বাঙালি মুসলিমের মূল সমস্যাটি কোথায়?

ফিরোজ মাহবুব কামাল 

সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম এবং সবচেয়ে বড় অপরাধকর্ম প্রসঙ্গ

মানব জীবনের সবচেয়ে বড় নেক কর্ম ও সবচেয়ে অপরাধকর্মটি ঘটছে পবিত্র কুর’আনকে ঘিরে। নবীজী (সা)‌’র প্রসিদ্ধ হাদীস, “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ যে কুর’আন শেখে এবং অন্যদের শেখায়।” এ হাদীসে নবীজী (সা)সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ হাদীসটির গুরুত্ব এ জন্যই অপরিসীম। বাঙালি মুসলিমগণ কতটা ব্যর্থ এবং কতটা সফল -সেটির যাচাইয়ে এই হাদীসটি ব্যবহৃত হতে পারে মানদণ্ড রূপে। নবীজী (সা:‍)’র সাহাবাগণ হলেন এ মানদণ্ডে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। কারণ কুর‌’আন নিজে শেখা ও অন্যদের শেখানোর ব্যাপারে তারাই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। এ কাজে আত্ম নিয়োগ করেছেন শতকরা শত ভাগ সাহাবী। তারাই ছিলেন মুসলিম উম্মাহর ড্রাইভিং সিটে। ফলে তাদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হয়েছে। এমন কি সাহাবাদের পরবর্তী গৌরব যুগের মুসলিমদের সাফল্যটিও বিশাল। কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনের তাগিদে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মত দেশের নবদীক্ষিত মুসলিমগণ নিজেদের মাতৃভাষাকে কবরে পাঠিয়ে পবিত্র কুর’আনের ভাষাকে নিজেদের ভাষা রূপে গ্রহণকরেছেন।

অথচ এ মানদণ্ডে বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। ক‌’জন বাঙালি মুসলিম কুর’আন বুঝে এবং অন্যদের বুঝায়। শতকরা একজন দূরে থাক, প্রতি হাজারে একজনও কি? সর্বশ্রেষ্ঠ সে নেক কর্ম নিয়ে ক’জন বাঙালি মুসলিমের রয়েছে আগ্রহ? সে শ্রেষ্ঠ মানুষটি ক’জন হতে চায়?  সে সাথে প্রশ্ন হলো, কাউকে কুর’আন শেখানোর অর্থ কি তাকে না বুঝে স্রেফ তেলাওয়াত শেখানো? অথচ বাংলাদেশে কুর‌’আন শিক্ষা বলতে সেটিই বুঝানো হয়। তাই পুরা কুর’আনের তেলাওয়াত শেষ হলে ঘরে কুর’আন খতমের উৎসব হয়। এটি তো শেখানোর বদলে মুর্খ রাখার কৌশল। এরূপ মুর্খতা নিয়ে বাঁচলে তো শয়তান খুশি হয়। তাতে শয়তান ও তার অনুসারীদের বিজয় বাড়ে। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে।  

মুর্খ থাকার অর্থ কোন কিছু বার বার পড়েও সেটি বুঝতে না পারা। এতে অজ্ঞতা দূর হয়না। এটি তো গুরুতর অপরাধকর্ম। অথচ সে অপরাধ কর্মটি হচ্ছে পবিত্র কুর’আনের বিরুদ্ধে। ডাক্তারি বই না পড়ে যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, তেমনি কুর’আন না বুঝে মুসলিম হওয়া যায় না। এজন্য নামাজ ফরজ হওয়ার ১১ বছর আগে কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। ইকরা তাই পবিত্র কুর’আনের প্রথম নাযিলকৃত শব্দ। ইসলামের প্রথম জিহাদটি শুরু হয় এই জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে। কোন কিছু শেখার অর্থ তো সেটি সঠিক ভাবে বুঝতে শেখা ও সেটি প্রয়োগ করতে শেখা। দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে কুর’আনের রোডম্যাপকে বিজয়ী করার লড়াইয়ে যে ব্যক্তি নাই -বুঝতে হবে কুর’আন থেকে শিক্ষা নেয়ার কাজটি তার জীবনে ঘটেনি। বুঝতে হবে, এমন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ডিগ্রিধারি হলেও সে একজন নিরেট জাহিল তথা মুর্খ। বাংলাদেশের রাজনীতি,বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণ তো এমন জাহিলদের দিয়ে পরিপূর্ণ। এরাই বাংলাদেশের ড্রাইভিং সিটে। এদের কারণেই দেশ দ্রুত নীচে নামছে।

কুর’আন বুঝা, তা নিয়ে ভাবা এবং কুর’আনের বাণীকে নিজ স্মরণে সর্বত্র জাগ্রত রাখার উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা সুরা ক্বামারে একই আয়াত ৪ বার নাযিল করেছেন। তা থেকে বুঝা যায়, এই আয়াতের গুরুত্ব কত অপরিসীম। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমরা কুর‌’আনকে সহজ করে পেশ করেছি যাতে মানুষ তা নিয়ে ভাবে এবং স্মরণে রাখে ও সাবধান হয়, কিন্তু এমন কেউ কি আছে যারা তা নিয়ে ভাবে, সাবধান হয় এবং শিক্ষা নেয়?” কি বিস্ময়! মহান আল্লাহতায়ালা যেখানে কুর’আন নিয়ে ভাবা, কুর’আনের বাণীকে স্মরণে রাখা ও সাবধান হওয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে বাঙালি আলেমদের পক্ষ থেকে না বুঝে তেলাওয়াতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এভাবে বিদ্রোহ হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে। এরূপ বিদ্রোহে কি কখনো ছওয়াব মেলে? তাছাড়া বুঝার কাজটি না হলে তা স্মরণে রাখা, তা থেকে শিক্ষা নেয়া ও সাবধান হওয়ার কাজটিই বা কীরূপে সম্ভব? বাঙালি মুসলিমদের সকল ব্যর্থতা মূল কারণটি এখানেই। তাদের ঔদ্ধত্য ও অহংকার এতোটাই প্রচণ্ড যে তারা ভাবে ভাল মানুষ হওয়া ও ভাল মুসলিম হওয়ার কাজটি কুর’আন না বুঝে ও তা থেকে শিক্ষা নিয়েই সম্ভব। ভাবে, সামনে এগুনোর জন্য মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপের অনুসরণের প্রয়োজন নাই। অথচ সেটি যে কখনোই হওয়ার নয় সেটি অতীতে যেমন বহুবার বহু দেশে প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশীও প্রকট ভাবে প্রমাণ করছে। সেটি দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়ে।       

খাদ্যাভাবে, অর্থাভাবে বা রোগভোগে কাউকে নিহত হতে দেখে হৃদয়বান মানব মাত্রই তার উপর সদয় হয়। সে বিপদ থেকে বাঁচাতে খাদ্যদান, অর্থদান ও চিকিৎসাদানে উৎসাহী হয়। প্রতি দেশে দান-খয়রাতের এটিই হলো সবচেয়ে বড় খাত। কিন্তু মানব জীবনে তার চেয়েও গুরুতর ও ভয়ানক বিপদটি ঘটে অন্য ভাবে। সেটি ঘটে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানের অভাবে। অনাহারে, দুর্ঘটনায় বা রোগে-ভোগে মারা যাওয়াতে কোন মানুষই জাহান্নামে যাবে না। নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান না থাকায় এবং থাকলেও সে জ্ঞানের পথ অনুসরণ না করায়। অথচ সে বিপদটি শত শত কোটি মানুষের জীবনে নিরবে ঘটে যাচ্ছে। এটিই হলো মানব জাতির  সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক বিপদ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ মানুষ সে ভয়ানক বিপদটির বিষয় অনুধাবন করে না। কোন মানব সন্তান আগুনে বা পানিতে পড়লে তা থেকে উদ্ধার করার সর্বাত্মক চেষ্টা হয়। কিন্তু মানুষ যে জাহান্নামের পথে মিছিল বেধে ছুটে চলছে তা থেকে উদ্ধাবের চেষ্টা নাই।

মানবের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি হাজার কোটি টাকা দানে হয় না; সেটি হয় জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোতে। এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠতম সূন্নত। এ সূন্নত পালনের দায়ভার দিয়ে তিনি লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাদের কাছে ফেরেশতার মাধ্যমে ওহীর জ্ঞান পাঠিয়েছেন। মহান আল্লাহতায়ালার এই শ্রেষ্ঠতম সূন্নত নিয়ে বাঁচার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ইবাদত আর কি হতে পারে? এরচেয়ে সর্বাধিক ছওয়াবে কাজই বা কি আছে? অন্য কোন নেক আমলে এতো বড় কল্য়াণের কাজটি হয়না। যারা মহান আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় ছওয়াব বা পুরস্কারটি চায়, তারা তো নিজেদের শ্রেষ্ঠতম সামর্থ্যের বিনিয়োগ করে সে কল্যাণ কর্মে। সে শ্রেষ্ঠতম ইবাদত ও সে শ্রেষ্ঠতম ছওয়াবের কাজ নিয়ে বাঁচার প্রবল তাড়না দেখা গেছে সাহাবায়ে কেরাম ও গৌরব যুগের মুসলিমদের জীবনে। অগণিত মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে তারা হাজারো মাইল দূরের নানা দেশে এবং নানা জনপদে পৌঁছেছেন। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, মরুভূমি, নদী বা সাগরের বাধা তাঁরা মানেননি। মিথ্যা-ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধও লড়তে হয়েছে। সেসব যুদ্ধে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো সর্ববৃহৎ উদ্ধার-কর্ম। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা উদ্ধার করেছেন জাহান্নামের আগুন থেকে। অন্য কোন ধর্মের অনুসারিগণ মানব জাতির এতো বড় কল্যাণের কাজটি করেনি। গৌরব যুগের এই মুসলিমগণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশের বহু কোটি মানবকে শুধু মুসলিমই করেননি, তাদের মাঝে জান্নাতের রোডম্যাপ তথা কুর’আন বুঝার তাড়নাও সৃষ্টি করেছেন। সে প্রবল তাড়ানার কারণেই মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সুদান, মরক্কো, লিবিয়া, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া ও মৌরতানিয়ার ন্যায় বহু দেশের মানুষ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে কুর’আনের ভাষাকে গ্রহণ করেছে।

 

প্রচণ্ড ব্যর্থতা  সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকর্মে

কিন্তু সে সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যার্ণ-কর্মের তাড়নাটি সাধারণ বাঙালি মুসলিম দূরে থাক, এমন কি বাঙালি আলেমদের মাঝেও দেখা যায় না। সেটি বুঝা যায় মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত পালনে তথা পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানদানে আগ্রহের অভাব দেখে। আলেমগণ ভাবেন, পবিত্র কুর’আনের তেলাওয়াত শিখিয়েই তারা দ্বীনের বিশাল খেদমত করছেন। তারা বলে, না বুঝে পড়াতেই অনেক ছওয়াব। কিন্তু তারা বলে না যে, মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা কুর’আন বুঝা ফরজ করেছেন, কুর’আন তেলাওয়াত নয়। তাদের পক্ষ থেকে বহু কাল যাবত এরূপ ভূল শিক্ষা দেয়ার কারণে বাংলাদেশে কুর’আন শিক্ষা বলতে বুঝায় কুর’আন তেলাওয়াত শেখা, কুর’আন বুঝা নয়। ফলে কুর‌’আন বুঝায় প্রবল আগ্রহের কারণে প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ যেমন নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে আরবী ভাষা শিখেছেন সেরূপ আগ্রহ বাঙালি মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে না। কারণ, তারা পরকালের অনন্ত জীবন নিয়ে চিন্তিত নয়, প্রবল আগ্রহ স্রেফ খণ্ডকালীন পার্থিব জীবনকে সফল করা নিয়ে। ফলে প্রচণ্ড মনযোগী ইংরাজী বা অন্য ভাষা শেখা নিয়ে, কুর’আনের ভাষা বুঝা নিয়ে নয়। এক্ষেত্রে গৌরব যুগের মুসলিম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। এর পরিনামটি ভয়াবহ। তারা ব্যর্থ হচ্ছে কুর’আন থেকে শিক্ষা নিতে। এবং পথ চলছে কুর’আনী রোড ম্যাপ ছাড়াই। ফলে বহুকোটি বাঙালি মুসলিম নিয়মিত কুর’আন তেলাওয়াত করেও ব্যর্থ হচ্ছে সিরাতাল মুস্তাকীম অনুসরণ করতে। ফলে ব্যর্থ হচ্ছে জান্নাতের পথ পেতে। এরাই তো পথভ্রষ্ট -পবিত্র কুর’আনের ভাষায় দোয়াল্লিন। তেমন একটি ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশে বাজার পেয়েছে জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদ এবং বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়তী বিচার ব্যবস্থা, কুর’আন শিক্ষা এবং ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ। বিলুপ্ত হয়েছে ঐক্য।   

সিরাতাল মুস্তাকীম কাকে বলে এবং তার আলামতগুলি কি কি -তা দেখিয়ে গেছেন মহান নবীজী (সা:)। সেটি তো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, কুর’আনী জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জন, আদালতে শরিয়তী বিচার, দুর্বৃত্ত নির্মূলের জিহাদ এবং বিশ্ব মুসলিম ঐক্য। অথচ সেরূপ ইসলাম বাংলাদেশে বেঁচে নাই। দেশটিতে সুবিচারের প্রতিষ্ঠা না দিয়ে বরং শাসকের মসনদে বসানো হয়েছে চোরডাকাত, ভোটডাকাত, খুনি, ধর্ষক, মিথ্যাচারি ও অর্থপাচারকারি দুর্বৃত্তদের। ফলে ইসলামের প্রতিষ্ঠা দেয়া দূরে থাক, ইসলামকে বিজয়ী করার পক্ষে সংগঠিত হওয়াও দেশটিতে অপরাধ। ভোটডাকাতকে ভোটডাকাত বললেও জেলে নেয়া হয়।

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতাটিও বিশাল। বাংলাদেশের আলেমদের বিশাল ব্যর্থতা সে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতাটি বুঝে উঠাতেও। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনের কাজটি যথার্থ ভাবে করতে হলে সেটি করতে হয় আরবী ভাষা শিখে। কারণ মহান আল্লাহতায়ালা যে ভাষায় তাঁর বান্দার সাথে কথা বলতে চান সেটি সরাসরি বুঝতে হয় তাঁর নিজের ব্যবহৃত ভাষা থেকে। কুর’আনের অনুবাদ পড়ে অনুপ্রাণিত হওয়া যায় না। কারণ, পবিত্র কুর’আনের মধ্যে যে প্রবল ইমোশনাল ফোর্স -সেটিকে তরজমা করা যায় না। সে ইমোশনাল ফোর্সই পাঠকের আত্মাকে কাঁপিয়ে তোলে এবং ঈমানে জোয়ার তুলে। সেটির প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে সুরা আনফালের ২ নম্বর আয়াতে। পবিত্র কুর’আনের সে বোধ পাঠককে কাঁদায়; তাঁর চেতনায় ঝড় তোলে। প্রবল ভাবে আন্দোলিত করে তাঁর বিবেককে। কুর’আনের এমন পাঠ কখনোই নীরব ও নিষ্ক্রিয় হতে পারে না, বরং এক বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হয়। সেটিই দেখা গেছে সাহাবাদের জীবনে। কুর’আনকে তার নিজের ভাষাতে বুঝার তাগিদেই বহু দেশের অনারাব জনগণ তাদের মাতৃভাষা বর্জন করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিল।

অথচ বাংলাদেশে পবিত্র কুর’আন বুঝার কাজটিই হয়নি। ফলে কুর’আন অজানা রয়ে গেছে বহু কোটি বাঙালি পাঠকের কাছে। কুর’আনকে তার নিজস্ব ভাষায় বুঝার কাজটিই হয়নি। কুর’আন শিক্ষার নামে এতো কাল যা কিছু হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তা হলো না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াত। এতে কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা নেয়ার কাজটি হচ্ছে না। ফলে বার বার কুর’আন পাঠ করেও সে পাঠক কুর’আনের মিশন নিয়ে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃ্ত্তির ময়দানে জিহাদে নামে না। এভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে পবিত্র কুর’আন। কুর’আনকে এরূপ উপেক্ষা করা কি কম অপরাধ? ধ্বংস, পতন ও আযাব প্রাপ্তির জন্য এমন একটি অপরাধই কি যথেষ্ট নয়? লক্ষণীয় হলো, মাহে রমজানের রোজা ফরজ করতে পবিত্র কুর’আনে একটি মাত্র আয়াত নাযিল হয়েছে। সেটি সুরা বাকারায়। তাতেই মুসলিমদের উপর রোজা ফরজ হয়ে গেছে। অথচ কুর’আন বুঝা এবং কুর’আন থেকে জ্ঞানসংগ্রহের হুকুম এসেছে অসংখ্যবার। অথচ কোন কিছু ফরজ হওয়ার জন্য কোন হুকুম পবিত্র কুর’আনে একবার ঘোষিত হওয়াই যথেষ্ট। কুর’আন বুঝার সে ফরজ পালিত না হলে কি অন্য ফরজগুলি যথার্থ ভাবে পালিত হয়?  

বাংলাদেশে অনেক আলেম। কিন্তু বাংলা ভাষায় পবিত্র কুর’আনের প্রথম অনুবাদ কোন আলেম করেননি, বরং করেছেন ভাই গিরিশ চন্দ্র নামক একজন হিন্দু। কোন আলেম অনুবাদ করে থাকলেও সেটি সাধরণ মানুষের নজরে পড়েনি। অথচ কুর’আন হলো মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আর এই হলো এই সর্বশ্রেষ্ঠ দানের সাথে বাঙালি মুসলিমদের আচরণ! আলেমদের গর্ব এবং সে সাথে প্রচণ্ড অহংকারও যে, তাদের কারণেই বাংলাদেশে ইসলাম বেঁচে আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা যে ইসলামকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সেটি কি কুর’আনী ইসলাম তথা নবীজী (সা:)’র ইসলাম?  নবীজী (সা:)’র ইসলাম বাঁচলে তো প্রতিষ্ঠা পেত কুর’আনী জ্ঞান। প্রতিষ্ঠা পেত ইসলামী রাষ্ট্র। তখন আদালতে বিচারকার্য পরিচালিত হতো শরিয়তী আইনে। প্রতিষ্ঠা পেত জিহাদ, শুরা-ভিত্তিক শাসন ও ঐক্য। এবং আদালত থেকে বিলুপ্ত হতো কাফিরদের প্রণীত আইন, বিলুপ্ত হতো পতিতাপল্লী, জুয়া, ঘুষ ও নানারূপ দুর্বৃত্তি। কিন্তু এর কোনটাই অর্জিত হয়নি। বরং সে লক্ষ্যে কোন চেষ্টাও নাই। বেঁচে আছে নবীজী (সা:)’র সেই আদি কুর’আনী ইসলাম? অতএব আলেমদের কৃতিত্ব কোথায়?

ইসলামের নামে আজ যা বেঁচে আছে তা হলো মাজহাবতন্ত্র, পীরতন্ত্র, ফিরকাতন্ত্র, মাজারপূজা, মিলাদ, ওরশ, ইত্যাদি। নবীজী (সা:)’র আমলে কি এসব ছিল? মসজিদ-মাদ্রাসা-মকতব গড়ার মধ্য দিয়ে চলছে একপাল বেতনভোগী চাকুরীজীবী প্রতিপালন। ইসলামের নামে রাজনৈতিক দল গড়ে চলছে মন্ত্রী, এম.পি, মেয়র, চেয়ারম্যান ও মেম্বর হওয়ার লড়াই। সে লড়াইয়ে জিতবার জন্য এমন কি শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বিরোধী সেক্যুলারিস্ট দলগুলোর সাথে কোয়ালিশনও গড়া হয়। শরিয়তকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কোন জিহাদ নাই। অথচ সাহাবাগণ নিজ অর্থে ঘোড়া, অস্ত্র ও খাদ্য সংগ্রহ করে জিহাদে যেতেন। নবীজী (সা:) ওয়াজ করতে গিয়ে গালী ও পাথর খেয়েছেন। অথচ আলেমদের অবস্থা এমন, অর্থ না দিলে তারা ওয়াজ করেন না। মসজিদে চাকুরি না দিলে নামাজের ইমামতি করেন না। অর্থ না দিলে জানাজায় আসেন না। পার্থিব প্রশ্ন হলো, সাহাবাদের আমলে কেউ কি অর্থ নিয়ে ওয়াজ করতেন বা চাকুরি নিয়ে ইমামতি করতেন? নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের সে শিক্ষা আলেমদের মাঝে কই?

নামাজে ইমামতি ও জলসায় ওয়াজ কখনোই অর্থ-উপার্জনের মাধ্যম হতে পারে না। অর্থ নেয়ার অর্থ তো সেটিকে ব্যবসায় বানিয়ে নেয়া। সেটি বনি ইসরাইলের আলেমদের সূন্নত। সেটি নবী (সা:) ও তাঁর মহান সাহাবাদের সূন্নত নয়। নামাজ-রোজার ন্যায় ইমামতি ও ওয়াজ করা ইবাদত। ইবাদতে মুজুরী থাকে না, বরং সওয়াব থাকে -যা পরকালে জুটবে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। যে ব্যক্তির নিজ সামর্থ্যে উপার্জন করে সংসার চালানোর যোগ্যতা নাই, সে তো সমাজে বড়ই অযোগ্য ব্যক্তি। এমন অযোগ্য ব্যক্তি ইমাম হয় কি করে? ওয়াজই বা করে কি করে? আলেমদের অবশ্যই নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের সূন্নতের দিকে ফিরে যেতে হবে। নইলে নবীজী (সা)’র ইসলাম প্রতিষ্ঠা পাবে না। তাদের সূন্নত তো এটাই, সংসার চালানোর জন্য তারা কোন পেশা বেছে নিবে এবং পেশাদারী কাজের ফাঁকে এসে মসজিদে এসে নামাজ পড়াবে। মুসল্লীগণ যদি তাদের পেশাদারী কাজের ফাঁকে মসজিদে এসে জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারে -তবে সেটি ইমামগণ কেন পারবে না? ইমামমতি করার জন্য যদি অর্থ দিতে হয়ে, তবে যারা ইমামের পিছনে নামাজ মুক্তাদী হয় তাদের কেন অর্থ দেয়া হবে না? ইমাম তো একই রূপ রুকু-সিজদা করে এবং নামাজে একই পরিমান সময় দেয় -যা একজন মুক্তাদী করে বা দিয়ে থাকে। ইমাম ছাড়া যেমন নামাজ হয় না, তেমন মুক্তাদী না হলেও তো নামাজ হয়না। ইমাম আবু হানিফা যদি কাপড়ের ব্যবসা করে ইমামে আজম হতে পারেন, তবে ইমামগণ এরূপ উপার্জনে নামেন না কেন? বাস্তবতা হলো, এরূপ পরনির্ভর আলেমদের কারণেই দেশটিতে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে ধর্মের নামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *