বিএনপি নেতাদের আওয়ামী বয়ান এবং ক্ষমতার ক্ষুধা

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

 বিএনপি’র আওয়ামীকরণ

খুনি হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলটির দর্শন, বয়ান ও রাজনীতি মারা যায়নি। রোগী মারা যায়, কিন্তু দুষ্ট জীবাণু সমাজে বেঁচে থাকে, তেমনি বেঁচে থাকে দুষ্ট রাজনৈতিক রীতি-নীতি ও দর্শন।  সে আওয়ামী জীবাণুগুলিকে এখন বেঁচে থাকতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি রাজনীতিতে। দলটি পরিণত হয়েছে ভারতের বি’টিমে।

২০২৪’য়ের ৬ আগস্টের বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুব লীগের গুন্ডারা চাঁদাবাজী, মাস্তানী, বাজার দখল ও সন্ত্রাসের যে স্থানগুলি ছেড়ে যেত বাধ্য হয়েছে -সে স্থান দ্রুত দখলে নিয়েছে বিএনপি, ছাত্র দল ও যুব দলের গুন্ডারা।  ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ আওয়ামী ফ্যাসিস্টগণ শুরু করেছিল, সে যুদ্ধটি এখন চালিয় যাচ্ছে বিএনপি। বিভিন্ন স্থানে তাদের দেখা যাচ্ছে ওয়াজের মহফিলে বাধা দিতে -যেমন হাসিনার আমলে বাধা দিত আওয়ামী ফ্যাসিস্টগণ।

এখন এটি সুস্পষ্ট যে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এখন আর বেঁচে নাই। দলটিতে জিয়াউর রহমানের দর্শন ও রাজনীতির কোন স্থান নাই। বরং দলটির কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে আরেক বিএনটি -যা পুরোপুরি অধিকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরা বাম ধারার উগ্র সেক্যুলারিস্ট রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাতে।

 

বাম-অধিকৃত বিএনপি

খালেদা জিয়া এখন পুরোপুরি অসুস্থ ও অক্ষম। তারেক জিয়ার বসবাসও বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার মাইল দূরে। গাড়ি চালাতে হলো গাড়ীর ড্রাইভিং সিটে বসতে হয়। তেমনি দল চালাতে হলে দেশে থাকতে হয়। ৫ হাজার মাইল থেকে সে কাজটি করা অসম্ভব। ফলে ইচ্ছা থাকলেও দলের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার সামর্থ্য খালেদ জিয়া ও তারেক জিয়ার -এ দুই জনের কারোই নাই। আর তাদের এ অক্ষমতা থেকে ফায়দা নিচ্ছে দখলদার বাম নেতারা। খালেদ জিয়া ও তারেক জিয়াসহ পুরা দলটি এখন বামদের হাতে জিম্মি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ন্যায় বামঅধিকৃত বিএনপির যুদ্ধটিও ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে।  

বামধারার এই সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জানে, বাংলাদেশের ইসলামপ্রেমী জনগণের মাঝে বাম ধারার রাজনীতির কোন স্থান নাই। তাই তারা পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের ক্ষমতালিপ্সুর রাজনীতির হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করছে বিএনপিকে। এক সময় ব্যবহার করেছের ভাষানীর ন্যাপকে। একই উদ্দেশ্যে বাম ধারার কাজী জাফরের ন্যায় অনেকে ঢুকেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। আবার মতিয়া চৌধুরীর ন্যায় বাম নেত্রীরা ঢুকেছিল আওয়ামী লীগে। শেষ দিকে সে আওয়ামী স্রোতে ভেসে যায় রাশেদ খান মেনন এবং আরো অনেকে। বাম ধারার নেতাকর্মীগণ যে আদতে পরগাছা -সেটি তারা বরাবরই প্রমাণ করেছে।  

বিএনপিতে স্থান পাওয়া এসব নেতাকর্মীদের অধিকাংশই ছাত্র জীবনে চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিল। ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ন্যায় এরাও একাত্তরের ভারতের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল এবং ভারতের প্রচুর নিমক খেয়েছিল। এজন্যই তাদের রাজনীতিতে দেখা যায় ভারতের প্রতি নিমকহালালীর প্রবনতা। তাই শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গা দেখে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতই ক্রন্দন শুরু হয় সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এবং বিএনপির বর্তমান মহাসচিব মীর্জা ফখরুলের হৃদয়ে। তাই আওয়ামী ঘরানার প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দীন চুপ্পুর অপসারণ করতে সে রাজী নন।

 

গাদ্দারী জিয়াউর রহমানের আদর্শের সাথে

জিয়াউর রহমান তার ভাষনে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” যোগ করেন। অথচ আজ কেউ বিএনপি’র কোন জনসভায় “আল্লাহু আকবর” বললে তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয় বা শোকজ করা হয়। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিলেন মুসলিম লীগসহ বহু মুসলিম চেতনাধারী রাজনৈতিক দল। সে সব পাকিস্তানপন্থী দলের বহু নেতাকর্মীদেরকে জিয়াউর রহমান বিএনপি’তে ডেকে আনেন এবং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। অনেককে তিনি এমপি পদেও মনোনয়ন দেন। তাদের নিয়েই বিএনপি মজবুত সংগঠনে পরিণত হয় এবং প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়। কিন্তু আজকের বিএনপি নেতাগণ একাত্তরের সেসব নেতাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বলে গালি দেয়। আওয়ামী লীগের বয়ান এভাবেই ধ্বনিত হচ্ছে বিএনপি নেতাদের মুখ থেকে। এটি হলো জিয়াউর রহমানের আদর্শে ও চেতনার সাথে বর্তমান নেতাদের সুস্পষ্ট গাদ্দারী।

কিছুদিন আগে বিএনপি নেতা সুলতান সালাউদ্দিন বলেছেন ” বিএনপিকে কেউ কোন দিন বলতে পারবে না যে বিএনপি রাজাকারের দল। স্বাধীনতা বিরোধী দল।” গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন “মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের ছবক শুনতে জাতি রাজি নয়।”একই ধরণের কথা বিএনপির আরেক শীর্ষ নেতা গোলাম কবির রিজভীর মুখে। দেশের রাজনীতির অঙ্গণের আনাচে কানাচে একই কথা বলে বেড়াচ্ছে বিএনপি ও ছাত্র দলের নেতাকর্মীরা ।

 

যেসব পাকিস্তানপন্থীরা জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে স্থান পেয়েছিলেন

১৯৭১’য়ে যারা পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করেছিলেন এবং শেখ মুজিব তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। ১৯৭৫’য়ের ১৫ আগস্ট মুজিবের শাসন বিলুপ্ত হওয়ার পর তারা মুক্তি পান। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে নিম্নের ব্যক্তিবর্গকে বিএনপি’তে স্থান দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়:

(১) শাহ আজিজুর রহমান (বাংলাদেশের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী)। ইনি ১৯৭১’য়ে জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরতে যান।   

(২) আবদুর রহমান বিশ্বাস (বাংলাদেশের ১১তম রাষ্ট্রপতি)।

(৩) মশিউর রহমান যিনি যাদু মিয়া নামে পরিচিত (প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় সিনিয়র মন্ত্রী)। 

(৪) মোশাররফ হোসেন শাহজাহান (পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ছিলেন)

(৫) আহসানুল হক মোল্লা যিনি পচা মোল্লা নামেও পরিচিত। (সাবেক ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী)

(৬) চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ( সাবেক খাদ্যে ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় মন্ত্রী) 

(৭) চৌধুরী আকমল ইবনে ইউসুফ (ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ)

(৮) আবদুল মোমিন তালুকদার খোকা (বগুড়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক) 

(৯) কাজী ফারুক কাদের  (নীলফামারী-৩ প্রাক্তন সংসদ সদস্য সাবেক)

(১০) মির্জা রুহুল আমিন (প্রাক্তন মন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-২-এর অঞ্চলের সাবেক সংসদীয় প্রতিনিধি)

(১১) ড. ওসমান ফারুক (বাংলাদেশের সাবেক প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী) 

(১২) আব্দলু আলিম (জয়পুরহাট-১ এর সাবেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী)

(১৩) মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, যিনি নবী চৌধুরী নামেও পরিচিত (চট্টগ্রামের ডবলমুরিং-সীতাকুন্ড থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে গণ-যোগাযোগ মন্ত্রী এর পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন)

(১৪) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যিনি সাকা চৌধুরী নামেও পরিচিত (জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-২, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-৭ আসন থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য)।

 

বিএনপি’র বর্তমান ইতিহাসটি গাদ্দারীর

প্রশ্ন হলো, বিএনপির নেতাগণ কি ইতিহাস পড়ে না? তারা কি বিএনপির জন্মের ইতিহাস জানে না? যদি তারা বিএনপির সঠিক ইতিহাস জানতো তবে একাত্তরের যারা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাদেরকে কখনোই গালি দিত না। তাদেরকে কখনও স্বাধীনতার শত্রু বলতো না। প্রশ্ন হলো, উপরিউক্ত পাকিস্তানপন্থী নেতাদের দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা কি কখনো বিপদে পড়েছে?

জিয়াউর রহমানের আদর্শের প্রতি বর্তমান বিএনপি নেতাদের যদি সামন্যতম ভক্তি থাকতো তবে যাদেরকে তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে সম্মানিত করেছিলেন -তারাও তাদের প্রতি সম্মান দেখাতো। এবং আগামীতেও সে ধারাকে তারা অব্যাহত রাখতো। কিন্তু সে আদর্শ থেকে তারা দূরে সরেছে। এথেকে বুঝা যায়, তারা কতটা দূরে সরেছে জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও রাজনীতি থেকে। প্রশ্ন হলো, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও দর্শনের সাথে যারা এরূপ গাদ্দারী করতে পারে, তারা যে দেশের সাথে গাদ্দারী করবে না -তার নিশ্চয়তা কোথায়? ১৬/০৩/২০২৫

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *