বাঙালী মুসলমানের আত্মঘাতি আত্মবিস্মৃতি

যে ভয়ানক বিপদ স্মৃতি বিলুপ্তির

বাঙালী মুসলমানের সমস্যা নিছক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নয়। সন্ত্রাস, দূর্নীতি,ব্যর্থ প্রশাসন বা আইন-আদলতও  নয়। মূল বিপদ আরো গভীরে, সেটি স্মৃতিবিলুপ্তির। স্মৃতিবিলুপ্তির সে রোগটি এতটাই ভয়ানক যে, তাতে হারিয়ে গেছে মুসলমান রূপে দায়িত্ব পালনের স্মৃতি। মুসলমান হওয়ার অর্থ যে আল্লাহর সৈনিক হওয়া এবং সে সৈনিকের মূল কাজ যে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনা এবং সে বিজয় আনতে অর্থ, শ্রম, মেধা, এমনকি প্রাণের কোরবানী পেশ করা এবং সে কোরবানী ছাড়া জান্নাতে যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব –ইসলামের সে মৌলিক সত্য এবং নবীজী (সাঃ)র সে সূন্নতগুলো বাঙালী মুসলমানের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। ফলে আল্লাহর শরিয়ত এবং ইসলামের পতাকা আজ শত্রু শক্তির পদানত হলেও ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে সে পতাকা তুলে ধরার মত লোক নেই। বরং কোটি কোটি লোক আছে যারা কাফের ব্রিটিশদের প্রণীত আইন, তাদের সংস্কৃতি ও তাদের আইন-আদালতকে একান্ত আপন রূপে মনে করে। সেগুলির সুরক্ষায় যুদ্ধ করে এবং সে যুদ্ধে প্রাণও দেয়। হাজার হাজার মসজিদ মাদ্রাসার দেশে শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি আজ আইনবিরোধী,এবং তার পক্ষ নেয়াটি জঙ্গিবাদ। ফলে শাস্তিযোগ্য অপরাধও। অথচ আইনসিদ্ধ হল বেশ্যাবৃত্তি, সূদীকারবার, মদ-উৎপাদন ও মদের ব্যবসা।  ফলে দেশে ব্যাভিচারি আজ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা, সে ব্যবসায় কারো শাস্তি হয় না; কিন্তু শাস্তি হয় এবং পায়ে দণ্ডবেড়ী পড়ানো হয় শরিয়তের দাবী নিয়ে রাস্তায় নামলে।

চরম স্মৃতি-বিলুপ্তির শিকার দেশটির নিজের ইতিহাস। বাঙালী মুসলমান ভূলেই গেছে তাদের বিরুদ্ধে  ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও বর্ণহিন্দুদের অতীতের ষড়যন্তু ও শোষণের কথা। ভূলে গেছে শুধু ১৭৫৭ সালের মীরজাফরদেরই নয়, ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর মীরজাফরদেরও। ভূলে গেছে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি পাকিস্তান নামে একটি দেশে তারা বসবাস করতো, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সে মুসলিম রাষ্ট্রটির তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল এবং সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার বাঙালী ছিল। একথাও ভূলে গেছে,পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় বাঙালী মুসলমানদের অবদানই সবচেয়ে বেশী ছিল। এবং প্রায় পুরাপুরি ভূলে গেছে,বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুরু ১৯৭১ থেকে নয়,স্বাধীনতা দিবস রূপে ১৪ই আগষ্টের ন্যায় আরেকটি দিবস এ দেশের নগর-ব্ন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে ২৩ বছর মহা ধুমধামে পালিত হত। সে সাথে ভূলে গেছে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বর্ণহিন্দুদের প্রবল বিরোধীতার কথা।

আত্মবিস্মৃতি প্রতি পদে বিপর্যয় ডেকে আনে। মানুষের কর্ম ও আচরনের ন্যায় তার রাজনীতিও নিয়ন্ত্রিত হয় স্মৃতি থেকে। স্মৃতির ভাণ্ডার থেকেই মানুষ জানে কে তার শত্রু এবং কে তার মিত্র? “মেমোরি লস” বা স্মৃতি-বিলুপ্তিতে এসবই অসম্ভব হয়। তখন অসম্ভব হয় সুস্থ্য ও স্বাভাবিক ভাবে বাঁচা। মানুষ তখন পদে পদে ভূল করে, এমনকি চিনতে অসমর্থ হয় নিজের গৃহ, নিজের স্ত্রী এবং নিজের পুত্র-কণ্যাকে। অনেক সময় আপন  স্ত্রী এবং আপন পুত্র-কণ্যাকেও শত্রু-জ্ঞান করে মারতে তাড়া করে। এমন ব্যক্তি একাকী রাস্তায় বেরুলে সে আর নিজ ঘরে ফিরতে পারে না। চিকিৎসা শাস্ত্রে এমন রোগকে বলা হয় ডিমেনশিয়া বা এ্যাল্জহেইমারস ডিজিজ। তবে এমন স্মৃতি-বিলুপ্তি শুধু ব্যক্তি-জীবনে নয়, জাতীয় জীবনেও ঘটে। তখন সে জাতি চিরকালের ভয়ানক শত্রুকেও ভূলে যায়, এবং ভূলে যায় পরম মিত্রকেও। এমন স্মৃতি বিলুপ্তির নজির মানব ইতিহাসে অসংখ্য। আল্লাহকে ভূলে মানুষ শয়তানের পথ ধরে তো এমন স্মৃতিবিলুপ্তির ফলেই। ফিরোউনের বর্বর নিষ্ঠুরতা থেকে বনি ইসরাইলের লোকদের মহান আল্লাহতায়ালা প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। তাদের বাঁচাতে তিনি সাগর দ্বিখণ্ডিত করে তল দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা করে দিয়েছিলেন। মিশর থেকে উদ্ধারের পর সিনাই মরুভূমিতে আহার জোগাতে তাদের জন্য বছরের পর বছর আসমান থেকে মান্না ও সালওয়া পাঠিয়েছেন। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) যখন মাত্র ৪০ দিনের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যে যান তখন করুণাময় আল্লাহকে ভূলতে তাদের দেরী হয়নি। নিজ হাতে তারা গরুর স্বর্ণমুর্তি গড়ে সেটির পুঁজা শুরু করে দিয়েছিল।

বাঙালী মুসলমানদের স্মৃতি থেকে শুধু আল্লাহর শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠার দায়ভারই হারিয়ে যায়নি। হারিয়ে গেছে বাংলার শ্রেষ্ঠ মুসলমানদের স্মৃতি। ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে ইখতিয়ার মহম্মদ বখতিয়ার খিলজীকে –যিনি বাংলা জয় করে পৃথিবীর এ প্রান্তে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় শক্তি রূপে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন । হারিয়ে যাচ্ছে শাহজালাল, শাহ মখদুম ও খানজাহান আলীর মত মহামানবদের স্মৃতি। ভূলিয়ে দেয়া হচ্ছে সিরাজুদ্দৌলা,তিতুমির, হাজী শরিয়াতুল্লাহ।  স্মৃতি থেকে মুছে দেয়া হচ্ছে নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব আব্দুল লতিফ, মুন্সি মেহেরুল্লার মত মহান ব্যক্তিদের। নবাব সলিমুল্লাহ জমিদার পুত্র ছিলেন। রাজনীতিকে তিনি জনসেবার মাধ্যম রূপে ব্যবহার করেন। ফলে সম্পদের পাহাড় না গড়ে বরং নিঃস্ব হয়েছেন। ইন্তেকাল করেছেন ঋণী অবস্থায়। নিজ অর্থে ঢাকার বুকে গড়ে তুলেছেন বহু প্রতিষ্ঠান। উপমহাদেশের মুসলিম নেতাদের ঢাকায় দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলিম লীগ। সে মুসলিম লীগের হাতেই জন্ম নেয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান।মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে সেটিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অথচ সে ইতিহাস আজ বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় না। বরং পড়ানো তাদের ইতিহাস যারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেছে দূর্নীতির হাতিয়ার রূপে এবং দেশের সম্পদ লুটেছে দুহাতে।রাজনীতির মাধ্যমে ঢাকার অভিজাত এলাকায় তারা বাড়ি-গাড়ি ও বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছে। তাদের সে লুণ্ঠনের কারণে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি রূপে।

প্রচারণার সামর্থ্যটি বিশাল। লাগাতর প্রচারণার মাধ্যমে ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় অতি দুর্বৃত্তদেরও ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠা দেয় যায়। তেমনি শাপ-শকুন,গরু-ছাগলকেও দেব-দেবী রূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। হিটলার, মুসোলিনি, স্টালিন, জর্জবুশ ও ব্লেয়ারের ন্যায় গণহত্যার নায়কদের যে নিজ নিজ দেশে নেতা রূপে প্রতিষ্ঠা মিলেছিল সেটি তো প্রচার-প্রপাগাণ্ডার জোরেই। লাগাতর প্রচারের মাধ্যমে মানুষের স্মৃতির মানচিত্রই পাল্টে দেয়া যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিকল সেটিই ঘটেছে। দেশটির ইতিহাসের যারা সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারি ও দুর্নীতিপরায়ন,গণতন্ত্রকে যারা কবরে পাঠিয়ে একদলীয় বাকশাল কায়েম করলো, বাংলাদেশকে যারা ভারতের গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত করলো, দেশকে যারা আন্তর্জাতিক মহলে ভিক্ষার ঝুলি রূপে পরিচিত করলৌ এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে যারা আইন করে নিষিদ্ধ করলো সে অতি দুর্বৃত্তদেরও বলা হচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে। কাফের শক্তির সবচেয়ে বড় বন্ধুকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু ও পিতা রূপে। অপরদিকে যারা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা চায় তাদের পরিচিত করা হচ্ছে সন্ত্রাসী বলে।

 

যে অনিবার্য আযাব আত্মবিস্মৃতির

ব্যক্তির দায়িত্ব শুধু দেহ নিয়ে বাঁচা নয়, নানা রূপ স্মৃতি নিয়ে বাঁচাও। বিশেষ করে আল্লাহর প্রতি দায়ব্ধতার স্মৃতি নিয়ে বাঁচা। নামাযের প্রতি রাকাতে “ইয়্যাকানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাঈন” অর্থাৎ “আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার থেকেই সাহায্য চাই” –জায়নামাযে দাঁড়িয়ে মু’মিনের এটি এক বিশাল দায়ভারপূর্ণ ঘোষনা। এখানে ঘোষণাটি মহান আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের। ঈমানদারকে তার জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘন্টা, প্রতিটি মুহুর্ত বাঁচতে হয় এমন আত্মসমর্পেণের স্মৃতি নিয়ে। এরূপ বাঁচার মধ্যেই নিশ্চিত হয় সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা। মুমিনের জীবনে এটিই প্রতি মুহুর্তের যিকর। আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধতার এ যিকর বা স্মৃতিচারণ থেকে সামান্য বিচ্যুতির অর্থ কাফের হয়ে যাওয়া। আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধতার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই মুসলিমকে নামাযের প্রতি রাকাতে যেমন আত্মসমর্পিত গোলামের বেশে জায়নামাযে দাঁড়াতে হয়,তেমনি অবনত মস্তকে রুকু-সেজদাতে যেতে হয়। সে সাথে পবিত্র কোরআন থেকে পাঠও করতে হয়। নামাযের বাইরেও কোরআন-হাদীস পাঠ ও তাসবিহ-তাহলিলকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে হয়।

আল্লাহর স্মরণ যে কত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁকে ভূলে যাওয়া যে কত বিপদজনক -সে ঘোষণাটি পবিত্র কোরআনে বার বার এসেছে। বলা হয়েছে “যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে,অবশ্যই তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন উত্থিত কররো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে,“হে আমার প্রতিপালক!কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম।” তিনি বলবেন,“এরূপই আমার নিদর্শনবলী তোমার নিকট এসেছিল, কিন্তু তুমি সেগুলি ভূলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ  তুমিও বিস্মৃত হলে।” –(সুরা তা-হা আয়াত ১২৪-১২৬)। প্রতিদিন ৫ বার নামায আদায়ের মূল উদ্দেশ্যটি হলো মু’মিনের স্মৃতিতে আল্লাহর স্মরণকে চির জাগ্রত রাখা। তবে আল্লাহর স্মরণের অর্থ শুধু তাঁর নামের স্মরণ নয়,বরং তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার স্মরণ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“আমিই আল্লাহ,আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণ জাগিয়ে রাখতে নামায কায়েম করো।” –(সুরা তা-হা আয়াত ১৪)। যে ব্যক্তির মনে আল্লাহর স্মরণটুকুই বেঁচে নেই তার স্মৃতিতে কি সিরাতুল মোস্তাকীমে চলার প্রেরণা থাকে? আল্লাহবিস্মৃত এমন ব্যক্তি যে পথভ্রষ্ট হবে এবং শয়তানের অনুসরণ কররে সেটিই তো স্বাভাবিক।

আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়ভার থেকে আত্মবিস্মৃত হওয়ার অপরাধটি ইহুদীদের একার নয়। মহান আল্লাহর নেয়ামত ভোগের পর কোটি কোটি মানুষ আজও মুর্তি-পুজা করে,আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে –তা তো এমন স্মৃতি বিলুপ্তির কারণেই। আত্মবিস্মৃতির এ রোগটি তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়ানক আযাব রূপে আসে। আল্লাহকে ভূলে যাওয়া মানুষগুলো তখন লিপ্ত হয় আল্লাহর অবাধ্যতায় । পবিত্র কোরআনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ “তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভূলে যায়। (আল্লাহকে ভূলে যাওয়ার কারণে) তাদের স্মৃতি থেকে তাদের নিজেদেরকেই বিস্মৃত করে দেয়া হয়েছে, তারাই হল পাপাচারী” –সুরা  হাশর আয়াত ১৯)। অর্থাৎ যেখানেই ব্যক্তির স্মৃতি থেকে আল্লাহর স্মরণ বিলুপ্ত, সেখানেই আযাব রূপে আসে চরম আত্মবিস্মৃতি। মানুষের জীবনে স্মৃতি তো কম্পাসের কাজ করে। ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি,সংস্কৃতিসহ জীবনের প্রতি পদে সে স্মৃতিই পথ দেখায়। সে স্মৃতি হারিয়ে গেলে অসম্ভব হয় সঠিক পথে পথ চলা। আল্লাহবিমুখ মানুষের জন্য এটাই হল মহান আল্লাহর কঠিন শাস্তি। বেঈমানের জীবনে তাই কম্পাস নেই, ফলে নেই পথ চিনে সঠিক পথে চলার সামর্থ। সে পথ চলে পথ না চিনেই। কচুরিপানার ন্যায় নানা মত  ও মতবাদের স্রোতে তারা ভাসে। তাই বাংলাদেশে যারা এক সময় মার্কসবাদের জোয়ারে ভেসেছিল তারাই এখন ভারতপন্থি জাতিয়তাবাদী, কেউ বা মার্কিন শিবিরের এনজিও কর্মী।  

নিজের স্মৃতি থেকে নিজে বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ, নিজের মন থেকে নিজের কল্যাণচিন্তা বিলুপ্ত হওয়া। এমন আত্মবিস্মৃত ব্যক্তি তখন মূক্তির পথ দেখতে পায় না। আল্লাহ ও তাঁর প্রদর্শিত সিরাতুল মোস্তাকিমের বদলে তখন তার স্মৃতিতে জেগে উঠে শয়তান এবং শয়তানের প্রদর্শিত নানা পথ। তখন কল্যাণকর মনে হয় জাহান্নামের পথগুলি। আর ব্যক্তির জীবনে সে আযাবটিই ডেকে আনে সেক্যুলিরাজিম। সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ ইহজাগিকতা, ফলে এর লক্ষ্য হল মানুষকে আল্লাহবিমুখ ও পরকালবিমুখ করা। সেক্যুলারিস্ট ব্যক্তি তাই বেঁচে থাকে পার্থিব-স্বার্থ চিন্তা নিয়ে। এটি কোন আধুনিক মতবাদ নয়, বরং অতি আদিম জাহিলিয়াত। কাবিল ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম সেক্যুলার ব্যক্তি, নিছক পার্থিব স্বার্থচেতনায় সে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল। চেতনার ভূবনে এ মতবাদ প্রতিষ্ঠা পেলে বিলুপ্ত হয় আল্লাহর স্মরণ। তখন প্রকট আকার ধারণ করে আত্মবিস্মৃতি,এবং শুরু হয় পাপাচার। যাদের মনে মহান আল্লাহর স্মরণ নাই তাদের জীবনে অনিবার্য হয় নানা রূপের পথভ্রষ্টতা। তারা পরিণত হয় শয়তানের সহজ শিকারে। পথভ্রষ্ট হওয়ার আযাব আসে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকেও। তখন তাদের ঘাড়ে তিন চাপিয়ে দেন শয়তানকে। সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কোরঅআনের নিম্মুক্ত আয়াতেঃ “যারাই দয়াময়ের (রহমানের) যিকর থেকে বিস্মৃত হলো তাদের উপর আমরা চাপিয়ে দেই শয়তান, সে তখন তার সহচরে পরিণত হয়। নিশ্চয়ই তারা (শয়তান) বাধাগ্রস্ত করে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা, অথচ তারা (পথভ্রষ্টরা) মনে করে তারা হিদায়েতপ্রাপ্ত।”  -(সুরা যুখরাফ, আয়াত ৩৬-৩৭।  

চেতনা থেকে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ এবং তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বিলুপ্ত হলে মানুষ যে কতটা বিভ্রান্ত হয় তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ঢাকার এক পুজামণ্ডপে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন “মা দুর্গা তার গজে চড়ে আসায় বাংলাদেশে ফসল বেড়েছে”। তাঁর এমন বক্তব্য বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে ছাপাও হয়েছে। কোন ব্যক্তির স্মৃতিতে আল্লাহর স্মরণ বেঁচে থাকলে কি এভাবে দেব-দেবীর কথা মুখে আসে? শেখ হাসিনার এমন বিশ্বাস তাঁর চেতনায় হটাৎ গজায়নি। বরং এমন একটি কুফরি বিশ্বাসের জন্য বহু পূর্ব থেকেই সেক্যুলারিজম তার চেতনা জুড়ে বিশাল স্থান তৈরি করে দিয়েছিল।  সেটি আল্লাহর স্মরণ বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে। সে শূণ্যস্থানে সহজেই আধিপত্য জমিয়েছে দুর্গা দেবী। সেক্যুলারিস্টদের কাছে পরকালের স্মরণ, রাজনীতিতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার, সংস্কৃতিতে পর্দাপুশিদা এজন্যই সাম্প্রদায়িকতা। সে সাথে পশ্চাদপদতাও।তারা আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতা নিয়ে রাজনীতি করে না,বরং সেটি করে ব্যক্তি স্বার্থ,দলীয় স্বার্থ, বিদেশীদের স্বার্থের প্রতি নজর রেখে। ফলে সে রাজনীতির সর্বত্র জুড়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সুর। শরিয়তের প্রতিষ্টার বিরুদ্ধে এজন্যই তাদের যুদ্ধ। ফলে যে দেশে ও যে সমাজে সেক্যুলারিজমের প্রসার ঘটে সে দেশে স্বভাবতই বিলুপ্ত হয় আল্লাহর ভয়,এবং বিস্মৃত হয় তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার ফরজ দায়িত্ববোধটি। সে স্মৃতি-বিলুপ্তি নিয়েই শেখ মুজিব বাংলাদেশে ইসলামের বিজয়ের লক্ষ্যে প্রচার করা,কোন সংগঠন বা সভা-সমিতি করা সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ দরজা খুলে দিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী, সমাজবাদী -এরূপ নানা কুফরি মতবাদের প্রচারকদের।

আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বিস্মৃত হলে অনিবার্য হয় মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাব। আর সে আযাব আসে আত্মবিস্মৃতি রূপে, সেটি যেমন ব্যক্তি-জীবনে তেমনি জাতীয় জীবনে। জীবনে সুস্থ্যতা নিয়ে বাঁচতে হলে স্মৃতিতে শুধু বিশুদ্ধ খাদ্য-পানীয়’র চিত্র থাকলে চলে না। বিষ,বিষাক্ত শাপ ও হিংস্র জন্তজানোয়ারগুলোর চিত্রও মগজে রাখতে চয়। শিশুর সে স্মৃতি থাকে না, ফলে বিষাক্ত শাপকেও সে জড়িয়ে ধরে। তেমনি ভয়ানক ভূল হয় আল্লাহবিস্মৃত মানুষগুলোর জীবনে। তার ভূল করে ঘাতক শত্রুদের চিনতে। এমন স্মৃতিবিলুপ্তির কারণেই সেক্যুলার বাঙলী মুসলমানেরা ১৭৫৭ সালের শত্রুদের যেমন ভূলেছে, তেমনি ১৯৪৭ সালের শত্রুদেরও ভূলেছে। এবং ভুলেছে একাত্তর এবং একাত্তর পরবর্তী শত্রুদের চিনেতও। ভুলেছে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার বিশাল নেয়ামতটি। ফলে ১৯৭১য়ে যারা ভারতীয় লুটেরা বাহিনীকে বাংলাদেশে ডেকে আনলো, ১৯৭৪য়ে সীমান্ত বাণিজ্যের নামে যারা ভারতের হাতে সীমাহীন শোষণ এবং শোষণে শোষণে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপহার দিল, ভারতের হাতে তুলে নিল পদ্মার পানি, লুণ্ঠন হতে দিল পাকিস্তান আমলের হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, ভারতের দখলে দিল তালপট্টি ও বেরুবাড়ী -তারাও বন্ধু মনে হয়। বাংলাদেশের মুসলমানদের মূল সর্বনাশটি দেশের চোর-ডাকাতদের হাতে হয়নি,হয়েছে সেক্যুলারিস্টদের হাতে। তারা যে শুধু দেশকে শত্রুর কোলে তুলে দিয়ে স্বাধীনতা ও দেশবাসীর ইজ্জত-আবরুকে বিপন্ন করেছে তা নয়, বিপন্ন করছে বাঙালী মুসলমানের পরকালকেও।  দুর্বৃত্তরা অর্থ লুটে, এরা বিপন্ন করছে কোটি কোটি মানুষের জান্নাতপ্রাপ্তি।

 

যে স্মৃতি হারিয়ে গেছে বিস্মৃতিতে

বাঙালী মুসলমানের জীবনে স্মৃতিবিলুপ্তির রোগটি মারাত্মক ভাবে প্রকাশ পায় ১৯৭১ সালে। আর এখন সে রোগটি মহামারি রূপ ধারণ করেছে। সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীগণ হল এ “আত্মবিস্মৃতি” রোগের মূল ভাইরাস। এইডস রোগের ভাইরাস শরীরের ইম্যুনিটি বিলুপ্ত করে,এরাও তেমনি বিলুপ্ত করে চেতনা জগতের ইম্যুনিটি। ইম্যুনিটি হল রোগের বিরুদ্ধে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধের সামর্থ। এ প্রতিরোধ সামর্থ বিলুপ্ত হলে তখন অনায়াসে নানা রোগ-জীবাণূ দেহে রোগ ছড়ানোর সুযোগ পায়। সেক্যুলারিস্ট ভাইরাসগুলোর মূল কাজ,বাঙালী মুসলমানদের স্মৃতি থেকে ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের অপরাধগুলো বিলুপ্ত করা। ফলে বাংলাদেশীরা হারাচ্ছে শত্রুর সামিরক ও সাংস্কৃতিক হামলার বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি। ভূলিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় লুণ্ঠনের ইতিহাসও। বিলুপ্ত করছে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাসও। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি ছিল বাংলার মুসলমানদের জন্য আল্লাহর বিশাল নিয়ামত। মহান আল্লাহর অপার রহমত ছাড়া ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রবল বিরোধীতার মুখে ভারতের অনগ্রসর মুসলমানেদের একার পক্ষে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টি অসম্ভব ছিল। ১৬ কোটি বাংলাদেশী কি ভারত থেকে সামান্য তিন বিঘা ভূমিও নিতে পেরেছে? মহান আল্লাহতায়ালা যেমন পরাক্রমশালী ফিরাউনের কবল থেকে বনি ইসরাইলের অসহায় লোকদের উদ্ধার করেছিলেন, তেমনি ১৯৪৭ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে উদ্ধার করেছিলেন কোটি কোটি মুসলমানদের। পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের আজকের অবস্থা হতো অচ্ছুৎ হরিজনদের থেকেও করুণ। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নিয়োজিত সাম্প্রতিক তদন্ত কমিশন তো ভারতীয় মুসলমানদের সে চিত্রটিই তুলে ধরেছে। ঢাকার ন্যায় একটি শহরে যতজন মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রফেসর, সেনা অফিসারের বসবাস ভারতের ২০ কোটি মুসলিম তার অর্ধেকও সৃষ্টি করতে পারিনি। কারণ বেড়ে উঠার সে সুযোগই তাদের দেয়া হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে বাঙালী মুসলিমদের অবস্থা হতো ভারতীয় মুসলিমদের ন্যায়। অথচ স্মৃতিবিলুপ্তির ফলে সে ঐতিহাসিক সত্যটি আজ বাঙালী মুসলমানের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছে।

স্মৃতি-বিলুপ্তিতে হারিয়ে যায় সত্য,তখন চেতনার সে শূন্য স্থানটিতে আসন গাড়ে নিরেট মিথ্যা। মিথ্যার প্রচারকদের কাছে স্মৃতিবিলুপ্তি ঘটানোটি এজন্যই এতটা জরুরী। ভারত-ভক্ত সেক্যুলারিস্টদের হাতে বাঙালী মুসলমানদের স্মৃতি-বিলুপ্তি যে কতটা ব্যাপক ভাবে হয়েছে তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। বলা হয়,পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল মূলত বাঙালী মুসলমানদের কারণে। সমগ্র ভারতের মাঝে বাংলার মুসলমানগণই ছিল সবচেয়ে শোষিত ও বঞ্চিত। তাদের ঘাড়ে ছিল দুটি জোয়ালঃ একটি ব্রিটিশের,অপরটি উচ্চজাতের হিন্দুদের। ফলে বাংলার মুসলমানগণ পাকিস্তানের প্রয়োজনটি যতটা সহজে বুঝেছিল ভারতের অন্য প্রদেশের মানুষদের সেটি বুঝাতে বহু শ্রম ও বহু সময় লেগেছিল। একমাত্র বাংলাতেই ছিল কায়েদে আযমের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের সরকার। মুসলিম লীগের জন্মও হয়েছিল ঢাকায়। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাবের উপস্থাপকও ছিলেন একজন বাঙালী, এবং তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হক। ফলে যে বাঙালীরা মুসলিম লীগের জন্ম দিল,পাকিস্তানের প্রস্তাব উত্থাপণ করলো,যারা দেশটি সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল, এবং যে বাঙালীরা পাকিস্তানের তিন বার প্রধানমন্ত্রী হল সে বাংলা পাকিস্তানের কলোনী হয় কি করে? আরেকটি মিথ্যার ব্যাপক প্রচার ঘটে ১৯৭০ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে। আওয়ামী লীগ তখন পোষ্টার ছেপে প্রচার করে, সোনার বাংলা শ্মশান হয়েছে পাকিস্তান আমলের শোষণে। অথচ পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে হারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তা বাংলার বহুহাজার বছরের ইতিহাসে কোন কালেই হয়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ অবধি ২৩ বছরে পাকিস্তানে প্রবৃ্দ্ধির যে হার ছিল ভারত সেটি কোন সময়ই অতিক্রম করতে পারিনি। অতিক্রম করেছে আশির দশকের মাঝামাঝিতে এসে। তখন দক্ষিণ কোরিয়ান কর্মকর্তাগণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছবক নিতে পাকিস্তানে আসতো। স্মৃতি-বিলুপ্তির আরেক উদাহরণ, তারা শুধু পাকিস্তান সৃষ্টিকেই অনাসৃষ্টি বলে না,১৯৪৭-এ বাংলা বিভাগের জন্যও মুসলিম লীগকে দায়ী করে। অথচ অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকারে তখন মুসলিম লীগ। এবং দেশ-বিভাগ কি কোন দেশের শাসক দল করে? তারা চেষ্টা করেছিল বাংলাকে অবিভক্ত রাখায়। মুসলিম লীগের দাবী ছিল,বাংলা বিভক্তির পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত হতে হবে প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে। সেটি হলে বাংলা বিভক্ত করা অসম্ভব ছিল। কারণ বাংলার সংসদে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার পক্ষ থেকে মুসলিম লীগের সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হয়। তারা দাবী করে,সে সিদ্ধান্ত সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে নয়,হিন্দুদের পৃথক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং সে সাথে তাদেরকে ভেটো দেয়ার অধিকার দিতে হবে। তারা ভাইস-রয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটনকে তাদের সে দাবী মেনে নিতে বাধ্য করে। তখন হিন্দু সদস্যরা পৃথক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা বিভক্তির,এবং তাদের সে দাবীর ভিত্তিতেই ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করে। বাংলার মানচিত্রে বিভক্তির সে কাঁচিটি চালায় ব্রিটিশ র‌্যাডক্লিফ, মুসলিম লীগ নয়। কিন্তু সে স্মৃতি ক’জনের? স্মৃতি-বিলুপ্তি ঘটানোর সে ধারাবাহিকতায় বাঙালী মুসলমানের ইতিহাসে ১৯৪৭এর ১৪ই আগষ্টও যে একটি স্বাধীনতা দিবস ছিল,১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ অবধি যে একটি যুগ ছিল সেটিও আজ  ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হল,এত স্মৃতি বিলুপ্তি নিয়ে কি “কে শত্রু এবং কে মিত্র” সে বিচার সঠিক ভাবে হয়? বাংলাদেশীরা শত্রু মিত্র চিনতে যে পদে পদে ভূল করছে তা তো এ কারণেই। আর এর ফলে ঘনীভূত হচ্ছে বিপর্যয়। বিপর্যস্ত হচ্ছে স্বাধীনতার সুরক্ষা।

স্বাধীনতার সুরক্ষা ও কল্যাণে শুধু নিজ দেশের রাজনীতি, সমাজ, ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু জানলে চলে না। নিছক ভাষাজ্ঞান, কৃষিজ্ঞান, কারিগরি জ্ঞান, চিকিৎসাজ্ঞান বাড়ালেও চলে না। সঠিক ভাবে জানতে হয় প্রতিবেশীর মতি-গতি, মন-মানসিকতা,রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে। এজন্য দেশবাসীর স্মৃতি-বিলুপ্তি নয়, সে স্মৃতিকে প্রবল ভাবে বাড়াতে হয়। বিশেষ করে ইতিহাসের স্মৃতি। পাশের মহল্লায় বা জঙ্গলে কাদের বসবাস সে খবর না নিয়ে গৃহ নির্মান করাটি বুদ্ধিহীনতা। চোর-ডাকাত বা বাঘ-ভালুকের বসতিতে বসবাস নিরাপদ নয়। সে পরিবেশে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। ভারত ভূটান নয়,বার্মাও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় অন্য গোলার্ধের দেশও নয়। বরং ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী, এবং ঘিরে আছে পশ্চিম-উত্তর-পূর্ব এ তিন দিক দিয়ে। এ জন্য জরুরী হল, ভারতীয় জনগণ ও সে দেশের শাসক চক্রের স্বপ্ন, দর্শন, আশা-আকাঙ্খা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির খবর নেয়া। তখন প্রয়োজন হয় মুসলমান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য অহিন্দুদের সাথে তাদের অতীতের হিংস্র আচরণের বিষয়টি গভীর ভাবে জানা। কারণ জাতির চেতনা কথা বলে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাই বিপুল অর্থব্যয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ও সেনা বাহিনীই গড়ে না, গড়ে তুলে বিশাল বিশাল সমাজ গবেষণা ইন্সটিটিউটও। সেগুলির কাজ, অন্যদের জীবন-দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, সমরনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির উপর লাগাতর মনিটরিং করা।  রাডার বিমান হামলার পূর্বাভাস দেয়, কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্বাভাস দেয় শত্রুর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক হামলার। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটাতে পাশ্চাত্যের সোভিয়েত বিরোধী জোটকে একটি তীরও ছুঁড়তে হয়নি।

 

বার বার আসছে পরাধীনতা

জাতি কখনো হাসপাতাল,কলকারখানা বা ক্ষেতেখামারে মারা যায় না। মারা যায় চেতনার ময়দানে। জাতির বেঁচে থাকার চুড়ান্ত যুদ্ধটি হয় মূলত চেতনার এ রণাঙ্গনে। উদ্ভিদ বা পশুকুল থেকে মানুষের বাঁচাটি এজন্যই ভিন্নতর। জাতির বাঁচাটি নিরাপদ করতে হলে তাই অতীতের স্মৃতিকে তীব্রতর করতে হয়। আত্মবিস্মৃত ব্যক্তি শত্রু-মিত্র চেনে না। ব্যক্তি অন্যকে ভালবাসে বা ঘৃণা করে অতীত স্মৃতি নিয়েই। পিতা-মাতা নিজ সন্তুান থেকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পায় শিশু বয়স থেকে পিতামাতার আদরের সে স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠার কারণে। কার ঔরসে বা কার গর্বে জন্ম নিল শিশুর সেটি জানা থাকার কথা নয়,যা দেখে বা যা জানে তা হল পিতামাতার অকৃত্রিম ভালবাসা। তেমনি একটি দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি,সাহিত্য ও ইতিহাসে ফুটে উঠে অতীতের স্মৃতি। জাতির সে সামগ্রিক স্মৃতিতে বেঁচে থাকে যেমন মিত্রদের স্মৃতি, তেমনি ভয়ানক শত্রুদের স্মৃতিও। কিন্তু সেটি অসম্ভব হয় স্মৃতি বিলুপ্তিতে। অথচ সে স্মৃতি বিলুপ্তিই আজ বাংলাদেশে প্রকট,সেটি ডেকে এনেছে ভারতপন্থিরা। লক্ষ্য, ভারতের অপরাধগুলোকে বাংলাদেশীদের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত করা।

স্মৃতি-বিলুপ্তির ফলে একই ভূল বার বার হয়।তেমনি একই বিপর্যয়ে বার বার পড়ে আত্মবিস্মৃত জাতি। তখন পরাধীনতা আসে বার বার। তখন বার বার বিজয়ী হয় দুর্বৃত্ত মীরজাফররা। বাংলাদেশের বিপদ তাই কাটছে না। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় হিন্দুদের থেকে আজাদী মিলেছিল। কিন্তু গোলামী সে শিকল আবার গলায় উঠেছে। এমন লাগাতর বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে স্মৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হয়। সেজন্য লাগাতর বাড়াতে হয় ইতিহাস জ্ঞান। ব্যক্তির চেতনা সদাসর্বদা জাগ্রত রাখার এটিই অপরিহার্য মাধ্যম। জ্ঞানবিজ্ঞানের অসংখ্য শাখা-প্রশাখার মাঝে ইতিহাস বিজ্ঞান তাই অপরিহার্য। পবিত্র কোরআনের বিশাল অংশ জুড়ে তাই ইতিহাস বিজ্ঞান। করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কালামে বার বার নবী-রাসূলদের স্মৃতিকে যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি তুলে ধরেছেন নমরুদ,ফিরাউনের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের স্মৃতিও। ইতিহাস জ্ঞান মানুষের মনে র‌্যাডারের কাজ করে। সে র‌্যাডার রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহে পথ দেখায়। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত দেশগুলোর ব্যর্থতা শুরু থেকেই বিশাল। বাংলাদেশ প্রথম অধিকৃত হয় ১৭৫৭ সালে। সেটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতে। অথচ পশ্চিম ইউরোপীয়রা হঠাৎ করে হানাদার ঔপনিবেশিক হয়ে উঠেনি। বরং সেটি হয়েছিল এক দীর্ঘ প্রস্তুতির ধারাবাহিকতায়। কিন্তু বাংলার ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের মানুষ পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের লুণ্ঠনপ্রবন আগ্রাসী মনের পরিচয় ও তাদের প্রস্তুতির খবরটি যথাসময়ে ও যথার্থ ভাবে পায়নি। ফলে সে হামলার বিরুদ্ধে তারা প্রস্তুতিও নিতে পারিনি। ইঁদুর গর্ত করে স্রেফ ঘুমানোর জন্য নয়,লক্ষ্য লুণ্ঠন। তেমনি লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদীদেরও। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা বানিজ্যের নামে বাংলায় বহু কুঠি নির্মান করেছিল। তাদের লক্ষ্য নিছক চুরিমালা, চিরুনি বা পুথির মালা বিক্রি ছিল না। স্রেফ মসলিন ক্রয়ও ছিল না। সেসব ছিল ছদ্দবেশ। মূল লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্য স্থাপন। কিন্তু এদেশের শাসক মহল ও সাধারণ মানুষের চেতনার রাডারে সেটি ধরাই পড়েনি। ফলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সহজেই অধিকৃত হয়। ধীরে ধীরে অধিকৃত হয় সমগ্র ভারত। বুঝতে হবে, ভারতও নিছক মালামাল পারাপারের জন্য জল ও স্থল পথে করিডোর নিচ্ছে না। কিন্তু আওয়ামী কাপালিকদের কি সেটি বোঝার সামর্থ আছে? ইঁদুর যেমন ঘরের মেঝেতে গর্ত খুড়ে,এরাও তেমনি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোর নিচেছ। তবে পার্থক্য হলো, তারা সেটি ইঁদুরের ন্যায় লুকিয়ে লুকিয়ে নিচ্ছে না।

বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার অধিকৃত হয় ১৯৭১ সালে, এবং সেটি ভারতীয় বাহিনীর হাতে। ১৭৫৭ সালের পরাজয়ে বেনিয়া ব্রিটিশরা যতটা লুটেছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশী লুটেছিল ভারতীয় বেনিয়ারা। ভারতের সে লুটটি সম্ভব হয়েছিল তাদের পক্ষে বিপুল সংখ্যক সহায়তাদানকারির কারণে। ১৭৫৭-এ বিজয়ী ব্রিটিশদের প্রবল লুণ্ঠন-লিপ্সা থাকলেও দেশজুড়ে লুণ্ঠন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ছিল না। তাদের পক্ষে সহায়তাদানকারি বাঙালীর সংখ্যাও ততটা বিশাল ছিল না। একাত্তরে ভারত-ভক্ত আওয়ামী লীগ যতটা সংগঠিত ছিল, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ-ভক্ত মীরজাফর ও তার দলবল ততটা সংগঠিত ছিল না। ফল দাঁড়িয়েছিল, ১৭৫৭ এর পরাজয়ের পর ছিয়াত্তরের মনন্তর আসতে কিছু দেরী হয়েছিল। কিন্তু একাত্তরে ভারতীয় অধিকৃতির পর লুট এতটাই নির্মম ছিল যে তাতে অতি শীঘ্রই ভয়ানক দুর্ভিক্ষ নেমে আসে, এবং সেটি ১৯৭৪ সালে। বহু লক্ষ মানুষ তখন না খেয়ে মারা গিয়েছিল। তবে ভারত বাংলাদেশে দখল জমানোর  সে প্রস্তুতিটি স্রেফ ১৯৭১-এ নেয়নি। নিয়েছিল ১৯৪৭ সাল থেকেই। ভারত যে ভাবে করিডোর নিচ্ছে, দেশের বাজার দখল করছে, মিডিয়ার উপর অধিকার জমিয়েছে এবং রাজনীতিতে বিশাল মিত্রবাহিনী গড়ে তুলেছে -সেটিও তো এক গ্রাণ্ড স্ট্রাটেজীকে সামনে রেখেই।

 

মহা বিপর্যয়ের পথে দেশ

তাই আওয়ামী শাসনের বড় বিপদ দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি নয়।রাস্তাঘাট,পানি-বিদ্যুত-গ্যাস সরবরাহে দুর্গতি,স্বৈরাচারী নির্যাতন বা আইনশৃঙ্খলার অবনতিও নয়। বরং সেটি সীমাহীন মিথ্যাচার। স্মৃতি থেকে সত্য-বিলুপ্তির কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হল এ মিথ্যাচার। সে মিথ্যা যত বিশাল,ততই তার সত্যবিনাশী নাশকতা। স্মৃতি বিনাশের ফলে বিলুপ্ত হয় সত্য-মিথ্যা,ন্যায়-অন্যায় ও শত্রু-মিত্র বাছবিচারের সামর্থ। তখন জনগণের জীবনে আসে ভয়ানক চেতনা বিভ্রাট। য়ূয়ূএজন্যই ইসলামে মিথ্যাচারকে বলা হয় সকল পাপের মা। ইসলামে এটি কবিরা গুনাহ। স্মৃতি থেকে লা-শরিক আল্লাহর স্মরণকে ভূলাতে পৌ্ত্তলিকরা তাই মিথ্যা দেবদেবীর কিসসা শুনায়। খৃষ্টানরা তেমনি খাড়া করে ঈসা (আঃ)এর আল্লাহর পুত্র হওয়ার কাহিনী। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও তেমনি তাদের বাকশালী স্বৈরাচারি নেতার পর্বত সমান ব্যর্থতার স্মৃতি মুছে দিতে তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার কিসসা শুনায়। একাত্তরে তেমনি তারা তিরিশ লাখ নিহতের কিসসা খাড়া করেছিল। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করেছে হাসিনা সরকারের দূর্নীতির কারণে। অথচ আওয়ামী লীগ প্রচার করছে বিশ্ব ব্যাংক প্রস্তাবিত ঋণ বাতিল করেছে পূর্ববর্তী সরকারের দূনীর্তির ফলে। শেখ হাসিনার এ মিথ্যাচারও যে বিপুল সংখ্যক খরিদদার পাবে -তা নিয়েও কি সন্দেহ আছে? যে সব বাঙালী নিহত তিরিশ লাখের কথা বিশ্বাস করে,বিশ্বাস করে শেখ মুজিবের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে,তারা শেখ হাসিনার এ নতুন মিথ্যাকে শুধু মেনেই নিবে না,প্রচারও করবে। যে ব্যক্তি পুতুল পুঁজা করে সে ব্যক্তি শাপ-শকুনকেও পুঁজা করে। একই কারণে ভারতের প্রতি আজকের অধীনতাকে তারা শুধু স্বাধীনতাই বলবে না,তা নিয়ে উৎসবও করবে। এবং বিরাট সফলতা বলবে আজকের আওয়ামী লীগ সরকারের সকল ব্যর্থতাগুলোকেও। যুগে যুগে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্টদের শিবিরে কোন কালেও কি উৎসবের কমতি ছিল? মাসে মাসে পুঁজা-পার্বন লেগে থাকে তো সে পথভ্রষ্টতা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।বাংলাদেশের জাতিয়তাবাদী,সমাজবাদী,নাস্তিক সেক্যুলারিস্টগণও তেমনি তাদের মিথ্যাচার এবং সে মিথ্যাচারভিত্তিক রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার বছরের নানা দিনে নানা দিবস পালিত হবে,উৎসবও হবে। দিন দিন সে উৎসবগুলির সংখ্যা বেড়েই চলবে।| আল্লাহর স্মরণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেমন নামায-রোযা,তেমনি তাদের দুর্বৃত্তি ও পথভ্রষ্টতা বাঁচিযে রাখার জন্য হলো এ জাঁকজমকপুর্ণ উৎসব ও দিবস পালন।অতীতের ব্যর্থতা ও ভ্রষ্টতা নিয়ে আজ যেমন উৎসব হচ্ছে,তেমনি আজকের ব্যর্থতা,ভ্রষ্টতা ও দুর্বৃত্তি নিয়েও আগামীতেও বিপুল উৎসব হবে। সে উৎসবগুলো আরো বলবান করবে আজকের মিথ্যা ও পথভ্রষ্টতাকে। একটি দেশের জনগণের জন্য এর চেয়ে বড় বিপদ আর কি হতে পারে? ২৭/১০/১১ (পরিবর্ধিত:০৩/১১/১২ ও ১৪/০৪/২০১৯)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *