বাঙালি মুসলিম জীবনে মতবাদী রাজনীতির নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 বিষাক্ত মতবাদের গণনির্মূল নীতি

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী প্রাণনাশ ও সম্পদের বিনাশ ভূমিকম্প, ঘুর্ণিঝড় বা প্লাবনের কারণে হয়নি। সেটি বিষাক্ত জীবাণুর কারণেও হয়নি। সেটি হয়েছে বিভিন্ন মতবাদী রাজনীতির নাশকতায় । মানব ইতিহাসের বিবিধ প্রাণনাশী জীবাণুর চেয়ে অধিক প্রাণনাশী প্রমাণিত হয়েছে মানব-সৃষ্ট মতবাদগুলি। সে মতবাদগুলির মধ্য সবচেয়ে প্রাণনাশী প্রমাণিত হয়েছে বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনিজম। বিশ্বের নানা প্রান্তে এ মতবাদগুলি পরিণত হয়েছিল অপরাধের ভয়ানক হাতিয়ারে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, ইউরোপে কোন ধর্মের জন্ম হয়নি; কিন্তু উপরিউক্ত ৫টি বিষাক্ত মতবাদের সবগুলির জন্মই ইউরোপে। ফলে বিশ্বব্যাপী গণনির্মূলের নাশকতায় ইউরোপীয়ানদের কোন তুলনা হয়না। উল্লেখ্য যে, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনিজম  -এ ৫টি মতবাদের অনুসারীরাই বিশ্বে দুইটি বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে -যা প্রাণনাশ ঘটায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের। শত শত শহর, কোটি কোট ঘরবাড়ী সে যুদ্ধে মাটির সাথে মিশে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি পারমাণবিক বোমা। কোন রোগজীবণু, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও ভূমিকম্প কি মানবজাতির এতো বড় ক্ষতি করেনি।  

ইউরোপীয় বর্ণবাদী নাশকতায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাব-অরিজিন এবং নিউজিল্যান্ডে মাউরী জনগণ। গায়ের রং ভিন্ন হওয়া ছাড়া তাদের কোন অপরাধই ছিল না। মশা-মাছির মত তাদেরকে নির্মূল করা হয়েছে। তাদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে সেখানে ইউরোপীদের বসানো হয়েছে। গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে আফ্রিকানদের গলায় রশি বেঁধে গরুছাগলের ন্যায় হাটে তোলা হয়েছে এবং কৃতদাস রূপে বিক্রি করা হয়েছে। ঠাসাঠাসি করে জাহাজে করে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা নেয়ার পথে অনাহারে ও রোগে-ভোগে হাজার কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীর মৃত্যু হয়েছে এবং মৃতদের সমুদ্রে ফেলা হয়েছে।

জাতীয়তাবাদের নামে জাতিগত পরিচয়কে বড় করতে ও অন্যদের উপর দখলদারী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেসব দীর্ঘকালীন জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে শত বছর ধরে। অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছে জার্মানদের সাথে ফরাসী, পোলিশ, রাশিয়ানসহ অন্যান্য ইউরোপীয়ানদের। জাতীয় সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি বাড়াতে শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী উপনিবেশিক দখলদারী ও লুণ্ঠন। উপনিবেশগুলির আয়োতন বাড়াতে সংঘটত করা হয়েছে বর্ণগণ নির্মূল, জাতিগণ নির্মূল ও সভ্যতার নির্মূল। ইউরোপীয়দের হাত থেকে তাই বাঁচেনি দক্ষিণ আমেরিকার ও আফ্রিকার বহু প্রাচীন সভ্যতা।

জার্মান ও ইতালীয়ানদের ন্যায় ইউরোপীয় জাতিগুলির মাঝে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ হয়েছে নাজীবাদ ও ফ্যাসিবাদের নামে। বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সে ফ্যাসিবাদী নাশকতায়। এভাবে ভিন্ন দল, ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতের মানুষকে নির্মূল করা ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। জার্মানীতে যেমন বহু লক্ষ ইহুদীকে নির্মূল করা হয়, সে একই পথে ফিলিস্তিনীদের নির্মূল করা হচ্ছে তাদের নিজ জন্মভূমিতে। 

 

বিষাক্ত মতবাদের নাশকতা

কোভিড, এইডস, যক্ষার ন্যায় দৈহিক ব্যাধীগুলি যেমন বিশ্বময় সংক্রমণ ঘটায়, সেরূপ বিশ্বময় সংক্রমণ ঘটিয়েছে বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনজমের ন্যায় বিষাক্ত মতবাদগুলিও। তাই ইউরোপে জন্ম নেয়া বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদ ইউরোপে সীমিত থাকেনি, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্বেও। দেহে জীবাণু ঢুকলে যেমন রোগের উপদ্রব শুরু হয়, এ বিষাদ মতবাদও তেমনি রাজনীতিতে নাশকতা আনে। ফলে শুরু হয় আরব জাতীয়তাবাদ, তুর্কি জাতীয়তাবাদ, কুর্দি জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ঝড়। এসব মতবাদের কারণ শুরু হয় জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ -যাতে মৃত্যু হয়ে হাজার হাজার মুসলিমের। শুরু হয় আরবদের হাতে তুর্কি, তুর্কিদের হাতে আরব এবং বাঙালিদের হাতে অবাঙালি এবং অবাঙালিদের হাতে বাঙালির খুনোখুনি। টুকরো টুকরো খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে যায় মুসলিম উম্মাহর ভূগোল। বিভক্তির দেয়াল খাড়া হয় ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ও গোত্রের নামে। মুসলিম বিশ্বে এরূপ বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদী মহামারী পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। ১৩ শত বছর ধরে আরব, তুর্কি, কুর্দি ও আফ্রিকান মুসলিমগণ এক অখণ্ড মুসলিম ভূমিতে ভাতৃসুলভ সৌহার্দ নিয়ে শান্তিতে বসবাস করেছে। আরবগণ ইস্তাম্বুলে, বাঙালিগণ মক্কা-মদিনায় ঘর গড়তে পারতো -কোন ভিসা লাগতো না। 

ইউরোপীয় মতবাদী রোগগুলি মুসলিম ভূমিতে আসায় উম্মাহর ভাঙ্গন শুধু জাতীয়তাবাদে সীমিত থাকেনি; শুরু হয়েছে উপজাতীয় ও গোত্রীয় বিভক্তি। ফলে উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে একক আরব রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি, বরং জন্ম দিয়েছে ২২টি উপজাতীয় ও গোত্রীয় আরব রাষ্ট্রের। কোন জাতিকে শক্তিহীন করার সবচেয়ে সফল হাতিয়ার হলো বিভক্তি; বর্নবাদ, জাতীয়তাবাদ ও গোত্রবাদ সে কাজটিই করে। ফলে পৌত্তলিকতা, নাস্তিকতা, খৃষ্টান ধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম মুসলিম উম্মাহকে এতোটা ক্ষতি করতে পারিনি -যা করেছে পাশ্চাত্যের গর্ভে জন্ম নেয়া বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদ। এ মতবাদী রাজনীতির নাশকতায় যেমন ভেঙ্গে গেছে উসমানিয়া খেলাফত, তেমনি ভেঙ্গে গেছে খেলাফতের পর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। এ বিভক্তি মুসলিম উম্মাহকে এতোই শক্তিহীন করেছে যে, বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিম ইসরাইলের ৭০ লাখ ইহুদীর মোকাবেলা করতে পারছে না। বিশাল বপুধারী ব্যক্তি তার ভাঙ্গা হাড্ডি নিয়ে ধরাশায়ী হলে সে ব্যাথায় কাতরায়। মোকাবেলা দূরে থাক, খাড়া হওয়ারই সামর্থ্যও তার থাকে না। তখন শিশুও তার দেহের উপর নাচতে পারে। বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর অবস্থা তো সেরূপই। এজন্যই ইসরাইলের ৭০ লাখ ইহুদী ১৫০ কোটি মুসলিমের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তা করার সাহস পাচ্ছে। মহান আল্লাহতায়ালা এজন্যই একতাকে ফরজ করেছেন এবং বিভক্তিকে হারাম করেছেন। এজন্যই জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ ও বর্ণবাদের ন্যায় বিভক্তি সৃষ্টিকারী মতবাদগুলি ইসলামে হারাম। কোন ঈমানদার এসব মতবাদের অনুসারী হতে পারে। পরিতাপের বিষয় হলো মুসলিম বিশ্বে শুধু সূদী ব্যাংক, পতিতাবৃত্তি ও নানারূপ দুর্বৃত্তিই প্রতিষ্ঠা পায়নি, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এসব হারাম মতবাদও।       

মানব জাতির ইতিহাসে আরেক ভয়ংকর প্রাণনাশী মতবাদের আবিস্কার হয় কম্যুনিজমের নামে। বর্ণবাদী নির্মূলের পর এ মতবাদের অনুসারীগণ পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বেশী মনুষ্য প্রাণীর মৃত্যু ঘটিয়েছে। শ্রেণীশত্রু নির্মূলের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, কম্বোডিয়া, আলবানিয়া সহ বিশ্বের বহু দেশে। মানুষকে তারা গরু-ছাগলের মতই আরেক পশু মনে করে। ফলে মানব হত্যায় তাদের মনে আদৌ দংশন হয়না। কম্যুনিস্টদের শাসনামলে বিশ লাখের বেশী মানুষকে হত্যা করা হয়েছে কম্বোডিয়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও কম্যুনিস্টদের রাজনীতির নাশকতাটি বিশাল। প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলায় কম্যুনিস্টরা শুরু করে নক্সালবাড়ী আন্দোলনের নামে প্রাণনাশের রাজনীতি। সে রাজনীতি সংক্রামিত হয় বাংলাদেশেও। তাদের অনুকরণে শুরু হয় সর্বহারা পার্টি, জাসদের গণবাহিনী ও বিভিন্ন কম্যুনিস্ট পার্টির নামে খুনের রাজনীতি। তাদের হাতে খুন হয়েছে শত শত নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষ। 

বাঙালি মুসলিম মানসে কম্যুনিজমের সংক্রমণের শুরু পাকিস্তান আমল থেকেই -বিশেষ করে ষাটের দশকে। মতবাদ হিসাবে কম্যুনিজম আজ প্রমাণিত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক জঞ্জাল রয়েছে। তাই এ জঞ্জালকে রাশিয়া ও চীনের ন্যায় এ মতবাদের মূল ভূমিতেই নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে আবর্জনার স্তুপে। অথচ এ আবর্জনার স্রোত ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বেশীর ভাগকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় -যেমন পানির স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় খড়কুটো ও কচুরিপানাকে। পরিতাপের বিষয় হলো, আজও সে জঞ্জালের স্রোতে ভাসছে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবী।  বিশ্বের অন্যান্য দেশে কম্যুনিজমের জোয়ার বিলুপ্ত হলেও বাংলাদেশ এখনো অনেকে এ জঞ্জাল নিয়ে গর্ব করে।       

 

বাম রাজনীতির নাশকতা

বাঙালি মুসলিমের রাজনীতিতে কম্যুনিস্টদের বিশেষ একটি পরিচয় আছে। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থরক্ষার রাজনীতি সব সময় তাদের কাছে ঘৃণীত হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রূপে। ইসলাম ও মুসলিম -এ পরিচয় নিয়ে রাজনীত করা তাদের কাছে বড়ই অপছন্দের। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে বান্দার এ পরিচয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কে কোন জাতির, বর্ণের বা মতবাদের সে প্রশ্ন রোজ হাশরের বিচার দিনে উঠবে না। বরং প্রশ্ন উঠবে, কে কতবড় মুসলিম এবং কে কতটা ইসলামের বিজয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল ও কুরবানী দিয়েছিল -সেটির। ফলে ইসলাম ও মুসলিম -এ পরিচয়ের উপর ভিত্তি করেই মুসলিমদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র নির্মাণের ভাবনা। অথচ বামপন্থীদের কাছে ঈমানভিত্তিক পরিচয়বাদী এ রাজনীতি সাম্প্রদায়িক ও ঘৃণার বস্তু।  ইসলাম থেকে দূরে সরা এই বেঈমানগণ কখনোই ইসলামের ন্যায্যতা, সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেনা। এদের আদর্শিক গুরু কার্ল মার্কস অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামকেও নেশাগ্রস্তকারী আফিম বলতো।

শুরু থেকেই মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি বামপন্থীদের কাছে গণ্য হয়েছে রাজনৈতিক শত্রু রূপে। এমন একটি চেতনার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুসলিমদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনীতি তাদের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন তারা চায়নি, তেমনি দেশটি বেঁচে থাকুক -সেটিও তারা চায়নি। লক্ষণীয় হলো, পাকিস্তানের জন্মকাল থেকেই শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার স্নায়ু যুদ্ধ। সে সময় পাকিস্তান ছিল কম্যুনিজম বিরোধী মার্কিন শিবিরে। ভারত ছিল সোভিয়েত শিবিরে। ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে সোভিয়েত রাশিয়া সব সময়ই ভারতকে সমর্থন করে। তখন সে স্নায়ু যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার এজেন্ডা হয় মার্কিন শিবিরের দেশ পাকিস্তানের ক্ষতি সাধন। এবং সেটিই সোভিয়েত রাশিয়াকে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার কাজে ভারতের পার্টনারে পরিণত করে। তাই ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে গড় উঠে রাজনৈতিক ও সামরিক কোয়ালিশন। এবং সে কোয়ালিশনের চুড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্টগণ মেনে চলতো ভারতীয় কম্যুনিস্টদের নির্দেশাবলী। অপর দিকে ভারতীয় কম্যুনিস্টগণ মেনে চলতো সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্টদের নির্দেশাবলী। যে কোন আদর্শের ন্যায় কম্যুনিজমের কোন ভৌগলিক সীমারেখা ছিল না। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার নীতি, ভারতীয় কম্যুনিস্টদের নীতি ও বাঙালি কম্যুনিস্টদের নীতি একই মোহনায় একাকার হয়ে যায়। পাকিস্তান বেঁচে থাকুক সেটি ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় বাঙালি বামপন্থীগণ ও বাঙালি ফ্যাসিস্টগণও চায়নি। পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখায় তো তাদেরই আগ্রহ ছিল যারা মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত ছিল। স্বাধীন থাকতে হলে স্বাধীনতা বাঁচানোর সামর্থ্য থাকতে হয়। ১৯৪৭ সালে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলিমদের সে সামর্থ্য ছিল না। তাদের ছিল প্রচণ্ড ভারতভীতি। তাই তারা বৃহত্তর পাকিস্তানে যোগ দেয়। রুশভীতি যেমন ইউরোপীদের একত্রিত করেছে, ভারত ভীতিও তেমনি ১৯১৪৭’য়ে উপমহাদেশের মুসলিমদের একত্রিত করেছিল। কিন্তু বামপন্থীদের কাছে মুসলিমদের সে একতা ভাল লাগেনি। বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতার ভাবনা বাঙালি বামপন্থী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের ছিল না। ফলে একাত্তরে পাকিস্তানের বিভক্তিকরণে বামপন্থী, হিন্দুত্ববাদী ও আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের মধ্য গড়ে উঠে রাজনৈতিক কোয়ালিশন।

পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। ফলে সে সময় কম্যুনিস্টগণ যোগ দেয় মাওলানা ভাষানীর প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তথা ন্যাপে। ১৯৪৭’য়ের আগে মাওলানা ভাষানী ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি তার কেবলা পরিবর্তন করেন এবং পরিণত হন কম্যুনিস্টদের অভিভাবকে। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টগণ সোভিয়েত রাশিয়াপন্থী ও চীনপন্থী –এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। মাওলানা ভাষানী যান চীনের পক্ষে। এতে বিভক্ত হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্টগণও। মাওলানা ভাষানী ১৯৭০’য়ের নির্বাচন বয়কট করে মুজিবের বিজয়ে সহয়তা দেন এবং একাত্তরে আওয়ামী লীগের পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে যশোরের ভাষানী ন্যাপের সাবেক নেতা আব্দুল হক এবং তার চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ভাষানী ন্যাপের আরেক নেতা রংপুরের মশিহুর রহমান যাদু মিয়াও অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। অপর দিকে মাওলানা ভাষানী খোদ নিজে একাত্তরের যুদ্ধকালে ভারতের কোলে গিয়ে উঠেন এবং ভারত সরকারের পরিচর্যা নেন।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কম্যুনিস্টগণ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসে। তখন সোভিয়েত রাশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন ধারার রাজনীতির পথ অনুসরণ করতে থাকে। শেখ মুজিব যেভাবে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র কবর পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা দেয় তার পিছনে ছিল সোভিয়েতপন্থী কম্যুনিস্টদের প্রভাব। অনেকের বিশ্বাস, মুজিবকে একদলীয় বাকশালের পথে উস্কে দেয় মনি সিংহ’য়ের ন্যায় কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দ। কারণ বহুদলীয় গণতন্ত্রে যেমন রাশিয়ান কম্যুনিস্টদের আগ্রহ ছিল না, তেমনি আগ্রহ ছিল না সোভিয়েত অনুসারী বাঙালি কম্যুনিস্টদেরও। তেমন এক স্বৈরাচারী চেতনার কারণে বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদ ইসলাম কিছু কাল আগে বলেছিল, “হাসিনার বিকল্প নাই।” লক্ষ্য যখন ইসলামপন্থীদের নির্মূল ও এক দলীয় ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা, তখন নির্মূলমুখী সে রাজনীতিতে হাসিনার ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিকল্প না থাকারই কথা। 

যারা ইসলামপন্থী এবং ভারত বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সৃষ্টির পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে ঘোষীত হতে থাকে নির্মূলের হুংকার। তেমন এক যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরই। এটিই হলো বাংলাদেশের মাটিতে ভারতসেবী বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্ট রাজনীতির মূল এজেন্ডা। ভারতও সেটিই চায়। নির্মূলের সে ধ্বনিকে তীব্রতর করতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে গণ-আদালত বসানো হয়েছিল। গণ-আদালতে বিচার হয় না, বরং তুলে ধরা হয় বিশেষ একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দাবীকে। তবে নব্বইয়ের দশকে সে এজেন্ডার বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ, তখন ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার শাসনামলে সে গণ-আদালতকে ঢাকা হাইকোর্টের কক্ষে বসানো হয়। নাম দেয়া হয় মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক আদালত। অথচ এই আদালত কোন মানদন্ডেই আন্তর্জাতিক ছিল না। এ আদালতে বাংলাদেশের বাইরের আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকে কোন বিচারপতি আনা হয়নি। কোন বিদেশী আইনবিদকেও কোন আসামীর পক্ষে মামলা পরিচালনার অধিকার দেয়া হয়নি। বরং গণ-আদালতের কোন কোন বিচারককে এই আদালতের বিচারক রূপেও নিয়োগ দেয়া হয়।

 

ফ্যাসিবাদের নাশকতা

বহুদলীয় গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ বিচারে ফ্যাসিস্টদের রুচি থাকে না। তারা বরং রাজনীতির ময়দান থেকে অন্যদের নির্মূল করে এবং  আদালতকে ব্যবহার করতে চায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের হাতিয়ার রূপে। হাসিনা যখন ক্ষমতায়, আদালতকে নতজানু হতে বাধ্য করতে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় শাহবাগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল উদ্যক্তা ছিল বামপন্থী, হিন্দুত্ববাদী ও আওয়ামী রাজনীতির ফ্যাসিস্টগণ। জনসভায় স্লোগান তোলা হয়, “বিচার নয়, ফাঁসি চাই।” সুষ্ঠ বিচার নিয়ে  ফ্যাসিস্টদের যে সামান্যতম আগ্রহ থাকে না –এ হলো তারই প্রমাণ। শাহবাগ আন্দলোন সেদিন সফল হয়। কারণ, যে আন্দোলন গড়ে তোলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে –সফল হতে সে আন্দোলনের পথে কোন বাধা থাকে না। ফ্যাসিবাদে বিচারকদের ন্যায়-বিচারে স্বাধীনতা থাকে না; তখন বিচারকগণ বিচার করে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের খুশি করতে। ফলে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে যাবত-জীবন কারাদণ্ড থেকে ফাঁসিতে রূপান্তরিত করা হয়।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কখনোই নির্মূলের রাজনীতি চলে না, নির্মূলের জন্য চাই ফ্যাসিবাদ। তখন নির্মূলের কাজে পুলিশ, আদালত, দলীয় গুন্ডা বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছাচারে ব্যবহার করা যায়। তাই ফ্যাসিবাদী হাসিনা গণতন্ত্রকে কবরে পাঠায় এবং প্রতিষ্ঠা দেয় নিরেট ফ্যাসিবাদকে। এরই ফলে সাপলা চত্বরের গণহত্যা, পিল খানায় ৫৭ জন সামরিক অফিসার হত্যা, গুম, অপহরন, ক্রসফায়ারে হত্যা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন ও বিচারের নামে ফাঁসি বাংলাদেশে রাজনীতির আচারে পরিণত হয়। ভারত গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু তারা পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী বাকশালীদের এই ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে। এবং সমর্থন দিয়েছে ভোটডাকাতিকে।

প্রতিপক্ষ নির্মূলে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ময়দানে নামিয়েছিল পুলিশ, RAB ও সরকারি দলের ক্যাডারদের। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও বিজিবি’কেও। সভ্য রাজনীতির নিজস্ব কিছু ভদ্র রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি থাকে। কিন্তু সে ভদ্রতা, সভ্যতা ও ন্যায়নীতির রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কারণ সেগুলিকে বাঁচিয়ে রেখে ফ্যাসিবাদী শাসন চলে না। তবে রাজনীতিতে নির্মূলের এ ধারাটি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, বরং পরিকল্পিত ভাবে সেটি গড়ে তোলা হয়েছে। সেটি বাংলাদেশের জন্মের প্রথম দিন থেকেই। যে কোন দেশের জন্য এমন নীতি আত্মঘাতী। এমন নীতি সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণকে অসম্ভব করে। প্রতি দেশেই এমন নির্মূলমুখী নীতি রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ আনে। বাংলাদেশ তেমন একটি আত্মঘাতী যুদ্ধ শুরু করেছিল শেখ হাসিনা। তেমন একটি যুদ্ধের রক্তাক্ষয়ী চিত্রই দেখা গিয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে‌’তে মতিঝিলের সাপলা চত্বরে। যুদ্ধাবস্থায় মানুষ খুন হয়, কিন্তু কারো বিচার হয় না। বাংলাদেশেও তাই বিচার হয় না। সাপলা চত্বরে যে শত শত মানুষ নিহত হলো তাদের কেউই বিচার পায়নি। অসংখ্য অপরাধের কান্ড ঘটেছে, কিন্তু কারোই কোন শাস্তি হয়নি। ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য: অপরাধ ঘটানো, বিচার করা নয়। তাই ২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্টে হাসিনার সরকার অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে।

নির্মূলমুখী এ রাজনীতির জনক শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বে গড়ে উঠা আওয়ামী-বাকশালী ফ্যাসিস্ট শক্তি। এরূপ ঘাতক রাজনীতির পিছনে যেমন বিপুল বিদেশী বিনিয়োগ থাকে, তেমনি দেশধ্বংসের পরিকল্পনাও থাকে। লক্ষ্য, বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এবং সে কাজে ভারতের বিনিয়োগটি বিশাল। ২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ফ্যাসিবাদী হাসিনা পালাতে বাধ্য হলেও ভারতের বিনিয়োগে ভাটা পড়েনি। ভারতের লক্ষ্য, বাংলাদেশের মেরুদন্ড ভাঙ্গা। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত নতুন খেলাওয়ার নামাবে -সেটি সুনিশ্চিত। কারণ, হাসিনার ন্যায় পুরনো খেলাওয়াড়ের মাঠ ছাড়াতে শত্রুর খেলা কখনো শেষ হয়না। তাছাড়া বাংলার মাটিতে শুধু দেশপ্রেমিকই জন্ম নেয়না, মীরজাফরও পয়দা হয়। তাই স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে শত্রুদের যেমন চিনতে হবে, তেমনি যুদ্ধ নিয়েই বাঁচতে হবে। ২৮/০৯/২০২৪   

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *