বাংলাদেশে স্বৈরাচারের নাশকতা এবং যে ব্যর্থতা বাঙালী মুসলিমের
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 19, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
স্বৈরাচারঃ দুশমন মানব সভ্যতার
স্বৈরশাসকদের নৃশংস অপরাধ শুধু এ নয়, বিপুল সংখ্যায় তারা মানুষ খুন করে, গুম করে ও নির্যাতন করে। বরং তাদের হাতে সবচেয়ে বড় অপরাধটি ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সনাতন সত্যদ্বীনের নির্মূলে। ভয়ানক অপরাধ করে মানুষের বিবেক নিধনের ক্ষেত্রেও। স্বৈরশাসকের নাশকতাটি তাই হিংস্র পশু ও প্রাণ-নাশক জীব-জীবাণুর চেয়েও ভয়াবহ। কারণ, ঘাতক পশু ও জীব-জীবাণু ইসলাম ও ঈমানের শত্রু নয়। পশুর কাজ স্রেফ দৈহিক হত্যা; বিবেক হত্যা বা ঈমান হত্যা নয়। তাই হিংস্র পশু ও জীব-জীবাণুর নাশকতা বৃদ্ধিতে মানুষ জাহান্নামে যায় না; জাহান্নামে যাওয়ার কারণ তো ঈমানের মৃত্যু এবং সৎ আমলের শূণ্য ভাণ্ডার। সেটি ঘটে স্বৈরশাসকদের হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ায়। অসত্য ও অন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকে প্রবলতর করে তারা অসম্ভব করে সুস্থ্য ঈমান–আক্বীদা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ন্যায়নীতি ও নেক আমল নিয়ে বেড়ে উঠা। এভাবে অসম্ভব করে মুসলিম রূপে বাঁচা তথা ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠা।
দেশে দেশে স্বৈরশাসকগণ কাজ করে শয়তানের খলিফা রূপে। মহান আল্লাহতায়ালার খেলাফতের বদলে তারা প্রতিষ্ঠা করে শয়তানের খেলাফত। শয়তানের খলিফাগণ নবী-রাসূল ও তাদের প্রচারিত ধর্মের জন্য কোন দিনই সামান্যতম স্থানও ছেড়ে দিতে রাজী হয়নি। অতীতের ন্যায় আজও সেটিই তাদের রীতি। বাংলাদেশের ন্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোতে শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফত, জিহাদের ন্যায় ইসলামের মৌল বিধানগুলোর বিরুদ্ধে স্বৈর-শাসকদের যেরূপ উগ্র অবস্থান -সেটি তাই কোন নতুন নীতি নয়। এটিই তাদের সনাতন ও স্বাভাবিক নীতি। শুধু রাষ্ট্রের অঙ্গণে নয়, এমনকি জনগণের মনের ভূবনেও চায় ইসলামী চেতনার নির্মূল। চায়, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজমের ন্যায় নানারূপ ইসলাম বিরোধী মতবাদ বা ধ্যান-ধারনার অধিকৃতি। ইসলামের প্রতিষ্ঠাকামীদের বিরুদ্ধে স্বৈর-শাসকদের যুদ্ধ ও সন্ত্রাস এজন্যই এতটা লাগাতর এবং নৃশংস। গণতন্ত্রে যেহেতু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মভীরু মুসলিম জনগণের ইসলামী আক্বীদার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব ও বৈধতা পায়, শয়তানী শক্তিবর্গ এজন্যই গণতন্ত্রের ঘোরতর শত্রু। আলজিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশরে ইসলামপন্থিদের বিজয়কে ছিনিয়ে নিয়ে স্বৈর শাসনকে চাপিয়ে দেয়ার মূল কারণ তো এটিই।
মদিনার বুকে ইসলামের দ্রুত বেড়ে উঠার বড় কারণ, সেখান ফিরাউন, নমরুদের ন্যায় শক্তিশালী দুর্বৃত্তদের স্বৈরশাসন ছিল না। এলাকাটি কোন কালেই স্বৈরশাসন কবলিত তৎকালীন রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি দুর্বৃত্ত বিশ্বশক্তির কবজায় ছিল না। এতে মানুষের বিবেক বেঁচেছিল স্বৈরশাসকে হাতে নিহত হওয়া থেকে। ফলে মদিনার মানুষ নৈতীক যোগ্যতা পেয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন কবুল ও তাঁর মহান নবীজীকে নিজ শহরে দাওয়াত দেয়ার। মানব ইতিহাসে এমন ঘটনা পূর্বে আর কখনোই ঘটেনি। সেখানে ইসলাম পেয়েছিল দ্রুত বেড়ে উঠার সহায়ক পরিবেশ। অথচ স্বৈরশাসকদের হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার নাশকতাটি এতটাই প্রকট যে, অতি কঠিন হয়ে পড়ে সেখানে সুস্থ্য ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠা। যেমন কঠিন হয়েছিল নমরুদ ও ফিরাউনের শাসনামলে ইরাক ও মিশরে। এবং আজ হচ্ছে বাংলাদেশে।
শয়তানের এজেন্ডা পূরণে বিশ্বস্ত সহকারি রূপে কাজ করাই স্বৈর-শাসকদের নীতি। রাষ্ট্রকে তারা শয়তানের ইন্সটিউশনে পরিণত করে। শয়তানের অনুগত সৈনিক রূপে মানুষকে জাহান্নামে নেয়াই তাদের মূল মিশন। ফলে তারা প্রতিপক্ষ রূপে খাড়া হয় ইসলামের বিজয়ের বিরুদ্ধে। এজন্যই মানব সমাজের সবচেয়ে বড় নেক কাজটি হিংস্র পশু, মশামাছি বা ঘাতক রোগজীবাণু নির্মূল নয়, বরং সেটি হলো স্বৈরাচার নির্মূল। তাই ইসলামে সবচেয়ে বড় ইবাদতটি হলো স্বৈর শাসন নির্মূলের জিহাদ। এ কাজটি না হলে সে রাষ্ট্রে ঈমান নিয়ে বাঁচা এবং মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্বৈর শাসন নির্মূলের জিহাদে নবীজী (সাঃ)র শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী শহীদ হয়ে গেছেন। স্বৈর শাসক এজিদের বিরুদ্ধে জিহাদে শহীদ হয়েছেন ইমাম হোসেন (রাঃ) ও তাঁর ৭২ জন সহচর। স্বৈরাচারি শাসকদের হাতে জনগণের বিবেক হত্যার অপরাধটি মহামারি আকারে হওয়ার কারণেই অতি দুর্বৃত্ত শাসকগণও জাতির নেতা, পিতা, বন্ধু –এমন কি ভগবান রূপে স্বীকৃতি পায়। একারণেই নমরুদ ও ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরশাসকগণ মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিপক্ষ রূপে গৃহীত হয়েছিল। এবং নিন্দিত, নির্যাতিত, নিহত বা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন এমন কি নবীরাসূলগণ। যে দেশে চোর-ডাকাত, খুনি ও স্বৈরাচারিগণ শাসকরূপে স্বীকৃতি পায় ও সন্মানিত হয়, বুঝতে হবে সেখানে বিবেকের মৃত্যুটি একমাত্র চোর ডাকাত ও স্বৈরাচারি শাসকদের নিজস্ব বিষয় নয়, সেরূপ বিবেকের মৃত্যু ঘটে সাধারণ মানুষের জীবনেও। মিশরের বুকে ফিরাউন শুধু একা অপরাধী ছিল না, অপরাধী ছিল সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণও। তাই আযাব তাদের সবাইকে ঘিরে ধরেছিল।
স্বৈরাচারঃ শয়তানের বিশ্বস্ত হাতিয়ার
ন্যায়ের নির্মূলে ও অন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় শক্তির ক্ষমতাটি বিশাল। কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়, কোনটি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পাবে এবং কোনটি বর্জন করা হবে -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র। সেখানে মহান আল্লাহতায়ালার বিধান কাজ করে না। ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে থাকলে ধর্মীয় ও বর্ণগত নির্মূলকে যেমন বৈধ বলা যায়, তেমনি সুস্পষ্ট অন্যায়কেও ন্যায় বলা যায়। যেমনটি স্পেন থেকে মুসলিম নির্মূল এবং আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে আদিবাসীদের নির্মূলের ক্ষেত্রে হয়েছে। গ্যাস চেম্বারে লাখ লাখ মানুষ পুরিয়ে মারাকেও তখন আইনসিদ্ধ বলা যায়। যেমনটি হিটলার বলেছে। তখন বৈধতা দেয়া যায় মা-বাপদের কোল থেকে সন্তান ছিনিয়ে নেয়া, অন্যদের দেশ দখল করা, পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ বা গোয়ান্তানামো বে’এর ন্যায় জেলে বছরের পর বিনাবিচারে বন্দি রাখার ন্যায় নানারূপ অসভ্য কর্মকেও। যেমনটি করছে মার্কিনীরা। ক্ষমতার দাপটে একই ভাবে বহু হারাম কর্মকে মুসলিম দেশগুলিতে উৎসবযোগ্য করা হয়েছে। যেমন পৃথক ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ভূগোলের নামে মুসলিম দেশগুলিকে টুকরো টুকরো করে দুর্বল করা। এমন কি আইন সিদ্ধ করা বলা হয়েছে ভোটা-ডাকাতির নির্বাচনকেও। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তো সেটিই করেছে। সে লুন্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ের দোহাই দিয়ে দাপটের সাথে দেশ-শাসনের অবৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
স্বৈর-শাসন ও তার রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগুলো কাজ করে মূলতঃ শয়তানের একনিষ্ঠ হাতিয়ার রূপে। নামে মুসলিম হলেও তারা লড়ে শয়তানের ইসলাম বিরোধী এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষে। তাই স্বৈরাচার শুধু সুস্থ্য রাজনীতি, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও ন্যায়পরায়ণ প্রশাসনেরই শত্রু নয়; ভয়ানক শত্রু বিবেক-বুদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তিরও। তাদের কারণে বিপুল প্রতিপত্তি পায় দুর্বৃত্ত মানুষ ও দুর্বৃত্ত বুদ্ধিজীবীগণ। অপরাধী স্বৈর-সরকার কখনোই নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার নিজেরা গ্রহণ করেনা। সর্ব-অবস্থায় নিজেদের দোষমুক্ত জাহির করাই তাদের নীতি। এমনকি ১৯৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যেরূপ প্রাণ হারালো -সেজন্য আওয়ামী লীগ আজও দোষ স্বীকার করেনি। দোষ চাপিয়েছে বিদেশীদের উপর। বিদেশীদের দোষ, তারা কেন যথা সময়ে পর্যাপ্ত ভিক্ষা দিল না? অথচ এ আত্মজিজ্ঞাসা কখনোই আওয়ামী শাসক মহলে উঠেনি, হাজার হাজার কোটি টাকার ভিক্ষালব্ধ সম্পদ যে দেশের অরক্ষিত সীমানা দিয়ে ভারতে পাচার হয়ে গেল সেজন্যও কি বিদেশীরা দায়ী? নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো যে কোন সভ্য আইনেই গুরুতর অপরাধ। অথচ সেটাই হলো সকল স্বৈরাচারি শাসকদের স্বভাবজাত অভ্যাস। তাদের বিচারে নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নেয়ার অর্থ, নিজেদের পরাজয় মেনে নেয়া। তাদের ভয়, তাতে গণরোষে আবর্জনার স্তুপে পড়ার। সে ভয় থেকেই স্বৈরশাসকগণ সকল ব্যর্থতার দায়ভার বিরোধী পক্ষের উপর চাপায়। একই কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির কথাও তারা দেশবাসিকে ভূলিয়ে দিতে যায়। ভূলিয়ে দিতে চায়, ২০১৩ সালে ৫ই মে’র শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যার কথাও।
যে অপরাধ বাঙালী সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের
দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে ভয়ানক নাশকতাটি শুধু স্বৈরশাসকদের হাতে ঘটে না, ঘটে স্বৈরশাসক প্রতিপালিত বুদ্ধিজীবীদের হাতেও। মন্দিরের ঠাকুর বা পুরোহিত ছাড়া পুতুল পূজা, শাপপূজা, লিঙ্গপূজার ন্যায় বর্বর জাহিলিয়াত বাঁচে না। তেমনি মিথ্যসেবী বুদ্ধিজীবী ছাড়া অসভ্য স্বৈরশাসনও বাঁচে না। ফিরাউন কখনো নিজে ঘরে ঘরে গিয়ে জনগণের কাছে নিজেকে ভগবান রূপে পেশ করেনি। সে কাজটি করেছিল তার উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী ও ধর্মজীবীরা। পবিত্র কোরআনে এ শ্রেণীর দুর্বৃত্ত মানুষদের মহান আল্লাহতায়ালা মালাউন বলে অভিহত করেছেন। প্রতি যুগে এবং প্রতি দেশে এসব বুদ্ধিজীবী ও ধর্মজীবীদের অবস্থান ইসলামের ঘোরতর বিপক্ষে। ইসলামের লড়াকু সৈনিকদের বিরুদ্ধে এরাই স্বৈর-শাসকের ভাণ্ডারে বুদ্ধিবৃত্তিক গোলাবারুদ সরবরাহ করে। তাদের কারণেই শরিয়ত, হুদুদ, জিহাদ, খেলাফতের ন্যায় ইসলামের মৌল বিধানগুলি স্রেফ মুসলিম দেশ থেকে নয়, মুসলিম চেতনা থেকেও বিলুপ্ত হয়েছে। এরূপ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই দীর্ঘ আয়ু পায় দুর্বৃত্ত স্বৈর শাসকগণও। বাংলাদেশে বাকশালী স্বৈরাচার যে এখনো বেঁচে আছে সেটিও তো তাদের কারণে। তাদের কাজ, মিথ্যা ও অন্যায়কে স্রেফ বৈধ ও সঙ্গত রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া নয়, বরং প্রকৃত অপরাধীদের অপরাধকে মানুষের চোখ থেকে আড়াল করা। দেশের সকল ব্যর্থতার জন্য স্বৈরাচারকে দায়ী না করে তারা দায়ী করে জনগণকে। স্বৈরাচারের অদক্ষতা ও দূর্নীতিকে লুকাতে গিয়ে দায়ী করে দেশের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে। এমনকি দায়ী করে দেশের ভূমি, ভূগোল ও জলবায়ুক। দায়ী করে এমন কি ক্ষমতার মসনদ থেকে বহু দুরে থাকা বিরোধী দলকে। যেমন ফিরাউন দায়ী করতো হযরত মূসা (আঃ) ও তার ভাই হযরত হারুন (আঃ)কে।
সেবকশ্রেণীর এ বুদ্ধিজীবী ও ধর্মজীবীদের মূল কাজ স্রেফ স্বৈরশাসকদের গুণগান গাওয়া নয়, বরং তাদের কৃত জঘন্য অপরাধগুলি লুকানো। এদের সংখ্যাটি বাংলাদেশে বিশাল। সামান্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক। গত ২৬শে জুন, ২০১৮ আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলো’তে কলাম লিখেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে যা কিছু হয়েছে তার জন্য স্রেফ আওয়ামী লীগকে দোষ দেয়া যাবে না। তাঁর কথা, দোষ অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও। তবে লক্ষ্যণীয় হলো, ২০১৪ সালে নির্বাচনের নামে যে ভয়ানক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -সেটি তিনিও অস্বীকার করতে পারছেন না। তবে সৈয়দ আবুল মকসুদের নিজের অপরাধটি অন্যত্র। সেটি হলো, ভয়ানাক অপরাধীকে অপরাধী গণ্য না করার। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর ২০১৪ সালে যে নির্লজ্জ ডাকাতি হলো এবং সে ডাকাতির মূল নায়ক যে আওয়ামী লীগকে সে সত্যটি তিনি তার প্রবন্ধে গোপন করেছেন। এবং ডাকাতদের সামান্যতম নিন্দাও করেননি। অথচ সে ভয়ানাক অপরাধটি ছিল সমগ্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে। আজকের রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণও সেটি। এতবড় অপরাধের জন্য যারা দায়ী -তাদের শাস্তি না দেয়া তো আরেক অপরাধ। বুদ্ধিজীবীদের এ অপরাধের কারণে সাহস বাড়ে প্রকৃত অপরাধীদের। অথচ সৈয়দ মকসুদ আহমেদ সে অপরাধ ও অপরাধীর বিরুদ্ধে শাস্তির কথা মুখে আনেননি। বরং আওয়ামী লীগের অপরাধ লঘু করতে তিনি দোষ চাপিয়েছেন অন্যান্য দলের উপরও। আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত ভোট ডাকাতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিরোধী দলগুলি। ভাবটা এমন, ঘরে ডাকাতি হলে দোষ শুধু ডাকাতদের নয়, গৃহস্বামীরও। গৃহস্বামীর অপরাধ, ডাকাতদের জন্য দরজা খুলে না দেয়ার। এবং ডাকাতিতে সহযোগিতা না করার। ডাকাত পাড়ায় বিচার বসলে বিচারের রায় তো এরূপই হয়। ২০১৪ সালের ভোট ডাকাতি নিয়ে সেরূপ অভিন্ন রায়টি তাই স্বৈরসেবক প্রতিটি বুদ্ধিজীবীর।
অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আনায় আওয়ামী লীগের সামান্যতম আগ্রহ থাকলে নিরপেক্ষ কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন তারা মেনে নিত। বিরোধী দলের এ দাবী আদৌ অনায্য ছিল না। এ দাবী নিয়ে এক সময় শেখ হাসিনাও প্রচণ্ড আন্দোলন করেছেন। ফলে সে দাবী আজ অনায্য হয় কি করে? বিরোধী দল তো কখনো এ দাবী করেনি, তাদের পছন্দের লোকের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন করাতে হবে। তারা তো চেয়েছে স্রেফ নির্দলীয় সরকারের হাতে নির্বাচন। নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে সামান্যতম ইচ্ছা নেই -সেটির প্রমাণ শেখ হাসিনা বার বার দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণ ইচ্ছামত তাদের ভোট প্রয়োগ করুক –সেটি তিনি চান না। বরং চান, যে কোন ভাবে নির্বাচনি বিজয়। জনগণের ভোট তাঁর কাছে সামান্যতম গুরুত্ব পেলে যে নির্বাচনে ১৫৩টি সিটে কোন ভোটকেন্দ্রই খোলা হলো না এবং শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোট দিল না -সে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় কি করে? অন্যরাই বা এ নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয় কি করে? কেয়ারটেকার সরকারের বিধান যে বিচারক বিলুপ্ত করেছেন তার কথা এটি সংবিধান বিরোধী। কথা হলো, সংবিধান বিরোধী হলে সেটিকে সহজেই সংশোধন করা যেত। তেমনি একটি সাংবিধানিক সংশোধনীতে কি দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি হতো? বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে তো সেটি না করায়। অপর দিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে যে ভয়ানক ডাকাতি ঘটলো সেটি তো ২০১৪ য়ের ডাকাতির চেয়েও অভিনব। ২০১৪ সালে বিরোধী দলের উপর দোষ চাপানো হলো নির্বাচনে তারা অংশ না নিলে তাদের কি করার আছে? ২০১৮ সালে বিরোধী দল অংশ নিল। কিন্তু এবার ভোটের আগের রাতে সরকারি ভাণ্ডার থেকে ব্যালেট পেপার ছিনিয়ে সিল মেরে ব্যালট বক্স পূর্ণ করা হলো। নির্বাচনে জনগণকে ভোটদানের অধিকারই দেয়া হলো না।
সমস্যাটি লজ্জা-শরম বিলুপ্তির
সভ্য মানুষের কাছে লজ্জা-শরমেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। তাকে ঈমান ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে হয়। লজ্জা-শরমের কারণে সাধারণ মানুষ তাই অপরাধে নামে না। নবীজী (সাঃ) লজ্জা-শরমকে ঈমানের অর্ধেক বলেছেন। ফলে লজ্জা-শরম যার নেই, ঈমানের ভাণ্ডারেও তার থাকে প্রচণ্ড শূণ্যতা। শরমের ভয় থাকাতে এমন কি চোর-ডাকাতগণও রাতের আঁধারে লুকিয়ে চুরি-ডাকাতি করে। শরমের কারণে পতিতাও রাজপথে দেহ ব্যবসায়ে নামে না, গোপন আস্তানা খোঁঝে। কিন্তু স্বৈর-শাসকদের সে লজ্জা-শরম থাকে না। ফলে ডাকাতির পণ্য ভোটের উপর ডাকাতিতে তারা নামে দিন-দুপুরে এবং জনসম্মুখে। ফলে সমাজে এরাই হলো সবচেয়ে জঘন্য অপরাধী। এবং সবচেয়ে বড় বেঈমানও। অন্য অপরাধীরা কিছু লোকের সম্পদ ও ইজ্জত লুটে, কিন্তু স্বৈর-শাসক দখলে নেয় সমগ্র দেশ। স্বৈর-শাসক এরশাদ তাঁর সে লজ্জাহীনতা বার বার প্রমাণ করেছেন। সেজন্য যথার্থই তিনি আখ্যায়ীত হয়েছেন বেহায়া ও বেঈমান রূপে। ঝাঁকের কই ঝাঁকে চলে। বেহায়া এরশাদও তাই স্বৈরাচার বাঁচাতে হাসিনার সাথে জোট বেঁধেছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোট-ডাকাতির নির্বাচনে প্রমাণিত হলো স্বৈরাচারি এরশাদের ন্যায় শেখ হাসিনারও লজ্জা-শরমের বালাই নেই। যা আছে তা হলো ক্ষমতার নেশা। নেশাগ্রস্ততার কারণেই তিনি জনগণের ভোটের অধিকারের উপর ডাকাতি করেছেন দিনের আলোয় হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে। তাই লজ্জাহীন হওয়াটি শুধু ড্রাগ-এ্যাডিক্টদের রোগ নয়; একই রোগ পাওয়ার-এ্যাডিক্টদেরও। সেটিই শেখ হাসিনা বার বার প্রমাণ করে চলেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ডাকাতিটি কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল সমগ্র জনগণের ভোটের উপর। জনগণের কাছে এ ভোটের গুরুত্বটি অপরিসীম। কে সংসদে বসবে বা মন্ত্রী -হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধীকারটি শেখ হাসিনার নয়, সেটির হক একমাত্র জনগণের। জনগণ নিজেদের সে অধীকারটি প্রয়োগ করে রাজস্ব বা শ্রম দিয়ে নয়, বরং ভোট দিয়ে। অথচ শেখ হাসিনারও পছন্দ হয়নি জনগণ সে অধীকারের মালিক হোক। তাই ডাকাতির মাধ্যমে জনগণের সে অধীকারকে তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন। জনগণ পরিনত হয়েছে তাঁর স্বৈরাচারি আচরণের শক্তিহীন নীরব দর্শকে। জনগণের বদলে সংসদের সদস্য নির্বাচন করেছেন তিনি নিজে, সেটি দলীয় মনোনয়ন দিয়ে। রাজা-বাদশাহদের জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয় না; প্রয়োজন হয়নি হাসিনার দলের সংসদ সদস্যদেরও। ২০১৪ সালের ভোট ডাকাতির বদৌলতে তারা ৫ বছর সংসদে বসেছেন। ২০১৮ সালে সে মেয়াদেরই নবায়ন করে নিল আরেক ডাকাতি করে।
মহামারিটি বিবেকের অঙ্গণে
আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধজীবীদের ব্যর্থতাটিও কি কম? জনগণের অধিকারের প্রতি যাদের সামান্যতম দরদ ও শ্রদ্ধাবোধ আছে -তারা কি গুরুতর ভোট-ডাকাতিকে সমর্থন করতে পারে? কিন্তু সে দরদ ও বিবেকের প্রকাশ নেই আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। এখানে মহামারিটি তাদের বিবেকের অঙ্গণে। দেহের মৃত্যুর ন্যায় বিবেকের মৃত্যুও কখনো গোপন থাকে না। বিবেকের সে মৃত্যুটি বাংলাদেশে কতটা ব্যাপক সেটি বুঝা যায় দেশের পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠা, টিভি অনুষ্ঠান ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের দিকে নজর দিলে। পত্রিকায় যারা লিখেন, সেমিনারে যারা বক্তৃতা দেন বা টিভি অনুষ্ঠানে যারা হাজির হন -তাদের ক’জনের মাঝে রয়েছে মিথ্যাকে মিথ্যা, অন্যায়কে অন্যায়, স্বৈরাচারকে স্বৈরাচার এবং ভোট-ডাকাতকে ভোট-ডাকাত বলার সামর্থ্য? বরং অধীকাংশই ভোট-ডাকাতদের পক্ষ নেন এবং তাদের অপরাধকে গোপন করেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের মত বুদ্ধিজীবীদের লেখা তো তারই দৃষ্টান্ত।
সৈয়দ আবুল মকসুদের ন্যায় বুদ্ধিজীবীগণ কলম ধরার লক্ষ্য, জনগণের আহত স্মৃতির উপর মলম লাগানো। এবং ভোট ডাকাতের ইমেজ থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্তি দেয়া। সেটি করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০১৪ সালের নির্বাচনে যা কিছু হয়েছে তার জন্য দোষ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির উপরও চাপিয়েছেন। তবে একাজে সৈয়দ আবুল মকসুদ একা নন। তাঁর ন্যায় বুদ্ধিজীবীদের বিবেকশূণ্যতা এক্ষেত্রে অতি প্রকট। এ বিষয়টি তাদের বিবেচনায় আসে না, ২০১৪ সালে দেশে যে রাজনৈতিক দলগুলি ময়দানে ছিল সেগুলি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও ছিল। তাদের কারণে সে নির্বাচনগুলোতে কি কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল? গাড়ি খাদে পড়ে তো নেশাগ্রস্ত চালকের কারণে, যাত্রীদের কারণে নয়। বিষয়টি অনুরূপ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বেলায়ও। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি না হওয়ার কারণ, সে নির্বাচনগুলি শেখ হাসিনার ন্যায় কোন পাওয়ার-এ্যাডিক্ট স্বৈর-শাসকের হাতে হয়নি। হয়েছে কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে।
নির্বাচনের নামে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যা কিছু হয়েছে তার জন্য অন্য কোন পক্ষ জড়িত ছিল না। জড়িত ছিল একমাত্র শেখ হাসিনার স্বৈরাচারি সরকার। নির্বাচনটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হোক –সেটি কখনোই শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তাঁর পরিকল্পিত উদ্দেশ্য ছিল, প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাঁর নিজের দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করা। সে পরিকল্পনার অংশ রূপেই নির্বাচনের কিছুকাল আগে খায়রুল হকের ন্যায় একজন আজ্ঞাবাহক বিচারককে দিয়ে তিনি কেয়ারটেকার সরকারের বিধিকে বিলুপ্ত করেন। কিছুকাল পরে সে বিচারককে নিজের রিলিফ ভাণ্ডার থেকে ১০ লাখ টাকার অর্থদানও করেছেন –যা পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ফলে শুরু থেকেই নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচনি কমিশন ও প্রশাসন গড়ে তোলাটি তাঁর এজেন্ডায় স্থান পায়নি। তাছাড়া কথা হলো, একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব যাদের কাছে বাঙালী ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও অনুকরণীয় আদর্শ তাদের কাছে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন থাকবে –সেটিই বা কি রূপে ভাবা যায়? তারা বরং সুযোগ পেলে মুজিবের বাকশালী স্বৈরাচার ফিরিয়ে আনবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। সে বাকশালী স্বৈরাচারের কারণেই দেশ বহু রাজনৈতিক দল থাকলে রাজনীতির অঙ্গণে দখলদারি মাত্র একটি দলেরই। সে বিষয়টি বাংলাদেশের নিরক্ষর কৃষক-শ্রমিকও বুঝে। কিন্তু আওয়ামী ঘরানার আবুল মকসুদগণ সেটি ইচ্ছা করেই বুঝতে রাজী নন। এর কারণ, তাদের চেতনার ভূমিতে যে চেতনাটি দখল জমিয়েছে সেটি কোন গণতান্ত্রিক চেতনার নয়; বরং সেটি মুজিবের একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচারি আদর্শের।
যে ব্যর্থতা বাঙালী মুসলিমের
ডাকাতদের নেতৃত্ব ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে একটি জনপদের অসভ্যতা। রাস্তা-ঘাট বা দালান-কোঠা দিয়ে সে অসভ্যতা ঢাকা যায় না। মিশরেরর ফিরাউনগণ অসংখ্য এবং বিস্ময়কর পিরামিড গড়েও সে অসভ্যতা ঢাকতে পারিনি। সভ্য মানুষেরা তাই সে বসতি থেকে হয় ডাকাত নির্মূল করে, নতুবা নিজেরাই অন্যত্র চলে যায়। আলো ও আঁধার যেমন একত্রে থাকে না, তেমন সভ্য ও অসভ্য মানুষেরাও কখনোই একত্রে বসবাস করে না। তাই হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গিসাথীগণ নিজেদের ঘরবাড়ী ও সহায়-সম্পদ জালেমদের হাতে ফেলে মিশর ছেড়েছিলেন। হযরত মহম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গিগণ ছেড়েছিলেন মক্কা। ইসলামে এটিই হলো পবিত্র হিজরত। স্রেফ উলঙ্গতা, ব্যাভিচার, চুরিডাকাতি, সন্ত্রাস, গরুপূজা, মু্র্তিপূজা বা লিঙ্গপূজাই কোন জাতির অসভ্যতার মূল মাপকাঠি নয়। অসভ্যতার অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভূল মাপকাঠি হলো দেশের উপর স্বৈরাচারি শাসন। কারণ, স্বৈরাচারি শাসন হলো মানুষকে বিবেকহীন, শক্তিহীন ও অসভ্য করার শয়তানের ইন্সটিটিউশন। স্বৈরশাসকদের হাতে অধিকৃত হলে সমগ্র দেশ তখন অসভ্য ডাকাত পাড়ায় পরিণত হয়। অতীতে ডাকাতদের সে অসভ্য সংস্কৃতিই জন্ম দিয়েছে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ। আজও সে সংস্কৃতি বিলুপ্তি হয়নি।
ঈমান-আমল ও মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণের পরিমাপটি স্রেফ নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও দান-খয়রাত দিয়ে হয় না। সে সামর্থ্য বহু পাপী ও বহু মুনাফিকেরও থাকে। সে বিচারটি নির্ভূল ভাবে হয় রাষ্ট্রের বুক থেকে স্বৈরশাসনের অসভ্যতা নির্মূলে ব্যক্তির জান ও মালের বিনিয়োগ থেকে। নিজের স্বার্থ-উদ্ধারের লক্ষ্যে মানুষ এ ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় আপোষটি করে এবং অসভ্য স্বৈরাচারের সমর্থকে পরিণত হয়। এমন কি ধর্মের লেবাসধারিরাও। এজন্যই এজিদেরা তাদের দুর্বৃত্তিতে কখনো একাকী ছিল না। অথচ দুর্বৃত্তদের নির্মূলে কে কতটা অংশ নিল -সেটিই হলো ঈমান যাচায়ে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষিত লিটমাস টেস্ট। সেটির ঘোষণা এসেছে পবিত্র কোরআনের সুরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “তোমাদের (মুসলিমদের) উত্থান ঘটানো হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মডেল রূপে। তোমরা প্রতিষ্ঠা করো ন্যায়ের এবং নির্মূল করো অন্যায়ের। এবং তোমরা ঈমান রাখো আল্লাহর উপর।” অতএব মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা এজন্য নয় যে, তারা বেশী বেশী নামায পড়ে, রোযা রাখে বা পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ গড়ে। বরং এজন্য যে, তারা অন্যায়কে নির্মূল করে এবং ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে। এবং মহান আল্লাহতায়ালার উপর অটল বিশ্বাস রাখে। বাংলাদেশ যখন দুর্নীতিতে বার বার বিশ্বে প্রথম হয়, তখন ঘটে উল্টোটি। তখন প্রকাশ পায়, বাঙালী মুসলিমের গভীর ব্যর্থতা।
সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লব
সুরা আল ইমরানের উপরুক্ত ১১০ নম্বর আয়াত থেকে অপর যে বিষয়টি সুস্পষ্ট বুঝা যায় সেটি হলো, মানব জীবনে সবচেয়ে বড় নেক কর্ম এবং রাষ্ট্রের বুকে সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি কোটি কোটি টাকার দান খয়রাতে হয় না। বহুকোটি টাকার দান-খয়রাত বহু কাফেরও করে। বরং সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্মের শুরুটি হয় ব্যক্তির বিবেক ও জিহবা থেকে। বিবেকের দ্বারা সে নেক কাজটি হয় অন্যায়কে অন্যায় এবং সত্যকে সত্য রূপে চেনার মধ্য দিয়ে। বিবেকের ভূমিতে সে বিশাল বিপ্লবের কাজটি করে পবিত্র কোরআনের জ্ঞান। পবিত্র কোরআনের জ্ঞানার্জন এজন্যই প্রতিটি নর-নারীর উপর ফরজ। এ ফরজ পালন ছাড়া কোন ব্যক্তির পক্ষে সভ্যতর মানব রূপে গড়ে উঠা অসম্ভব। সভ্যতর সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ার মহাবিপ্লবের শুরু তো এখান থেকেই। বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতার কারণও মূলতঃ এখানে।
সত্যকে সত্য রূপে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে চেনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সামর্থ্যের। ব্যক্তির বিবেকে সে সামর্থ্য না থাকলে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সত্য দ্বীন এবং মানব জীবনের মূল মিশনটিও অজানা থেকে যায়। তখন শয়তানের মিশনকে তারা নিজ জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়। এর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে প্রতিষ্ঠা পায় ধর্ম ও মতবাদের নামে নানারূপ মিথ্যাচার ও অসভ্যতা। দেশে দেশে রাজনৈতিক মতবাদের নামে জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং ধর্মের নামে শাপপূজা, লিঙ্গপূজা, গরুপূজা ও মুর্তিপূজার ন্যায় নানারূপ সনাতন মিথ্যা ও আদিম অসভ্যতা তো বেঁচে আছে বিবেকের সে অসামর্থ্যের কারণেই। অপর দিকে নেক আমলে এবং সমাজ বিপ্লবে জিহবার সামর্থটিও বিশাল। ব্যক্তির জিহবা শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে কাজ করে সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে। বিবেক ও জিহবার সে সামর্থ্যের বলেই একজন ঈমানদার যেমন জনসম্মুখে কালেমায় শাহাদত পাঠ করে, তেমনি দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধেও আমৃত্য সৈনিক রূপে খাড়া হয়। প্রবল বিক্রমে সে প্রতি অঙ্গণে সাক্ষ্য দেয়, মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের পক্ষে। এরাই স্বৈরশাসকের নির্মূলে এবং সত্যদ্বীনের প্রতিষ্ঠায় নিজের জান ও মাল নিয়ে জিহাদে নামে।
নবী-রাসূলদের মূল কাজ তো ব্যক্তির বিবেক ও জিহবার সামর্থ্য বৃদ্ধি। এ কাজে মূল হাতিয়ারটি হলো পবিত্র ওহীর জ্ঞান। জ্ঞানের সে সমৃদ্ধিতেই ঘটে মানব জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লব। তখন ব্যক্তি খুঁজে পায় সিরাতুল মুস্তাকীম। জ্ঞান-সমৃদ্ধ বিবেকের সামর্থ্যেই ব্যক্তি পায়, সত্যকে চেনা ও জান্নাতের পথে চলার সামর্থ্য। নইলে মানুষ যেমন বিবেকহীন হয়, তেমনি মিথ্যাবাদী এবং দুর্বৃত্তও হয়। এমন বিবেকহীন মানুষই স্বৈরশাসকের সেবাদাসে পরিণত হয়। নবী-রাসূলগণ অর্থশালী ছিলেন না, তারা বড় বড় নেক কাজ করেছেন তাদের জ্ঞানসমৃদ্ধ বিবেক দিয়ে ও সাহসী জিহবা দিয়ে। তাঁরা জিহবাকে কাজে লাগিয়েছেন নির্ভয়ে জ্ঞানদানে ও সত্যের পক্ষে সাক্ষদানে। তাদের জ্ঞান-সমৃদ্ধ সে বিবেক ও জিহবা নিয়োজিত হয়েছিল অন্যায়, অসত্য ও স্বৈরাচার নির্মূলে। তাঁরা বীরদর্পে দাঁড়িয়েছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সে কাজ করতে গিয়ে হাজার হাজার নবী-রাসূল শহীদ হয়েছেন। সাহাবাগণ তাদের পথ বেয়েই সামনে এগিয়েছেন। এবং তাদের প্রচেষ্ঠাতেই নির্মিত হয়েছে মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।
আখেরাতে যারা জাহান্নামের বাসিন্দা হবে তাদের অধিকাংশ যে মানুষ খুন বা ব্যাভিচারের জন্য সেখানে যাবে -তা নয়। তারা সেখানে পৌঁছবে মিথ্যার পক্ষে সাক্ষী দেয়া এবং মিথ্যা-সেবী অপরাধীদের দলে শামিল হওয়ার কারণে। এরূপ মিথ্যা-সেবীদের খাসলত, তারা নিজেদের জিহবাকে ব্যবহার করে জালেম সরকারের পক্ষে জিন্দাবাদ বলায়। বিবেককে ব্যবহার করে জাতিয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়া, মিছিল করা ও ভোট দেয়ার কাজে। বাংলাদেশে রাজনীতির নামে এমন অপরাধই তো বেশী বেশী হচ্ছে। এখানেই বাঙালী মুসলিমের বিশাল ব্যর্থতা। সে ব্যর্থতার কারণে অপরাধী স্বৈরশাসকগণ যেমন সমর্থণ পায়, ভোট পায় এবং অর্থ পায়, তেমনি ভ্রষ্ট মতবাদ, দূষিত শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং শরিয়ত বিরোধী আইনও প্রতিষ্ঠা পায়। বস্তুতঃ এরূপ বিবেকহীনদের বিপুল সংখ্যার কারণেই বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুপক্ষের লোকবলের অভাব হচ্ছে না। এতে পরাজয় বাড়ছে যেমন ইসলামের, তেমনি পাপ বাড়ছে মুসলিমদের। কথা হলো, স্রেফ নামায-রোযা পালন বা মসজিদ-মাদ্রসা গড়ে কি পরকালে এ পাপের শাস্তি থেকে মুক্তি মিলবে?
বাংলাদেশের মুসলিমগণ বিশেষ করে আলেমগণ বেশী বেশী নবীজী (সাঃ)র সূন্নতের কথা বলে। প্রশ্ন হলো, নবীজী (সাঃ)র সূন্নত কি স্রেফ নামায-রোযা, হজ-যাকাত, দান-খয়রাত, লম্বা জোব্বা বা দাড়ি টুপি? সেটি কি স্রেফ মসজিদ-মাদ্রসার প্রতিষ্ঠা? সেটি তো জিহাদ। সেটি তো মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনী বিধানের প্রতিষ্ঠায় জানমালের কোরবানী। সেটি দুর্বৃত্ত শাসকের নির্মূল ও শরিয়তি শাসনের প্রতিষ্ঠা। একমাত্র এভাবেই তো আসে ইসলামের বিজয়। নবীজী (সাঃ)র সাহাবায়ে কেরামের যুগকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলা হয়। কিন্তু কেন সেটি সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ? সে আমলে আজকের ন্যায় এতবড় বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা ও এত মসজিদ-মাদ্রাসা ছিল না। তাদের গৌরবের মূল কারণ, একমাত্র তাদের আমলেই পূর্ণাঙ্গ ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ইসলামের শরিয়তি বিধান, হুদুদ,জিহাদ, খেলাফত ও শুরাভিত্তিক শাসন। এবং নির্মূল হয়েছিল স্বৈরাচারি অসভ্যতা। এটিই ছিল মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লব। সে বিপ্লব সফল করতে শতকরা ৭০ ভাগ সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। নবীজী (সাঃ) জিহাদের ময়দানে নেমেছেন এবং তিনি নিজে আহত হয়েছেন। বাংলাদেশের ওলামাগণ নবীজী (সাঃ)র প্রতি মহব্বত ও তাঁর সূন্নত পালনের কথা বললেও তাদের জীবনে সে সূন্নত নেই। পবিত্র কোরআনের জ্ঞান, ৫ ওয়াক্ত নামায, মাসব্যাপী রোযা, হজ-যাকাত, দান-খয়রাত ও নানারূপ ইবাদতের উদ্দেশ্য তো তেমন একটি নৈতীক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্য ঈমানদারকে প্রস্তুত করা। বাঙালী মুসলিমেদর দ্বারা সে কাজটি হয়নি। বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের শত্রুপক্ষের প্রতিপত্তি ও বিজয়ই বলে দেয়, ১৬ কোটি বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতাটি কত বিশাল। তাদের সে ব্যর্থতা আনন্দ বাড়িয়েছে ইসলামের শত্রুদের। আর শত্রুর বিজয় মুসলিম জীবনে দুঃসহ আযাব আনবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। ৮/৭/২০১৮; নতুন সংস্করণ ১৯/০৩/২০১৯ Tweet:@drfmkamal; facebook.com/firozkamal
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018