিরোধী শক্তি থেকে। তাদের কাছে ইসলামের প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগই হলো মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস। তারা ইসলামের বিজয় রোধে যে কোন নৃশংস স্বৈরাচারকে মেনে নিতে রাজী আছে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্বর শাসকগণ তো বেঁচে আছে তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য নিয়েই। সেরূপ স্বৈরাচারপ্রীতির কারণেই মিশরের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রসিডেন্ট ড. মহম্মদ মুরসীকে যখন সামরিক ক্যুর মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া হলো -পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ সেটিকে সমর্থণ করতে দেরী করেনি।

যে বিশেষ এজেন্ডার উপর বিশ্বের তাবত ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে অটুট একতা সেটি হলো, মুসলিম দেশের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা। কারণ, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মধ্যে তারা একটি প্রতিপক্ষ সভ্যতার নির্মাণ দেখতে পায়। সভ্যতার সংঘাতের লড়াইয়ে এমন একটি শক্তিতে তারা নিজেদের প্রতিপক্ষ গণ্য করে। সভ্যতার এ লড়াইয়ে যারাই ইসলামের বিপক্ষে তারাই তাদের মিত্র। আওয়ামী বাকশালীরা তো এজন্য ভারতীয় শাসকচক্রের এত কাছের। ইসলামের বিজয় রুখতে তারা জনগণকে তাদের সৃষ্ট পাপাচারের জোয়ার ভাসিয়ে নিতে চায়। সেটিকে তারা বলে আধুনিকতা। এজন্যই সেক্যুলার সরকারগুলোর এজেন্ডা সুনীতির প্রতিষ্ঠা যেমন নয়, তেমনি পাপাচারের নির্মূলও নয়। নর্দমার কীট যেমন আবর্জনায় পরিপুষ্টি পায়, এরাও তেমনি পরিপুষ্টি পায় দুর্নীতিতে। ফলে বাংলাদেশে এদের মুল কাজটি হলো, পাপাচারে ও দুর্নীতি দেশটিকে দ্রুত নীচে নামানো। সে মিশনে এরা যে কতটা সফল -সেটি তারা প্রমাণ করেছে পৃথিবীর দুইশতটি দেশটির মাঝে দুর্নীতিতে ৫ বার প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়ে।

 

সাংস্কৃতিক সংকট

শুধু কালেমা পাঠে সংস্কৃতবান মানুষ সৃষ্টি হয় না। সেজন্য তাকে সংস্কারের একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। বহু বীজ যেমন গজিয়ে শেষ হয়ে যায়, তেমনি বহু মানুষের জীবনে কালেমা পাঠ থাকলেও পরিপূর্ণ মুসলমান রূপে বেড়ে উঠাটি হয়না। বাংলাদেশে বহু মুসলিম তো মুখে কালেমা পাঠ করলেও বেড়ে উঠেছে হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে। সংস্কারের চাষাবাদটি হয় চেতনারাজ্য, মুসলিমদের  জীবনে সেখানে কাজ করে কোর’আনী দর্শন। কোর’আনের জ্ঞানার্জন এজন্যই ইসলামে ফরয। যেখানে সে জ্ঞান নাই, সেখানে সে সংস্কারও নাই। তখন অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া। অথচ সে কোর’আনী জ্ঞানে যার জীবন সমৃদ্ধ তাঁর জীবনে সংস্কারটি আসে বিশাল আকারে। ঈমানদারের জীবনে সে সংস্কারের চুড়ান্ত পর্বটি হলো আল্লাহর রাস্তায় অর্থদান, শ্রমদান, মেধাদান ও প্রাণদান। তাই যে সমাজে কোর’আনের চর্চা যত অধিক -সে সমাজে ততই বেড়ে উঠে আল্লাহর পথে মোজাহিদ এবং শহীদের সংখ্যা। সে জ্ঞানে শূন্যতা দেখা দিলে বিপুল সংখ্যায় বেড়ে উঠে দুর্বৃত্তরা। ইসলামের শত্রু পক্ষ সেজন্যই ইসলামের পথে বেড়ে উঠার পদ্ধতিটি রুখতে চায়। তাদের আগ্রহ তাই মুসলিম চেতনায় অশিক্ষা ও অজ্ঞতার আবাদে। শিক্ষার নামে তারা ভ্রষ্টতা বাড়ায়। এমন একটি বিধ্বংসী শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই বাংলাদেশের মত দেশে সবচেয়ে চরিত্রহীন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারীগণ। বাংলাদেশকে এরাই দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম করেছে। ঈমান ধ্বংসের এমন একটি প্রকল্পকে সামনে রেখেই সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া মুসলিমদের জন্য কোর’আনের জ্ঞানদান বন্ধ করেছিল। তালা ঝুলিয়েছিল মসজিদ­-মাদ্রাসায়। চীন সে কাজটি করছে উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে। অপরদিকে একই রূপ উদ্দেশ্য নিয়ে আজ মার্কিনীগণ মুসলিম দেশে সিলেবাস নিয়ন্ত্রণে নেমেছে।  বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ তেমনি একটি উদ্দেশ্য নিয়েই পীর-ফকির ও  আউল-বাউলদের খুঁজছে। আজ থেকে কয়েক শত বছর আগে ইসলামের বিজয় রুখার সে তাগিদে তারা চৈতন্যদেবকে হাজির করেছিল।

সংস্কৃতি বস্তুত চেতনা ও চরিত্র গড়ার বিশাল ইন্ডাস্ট্রী। এটি পরিবার, সমাজ, পথ-ঘাট, স্কুল-কলেজ তথা দেশের সর্বত্র জুড়ে মানব মনে নীরবে কাজ করে। সংস্কৃতির অঙ্গণে জ্ঞান, ধর্মীয় আচার, সাহিত্য, ঐতিহ্য, ইতিহাস, মূল্যবোধ ও বিবেকবোধ একত্রে কাজ করে। ইসলামী সংস্কৃতিই মূলত মু’মিনকে ইসলামি সভ্যতার নির্মাণে নিরলস সৈনিকে পরিণত করে। তখন তার কর্ম, মূল্যবোধ, রুচিবোধ, পানাহার,রাজনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ ও তার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় সংস্কারপ্রাপ্ত এক চেতনা ও জীবনবোধ। প্রকাশ পায় তার আল্লাহভীরুতা। এখানে কাজ করে আল্লাহর কাছে প্রিয়তর হওয়ার প্রবল আগ্রহ। প্রিয়তর হওয়ার সে প্রবল আগ্রহ থেকেই ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর জান, মাল ও সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগে জিহাদের ময়দান খুঁজে। জিহাদ এভাবেই মু’মিনের সংস্কৃতির অবিচ্ছদ্য অঙ্গে পরিণত হয়। ঈমানদারের চিন্তুা ও কর্মে এভাবেই আসে পবিত্রতা -যা একজন কাফের বা মুনাফিকের জীবনে কল্পনাও করা যায় না। মুসলিম সমাজে এভাবেই আসে শান্তি, শৃঙ্খলা ও শ্লিলতা। অথচ সেক্যুলারদের জীবনে সেটি আসে না। বরং সেক্যুলার সমাজে যেটি প্রবলতর হয় সেটি পার্থিব স্বার্থ হাসিলের প্রেরণা। জীবন-উপভোগে মানুষ এখানে প্রচণ্ড স্বেচ্ছাচারি হয়। সে স্বেচ্ছাচারকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার লেবাস পড়িয়ে জায়েজ করে নিতে চায়। সেক্যুলার সমাজে পতিতাবৃত্তি, ব্যভিচার, পর্ণছবি, সমকামিতা, অশ্লিলতা, মদ্যপানের ন্যায় নানাবিধ পাপাচার বৈধ্যতা পায় জীবন উপভোগের এমন স্বেচ্ছাচারি প্রেরণা থেকেই। সেক্যুলারিজম প্রবলতর হলে পাপাচারে এজন্যই প্লাবন আসে। বাংলাদেশ আজ তেমনি এক প্লাবনে নিমজ্জমান। দুর্নীতির দ্রুত বৃদ্ধির কারণ তো এটাই।

 

লড়াই শত্রুমূক্ত স্বাধীনতার

আজকের বাংলাদেশে ভৌগলিক ভাবে অধিকৃত নয়। তবে এ মুসলিম ভূমিতে অধিকৃতিটি সাংস্কৃতির। এরূপ সাংস্কৃতিক অধিকৃতিই অসম্ভব করেছে সত্যিকার মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। আর সে অধিকৃতিটি ইসলামের শত্রুপক্ষের। মুসলিম রূপে বেঁচে থাকা ও বেড়ে উঠার জন্য ঘরবাঁধা, চাষাবাদ করা, রাস্তা নির্মাণ বা কলকারখানা গড়াই সবকিছু নয়। পানাহারে জীবন বাঁচে বটে, তাতে ঈমান বাঁচে না। স্রেফ দেহ নিয়ে বাঁচার মধ্য দিয়ে সিরাতুল মোস্তাকিম নাই; সেরূপ বাঁচাতে বাড়ে পথভ্রষ্টতা। সে পথভ্রষ্টতায় বিপন্ন হয় আখেরাতের জীবন। ইহকাল ও পরকাল বাঁচাতে এজন্যই একজন চিন্তাশীল মানুষকে বেড়ে উঠতে হয় জীবন-বিধান, মূল্যবোধ, জীবন ও জগত নিয়ে একটি সঠিক ধারণা নিয়ে। নিত্যদিন বাঁচবার সে কোর’আন ভিত্তিক প্রক্রিয়াটি হলো ইসলামী সংস্কৃতি। তবে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্য যা অপরিহার্য -তা হলো শত্রুমূক্ত স্বাধীনতা।

১৯৪৭’য়ের আগে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিপক্ষ শুধু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশগণ ছিল না, প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দুরাও। আল্লামা ইকবাল চেয়েছিলেন শুধু ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি নয়, হিন্দুদের থেকেও মুক্তি। উভয়ের থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন হতে পরামর্শ দেন। এজন্যই আল্লামা ইকবালকে বলা হয় পাকিস্তানের মূল স্বপ্নদ্রষ্টা। ইকবালের ধারণা যে কত নির্ভূল ছিল তার প্রমাণ আজকের ভারতীয় মুসলিমগণ। সংখ্যায় তারা পাকিস্তানের সমূদয় জনসংখ্যার চেয়ে অধিক, ইন্দোনেশিয়ার পরই তাদের অবস্থান। কিন্তু এতবড় বিশাল জনসংখ্যার সফলতা কোথায়? কিছু অভিনেতা, কিছু গায়ক-গায়ীকা, কিছু খেলোয়াড় সৃষ্টি করতে পারলেও তারা কি ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ মোজাহিদ, দার্শনিক ও আলেমের সৃষ্টি করতে পেরেছে? শুধু করাচীর ন্যায় পাকিস্তানের একটি মাত্র শহরে যে সংখ্যক আলেম, লেখক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আইনবিদ, প্রফেসর, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোগী ব্যক্তি সৃষ্টি হয়েছে -তা কি ভারতের সমগ্র মুসলিমগণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। হাজার হাজার পাকিস্তানীরা প্রাণ দিয়েছে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত রাশিয়াকে হঠাতে। জিহাদের সে পবিত্র ময়দানে মোজাহিদ এসেছে সূদুর আফ্রিকা থেকে। কিন্তু ক’জন ভারতীয় মুসলিম সে জিহাদে যোগ দিয়েছে? অথচ মুসলিমের জীবনে জিহাদ তো অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতি; তাতে ব্যক্তির ঈমান দেখা যায়। ঈমান যে জীবনে বলিষ্ঠ এবং চেতনার সংস্কার যেখানে চুড়ান্ত, জিহাদ তখন অনিবার্য। কোন ভৌগলিক সীমান্ত দিয়ে কি সে জিহাদ সীমিত রাখা যায়? অথচ সে ইসলামও ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি।

ভারত যে স্ট্রাটেজী নিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের শক্তিহীন করেছে -সে স্ট্রাটেজী নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলিমদের বিরুদ্ধেও। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলমান এ সাংস্কৃতিক যুদ্ধে ভারত একা নয়। কাজ করছে এক বিশাল কোয়ালিশন। এ কোয়ালিশনে ভারতের সাথে সমগ্র পাশ্চাত্য বিশ্ব এবং ইসরাইল। শত্রুপক্ষের সে অভিন্ন কোয়ালিশনটি একই যুদ্ধ লড়ছে আফগানিস্তান, ইরাক ও ফিলিস্তিনে। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে তারা অতি-উৎসাহী সহযোদ্ধা রূপে পেয়েছে দেশটির বিপুল সংখ্যক সেক্যুলার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক ক্যাডার, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারপতিসহ বহু সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে। বিশ্ব-রাজনীতির অঙ্গণ থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিদায়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল তাদের পথের কাঁটা এবার দূর হলো। তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হবে এবার বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সেটি হয়নি। একমাত্র আফগানিস্তান দখলে রাখতেই তাদের হিমশিম খেতে হচেছ। পরাজিত হয়েছে ইরাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ শেষ হতে ৫ বছর লেগেছিল। কিন্তু বিগত ২০ বছর যুদ্ধ লড়েও মার্কিন নেতৃত্বাধীন ৪০টিরও বেশী দেশের কোয়ালিশ বাহিনী আফগানিস্তানে বিজয় আনতে পারিনি। বরং দ্রুত এগিয়ে চলেছে পরাজয়ের দিকে। এখন তারা জান বাঁচিয়ে পালাবার রাস্তা খুঁজছে।

 

স্ট্রাটেজী ইসলাম বিকৃতির ও অপসংস্কৃতির

পাশ্চাত্যের কাছে সুস্পষ্ট, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, লিবিয়া, লেবানন, সোমালিয়ার মত ক্ষুদ্র দেশগুলো দখল করা এবং সেগুলোকে কন্ট্রোলে রাখার সামার্থ্যও এখন তাদের নাই। অধিকৃত দেশগুলোতে যে প্রতিরোধের মুখে তারা হারতে বসেছে –সে যুদ্ধের মূল হাতিয়ারটি যুদ্ধাস্ত্র নয়। সেটি জনবল বা অর্থবলও নয়। বরং সেটি কোর’আনী দর্শন ও ইসলামের সনাতন জিহাদী সংস্কৃতি। এ দর্শন ও সংস্কৃতিই যুগে যুগে মুসলিমদের জন্য আত্মসমর্পণকে অসম্ভব ও অচিন্তনীয় করে। এবং মুসলিম চেতনায় অতি কাম্য গণ্য করে আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই ও শাহাদত। এমন চেতনা এবং সংস্কৃতির বলেই অতীতে মুসলিমগণ রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছিল। এ যুগেও তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ও বিশ্বশক্তি  রাশিয়াকে পরাজিত করেছে। এবং এখন গলা চেপে ধরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আফগান মোজাহিদদের জিহাদ তাই পাল্টে দিয়েছে বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ। কামান, বোমা ও যুদ্ধবিমানের বলে গণহত্যা চালানো যায়। নগর-বন্দরও ধ্বংস করা যায়। কিন্তু সে কামানে বা গোলায় কি দর্শন ও সংস্কৃতির বিনাশ সম্ভব? বরং তাদের আগ্রাসন ও গণহত্যার ফলে প্রতিরোধের সে দর্শন ও সংস্কৃতিই দিন দিন আরো বলবান হচ্ছে। কোন একজন মার্কিনী সৈনিককে রণাঙ্গণে রাখতে মাথাপিছু প্রায় ১০ লাখ ডলার খরচ হয়। অথচ মুসলিমগণ জিহাদের ময়দানে হাজির হচ্ছে নিজ খরচে। স্বেচ্ছায় তারা শুধু অর্থই দিচ্ছে না, প্রাণও দিচ্ছে।

অবস্থা বেগতিক দেখে পাশ্চাত্য এখন ভিন্ন স্ট্রাটেজী নিয়েছে। সেটি শুধু দেশদখল ও গণহত্যা নয়। নিছক নগর-বন্দর, ঘরবাড়ী এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনাশও নয়। বরং সেটি ইসলামি দর্শন ও সংস্কৃতি ধ্বংসের। কোর’আনে ঘোষিত বিশুদ্ধ ইসলাম ও সে ইসলামের অনুসারিদেরকে তারা শত্রু মনে করে। তাদেরকে চিত্রিত করছে সন্ত্রাসী রূপে। তারা চায়, মুসলিম বেঁচে থাকুক এমন এক ইসলাম নিয়ে যে ইসলামে জিহাদ নেই, শরিয়তের বিধান নাই এবং সূদ-ঘুষ-মদ্যপান ও ব্যভিচারের ন্যায় পাপাচারগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধও নাই। এবং যুদ্ধ নাই সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির বিরুদ্ধে। তেমন একটি ইসলামের প্রচার বাড়াতে তাদের স্ট্রাটিজীটি হলো ইসলাম বিকৃতিকরণের। এমন বিকৃত ইসলামকে তারা বলছে প্রকৃত ইসলাম। সেটিকে বলছে মডারেট ইসলাম। সে ইসলামকে জনমনে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু করেছে প্রকান্ড এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। কাঙ্খিত সে সংস্কৃতিটি মূলত পাপাচারের সংস্কৃতি। এটি মূলত নিরপরাধ মানুষ হত্যার পাশাপাশি ঈমান হত্যার স্ট্রাটেজী।

বাংলাদেশের ন্যায় প্রতিটি মুসলিম দেশই এখন ইসলামের শত্রুশক্তির পক্ষ থেকে এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক যুদ্ধের শিকার। তবে বাংলাদেশ তাদের অন্যতম টার্গেট হওয়ার কারণ, দেশটিতে ১৬ কোটি মুসলিমের বাস। তেল, গ্যাস বা অন্য কোন খনিজ সম্পদের চেয়ে ১৬ কোটি মুসলিম জনসংখ্যার ফ্যাক্টরটিই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেল, গ্যাস বোমায় পরিণত হয়না, কিন্তু মানুষ হয়। মাত্র ১৭ জন মুসলিম সৈনিক আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে বাংলাসহ সমগ্র পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রই পাল্টে দিয়েছিল। যে চেতনা নিয়ে ১৭ জন মুসলিম সৈনিক বাংলা জয় করেছিল সে চেতনায় ১৬ কোটি মুসলিম জেগে উঠলে সমগ্র ভারতের মানচিত্র পাল্টে যাবে -সেটি ইতিহাসের যে কোন পাঠকই বুঝতে পারে। ভারতও সেটি বুঝে। তাই না চাইলেও ভারতের এ আগ্রাসনের টার্গেট হওযা থেকে বাঁচার উপার নাই। স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে তাই লড়াই করেই বাঁচতে হবে।

ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের লড়াইটি সব সময়ই লাগাতর। শত্রুর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া এমন যুদ্ধ থেকে খোদ নবীজী (সা:)ও বাঁচতে পারেননি। মাত্র ১০ বছরে তাকে ছোট-বড় ৩০টির বেশী যুদ্ধ করতে হয়েছে। এমন যুদ্ধে শত্রুর লক্ষ্য, শুধু দৈহিক নির্মূল নয়, ঈমান হত্যাও। তাই চলমান এ যুদ্ধে পরাজিত হলে অতি কঠিন হবে বাংলাদেশী মুসলিমদের ঈমান নিয়ে বাঁচা। তাতে সংকটে পড়বে তাদের আখেরাতের জীবনও। তবে শত্রুর কাছে যারা আত্মসমর্পিত তাদের জীবনে যুদ্ধ আসে না। যা আসে তা হলো লাগাতর গোলামী। পোষা কুকুরে ন্যায় তাদের গলায় তখন শোভা পায় পরাধীনতার শিকল। তাজুদ্দীনের আমলে সে শিকলটি ছিল ভারতের সাথে ৭ দফা চুক্তির, আর মুজিবামলে সেটি ছিল ২৫ সালা চুক্তির। তবে গৃহপালিত বা আত্মবিক্রীত হলে আর চুক্তি লাগে না। এমন গোলামদের কাছে দাসত্ব তখন জীবন-সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের আওয়ামী বাকশালীদের জীবনে তো সেটাই ঘটেছে।

 

যে যুদ্ধের শেষ নেই

বাইবেল, তাওরাত বা বেদ-উপনিষদের জ্ঞান দিয়ে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করা অসম্ভব। অসম্ভব মুসলিম জনপদে পাদ্রী বা পুরোহিতদের নামিয়ে। ব্রিটিশ শাসকেরা সেটি জানতো। জানে আজকের ভারতীয় হিন্দু শাসকগণও। ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে তারা সৈন্য নামিয়েছে ধার্মিক মুসলিম বা ইসলামী শিক্ষার ছ্দ্দবেশে। যুগে যুগে ইসলামের শত্রুপক্ষের এটাই কৌশল। মুসলিমদের মাঝে কাউকে নামিয়েছে মুসলিম নামধারী আলেমের বেশে, কাউকে বা রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবীর বেশে। তেমন এক স্ট্রাটেজী নিয়ে ব্রিটিশগণ ভারতে আলিয়া মাদ্রাসা খুলেছিল। দেশে দেশে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে এসব মুসলিম নামধারিদের হাতে। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে সূদী লেনদেন, ঘুষ, বেপর্দা ও অশ্লিলতা,সেক্যুলার রাজনীতি, পতিতাপল্লি, মদ্যপান ও ব্যভিচারের ন্যায় নানা দুর্বৃত্তি বিনা প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তো তাদের কারণেই। এরাই অতীতে মুসলিমদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করেছিল জিহাদের ন্যায় ইসলামের মূল শিক্ষাকে। ফলে নিরাপদ হয়েছিল ব্রিটিশদের ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন।

ইসলামে বিরুদ্ধে অতীতের সফল স্ট্রাটেজী নিয়ে শত্রুগণ আবার ময়দানে নেমেছে বাংলাদেশে। এখন সে স্ট্রাটেজীর বাস্তবায়নে তারা ব্যবহার করতে চায় জনগণের নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিষ্টদের সহায়তায় ইতিমধ্যই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন তাদের হাতে অধিকৃত। অধিকৃত দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও। শুরু হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রপাগান্ডা। তাদের কথা, ইসলাম এ যুগে অচল। ইসলামের নামে মুসলিমদের চৌদ্দশত বছর পিছনে নেয়া যাবে না। যেন কোর’আন নাযিল হয়েছিল শুধু নবীজী (সাঃ)’র উপর জামানার লোকদের জন্য। তারা শরিয়তকে বলছে মানবতাবিরোধী। ইসলামের বিরুদ্ধে সে প্রচারকে ব্যাপকতর করছে বাংলাদেশের বহু টিভি চ্যানেল,পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তক। সেগুলির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছে হাজার হাজার এনজিও। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা হলো, নবীজী (সাঃ)’র আমলের ইসলামকে জনগণের মন থেকে ভূলিয়ে দেওয়া এবং মহান আল্লাহতায়ালার কোর’আনী হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করা।

 

লক্ষ্য জিহাদ বিলুপ্তি

বাংলাদেশের ভূমিতে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ই্‌উরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশী-বিদেশী ইসলাম বিরোধী শক্তির সম্মিলিত স্ট্রাটেজী হলো, মুসলিমদের জীবন থেকে জিহাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা। এবং ভূলিয়ে দেয়া ইসলামের মৌল শিক্ষাগুলোকে। অথচ ইসলাম থেকে নামায-রোযাকে যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনি আলাদা করা যায় না জিহাদকেও। পবিত্র কোরআনে জিহাদে যোগ দেয়ার নির্দেশ এসেছে বার বার। অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সাঃ) নিজে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ লড়েছেন বহুবার; এবং তিনি নিজে আহত হয়েছেন। ইসলামের বহুশত্রুকে হত্যা এবং বনু কুরাইজা ও বনু নাযির ন্যায় ইহুদী বস্তিকে নির্মূল করা হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অথচ নবীজী (সাঃ)র সে আপোষহীন নীতি ও ইসলামের সে সংগ্রামী ইতিহাসকে তারা সুপরিকল্পিত ভাবে আড়াল করতে চায়। নামায-রোযা, হজ-যাকাতের বাইরেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও আইন-আদলতের সংস্কারে ঈমানদারের যে গুরুতর দায়ভার রয়েছে সেটিকেও তারা ভূলিয়ে দিতে চায়।

জিহাদই দেয় ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিরক্ষা। সৈনিকদের হাত থেকে হাতিয়ার কেড়ে নিলে তারা শক্তিহীন ও প্রতিরক্ষাহীন হয়, তেমনি ঈমানদারগণ জিহাদশূণ্য হলে ইসলামের পক্ষে দাঁড়াবার কেউ থাকে। শত্রুপক্ষ তখন বিনা বাধায় নবীজী (সা:)’র ইসলাম ও মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী বিধানকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় তখন সর্বত্র জুড়ে। বাংলাদেশ তো তারই উদাহরণ। দেশটি ১৬ কোটি মুসলিমের সামনে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে যেরূপ বিদ্রোহ হচ্ছে এবং তাঁর শরিয়তী বিধান যেরূপ উপেক্ষিত হচ্ছে –তার মূল কারণ তো মুসলিম জীবনে জিহাদশূণ্যতা। সাহাবায়ে কেরামের যুগে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। কিন্তু তাদের সামনে আল্লাহর শরিয়তী বিধান এভাবে পরাজিত ও অপমানিত হয়নি। কারণ, নামায-রোযার সাথে তাদের জীবনে লাগাতর জিহাদও ছিল। অথচ বাংলাদেশে বিপুল বিজয়ীর বেশে ইসলামের শত্রুপক্ষ। মহান আল্লাহর বদলে রাষ্ট্রের মালিক-মোখতার হয়ে পড়েছে ইসলাম বিরোধী দুর্বৃত্তরা। অথচ এ বিশাল বিজয় আনতে শত্রুপক্ষকে একটি তীরও ছুঁড়তে হয়নি। কারণ, যুদ্ধটি হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির ময়দানে। এবং যুদ্ধটি লড়েছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। নিজেদের রক্তক্ষয় ও অর্থব্যয় এড়াতে বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম ভূমিতে এমন একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকেই তারা লাগাতর চালিয়ে যেতে চায়। ফলে এ যুদ্ধের শেষ নাই। দেশটির সাংস্কৃতিক রণাঙ্গনে তাদের বিপুল সৈন্য সমাবেশ দেখে তা নিয়ে কি সন্দেহ করা চলে?  ১ম সংস্করণ ১৪/০৪/২০১২; ২য় সংস্করণ ০৫/০২/২০২১।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *