বাঙালি মুসলিম জীবনে পূজা ও নাশকতার উৎসব

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

 বাঙালি মুসলিম জীবনে পূজা

 উৎসবের মধ্যই পরিচয় মেলে ব্যক্তির ঈমানের ও বেঈমানীর। ঈমানের ও বেঈমানী ব্যক্তির ভিতরের বিষয়, আর উৎসব হলো তার বাহিরের বিষয়। বস্তুত জনগণের দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দ এবং ভালবাসার বিষয়গুলি প্রকাশ পায় উৎসবগুলির মধ্য দিয়ে। তাই মুসলিম ও কাফিরদের উৎসব কখনোই একই রূপ হয় না। তাই মহান আল্লাহতায়ালা বান্দাদের ইবাদতই শুধু দেখেন না, দেখেন তাদের উৎসবগুলিও। ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য বিধান দিয়েছে নিজস্ব উৎসবের -যেমন দুই ঈদের উৎসব। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ উৎসবের নামে নানারূপ বিদ’য়াতের জন্ম দিয়েছে এবং সেগুলিকে তারা সংস্কৃতির অংশ বানিয়ে নিয়েছে। ইসলামের শত্রুগণ বাঙালি মুসলিমদের মাঝে ধর্মান্তর ঘটাতে ব্যর্থ হলেও বিপুল সফলতা পেয়েছে সাংস্কৃতিক কনভার্শন ঘটাতে। সেটি বাঙালি সংস্কৃতির নামে। বিজয় এখানে বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির।

বাঙালি মুসলিম জীবনে সেরূপ সাংস্কৃতিক বিদ’য়াতগুলি চেপে বসেছে একুশে ফেব্রেয়ারি, নব বর্ষ, বসন্ত বরণ, জন্ম দিবস, বিবাহ দিবস ও ভালবাসা দিবসের নামে। একুশে ফেব্রেয়ারির দিনকে ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলার বাঙালি মুসলিমরা রীতিমত পূজার উৎসবে পরিণত করেছে। এ দিনটিতে তারা নগ্ন পদে, হাতে ফুল নিয়ে, গানের সুরে জপ গেতে গেতে বেদি মূলে ফুল চড়াতে হাজির হয়। আরেকটি পূজার উৎসব হলো বর্ষবরণ উৎসব। বর্ষবরণের নামে ঢাকার বুকে যে পূজা উৎসব হয় -তা দেখে কলকাতার দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকার সংবাদদাতার পক্ষ ঢাকাকে কলকাতা ও বোল পুরের বিশ্বভারতী থেকে পৃথক করাই কঠিন হয়ে পড়ে। ঢাকার উৎসবে হিন্দুত্বের বিশাল প্রকাশ দেখে উক্ত সাংবাদিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় গদ গদ চিত্তে বিশাল ফিচার লিখেছেন। সংস্কৃতির নামে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বাঙালি মুসলিমদের উপর যে কতটা প্রবল ভাবে চেপে বসেছে -এ হলো তার নজির।     

অথচ নতুন বর্ষ, নতুন ঋতু, জন্ম দিন, বিবাহ দিবস, ভালবাসার দিন নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের জীবনেও এসেছিল। কিন্তু সেগুলিকে তারা উৎসবের দিন বানাননি। তাতে তাদের সভ্য ও পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে কোন সংকট বা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়নি। আজ বাঙালি মুসলিম জীবনে যতই উৎসব বাড়ছে, ততই প্লাবন আসছে নানা রূপ দুর্বৃত্তির। মানুষ ততই দূরে ছুটছে জীবনের মূল এজেন্ডা থেকে। বস্তুত এ উৎসবগুলি পরিণত হয়েছে জীবনের মূল এজেন্ডা থেকে দূরে সরানোর হাতিয়ার রূপে। এ জীবনের মূল এজেন্ডা হতে হয় কি করে মহান রাব্বুল আলামীনের মাগফিরাত পাওয়া যায় এবং কি করে নিজেকে জান্নাতের যোগ্য করা যায় -সে সাধনায় মগ্ন হওয়া। সমগ্র জীবনটাই হলো পরীক্ষা পর্ব; পরীক্ষার হলে বসে যারা উৎসবে আত্মহারা হয় -তারা কি কখনো পরীক্ষায় পাশ করতে পারে?  অথচ এ উৎসবগুলো পরীক্ষার হলে মনযোগী হওয়ার সুযোগই দিচ্ছে না। হৈ হুল্লোড় বাড়াছে পরীক্ষার হলে। এগুলি পরিণত হয়েছে জীবনের মূল এজেন্ডা থেকে দূরে সরানোর শয়তানী হাতিয়ারে।   

শেখ হাসিনা বলেছিল, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। একথা তো শয়তানের। শয়তান তো এভাবেই কালী পূজা, দুর্গা পূজা, স্বরস্বতি পূজার ন্যায় নানা দেব-দেবী পূজাকে বাঙালি মুসলিমের উৎসবে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করে। শয়তানের এটি সাংস্কৃতিক ইঞ্জিনীয়ারিং। শয়তান তো এভাবেই মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরায় এবং পৌত্তলিকতার কাছে টানে। হাসিনার মত যারা ইসলাম থেকে দূরে সরেছে একমাত্র তারাই পূজার উৎসবকে নিজেদের উৎসব রূপে গ্রহণ করতে পারে, কোন ঈমানদার নয়। প্রশ্ন হলো, হিন্দুরা কি কখনো মুসলিমদের গরু কুর’বানীর ঈদ উৎসবকে নিজেদের উৎসব রূপে গ্রহণ করবে? মুসলিমগণ তো জবাই করে তাদের গো-দেবতাকে। ফলে সে উৎসবে তার যোগ দেয় কি করে? তারা তো গো-মুত্র সেবন করে। একই কারণে মুসলিমগণ বা কি করে দেব-দেবীর মূর্তির সামনে গিয়ে উৎসব করে? তাদের মহান নবী (সা:)’র সূন্নত তো মূর্তি ভাঙ্গার, মূর্তি গড়া বা মূর্তির সামনে গিয়ে ভক্তি দেখানো নয়। তাই কাফেরদের উৎসবগুলি একান্তই তাদের নিজস্ব উৎসব, সেগুলি কখনোই মুসলিমদের উৎসব হতে পারে না। তেমনি মুসলিমদের উৎসবগুলিও হিন্দুদের উৎসব হতে পারে না।        

 

 মুসলিম দেশে আত্মঘাতী নাশকতার উৎসব

আরো পরিতাপের বিষয়, মুসলিমগণ আত্মঘাতী নাশকতা নিয়েও উৎসব করে। নাশকতা কি শুধু আপন জনের মৃত্যু, ঘর ভাঙ্গা, দোকান ভাঙ্গা ও কৃষিক্ষেতের ক্ষয়ক্ষতি? বরং নাশকতার সবচেয়ে বড় কান্ডটি হলো দেশ ভাঙ্গা। কারণ দেশ ভাঙ্গলে বিপন্ন হয় স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ইজ্জত। তখন ঘাড়ের উপর চেপে বসে শত্রু শক্তির গোলামী। তখন অসম্ভব হয় পূর্ণ ইসলাম পালন এবং কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন। ফলে অসম্ভব হয় সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা। কারণ, সিরাতাল মুস্তাকীমে চলতে হলে তো তার রোড ম্যাপ কুর’আনকে বুঝতে হয়। কিন্তু ইসলাম বিরোধী দখলদার শক্তি সে কুর’আনী জ্ঞানার্জনের কাজটি স্কুল-কলেজে হতে দেয় না। তাই বাংলাদেশের ছাত্ররা তাদের বিশ বছরের শিক্ষা জীবন শেষ করে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য অর্জন না করেই। অথচ প্রতিটি মুসলিমের উপর কুর’আনী জ্ঞানার্জনের কাজটি নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ। এবং এ ফরজের কোন ক্বাজা বা কাফ্ফারা নাই। এভাবেই শয়তানী শক্তির দখলদারীতে বাধাগ্রস্ত বা অসম্ভব হয় প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার কাজ। তখন অনিবার্য হয় শত্রুর হাতে পরাজয় ও পরাধীনতা।  

মুসলিম উম্মাহ আজ যে কারণে স্বাধীনতাহীন, নিরাপত্তাহীন ও ইজ্জতহীন -তার কারণ তাদের জনসংখ্যার বা সম্পদের কমতি নয়, বরং ৫০টির অধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ খণ্ডিত ভূ-রাজনীতি। ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে এ মুসলিম রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা বাঁচানো সামর্থ্য নাই; ফলে দেশগুলির উপর চলছে শয়তানী শক্তির পরোক্ষ দখলদারি। এসব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির কোন একটিতে নবীজী (সা:)’র  অনুসরণে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হলে অসম্ভব হবে সেটিকে শয়তান শক্তির আগ্রাসন থেকে বাঁচানো। তখন সে ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামবিরোধী সকল শক্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কারণ শয়তানী শক্তিবর্গ মুসলিম বিশ্বে ফ্যাসিবাদী, জাতীয়তাবাদী, রাজতন্ত্রী ও স্বৈরাচারি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠ নিয়ে কোন আপত্তি করে না, বরং তাদের সাথে সহযোগিতার নীতিই অবলম্বন করে। কারণ সে সেক্যুলার মুসলিম রাষ্ট্রগুলি তাদের শয়তানী এজেন্ডা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কোন চ্যালেঞ্জ খাড়া করে না। কিন্তু তারা কোন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে রাজী নয়।  যে কোন ইসলামী রাষ্ট্রকে তাদের নিজ অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে।

তাছাড়া স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য আবশ্যকীয় লোকবল এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক বল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের থাকে না। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা একতাকে ফরজ করেছেন এবং দেশভাঙ্গাকে হারাম করেছেন। মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি এবং ক্ষুদ্র ভূগোল তাদের স্বাধীন ভাবে বাঁচাকে অসম্ভব করেছে। অথচ শয়তানী শক্তিবর্গ সেটিই চায়। বৃহৎ মুসলিম দেশগুলি ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর করা তাই শয়তানী শক্তিবর্গের প্রধান কৌশল। সে লক্ষ্য অর্জনে কাফির শক্তির সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ তাই মুসলিম দেশের সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে। সে জন্য তারা যুদ্ধও করে। ১৯৭১’য়ে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় কাফিরগণ তেমন একটি যুদ্ধ করেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভাঙ্গতে।  পাকিস্তান ভাঙ্গার সে হিন্দু প্রকল্পে যোগ দিয়েছে ইসলামী চেতনাশূণ্য কাপালিক মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ। মুজিবের সাফল্য, হেমিলিয়নের বংশীবাদকের ন্যায় সে সাথে নিতে পেরেছিল ইসলামী চেতনাশূণ্য কোটি কোটি বাঙালি মুসলিমকে। মুজিবের সে নাশকতায় কাজে যোগ দিয়েছে ইসলামচ্যুৎ সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার বাঙালিগণও। 

অথচ পাকিস্তান শুধু পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি ও বেলুচদের দেশ ছিল, দেশটি ছিল বাঙালি মুসলিমদেরও। বরং পাকিস্তানের সংখ্যগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল তারাই। এবং মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি ছিল বাঙালি মুসলিমদের। ফলে সে দেশটির প্রতিরক্ষার সবচেয়ে বড় দায়িত্বটিও ছিল তাদেরই। কিন্তু সে দায়িত্ব তারা পালন না করে তারা বরং চিহ্নিত শত্রু শক্তি ভারতের সহযোগী হয়েছে এবং ভারতকে বিজয়ী করেছে। এটি ছিল নিজ দেশের সাথে তাদের গাদ্দারি।

প্রতি দেশেই নানা রূপ সমস্যা থাকে -যেমন সমস্যা রয়েছে আজকের বাংলাদেশে। তবে সে সব সমস্যার সমাধানও থাকে। সমস্যার সমাধানো সচেষ্ট না হয়ে মুসলিম দেশভাঙ্গা কখনোই জায়েজ নয়। তাতে শক্তিহানী হয় ও শত্রুর গোলাম হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এজন্যি ইসলামে মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গা হারাম। তাই একাত্তরে কোন ইসলামী দল, কোন আলেম, কোন পীর পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেনি।  দেশের সমস্যার সমাধান করতে হয় দেশের অখণ্ডতা বাঁচিয়ে রেখে; দেশকে ভেঙ্গে এবং শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে নয়। অথচ মুজিব ও তার অনুসারীগণ সেটিই করেছে। এবং এরাই বছুর ঘুরে ১৬ ডিসেম্বর এলে ভারতের সে বিজয় নিয়ে উৎসব করে।

মুসলিম হওয়ার অর্থ একাকী নামাজ-রোজা পালন নয়, বরং প্রবল আগ্রহ থাকতে হয় ভিন্ ভাষী, ভিন্ বর্ণের ও ভিন্ এলাকার মুসলিমের সাথে একই জায়নামাজে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়ায়। একই রূপ আগ্রহ থাকতে হয় তাদের মত ভিন্ ভাষী, ভিন্ বর্ণের ও ভিন্ এলাকার মুসলিমের সাথে কাঁধ কাঁধ মিলিয়ে অখণ্ড রাষ্ট্র নির্মাণের ও সে রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ বসবাসের। নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের যুগে তো তেমনটিই দেখা গেছে। কিন্তু বাঙালি মুসলিমগণ নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের সে সূন্নত নিয়ে বাঁচতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তারা বরং মূর্তিপূজারি ভারতীয় কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নেমেছে; এবং সেটি পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গতে এবং অবাঙালি মুসলিম ভাইদের হত্যা করতে ও তাদের ঘরবাড়ী দখলে নিতে। মহান আল্লাহ তায়ালার এর চেয়ে অধিক গর্হিত কাজ আর কি থাকতে পারে?   

প্রশ্ন হলো, কোন মুসলিম কি অন্য মুসলিমের ঘরভাঙ্গা নিয়ে উৎসব করতে পারে? এরূপ বিকৃত রুচির মানুষ নামায়-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করুক না কেন, তাকে কি ঈমানদার বলা যায়? অথচ মুসলিমের ঘর ভাঙ্গার চেয়ে বহু লক্ষ গুণ অধিক ক্ষতিকর হলো কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গা। কারণ কোন মুসলিম দেশকে দুর্বল করার অর্থ মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করা। তাই সেটি হারাম। এজন্যই বিশ্বের কোন মুসলিম রাষ্ট্র ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত ও ভারত অনুগত ভূটানের ন্যায় কিছু কাফির রাষ্ট্র।  কোন ঈমানদার কি একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গা নিয়ে উৎসব করতে পারে? অথচ ১৬ ডিসেম্বর এলে মুসলিম নামধারী বহু বাঙালি ভারতীয় পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে মিলে পাকিস্তান ভাঙ্গার উৎসব করে।

মোদ্দা কথা হলো, ইসলাম শুধু নামাজ-রোজা ও  হজ্জ-যাকাতের  বিধানই দেয়নি; বরং দেশের রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার ক্ষেত্রেও কিছু অলংঘনীয় নীতি মালা দিয়েছে। তাই যেমন হারাম রাজনীতি রয়েছে; তেমনি রয়েছে ফরজ রাজনীতি তথা জিহাদের রাজনীতি। সে ফরজ রাজনীতিতে গুরুত্ব পায় মুসলিম দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতাকে রক্ষা করা। গুরুত্ব পায় প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব। এবং চরম গাদ্দারী  রূপে গণ্য হয় ভাষা ও অঞ্চলের নামে কোন মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করার কাজ। এবং হারাম গণ্য হয় কাফের শক্তির অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা। অথচ একাত্তরে মুক্তি বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর লোকেরা তো সেটিই করেছে।

পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা ফিতনাকে মানব হত্যা বা গণহত্যার চেয়েও গুরুতর পাপকর্ম বলেছেন। মানব হত্যা বা গণহতার ন্যায় অপরাধে বহু লোকের প্রাণনাশ হয়। এরূপ মানব হত্যা বা গণহতার কাণ্ড উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফাদের আমলেও হয়েছে।   কিন্তু সে প্রাণনাশের ফলে মুসলিম উম্মাহ সেদিন ভূগোল টুকরো টুকরো হয়নি। ফলে মুসলিম উম্মাহ দুর্বল হয়নি; স্বাধীনতাও হারায়নি।  অথচ ফিতনার কারণে মুসলিম টুকরো টুকরো হয় এবং মুসলিম ভূমি পরাধীন হয় -যেমনটি একাত্তরে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে। প্রশ্ন হলো ফিতনা কি? ফিতনা তো তাই যা মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা, ঐক্য, স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে। তাই একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান আর্মির অপারশনে মুসলিম উম্মাহর যতটা ক্ষতি হয়েছিল, তার চেয়ে বহু হাজার গুণ অধিক ক্ষতি হয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বাহিনী ও তাদের প্রভু হিন্দুত্ববাদী ভারতের হাতে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ ভারতে অধিনত গোলাম রাষ্ট হতো না। ৫৪টি নদীর পানি ভারতের হাতে লুণ্ঠিত হতো। গণতন্ত্রকে কবরে যেত হতো না। এবং আলেমদের গণহত্যা ও ফাঁসির মুখে পড়তে হতো না। তখন পাকিস্তান পরিণত হতো ৪৪ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক রাষ্ট্রে। তখন দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি রূপে বাঙালি মুসলিমগণ সুযোগ পেত বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার। সে অখণ্ড পাকিস্তানের মৃত্যুতে বাঙালির সম্ভাবনারও মৃত্যু ঘটেছে।    

মুসলিম হওয়ার শর্ত হলো, মেনে চলতে হয় ইসলামের শতকরা শতভাগ বিধান। একটি বিধান অমান্য করাতে ইবলিস অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে। বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের জীবনে ইসলামী বিধানের প্রতি সে আনুগত্য থাকলে তারা কি ১৯৭১’য়ে ভারতের ন্যায় একটি শত্রু দেশের  কোলে গিয়ে উঠতো? সেদেশের কাফের শক্তিকে বিজয়ী করে তাদের মুখে কি হাসি ফোটাতো? সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর আয়াতে এবং সুরা মুমতাহেনার ১ নম্বর আয়াতে কাফিরদের বন্ধু রূপ গ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে। ১৯৭১’য়ে যারা ভারতে আশ্রয় এবং ভারতীয় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে যুদ্ধ করে, তাদের কাছে কি গুরুত্ব পেয়েছিল সে কুর’আনী হুকুম? কাফিরদের বিজয় বাড়ানো তো শয়তানের কাজ, ঈমানদারের নয়।

 

ঈমানদারকে সুস্পষ্ট চেনা যায় কাকে সে বন্ধু এবং কাকে সে শত্রুরূপে গ্রহণ করলো –তা দেখে। ঈমানদার  কখনোই কোন কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করে না। সে হারাম কাজটি করেছিল নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর। সে বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রবার্ট ক্লাইভকে। এতে ইংরেজদের হাতে লুন্ঠিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। আর শেখ মুজিব বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছিল ভারতীয় কাফের ইন্দিরা গান্ধিকে। তার সে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পরাধীনতা নেমে আসে বাংলাদেশীদের জীবনে। বাংলাদেশ পরিণত হয় ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রে (vassal state)। ১৭৫৭’য়ে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পর বাঙালি মুসলিম ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে কলংকিত অধ্যায়। ইসলাম ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব ও তার অনুসারীদের অপরাধ এবং ভারতের প্রতি তাদের দাসসুলভ চরিত্র আজ আর গোপন বিষয় নয়। শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশে আজ যা কিছু ঘটেছে -তা তো তার পিতার অপরাধেরই ধারাবাহিকতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *