বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁ ও নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল 

রেনাসাঁ থেকে আত্মঘাত

বাঙালী হিন্দুদের মাঝে যেমন জাগরণ এসেছে, তেমনি প্রচন্ড আত্মঘাত এবং নাশকতাও এসেছে। বাঙালী হিন্দুগণ তাদের এ জাগরণকে বলে বাঙালীর রেনেসাঁ। কিন্তু সে রেনেসাঁ কি সমগ্র বাঙালীর? তাদের আত্মঘাতটি এসেছে রেনেসাঁর ঠিক পরপরই। এবং তাদের হাত দিয়ে নাশকতাটি ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ঘটনার পরম্পরা দেখে মনে হয়, জাগরণটি যেন এসেছিল তাদেরকে আত্মঘাতের দিকে দ্রুত ঠেলে দেবার জন্যই। বাঙালী হিন্দুর সে আত্মঘাতটি ষোল কলায় পূর্ণ হয় ১৯৪৭ সালে বাংলার দেহ খন্ডিত করার মধ্য দিয়ে। বাংলা নিয়ে বাঙালী হিন্দুদের যে বিশাল স্বপ্ন ছিল তা যেন হটাৎ মারা যায়। ফলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ যেমন ইউরোপীয়দের শিক্ষা, শিল্প, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে লাগাতর উন্নয়ন আনে এবং তাদেরকে বিশ্বশক্তিতে পরিনত করে, বাঙালী হিন্দুর জীবনে সেটি ঘটেনি। কিছুটা বেড়ে উঠার পর তাদের বেড়ে উঠাটি হঠাৎ থেমে যায়। বিশ্বমাঝে দূরে থাক, এমনকি ভারতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিনত হতে পারেনি। তবে তাদের আত্মঘাতটি নীরব আত্মহত্যা ছিল না, প্রচন্ড নাশকতা ঘটিয়েছে বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং বিপন্ন করেছে বাঙালী মুসলিমের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ রূপে উপমহাদেশ বা মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতেই শুধু নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও বাঙালী মুসলিম যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো সেটিও তাদের ষড়যন্ত্রে মারা পড়ে ১৯৭১’য়ে।

অথচ উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শিক্ষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে বাঙালী হিন্দুর অর্জনটি কম ছিল না। কিন্তু এখন সেটি নিছক ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাঙালী হিন্দুর প্রচন্ড গর্ব, কিন্তু তার বিশাল সাহিত্যে বাঙালীর জাগরণ বেগবান না হয়ে বরং আত্মঘাত বাড়ায়। বলা হয়, বাঙালীর রেনেসাঁ শুরু হয় রাজা রামমোহন থেকে। আর রবীন্দ্রনাথের মরদেহের সাথে সেটিও শশ্মান ঘাটে গিয়ে পৌঁছে। তাই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম বাঙালীর গর্ব বাড়ালেও আত্মঘাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। মৃত্যু যখন কোন ঘাতকের পক্ষ থেকে আসে তখন সেটি হত্যাকান্ড। আর যখন সেটি নিজ হাতের কামাই, তখন সেটি আত্মঘাত বা আত্মহত্যা। আর বাঙালীর হিন্দুদের জীবনে দ্বিতীয়টিই এসেছিল। এবং সে আত্মঘাতের ঘটনাটি শ্রী নিরোদ চন্দ্র চৌধুরীর চোখেও ধরা পড়েছিল। তবে নীরদ বাবুর ভূল হলো, তিনি সেটিকে হিন্দু বাঙালীর আত্মঘাত না বলে তাঁর লিখিত “আত্মঘাতি বাঙালী” বইতে বাঙালীর আত্মঘাত বলেছেন। সম্ভবত তিনি সেটি ইচ্ছাকৃত ভাবেই বলেছেন। কারণ, শরৎচন্দ্র চ্যাটার্জীর মত তিনিও হয়ত বাঙালী বলতে শুধু বাঙালী হিন্দুদেরই বোঝাতেন। যেমন শরৎচন্দ্র লিখেছেন, “আমাদের স্কুলে বাঙালী ও মুসলমানদের মাঝে খেলা।”

 

চেতনায় মুসলিম বিদ্বেষ

বাংলার ইতিহাসে বড় সত্যটি হল, এ দেশে ইসলামের আগমন ও মুসলিম শাসনকে হিন্দুরা কখনই মেনে নিতে পারিনি। তেল আর পানি যেমন একত্রে মেশে না, তেমনি বাংলার হিন্দু ও মুসলিমগণ ৮ শত বছরের বেশী কাল পাশাপাশি বসবাস করলেও তাদের মাঝে সৌহাদ্য-সম্প্রীতি গড়ে উঠেনি। মুসলিমগণ হিন্দুদের কাছে ম্লেছ, মোছলা, যবন, নেড়ে এবং বহিরাগতই রয়ে গেছে। সেটি যেমন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মত প্রথম সারির হিন্দু সাহিত্যিকের লেখায়, তেমনি সাধারণ হিন্দুদের চেতনায়। ঘৃনাপূর্ণ হিন্দু-মনের বেদনায়ক সে স্মৃতিটি বাংলার মুসলিমদের ঘরে ঘরে। তারই ক্ষুদ্র চিত্র তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক জনাব আসাফউদ্দৌলাহ। ঢাকায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “পড়তাম ফরিপুর জেলা স্কুলে। কোনদিন ক্লাসে দ্বিতীয় ছাড়া প্রথম হতে পারিনি। প্রথম হলাম ১৯৪৮ সালে। হিন্দু শিক্ষকদের কাছে আমরা ছিলাম মোছলা। পাজামা পড়তাম বলে বলতো দোনালা। আমার নাম আসাফউদ্দৌলাহ, অথচ হিন্দুরা সে নামে না ডেকে বলতো ফসফসা। হিন্দু বন্ধুদের বাসায় গিয়েছি এবং একবার ভূলে বই ফেলে আসি। বই আনতে গিয়ে দেখি আমার বন্ধুর মা তীব্র ভাষায় গালী-গালাজ করছে। বলছে সব অপবিত্র হয়ে গেছে। আমি যেখানে বসেছিলাম সে জায়গা ও সে চেয়ার পানি ঢেলে ধুচ্ছে। হাফইয়ার্লী পরীক্ষার খাতায় বাবরকে ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসক লেখেছিলাম। কেন চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত বা অশোক লিখলাম না -সে অপরাধে আমাকে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে বলা হয়েছে। পিয়নকে দিয়ে হাতের তালুতে বেতের ঘা মারা হয়েছে।” (সূত্রঃ বক্তৃতার ইউটিউব ভিডিও)। হিন্দু মনে ঘৃণার মাত্রাটা এতটাই অধিক ছিল যে, মুসলিমদের পৃতৃদত্ত নামটাকেও তারা সঠিক ভাবে বলতো না। কোলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলো প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা ও দৈনিক আজাদ পত্রিকা সম্পাদক জনাব মাওলানা আকরাম খাকে বলতো আক্রমণ খাঁ। আরেক নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বলতো সুরাবর্দী।  

প্রতিবেশীকে বিকৃত নামে ডাকা, গালী দেয়া বা ঘৃণা করা ভদ্রতা নয়, সুরুচীর ও সুশীল মনের পরিচয়ও নয়। বিশেষ করে সে প্রতিবেশীকে, যার সাথে একই গ্রাম-গঞ্জ ও মাঠ-ঘাট, একই আলো-বাতাস, একই নদী-পুকুর, একই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, একই রাস্তাঘাট ও হাট-বাজার ভাগাভাগি করে বসবাস করতে হয়। অথচ হিন্দু মনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার মাত্রাটি এতটাই অধিক ছিল যে, কোন মুসলিম হিন্দুর ঘরে পা রাখলে গঙ্গাজল ও গোবর ছিটিয়ে সে স্থান পবিত্র করতো। সে চিত্রটি চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা “গোরা” উপন্যাসেও। প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা এবং এমন বিদ্বেষের নজির বিশ্বের আর কোন দেশে নাই। যার সাথে একত্রে বসবাস -তার বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা কি সে রাষ্ট্রে বা সমাজে শান্তি আনে? বরং তাতে তীব্রতর ও রক্তাত্ব হয় বিভক্তি ও সংঘাত। আরো বিপদ হল, ঘৃণার সে বীজকে বাঙালী হিন্দুরা শুধু বাংলাতে সীমাবদ্ধ রাখেনি, ছড়িয়ে দিয়েছে সমগ্র ভারত জুড়ে। আর প্রতিবেশীর প্রতি ঘৃণা যখন প্রবলতর হয়, তখন তাদের প্রতি সহানুভুতি, সুবিচার বা কল্যাণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। বরং তাদের ঠকানো বা শোষন করাটাই সামাজিক নীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যে ঘৃণার উপর ভিত্তি করে মুসলিমদের শোষণ ও বঞ্চনার প্রক্রিয়া বাংলাতে শুরু হয়েছিল -সেটিই এখন সমগ্র ভারত জুড়ে।

বাংলার হিন্দু জমিদারগণ মারা গেছেন। কিন্তু তাদের অবিচারটি বেঁচে আছে খোদ ভারত সরকারের নীতিতে। ফলে হিন্দু জমিদারগণ মুসলিম প্রজাদের সাথে যেরূপ অত্যাচার করতো -সেটিই হচ্ছে সমগ্র ভারতীয় প্রশাসনে। ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ। অথচ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কর্তৃক স্থাপিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, সরকারি চাকুরিতে তাদের সংখ্যা শতকরা ৩ ভাগেরও কম, বড় চাকুরিতে দূরে থাক ছোট চাকুরিতে তাদের স্থান নেই। বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার তারা সর্বত্র। শুধু মাত্র ঢাকা, লাহোর বা করাচীর মত একটি শহরে যতজন মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, ব্যবসায়ী, বিচারক, আইনজ্ঞ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাস করে সমগ্র ভারতে ২০ কোটি মুসলমানের মধ্যেও তা নেই। ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিবেকহীন অবিচার ও নাশকতা যে কতটা গভীর সেটি বোঝার জন্য কি এ পরিসংখ্যানটিই যথেষ্ট নয়? আরো ভয়ানক বিবেকহীনহতা হল, এটি যে প্রচন্ড অন্যায় ও অবিচার -সেটিও আজকের ভারতে রাজনীতির কোন প্রসঙ্গ নয়। ফলে প্রতিকারেরও কোন উদ্যোগ নেই। দুর্বৃত্তি, অবিচার ও অনাচার প্রতি সমাজেও ঘটে। কিন্তু সভ্য সমাজের পরিচয় হল, সে দুর্বৃত্তি ও অনাচার অপরাধ রুপে চিত্রিত হয় এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে এবং প্রতিকারেরও ব্যবস্থা হয়। কিন্তু ভারতে হচ্ছে তার উল্টোটি। দিন দিন শুধু অবিচারই বাড়ছে না, অবিচারের সাথে মুসলিমের জানমাল ও ইজ্জতের উপরও হাত পড়ছে। বার বার দাঙ্গা বাঁধিয়ে মুসলিম-হত্যা হচ্ছে, তাদের নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, মসজিদও ধ্বংস করা হচ্ছে। আজ থেকে শত বছর আগে বাবরী মসজিদের ন্যায় ঐতিহাসিক মসজিদকে গুড়িয়ে দেয়া হয়নি। অথচ এখন সেটি হচ্ছে। এবং অতি উৎসবভরে হচ্ছে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এরূপ জঘন্য অপরাধও চিত্রিত হচ্ছে না কোন অপরাধ রূপে। ফলে সে অপরাধের কোন বিচার হচ্ছে না, সেজন্য কারো কোন শাস্তিও হচ্ছে না। ভারতীয় হিন্দুদের মত যে মুসলিমবিদ্বেষে কতটা ভয়ানক ভাবে অসুস্থ্য -সেটি কি এর পরও বুঝতে বাঁকি থাকে?

অথচ মুসলিম শাসকগণ হিন্দুদের শুধু প্রশাসনিক আমলা, জমিদার, হিসাবরক্ষক, তালুকদারই পদেই বসায়নি, তাদেরকে মন্ত্রী এবং সেনাপতির পদেও বসিয়েছে। মোঘল বাদশাহদের ন্যায় নবার সিরাজুদ্দৌলার গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিও ছিলেন হিন্দু। মুসলিম শাসনামলে দেশে হিন্দু-মুসলিমের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে –সে ইতিহাস বিরল। কিন্তু তাতেও হিন্দুদের মনে মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃনার মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং সে বিদ্বেষ এতটাই প্রবল ছিল যে, মুসলিমদের চরম শত্রুদের তারা পরম বন্ধু রূপে গ্রহন করেছে। তাদের মাঝে কাজ করেছে শত্রুর বন্ধুকে বন্ধু রূপে গ্রহন করার নীতি। এরই প্রমাণ, প্রতিবেশী বাঙালী মুসলিমদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করতে পারলে কি হবে, বহু হাজার মাইল দূরের অন্য এক মহাদেশ থেকে আগত ইংরেজদের তারা বিস্বস্ত বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছে। ইংরেজের যে গুণটি তাদেরকে আকৃষ্ট করেছে তা হল তাদের মুসলিম-বিনাশী নীতি। একই ভাষা ও একই ভূখন্ডে বসবাসকারি বাঙালী মুসলিমদের প্রতি এই হলো তাদের বাঙালীত্বের নমুনা। মুসলিমদের মুসলিম হওয়াটাই তাদের কাছে অপরাধ গণ্য হয়েছে। ফলে পল্লির নিরীহ কৃষক প্রজাটিও হিন্দু জমিদারের অত্যাচার ও শোষন থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। মুখের দাড়ী রাখার জন্যও তাকে খাজনা দিতে হয়েছে। মুসলিম-বিরোধীতা বাঙালী হিন্দুর মনে এতটা প্রবল ভাবে বাসা বেঁধেছিল যে যখনই কোন কিছুতে মুসলিমের কল্যাণ দেখেছে তখনই প্রাণপনে সেটির বিরোধীতা করেছে। সেটি ১৯০৫’য়ের বঙ্গভঙ্গ হোক বা ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক বা ১৯৩৫ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিমদের সরকার গঠন হোক বা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হোক বা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটির টিকে থাকার বিষয় হোক। এমন বিষপূর্ণ চেতনার কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতার রাস্তায় মিছিল করেছেন। ১৯৩৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙলী মুসলিমদের অবিভক্ত বাংলায় সরকার সুযোগ আসে। সেটি ভোটার তালিকায় মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে অধিক হওয়ার কারণে। কিন্তু সেটি রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিদের কাছে ভাল লাগেনি। মুসলিমগণ যাতে বাংলায় মন্ত্রীসভা গঠন না করতে পারে সে জন্য ১৯৩৬ সালের জুন মাসে বাংলার তৎকালীন গভর্নরের কাছে বাঙালী হিন্দুগণ পত্র লেখে। তাতে দাবী করা হয়, বাঙালী মুসলিমগণ যেহেতু শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থসম্পদ ও সামাজিক মর্যাদায় বাঙালী হিন্দুদের চেয়ে নীচে, অতএব হিন্দুদের উপর তাদের শাসক হওয়ার কোন অধিকার নাই। এবং সে পত্র স্বাক্ষর করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের চরম মুসলিম কি  এরপরও গোপন থাকে। অথচ তাঁর গানই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত! সে পত্রে সাক্ষর করেছিলেন এমন কি শরৎচন্দ্র চন্দ্র চট্টপাধ্যয়ও। অপর দিকে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির দাবী ছিল, মুসলিমগণ যেহেতু নিন্মবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত -ফলে তাদের অধিকার নেই হিন্দুদের উপর শাসক হওয়ার। -(সৌমিত্র দস্তিদারের ডকুমেন্টারী)।     

 

সভ্যতার সংঘাতে বাঙালী হিন্দু

প্রফেসর হান্টিংটন তাঁর “Clush of Civilisation” বইতে সভ্যতার অনিবার্য সংঘাতের কথা বলেছেন। সে সংঘাত ইসলামী সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার। তাঁর পরামর্শ, সে লড়াইয়ে জিততে হলে পাশ্চত্য শক্তিকে হিন্দুভারত ও রাশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য শক্তির সাথে কোয়ালিশন গড়তে হবে। হান্টিংটনের মতে মুসলিম সভ্যতাই পাশ্চাত্যের খৃষ্টান সভ্যতার মূল প্রতিদ্বন্দী। এ পরামর্শটি তিনি এমন এক সময় দিয়েছেন যখন মুসলিমগণ পরাজিত, বিভক্ত ও অধঃপতিত এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পাশ্চাত্য শক্তির হাতে অধিকৃত। কিন্তু ১৭৫৭ সালে বাংলায় ইংরেজ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা যখন শুরু হয় তখন মুসলিমদের অবস্থা আজকের মত দুর্বল ছিল না। তখন মুসলিমগণই ছিল প্রধানতম বিশ্বশক্তি। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশরা বিশ্বশক্তি হওয়া দূরে থাক, উল্লেখযোগ্য সামরিক শক্তিও ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় ঘটে নিতান্তই প্রাসাদ ষড়ন্ত্রের ফলে, দুর্বল সামরিক শক্তির কারণে নয়। তখনও বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ছাড়া প্রায় সমগ্র ভারত মুসলিমদের হাতে। উসমানিয়া খেলাফতের দখলে তখনও গ্রীস, বুলগিরিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, সাইপ্রাস, মেসিডোনিয়া, ক্রিমিয়া, আলবেনিয়াসহ ইউরোপের বিশাল ভূ-ভাগ। ইরান, আফগানিস্তান তখনও শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্র। ঠিক এমন অবস্থায় বাংলা থেকে শুরু হয় ব্রিটিশ শক্তির মুসলিম ভূমিতে আগ্রাসন। সভ্যতার সংঘাতটি শুরু হয় বস্তুত তখন থেকেই। প্রফেসর হান্টিংটন যে পরামর্শটি দিচ্ছেন, ইংরেজগণ সেটির প্রয়োগ করেছে আজ থেকে প্রায় তিনশত বছর আগেই। তারা জানতো, মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন ও সে বিজয় ধরে রাখা তাদের একার পক্ষে অসম্ভব। ফলে শুরুতেই তারা বিশ্বস্ত পার্টনার খুঁজতে থাকে। পার্টনার তাঁরা পেয়েও যায়। মুসলিমদের মধ্য থেকে মীর জাফরদের ন্যায় মুষ্টিমেয় কিছু বিশ্বাসঘাতক পেলেও তাঁদের মূল পার্টনার ছিল বাঙালী হিন্দুগণ।

বাঙ্গালী হিন্দুর মন যে কতটা বিষপূর্ণ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ ছিল সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে ইংরেজ আমলে রচিত তাদের সাহিত্যে। সেটি যেমন প্রকাশ পায় বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বচন্দ্রগুপ্ত, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্রের মত প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষী সাহিত্যিকদের লেখায়, তেমনি প্রকাশ পায় রবীন্দ্র ও শরৎ-সাহিত্যেও। শুধু সাহিত্যে নয়, প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষ ফুটে উঠে বাঙালী হিন্দুর শিক্ষাব্যবস্থা, পত্র-পত্রিকা, রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও। অথচ এই আমলটিই হল বাঙালী হিন্দুদের সবচেয়ে আলোকিত ও সবচেয়ে গৌরবের। তাজ্জবের বিষয়, এ আমলে বাংলার হিন্দুদের মাঝে পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটলেও তাদের মনের বিদ্বেষপূর্ণ কুৎসিত অন্ধকারটি তাতে দূর হয়নি। বরং বেড়েছে বহুগুণ। এদিক দিয়ে বলা যায়, বাঙালীর ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে অন্ধকার যুগ। সে সময় যতই বেড়েছে হিন্দুর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, ততই বেড়েছে তাদের মনে মুসলিম বিদ্বেষ। হিন্দু-মুসলিমের ধর্ম ও মতের অমিলগুলো শত শত বছরের। কিন্তু কোন কালেই হিন্দুদের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ছড়ায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে এতো ঘৃণা, এতো গালি, এতো মিথ্যাচার এতোটা তীব্র ভাবে ভাবে প্রকাশ পায়নি, যা পেয়েছে তথাকথিত এ রেনেসাঁ আমলে। মুসলিম বিরোধী প্রচারে হঠাৎ এমন জোয়ার সৃষ্টির অন্যতম কারণ ইংরেজদের পক্ষ থেকে দেয়া উস্কানি। শুরু থেকেই ইংরেজদের নীতি ছিল devide and rule অর্থাৎ ভাগ করো এবং শাসন করো। নিজেদেরকে সেক্যুলার রূপে দাবী করলেও তারা এখানে বিভেদের রেখাটি টেনেছে ধর্মের নামে। আর ভাগাভাগীটা তো তখনই তীব্রতর রূপ নেয় যখন সেটি প্রতিষ্ঠিত হয় গভীর ঘৃণার উপর। হিন্দু-মুসলিমের এ ভাগাভাগীটা না হলে মুষ্টিমেয় ইংরেজের পক্ষে কি ভারত শাসন সম্ভব হত? ভারতে ব্রিটিশে শাসনের প্রতিরক্ষায় এতো ইংরেজ লাঠি ধরেনি বা কলম ধরেনি যত হিন্দু বাঙালী ধরেছে। এখানে হিন্দুর মনে যে বিষয়টি প্রবল ভাবে কাজ করেছে সেটি হলো, মুসলিম ভীতি ও মুসলিমদের থেকে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা। এমন এক ভীতিপূর্ণ ও প্রতিশোধ-পরায়ন মানসিক অবস্থার কারণেই ইংরেজ শাসন তাদের কাছে আশির্বাদ মনে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তসহ অধিকাংশ হিন্দুদের সাহিত্যে সে সুরটি প্রবল।    

 

রেনাসাঁ থেকে স্নায়ুযুদ্ধ

হিন্দুদের মনে মুসলিম বিরোধী ঘৃণা সৃষ্টির মূল দায়িত্বটি পালন করে ইংরেজ ওরিয়েন্টালিস্ট তথা প্রাচ্যবিদগণ। সেটি মিথ্যা ইতিহাস রচানার মাধ্যমে। গবেষণার নামে বিকৃত ইতিহাস লেখা তখন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এসব ইংরেজ ওরিয়েন্টালিস্টগণ হিন্দুদের মনে এ বিশ্বাসটি বদ্ধমূল করে যে, অতীতে তাদের সভ্যতা ছিল এবং সে সভ্যতা স্বর্ণোজ্বলও ছিল। আরো বলে, সেটি ধ্বংস করেছে বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা। মুসলিমগণ এভাবে চিত্রিত হয় হিন্দুদের পরম শত্রু রূপে। এসব ওরিয়েন্টালিস্টদের লেখা সেসব বই বগলে করে আধুনিক হিন্দু লেখকগণ সভা-সমিতি করেছে এবং সেগুলির সাথে আরো রং চং মেখে সারা ভারতের হিন্দুদের ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। নিজেদের পূর্বপুরুষদের যদি অন্য দেশের প্রফেসর এসে রাজপুত্র এবং এক গৌরবজনক সভ্যতার নির্মাতা বলে -তবে সেটি কার ভাল না লাগে? তখন বরং সে সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে নাচতে শুরু করবে –সেটিই তো স্বাভাবিক। তেমন উল্লাসের ভাব ভারতীয় হিন্দুদের মাঝেও এসেছিল। অথচ মুসলিমগণ যখন বাংলা দখল করে তখন এদেশে পিরামিডের ন্যায় পিরামিড, চীনের দেয়ালের ন্যায় দেয়াল বা ব্যাবিলিয়নের উদ্যানের ন্যায় উদ্যান পায়নি। তখন সমগ্র ভারত জুড়ে দিল্লি, লাহোর বা আগ্রার ন্যায় কোন শহর ছিল না। কুতুব মিনারের ন্যায় কোন মিনার এবং তাজমহলের ন্যায় কোন সৌধও ছিল না। ফলে সেগুলো ধ্বংস করার প্রয়োজন দেখা দেয় কি করে? বরং সে আমলের মন্দিরগুলি ভারতের নানা স্থানে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বরং ঐতিহাসিক স্থাপত্য ধ্বংসের ইতিহাস গড়ছে তো হিন্দুগণ। বাবরী মসজিদের বিনাশ তো তারই প্রমাণ।

মিথ্যা অভিযোগ খাড়া করতে গবেষণা লাগে না। সেটি উৎপাদিত হয় মিথ্যুকের মগজে। এবং সে কাজে ওরিয়েন্টালিস্টদের মগজের উর্বরতা কম ছিল না। শুধু  বাংলা বা ভারতে নয়, ইংরেজগণ যেখানেই গেছে সেখানেই বিভক্ত সৃষ্টির এ কাজটি অতি সুচারু ভাবে করেছে। তাতে ফল দাড়িয়েছে, নানা বর্ণ ও নানা ভাষার জনগণ যেখানে শান্তিপূর্ণ ভাবে শত শত বছর পাশাপাশি বসবাস করেছে, তাদের পক্ষে একত্রে এক ভূখন্ডে বসবাস করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। গবেষণার নামে বই লেখে আরবদের ক্ষেপিয়েছে তুর্কী ও ইরানীদের বিরুদ্ধে, আবার ইরানী ও তুর্কিদের ক্ষেপিয়েছে আরবদের বিরুদ্ধে। অপরদিকে তুর্কি, কুর্দি ও ইরানীদের থেকে দূরে টানার পর আরবদেরকেও তারা একতাবদ্ধ থাকতে দেয়নি। তাদের মধ্যে বিভেদ গড়েছে বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন ভৌগলিক এলাকার নামে। মধ্যপ্রাচ্য আজ যেরূপ ২২ টুকরায় বিভক্ত -সেটি তো সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকদের সৃষ্ট। এর কারণ, তারা নিজেদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ দেখে মুসলিমদের বিভক্ত রাখার মাঝে। ফলে মুসলিমদের বিভক্ত করা ও পদতলে রাখাই তাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি।

শত্রু দেশের আগ্রাসনটি নিছক রণাঙ্গণে সীমিত থাকে না, সেটি হাজির হয় সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসন নিয়েও। শুরু হয় স্নায়ু যুদ্ধ। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের লড়াইটি তাই পলাশীর ময়দানে শেষ হয়নি। বরং সেটি তীব্রতর হয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনীতির ময়দানে। সে লড়াইটি তীব্রতর করতে বাংলায় এবং পরে ভারতে তারা শুধু সামরিক সেনা ছাউনিই গড়েনি, গড়েছে শিক্ষা, ধর্ম, গবেষণা ও সংস্কৃতির নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তাই সৈনিকদের পাশাপাশি বহু প্রফেসর ও গবেষকও এনেছে। তাই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা একদিকে যেমন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গড়ে এদেশের হিন্দুদের ব্রিটিশরাজ রক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তেমনি এসিয়াটিক সোসাইটি গড়ে গবেষণার নামে হিন্দুদের মন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করার লক্ষ্যে বইয়ের পর বই লিখেছে। শুধু সামরিক শক্তির জোরে কোন শক্তিই কোন দেশকে বেশী দিন ধরে রাখতে পারে না। শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে গাছ যেমন মজবুত শিকড় গড়ে, সরকারও তেমনি দেশের জনগণের গভীরে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংযোগ গড়ে। এই মজবুত সংযোগটির কারণেই ভারতে মুসলিম শাসন সাড়ে ছয়শত সাল টিকে থাকে।

ইংরেজদের কাছেও এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যটি নিছক কিছু বছরের জন্য ছিল না, ছিল শত শত বছরের জন্য। তারা জানতো, নব প্রতিষ্ঠিত এ সাম্রাজ্যের আয়ু বাড়াতে হলে শুধু দেশের ভূগোলে নয়, মনের ভূগোলেও অধিকার জমাতে হবে। এদেশবাসীর মধ্য থেকে প্রচুর সংখ্যক দালাল বা কলাবোরেটর গড়ে তুলতে হবে। নইলে কয়েক হাজার প্রবাসী ইংরেজদের দ্বারা এ বিশাল ভারত দীর্ঘকাল অধিকারে রাখা অসম্ভব। এ লক্ষ্যে ধর্মান্তর যেমন জরুরী, তেমনি জরুরী হলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কনভার্শন। তারা এটাও জানতো, কলাবোরেটর বা সহযোগী খোঁজার কাজটি করতে হবে হিন্দুদের মাঝে। কারণ তারা জানতো, সে কাজটি সহজ নয় মুসলিমদের মাঝে। ইংরেজগণ রাজ্য ছিনিয়ে নেয় মুসলিমদের থেকে। ফলে মুসলিমদের কাছে ইংরেজগণ ছিল তাদের স্বাধীনতা, ধর্ম, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দুষমন। মুসলিম মনে এ পরাজয়ের বেদনাটি ছিল প্রতিদিন ও প্রতি মুহুর্তের। ব্রিটিশরা সেটি বুঝতো। ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিস্তার ও সেটি প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকেই তারা মূল শত্রু ভাবতো। এবং নির্ভরযোগ্য পার্টনার ভাবতো হিন্দুদের। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কনভার্শনের উর্বর ক্ষেত্র রূপে গণ্য হয় শিক্ষাঙ্গণ। হিন্দুদের জন্য গড়া হয় স্কুল-কলেজ। সেসব স্কুল-কলেজ থেকে বাঙালী হিন্দুগণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি সেবাদাস মানস নিয়ে বেরুতে শুরু করে। তারা পরিনত হয় ব্রিটিশ শাসনের পাহারাদার সৈনিকে। এভাবে বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁ বেড়ে উঠে ব্রিটিশসেবী এক দালাল চেতনা নিয়ে।  

 

ব্রিটিশের মুসলিমদলন ও হিন্দুলালন নীতি

কৃষক তার গরুকে ঘাস দেয়ে যাতে সে লাঙল টানতে পারে। তেমনি ইংরেজগণও শিক্ষার নামে হিন্দুদের সামর্থ্য বাড়িয়েছে -যাতে তারা ব্রিটশদের শাসন ও লুন্ঠনে সহায়তা দেয়। ফলে রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি গুরুত্ব পায় হিন্দুদের মাঝে ইংরেজী ভাষা, ইংরেজের দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দ্রুত বিস্তার। অপর দিকে মুসলিমদের অশিক্ষিত রাখা ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল রাখার মাঝে নিজেদের কল্যাণ দেখে। প্রণীত করে এমন এক শিক্ষানীতি –যাতে ব্যাপকতর হয় ভারত ভূমিতে দালাল উৎপাদনের কাজ। ভারতে এমন একটি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ব্যাখা করতে গিয়ে লর্ড ম্যাকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “ব্রিটিশ সরকার ভারতে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করবে যার মাধ্যমে এমন একদল ভারতীয় সৃষ্টি হবে যারা শুধু রক্তে-মাংসে হবে ভারতীয়, কিন্তু চিন্তা-চেতনা, মন ও মননে হবে ব্রিটিশ (অর্থাৎ ব্রিটিশের সেবক)।” সে স্ট্রাটেজীকে সামনে রেখে ময়দানে নামে উইলিয়াম কেরীর ন্যায় বহু পাদ্রী। প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীরাম পুর কলেজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু কলেজ  ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে তোলা হয় ছাপাখানা। প্রকাশনা শুরু হয় বহু পত্র-পত্রিকার। লক্ষ্য, বাংলার হিন্দুদেরকে তাদের প্রতিবেশী মুসলিমদের থেকে সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে আলাদা করা। এবং মন ও মননে, চেতনা ও দর্শনে নিজেদের কাছের মানুষ রূপে গড়ে তোলা। বাংলার হিন্দুদের মাঝে তখন সাজ সাজ রব, বিশেষ করে বর্ণ হিন্দুদের মাঝে। প্রশাসন, বিচার ও শিক্ষা থেকে মুসলিমদের পরিকল্পিত ভাবে হঠিয়ে হিন্দুদের জন্য বিশাল শূণ্যস্থান সৃষ্টি করা হয়। তাদের জন্য সষ্টি করা হয় অর্থ উপার্জনের বিপুল সুযোগও। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর কেরানী, এজেন্ট ও ঠিকাদার এবং ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব কালেক্টর, আদালতের মুন্সেফ-ম্যাজিস্টেট বা উকিল, ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থার এজেন্ট -এগুলো হয়ে দাঁড়ায় সে কালের বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে অতি আকর্ষণীয় পেশা। বঙ্কিম চন্দ্রের ন্যায় প্রথম সারির লেখকদের জীবনের সিংহভাগ কেটেছে ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব কালেক্টর রূপে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কোলকাতা থেকে পত্রিকা বের করেছেন যার মূল কাজ ছিল ইংরেজদের বন্দনা করা, মুসলিম চরিত্রে কালীমা লেপন করা, আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেবায় হিন্দুদের অনুপ্রাণিত করা। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের জীবন কেটেছে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ও ব্রিটিশ সরকারের অতি বিশ্বাসভাজন এজেন্ট রূপে। এধরণের শত শত তাঁবেদার হিন্দুদের অর্থনৈতিক ভিত্তিটা আরো মজবুত করতে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় জমিদারি। সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জে বিদ্রোহী মুসলিমদের রুখতে ব্রিটিশের পক্ষে লাঠিয়ালের মূল দায়িত্বটা পালন করেছে এ দুর্বৃত্ত জমিদারগণই। এরূপ দালাল শ্রেণীর কারণেই মুষ্টিমেয় ব্রিটিশদের প্রশাসনের কাজে থানায় থানায় বা গ্রাম পর্যায়ে নামতে হয়নি; তাদের কাজ ছিল বড় বড় শহরে বসে শুধু নির্দেশ দেয়া। এভাবেই ভারত জুড়ে প্রতিষ্ঠা পায় বিদেশী ব্রিটিশ সরকার ও তার দেশী দালাল শ্রেনীর যৌথ দুর্বৃত্ত শাসন।

কোম্পানীর লক্ষ্য ব্যবসার নামে অবাধ লুন্ঠন। কোন খয়রাতি কাজকর্ম বা জনকল্যাণ তাদের লক্ষ্য ছিল না। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে এসেছে, ভারতে নতুন নতুন রাজ্য জয় করেছে, সে সব অধিকৃত রাজ্যে দুর্গ গড়েছে নিছক শোষনভিত্তিক সে বাণিজ্যিক প্রজেক্টের অংশ রূপে। কোম্পনী জনগণ থেকে উচ্চহারে রাজস্ব নিয়েছে সে শোষণ ও শাসন প্রক্রিয়াকে তীব্রতর করতে। এভাবেই মুনাফা বাড়িয়েছে এবং মুনাফার সে অর্থ বিলেতে ব্রিটিশ সরকার ও কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডারদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। ব্রিটিশ পণ্যের বাজার বাড়াতে বাংলার জগতবিখ্যাত মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে। মসলিনের উৎপাদন বন্ধ করতে এমন কি তাঁতীদের আঙ্গুলও কাটা হয়েছে। বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসন তাই সর্বার্থেই ছিল এক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও নির্যাতনমূলক শাসন। তাদের সে সীমাহীন শোষণের ফলেই বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার কিছু কাল পরই ১৭৭০ সালে সৃষ্টি হয় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। তাতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। ইতিহাসের সেটিই ছিয়াত্তরের মন্বন্তর রূপে পরিচিত। তারা আরেকটি দুর্ভিক্ষ উপহার দেয় ১৯৪৪ সালে। সেটি আসে বাংলার খাদ্যের মওজুদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গণে পাঠিয়ে দেয়ার ফলে। শেষাক্ত এ দুর্ভিক্ষেও লক্ষ লক্ষ বাঙালীর মৃত্যু ঘটে। অথচ সাত শত বছরের মুসলিম শাসনে বাংলায় বা ভারতে একটি বারও দুর্ভিক্ষ আসেনি। বরং নবাব শায়েস্তা খানের আমলে খাদ্যপণ্যের সস্তা মূল্য বিশ্বে রেকর্ড গড়েছিল। প্রতি দেশেই সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শাসন নির্যাতন, লুন্ঠন, দেশী শিল্পের বিনাশ ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে হাজির হয়। মুসলিম শাসনকালে সেটি হয়নি।  তাই বাংলায় বা ভারতে মুসলিম শাসনকে কখনোই ঔপনিবেশিক বিদেশী শাসন বলা যায় না। মুসলিমগণ এদেশে কখনই ব্যবসায়ীক লক্ষ্যে বা লুন্ঠনের স্বার্থে সাম্রাজ্য স্থাপন করেনি। আর্য ও অনার্য বহুবর্ণের মানুষ বাংলার বাইরে থেকে এসে এদেশে বসবাস করছে। তেমনি মুসলিমগণও ভারতে ঘর বেঁধেছে। এটিই তো মানব সভ্যতার রীতি। দেয়াল গড়ে বা কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে মানবের সে প্রবাহ অতীতে কখনোই বন্ধ করা হয়নি। অপর দিকে বেশীর ভাগ বাঙালী মুসলিম তো বাংলার আদিবাসী; তারা মুসলিম হয়েছে ইসলাম কবুলের মাধ্যমে। বিদেশ থেকে যে সব মুসলিম বাংলায় এসেছে তারা যা কিছু গড়েছে তা বাংলাতেই গড়েছে। বাংলার সম্পদ নিয়ে ব্রিটিশগণ যেমন বিলেতে নগর-বন্দর গড়েছে, বাংলার কোন মুসলিম শাসকই সেটি করেনি। ঢাকা, সোনার গাঁ, গৌড়, মূর্শিদাবাদ, বাগের হাট ও উত্তর বঙ্গে যা কিছু ঐতিহাসীক কৃর্তি -তা তো মুসলিমদেরই গড়া। অথচ হিন্দু রাজাগণও এদেশ বহুকাল শাসন করেছে। কিন্তু তাদের সে নিদর্শনগুলি কোথায়? ব্রিটিশদের গড়া নিদর্শনগুলিই বা কোথায়? তাছাড়া এদেশের উপর বর্গী হামলা, মগ হামলা, মারাঠা হামলা ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছে তারা তো প্রায় সবাই মুসলিম। পলাশীর রণাঙ্গন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মজনু শাহের ফকির বিদ্রোহ বা দুদু মিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন –সর্বত্র তো তারাই। অথচ ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের দ্বারা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদারীর যে ইতিহাস নির্মিত হল -সেটিকে বলা হচ্ছে বাঙালীর রেনেসাঁ যুগ। এবং ইংরেজ শাসন চিত্রিত হচ্ছে আশির্বাদ রূপে। আর মুসলিম শাসনামলকে বলা হচ্ছে অন্ধকার যুগ বলে!

 

হিন্দু সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা

বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যরা তাদের সাহিত্যে যে মুসলিম বিরোধী বিষ উদগিরণ করেছেন সেটি বাংলার মধ্য যুগের বা আদি যুগের সাহিত্যে পাওয়া যায় না। বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদের মগজে ঘৃনাপূর্ণ মিথ্যার বিষ ঢুকিয়েছিল বস্তুত ইংরেজগণ। তারাই প্রথম আবিস্কার করে, ভারতের মুসলিম শাসন শুধু ধ্বংস, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও শোষণ ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। বলেছে, মন্দির ভেঙ্গে তার উপর মসজিদ গড়েছে। তাদের লেখনিতে শিবাজীর চরিত্র অংকিত হয়েছে হিন্দু জাগরনের এক মহান ও আদর্শনীয় বীর রূপে, আর মোঘল বাদশা আওরঙ্গজীব চিত্রিত হয়েছেন কুৎসিত ভিলেন রূপে।

বাংলায় হিন্দুদের বাস মুসলিমদের চেয়ে অধিক কাল ধরে। অথচ তাদের ব্যর্থতা হল, সমগ্র ইতিহাস ঘেঁটে একজন হিন্দুকেও বের করতে পারে যিনি স্বাধীনতার লড়াইয়ে বাংলার মানুষের সামনে আদর্শ হিসাবে চিত্রিত হতে পারেন। সেরূপ একটি চরিত্রের তালাশে বঙ্কিম ও মাইকেল মধুসূদন যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথও ব্যর্থ হয়েছেন। ইতিহাসে পাতায় সে এক বিশাল শূন্যতা। সে শূন্যতা পূরণে রবীন্দ্রনাথকে তাই অবাঙালী শিবাজীকে হিরো রূপে পেশ করতে হয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “শিবাজী উৎসব” কবিতায় শিবাজীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন,

“হে রাজ-তপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা

বিধর ভান্ডারে

সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা

পারে হরিবারে?

তোমার সে প্রাণোৎসর্গ, স্বদেশ-লকক্ষীর পূজাঘরে

সে সত্য সাধন,

কে জানিত, হয়ে গেছে চির যুগ-যুগান্তর ওরে

ভারতের ধন।”

এই হল রবীন্দ্রনাথের বিচার বোধ। এই হল রবীন্দ্র মানস ও চেতনা! তবে এটি শুধু রবীন্দ্রনাথের একার চেতনাগত সমস্যা নয়, এটিই মূল সংকট ছিল বাঙালীর রেনেসাঁর কর্ণধারদের। কিছু দালানকোঠা ও কলকারখানা গড়া, কিছু ডিগ্রিধারি মানুষ গড়া, কিছু কবিতা-উপন্যাস লেখা, রাজনীতিতে কিছু আলোড়ন তোলাই একটি জাতির জীবনে জাগরণ আনার জন্য কি যথেষ্ট? বিশাল বিপ্লবের কাজে উচ্চতর দর্শনও লাগে। সে দর্শনটিই আনে জনগণের চেতনা রাজ্যে বিপ্লব। কিন্তু বাংলার হিন্দুগণ সে দর্শনের খোঁজ পায়নি। ফলে তাদের মনের রাজ্যে বিপ্লবও আসেনি। বরং ঘোর অন্ধকারই রয়ে গেছে। রামমোহন রায় এবং রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ সে দর্শনের খোঁজে হিন্দুর পৌত্তলিকতা ছেড়ে একাশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। মধুসূদন দত্ত খৃষ্টান হয়ে গেছেন। অপর দিকে বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দো ঘোষেরা হিন্দুদের আবার সনাতন পৌত্তলিকার দিকে ফিরেয়ে এনেছেন। ফলে হিন্দুদের আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন সে স্থানটিতে যেখান থেকে রাম মোহন, দ্বারকানাথ ও তাদের সাথীরা যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরই ফল হলো, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সন্তানেরাও আর সে ব্রাহ্ম ধর্মে স্থির থাকতে পারেননি, ফিরে গেছেন হিন্দু পৌত্তলিকতায়। রবীন্দ্রনাথ এমন এক কট্টর হিন্দু হওয়ার কারণেই শিবাজীকে হিরো বানিয়েছেন। আর শিবাজীর মত একজন দস্যু চরিত্রের মানুষ যখন হিরো হয় তখন কি সে জাগরণ বেঁচে থাকে? আর এটিই বাংলার হিন্দুর রেনেসাঁর আদর্শিক ও নৈতিক সংকট। এমন সংকট খোদ রেনেসাঁরই মৃত্যু ঘটায়। বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁও তাই বাঁচেনি।

দেখা যাক, রবীন্দ্র নাথ যাকে “হে রাজস্বী বীর” বলে মুগ্ধ মনে কবিতা লিখেছেন তার প্রকৃত পরিচয়টি কি? ব্যক্তিকে বুঝা যায় তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও আরাধ্য ব্যক্তিকে দেখে। রবীন্দ্র মানস ও তাঁর চেতনাকে বুঝতে হলে শিবাজীকেও বুঝতে হবে। এতে বুঝা যাবে রবীন্দ্রনাথভক্তদের রাজনৈতীক এজেন্ডা। প্রশ্ন হল, তিনি কি আদৌ বীর ছিলেন? শিবাজীর পরিচয় হল, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে তিনি ব্যস্ত রেখেছিলেন মারাঠা অঞ্চলে লুকিয়ে থেকে অতর্কিত হামলার মধ্য দিয়ে। এটি ছিল দিল্লির মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে উগ্রহিন্দুর সন্ত্রাস। সম্মুখ সমরে আসার সামর্থ্য শিবাজীর ছিল না। যুদ্ধে একবার পরাজিত ও বন্দী হওয়ার পর ফন্দি করে লুকিয়ে পালিয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব একবার সেনাপতি আফজাল খাঁর নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনীকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুদ্ধের বদলে আলোচনায় ডেকে আফজাল খাঁকে তিনি হত্যা করেন। সেটি ছিল কাপুরুষিত হত্যা। সে সময় আফজাল খাঁ তাকে ইসলামী  উদারতায় আলিঙ্গনে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সে মুহুর্তে তার বাঁ হাতে লুকানো “বাঘের নখ” দিয়ে তার দেহ ছিন্ন করেন। অথচ এ নিরেট কাপুরুষতা বীরতূল্য গণ্য হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছে, যা নিয়ে বিশাল এক কবিতাও লিখেছেন। এ হল রবীন্দ্রনাথের বিবেচনা ও মানবতার মান! রবীন্দ্রনাথ বরং সে সব ঐতিহাসিকদেরও নিন্দা করেছেন যাদের দৃষ্টিতে শিবাজী ছিল এক বর্বর দস্যু। রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরকে মিথ্যাময়ী বলেছেন, এবং তাঁদের বিদ্রুপ করে লিখেছেন,

“বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলে করে পরিহাস

অট্টহাস্য রবে…

তব পুণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস

এই জানে সবে।

অয়ি ইতিবৃত্ত কথা, ক্ষান্তু করো মুখর ভাষণ

ওগো মিথ্যাময়ী,

তোমার লিখন- ‘পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন

হবে আজি জয়ী।

যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে

তব ব্যঙ্গ বাণী

যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে

নিশ্চয় সে জানি।”

ঐতিহাসিক ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও স্বজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনই এর উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ যাঁর পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিকতাকে সাম্প্রদায়িক দৃ্ষ্টভঙ্গীর সঙ্গে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তাঁর কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্মেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, কোনও মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও একচ্ছত্রও লেখেননি –যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছে। এ থেকেএ প্রমাণিত হয় উনিশ শতকী বাংলার জাতীয়তা জ্ঞানের উৎসমূল কোথায় ছিল।” –(সূত্রঃ Dr. Romesh Chandra Majumder, History of Bengal, p 203.)

বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁ যুগে সবচেয়ে ঘৃণ্য যে কাজটি হয়েছে তা হলো, ইংরেজদের কলাবোরেটর রূপে হিন্দুদের যোগদান। সমগ্র উপমহাদেশে তারাই সর্বপ্রথম এ পেশায় নামে। কয়েক ডজন নবেল প্রাইজ দিয়েও কি বাঙালীর এ কলংক ঢাকা যাবে? তখন ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনে দুই ধরনের বাবু দেখা যেত। এক), গোরা বা শ্বেতাঙ্গ বাবু, দুই), বাঙালী বাবু। বাঙালী বাবুদের ইংরেজ-সেবা শুধু প্রশাসনে সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং শুধু বাংলাতেও সীমাবদ্ধ রাখেনি। প্রশাসনের পাশে সাহিত্যেও সেটি প্রবল ভাবে প্রকাশ পায়। বাংলার সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাতসহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে। শিকারী যেমন শিকারী ঘুঘুকে দিয়ে ঘুঘু ধরে, তেমনি ইংরেজগণও বাঙালী হিন্দুদের দিয়ে সমগ্র ভারতের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দুদেরও তাঁবেদারে পরিণত করে। ইংরেজ সেবার যে আদর্শ রবীন্দ্র-পরিবার ও বঙ্কিমচন্দ্র স্থাপন করেন, সেটিই ভারতীয় হিন্দুদের আদর্শে পরিণত হয়। ফল হলো, এমনকি কংগ্রেস নেতা করম চাঁদ গান্ধিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান ও প্রাণদানের পক্ষে নিজ প্রদেশ গুজরাতে সৈন্য সংগ্রহে নেমেছিলেন।

বাঙালী হিন্দুদের অপরাধ শুধু এ নয় যে, মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষ ছড়িয়ে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে তারা বিষাক্ত করেছে। তারা বিষাক্ত করেছে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দুদের মনও। ইংরেজ ওরিয়েন্টালিস্টগণ মুসলিম বিদ্বেষপূণ মিথ্যা দিয়ে যেসব ইতিহাস রচনা করে, সেগুলি সর্বপ্রথম গলধঃকরণ করে বাঙালী হিন্দুগণ। পরে তারা সেগুলির সাথে নিজ মনের আবেগ মিশিয়ে নিজেরাও ইতিহাস লেখে এবং সেগুলি সমগ্র ভারত ব্যাপী ছড়িয়ে দেয়। বস্তুত এসব হিন্দু বাঙালীদের লেখা বইগুলোই বহুকাল যাবত পঠিত হয়ে আসছে সারা ভারতের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই রূপে। অহিন্দু ও অভারতীয় ইংরেজ ওরিয়েন্টালিস্টদের লেখা ইতিহাসের স্থলে সে বইগুলোর বাড়তি সুবিধাটি হল, বাঙালী হিন্দুদের হাতে রচিত হওয়ার সেগুলো ভারতের অন্য এলাকার হিন্দুদের কাছে সহজে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। সে সময়ের ইতিহাসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শুরুও এই বাংলা থেকে। সেটিও এ বর্ণহিন্দুদের হাতে। আজ ভারত জুড়ে হিন্দুত্বের জোয়ার। সেটির শুরুও বাঙালী হিন্দুদের থেকে। এর আদি গুরু বঙ্কিম চ্যাটার্জি। তার লেখা ‘আনন্দ মটে” ধ্বনিত হয়েছে উগ্র হিন্দুত্বের বাণী। ‘আনন্দ মটে”র বন্দে মাতরম গানটি গৃহীত হয়ে ভারতের জাতীয় সংগীত রূপে।

ভারত থেকে মুসলিম নির্মূলের মিশন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ তথা আর. এস.  এস। এর প্রতিষ্ঠাতা  হেডগেয়ার তার মুসলিম বিরোধী চেতনার পরিপুষ্টি পেয়েছে শিক্ষাকালে কলকাতায় অবস্থান কালে। ভারতের রাজনীতিতে আজ যে উগ্র সাম্প্রদায়িক বিজিপি –সেটির শুরু হিন্দু মহাসভা থেকে। আর হিন্দু মহাসভার জন্ম কোলকাতায়, এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তিনি ছিলেন বাঙালী, এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জির পুত্র। তিনি নিজেও ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ অবধি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।  আততায়ীর হাতে গান্ধীর মৃত্যু হলে দোষ বর্তায় হিন্দু মহাসভার উপর। সে দুর্নাম থেকে বাঁচার তাগিদে তিনি নতুন দল গড়েন ভারতীয় জনসংঘ -যা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় ভারতীয় জনতা পার্টি, সংক্ষেপে বিজেপী। বার বার নাম পরিবর্তন করা হলেও এ দলের মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ কট্টর সাম্প্রদায়ীক নীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

 

মুসলিম গণহত্যায় বাঙালী হিন্দুর লিগ্যাসি                

মুসলিম গণহত্যার রাজনীতির জন্মটি আহমেদাবাদ, মোম্বাই বা মিরাটে হয়নি, হয়েছিল হিন্দু রেনেসাঁর জন্মভূমি কলকাতায়। এবং এ সন্ত্রাসী রাজনীতির শুরু বস্তির গুন্ডা, চোর-ডাকাত বা নারীধর্ষক দুর্বৃত্তদের হাতেও হয়নি, বরং হয়েছে শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ন্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী উপাচার্যের হাত দিয়ে। সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের মনও যে কতটা বিষাক্ত ও প্রতিহিংসাপূর্ণ হতে পারে -এ হল তার নমুনা। শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯৪১ সালে হিন্দুদের এক জনসভায় বলেছিলেন, মুসলিমরা যদি পাকিস্তান চায় তবে তাদের তল্পিতল্পা বেঁধে ভারত ত্যাগ করা উচিত।–(BLCP, 1941)। পাকিস্তানের জন্ম ও তার বেঁচে থাকাটি তাঁর মত হিন্দুনেতাদের কাছে যে কতটা অসহ্য ছিল -এ হলো তার নমুনা। তাঁর কাছে অসহ্য হলো ভারতে মুসলিমদের বসবাসও। বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন বিজেপী নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানী। বিজিপির আরেক নেতা নরেন্দ্র মোদী ইতিহাস গড়েছেন গুজরাতে মুসলিম হত্যায় নেতৃত্ব দিয়ে। তবে যে শহরটি মুসলিম গণহত্যাকে রাজনৈতিক আচার রূপে প্রথম শুরু হয় সেটিও ভারতের অন্য কোন শহর নয়, সেটি বাঙালী হিন্দুদের শহর কলকাতা। আহমেদাবাদ, মুম্বাই, মুরাদাবাদ, বিহার ও ভারতের অন্যান্য স্থানে মুসলিম নির্মূলের গণহত্যাগুলি এসেছে বাঙ্গালী বাবুদের সৃষ্ট ১৯৪৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম বিরোধী গণহত্যার পর।

কলকাতার হিন্দুদের মন যে কতটা মুসলিমবিদ্বেষপূর্ণ ও দাঙ্গাপাগল -সেটিই প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৪৬ সালের মুসলিম বিরোধী গণহত্যায়। সে গণহত্যার কিছু নিজ চোখে-দেখা ভয়াবহ বর্ণনাটি দিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বাঙালী প্রফেসর ড. তপন রায় চৌধুরী তাঁর “বাঙাল নামা” বইতে। প্রফেসর ড.তপন রায় চৌধুরী লিখেছেন, “নিজের চোখে দেখা ঘটনার বিবরণে ফিরে যাই। হস্টেলের বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম রাস্তার ওপারে আগুন জ্বলছে। বুঝলাম ব্যাপারটা আমার চেনা মহাপুরুষদেরই মহান কীর্তি। হস্টেলের ছাদে উঠে দেখলাম –আগুন শুধু আমাদের পাড়ায় না, যতদূর চোখ যায় সর্বত্র আকাশ লালে লাল। তিন দিন তিন রাত কলকাতার পথে ঘাটে পিশাচনৃত্য চলে। … দাঙ্গার প্রথম ধাক্কা থামবার পর বিপজ্জনক এলাকায় যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন ছিলেন, তাঁদের খোঁজ নিতে বের হই। প্রথমেই গেলাম মুন্নুজন হলে। ..নিরঙ্কুশ হিন্দু পাড়ার মধ্যে ওদের হস্টেল। তবে ভদ্র বাঙালি পাড়া। সুতরাং প্রথমটায় কিছু দুশ্চিন্তা করিনি। কিন্তু দাঙ্গা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালির রুচি-সংস্কৃতির যেসব নমুনা দেখলাম, তাতে সন্দেহ হল যে, মুন্নুজান হলবাসিনী আমার বন্ধুদের গিয়ে আর জীবিত দেখবো না। …হোস্টেলের কাছে পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে ভয়ে আমার বাক্যরোধ হল। বাড়ীটার সামনে রাস্তায় কিছু ভাঙা স্যুটকেস আর পোড়া বইপত্র ছড়ানো। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। ফুটপথে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন – একটু আগে পুলিশের গাড়ি এসে মেয়েদের নিয়ে গেছে।…শুনলাম ১৬ই আগষ্ট বেলা এগারোটা নাগাদ একদল সশস্ত্র লোক হঠাৎ হুড়মুড় করে হস্টেলে ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা অশ্রাব্য গালিগালাজ করে যার মূল বক্তব্য –মুসলমান স্ত্রীলোক আর রাস্তার গণিকার মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। …হামলাকারিরা অধিকাংশই ছিলেন ভদ্রশ্রেণীর মানুষ এবং তাঁদের কেউ কেউ ওঁদের বিশেষ পরিচিত, পাড়ার দাদা। ” –(তপন রায়চৌধুরী, ২০০৭)।

প্রফেসর ড.তপন রায় চৌধুরি আরো লিখেছেন, “খুনজখম বলাৎকারের কাহিনী চারি দিক থেকে আসতে থাকে। …বীভৎস সব কাহিনী রটিয়ে কিছু লোক এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। তার চেয়েও অবাক হলাম যখন দেখলাম কয়েকজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত লোক মুসলমানদের উপর নানা অত্যাচারের সত্যি বা কল্পিত কাহিনি বলে বা শুনে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে দু-তিনজন রীতিমত বিখ্যাত লোক। প্রয়াত এক পন্ডিত ব্যক্তি, যাঁর নাম শুনলে অনেক নিষ্ঠাবান হিন্দু এখনও যুক্তকরে প্রণাম জানায়, তাঁকে এবং সমবেত অধ্যাপকদের কাছে নিকাশিপাড়ার মুসলমান বস্তি পোড়ানোর কাহিনি বলা হচ্ছিল। যিনি বলছিলেন তিনি প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিশ্বাসযোগ্য লোক। বেড়া আগুন দিয়ে বস্তিবাসীদের পুড়িয়ে মারা হয়। একজনও নাকি পালাতে পারিনি। ছেলেটি বলছিল, কয়েকটি শিশুকে আগুনের বেড়া টপকে তাদের মায়েরা আক্রমণকারীদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে ওদের প্রাণগুলি বাঁচে। বাচ্চাগুলিকে নির্দ্বিধায় আবার আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। আমরা শুনেছিলাম, এই কুকীর্তির নায়ক কিছু বিহারী কালোয়ার। তাই ভয়াবহ বর্ণনাটি শুনে সুশোভনবাবু মন্তব্য করেন, “এর মধ্যে নিশ্চয়ই বাঙালি ছেলেরা ছিল না?” শুনে সেই পন্ডিত প্রবর গর্জে উঠলেন, “কেন, বাঙালি ছেলেদের গায়ে কি পুরুষের রক্ত নেই?” –(তপন রায়চৌধুরী, ২০০৭)।

 

বাঙালী হিন্দুর স্বার্থপরতা ও বিভক্ত বাংলা

বাংলার হিন্দুদের চেতনায় স্বার্থপরতাটি অতি প্রকট। তাতে মারা পড়ে মানবতা ও বিবেক বোধ। ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয় মূলত এমনি এক বিষাক্ত ও স্বার্থপর মনের প্রেক্ষাপটে।  তবে তেমন একটি চেতনায় বাংলা বিভক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের বহু আগেই; ১৯৪৭ সালে সে বিভক্তিটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও স্বীকৃতি পায় মাত্র। রেনেসাঁর নামে বাংলার হিন্দুদের মাঝে যেরূপ আত্মপুজা ও মুসলিম ঘৃনার চর্চা শুরু হয়েছিল সেটিই ধাবিত করে বাঙালী হিন্দুদের আত্মঘাতে। সে আত্মঘাতী রেনেসাঁয় গুরুত্ব পায় মুসলিমদের পিছনে ফেলে হিন্দুদের দ্রুত এগিয়ে চলা। পাশাপাশি দুটো গাছ জন্ম নিলে একটি অপরটির জন্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেয়, সে প্রয়োজনে দুটি গাছই দুই পাশে কিছুটা হেলে যায়। কিন্তু হিন্দুগণ প্রতিবেশী মুসলিমদের জন্য কোন স্থান ছেড়ে দিতে রাজী ছিল না। তারা সবটুকুই নিজেদের দখলে রাখতে চেয়েছিল। তারা দখল নিতে চেয়েছিল অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা ও প্রশাসনের সবটুকু জুড়ে। অথচ তখন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫%। একটি দেশের ৪৫% ভাগ মানুষ তার ৫৫% ভাগ মানুষকে পিছনে ফেলে সামনে এগুয় কি করে? সেটি ভাবনায় আসেই বা কীরূপে? উগ্র স্বার্থপরতায় সবকিছুই সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বশক্তি। কিন্তু তাদের বেড়ে উঠার পিছনে বড় কারণটি হল, দেশটি সাদা-কালা, ইউরোপীয়-অইউরোপীয় সকল নাগরিককে বেড়ে উঠার জন্য স্থান করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলায় সেটি হয়নি। বাঙালী হিন্দুদের সেরূপ উদারতাই ছিল না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলিমদের জন্য সরকারি চাকুরিতে কিছু স্থান ছেড়ে দেয়ার জন্য হিন্দুদের সামনে সুপারিশ রেখেছিলেন, কিন্তু সেটিও তাদের পছন্দ হয়নি। হিন্দুগণ তাদের প্রতিষ্ঠিত স্বার্থকে একটুও ছাড়তে রাজী ছিল না। প্রশ্ন হলো, দুটি সম্প্রদায়ের মাঝে এতো ঘৃনা, এতো অবিশ্বাস ও এতো বঞ্চনা বিরাজ করলে সে দেশ কি সামনে এগুতে পারে? এটিতো সংঘাত ও আত্মঘাতের পথ। শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার বই ‘আত্মঘাতী বাঙালী’তে বাঙালী হিন্দুর নানা নৈতিক রোগের চিত্র পেশ করলেও তাদের এ অতি নৃশংস, অমানবিক ও মুসলিমবিদ্বেষী চিত্রটি তুলে ধরেননি।

 

বাঙালী রেনাসাঁ কি আদৌ কি রেনাসাঁ?

দেখা যাক, বাংলায় হিন্দু জাগরণের নায়ক কারা ছিলেন? কী ছিল তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দর্শন? এ জাগরণের শুরু রাজা মোহন থেকে এবং শেষ হ্য় রবীন্দ্রনাথে। এর সময়কাল উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক অবধি। প্রশ্ন হলো, এ জাগরণকে কি আদৌ রেনেসাঁ বলা যায়? রেনাসাঁর অর্থ পুনর্জাগরণ। এ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় ষোড়ক ও শপ্তদশ শতকের ইউরোপে যে জাগরণ শুরু হয় সেটি বোঝাতে। গ্রীক ও রোমানদের হাতে খৃষ্টের জন্মের আগে ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে সাম্রাজ্য গড়ে উঠে। তাদের হাতেই প্রতিষ্ঠা ঘটে পাশ্চাত্য সভ্যতার। ইউরোপের জাগরণটি ছিল মূলত সেটির পুনর্জন্ম ঘটানোর। আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতাকেও বলা হয় সে গ্রীকো-রোমান সভ্যতারই পরম্পরা রূপ। কিন্তু বা্ংলায় হিন্দুদের মাঝে যে জাগরণ আসে সেটিকে রেনেসাঁ বললে এ কথাও মেনে নিতে হয় যে, বাংলার হিন্দুদের দ্বারা এর পূর্বেও একবার সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ তাদের হাতেও বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বাঙালী হিন্দুর ইতিহাসে সেরূপ জাগরণ বা সাম্যাজ্য নির্মাণের প্রমাণ কই? সেটি কি সেন রাজাদের আমল? সেনা রাজারা হিন্দু হলেও তারা তো বাঙালী ছিল না। তারা এসেছিল দক্ষিণ ভারতের কর্নাটাকা থেকে। সেনদের পূর্বে তো ছিল বৌদ্ধ পাল রাজবংশ। বস্তুত উনবিংশ শতাব্দীর এ বাঙালী হিন্দুর জাগরণ যেমন রেনেসাঁ ছিল না, তেমনি সমগ্র বাঙালীরও ছিল না। এমনকি সমগ্র হিন্দুদেরও নয়, এটি ছিল বাংলার সংখ্যালঘু বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের জাগরণ। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ আজকের ন্যায় সেদিনও মুসলিম ছিল। তারা ছিল এ বঙ্গেরই আদিবাসী। কথা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদেরকে যখন কোনরূপ রেনেসাঁ বা জাগরণ থেকে বাদ রাখা হয় সেটিকে কি সমগ্র বাঙালীর রেনেসাঁ বলা যায়?      

বাংলায় হিন্দু জাগরণের নামে যা কিছু ঘটেছে সেটির মূলে যারা ছিলেন তারা হলেন রাজা রামমোহন রায়, কবি রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকনাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামতনু লাহিড়ীর ন্যায় ব্যক্তিবর্গ। শুরুতে যে দর্শনটা কাজ দেয় সেটিও হিন্দু দর্শন ছিল না। ছিল ব্রাহ্মসমাজের নব আবিস্কৃত ধর্ম -যা ছিল পৌত্তলিকতা বিরোধী। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন সে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রধান প্রবক্তা। তাঁর পৌত্তলিকতা বিরোধী সে ধারণাটি আসে ইসলাম ও খৃষ্টান ধর্মের প্রভাব থেকে। মাইকেল মধুসূদনের মত অনেকেই যেমন খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন তেমনি রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকনাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেনের মত অনেকেই খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা না নিলেও হিন্দুদের সনাতন পৌত্তলিকতাকে বর্জন করেছিলেন। এক ঈশ্বর ভিত্তিক ব্রাহ্ম ধর্ম কোলকাতা ভিত্তিক বুদ্ধিজীবীদের মাঝে আলোড়ন তুলতে সমর্থ হলেও সাধারন হিন্দুদের মাঝে সে ধর্মের তেমন বিস্তার ঘটেনি। তারা ব্যর্থ হয়েছেন ধর্মীয় ইন্সটিটিউশন গড়ে তুলতে। তবে তাদের মূল সমাস্যটি হলো তাদের যেমন কোন পয়গম্বর ছিল না, তেমনি কোন ধর্মীয় গ্রন্থও ছিল না। শুধু চিন্তাভাবনা, বুদ্ধিবৃত্তি বা ইনটেলেকচুয়ালিজমের উপর ভিত্তি করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায় না। ফলে ব্রাহ্ম ধর্ম ব্যর্থ হয়েছে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে এবং রবীন্দ্রনাথের মত ব্রাহ্মরা অবশেষে মিশে গেছেন পুরোন হিন্দুধর্মের মূল দেহে। বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে হাজির হন, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, দ্বীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের মত সাহিত্যিক। সাহিত্যের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের বাণী নিয়ে হাজির হাজির হন বিপিন চন্দ্র পাল, স্বামী বিবেকানন্দ ও অরবিন্দু ঘোষ।  বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন জগতিশ চন্দ্র বোস ও সত্যন্দ্র নাথ বোস। রাজনীতিতে আসেন সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বোস এবং শরৎ বোস। এভাবেই শুরু হয় তথাকথিত রেনেসাঁ। এটি বাংলায় শুরু হলেও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের তাতে কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না।

যে কোন জাগরণেরই একটি উচ্চতর নৈতিক ও মানবিক লক্ষ্য থাকে। অজ্ঞতা, পশ্চাদপদতা ও কুসংস্কারের বদলে মানবতা তখন নতুন প্রাণ পায়। তখন জেগে উঠে বিবেক। রেনেসাঁকে তখনই প্রকৃত রেনেসাঁ বা পুনর্জন্ম বলা যায়। কিন্তু বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁয় কতটুকু বেড়েছিল মানবতা? কতটুকু জেগেছিল বিবেক? রবীন্দ্র নাথ যখন কবিতা লেখা শুরু করেন তথাকথিত বাঙালী রেনেসাঁ তখন মধ্য গগনে। অথচ তখনও বাংলায় সতিদাহের নামে বিধবা রমনীদের চিতায় জ্বলতে হচেছ। বাংলার ইতিহাসে এটি এক কালো অধ্যায়। অথচ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সে নৃশংস বর্বরতাটি প্রশংসিত হয় বিধবার আত্মদান রূপে। সেটির প্রতি শ্রদ্ধাভরে এবং উৎসাহভরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

“জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ

পরান সপিবে বিধবা বালা।

জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন

জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা।”

সতিদাহ প্রথাকে আইন করে বিলুপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। বিধবা হিন্দু রমনীদের বাঁচানো নিয়ে কবিতা বা প্রবন্ধ না লিখলেও রবীন্দ্রনাথের নজর পরে তাদের গো’ দেবতা বাঁচানোর দিকে। তখন সে গো’ দেবতা বাঁচানোর মিশন নিয়ে ময়দানে নামেন শিবাজীর আরেক ভক্ত মহারাষ্ট্রের কট্টোর সাম্প্রদায়িক নেতা তিলক। তিনি ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “গোরক্ষিণী সভা”। গরু বাঁচাতে গিয়ে তখন ভারত জুড়ে শুরু হয় মুসলিম হত্যা। রবীন্দ্রনাথও তিলকের এ মিশনে একাত্ম হন এবং তাঁর নিজ জমিদারী এলাকায় গরু কোরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই হল, হিন্দু বাঙালীর রেনেসাঁ চেতনা। ঐতিহাসিক নীরদ চৌধুরী তাই লিখেছেন, “রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন একটি মাত্র সমন্বয় সাধনের, আর সে সমন্বয়টি হিন্দু ও ইউরোপীয় চিন্তাধারার। ইসলামী ভাবধারা ও ট্রাডিশন তাঁদের চেতনাবৃত্তকে কখনও্ স্পর্শ করেনি। -(সূত্র, Nirod Chandra Chowdhury, Autobiography of an Unknown Indian, p 196.)

ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পরও এদেশে ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি আরবী, ফারসী, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষার চর্চা ছিল। কিন্তু রাজা রামমোহন রায়ের মত বাঙালীদের সেটি পছন্দ হয়নি। তারা জোর দেয় আরবী ও ফার্সী বর্জনে এবং সরকারকে বলে ইংরেজী চর্চার উপর গুরুত্ব দিতে। রাজা রাম মোহন রায় যখন লন্ডন যান সেখানে গিয়েও সেটিই ব্রিটিশ সরকারকে বোঝান। অথচ ভারতীয় মুসলিমদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা ছিল আরবী ও ফারসী। মুসলিম নর-নারীদের উপর জ্ঞান শিক্ষা এ জন্য ফরয নয় যে -তা থেকে স্রেফ ব্যবসা-বাণিজ্যে ও চাকুরিতে সুবিধা হবে। বরং এ জন্য যে, শিক্ষার মাধ্যমে জীবন ও জগত নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্যটিকে জানার সুযোগ মিলবে। সুযোগ মিলবে মহান আল্লাহতায়ালার হিদায়েতের বাণীটি জানার। সুযোগ মিলবে ইসলামী সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠার। একমাত্র তখনই সে শিক্ষার মাধ্যমে মানব জীবনের সবচেয়ে বড় উপকারটি হয়। একজন মুসলিমের জীবনে শিক্ষার প্রয়োজন ও শিক্ষাবিষয়ক মূল দর্শনটির মোদ্দা কথা তো এটাই। সে প্রয়োজনটি না মিটলে সে শিক্ষালাভে মুসলিম মনে অনাগ্রহ জাগাটাই স্বাভাবিক। ব্রিটিশদের প্রণীত শিক্ষানীতিতে মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটানোর বিষয়টিকে পরিকল্পিত ভাবে বাদ দেয়া হয়। বরং গুরুত্ব পায় ব্রিটিশের কেরানী, সেপাই, ট্যাক্স কালেক্টর, ম্যাজিস্টেট তথা সদা অনুগত দাসসৃষ্টির বিষয়টি। ফলে শিক্ষানীতি হাতিয়ারে পরিনত হয় ব্রিটিশের কলাবোরেটর বা দালাল সৃষ্টির। তাই আত্মসন্মানবোধ সম্পন্ন কোন মুসলিম কি এমন শিক্ষায় আগ্রহী হতে পারে?

সত্য তো এটাই, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজীবাদীদের আগমন ভারতবাসীদের শিক্ষিত করার জন্য ঘটেনি। সে আগমন এদেশে বসবাসের লক্ষ্যেও ছিল না। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী বা ব্রিটিশ সরকার কোন খয়রাতি প্রতিষ্ঠানও ছিল না। তাদের দায়বদ্ধতা ছিল না ভারতবাসীর প্রতিও; সেটি ছিল কোম্পানীর ব্রিটিশ শেয়ার হোল্ডারদের প্রতি। ফলে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, বাণিজ্যের নামে অধিক শোষন ও লুন্ঠন। শোষণ ও লুন্ঠনের কাজটি তীব্রতর করার স্বার্থে তারা কোম্পানীর কাজকে শুধু ব্যবসার মধ্যে সীমিত রাখেনি। আত্মনিয়োগ করে নতুন নতুন রাজ্যজয় ও রাজ্যশাসনে। ফলে যে কোন সংজ্ঞায় তারা ছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শত্রু। সুশিক্ষা ও সুস্থ্য চেতনাধারী কোন মানুষই এরূপ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীর গোলামী মেনে নিতে পারে না। তাদের সেবকও হতে পারে। ইসলামে এটি হারাম। ফলে সুশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই তাদের শত্রু হবে ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হবে -সেটাই স্বাভাবিক। যে কোন সুস্থ্য মানুষের ন্যায় ইংরেজরাও এ সত্যটি বুঝতো। ইংরেজগণ তাই সুশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে নিজ শত্রুদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটাবে -সেটি কি বিশ্বাস করা যায়? শিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় শত্রুর সাম্রাজ্যবাদী দখলদারীকে মজবুত করার হাতিয়ার -তবে কোন স্বদেশপ্রেমিক কি তাতে শামিল হতে পারে? এখানেই হিন্দু-মানসের সাথে তৎকালীন মুসলিম-মানসের মূল পার্থক্য।

 

বাঙালী হিন্দুর গোলাম-মানস

হিন্দুরা ব্রিটিশদের শত্রু ভাবতো না, বরং ভাবতো ভগবানের প্রেরিত মূক্তিদাতা। সেটি ধরা পড়ে হিন্দুদের রচিত সাহিত্যে। বৃটিশ রাজাকে ‘জন-গণ-মনঅধিনায়ক, জয়ো হে’ বলে রবীন্দ্রনাথ স্তুতিমূলক কবিতা লিখেছেন। শরৎচন্দ্র তার “পথের দাবী” উপন্যাসে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেটি পছন্দ করেননি। নিন্দা জানিয়ে তিনি শরৎচন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন। লিখেছিলেন, “কল্যাণীয়েষু, তোমার পথের দাবী পড়া শেষ করেছি। বইখানি উত্তেজক। অর্থাৎ ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। …ইংরেজ রাজ ক্ষমা করবেন এই জোরের উপরেই ইংরেজ রাজকে আমরা নিন্দা করি এটাতে পৌরুষ নেই। আমি নানা দেশে ঘুরে এলুম। আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এই দেখলাম একমাত্র ইংরেজ গবর্নমেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আর কোন গভর্নমেন্ট এতটা ধৈর্য্যের সঙ্গে সহ্য করে না।– ইতি তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারিখ ৭/৩/১৩৩৩।  –(সূত্রঃ শ্রী শিশির কর)।

শরৎচন্দ্রের কাছে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের যে পোষমানা চেতনাটির প্রকাশ ঘটেছে -সেটি শুধু রবীন্দ্রনাথের একার ছিল না। এমন একটি উপলব্ধি ছিল সে আমলের অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দুদের। আর এখানেই কাঙ্খিত লক্ষ্য হাছিলে ব্রিটিশদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার বড় সাফল্য। শিক্ষার লক্ষ্য শুধু অক্ষরজ্ঞান, হিসাবজ্ঞান বা কারিগরিজ্ঞান নয়, বরং শিক্ষার মধ্য দিয়েই ধর্ম, চিন্তা-চেতনা, দর্শন, রাজনীতি¸ সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও রুচীবোধে আসে বিপ্লবী পরিবর্তন। এতে মন পায় সঠিক দিকনির্দেশনা। পায় বিবেক ও বিদ্যাবুদ্ধিকে কাজে লাগানোর সামর্থ্য। তখন ব্যক্তির মন পায় ন্যায়কে ভালবাসা ও অন্যায়কে ঘৃণা করার বল। এ সামর্থ্য সৃষ্টি না হলে বুঝতে হবে শিক্ষানীতি নিষ্ফল।

শিক্ষা শুধু সুশিক্ষার নয়, কুশিক্ষারও বাহন হতে পারে। ফিরাউন, নমরুদ, হিটলার, মুসোলিনির মত অতি দুর্বৃত্তদেরও একটি শিক্ষানীতি ছিল। আজকের সাম্রাজ্যবাদী দুর্বৃত্তদেরও আছে। ভারতে তেমনি ব্রিটিশ শাসকদেরও ছিল। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মিশনারিরা যেমন ছাত্রদের নিজ ধর্মে টানে, সাম্রাজ্যবাদীরা তেমনি গড়ে নিজেদের পক্ষে লাঠিধরার লোক। বস্তুত শিক্ষার মাধ্যমেবাঙালী হিন্দুগণ পরিণত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের লাঠিয়ালে। গোলাম-মানস নিয়ে তারা এতটাই বিপুল সংখ্যায় সে কাজে নেমেছিল যে, ১৯০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনে ইংরেজগণ নিজেরা নিজেদের শাসন বাঁচাতে লাঠি ধরার খুব একটা প্রয়োজন বোধ করেনি। বাঙালী হিন্দু বাবুগণই সেটি দক্ষতার সাথে করেছে।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ইংরেজী শিখেনি। এটি সত্য, অধিকাংশ মুসলমানই ইংরাজী শেখায় ও ইংরেজদের সহযোগিতায় এগুয়নি। তবে কারণটি সহজ। ঔপনিবেশিক আগ্রাসীদের সহযোগীতায় হাত বাড়ানো ইসলামে হারাম। যেমন হারাম মদ্যপান ও জ্বিনা। এটি শুধু মুসলিম রাজনীতিবিদদের কথা নয়, কোর’আন-হাদীসের কথাও। ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরজ। মুসলিম যেমন নামায-রোযার ন্যায় ইবাদত থেকে দূরে থাকতে পারে না, তেমনি দূরে থাকতে পারে না জ্ঞানার্জন থেকেও। বেঁচে থাকার জন্যই পানাহার ফরজ। তবে পানাহারের নামে যদি হারাম বস্তু সেবনের ব্যবস্থা হয় -তখন সেটি হারাম। তেমনি শিক্ষার বিষয়টিও। ব্রিটিশগণ শিক্ষার নামে সেটিরই ব্যবস্থা করেছিল। শিক্ষার লক্ষ্য ছিল, শত্রুশাসনের সেবাদাস বানানো। ভারতের মুসলিমদের, বিশেষ করে বাংলার মুসলিমদের সে শিক্ষা থেকে দূরে থাকার দূরে থাকার এটিই মূল কারণ। ফলে মুসলিমগণ তখন মসজিদ ও মাদ্রাসাকেন্দ্রীক বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

ব্রিটিশ প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে থাকার ফলে মুসলিমগণ চাকুরি-বাকুরি ও অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও তারা বেঁচেছিল ব্রিটিশের মানসিক গোলাম হওয়া থেকে। কতটা বেঁচেছিল তার উদাহরণ দেয়া যাক রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাজা রাজা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লৌহ খন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাদের জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষরূপে ইংরেজদের প্রতি। তাহাদের যথেষ্ট শাস্তিও হইয়াছিল। …কেহ কেহ বলিল মুসলমানদের বস্তিগুলো একেবারে উড়াইয়া পুড়াইয়া দেওয়া যাক…।” –রবীন্দ্রনাথ রচনাবলী, ১০ম খন্ড, পৃঃ ৪২৮-৪২৯।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা যে কোন সভ্য দেশেই প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সেদেশের শুধু শিক্ষিত লোকেরাই এ দুর্বৃত্তদের ঘৃনা করে না, ঘৃনা করে এমনকি নিরক্ষর মানুষেরাও। তাদের বিরুদ্ধে মিছিল, লড়াই -এমনকি অস্ত্র ধারনও জায়েজ মনে করে। মানব মনে এমন ঘৃনা ও এমন প্রতিরোধ গড়ে উঠার জন্য বড় মহাত্মা বা সাধক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সুস্থ্য মানুষের এটাই তো মানবিক গুণ। কোলকাতার রাস্তার যে মুসলিম ব্যক্তিটি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন সে ব্যক্তিটি রবীন্দ্রনাথের ন্যায় নোবেল বিজয়ী ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীও ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাস্তার মানুষ। কিন্তু বিবেকের যে মান সে নিরক্ষর ব্যক্তিটির মাঝে প্রকাশ পেয়েছিল -তা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রফেসর এবং বহু নোবেল বিজয়ীও দেখাতে পারেননি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃনা করার সে নৈতিক বল এমন কি রবীন্দ্রনাথ দেখাতে পারেননি। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ইতর বলেছেন। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত হয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের উকিল রূপে। তাঁর বই ব্যবহৃত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার দলিল রূপে। তাঁর লেখা “চার অধ্যায়” উপন্যাসটির শত শত কপি ব্রিটিশ সরকার তাঁর অনুমতি নিয়ে ভারতের বিভিন্ন জেলে রাজবন্দীদের মাঝে বিতরণ করেছে -যাতে তা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ব্রেইন ওয়াশ তথা মগজ ধোলাই করা যায়। (সূত্রঃ অরবিন্দ পোদ্দার)।

রেনেসাঁর নামে বাংলার হিন্দুদের মগজে যেটি প্রবল ভাবে দানা বাঁধে সেটি মুসলিম ভীতি ও ইংরেজদের প্রতি সেবাদাস মানসিকতা। তাদের ভয়ের কারণ, ইংরেজদের চলে যাওয়ার পর না জানি মুসলিমগণ আবার ভারতের শাসনকর্তায় পরিণত হয়। অতিরিক্ত ভয় অনেক সময় আত্মহত্যায় ধাবিত করে। ভীতু মন আঁধার রাতে দূরের আলোকে ভূতের আলো ভাবে। ভয়ে এমন ভীতু ব্যক্তি বাকশক্তি হারায়। একই অবস্থা বাঙালী হিন্দুর। এটিই তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সে ভয়ের কারণে ইংরেজ শাসনামলকে তারা নিজেদের অবকাঠামো মজবুত করার কাজে ব্যবহার করে। সেটি যেমন শিক্ষাদীক্ষায়, তেমনি রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও শিল্পে।  শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগতির সাথে সাথে বাড়তে থাকে তাদের মনবল ও আত্মবিশ্বাস।  সে সাথে বাড়ে মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃনা। তাদের মাঝে প্রবলতর হয় অখন্ড হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন এক কালে বঙ্কিম ও রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছিল সেটিই পরবর্তীতে হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজিপী) ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের নীতিতে পরিণত হয়। বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁ এ ভাবেই জন্ম দেয় ভারত জুড়ে হিন্দু জাগরণ।

অন্যরা না জানলেও বাঙালী হিন্দুগণ ভালই জানে প্রতিবেশী সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের তারা কতটা ঘৃনা, কতটা অবিশ্বাস ও কতটা ভয় করে। পাশের প্রতিবেশীকে অবিশ্বাস ও ভয়ানক শত্রু ভাবলে কেউ কি রাতে ঘুমাতে পারে? ঘুমাতে পারে না বলেই তারা ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা থেকে তারা পৃথক হয়ে যায়। এভাবে বাঙালী হিন্দুর রেনেসাঁর মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু সে রেনাসাঁ কালে যে ঘৃনা ও বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল সেটি মরিনি, বরং তা প্রকান্ড রূপে বেড়ে উঠেছে। এখন সেটি বিষময় ফল ফলাচ্ছে; এবং অবিরাম ভাবে। বাঙালী হিন্দুর সে মৃত রেনেসাঁর মূল সুরটি এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ভারত সরকারের আগ্রাসী নীতির মধ্যে। সেটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার। ফলে ১৯৪৮’য়ে কাশ্মিরে ভারতীয় আগ্রাসন ও জবরদখল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বার বার যুদ্ধ, একাত্তরের পর বাংলাদেশের উপর ২৫ সালা দাসচুক্তি –এগুলি বস্তুত সে অভিন্ন আধিপত্যবাদী স্ট্রাটেজীরই অংশ। ফলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর দেশটির সম্পদের অবাধ লুন্ঠন ও লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে ১৯৭৪’য়ে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে তাদের বিবেকে সামান্যতম দংশনও হয়নি। ভারত তখন লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীর জীবনে জঠর জ্বালা ও মৃত্যু উপহার দিয়েছিল। আর এখন সে বিষের ফলটি সীমান্ত ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া, উজানে পানি অপহরন, সমুদ্রসীমা ও তালপট্টি দখল, তিনবিঘা সহ সীমান্ত-ভূমি দখল এবং সীমান্তে লাগাতর মানুষ হত্যায় রূপ নিয়েছে। একটি জনগোষ্ঠীর অহংকারপূর্ণ অভিলাষ কিভাবে তার নিজের আত্মঘাত ও অন্যের বিরুদ্ধে নাশকতায় রূপ নেয় এ হল তার নমুনা।  লন্ডনঃ ১ম সংস্করণ ১২/০৩/১১; ২য় সংস্করণ ১৪/১১/২০২০

গ্রন্থপঞ্জিঃ

1). Bengal Legislative Council Proceedings (BLCP) 1941, Vol. LIV No 6, p 216.

২). তপন রায়চৌধুরী, ২০০৭; বাঙালনামা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯।

৩). শ্রী শিশির কর, নিষিদ্ধ বাংলা, পৃঃ ২৪,৩২, দরদী শরৎচন্দ্র, মনীন্দ্র চক্রবর্তী, শরৎচন্দ্রের টুকরো কথা, অবিনাশ চন্দ্র ঘোষ)।

৪). অরবিন্দ পোদ্দার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, উচ্চারণ, কোলকাতা, পৃঃ৩২০)।

৫). সৌমিত্র দস্তিদার, মুসলমানের কথা (ডকুমেন্টারী) Source: Youtube.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *