বাংলা সাহিত্যে মুসলিম বিদ্বেষ ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on June 18, 2021
- Bangla Articles, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
প্রেক্ষাপট: মুসলিম-বিদ্বেষ ও ইংরেজ-তোষণের
বাংলায় মুসলিম শাসনের বিলুপ্তির পর পরই মুসলিমদের দ্রুত পতন শুরু হয়। এবং জাগরণ শুরু হয় হিন্দুদের। হিন্দুদের সে জাগরণের পিছনে মূল কারণটি ছিল তাদের প্রতি ইংরেজদের অনুগ্রহ। ঔপনিবেশিক ইংরেজগণ সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল মুসলিমদের থেকে। ফলে মুসলিমদের তারা বন্ধু হিসাবে পাবে -সেটি ইংরেজগণ কোন কালেই ভাবতে পারিনি। বরং তাদের মনে ছিল মুসলিম ভীতি। মুসলিমদের দমিয়ে রাখার জন্য ভারতবাসীদের মধ্য থেকেই সাহায্যকারীর প্রয়োজন দেখা দেয়। সে কাজে তারা হিন্দুদের বেছে নেয়। এবং হিন্দুগণ সে কাজ আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করে। মুসলিম শাসনামলে বাংলার সিকিভাগ চাষাবাদ যোগ্য জমি মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ ছিল। সেগুলিকে বলা হতো লাখেরাজ সম্পতি অর্থাৎ যার কোন খেরাজ বা রাজস্ব দেয়া লাগতো না। ইংরেজগণ সে জমি ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দুদের দেয় এবং একটি জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করে। জমিদারদের কাজ হয় রাজভৃত্য রূপে ইংরেজ শাসনের প্রতিরক্ষা দেয়া। ফলে মুসলিম দমনে ইংরেজদের গ্রাম-গঞ্জে নামতে হয়নি, সে কাজ হিন্দু জমিদারগণই তাদের পাইক-পেয়াদা দিয়ে করতো। আর এতে হিন্দুদের প্রতি ইংরেজদের সাহায্য ও সহানুভূতির পরিমানও বেড়ে যায়।
বস্তুত এরূপ নিবেদিত-প্রাণ হিন্দু সেবক শ্রেণীর কারণেই ইংরেজদের নিজ দেশ থেকে বাড়তি সৈনিক আনতে হয়নি। অপরদিকে জমি কেড়ে নেয়ার কারণে মাদ্রাসাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শিক্ষিত মুসলিম পরিবারগুলি দ্রুত মুর্খ হতে শুরু করে। ব্রিটিশ দখলদারীর আগে মুসলিম তাঁতিদের হাতে তৈরী হতো বিশ্বের সেরা কাপড় মসলিন। সে বস্ত্র শিল্পের বিশ্বজুড়া বাজারের কারণে বাংলা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনি দেশ। বাজারে ব্রিটিশদের কাপড়ের বাজার বাড়ানোর লক্ষ্যে তাঁতীদের আঙ্গুল কেটে মসলিন শিল্প ধ্বংস করা হয়। বাংলা চাষীদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম। তাদের দিয়ে জোর করে নিল চাষ করানো হয়। এভাবে শিক্ষা ও অর্থনীতি –এ উভয় ক্ষেত্রেই মুসলিমদের নীচে নামানো শুরু হয়। এরই ফলে দ্রুত বাড়তে থাকে হিন্দুদের সাথে মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দূরত্ব। ব্রিটিশদের এরূপ মুসলিম-বিরোধী নীতির কারণে যে মুসলিম পরিবারের পক্ষে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে দরিদ্র ও অশিক্ষিত হওয়া অসম্ভব ছিল তাদের পক্ষে স্বচ্ছল ও শিক্ষিত থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ স্বাক্ষ্যটি এসেছে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের একজন স্কটিশ কর্মকর্তা মি. ডব্লিও ডব্লিও হান্টারের পক্ষ থেকে।
ইংরেজদের প্রতি ভক্তি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও শত্রুতা শুধু হিন্দু জমিদারদের নিজেদের বিষয় ছিল না, সে অভিন্ন চিত্রটি প্রবল ভাবে দেখা দেয় হিন্দু সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝেও। ভারতের ইতিহাসে অতি আলোচিত একটি পর্ব হলো বাঙালী রেনাসাঁ। আসলে সেটি ছিল বাঙালী হিন্দু রেনেসাঁ। সেটি ছিল ইংরেজদের সহায়তা নিয়ে এবং মুসলিমদের পিছনে ফেলে বাঙালী হিন্দুদের একক ভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। সেটি যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তেমনি অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে। শত শত বছর এক দেশ ও এক আলো-বাতাসে বসবাস করেও হিন্দুদের মনে মুসলিম বিদ্বেষ যে কতটা তীব্র -সেটিই প্রবল প্রকাশ পেয়েছে হিন্দুদের রচিত সাহিত্যে।
বাংলা সাহিত্যে গালিগালাজ: লক্ষ্য মুসলিমগণ
হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ মুসলিমদের প্রশংসা করে কোন ভাল শব্দ ব্যবহার করেছে সে প্রমাণ খুঁজে পাওয়া অতি কঠিন। বরং তাদের লেখনীতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গালিগালাজের পরিমাণটি অধিক। যে গালিগুলি মুসলিমদের বিরুদ্ধে সচারচর ব্যবহার করেছে তা হলো ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, পাষন্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর, ইত্যাদি। বঙ্কিম চন্দ্রের ‘মৃণালীনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজ সিংহ’ ও ‘কবিতা পুস্তক’, ইশ্বর গুপ্তের ‘কবিতা সংগ্রহ’ দামোদর মুখোপাধ্যয়ের ‘প্রতাপসিংহ’ যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যয়ের বঙ্গানুবাদিত ‘রাজস্থান’ দীন বন্ধু মিত্রের ‘জামাই বারিক’ ইত্যাদি ইসলাম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৯০৩ খ্রি.) কাব্যসজ্জায় সুস্পষ্ট মুসলমান বিদ্বেষ পাওয়া যায় । “হেমচন্দ্র তাঁর বীরবাহুতে (১৮৬৪ খ্রি.) লিখেছে, “আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর, পুরাব যবন-রক্তে শমন-খর্পর”। [ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭০]।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭ খ্রি.) পদ্মিনী উপাখ্যানে (১৮৫৮ খ্রি.) স্বাধীনতার কামনা, পরাধীনতার বেদনা ও দেশপ্রীতির সাথে সাথে প্রকাশ পায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্বেষের ভাব। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৯ তে প্রকাশিত অশ্রুমতী নাটক উৎসর্গ করেন অনুজ রবীন্দ্রনাথকে। এবং উক্ত নাটক ছিল মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। উক্ত নাটকের সৈন্যগণ বলছে, “আজ আমরা যুদ্ধে প্রাণ দেব, চিতোরের গৌরব রক্ষা করব, মুসলমান রক্তে আমাদের অসির জ্বলন্ত পিপাসা শান্ত করব”… (অশ্রুমতী: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক সমগ্র, সাহিত্য সংসদ,২০০২, পৃষ্ঠা ১১৩।)]।
অতিশয় মুসলিম বিদ্বেষী ও ইংরেজভক্ত ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধরত মুসলমানদের মৃত্যুতে প্রচণ্ড খুশী হয়ে তিনি রচনা করেন;
একেবারে মারা যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)
হাঁসফাঁস করে যত প্যাঁজ (পিঁয়াজ) খোর নেড়ে
বিশেষত: পাকা দাড়ি পেট মোটাভূড়ে
রোদ্র গিয়া পেটে ঢোকে নেড়া মাথা ফূড়ে
কাজি কোল্লা মিয়া মোল্লা দাঁড়িপাল্লা ধরি
কাছা খোল্লা তোবাতাল্লা বলে আল্লা মরি
ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মুসলিম বিদ্বেষের পাশাপাশি ব্রিটিশদের প্রতি ভক্তির মাত্রাটিও ছিল অতি উগ্র। তার একটি নমুনা দেয়া যাক। তিনি লিখেছেন: “ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয় মুক্তমুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।” –(দিল্লীর যুদ্ধ : গ্রন্থাবলী,পৃ. ১৯১)।]
বঙ্কিমচন্দ্র তার নিজের ভান্ডারের সবগুলি গালিগালাজ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছেন। ‘ম্লেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদের দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে দিতে বাদ রাখেনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসে এক মন্তব্যে বলেন, ‘‘ধর্ম গেল, জাত গেল, মান গেল, কূল গেল, এখনতো প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের (মুসলমানদের) না তাড়াইলে আর কি হিন্দুয়ানি থাকে’’। এমনকি গল্পের মাধ্যমে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার ইচ্ছাও প্রকাশ পেয়েছে এ উপন্যাসে; “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা মাধবের মন্দির গড়িব?” [আনন্দমঠ, তৃতীয় খন্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ]।
শুধু তাই নয়, “তিনি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ দানেশ খাঁকে দিয়ে মুসলমানদেরকে ‘শুয়ার’ বলে গালি দিয়েছেন। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে কতিপয় স্ত্রীলোককে দিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুখে লাথি মারার ব্যবস্থা করেছেন। ‘মৃণালিনী’তে বখতিয়ার খিলজীকে ‘অরণ্য নর’ বলেছেন। কবিতা পুস্তকে তিনি লিখেছেন, ‘‘আসে আসুক না আরবী বানর – আসে আসুক না পারসী পামর’’। (আফজাল চৌধুরীর শেষ কবিতা: মুকুল চৌধুরী, দৈনিক সংগ্রাম,ঈদসংখ্যা-২০১২)।
সাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু তাঁর রচিত সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম বিদ্বেষের প্রমাণ অঢেল। বিস্ময়ের বিষয় হলো, প্রতিবেশী মানুষের প্রতি মানুষের প্রতি ঘৃণা নিয়ে একজন মানুষ নবেল পুরস্কার পায় কি করে? তার বন্ধু মুসলিম বিদ্বেষী ব্রাহ্ম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি মুসলিম জাতি ও সমাজ সম্বন্ধে তার নানা লেখায় বরং বিরূপ মন্তব্যই করিয়াছেন। (বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা, মনিরা কায়েস, পৃ. ২৩)। শিবনারায়ণ রায় বলেছেন: “তিনি (রবীন্দ্রনাথ) কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই চর্চা করেননি। সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন.. (প্রতিক্ষণ, জুলাই ১৯৯৩, পৃ. ১৭)।” গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “ভালো মানুষি ধর্ম নয়; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মহম্মদ সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্ম প্রচার করেন নি।” (গোরা,পৃষ্ঠা ১৭)।”
রবীন্দ্রনাথ তার ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে মুসলিম চরিত্র হরণ করেছে এভাবে: “আল্লা হো আকবর” শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিন লক্ষ যবনসেনা, অন্যদিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য। হর হর বোম্ বোম্! পাঠক বলিতে পার, কে ঐ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশ জন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বজ্রের ন্যায় শত্রুসৈন্যের উপরে আসিয়া পতিত হইল? বলিতে পার, কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবনসৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল? কাহার বজ্রমন্দ্রিত ‘হর হর বোম্ বোম্’ শব্দে তিনলক্ষ ম্লেচ্ছকণ্ঠের “আল্লা হো আকবর” ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল? ইনিই সেই ললিতসিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র।”
‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে প্রতাপাদিত্যের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলাচ্ছেন- “খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।” রবীন্দ্রনাথের ব্রিটিশ-ভক্তি ও মুসলিম বিদ্বেষের নজির মেলে তাঁর ‘কণ্ঠরোধ’ (ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫) নামক প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, “কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে- উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষ রুপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে- ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলমান) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ খন্ড,৪২৮ পৃষ্ঠা)
ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও স্বজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনই এর উপস্থিতি স্বীকার করবে না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ভারতের রবীন্দ্রনাথ যাঁর পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিকতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তার কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, কোনও মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও একচ্ছত্রও লেখেননি। যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন।” (Dr. Romesh Chandra Majumder, History of Bengal, p 203.)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক চেতনার অতি উজ্বল দৃষ্টান্ত মেলে তাঁর ‘শিবাজী উৎসব্’ (১৯০৪) কবিতায়। ভারত জুড়ে তখন হিন্দু জাগরণের ঢেউ। সে ঢেউ বাংলাতেও এসে পড়ে। উল্লেখ্য হলো, মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক নামক একজন উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিলে সেখানে শিবাজী উৎসব চালু করেন। তার একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। সেটি হলো শিবাজীকে হিন্দু জাগরণের আদর্শ নেতা রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া। শিবাজী উৎসবের অনুকরণে চালু হয় গণপতি পূজা। গরু হত্যা বন্ধে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গো-রক্ষিণী সভা। মহারাষ্টের শিবাজী উৎসবের অনুকরণে কলকাতায় শুরু হয় শিবাজী উৎসব ১৯০২ সালের ২১ জুন তারিখে। শিবাজী উৎসবের মূল মন্ত্র ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষ, সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িকতা। সে সাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে রবীন্দ্রনাথও জড়িত হয়ে পড়েন। “শিবাজী উৎসব” কবিতাটি তারই দলিল।
শিবাজী উৎসবের সূত্র ধরেই বাংলায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির শুরু। তারই সূত্র ধরে এ বাংলাতেই জন্ম নেয় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা। পরবর্তীতে যা পরিণত হয় জনসংঘে এবং তার কিছুকাল পর আজকের বিজিপি’তে। “শিবাজী উৎসব” কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর কর্মকান্ড ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখেন: “কোন দূর শতাব্দের এক অখ্যাত দিবসে নাহি জানি আজ মারাঠার কোন শৈল অরণ্যের অন্ধকারে বসে হে রাজা শিবাজী তব ভাল উদ্ভাসয়া এ ভাবনা তরিৎ প্রভাবৎ এসেছিল নামি ‘একরাজ্যধর্ম পাশে খন্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেধে দিব আমি।” এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শিবাজীকে ভারতের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, খন্ড, ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল শিবাজীর জীবনের উদ্দেশ্য।
ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ও আর.এস.এস’য়ের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, ভারতের সকল মুসলিমই পূর্বসূত্রে হিন্দু। ফলে ফলে তাদেরকে ঘরে ফেরাতে হবে। এটিকে তারা বলে “ঘর ওয়াপসি”। অথচ এ ধারণাটি কবি রবীন্দ্রনাথই প্রথম চালু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: মুসলমানরা ধর্মে ইসলামানুরাগী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা ‘হিন্দু মুসলমান’। -(আবুল কালাম শামসুদ্দিনের লেখা অতীত দিনের স্মৃতি, পৃষ্ঠা: ১৫০)। মুসলিমদের হিন্দুতে ফিরিয়ে আনার জন্য যে কমিটি হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এই কমিটির কাজ ছিল নিম্নবর্ণের যেসব হিন্দু মুসলিম হয়েছিল তাদের আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেয়া।-(প্রশান্ত পালের লেখা রবি জীবনী: ৬ষ্ঠ খন্ডের ২০৭ এবং ২০৮ পৃষ্ঠা, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা)।
ভারতে বিধবা মহিলাদের মৃত স্বামীর চেতায় একত্রে জ্বালানোর অতিশয় নৃশংস রীতি চালু ছিল। রাজা রাম মোহন রায় এবং ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত অনেকেই এ নিষ্ঠুর প্রথা রোধে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ দেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সতীদাহ প্রথাকে সমর্থন করে কবিতা লিখেছেন। এই হলো রবীন্দ্রনাথের বিবেক ও মানবতার মান! মুসলিমগণ যেহেতু সতিদাহ প্রথাকে নিন্দা করতো, তাতে রবীন্দ্রনাথের রাগ গিয়ে পড়ে মুসলিমদের উপর। তিনি তার কবিতায় মুসলিমদের যবন বলে গালি দেন। সে কবিতাটি হলো: “জ্বল জ্বল চিতা! দ্বিগুন দ্বিগুন পরান সপিবে বিধবা বালা জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন জুড়াবে এখনই প্রাণের জ্বালা। শোনরে যবন, শোনরে তোরা, যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে, স্বাক্ষী রলেন দেবতার তার, এর প্রতিফল ভুগিতে হবে।”
কোন বিবেকবান মানুষ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ করেছেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে এক সমাবেশ হয়। ঠিক তার দু’দিন পূর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেওয়া যাবে না। উক্ত উভয় সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ( তথ্যসূত্র: কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ হাজরা, ২য় খণ্ড, ৪র্থ পর্ব)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সেদিন ময়দানে নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলো, হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতারা। গিরিশচন্দ্র ব্যানার্জী, রাসবিহারী ঘোষ এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে বাংলার এলিটরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি দেন লর্ড হার্ডিঞ্জকে এবং বড়লাটের সঙ্গে দেখা করেন। (ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কমিশন রিপোর্ট, খ- ৪, পৃ. ১৩০)।
সাম্প্রদায়িক শরৎচন্দ্র ও অন্যরা
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের লেখাতেও প্রচুর মুসলিম বিদ্বেষ। তার হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রমাণ মেলে “বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা” নামক প্রবন্ধে। উক্ত প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুসলিমদের পাণ্ডা বলে সম্বোধন করেন। তিনি লিখেছেন: “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। হিন্দু-মুসলমান-মিলন একটা গালভরা শব্দ। বস্তুত, মুসলমান যদি কখনও বলে, হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুতঃ অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই।” তাই তাকে নিয়ে আহমদ ছফা বলেছেন, “এই রকম সাম্প্রদায়িক রচনা শরৎবাবুও লিখতে পারেন আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে” (যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ৫৬)।
হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখায় মুসলিম বিদ্বেষ ও হিন্দুত্ব এতটাই প্রকট ছিল যে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন,“কি পরিতাপের বিষয় আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাশেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তাহা পড়িতে পায় না। এখন হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে রাম-লক্ষণের কথা,কৃষ্ণার্জ্জনের কথা, সীতা-সাবিত্রির কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে। সম্ভবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের বড় লোক নেই। এই সকল পুস্তুক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ব বিহীন করা হয়। বুদ্ধদেবের জীবনী চারপৃষ্ঠা আর হযরত মোহম্মদ (সা:) এর জীবনী অর্ধপৃষ্ঠ মাত্র। অথচ ক্লাসে একটি ছাত্রও হয়তো বৌদ্ধ নহে। আর অর্ধাংশ ছাত্র মুসলমান।.. মূল পাঠ্য ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের সম্বদ্ধে অগৌরবজনক কথা প্রায় ঢাকিয়া ফেলা হয়,আর মুসলমানদিগের বেলা ঢাকঢোল বাজাইয়া প্রকাশ করা হয়। (আমাদের (সাহিত্যিক) দারিদ্রতা, মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জৈষ্ঠ ১৩২৩, সংগ্রহে মুস্তফা নুরউল ইসলামঃ সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত, পৃঃ ৩০-৩১)।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018