বাঙালী মুসলিম জীবনে সেক্যুলারিজমের নাশকতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 5, 2020
- Bangla Articles, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
যুদ্ধটি ধর্মের বিরুদ্ধে
সেক্যুলারারিজম বলতে আমারা কি বুঝি? সেক্যুলারিজমের নাশকতাটাই বা কোথায়? কি তার ভয়াবহতা? বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশের প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর সাথে জড়িত শুধু বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দূরাবস্থাই নয়, বরং দেশটির কোটি কোটি নারী-পুরুষের ভবিষ্যৎ। জড়িত শুধু পার্থিব সাফল্যই নয়, অনন্ত আখেরাতের কল্যানও। সেক্যুলারিজমের অভিধানিক অর্থ হলো ইহজাগতিকতা। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতের এর মূল প্রয়োগ হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা বোঝাতে। অথচ এটি হলো সেক্যুলারিজমের সম্পূর্ণ ভূল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা -যা পেশ করা হয়েছে নিছক ইসলামবিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক স্বার্থে। সেক্যুলারারিজম আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ নয়, বরং এর মূল যুদ্ধটি ধর্মের বিরুদ্ধে। এর মূল রয়েছে প্রচন্ড ধর্মবিরোধী ধারণা। বিরোধটি এখানে ইসলামের মূল আক্বীদা বা বিশ্বাসের সাথে। সেক্যুলারিজমের ইহজগত-কেন্দ্রীক চেতনা ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল শিকড়ই কেটে দেয়। ভূলিয়ে দেয় জীবনের আসল লক্ষ্যস্থল তথা আখেরাত এবং বিচ্যুৎ করে জান্নাতে পৌঁছার সরল পথ তথা সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে।
সেক্যুলারিষ্টদের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে মৃত্যুর ওপার তথা পরকালীন জীবনের কল্যাণ নিয়ে কোন ভাবনা নেই। গুরুত্ব পায় পার্থিব জীবনের কল্যাণ নিয়ে। সেক্যুলারিষ্টদের মধ্যে কেউ নাস্তিক এবং কেউ আস্তিক। যারা নাস্তিক, তাদের জীবনে আখেরাত বলে কোন স্টেশন নেই। সিরাতুল মোস্তাকিমও নেই। এবং যারা আস্তিক তাদের কাছে আখেরাতের ন্যায় বিষয়গুলি অ-ইহজাগতিক বা পরকালীন বিষয়, তাই সেগুলির ভাবনা পার্থিব জীবনের পরিসরে স্থান দিতে রাজী নয়। যা পার্থিব -একমাত্র সেটিই সেক্যুলারিষ্টদের কাছে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। পরকাল ও পরকালীন জান্নাত-দোজখের ভাবনা তাদের কাছে তাই নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। ফলে তাদের রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি শিক্ষা-দীক্ষা -সর্বক্ষেত্রে প্রকাশ পায় প্রকট ইহজাগিতকতা। এসব ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হলো ইসলামের প্রবেশ। আদিম কুসংস্কার ও পশ্চাতপদতা রূপে গণ্য হয় আখেরাতের ভাবনা। এবং প্রাধান্য পায় নিরেট ভোগবাদ। যেমন খুশি তেমন ভাবে ফুর্তি করাটিই তখন জীবনের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজমের প্রভাব বাড়লে, তাই বাড়ে মদ্যপান, ড্রাগসেবন, অশ্লিলতা, ব্যভিচার, ধর্ষণ, সমকামিতা, চুরি-ডাকাতি, এবং নানারূপ দূর্নীতি ও পাপাচার। সেক্যুলারিজমের জোয়ার আসলো অথচ দুর্বৃত্তির জোয়ার আসলো না -তাই সেটি ভাবা যায় না। বাংলাদেশ সেক্যুলারিস্টদের দখলে যায় ১৯৭১ সালে। তখন থেকেই শুরু হয় জনজীবন থেকে ধর্মের প্রভাব নির্মূলের উদ্যোগ। ফলে শুরু হয় দুর্নীতির জোয়ার -যা দেশটিকে দুর্নীতিতে বিশ্বমাঝে ৫ বার শীর্ষ স্থানে পৌঁছে দেয়।
সেক্যুলারিস্টদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলে স্থান পেতে হলে অতি জরুরী হলো ধর্মে অঙ্গীকারহীন হওয়া। ধর্মে এরূপ অঙ্গীকারহীনতাই রূপ নেয় প্রচন্ড ধর্ম বিরোধীতায়। ফলে বাংলাদেশ, মিশর, তুরস্কসহ যেসব মুসলিম দেশে এসব সেক্যুলারিষ্টগণ ক্ষমতায় গেছে সেখানেই তারা প্রচন্ড ভাবে কাজ করেছে জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর লক্ষ্যে। বাধা দিয়েছে কোর’আন শিক্ষা্য় এবং বন্ধ করে দিয়েছে বা কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে মসজিদ ও মাদ্রসাগুলির উপর। তুরস্কে কামাল পাশার ন্যায় রেডিক্যাল সেক্যুলারিস্টের ক্ষমতায় থাকা কালে হত্যা করা হয় বহু হাজার আলেমকে। বন্ধ করা হয় আরবীতে আযান। নিষিদ্ধ করা হয় মহিলাদের পর্দা। ইসলাম চর্চাকে নিয়ন্ত্রন করতে এমনকি তুর্কি ভাষার আরবী হরফ পাল্টিয়ে ল্যাটিন হরফ চালু করা হয়। সেক্যুলারিজম অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা –এ কথাটি বলা হয় নিছক ধোকা দেওয়ার জন্য। ইসলামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী রেডিক্যাল সেক্যুলারিস্টদের গোপন কিছু নয়। একাত্তরে পাকিস্তানের পরাজয় এবং এদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় সত্তরের দশকে বহু হাজার ইসলামপন্থিকে হত্যা ও বন্দী করা হয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করা হয় কোরআনের আয়াত সম্বলিত মনোগ্রাম ও কোরআনী জ্ঞানদান। নিষিদ্ধ করা হয় ইসলামপন্থিদের রাজনীতি। ইসলামী বিধানকে বিজয়ী করার যে কোন উ্দ্যোগ গণ্য হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে। ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় বলা প্রচার করা হলেও ধর্মচর্চাকে এমন কি ব্যক্তিজীবনেও সুষ্ঠ ও স্বাধীন ভাবে চলতে দেয়া হয়নি। ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো, ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় ইসলাম বিরোধীতাকে তারা রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করে।
হারাম কেন সেক্যুলারিস্ট হওয়া?
অপরদিকে মুসলিম জীবনে সর্ব মুহুর্তে যে চেতনাটি প্রবল ভাবে কাজ করে -সেটি হলো ইহকাল ও পরকাল – এ উভয় কালের কল্যাণচিন্তা। প্রতিক্ষণ সে বাঁচে আল্লাহ-সচেতনতা নিয়ে। ঈমানদারের অটল বিশ্বাস, এ জীবনে অন্ত বা মৃত্যু বলে কিছূ নেই, আছে স্থানান্তর। আরবী ভাষায় এ স্থানান্তরকেই বলা হয় ইন্তেকাল। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাই এ জীবন শেষ হয় না, অনন্ত-অসীম এক পরকালীন জীবনে প্রবেশ করে মাত্র। পরকালীন জীবনের সফলতাই হলো আসল ও স্থায়ী সফলতা। সেখানে যেমন আছে জান্নাতের অন্তহীন সুখ-শান্তি ও তেমনি আছে জাহান্নামের অবর্ণনীয় আযাব। এ দুটি ভিন্ন লক্ষ্য বা গন্তব্যস্থলকে সামনে রেখে ইহকালীন জীবনেও রয়েছে দুটি ভিন্ন পথ। একটি দোযখের, অপরটি জান্নাতের। জান্নাতের সে পথটিই হলো পবিত্র কোরআনে বর্নীত সিরাতুল মোস্তাকিম। ফলে মু’মিনের ধর্মকর্মই শুধু নয়, তার রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সবকিছু চলে এ সিরাতুল মোস্তাকিম বেয়ে। সেক্যুলারিস্টদের জীবনের মূল সমস্যা হলো, তাদের জীবনে সিরাতুল মুস্তাকিম নেই। পবিত্র বর্ণিত সিরাতুল মুস্তাকিমে চলায় তাদের কোন আগ্রহ নাই। তারা চলে নিজেদের গড়া পথ বেয়ে। তাদের যাত্রাপথ নির্ধারীত হয় হারাম-হালাম ও অনন্ত অসীমকালের কল্যাণচিন্তাকে বাদ দিয়েই। তাই তাদের জীবনের গতিপথটিও ভিন্ন। ফলে মুসলিমদের থেকে সেক্যুলারিষ্টদের ভিন্নতা শুধু চিন্তা-চেতনা, দর্শন বা ধর্ম-কর্মেই নয়, বিপুল ভিন্নতা হলো শিক্ষা, সংস্কৃতি, খাদ্য-পানীয়, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ জীবনের প্রতিটি কর্ম ও আচরণে। তাদের জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র, খেলাফত ও উম্মাহর ধারণা, শরিয়ত, শুরা ও জিহাদের ন্যায় ইসলামের মৌল বিষয়ের কোন স্থান নাই। তাই হারাম হলো সেক্যুলারিস্ট হওয়া।
জন্ম পাশ্চাত্যে এবং অজ্ঞতা ইসলাম নিয়ে
সেক্যুলারিজমের জন্ম পাশ্চাত্যে। ধর্মের নামে মধ্যযুগীয় খৃষ্টান চার্চ ও চার্চকেন্দ্রীক ধর্মযাযকগণ যে সীমাহীন শোষন, নির্যাতন ও স্বৈরাচারি আচরন করতো -সেটিই পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচন্ডভাবে বিদ্রোহী করে। জন্ম থেকেই তাই এ মতবাদটি রিয়াকশনারি বা প্রতিক্রিয়াশীল। প্রচন্ড প্রতিক্রিয়ার ফলেই এটির অনুসারিরা গিয়ে পড়েছে আরেক মেরুতে। এবং সেটি ধর্মহীনতার। চার্চের অত্যাচারের কারণে সে সময় স্বাধীন ভাবে বিজ্ঞানচর্চাও অসম্ভব ছিল। ধর্মযাযকগণ বহু বিজ্ঞানীকে হত্যাও করা হয়েছিল। কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের একটি বিরাট অংশ চার্চ নিয়ে নিত। সে অর্থে বিপুল সংখ্যায় বড় বড় চার্চ নির্মিত হতো। কিন্ত মেহনতি কৃষক গরীবই থেকে যেত। শিক্ষা, যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রনও ছিল চার্চের হাতে। তারা ধর্মের নামে ধর্মের মূল শিক্ষাকেই জনগণ থেকে আড়াল করতো। শোষন ও নির্যাতনমূলক এ নীতির কারণে সমাজের অগ্রগতি সে সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয় সাধারণ মানুষ। সে বিদ্রোহে পরাজিত হয় চার্চ এবং বিলুপ্ত হয় তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা। কিন্তু সেক্যুলারিষ্টদের সীমাবদ্ধতা হলো, ধর্ম নিয়ে তাদের যে অভিজ্ঞতা সেটি নিতান্তই পাশ্চাত্যের চার্চ ও তাদের খৃষ্টান ধর্ম নিয়ে। অথচ সে অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা থেকেই তারা উপসংহার টেনেছে সকল ধর্মের বিরু্দ্ধে। এবং সেটিকে প্রয়োগ করেছে ইসলামের বিরুদ্ধেও। ইসলাম যে খৃষ্টান ধর্ম নয়, জীবন ও জগত, শিক্ষা ও বিজ্ঞান নিয়ে ইসলামের যে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ধারণা রয়েছে সেটি তাদের জানার সুযোগই হয়নি। কোন এক বিশেষ বৃক্ষের ফল খেয়ে কি অন্য বৃক্ষ নিয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া যায়? কিন্তু তারা সেটিই করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে এটিই হলো তাদের বড় অপরাধ। বাংলাদেশেসহ সকল মুসলিম দেশে তারা একই রূপ অসত্য ধারনা ছড়াচ্ছে। তাছাড়া পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীদের এ বিদ্রোহ শুধু চার্চের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ বিদ্রোহ পরিাচলিত হয়েছে স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধেও। ফলে সেক্যুলারিষ্টদের সচারাচরই পরিণত হয় নাস্তিকে। হযরত ইব্রাহীম(আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মহম্মদ(সাঃ) পর্যন্ত যে অসংখ্য নবী রাসূল পৃথিবীর বুকে এলেন এবং আল্লাহসচেতন এক ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচর্যা দিলেন -তারা অবস্থান নিল তার বিরুদ্ধেও। প্রযু্ক্তি ও শিল্পে পাশ্চাত্যের বিপুল উন্নয়নের পর তারা নিশ্চিত ভাবে ভাবতে শুরু করে, এ বিপ্লবের কারণ তাদের অনুসৃত সেক্যুলারিজম। অথচ এমন ধারণা যে সম্পূর্ণ অসত্য -সে প্রমাণ প্রচুর।
শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মানবিকতায় মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজয় এনেছিল ইসলাম। তখন অবিশ্বাস্য ভাবে সমৃদ্ধি পেয়েছিল মানবতা। এবং নির্মিত হয়েছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা নামায-রোযার পূর্বে জ্ঞানার্জনকে ফরয করেছে। শিক্ষাই যে মানব-উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি –সে শিক্ষাটি তো ইসলামের। এমন একটি ধারণা প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কারণেই মুসলিম ধর্মীয় নেতারা সেদিন মাদ্রাসায় বসে শুধু কোরআন-হাদিস চর্চা করেননি। বরং অমুসলিমদের লেখা বই পড়েছেন এবং সেগুলি আরবীতে তরজমাও করেছেন। যারা ভেড়া চড়াতেন তারা পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিতে। মানবতা ও সমতা এতই গুরুত্ব পেয়েছিল যে খলিফারা ভৃত্যকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে পায়ে হেঁটে চলেছেন। রাতে না ঘুমিয়ে আটার বস্তা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে গরীবের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে একটি দিনের জন্যও কি এমন নজির সৃষ্টি হয়েছে? অতি অল্প সময়ে তারা বিপ্লব এনেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে। ইউরোপের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান পৌঁছেছে তো তাদের হাত দিয়েই। অপর দিকে মানুষের সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক ক্ষতিটি করেছে পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিষ্টগণ। খৃষ্টানচার্চ ও চার্চকেন্দ্রীক ধর্মযাযকগণ যেমন নির্যাতনমূলক শাসন ব্যবস্থা ও ক্রুসেডের ন্যায় রক্তাত্ব যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল, সেক্যুলারিষ্টগণও তেমনি জন্ম দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদের ন্যায় মানবতাবিরোধী জঘণ্য মতবাদের। এগুলি নিতান্তই তাদের নিজস্ব আবিস্কার। তাদের হাতেই জন্ম নেয় বিশ্বের কোণে কোণে দূর্বল আদিবাসী নির্মূলের এক অভিনব প্রক্রিয়া। আমেরিকার রেডইন্ডিয়ান, নিউজিল্যান্ডের মাউরী ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ন্যায় বহু জনগোষ্ঠীকে তারা প্রায় নির্মূল করে ছেড়েছে। গবাদী পশুর ন্যায় গাটে তুলেছে বহু লক্ষ আফ্রিকানদের। ধর্মপ্রাণ মানুষ যেখানে চালিত হয় পরকালীন লাভ-লোকসানের চেতনায়, সেখানে সেক্যুলারিষ্টগণ তাড়িত হয় ভোগের তাড়নায়। ভোগের লক্ষে তারা চায় অধিক সম্পদ। ফলে লুন্ঠনে নামে বিশ্ব জুড়ে। লুন্ঠনের এমন উগ্র মানসিকতায় তুচ্ছ মনে হয় অন্য দেশ ও অন্য জাতির মানুষের জীবন। এমন একটি চেতনার কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভাব হয়েছিল দুই-দুইটি বিশ্ব যুদ্ধ বাধিয়ে প্রায় আট কোটি মানুষের হত্যা। সম্ভব হয়েছিল অগণিত মানুষের মাথার উপর দুই-দুইটি আনবিক বোমা নিক্ষেপ। এরাই হিংস্র পশুর ন্যায় দল বেঁধে নেমেছে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়া। ধর্মশূণ্য হলে মানুষ যে কতটা মানবতাশূন্য পশুতে পরিণত হয় এগুলি হলো তারই নমুনা। আর এরূপ ধর্মশূণ্যতার জন্ম সেক্যুলারিজমের গর্ভে।
টানছে জাহান্নামের দিকে
সেক্যুলারিজমের আরেক বিপদ, এ মতবাদটি ব্যক্তির জীবনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ধারণাই পাল্টে দেয়। অথচ মুসলিম জীবনে মূল বিষয়টি নিছক আল্লাহর উপর বিশ্বাস নয়, বরং প্রতিকর্মে তাঁর বিধানের পূর্ণ আনুগত্য। এ ক্ষেত্রে সামান্যতম আপোষ চলে না। বরং একজন মুসলিম প্রকৃত মুসলিম রূপে পরিচয় পায় এরূপ নিরংকুশ আনুগত্যের কারণে। আনুগত্যের এ লাগাম ঢিলা হলে সে ব্যক্তি আর মুসলিমই থাকে না। তার জীবনে তখন স্থান পায় শয়তানের আনুগত্য। জীবনের প্রতিকর্মে তখন সে নির্দেশনাও পায় শয়তান থেকে। এমন ব্যক্তির জীবনে শয়তান পরিণত হয় সার্বক্ষণিক বন্ধুতে। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে এমন মানুষের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,‘‘ওয়াল্লাযীনা কাফারু আউলিয়া হুমুত্তাগুত, ইয়ুখরিজুনাহুম মিনান্নুরে ইলাজ্জুলুমাত।’’ অর্থঃ যারা কুফুরি করে তথা আল্লাহর অবাধ্যতা করে তাদের অভিভাবক হলো শয়তান যে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। শয়তানের আনুগত্যের কারণেই তাদের ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, চরিত্র, রাজনীতি, আইন-আদালত, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ সবকিছুই পাল্টে যায়। মানুষ তখন নিজেই আবির্ভূত হয় আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এক সাক্ষাত শয়তান রূপে। তখন রাষ্ট্রের বুক থেকে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বকে হঠিয়ে এমন শয়তান চরিত্রের মানুষগুলো নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে। দেশের আইন-আদালত থেকে তারা হটিয়ে দেয় আল্লাহপাকের আইন।
মুর্তি পুজাই কাফেরদের একমাত্র ধর্ম নয়। বরং মহান আল্লাহতায়ালার যে কোন হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতাই ব্যক্তিকে কাফেরে পরিণত করে। বাংলাদেশের মূলতঃ সে অবাধ্যতাই হচ্ছে সর্বস্তরে। এবং সেটি হয়েছে সেক্যুলার গনতন্ত্রের নামে। যে কোন মুসলিম দেশে সেক্যুলারিজমের বিপদ এখানেই। বাংলাদেশের বিপদ হলো, এ হারাম মতবাদটিই এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবল ভাবে বিজয়ী। এবং সে বিজয়ের উৎসব পালিত হচ্ছে নানা ভাবে। উৎসবযোগ্য হিসাবে গন্য হয়েছে দেশ থেকে আল্লাহ আইন ও তাঁর সার্বভৌমত্ব হটানোর মত কুফুরি কর্মটিও। এটিকে বলা হচ্ছে জনগণের বিজয়। বলা হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব্। নবীজীর(সাঃ) পর খোলাফায়ে রাশেদার চেয়ে অধিক যোগ্য ও ন্যায়পরায়ন শাসক আর কারা ছিলেন? অথচ তারাও সার্বভৌম শাসক রূপে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেননি। তারা পরিচয় দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধি তথা খলিফা রূপে। এ জমিন ও আসমানে সার্বভৌম শক্তির অধিকারি তো একমাত্র আল্লাহতায়ালা। বান্দাহর কাজ হলো তার প্রতিনিধি বা খলিফা রূপে একমাত্র তারই হুকুমের প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামে তাই খেলাফত আছে, জনগণের সার্বভৌমত্ব নাই। এটি ইসলামের অতি মৌলিক বিষয়। অথচ সেটিই বিলীন হয়ে গেছে সেক্যুলারিজমের প্রকোপে। ফলে আল্লাহর অবাধ্যতার ন্যায় কবিরা গুনাহ হচ্ছে সর্বত্র। বিচারের নামে দেশের প্রতি আদালতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহান রাব্বুল আ’লামীনের আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহের আয়োজন হচ্ছে এমন জনগণের রাজস্বে যারা নিজেদেরকে আল্লাহ অনুগত দাস বা মুসলিম মনে করে। এদের মধ্য থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নামায-রোযাও পালন করে। অথচ বিস্ময়! তাদের প্রতিষ্ঠিত আদালতে ব্যভিচারও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। শাস্তিযোগ্য নয় সূদখাওয়া, মদখাওয়া এমনকি পতিতাপল্লি প্রতিষ্ঠাও। আল্লাহর বিরুদ্ধে এমন সর্বাত্মক বিদ্রোহকে শাসনতান্ত্রিক বৈধতা দিয়েছে সংসদে নির্মিত আইন। আর সেসব সাংসদদের নির্বাচিত করেছে জনগন। ফলে আল্লাহর বিরুদ্ধে এ সর্বাত্মক বিদ্রোহে জড়িত শুধু সরকার নয়, জড়িত জনগনও। এ বিদ্রোহে জনগণ অর্থব্যয়, শ্রমব্যয়, এমনকি রক্তব্যয়ও করছে।
ফলে যে শয়তানের আনুগত্য চর্চা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল উপনিবেশিক বৃটিশের হাতে, বাংলাদেশে এখন সেটিই সরকারি নীতি। ফলে মহান আল্লাহ ও তাঁর বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চর্চা হচ্ছে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ গণজীবনের সর্বত্র। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। বরং সেগুলি হচ্ছে অতি প্রচন্ড ভাবে। অথচ মুসলিম জীবনের মিশনই হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের উৎখাত। পবিত্র কোরআনে এটিকে বলা হয়েছে,‘‘আমিরু বিল মারুফ ওয়া নিহি আনিল মুনকার।’’ মুসলমানের রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার তথা প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত হবে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে, এটিই হলো উপরুক্ত আয়াতের ঘোষণা। নবী পাক (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম আজীবন সেটিই করেছেন। অথচ বাংলাদেশের মানুষ রেকর্ড গড়েছে আল্লাহর এ হুকুমের বিরুদ্ধাচারনে। অন্যায়ের উৎখাতে নয়, বরং বিশ্বেরেকর্ড গড়েছে অন্যায়ের প্রাতিষ্ঠায়। এবং সে পথ ধরেই বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত দেশে। আল্লাহর আনুগত্য প্রাধান্য পেলে কি এমনটি হতো? এভাবে বাংলাদেশের মানুষ শুধু নিজেদেরই কলংকিত করেনি, কলংকিত করেছে ইসলামেরও। নিজেদের কদর্য দিয়ে তারা ইসলামকেও আড়াল করেছে। দুনিয়ার রেকর্ড যাদের এত খারাপ সেটি আখেরাতেও কি কোন কল্যাণ দিবে? এবং এত দ্রুত নীচে নামার কারণ, রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটটি অধিকৃত সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্তগণদের হাতে।
বিপন্ন করছে স্বাধীনতা
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কোন দেশের মানচিত্র ভাষা, বর্ণ বা জলবায়ু দ্বারা নির্ধারিত হয় না, সেটির নির্ধারণে যেটি প্রবল প্রভাব রাখে তা হলো জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন-দর্শন বা ধর্ম। এটি পাল্টে গেলে দেশের মানচিত্র বা ভূগোলও পাল্টে যায়। আরবের ইসলাম-উত্তর ভূগোল ও ইসলাম-পরবর্তী ভূগোল তাই এক নয়। একই কারণে বাংলাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন এসেছে ১৯৪৭ এবং ১৯৭১য়ে। ১৯৪৭য়ে বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এর মূলে ছিল প্যান-ইসলামি চেতনা। ফলে পাকিস্তান ভূক্তিতে এ দেশে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। বরং মানুষ স্বতঃফুর্ত ভাবে পাকিস্তানভূক্ত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭০য়ে এসে সে প্যান-ইসলামিক চেতনা ভেসে যায় জাতীয়তাবাদের প্রবল জোয়ারে। ১৯৪৭ যেখানে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী মুসলমানেরা কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলো তারাই একাত্তরে এক রক্তাত্ব যুদ্ধে সে দেশটিকে খন্ডিত করলো।
চেতনা রাজ্যে বিবর্তনের এ ধারা কখনই থেমে থাকে না। বিবর্তনের এ ধারা জাতীয় জীবনের বহু কিছুই পাল্টে দেয়। প্লাবনের পানির ন্যায় আজ যে মতবাদটি বাংলাদেশকে গ্রাস করছে সেটি হলো সেক্যুলারিজম। ফলে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে যেমন মানুষের জীবন দর্শন ও চেতনা, তেমনি পাল্টে যাচ্ছে সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মূল্যবোধ। ফলে দ্রুত পাল্টে যাচছে মানুষের চেতনা ও দর্শনের ভূগোল। এ জন্যই দেশের ভৌগলিক সীমান্ত বাঁচাতে হলে আদর্শ, সংস্কৃতি ও চেতনার ভূগোলকে বাঁচাতে হয়। অথচ সে কাজটিই হচ্ছে না। ফলে বিলুপ্ত হচেছ ভারতের সাথে আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও চেতনাগত ভূগোলের সীমানা। একাজে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে ভারতীয় পুঁজি। বিশেষ করে বাংলাদেশের রেডিও, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা তথা বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের ভিন্ন রাজনৈতিক ভূগোলও কি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে না? তখন বিপন্ন হবে স্বাধীনতাও। ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী অমুসলিম দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দুর্বল মুসলিম দেশের জন্য এটি এক ভয়ংকর দিক। সেক্যুলারিজম এভাবে ভয়ানক বিপদ ডেকে আনছে শুধু ইসলামের বিরুদ্ধেই নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধেও। শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত ও রাজনীতি থেকে ইসলামকে বাদ দিলে সম্মান ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচাও যে অসম্ভব -সেটি কি এভাবে প্রমাণিত হয় না? এবং অবাধ্য মুসলিমদের জন্য আল্লাহর আযাব কি এভাবেই অনিবার্য হয়ে উঠে না? ৫/১১/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018