বাঙালি মুসলিমের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on May 14, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
নির্মূলের রাজনীতি এবং চলমান যুদ্ধ
নির্মূলের রাজনীতি কোন দেশেই শান্তি আনে না, বরং যুদ্ধ আনে। বাংলাদেশে ভারতসেবী আওয়ামী স্বৈরচক্রের এ যুদ্ধটি শুধু বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধ নয়, বরং সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধেও। কারণ, সরকারবিরোধীগণ তো জনগণেরই অংশ। এবং এ যুদ্ধে প্রচুর ঘি ঢালছে ভারত। কারণ, ভারতের স্বার্থ এ যুদ্ধকে তীব্রতর করার মধ্যে। বাংলাদেশকে দুর্বল করা ও ভারতের পদানত করার হাতিয়ার হলো এই যুদ্ধ। বাংলাদেশের সকল অশান্তি ও নাশকতার মূলে হলো নির্মূলমুখী এই রাজনীতি ও যুদ্ধ। অথচ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এরূপ নির্মূলমুখী যুদ্ধ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর হয়নি। কংগ্রসের ন্যায় যেসব সংগঠন পাকিস্তান সৃষ্টির প্রবল বিরোধীতা করেছিল তারাও সেদিন রাজনীতির অধিকার হারায়নি। ফলে পাকিস্তানের মাটিতে মনরঞ্জন ধর ও ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের ন্যায় বহু কংগ্রেস নেতা স্বাধীন ভাবে রাজনীতি করেছেন। তারা পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যপদ হারাননি। পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধী বলে এক দিনের জন্যও তাদের কারাবন্দী করা হয়নি।
অথচ বাংলাদেশ সৃষ্টির পর যুদ্ধ শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে -যারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। অথচ তারা কখনোই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন না। তারা বরং অখণ্ড পাকিস্তানে থাকার মাঝে বাঙালি মুসলিমদের অধিক নিরাপত্তা, অধিক স্বাধীনতা ও অধিক কল্যাণ দেখেছিলেন। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলাকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মাঝে কল্যাণ দেখলে মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রজ্ঞাবান নেতাগণ ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ বানাতেন। মুসলিম লীগ নেতাগণ তখন মনে করতেন, পাকিস্তানে যোগ না দিলে শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল পূর্ব বাংলাকে আরেকটি অধিকৃত কাশ্মীর বা হায়দারাবাদ হতে হতো। হিন্দুত্বের সে গোলামী সহজে শেষ হতো না। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সকল নেতাদের সাথে শেখ মুজিব নিজেও ১৯৪৬’য়ের পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের সাথে একাত্ম হয়েছিলেন এবং নিজে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” য়ের লড়াইয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। প্রশ্ন হলো, যে স্বাধীনতার যে বয়ান ১৯৪৭’য়ে সত্য ছিল, সে বয়ান ১৯৭১’য়ে এসে মিথ্যা হয় কি করে? ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানে পক্ষ নেয়া যদি প্রশংসিত হয়ে থাকে তবে ১৯৭১’য়ে সে সিদ্ধান্ত নিন্দনীয় হয় কি করে?
শেখ মুজিব ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানপন্থী দলগুলিকে স্বাধীনতার শত্রু রূপে আখ্যায়ীত করে নিষিদ্ধ করেন। দলগুলির নেতাদের কারাবন্দী করেন। এ ছিল মুজিবের মিথ্যাচারের অপরাজনীতি। যেমন মিথ্যাচার করেছেন একাত্তরে ৩০ লাখ নিহতের কথা বলে। ১৯৪৭’য়ে রাজনীতির ময়দানে যে বয়ান শোনা যেত ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মুখে -একাত্তরের পর অবিকল সে অভিন্ন বয়ানই ধ্বনিত হতে থাকে শেখ মুজিব ও তার সাথীদের মুখে। মুসলিম লীগের রাজনীতি চিত্রিত হতে থাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রূপে। এবং পাকিস্তানকে বলা হয় ব্রিটিশ-সৃষ্ট এবং মুসলিম লীগকে বলা হয় ব্রিটিশ স্বার্থের ক্রীড়ানক। এবং কংগ্রেসের রাজনীতিকে বলা হয় প্রগতিশীল রাজনীতি। অথচ এ কথা বলা হয় না, মুসলিম লীগের কারণেই বাঙালি মুসলিমগণ মুক্তি পেয়েছে হিন্দু জমিদারদের শোষণ-নির্যাতন থেকে এবং পেয়েছে জমির উপর মালিকানা। এ কথাও বলে না, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কারণেই একমাত্র ঢাকা শহরে যতজন মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, প্রশাসক, শিল্পমালিক, সামরিক অফিসার, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বসবাস করে তা ভারতের ২২ কোটি মুসলিম বিগত ৭৫ বছরেও তৈরী করতে পারিনি। কারণ ভারতীয় মুসলিমদের সে সুযোগ দেয়া হয়নি। পরিকল্পিত ভাবে তাদেরকে শিক্ষা, সরকারি চাকুরি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এবং যেখানেই তারা নিজ উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছু উন্নতি করে সেখানে দাঙ্গা বাধিয়ে সেগুলি নির্মূল করা হয়। পাকিস্তান কোন ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না। দেশটি শাসিত হয়েছে সেক্যুলারিস্টদের দ্বারা। তা সত্ত্বেও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাবমুক্ত হওয়া মুসলিমগণ শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দ্রুত সামনে এগুনোর সুযোগ পায়। সেরূপ সুযোগ ভারতীয় মুসলিমগণ ভাবতেও পারে না।
ক্ষমতাসীন হয়েই শেখ মুজিবের এজেন্ডা হয়, নিজের রাজনৈতিক শত্রুদের নির্মূল। তিনি আস্থা হারান তাঁর নিজ জনপ্রিয়তার উপর। আস্থা হারিয়ে ফেলেন নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপর। ফলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেন একজন নৃশংস ফ্যাসিস্ট শাসক রূপে। শুরু করেন বিরোধীদের বিরুদ্ধে গুম, জেল-জুলুম ও বিচার বহির্ভুত হত্যা। নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি দেশের পুলিশের উপর নির্ভর করতে পারেননি। নিজের অনুসারীদের দিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল রক্ষিবাহিনী। অথচ পাকিস্তানের ২৩ বছরে এরূপ বাড়তি সশস্ত্র বাহিনী গড়ার প্রয়োজন পড়েনি। সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরু হয় সর্বহারা পার্টির ন্যায় বামপন্থীদের নির্মূলে। রীতিমত যুদ্ধ হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)’য়ের নির্মূলেও। মুজিব নিজের জন্য গণতান্ত্রিক ভাবে বিদায়ের সকল রাস্তাই নিজ হাতে বন্ধ করেছিলেন। এতে তার নিজের জন্যও ফলটি ভাল হয়নি; তাকে বিদায় নিতে হয়েছে অগণতান্ত্রিক রক্তাক্ত পথে। গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখলে তাকে এরূপ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতো না। তিনি গদি হারাতেন, কিন্তু তাঁকে ও তার পরিবারকে প্রাণ হারাতে হতো না। বিরোধীদের বিনা বিচারে হত্যা ও গণতন্ত্র হত্যার অপরাধের শাস্তি থেকে মুজিব তাই রেহাই পাননি। শেখ হাসিনাও তাঁর পিতার পথ ধরেছে। শেখ মুজিবের ন্যায় শেখ হাসিনাও নিজের জন্য গণতান্ত্রিক ভাবে বিদায়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সেটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথকে বন্ধ করে। হাসিনার কাছে নির্বাচন মানেই ভোটডাকাতি -সেটি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। হাসিনার এভাবে নিজেকে জনগণের প্রতিপক্ষ রূপে খাড়া করেছে।
রাজনীতির এজেন্ডা যখন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আগ্রাসী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় বিদেশী শক্তির এজন্ডা-পূরণ হয়, তখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ যুদ্ধ নিয়ে বাঁচতে হয়। তখন স্ট্রাটেজী হয় নিরাপক্ষ নির্বাচনের পথ বন্ধ করে ভোটডাকাতি করা। রাজপথে তখন পুলিশ, বিজিবি, RAB সেনা বাহিনী ও হেলমেটধারী দলীয় গুন্ডাদের নামাতে হয়। রাষ্ট্রের সকল সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামো ও তার বিপুল জনশক্তি তখন নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। জনগণের বিরুদ্ধে তেমনি এক বিরামহীন যুদ্ধ এবং নির্বাচনের নামে ভোটডাকাতি দেখা গেছে শেখ মুজিবের রাজনীতিতেও। এখন সেরূপ একটি বিরামহীন যুদ্ধ দেখা যায় শেখ হাসিনার রাজনীতিতেও। মুজিব নামিয়েছিলেন রক্ষি বাহিনীকে। হাসিনার নামিয়েছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, RAB এবং ছাত্র লীগের হেলমেট বাহিনীকে। এরূপ একটি অধিকৃত দেশে যারাই স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চায় এবং ভোটের ইজ্জত চায় -তারাই শত্রু গণ্য হয়। তাই হাসিনার কাছে শত্রু হলো বাংলাদেশের আপামর জনগণ। চলমান এ যুদ্ধে নিরস্ত্র জনগণ আজ পরাজিত। এবং বিজয়ী হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্যপুষ্ট আওয়ামী বাকশালী পক্ষ। কোয়ালিশন এখানে সকল জাতের দেশী-বিদেশী ইসলামের শত্রুপক্ষের। যারা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চায় তারা কি কখনো বাঁচে এরূপ শত্রুপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে? বুঝতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হতে পারে একমাত্র এরূপ শত্রুশক্তির কবরের উপরই।
পরিত্যক্ত হচ্ছে ফরজ এবং উৎসব হচ্ছে হারাম অর্জন নিয়ে
ইতিহাস পথ দেখায়। তুলে ধরে শত্রু ও মিত্রদের পরিচয়। অতীতের ভূলগুলি এবং দুর্বলতাগুলি ইতিহাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তুলে ধরে দেশী ও বিদেশী শত্রুদের ষড়যন্ত্র, স্ট্রাটেজী ও অপরাধের চিত্র। তাই সঠিক পথে চলতে হলে বার বার অতীত ইতিহাসের দিক চোখ ফেরাতে হয়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে -একই গর্তে বার বার পড়তে হয়। তখন বার বার পরাজয় আসে। একবার শত্রুর ফাঁদে পড়লে কৃতিত্বটি শত্রুর। কিন্তু সে ফাঁদে বার বার পড়লে অপরাধটি নিজের। সে অপরাধ থেকে বাঁচতে হলে ইতিহাস পাঠ জরুরি। তবে একমাত্র সে ইতিহাস পাঠেই ফায়দা হয় যে ইতিহাসের বইয়ে ঘটনার সঠিক বর্ণনা থাকে। ভেজাল ঔষধের ন্যায় ভেজাল ইতিহাসও চরম ক্ষতিকর। মিথ্যা ইতিহাসে প্রকৃত অপরাধীদের অপরাধগুলি লুকানো হয় এবং জঘন্য অপরাধীদের হিরো বানানো হয়। পরম শত্রুকেও বন্ধু রূপে চিত্রিত করা হয়। এবং দেশের প্রকৃত বীরদের শত্রু বানানো হয়। একাত্তরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মূলত সে কাজটিই বেশী বেশী হয়েছে। তাই এসব ইতিহাসের বইয়ে এ তথ্য মেলে না, কারা একাত্তরে লক্ষাধিক বিহারীকে হত্যা করলো? কারা হাজার হাজার বিহারী নারীকে ধর্ষণ করলো? কারা প্রায় ৬ লাখ বিহারীকে তাদের গৃহ, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও চাকুরি থেকে তাড়িয়ে সেগুলি দখলে নিল? কোন ধর্ম, কোন নীতি এবং কোন সভ্য মূল্যবোধ কি এরূপ অপরাধ কর্মকে সমর্থন করে? বাংলার বহু হাজার বছরের ইতিহাসের এগুলিই হলো সবচেয়ে বর্বর অপরাধ কর্ম। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে এহেন বর্বর নৃশংসতার কোন বিবরণ মেলে না। একাত্তরের উপর লেখালেখির কাজটি পরিণত হয়েছে মিথ্যা উৎপাদনের শিল্পে। সে মিথ্যাচারের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, ভারতসেবী ও দুর্বৃত্তির লালনকর্তাকে দেশের নেতা, পিতা ও বন্ধুর আসনে বসানো হয়েছে। এটি তো ফিরাউনী সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতিতে ফিরাউনের ন্যায় খুনি, স্বৈরাচারি ও দুর্বৃত্তকে ভগবান রূপে চিত্রিত করা হয়। অথচ মহান আল্লাহতায়ালা দুর্বৃত্তদের নির্মূলকে ফরজ করেছেন এবং হারাম করেছেন তাদের সম্মান করা। মুসলিমগণ সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা পেয়েছে সে জিহাদী মিশন নিয়ে বাঁচার কারণে -যার ঘোষণা এসেছে সুরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে। অপর দিকে যারা বাঁচে মিথ্যা, অবিচার ও দুর্বৃত্তির প্রতিষ্ঠা নিয়ে -তারা পরিণত হয় সর্বনিকৃষ্ট জাতিতে। তারা বিশ্ব রেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে। বাংলাদেশ সেরূপ দুর্বৃত্তিতে এ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। মুজিব যে দুষ্ট রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন -এ ছিল তারই পরিণতি।
একাত্তরের ইতিহাস থেকে শিক্ষণীয় বিষয় বহু। একাত্তরের ঘটনাবলি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কারা বাঙালি মুসলিমের প্রকৃত শত্রু। বলে দেয়, একটি মুসলিম জনগোষ্ঠি কিরূপে এবং কত দ্রুত স্বাধীনতা ও ইজ্জত হারায় এবং শত্রু রাষ্ট্রের গোলামে পরিণত হয়। ইতিহাস এ বিবরণও বিষদ ভাবে পেশ করে, কিরূপে একটি মুসলিম জনগোষ্ঠি দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়। এবং ধরা পড়ে, দুর্বৃত্তদের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হওয়ার নাশকতা। তবে পরিকল্পিত ভাবে ইতিহাসের সে সামর্থ্য কেড়ে নেয়া হয়েছে। এবং এটি দুর্বৃত্ত শাসকদের রীতি। তারা সত্যের প্রচার যেমন নিষিদ্ধ করে, তেমনি অসম্ভব করে ইতিহাসের বই’য়ে সত্য বিবরণ লিপিবদ্ধ করা। ইতিহাসের শক্তি তার সত্য বিবরণে। মিথ্যা দূষণ ঘটলে ইতিহাসের সে সামর্থ্য বিলুপ্ত হয়। মিথ্যা দূষণের কারণ, একাত্তরের ইতিহাসের সবটুকুই লিখেছে শুধু বিজয়ী পক্ষের লোকেরা। দাপট এখানে বুদ্ধবৃত্তিক ফ্যাসিবাদের। ইতিহাসের বইয়ে ইচ্ছামত মিথ্যাচার হয়েছে তাদের নিজ ভূমিকাকে মহামান্বিত করার লক্ষ্যে। মিথ্যার নমুনা হলো ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ নিহতের কথা। ৩০ লাখ নিহত হলে, যুদ্ধকালীন ৯ মাসের প্রতিদিন নিহতের সংখ্যা ১১ হাজার হতে হয়। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি; ফলে ৩০ লাখ নিহতের সংখ্যা পূরণ হলে প্রতি ২৫ জন একজন নিহত হতে হয়। যে গ্রামে বা মহল্লায় ১ হাজার লোকের বাস সেখানে মারা যেতে হয় ৪০ জনকে। এটি পাটিগণিতের হিসাব। এ হিসাবই বলে দেয় কতবড় মিথ্যাচার হয়েছে একাত্তর নিয়ে। আরেকটি বড় মাপের মিথ্যা গলা বাড়িয়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধারা নাকি দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু তারা বলতে পারে না কোন জেলা, মহকুমা ও থানার নাম -যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর রণাঙ্গণে নামার আগে মুক্তি বাহিনী স্বাধীন করেছিল। এরূপ ভুরি ভুরি মিথ্যা যখন ইতিহাসের বই’য়ে ঢুকানো হয় তখন সেটি আর ইতিহাস থাকে না; আবর্জনায় পরিণত হয়।
ইতিহাসের বইয়ে গৌরবের কাজ বলা হয়েছে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে। অপরাধ বলা হয়েছে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াকে। অথচ পাকিস্তান কেন সৃষ্টি হলো -সে ইতিহাস স্কুলে পড়ানো হয় না। মাঝে বিশাল ভারত ও ১২ শত মাইলের দূরত্ব নিয়ে কেন পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল এক দেশ হলো -সে বিষয়েও কিছু বলা হয়না। যে বাঙালি মুসলিম নেতাগণ ভৌগলিক ভাবে বিভক্ত দুটি অঞ্চল নিয়ে অখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টি করলেন তাদের কেউ পাগল ছিলেন না। অশিক্ষিতও ছিলেন না। বরং তারাই ছিলেন বাংলার সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম। সে সময়ে নেতা জনাব হোসেন শহীদ সহরোওয়ার্দি লেখাপড়া করেছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। খাজা নাজিমুদ্দীন লেখাপড়া করেছেন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেরে বাংলা ফজলুল হক লেখাপড়া করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেখ মুজিব, তাজুদ্দীন ও সিরাজুল আলম খানের ন্যায় আওয়ামী কাপালিক রাজনীতিকদের কেউ কি অক্সফোর্ড ও ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজায় পা রাখার সামর্থ্য ছিল? তাছাড়া তাদের রাজনীতি ছিল হিন্দুত্ববাদী সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের। লড়াই করেই তারা অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ফলে হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক দর্শন ও এজেন্ডা তাদের অজানা ছিল না। কিন্তু সে সুযোগ শেখ মুজিব, তাজুদ্দীন ও সিরাজুল আলম খানের ন্যায় একাত্তরের নেতাদের ছিল না। সে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মেজর জিয়াউর রহমানেরও ছিল না। ফলে তাদের রাজনীতি ছিল হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আত্মসমর্পণের। সেটিরই প্রকাশ ঘটে একাত্তরের যুদ্ধে এবং একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের বিদেশ নীতিতে।
দেশ ভাঙ্গা ও দেশ গড়া’র মাঝে কোনটি শ্রেষ্ঠ কর্ম -সে প্রশ্নটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বইয়ে আলোচিত হয়না। মুসলিম লীগের জন্ম যে ঢাকায় এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টিই যে বাঙালি মুসলিমের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম -গোপন করা হয় সে ঐতিহাসিক সত্যকেও। বরং সে অবদানকে সাম্প্রদায়িক বলে বাঙালি মুসলিমের সর্বশ্রেষ্ঠ সে কর্মকে খাটো করা হয়। প্রতিটি যুদ্ধ নিয়েই সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষেরই নিজস্ব বয়ান থাকে। বয়ান ছিল ইসলামের পক্ষের শক্তিরও। কি ছিল তাদের সে বয়ান -সে কথাটি একাত্তরের ইতিহাসের বইয়ে কোথাও বলা হয়নি। অথচ আদালতের রায়ের ন্যায় ইতিহাসের রায়েও দুই পক্ষের বয়ান থাকতে হয়। নইলে সে রায়টি নিরপেক্ষ থাকে না। ফলে সে রায়ের গ্রহনযোগ্যতাও থাকেনা। তখন সে পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসের বইকে আবর্জনার স্তুপে যেতে হয়। বাংলাদেশে তাই বিশাল আবর্জনা জমেছে দেশটির ইতিহাস নিয়ে।
ইসলামের যে বয়ানটি নিয়ে আলেমদের মাঝে কোন বিরোধ নাই তা হলো, কোন মুসলিম দেশ কোন সামরিক জান্তা বা দুর্বৃত্ত জালেম শাসক দ্বারা অধিকৃত হলেই সে দেশ ভাঙ্গা জায়েজ হয়ে যায় না। দেশের আয়োতন এক মাইল বাড়াতে প্রচুর রক্তক্ষয় হয়। তাই ফরজ হলো দেশের সে ভূগোলকে খণ্ডিত হওয়া থেকে বাঁচানো। নইলে দেশ ক্ষুদ্রতর হয়। আর দেশ ভেঙ্গে যাওয়া বা ক্ষুদ্রতর হওয়ার অর্থ দেশকে দুর্বল করা। আর কোন মুসলিম দেশকে দুর্বল করা হারাম। আর দেশ দুর্বল হলে স্বাধীনতা হারাতে হয়। তাই ফরজ হলো শক্তিকে ধরে রাখা বা বাড়ানো। এজন্যই মুসলিমদের লড়াইটি হতে হয় জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে নয়। যেমন গৃহে বাঘ ঢুকলে, লড়াইটি বাঘের বিরুদ্ধে হতে হয়। গৃহের বিনাশে নয়। কিন্তু একাত্তরে সে সভ্য নীতি মানা হয়নি। মুসলিম ভূমি বহুবার জালমদের দ্বারা অধিকৃত হয়েছে -এমন কি উমাইয়া ও আব্বাসীয়া খলিফাদের আমলেও। স্বৈরাচারী জালেম শাসকের হাতে অধিকতৃ হয়েছে খোদ বাংলাদেশও। তবে কি বাংলাদেশও ভাঙ্গতে হবে? জালেম শাসক তাড়ানোর লড়াইটি ইসলামে ফরজ -এটি পবিত্র জিহাদ; কিন্তু দেশভাঙ্গা হারাম। কোন মুসলিম দেশকে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ভূমির দোহই দিয়ে ভাঙ্গাও জায়েজ নয়। ইসলামের অতি মৌলিক মোদ্দা কথা হলো এটি। এজন্যই একাত্তরে কোন ইসলামী দল, কোন হাক্কানী আলেম, কোন হাক্কানী ইমাম, কোন বিবেকমান পীর পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেনি। বরং পাকিস্তান ভাঙ্গাকে তারা হারাম বলেছেন। একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের পত্রিকা খুললেই সে প্রমাণ মিলবে। পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে দাঁড়িয়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরা আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ, ভাষানী ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ও হিন্দুরা। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার না থাকার কারণেই তারা সেদিন পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে যুদ্ধে নেমেছে। কিন্তু ঈমানদার যে ব্যক্তিটি বাঁচে মুসলিম স্বার্থের প্রতি গভীর অঙ্গীকার নিয়ে এবং স্বপ্ন দেখে পৃথিবীর মানচিত্রে মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশক্তি রূপে -সে কি কখনো মুসলিম দেশ ভাঙ্গার পক্ষ নেয়? সে তো ভূগোল ভাঙ্গার বদলে বাড়াতে মনযোগী হয়। মুসলিমদের গৌরব যুগে তো সেটিই দেখা গেছে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে ১২ শত মাইলের দূরত্বকে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে যুক্তি রূপে খাড়া করা হয়। প্রশ্ন হলো, এরা কি পৃথিবীর মানচিত্র দেখে না? রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট, কানাডা, আর্জেন্টেনিয়া ও ব্রাজিলের মত দেশগুলির এক সীমান্ত থেকে অপর সীমান্তের মাঝে যে দূরত্ব তার চেয়ে বহু কম দূরত্ব ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে। উপরিউক্ত দেশগুলি কত বিচিত্র ভাষা, বর্ণ, ও ধর্মের মানুষদের নিয়েই না গঠিত। অমুসলিমদের জন্য ভৌগলিক সংহতি ও একতা ফরজ নয়; এবং হারাম নয় বিচ্ছন্নতার যুদ্ধ। কিন্তু তারপরও তারা একাতবদ্ধ। ভারত তার উদাহরণ। কত ভাষা, কত বর্ণ ও কত ধর্মের মানুষদের নিয়েই না ভারত। একতা ও সংহতি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেয়। বিচ্ছিন্নতা এবং বিভক্তি দেয় পরাজয় ও পরাধীনতা। মুসলিম ভূমিতে শত্রুশক্তির দখলদারী প্রতিষ্ঠা পেলে অসম্ভব হয় শরিয়ত পালনসহ পূ্র্ণ ইসলাম-পালন। ফলে অসম্ভব হয় পূর্ণ মুসলিম রূপে বাঁচা। তারই প্রমাণ, ইংরেজদের হাতে বাংলা অধিকৃত হওয়ায় আদালত থেকে বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়তী আইনের বিচার।
টুপি, দাড়ি ও পাগড়ি না থাকলে কেউ কাফির হয়না। এমন কি তাতে গুনাহও হয়না -কারণ এ নিয়ে পবিত্র কুর’আনে কোন নির্দেশ আসেনি। কিন্তু আদালতের বিচার শরিয়তের আইন অনুযায়ী না হলে কাফির, জালিম ও ফাসিক হতে হয়। সে ঘোষণাটি খোদ মহান আল্লাহতায়ালার; এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বয়ান এসেছে সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। তাই যারা জান্নাতের স্বপ্ন দেখে তাদেরকে অবশ্যই শরিয়তের বিচার মেনে নিয়ে এবং আদালতে তা প্রতিষ্ঠা দিয়ে বাঁচতে হয়। নইলে কাফির, জালিম ও ফাসিকের খেতাব নিয়ে জাহান্নামে যেতে হয়। আদালতে শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি শত্রু অধিকৃত পরাধীন দেশে সম্ভব নয়, সেজন্য জরুরি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। একমাত্র তখনই বাঁচে শরিয়ত পালনসহ পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বাধীনতা। মহান নবীজী (সা:)কে তাই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছে। ইসলামে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাজ। সে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা দেয়ার কাজে অর্ধেকের বেশী সাহাবাকে শহীদ হতে হয়েছে।
শুধু নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের যুগে নয়, প্রতি যুগে ও প্রতি মুসলিম দেশে স্বাধীনতা বাঁচানোই ছিল মুসলিমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। কারণ, স্বাধীনতা বাঁচলেই পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বাধীনতা বাঁচে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, আজকের মুসলিমগণ সে ইসলামের উপর নাই। তারা আবিষ্কার করে নিয়েছে নিজের মনঃপূত ইসলাম। এ ইসলামে টুপি-দাড়ি এবং মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা গুরুত্ব পেলেও গুরুত্ব পায়নি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এবং গুরুত্ব পায়নি মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তের আইনের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৭’য়ে বিদেশী শত্রুদের শাসন বিলুপ্ত হয়েছে; কিন্তু প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলামের দেশী শত্রুদের শাসন।ফলে বাংলাদেশের আদালতে ইসলামের কোন বিজয় আসেনি। চলছে শরিয়তের আইনের বদলে কুফুরি আইনের শাসন। যেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং শরিয়তী আইনের পালন ছাড়াই তারা ইসলাম পালন করে ছাড়বে!
স্বাধীন ভাবে বাঁচার সামর্থ্য বাড়াতে হলে অবশ্যই নিজেদের একতা বাঁচাতে হয়। বিভক্তির বিপদ এক্ষেত্রে ভয়াবহ। তখন পরাজয় ও পরাধীনতা অনিবার্য হয়ে উঠে। সে বিপদ থেকে বাঁচাতেই মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের উপর একতাকে ফরজ এবং বিচ্ছিন্নতাকে হারাম করেছেন। কিন্তু আফসোস! মুসলিমগণ পরিত্যাগ করেছে সে ফরজকে এবং বেছে নিয়েছে বিভক্তির হারাম পথকে। মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত হলো, তিনি গড়াকে পছন্দ করেন, এবং অপছন্দ করেন ভাঙ্গাকে। এবং বিভক্তির পথটিই হলো ভাঙ্গার পথ। অথচ মুসলিমগণ গড়া বাদ দিয়ে বেছে নিয়েছে ভাঙ্গার পথকে। মুসলিম বিশ্ব তাই ৫০’য়ের বেশী টুকরোয় বিভক্ত। বিভক্তির এ পথটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও; ফলে এ পথটি প্রতিশ্রুত আযাবেরও। ফলে বিশ্বের দরবারে সাড়ে ৬ কোটি ব্রিটিশের যে শক্তি, সম্মান ও প্রভাব আছে -তা ১৫০কোটি মুসলিমের নাই।
তাছাড়া বাংলাদেশ নিজেই প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছে। সে সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল লন্ডন। এবং লন্ডনের অবস্থান ছিল ঢাকা থেকে আকাশ পথে ৪,৯৭৭ মাইল দূরে। কিন্তু বাংলায় যখন ব্রিটিশ শাসনের শুরু হয় তখন যোগাযোগটি আকাশ পথে হতো না, সেটি হতো জল পথে পালবাহী জাহাজের মাধ্যমে। জাহাজগুলো বহু সাগর এবং দুটি মহাসাগর পাড়ি দিয়ে কলকাতায় আসতো। ঘুরে আসতো হতো আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে। তাতে কি ভারত শাসনে ব্রিটিশদের কোন অসুবিধা হয়েছে? তারা আরো বহু দূরে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে এমন কি দূরত্ব ছিল? মোগল ও ব্রিটিশ আমলে তো এ দূরত্ব নিয়েই একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কাছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে দূরত্বের বিষয়টি অজানা ছিল না। তাদের ভিশন ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নির্মাণের এবং একটি বিশাল শক্তি রূপে উত্থানের। এমন একটি ভিশন নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তাদেরকে ভৌগলিক দূরত্বের উর্দ্ধে উঠতে হয়। এবং দেশের ভূগোল বাড়াতে হয়। নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে একতা গড়তে হয়। এরূপ ভিশন ও মিশন নিয়ে রাজনীতি করতে হলে ঈমান লাগে, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে কিছু করার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার লাগে। সেরূপ ঈমান ও অঙ্গীকার কি একাত্তরের ইসলামী চেতনাশূণ্য নেতাদের ছিল? আজও যারা একাত্তর নিয়ে পাকিস্তানপন্থীদের গালি-গালাজ করে -তাদের মধ্যে কি সে ঈমান ও সে অঙ্গীকার আছে?
বেঈমানীর জোয়ার
ঈমানের জোয়ারের ন্যায় ব্যক্তির জীবনে বেঈমানীর জোয়ারটিও খালি চোখে দেখা যায়। ঈমান শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে প্রকাশ পায়না, প্রকাশ পায় কর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, যুদ্ধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতেও। জনগণের মাঝে ঈমানের জোয়ার এলে জোয়ার আসে নেক আমলে। বিপ্লব আসে ভিশনে ও মিশনে। তখন নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষের মাঝে মহব্বত বাড়ে। বাড়ে একতা। তখন দেশের ভূগোলে বৃদ্ধি ঘটে। মুসলিমগণ প্রতিষ্ঠা পায় বিশাল রাজনৈতিক শক্তি রূপে। ১৯৪৭ তেমন এক বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল বাংলার মুসলিমগণ। ফলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। অপর দিকে বেঈমানী বাড়লে বাড়ে মনের দূরত্ব। বাড়ে পরস্পরে ঘৃণা। তখন শুরু হয় আরব-অনারব, তুর্কী-কুর্দি এবং বাঙালি-বিহারির মাঝে ভাতৃঘাতী সংঘাত ও গণহত্যা। শুরু হয় দ্রুত নিচে নামা। মুসলিম দেশের ভূগোল তখন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে। এটিই হলো মুসলিম উম্মাহর শক্তিহানীর প্রক্রিয়া। ১৯৭১’য়ে তেমন এক নিচে নামার প্রক্রিয়ায় শামিল হয় বাঙালি মুসলিমগণ। ফলে পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় বাংলাদেশ নামে ভারতের রাডারের নিচে অতি দুর্বল এক অধিনত দেশে।
মুসলিম জীবনে ঈমানের প্রবল জোয়ারটি আনে পবিত্র কুর’আন। এ জোয়ার মুসলিমদের একতাবদ্ধ করে ও তাদেকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করে। অপর দিকে বেঈমানীর জোয়ারটি আনে বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় জাহিলী মতবাদ। এ মতবাদগুলি মুসলিমদের বিভক্ত করে এবং শত্রুশক্তির গোলামে পরিণত করে। বঙালি মুসলিম জীবনে সে জাহিলিয়াতের জোয়ার দেখা গেছে ১৯৭০ ও ১৯৭১’য়ে। তখন জাতীয়তাবাদী বাঙালিগণ যুদ্ধ করেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের বিনাশে ও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের বিজয় বাড়াতে। এখনো সে জোয়ার ও বিজয় নিয়ে গর্ব করা হয়। আরবদের জীবনে সেরূপ জোয়ার দেখা গেছে ১৯১৭ সালে। তখন জাতীয়তাবাদী ও গোত্রবাদী আরবগণ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিজয়ী করতে যুদ্ধ করেছে। ১০ লাখের বেশী আরব মুসলিম ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সে জোয়ারে পাকিস্তান যেমন দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, তেমনি আরব ভূমি বিভক্ত হয়েছে ২২ টুকরোয়। সে বিভক্তির দিবসগুলিকে স্বাধীনতা দিবস নাম দিয়ে উৎসব করা হয়। তাদের চেতনায় যদি রোজ হাশরের বিচার দিবস গুরুত্ব পেত এবং গুরুত্ব পেত মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জবাবদেহীতা -তবে তথাকথিত স্বাধীনতা দিবসের এ উৎসবগুলি মাতমে পরিণত হতো। এসব জাহিলী মতবাদের নাশকতা থেক্কে বাঁচাতেই ইসলামে এ মতবাদগুলিকে হারাম ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে নবীজী (সা:)’র হাদীস: “যারা কোন গোত্রের নামে যুদ্ধ করে ও নিহত হয় তারা আমার উম্মত নয়।” –(সুনানে আহমেদ)। মুসলিমদের মাঝে নবীজী (সা:)’র এ শিক্ষা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন আরব, তুর্ক, কুর্দ, ইরানী, হাবসী, আফগানীর ন্যায় নানা গোত্র প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ববোধ নিয়ে একত্র বসবাস করেছে। এবং বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছে।
ঈমানদার কখনোই বর্ণবাদী, গোত্রবাদী ও জাতীয়তাবাদী হয় না। সেটি একমাত্র ঈমানের মৃত্যুতেই সম্ভব। সেটি দেখা যায় নিরেট বেঈমানদের জীবনে। নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করলেও অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ, অন্য গোত্র ও অন্য অঞ্চলের মুসলিমগণ তাদের কাছে শত্রু। সেসব পরিচিতির ভিত্তিতে তারা বিভক্তি গড়ে এবং রক্তাক্ত যুদ্ধ লড়ে। আরব জাতীয়তাবাদের জোয়ার থেকে আরবগণ যতদিন মুক্ত ছিল, ততদিন তাদের মাঝে একতা ছিল। ততদিন প্রতিষ্ঠা পায়নি ইসরাইল। মোসল, রামাদী, ফালুজা, আলেপ্পো, রাক্কা, গাজার ন্যায় অসংখ্য শহরগুলি তখন বেঁচেছে ধ্বংস হওয়া থেকে। জাতীয়তাবাদ হলো ইসলামের প্যান-ইসলামিক চেতনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্রোহ এখানে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে। মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের মাঝে একতা চান, আর জাতীয়তাবাদীগণ চায় বিভক্তি। এরূপ বিদ্রোহ কখনোই একাকী আসে না, সাথে আনে ভয়ানক আযাবও। সে আযাব আসে নৃশংস যুদ্ধের নাশকতা নিয়ে। শত্রুশক্তি তখন আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হয়। আরব ভূমিতে এক সময় আযাবের হাতিয়ারটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এখন সে হাতিয়ারটি হলো ইসলরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বেঈমানীর সে রাজনীতি বাঙালি মুসলিম জীবনে দেখা গেছে ১৯৭৭০-৭১ সালে। তেমনি দেখা যায় বাংলাদেশ সহ সকল মুসলিম দেশে। মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে এই বেঈমানগণই বিজয়ী। ফলে মুসলিম বিশ্ব আজ ভাষার নামে, বর্ণের নামে ও অঞ্চলের নামে ৫০টির বেশী খণ্ডে বিভক্তি। এবং কারণ স্বাধীনতার নামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ গড়ার যে উৎসব -সে উৎসব তো ইসলামের পরাজয় এবং শয়তান ও তার অনুসারীদের বিজয় নিয়ে। কোন ঈমানদার কি এমন উৎসবে শরীক হতে পারে?
ব্যর্থতাটি বুদ্ধিবৃত্তিক
পাকিস্তান ভৌগলিক দূরত্বের কারণে ভেঙ্গে যায়নি, ভেঙ্গে গেছে মনের দূরত্বের কারণে। মনের দূরত্ব বাড়লে সহোদর ভাইগণও পাশাপাশি একই ভিটায় বসবাস করতে পারে না; তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে গিয়ে ঘর বাঁধে। মনের দূরত্বের কারণেই প্রায় ৪০ কোটি আরব এক ভাষা, এক ধর্ম, এক বর্ণ ও এক অখণ্ড ভূগোলে বসবাস করেও অখণ্ড একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারিনি। তারা বিভক্ত হয়েছে ২২টি রাষ্ট্রে। জনগণের মাঝে মনের দূরত্ব সব সময়ই সৃষ্টি করেছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, কম্যুনিজম ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদগুলি। মুসলিম দেশে এরূপ হারাম মতবাদের আবাদ বাড়াতে বিদেশী শত্রুদের বিনিয়োগটি বিশাল। মুসলিম জীবনের প্রথম জিহাদটি সশস্ত্র শত্রুদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে হয়না, সেটির শুরু হারাম মতবাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ দিয়ে। নবীজী (সা:) সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি শুরু করেছিলেন তাঁর নবুয়তী জীবনের প্রথম দিন থেকে। যে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের মুজাহিদ হতে হয় প্রতিটি ঈমানদারকে। এবং এ পবিত্র জিহাদের মূল অস্ত্রটি হলো জ্ঞান। মহান আল্লাহতায়ালা তাই প্রথম নামাজ-রোজাকে ফরজ না করে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। জ্ঞানের এ অস্ত্রে সজ্জিত না হলে পরাজিত হতে হয় এবং ভেসে যেতে জাহিলী মতবাদের স্রোতে।
একটি দেশে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, কম্যুনিজম ও সেক্যুলারিজমের স্রোতে ভাসা বিপুল সংখ্যক লোক দেখে নিশ্চিত বলা যায়, সে দেশের বুকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় অতি বিশাল। মুসলিমগণ তাদের গৌরবযুগে বিভেদ সৃষ্টিকারী এবং জাহান্নামের দিকে টানা এ মতবাদগুলিকে কবর দিতে পেরেছিলেন বলেই বিশ্বশক্তির জন্ম দিতে পেরেছিল। তখন আরব, ইরানী, তুর্কী, মুর, হাবসী, আফগানী ইত্যাদি নানা ভাষার মুসলিমগণ একত্রে কাজ করেছিলেন। অথচ আজ মুসলিমগণ ফিরে গেছে ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগের হারাম মতবাদগুলিতে। সে যুগে আরবদের কোন রাষ্ট্র ছিল না। তারা বাঁচতো অসংখ্য গোত্রে বিভক্ত কলহপ্রবন এক অসভ্য গোত্রীয় পরিচিতি নিয়ে। সে রক্তাক্ত বিভক্তি ও কলহ-প্রবনতা আরবদের জীবনে আবার ফিরে এসেছে। সেটি প্রকট ভাবে আজ দেখা যাচ্ছে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়া, লেবানন, মরক্কোসহ অধিকাংশ আরব দেশে। পাকিস্তানও ভেঙ্গে গেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ন্যায় হারাম মতবাদের আঘাতে। ১৪/০৫/২০২৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018