বিপ্লবের পথ ও পতনের পথ

                                                                           

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

বিপ্লবের শুরু দর্শন থেকে

প্রতিটি বিপ্লবের জন্ম দর্শন থেকে। যেখানে দর্শন নাই, সেখানে বিপ্লবও নাই। সে বিপ্লব সুফল দিবে, না কুফল দিবে -সেটি নির্ভর করে দর্শনের গুণাগুণের উপর। চোরডাকাত, ভোটডাকাত, দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদেরও দর্শন থাকে। সেটি অপদর্শন। ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে যদি সে বিপ্লবের ভিত্তি হয় কম্যুনিজম, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় ভ্রষ্ট, বিষাক্ত ও অসত্য মতবাদ। তাই কোন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির জীবনে বিপ্লব আনতে হলে প্রথমে চিন্তার মডেল তথা দর্শনে বিপ্লব আনতে হয়। দর্শন পাল্টে গেলে ব্যক্তির কর্ম, চরিত্র, আচরণও পাল্টে যায়। তখন পাল্টে যায় জীবনের ভিশন ও মিশন। এবং পাল্টে যায় রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি। তখন নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মিত হয়। সমাজ বিজ্ঞানে একেই বলা হয় প্যারাডাইম শিফট।

তাই দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি বদলাতে হলে জনগণের চেতনার ভূবনে হাত দিতে হয়। বদলাতে হয় বিরাজমান বিশ্বাসকে। সে বিশ্বাসটি শুধু কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান ও নানারূপ পেশাদারীর বিষয় নিয়ে হলে চলে না, সেটিকে হতে হয় আমরা কেন বাঁচবো, কিভাবে বাঁচবো, সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাণই বা কিরূপে সম্ভব -জীবনের এরূপ অতি মৌলিক বিষয়গুলি নিয়ে। প্রশ্ন হলো দর্শন বলতে আমরা কি বুঝি? দর্শনের গুরুত্বই বা কি? দর্শন তাই যা মানুষকে কোন কিছুকে দেখতে, তা নিয়ে ভাবতে ও তার ভাল-মন্দ যাচাইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য জুগায়। দর্শনের ভিন্নতার কারণে মানুষ একই বিষয় একই ভাবে দেখে না। চোর-ডাকাতের দর্শনে চুরিডাকাতি অপরাধ নয়। ধর্ষকের দর্শনে ধর্ষণও অপরাধ নয়। তেমন স্বৈরাচারী শাসকের অসুস্থ দর্শনে জুলুম-নির্যাতন, ভোটডাকাতি ও মানবের মৌলিক অধিকার হরন কোন অপরাধ নয়। অপরাধ নয় গণহত্যার নৃংশসতা। 

দর্শনের গুরুত্ব এজন্যই অপরিসীম। দর্শনের গুণেই মানুষ পশু থেকে ভিন্নতর ও শ্রেষ্ঠতর হয়। এবং ঈমানদারগণ ভিন্নতর হয় বেঈমান কাফিরদের থেকে।  পশুর দর্শন থাকে না বলেই সে পশু। দর্শন থেকেই মানুষ পায় তাঁর জীবনের এজেন্ডা এবং বাঁচার মিশন ও ভিশন। হাতি কে হাতি রূপে এবং গরুকে গরু রূপে চেনার জন্য চাই চোখের সামর্থ্য। কিন্তু সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা, ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় রূপে জানার জন্য চাই মনের সামর্থ্য। মনের সে সামর্থ্যই হলো দর্শন। চোখের সামর্থ্য মানুষ জন্মসূত্রে পায়। সে সামর্থ্য পশুদেরও থাকে। কিন্তু দর্শনের সামর্থ্য ব্যক্তিকে নিজে অর্জন করতে হয়। সেটি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে। জ্ঞান নির্ভূল হলে দর্শনও নির্ভূল হয়। ঈমানদার সে নির্ভূল দর্শনটি পায় পবিত্র কুর’আন থেকে। কারণ, পবিত্র কুর’আনে হলো মহান আল্লাহপ্রদত্ত নির্ভূল জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার। এটি হলো সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। কুর’আন লব্ধ সে দর্শনের কারণেই সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ঈমানদারের বিচার সঠিক হয়।

 

সুস্থ দর্শনের কল্যাণ এবং অসুস্থ দর্শনের নাশকতা

অসত্য, অসভ্য ও বিষাক্ত মতবাদ দিয়ে কখনোই সুস্থ, সভ্য ও সুশীল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মিত হয়না। তাতে বরং শুরু হয় বর্ণগত, ধর্মগত ও জাতিগত নির্মূলের নৃশংসতা। এবং সংঘটিত হয় রক্তাক্ত যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও বিশ্বযুদ্ধ।  বিষাক্ত দর্শনের কারণে একমাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধেই প্রাণ হারিয়েছে ৮কোটির বেশী মানুষ এবং বিধ্বস্ত হয়েছে শত শত নগর-বন্দর। আর এসবই হয়েছে দর্শনের দূষণে। সঠিক দর্শন চারিত্রিক বিপ্লব আনে, মিথ্যা দর্শন আনে বিপর্যয়। এবং সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি হলো জাহান্নামে পৌঁছার।  এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর লক্ষাধিক নবী-রাসূলগণকে এ পৃথিবীতে কৃষি, শিল্প বা বিজ্ঞান শেখাতে পাঠাননি; তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণটি করতে। সেটি ছিল, অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়া এবং তাদের চিন্তার মডেলে তথা দর্শনে পরিশুদ্ধি আনা। সর্বোপরি মানব সন্তানকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বাস্তবায়নে তাঁর সৈনিক এবং জান্নাতের উপযোগী করে গড়ে তোলা।

ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ি জোড়া যায়না, তেমনি চেতনা ও দর্শনের পরিশুদ্ধির আগে চরিত্র ও কর্মে‌ পরিশুদ্ধি আনা যায়না। চেতনা রাজ্যে পরিশুদ্ধির পথ ধরেই নবীজী (সা:) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়তে পেরেছিলেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ার কাজটিও তিনিই শুরু করেছিলেন।  নবীজী (সা:)’র সে অভূতপূর্ব সাফল্যের মূলে কোন স্বর্ণখনির আবিষ্কার, কৃষি বিপ্লব, অর্থনৈতিক বিপ্লব ও উন্নত প্রযুক্তি ছিলনা, সেটি ছিল দর্শনের বিপ্লব। এবং সে দর্শনের আবিষ্কারক নবীজী (সা:) নিজে ছিলেন না। সে বিশুদ্ধ দর্শনটি তিনি পেয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কুর’আন থেকে -যা এসেছিল সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত রূপে। এ কিতাব শুধু শ্রেষ্ঠ মানব গড়ার রোডম্যাপ নয়, ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার গড়ার রোডম্যাপও। সে রোডম্যাপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে গৌরব যুগের মুসলিমদের হাতে।  আবিষ্কার

বিশুদ্ধ দর্শনটি খুঁজে পাওয়াই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একাজ নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ। দূষণমূক্ত পানাহার ছাড়া যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি দূষণমুক্ত দর্শন ছাড়া বিবেক বাঁচে না। একাজে ব্যর্থতা মানব জীবনে ভয়ানক ব্যর্থতা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। জন্ম থেকেই যে ব্যক্তি অন্ধ -সে হাতি ও গরুর ন্যায় জীবজন্তুর চেহারা নিয়ে কেবল কল্পনাই করতে পারে। সেগুলি নিয়ে কখনোই সঠিক ধারণা পায়না। তেমনি অজ্ঞ ব্যক্তিও ব্যর্থ হয় সত্য, মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়কে চিনতে। ধর্মের নামে গরু, সাপ, মুর্তি, পাহাড়-পর্বত পূজনীয় হয় তো মিথ্যা দর্শনের কারণে। তেমনি মিথ্যা দর্শনের কারণে ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ন্যায় অসভ্য, নৃশংস ও বিষাক্ত মতবাদগুলিও এ পৃথিবী পৃষ্ঠে কোটি কোটি অনুসারী পায়। দর্শনের ভিন্নতার কারণেই একই দেশ ও একই জলবায়ুতে বসবাস করেও মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচারবোধ ও মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠে। তাই একজন সেক্যুলারিস্ট বাঙালির কাছে নারী-পুরুষের বিবাহাহীন যৌন সম্ভোগ প্রেম রূপে নন্দিত হয়। অথচ সেরূপ জ্বিনা একজন ঈমানদার বাঙালির কাছে শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ গণ্য হয়। বিবাহিত হলে সে জ্বিনার শাস্তি প্রস্তারাঘাতে হত্যা, অবিবাহিত হলে ৮০টি বেত্রাঘাত। একজন সেক্যুলারিস্টের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার লড়াই গণ্য হয় সন্ত্রাস রূপে। অথচ একজন ঈমানদারের কাছে সেটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। বাঙালি সেক্যুলারিস্টের কাছে  পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিমদেশকে ভাঙ্গা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের পদতলে সঁপে দেয়াটি গর্বের মুক্তিযুদ্ধ। তাদের হাতে নৃশংস ভাবে লাশ হতে হয় আবরার ফাহাদের ন্যায় বিদেশী আধিপত্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিকদের। এবং ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ও কারাগারে নির্যাতিত হয় ইসলামপন্থীদের। এসবই হলো বিষাক্ত দর্শন সমূহের নাশকতা। দর্শনের এমন দূষণে ইসলামী ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচা ও ঈমানদার হওয়া অসম্ভব হয়।          

 

যে বিপ্লবটি অনিবার্য হয় আখেরাতের ভয়ে

দেশবাসীর কল্যাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, গার্মেন্ট রপ্তানী ও মানব রপ্তানী নয়। বরং সেটি হলো জনগণের দর্শনের সুস্থতা সাধন। নইলে কখনোই সভ্য, বিবেকবান ও সৃষ্টিশীল মানব নির্মাণের কাজটি হয়না। তখন মারা পড়ে মানবতা, বিবেকবোধ ও ঈমান। তখন দেশ দুর্বৃত্তিতে বার বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়। অতিশয় অপমানের বিষয় হলো, বাংলাদেশ সেরূপ বিশ্বচ্যাম্পিয়ান অতীতে ৫ বার হয়েছে। তাই মহান নবীজী (সা:) তাঁর মিশন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দিয়ে শুরু করেননি। শুরু করেছিলেন মানুষের চেতনা বা দর্শনে পরিশুদ্ধি ও বিপ্লব আনার মধ্য দিয়ে। নবীজী (সা:)’র আমলেও আরবের পৌত্তলিকগণ আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করতো। এমনকি নিজ সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ তথা আল্লাহর গোলাম রাখতো। কিন্তু তারা আখেরাতকে বিশ্বাস করতো না। তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে, মাটিতে মিশে যাওয়া হাড্ডি-মাংসকে আবার পুনর্জীবিত করা হবে। তাদের সকল জীবন-সাধনা ছিল স্রেফ পার্থিব জীবনকে সফল করা নিয়ে। এমন ইহজাগতিক বিশ্বাসকেই বলা নিরেট সেক্যুলারিস্ট দর্শন। কিন্তু নবীজী (সা:) তাদের সে বিশ্বাসে আমূল বিপ্লব আনেন। প্রতিষ্ঠা দেন আখেরাতের ধারণা। আখেরাতের অর্থ মৃত্যুর পর আবার পুনরুত্থান, রোজ-হাশরের বিচার দিনে আল্লাহতায়ালার সামনে নিজ কর্মের জবাবদেহীতা এবং বিচার শেষে  অনন্ত-অসীম কালের জন্য অফুরন্ত নিয়ামত ভরা জান্নাত অথবা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পৌঁছা। কাফির ও মুনাফিকদের জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ; সেখানে একমাত্র তারাই যাবে যারা ঈমান, আমল ও আল্লাহতায়ালার পথে নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগে অর্জন করবে মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও মাগফিরাত।  যরা অবিশ্বাসী কাফির এবং যাদের বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নামে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।  

মুসলিমদের চরিত্র, আচরণ ও কর্মে অভূতপূর্ব বিপ্লবের মূল কারণ, আখেরাতের উপর বিশ্বাস। তখন ঈমানদারের প্রতিদিনের ও প্রতিক্ষণের তাড়না হয় মহান আল্লাহতায়ালার মাগফিরাত লাভে কি করে নিজেকে যোগ্যতর করা যায় -তা নিয়ে। তখন তাঁর মনে বিন্দু মাত্র সন্দেহ থাকে না যে, জান্নাত লাভে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ নিজেকে নিশ্চিত ভাবে জাহান্নামে নেয়া। তখন এ জীবনে বাঁচাটাই ভয়ানক আযাবের কারণ হয়। সে ভয়ানক আযাব থেকে বাঁচতেই ঈমানদারের জীবনে প্রতিক্ষণের তাড়াহুড়া ও প্রতিযোগিতা থাকে শুধু নেক আমলে এবং পাপ থেকে বাঁচায়। সেরূপ এক তাড়াহুড়া নিয়ে বাঁচার নির্দেশ এসেছে সুরা আল ইমরানের ১৩৩ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

۞ وَسَارِعُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا ٱلسَّمَـٰوَٰتُ وَٱلْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ

অর্থ: “এবং তাড়াহুড়া করো তোমাদের রব থেকে মাগফিরাত লাভে এবং জান্নাত লাভে যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের সমান -যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীনদের জন্য?” 

মাগফিরাত লাভে এবং জান্নাত লাভে প্রতিযোগিতার হুকুম এসেছে সুরা হাদীদের ২১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

سَابِقُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلْفَضْلِ ٱلْعَظِيمِ

অর্থ: “তোমরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও তোমাদের রব থেক মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের জন্য -যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের প্রশস্ততা সমান, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে তাদের জন্য যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। এটিই হলো আল্লাহর রহমত  -যা তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। এবং তিনিই সামর্থ্য রাখেন বিশাল অনুগ্রহের।” 

পরকালে অবিশ্বাসী কাফিরদের সকল প্রতিযোগিতার লক্ষ্য, স্রেফ এ দুনিয়ায় সফল হওয়া। পরকালের সাফল্য নিয়ে তারা ভাবে না। কিন্তু সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ঈমানদার বান্দাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করতে চান। এবং কিরূপে অর্জিত হতে পারে সে সবচেয়ে বড় কল্যাণটি -সে কথটিও তিনি বাতলিয়ে দিয়েছেন উপরিউক্ত আয়াতে। সেটি মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতা। যারা বাঁচে সে প্রতিযোগতিা নিয়ে একমাত্র তারাই এ জীবনে সফল হয়। প্রতিযোগিতাটি এখানে বেশী বেশী নেক আমলের এবং পাপচার থেকে বাঁচার। এজন্যই যে রাষ্ট্রে প্রকৃত ঈমানদারদের বসবাস -সে রাষ্ট্রে নেক আমলের জোয়ার আসতে বাধ্য। এরূপ রাষ্ট্রে পাপাচার বা দুর্বৃত্তি রোধে হাজার হাজার পুলিশ লাগে না। কারণ, ঈমানদার ব্যক্তিগণ নিজেরাই নিজেদের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে পুলিশে পরিণত হয়।

তাছাড়া প্রতিটি নেক আমলই তো অর্থনৈতিক কর্ম। দর্শনে মিথ্যার দূষণ বিলুপ্ত হওয়াতে বাড়ে সততা ও সৎ কর্মে আগ্রহ এবং শুরু হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ। তখন নির্মিত হয় social capital তথা সামাজিক পুঁজি। সে সামাজিক পুঁজির বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দুর্বৃত্তদের থেকে পুঁজি তখন নিরাপত্তা পায়। এর ফলে সমৃদ্ধি আসে অর্থনীতিতে। মহান নবীজী (সা:) ও খোলাফায়ে রাশেদার আমলে তো সেটিই হয়েছিল। অপর দিকে যে রাষ্ট্রে জোয়ারটি গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের -সেখানে ঘটে উল্টোটি। তখন বিপদের মুখে পড়ে পুঁজি বিনিয়োগ। বিনিয়োগের উপর তখন থাবা পড়ে দুর্বত্তদের। ফলে আসে অর্থনৈতিক ধ্বস। যে দেশে জোয়ারটি দুর্বৃত্তির, বুঝতে হবে সে দেশের মানুষ আখেরাতের ভয় নিয়ে বসবাস করে না। মুসলিম রূপে পরিচয় দিলেও তারা আসলে বেঈমান। জনগণকে ধোকা দেয়ার লক্ষ্যে তারা ঈমানদার সাজার অভিনয় করে মাত্র। তারা জাহিলী যুগের আরবদের ন্যায় সেক্যুলারিষ্ট।  জাহিলী আরব সেক্যুলারিষ্টগণ নিজেদের পার্থিব জীবনকে আনন্দময় করতে নিজেদের কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিত। এরাও নিজেদের দুর্বৃত্তি বাঁচাতে ঈমাদারদের ফাঁসি দেয়, বিরোধীদের কারাবন্দী করে, নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যা চালায়। এসবেরই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ।     

নবীজী (সা:) ঈমানদারদের চেতনায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন যেমন মহান আল্লাহতায়ালার উপর অটল বিশ্বাস, তেমনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন জান্নাত ও জাহান্নামের উপর বিশ্বাস। প্রবলতর করেছিলেন রোজ হাশরে জবাবদেহীতার ভয়। তবে কারা জাহান্নামের ভয় নিয়ে বাঁচে সেটি কখনো গোপন থাকে না। সত্যিকারের ঈমানদারের জীবনে সেটি খালি চোখেও দেখা যায়। সেটি ধর্মব্যবসায়ীর দাড়ি-টুপি, পাগড়ি. আল-খেল্লা ও ওয়াজের অভিনয়ে মাঝে ধরা পড়ে না। সেটি নিখুঁত ভাবে দেখা যায় আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয়ে ঈমানদারের নিজ অর্থ, নিজ শ্রম, নিজ মেধা ও নিজ রক্তের বিনিয়োগ দেখে। সত্যিকার ঈমানদারের জীবনে ধর্মের নামে অর্থ-উপার্জনের নেশা থাকে না. বরং থাকে ত্যাগের নেশা। থাকে দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগের নেশা। এরা তাই জিহাদে হাজির হয় নিজ অর্থ, নিজ অস্ত্র, নিজ ঘোড়া ও নিজের সর্ব সামর্থ্য নিয়ে। এরা তাই ওয়াজ করে, জানাজা পড়িয়ে, দোয়া করে, আযান দিয়ে বা ইমামতি করে অর্থ নেয় না -যেমনটি নেননি নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। উপার্জনের জন্য তারা অন্য পেশা বেছে নেন, কখনোই সে উপার্জন ধর্ম ও ধর্মীয় অঙ্গণে নয়। বরং দ্বীনের প্রচারে এরা নিজ গৃহ ছেড়ে পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, বনভূমি, নদী-সাগর পাড়ি দিয়ে ভিন দেশের এক অপরিচিত পরিবেশ গিয়ে ঘর বাঁধে। তারা এসবই করে মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভ ও মাগফিরাত লাভের লক্ষ্যে। তারা সকল কষ্ট সয়ে যায় এবং ছবর করে স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার তাড়নায়। মুসলিমদের গৌরব যুগে ইসলামের যে বিশ্বজুড়ে প্রসার -সেটি তো তাদের জন্যই। 

 

ধর্মব্যবসায়ীদের নাশকতা                                                                                                                               স

ধর্ম প্রচারের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা পেলে তাতে মানুষের ঈমান বাড়ে না। তখন ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা ও শ্রোতা বাড়লেও নেক আমল বাড়ে না। তখন বিরাজমান পাপের প্লাবনে সামান্যতম কমতিও আসে না; বরং দিন দিন তা বৃদ্ধি পায়। তাতে বাড়ে ধর্মব্যবসায়ীদের উপার্জন। নবীজী (সা:) ওয়াজ করতে গিয়ে পাথর খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন, অথচ ধর্মব্যবসায়ীগণ কুর’আনের আয়াত ও নিজেদের ওয়াজকে বিক্রি করে অর্থ কামাই করে। অর্থের প্রয়োজন কার না আছে? কিন্তু অর্থের সে প্রয়োজন মেটাতে অতি দরিদ্র সাহাবাগণ অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু কখনোই তারা ওয়াজ করে, জানাযা পড়িয়ে, দোয়া করে, ইমামতি করে বা আযান দিয়ে অর্থ নেননি। এগুলি তো ইবাদত; ইবাদতে কি অর্থ নেয়া যায়? কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী, তাদের তাড়নাটি ইবাদতে নয়, বরং অর্থ লাভে।  ধর্মব্যবসায়ী বনি ইসরাইলী আলেমদের কদর্য চিত্রটি মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে তুলে ধরেছেন। তারা তাওরাতের আয়াত বিক্রি করে খেত। সুরা জুম্মাতে তাদেরকে ভারবাহী গাধা বলেছেন। গাধাগণ ভার বহন করতে পারে, কিন্তু পিঠের উপর জ্ঞানগর্ভ কিতাব থাকলেও তা নিয়ে ভাবতে পারে না। বনি ইসরাইলীরা ইসলামের ব্যর্থ ছাত্র। বনি ইসরাইলী আলেমদের কদর্য চিত্রটি পবিত্র কুর’আনে তুলে ধরার অর্থ, মুসলিম আলেমগণ যেন সে পথ না ধরে। কিন্তু তাদের থেকে শিক্ষা নেয়ার কাজটি হয়নি; ফলে সে রোগের বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে।

শ্রোতাদের দর্শন পাল্টাতে এবং তাদের  চরিত্র নির্মাণে ওয়াজের চেয়ে বক্তার আমল অধিক শক্তিশালী। নবীজী (সা:)কে তাই ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়াজ করতে হয়নি। তাঁর আমল কথা বলতো। তাই নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের দ্বীনের দাওয়াত ছিল আমল নির্ভর, ওয়াজ নির্ভর নয়। ওয়াজ মুসলিম জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। এ জিহাদের মূল অস্ত্রটি হলো পবিত্র কুর’আন। তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো: “জাহিদু বিহি জিহাদান কবিরা।” অর্থ: এই কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো। তাই নবীজী (সা:) তাঁর ওয়াজ করতেন পবিত্র কুর’আনের আয়াত দিয়ে। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী তারা তাদের ওয়াজে কুর’আনে আয়াতের চেয়ে নিজেদের বক্তব্যকে বেশী গুরুত্ব দেন। থাকে মঞ্চে অভিনয়ের নেশা। গুরুত্ব দেন ভিত্তিহীন কিচ্ছা-কাহিনীকে। অথচ কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার ওয়াজের চেয়ে উত্তম ওয়াজ আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের সে ওয়াজকে সুরা আল ইমরানের ১৩৮ নম্বর আয়াতে “মাও’য়েজাতুল হাসানা” অর্থাৎ “উত্তম ওয়াজ” বলে অভিহিত করেছেন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীদের থাকে অভিনয়ের নেশা।

নাটকের মঞ্চে যারা অভিনেতা, অন্যদের থেকে ভিন্নতর হয় তাদের সাজগোজ ও পোষাক-পরিচ্ছদ। অথচ নবীজী (সা:)কে যারা কোন দিন দেখেনি তাঁরা মদিনায় মসজিদে নববীতে গিয়ে সেখানে সাধারণ মুসল্লিদের মাঝে বসে থাকা নবীজী (সা:)কে চিনতে সমস্যায় পড়তেন। তাঁকে চিনতে অন্যদের জিজ্ঞাসা করতে হতো। কারণ, নবীজী (সা:)’র পোষাক-পরিচ্ছদ ছিল অন্যদের মতই অতি সাধারণ। এমনকি বাংলাদেশের চেয়ে ৬০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের খলিফাকে চিনতেও বিদেশীরা সমস্যায় পড়তো। খলিফা উমর (রা:) যখন মদিনা থেকে জেরুজালেমে পৌঁছান তখন স্থানীয় খৃষ্টানগণ উঠের পিঠে আসীন সঙ্গি কর্মচারিকে খলিফা মনে করে। কিন্তু সেরূপ ভূল বাংলাদেশে হয়না। কারণ, যারা ওয়াজের জগতে অভিনেতা -তাকে হাজার হাজার মানুষের মাঝেও সহজে চেনা যায়। সেটি তার পোষাকের অসাধারণ সাজগোজ ও চাকচিক্য দেখে। তার বিশেষ ঢংয়ের টুপি, পাগড়ি, জুব্বা দেখে। তিনি জলসায় নিজেকে হাজির করেন অনন্য রূপে।  

অভিনয়ের মাধ্যমেই এসব ধর্মব্যবসায়ীগণ শ্রোতাদের ঘন্টার পর ঘন্টা মাতিয়ে রাখে। কোন আলেম শ্রোতাদের কতটা মাতিয়ে রাখতে পারলো -তা দিয়ে তার ওয়াজের মুজুরি ধার্য হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর যত ওয়াজ মাহফিল হয় -তা বিশ্বের আর কোন দেশে হয়না। সেসব জলসায় হাজির হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ । বাংলাদেশে এক মাসে যত ওয়াজ মাহফিল হয় এবং যত মানুষ ওয়াজ শুনে -নবীজী (সা:) তাঁর ২৩ বছরের নবুয়তী জীবনে এতো ওয়াজ করেননি এবং এতো শ্রোতাও তিনি পাননি। প্রতিটি ওয়াজ হয় বহু ঘন্টা ধরে। কোন কোন ওয়াজ চলে প্রায় সারা রাত ধরে। বাংলাদেশে তাবলিগ জামায়াতের ওয়াজে হাজির হয় ২০ লাখের বেশী মুসল্লি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা ওয়াজ করে এবং যারা সে ওয়াজ শুনে -কতটা বাড়ে তাদের ঈমানদারী? সে ওয়াজ শুনে লক্ষ লক্ষ শ্রোতাদের মাঝে ঈমানদারী বাড়লে তো দেশে নেক আমলের জোয়ার দেখা যেত। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবল জোয়ার এসেছে পাপাচারের। বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেশে যত বেশী ওয়াজ হচ্ছে, ততই বাড়ছে দুর্নীতি।  

 

আখেরাতে ভয়: বিপ্লবকে যা অনিবার্য করে 

কুর’আনী দর্শনের মূলে হলো আখেরাতে জবাবদেহীতার ভয়। সেটি জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল দগ্ধিভুত হওয়ার ভয়। এ ভয় ব্যক্তির প্রতি দিনের ভাবনা, চরিত্র, কর্ম, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিতে বিপ্লব অনিবার্য করে তোলে। তখন সে একটি নির্ভূল ভিশন ও  মিশন পায়। তখন সে শুধু বাঁচার জন্য বাঁচে না। বরং বাঁচে সে ভিশন ও মিশনকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে। আখেরাতের এ ভয় ব্যক্তিকে পদে পদে সতর্ক থাকতে ও ভাবতে শেখায়। নবীজী (সা:)’‌র আমলে আরবের জনগণ মহান আল্লাহতায়ালাকে অবিশ্বাস করতো -বিষয়টি তা নয়। বরং আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বকে তারা শুধু বিশ্বাসই করতো না, প্রবল বিশ্বাস নিয়ে সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান রাখতো। কিন্তু তাদের মূল সমস্যাটি ছিল অন্যত্র। তারা বিশ্বাস করতো না মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে এবং রোজ হাশরের বিচার দিনে জবাবদেহীতাকে।  তারা বিশ্বাস করতো না জান্নাত ও জাহান্নামকে। নবীজী (সা:)’‌র যুগে পরকালে পুনরুত্থান নিয়ে আরব কাফিরগণ কি ভাবতো -ইতিহাস থেকে তাদের সে ভাবনা হারিয়ে যায়নি। মহান আল্লাহতায়ালা তাদের বক্তব্যগুলিকে রেকর্ড করে রেখেছেন পবিত্র কুর’আনে। তারই নমুনা হলো:

‍بَلْ عَجِبُوٓا۟ أَن جَآءَهُم مُّنذِرٌۭ مِّنْهُمْ فَقَالَ ٱلْكَـٰفِرُونَ هَـٰذَا شَىْءٌ عَجِيبٌ ٢          

أَءِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًۭا ۖ ذَٰلِكَ رَجْعٌۢ بَعِيدٌۭ ٣

অর্থ: “বরং তারা বিস্মিত হলো যখন তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন সতর্ককারী এলো (এবং মৃত্যুর পর আবার পুনরুত্থানের কথা শোনালো); (সে কথা শুনে) তারা বললো, “এটি তো বড়ই আশ্চর্য বিষয়‍! আমরা যখন মারা যাবো এবং পরিণত হবো মৃত্তিকায়, আমরা কি আবার পুনরুত্থিত হবো? (তারা আরো বললো) সুদূর পরাহত সে প্রত্যাবর্তন।” –(সুরা ক্বাফ, আয়াত ২-৩)। তারা আরো বলতো:

وَكَانُوا۟ يَقُولُونَ أَئِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًۭا وَعِظَـٰمًا أَءِنَّا لَمَبْعُوثُونَ ٤٧

أَوَءَابَآؤُنَا ٱلْأَوَّلُونَ ٤٨

অর্থ: “এবং তারা বলতো, আমরা যখন মারা যাবো এবং পরিণত হবো মৃত্তিকায় ও অস্থিতে, এরপরও কি আমরা আবার উত্থিত হবো তথা জীবিত হবো? (পুনরুত্থিত হবে কি) এমন কি আমাদের পূর্বপুরুষগণও?” –(সুরা ওয়াকেয়া, আয়াত ৪৭-৪৮)। 

আখেরাতের উপর বিশ্বাস না থাকায় তাদের সকল চেষ্টা ও সামর্থ্য ব্যয় হতো একমাত্র দুনিয়াবী জীবনকে আনন্দময় করতে। তখন তাদের সকল কর্ম, রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালিত হতো নিরেট স্বার্থপরতা থেকে। সে স্বার্থপরতার কারণে এমন কি নিজ সন্তানও তাদের কাছে আপদ ও শত্রু মনে হতো। তারা ভাবতো, সন্তানেরা তাদের ভোগের আয়োজনে ভাগ বসাবে। তেমন এক স্বার্থপর ভাবনার কারণেই আরবের মানুষদের মাঝে কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফন করার রেওয়াজ ছিল। এ দিক দিয়ে তারা ছিল নিরেট সেক্যুলার তথা ইহজাগতিক। তাদের সে সেক্যুলার চেতনার অন্ধকার ভূমিতে নবীজী (সা:) এক আমূল বিপ্লব আনেন। তাঁর জীবনের প্রথম জিহাদটি ছিল জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে। সে জিহাদে নবীজী (সা:) হাতিয়ার রূপে বেছে নেন পবিত্র কুর’আনকে।

মহান আল্লাহতায়ালা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে এ কুর’আনী জ্ঞানের জিহাদকে “জিহাদান কবিরা” বলেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে এ জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এ জিহাদে অবশ্যই বিজয়ী হতে হয়। নইলে ব্যর্থতা অনিবার্য। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে নবীজী (সা:)’র বিশাল বিজয়ের মূল কারণ, তিনি পুরোপুরি সফল হয়েছিলেন জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে এই বড় জিহাদে। অথচ এ যুগে অন্যদের ব্যর্থতার মুল কারণ, তারা ব্যর্থ হয় এই বড় জিহাদে। পবিত্র কুর’আনী জ্ঞানের আলোকে নবীজী (সা:) তাঁর সাহাবাদের আখেরাতে পূর্ণ বিশ্বাসী রূপে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। চোখের সামনে তারা যেমন নিয়ামত ভরা জান্নাত দেখতেন, তেমনি দেখতেন লেলিহান আগুনে ভরা জাহান্নাম। এটিই  ছিল তাদের সার্বক্ষণিক মারেফত তথা সজ্ঞানতা। তারা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যু এ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে না, বরং মৃত্যুহীন ও অন্তহীন এক জীবন দেয়। কে জান্নাতে যাবে এবং কে জাহান্নামে যাবে -সেটি নির্ভর করে ঈমান ও আমলের উপর। ঈমান ও আমলের পরীক্ষা নেয়ার জন্যই এ দুনিয়ার জীবন। মহান আল্লাহতায়ালা সেটি জানিয়েছেন সুরা মুলকের ২ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَوٰةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًۭا ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفُورُ

অর্থ: “তিনিই সেই মহান আল্লাহতায়ালা যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্য আমলের দিক দিয়ে কে উত্তম -সেটি পরীক্ষার জন্য; এবং তিনি পরাক্রমশালী ও গুনাহ মাফকারী।” এ পার্থিব জীবন নিয়ে এরূপ একটি ধারণায় বিশ্বাসী হলে পাল্টে যায় ব্যক্তির কর্ম, চরিত্র, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। এমন বোধ থেকেই শুরু হয় ঈমানদারের জীবনে আমূল বিপ্লব। তখন এ জীবনের আনন্দ-উল্লাস ও আরাম-আয়েশ অতি তুচ্ছ মনে হয়। তখন এ জীবন গণ্য হয় পরীক্ষাস্থল রূপে। পরীক্ষার হলে বসে কেউ আনন্দ-ফুর্তি করে না। বরং প্রতি মুহুর্তে মনযোগী হয় নেক আমল বাড়াতে এবং জান্নাতের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করতে।

সুরা মুলকের উপরিউক্ত আয়াতটি পবিত্র কুর’আনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এ আয়াতটিতে প্রকাশ পেয়েছে, মানব সৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহতায়ালার মূল লক্ষ্য ও দর্শনটি। এ আয়াতটিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী রয়েছে প্রতিটি মানব সন্তানের জন্যও। সে সতর্কবাণীটি হলো, প্রতিটি নর ও নারীর জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামত হলো নানাবিধ দৈহিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যে পরিপূর্ণ এ পার্থিব জীবন। এ পার্থিব জীবন পরিণত হতে পারে জান্নাত লাভের চাবীতে। তবে শর্ত হলো, সে জন্য পাশ করতে হয় ঈমান ও আমলের পরীক্ষায়। এ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষায় পাশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাগে না; অর্থশালীও হতে হয়না। বরং থাকতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার উপর অটল বিশ্বাস এবং তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্মতা। থাকতে হয় সে এজেন্ডার বিজয়ে অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ। এবং সে লক্ষ্যে প্রতিটি বিনিয়োগই হলো নেক আমল। অপর দিকে প্রতিটি পাপকর্ম হলো খেয়ানত। খেয়ানত এখানে মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত সামর্থ্যের তথা আমানতের। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বেজে উঠে এ পরীক্ষার শেষ ঘন্টাটি। তাই এ জীবনের সবচেয়ে বড় প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তাটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ করা নয়। এমন পাশ তো বহু জালেম, ফাসেক ও দুর্বৃত্ত বেঈমানগণও করে। বরং সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত এ পরীক্ষায় পাশ করা। একমাত্র সে পাশই জান্নাতে নেয়। আমানতের ভয়ানক খেয়নাত হয় যদি এ পরীক্ষা পাশে মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত নিয়ামত-ভরা এ জীবনকে কাজে লাগানো না হয়। খেয়ানতের শাস্তিটি ভয়ানক; সেটি জাহান্নামের আগুন।

প্রতিটি মানুষের প্রতিক্ষণের বসবাসটি পরীক্ষার মধ্যে। এবং সর্বক্ষণ পরীক্ষার মধ্যে থাকার ভাবনা নিয়ে বাঁচাই হলো তাকওয়া। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বক্ষণিক নজর ব্যক্তির প্রতিটি কথা ও প্রতিটি আমলের দিকে। তিনি শুধু রেজেকদাতা ও প্রতিপালকই নন, বরং প্রতিটি কর্মের পরীক্ষকও। প্রতিটি ব্যক্তির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য চিন্তার খবর তিনি রাখেন। প্রত্যেকের দুই কাঁধে আসীন রয়েছেন দুইজন ফিরেশতা। ফলে কোন মানবই তাঁর রাডারের বাইরে নয়। এ পরীক্ষায় তারাই ভাল ফল পায় যাদের প্রতিক্ষণের ব্যস্ততা এমন কাজে যা মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করে। সে সাথে এমন কাজ থেকে বিরত থাকে -যা তাঁর অপছন্দের। যে ব্যক্তি প্রতিক্ষণ এমন সজ্ঞানতা নিয়ে বাঁচে, সে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে পরীক্ষা দেয়ার আগে নিজেই নিজের পরীক্ষা নেয়। এভাবেই পদে পদে নিজেকে যোগ্যতর করে মাগফিরাত লাভে। মু’মিনের কর্ম, আচরণ এবং বাঁচার সংস্কৃতিতে এভাবেই ঘটে যায় আমূল বিপ্লব। এরূপ বিপ্লবের মূল কারণ, মগজে ঘটে যাওয়া দর্শনের বিপ্লব। সেরূপ বিপ্লব যার জীবনে ঘটেনি, তার পক্ষে অসম্ভব হলো এ পরীক্ষায় পাশ করা। পরীক্ষার হলও তার কাছে ফুর্তি-ভরা সার্কাস বা রঙ্গমঞ্চ মনে হয়। 

ব্যক্তির দর্শনে আমূল বিপ্লবটি আনে তাঁর কুর’আনী জ্ঞান। কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা নিয়ে সেরূপ বিপ্লবের কথা ভাবা যায়না। দর্শনে বিপ্লব এলে ঈমান ও নেক আমলের ধারণাই পাল্টে যায়। অন্যের কল্যাণে অর্থদান, বস্ত্রদান, চিকিৎসাদান, গৃহদান -এ সবই নেক আমল। মসজিদ-মাদ্রাসা গড়াও নেক আমল। তবে সবচেয়ে বড় নেক আমলটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্ম হওয়া। যারা তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় -একমাত্র তারাই তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার সৈনিকে পরিণত হয়। তাদের জীবনে তখন অবিরাম জিহাদ শুরু হয়। দর্শনের সে বিপ্লবটি তখন তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও দেখা যায়। অপর দিকে কুর’আন তেলাওয়াত, কুর’আন মুখস্থ এবং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও যারা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হতে ব্যর্থ হয়, বুঝতে হবে তাদের চেতনা রাজ্যে বিপ্লব আসেনি। বুঝতে হবে, পাল্টায়নি তাদের দর্শনের মডেল। এদের বাঁচাটাই তখন আযাবের কারণ হয়। সে আযাব শুধু জাহান্নামের নয়, এ পার্থিব জীবনেরও। ১৯/০৬/২০২৪

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *