বিপ্লবের শুরু হতে হবে দর্শনের বিপ্লব দিয়ে
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on September 3, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
দর্শনেই বিপ্লবের বীজ
প্রতিটি বিপ্লবের জন্ম দর্শন থেকে। যেখানে দর্শন নাই, সেখানে বিপ্লবও নাই। সে বিপ্লব সুফল দিবে, না কুফল দিবে -সেটি নির্ভর করে দর্শনের গুণাগুণের উপর। চোরডাকাত, ভোটডাকাত, দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদেরও দর্শন থাকে। সেটি অপদর্শন। ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে যদি সে বিপ্লবের ভিত্তি হয় কম্যুনিজম, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় ভ্রষ্ট, বিষাক্ত ও অসত্য মতবাদ। তাই কোন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির জীবনে বিপ্লব আনতে হলে প্রথমে চিন্তার মডেল তথা দর্শনে বিপ্লব আনতে হয়। দর্শন পাল্টে গেলে ব্যক্তির কর্ম, চরিত্র, আচরণও পাল্টে যায়। তখন পাল্টে যায় জীবনের ভিশন ও মিশন। এবং পাল্টে যায় রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি। তখন নতুন সমাজ ও নতুন রাষ্ট্র নির্মিত হয়। দর্শনের জগতের এ মোড় নেয়াকে সমাজ বিজ্ঞানে প্যারাডাইম শিফট বলা হয়।
দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি বদলাতে হলে হাত দিতে হয় জনগণের চেতনার ভূবনে। বদলাতে হয় বিরাজমান দর্শন ও বিশ্বাসকে। সে দর্শনটি শুধু কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান ও নানারূপ পেশাদারীর বিষয় নিয়ে হলে চলে না, সেটিকে হতে হয় আমরা কেন বাঁচবো, কিভাবে বাঁচবো, সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাণই বা কিরূপে সম্ভব -জীবনের এরূপ অতি মৌলিক বিষয়গুলি নিয়েও। প্রশ্ন হলো দর্শন বলতে আমরা কি বুঝি? দর্শনের গুরুত্বই বা কি? দর্শন তো তাই যা মানুষকে কোন কিছুকে দেখতে, তা নিয়ে ভাবতে ও তার ভাল-মন্দ যাচাইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য যোগায়। দর্শনের ভিন্নতার কারণে মানুষ একই বিষয় একই ভাবে দেখে না। চোর-ডাকাতের দর্শনে চুরিডাকাতি অপরাধ নয়। ধর্ষকের দর্শনে ধর্ষণও অপরাধ নয়। তেমন স্বৈরাচারী শাসকের অসুস্থ দর্শনে জুলুম-নির্যাতন, ভোটডাকাতি ও মানবের মৌলিক অধিকার হরন কোন অপরাধ নয়। অপরাধ নয় গণহত্যার নৃংশসতা।
দর্শনের শক্তি ও গুরুত্ব অপরিসীম। দর্শনের গুণেই মানুষ পশু থেকে ভিন্নতর ও শ্রেষ্ঠতর হয়। এবং ঈমানদারগণ ভিন্নতর হয় বেঈমান কাফিরদের থেকে। পশুর দর্শন থাকে না বলেই সে পশু। দর্শন থেকেই মানুষ পায় তাঁর জীবনের এজেন্ডা এবং বাঁচার মিশন ও ভিশন। হাতি কে হাতি রূপে এবং গরুকে গরু রূপে চেনার জন্য চাই চোখের সামর্থ্য। কিন্তু সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা, ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় রূপে জানার জন্য চাই মনের সামর্থ্য। মনের সে সামর্থ্যই হলো দর্শন। চোখের সামর্থ্য মানুষ জন্মসূত্রে পায়। সে সামর্থ্য পশুদেরও থাকে। কিন্তু দর্শনের সামর্থ্য ব্যক্তিকে নিজে অর্জন করতে হয়। সেটি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে। জ্ঞান নির্ভূল হলে দর্শনও নির্ভূল হয়। ঈমানদার সে নির্ভূল দর্শনটি পায় পবিত্র কুর’আন থেকে। কারণ, পবিত্র কুর’আনে হলো মহান আল্লাহপ্রদত্ত নির্ভূল জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার। এটি হলো সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। কুর’আন লব্ধ সে দর্শনের কারণেই সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ঈমানদারের বিচার সঠিক হয়।
দুষ্ট দর্শনের নাশকতা
অসত্য, অসভ্য ও বিষাক্ত মতবাদ দিয়ে কখনোই সুস্থ, সভ্য ও সুশীল ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নির্মিত হয়না। তাতে বরং শুরু হয় বর্ণগত, ধর্মগত ও জাতিগত নির্মূলের নৃশংস নাশকতা। এবং সংঘটিত হয় রক্তাক্ত যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও বিশ্বযুদ্ধ। বিষাক্ত দর্শনের কারণে একমাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধেই প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৮কোটি মানুষ এবং বিধ্বস্ত হয়েছে শত শত নগর-বন্দর। আর এসবই হয়েছে দর্শনের দূষণে। সঠিক দর্শন চারিত্রিক বিপ্লব আনে, দুষ্ট দর্শন আনে বিপর্যয়। এবং সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি হলো জাহান্নামে পৌঁছার। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর লক্ষাধিক নবী-রাসূলগণকে এ পৃথিবীতে কৃষি, শিল্প বা বিজ্ঞান শেখাতে পাঠাননি; তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণটি করতে। সেটি ছিল, অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়া। এবং সেটি ছিল তাদের চিন্তার মডেলে তথা দর্শনে পরিশুদ্ধি আনা। সর্বোপরি মানব সন্তানকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বাস্তবায়নে তাঁর সৈনিক এবং জান্নাতের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ি জোড়া যায়না, তেমনি চেতনা ও দর্শনের পরিশুদ্ধির আগে চরিত্র ও কর্মে পরিশুদ্ধি আনা যায়না। চেতনা রাজ্যে পরিশুদ্ধির পথ ধরেই নবীজী (সা:) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়তে পেরেছিলেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ার কাজটিও তিনিই শুরু করেছিলেন। নবীজী (সা:)’র সে অভূতপূর্ব সাফল্যের মূলে কোন স্বর্ণখনির আবিষ্কার, কৃষি বিপ্লব, অর্থনৈতিক বিপ্লব ও উন্নত প্রযুক্তি ছিলনা, সেটি ছিল দর্শনের বিপ্লব। এবং সে দর্শনের প্রণেতা নবীজী (সা:) নিজে ছিলেন না। সে বিশুদ্ধ দর্শনটি তিনি পেয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কুর’আন থেকে -যা এসেছিল সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার নিকট থেকে মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত রূপে। এ কিতাব শুধু শ্রেষ্ঠ মানব গড়ার রোডম্যাপ নয়, ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার গড়ার রোডম্যাপও। সে রোডম্যাপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে গৌরব যুগের মুসলিমদের হাতে।
বিশুদ্ধ দর্শনটি খুঁজে পাওয়াই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একাজ নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ। দূষণমূক্ত পানাহার ছাড়া যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি দূষণমুক্ত দর্শন ছাড়া বিবেক বাঁচে না। একাজে ব্যর্থতা মানব জীবনে ভয়ানক ব্যর্থতা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। জন্ম থেকেই যে ব্যক্তি অন্ধ -সে হাতি ও গরুর ন্যায় জীবজন্তুর চেহারা নিয়ে কেবল কল্পনাই করতে পারে। সেগুলি নিয়ে কখনোই সঠিক ধারণা পায়না। তেমনি অজ্ঞ ব্যক্তিও ব্যর্থ হয় সত্য, মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়কে চিনতে। ধর্মের নামে গরু, সাপ, মূর্তি, লিঙ্গ ও পাহাড়-পর্বত পূজনীয় হয় তো মিথ্যা দর্শনের কারণে। তেমনি মিথ্যা দর্শনের কারণে ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ন্যায় অসভ্য, নৃশংস ও বিষাক্ত মতবাদগুলিও এ পৃথিবী পৃষ্ঠে কোটি কোটি অনুসারী পায়। দর্শনের ভিন্নতার কারণেই একই দেশ ও একই জলবায়ুতে বসবাস করেও মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচারবোধ ও মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠে। তাই একজন সেক্যুলারিস্ট বাঙালির কাছে নারী-পুরুষের বিবাহাহীন যৌন সম্ভোগ প্রেম রূপে নন্দিত হয়। অথচ সেরূপ জ্বিনা একজন ঈমানদার বাঙালির কাছে শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ গণ্য হয়।
একজন সেক্যুলারিস্টের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার লড়াই গণ্য হয় সন্ত্রাস রূপে। অথচ একজন ঈমানদারের কাছে সেটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। বাঙালি সেক্যুলারিস্টের কাছে পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিমদেশকে ভাঙ্গা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের পদলে সঁপে দেয়াটি গণ্য হয় গর্বের মুক্তিযুদ্ধ রূপে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রতি সেবাদাসত্ব গণ্য হয় রাজনীতি রূপে। তাদের হাতে নৃশংস ভাবে লাশ হতে হয় আবরার ফাহাদের ন্যায় বিদেশী আধিপত্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিকদের। এবং ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ও কারাগারে নির্যাতিত হয় ইসলামপন্থী নেতাকর্মীদের। এসবই হলো বিষাক্ত দর্শন সমূহের নাশকতা। দর্শনের এমন দূষণে ইসলামী ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচা ও ঈমানদার হওয়া অসম্ভব হয়। সেটি অপরাধ গণ্য হয়। এবং অপরাধ গণ্য হয় নিজ ভাষা, নিজ ভূগোল ও নিজ বর্ণের উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের অনুসারী হওয়া।
আখেরাতের ভয়: যা অনিবার্য করে বিপ্লব
দেশবাসীর কল্যাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, রপ্তানী বাণিজ্য ও মানব রপ্তানী নয়। বরং সেটি হলো জনগণের দর্শন ও ঈমান-আক্বীদার সুস্থতা সাধন। নইলে কখনোই সভ্য, বিবেকবান ও সৃষ্টিশীল মানব নির্মাণের কাজটি হয়না। তখন মারা পড়ে মানবতা, বিবেকবোধ ও ঈমান। তখন দেশ দুর্বৃত্তিতে ইতিহাস গড়ে। তাই মহান নবীজী (সা:) তাঁর মিশন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দিয়ে শুরু করেননি। তিনি আরবের বুকে কোন কৃষি বিপ্লব বা শিল্প বিপ্লব আনেননি। তিনি এনেছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক বিপ্লব। মানব বেড়ে উঠেছে ফিরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর রূপে। সে কাজের শুরুটি করেছিলেন মানুষের দর্শনে পরিশুদ্ধি ও বিপ্লব আনার মধ্য দিয়ে।
নবীজী (সা:)’র আমলেও আরবের পৌত্তলিকগণ আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করতো। এমনকি নিজ সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ তথা আল্লাহর গোলাম রাখতো। কিন্তু তারা আখেরাতকে বিশ্বাস করতো না। তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে, মাটিতে মিশে যাওয়া হাড্ডি-মাংসকে আবার পুনর্জীবিত করা হবে। তাদের সকল জীবন-সাধনা ছিল স্রেফ পার্থিব জীবনকে সফল করা নিয়ে। এমন ইহজাগতিক বিশ্বাসকেই বলা হয় নিরেট সেক্যুলারিস্ট দর্শন। কিন্তু নবীজী (সা:) তাদের সে বিশ্বাসে আমূল বিপ্লব আনেন। প্রতিষ্ঠা দেন আখেরাতের ধারণা। আখেরাতের অর্থ মৃত্যুর পর আবার পুনরুত্থান, রোজ-হাশরের বিচার দিনে আল্লাহতায়ালার সামনে নিজ কর্মের জবাবদেহীতা এবং বিচার শেষে অনন্ত-অসীম কালের জন্য অফুরন্ত নিয়ামত ভরা জান্নাত অথবা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পৌঁছা। কাফির ও মুনাফিকদের জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ; সেখানে একমাত্র তারাই যাবে যারা ঈমান, আমল ও আল্লাহতায়ালার পথে নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে অর্জন করবে মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও মাগফিরাত। যারা অবিশ্বাসী কাফির এবং যাদের বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে -তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নামে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।
মুসলিমদের চরিত্র, আচরণ ও কর্মে অভূতপূর্ব বিপ্লবের মূল কারণ, আখেরাতের উপর বিশ্বাস। তখন ঈমানদারের প্রতিদিনের ও প্রতিক্ষণের তাড়না হয় মহান আল্লাহতায়ালার মাগফিরাত লাভে নিজেকে যোগ্যতর করা যায় -তা নিয়ে। তখন তাঁর মনে বিন্দু মাত্র সন্দেহ থাকে না যে, মাগফিরাত লাভে তথা জান্নাত লাভে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ নিজেকে নিশ্চিত ভাবে জাহান্নামে নেয়া। তখন এ জীবনে বাঁচাটাই ভয়ানক আযাবের কারণ হয়। সে ভয়ানক আযাব থেকে বাঁচতেই ঈমানদারের জীবনে প্রতিক্ষণের তাড়াহুড়া ও প্রতিযোগিতা থাকে শুধু নেক আমলে এবং পাপ থেকে বাঁচায়। সেরূপ এক তাড়াহুড়া নিয়ে বাঁচার নির্দেশ এসেছে সুরা আল ইমরানের ১৩৩ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
وَسَارِعُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا ٱلسَّمَـٰوَٰتُ وَٱلْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
অর্থ: “এবং তাড়াহুড়া করো তোমাদের রব থেকে মাগফিরাত লাভে এবং জান্নাত লাভে যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের সমান -যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীনদের জন্য?”
মাগফিরাত লাভে এবং জান্নাত লাভে প্রতিযোগিতার হুকুম এসেছে সুরা হাদীদের ২১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
سَابِقُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلْفَضْلِ ٱلْعَظِيمِ
অর্থ: “তোমরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও তোমাদের রব থেক মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের জন্য -যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের প্রশস্ততা সমান, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে তাদের জন্য যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। এটিই হলো আল্লাহর রহমত -যা তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। এবং তিনিই সামর্থ্য রাখেন বিশাল অনুগ্রহের।”
পরকালে অবিশ্বাসী কাফিরদের সকল প্রতিযোগিতার লক্ষ্য, স্রেফ এ দুনিয়ায় সফল হওয়া। পরকালের সাফল্য নিয়ে তারা ভাবে না। কিন্তু সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ঈমানদার বান্দাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করতে চান। এবং কিরূপে অর্জিত হতে পারে সে সবচেয়ে বড় কল্যাণটি -সে কথটিও তিনি বাতলিয়ে দিয়েছেন উপরিউক্ত আয়াতে। সেটি মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতা। যারা বাঁচে সে প্রতিযোগতিা নিয়ে -একমাত্র তারাই এ জীবনে সফল হয়। প্রতিযোগিতাটি এখানে বেশি বেশি নেক আমলের এবং পাপচার থেকে বাঁচার। এজন্যই যে রাষ্ট্রে প্রকৃত ঈমানদারদের বসবাস -সে রাষ্ট্রে নেক আমলের জোয়ার আসতে বাধ্য। এরূপ রাষ্ট্রে পাপাচার বা দুর্বৃত্তি রোধে হাজার হাজার পুলিশ লাগে না। কারণ, ঈমানদার ব্যক্তিগণ নিজেরাই নিজেদের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে পুলিশে পরিণত হয়।
তাছাড়া প্রতিটি নেক আমলই তো অর্থনৈতিক কর্ম। দর্শনে মিথ্যার দূষণ বিলুপ্ত হওয়াতে বাড়ে সততা ও সৎ কর্মে আগ্রহ এবং শুরু হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ। তখন জনগণের মাঝে নির্মিত হয় social capital তথা সামাজিক পুঁজি। সে সামাজিক পুঁজির বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দুর্বৃত্তদের থেকে পুঁজি তখন নিরাপত্তা পায়। এবং সাধারণ মানুষ কর্মে, আচরণে ও নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে ঈমানদার হয়। এর ফলে সমৃদ্ধি আসে অর্থনীতিতে। মহান নবীজী (সা:) ও খোলাফায়ে রাশেদার আমলে তো সেটিই হয়েছিল। অপর দিকে যে রাষ্ট্রে জোয়ারটি গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের -সেখানে ঘটে উল্টোটি। তখন বিপদে পড়ে পুঁজি বিনিয়োগ। বিনিয়োগের উপর তখন থাবা পড়ে সরকারি ও বেসরকারি দুর্বৃত্তদের। লক্ষ লক্ষ পুলিশ প্রতিপালন করেও তখন লাভ হয়না। বরং পুলিশ বাহিনীও তখন দুর্বৃত্ত বাহিনীতে পরিণত হয়। ফলে আসে অর্থনৈতিক ধ্বস।
যে দেশে জোয়ারটি দুর্বৃত্তির, বুঝতে হবে সে দেশের মানুষ আখেরাতের ভয় নিয়ে বসবাস করে না। মুসলিম রূপে পরিচয় দিলেও তারা আসলে বেঈমান। জনগণকে ধোকা দেয়ার লক্ষ্যে তারা ঈমানদার সাজার অভিনয় করে মাত্র। তারা জাহিলী যুগের আরবদের ন্যায় উগ্র সেক্যুলারিষ্ট। জাহিলী আরব সেক্যুলারিষ্টগণ নিজেদের পার্থিব জীবনকে আনন্দময় করতে নিজেদের কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিত। আর এ যুগের সেক্যুলারিষ্টগণ তাদের নিজ দুর্বৃত্তি ও ফুর্তি বাঁচাতে নিজ কন্যাদের জীবন্ত কবর না দিলেও ঈমানদারদের ফাঁসি দেয়, বিরোধীদের কারাবন্দী করে এবং নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যা চালায়। এসবের উত্তম দৃষ্টান্ত হলো হাসিনার আমলের বাংলাদেশ।
নবীজী (সা:) ঈমানদারদের চেতনায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন যেমন মহান আল্লাহতায়ালার উপর অটল বিশ্বাস, তেমনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন জান্নাত ও জাহান্নামের উপর বিশ্বাস। তীব্রতর করেছিলেন রোজ হাশরে জবাবদেহীতার ভয়। তবে কারা জাহান্নামের ভয় নিয়ে বাঁচে সেটি কখনোই গোপন থাকে না।প্রকৃত ঈমানদারের জীবনে সেটি খালি চোখেও দেখা যায়। সেটি ধর্মব্যবসায়ীর দাড়ি-টুপি, পাগড়ি. আল-খেল্লা ও ওয়াজের অভিনয়ে মাঝে ধরা পড়ে না। সেটি নিখুঁত ভাবে দেখা যায় আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয়ে ঈমানদারের নিজ অর্থ, নিজ শ্রম, নিজ মেধা ও নিজ রক্তের বিনিয়োগ দেখে। সত্যিকার ঈমানদারের জীবনে ধর্মের নামে অর্থ-উপার্জনের নেশা থাকে না. বরং থাকে ত্যাগের তাড়না। আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে বিনিয়োগ করে নিজ সামর্থ্যের। এরা জিহাদে হাজির হয় নিজ অর্থ, নিজ অস্ত্র, নিজ ঘোড়া ও নিজের সামর্থ্য নিয়ে। এরা ওয়াজ করে, জানাজা পড়িয়ে, দোয়া করে, আযান দিয়ে বা ইমামতি করে অর্থ নেয় না -যেমনটি নেননি নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। বরং নিজ অর্থ ব্যয়ে মজলিসে হাজির হয় কুর’আনের বাণী পৌঁছে দেয়ার তাগিদে। অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কখনোই ধর্মীয় অঙ্গণে হাজির হন না, সে কাজে অন্য পেশা বেছে নেন। দ্বীনের প্রচারে তারা বরং নিজ গৃহ ছেড়ে পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, বনভূমি, নদী-সাগর পাড়ি দিয়ে ভিন দেশের এক অপরিচিত পরিবেশ গিয়ে ঘর বাঁধেন। তারা এসব করেন মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর হওয়া এবং মাগফিরাত লাভের আশায়। তারা সকল কষ্ট সয়ে যান এবং ছবর করেন স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার তাড়নায়। মুসলিমদের গৌরব যুগে ইসলামের যেরূপ বিশ্বজুড়ে দ্রুত প্রসার ঘটে -সেটির মূলে ছিল তাদের এই কষ্টস্বীকার ও কুরবানী।
ধর্মব্যবসায়ীদের নাশকতা
ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ভয়ানক নাশকতাটি শুধু বিধর্মী কাফির এবং স্বধর্মী জাতীয়তাবাদী, উপজাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী, সেক্যুলারিস্ট ও রাজা-বাদশাহদের দ্বারা হয়নি, বরং প্রকট ভাবে হয়েছে আলেমের লেবাসধারী ধর্ম ব্যবসায়ীদের দ্বারাও। মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে রাখে, তারাও তেমনি আড়াল করে রেখেছে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামকে। সেটি ফিরকা, ত্বরিকা, পীর-মুরিদী ও মাজহাবের নামে। তাদের কারণেই নবীজী (সা:)’র ইসলাম -যাতে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, শরিয়তী আইনের বিচার, প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্ব এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ, সে ইসলামের ধারণা সাধারণ মুসলিমদের মগজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে মুসলিম বিশ্ব জুড়ে মসজিদ-মাদ্রাসা, মোল্লা-মৌলভী ও আলেম-আল্লামাদের সংখ্যা বিপুল সংখ্যায় বাড়লেও নবীজী (সা:)’র ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়নি।
কোন আমল তো তখনই নেক আমল হয়, যখন তার পিছনে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা ও তাঁকে খুশি করার তাড়না। ব্যবসার সাথে এখানেই ইবাদতের পার্থক্য। ইবাদতে উপার্জনে এজেন্ডা থাকে না; বরং তাতে থাকে অর্থদান, শ্রমদান, সময়দান -এমন কি প্রাণদানের তাড়না। এমন ইবাদতে ঈমান বাড়ে এবং মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য নামিয়ে আনে। তখন দ্বীনের বিজয় আসে। যেমনটি নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমলে দেখা গেছে। ধর্মের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা পেলে তাতে যেমন ঈমান বাড়ে না, তেমনি তাতে মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য ও বিজয়ও আসে না। এরই উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ। এদেশটিতে প্রতিবছর যত ওয়াজ মাহফিল এবং যেরূপ লক্ষ লক্ষ মানুষ তাতে যোগ দেয় -নবীজী (সা:)’র ২৩ বছরের নবুয়তী আমলে তার শতভাগের এক ভাগও হয়নি। কিন্তু নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের অল্প সংখ্যক ওয়াজে ইসলামের বিজয় এসেছিল। অথচ বাংলাদেশে হাজার হাজার ওয়াজ মহফিল হলেও তাতে দ্বীনের বিজয় না এসে পরাজয় আসছে।
নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের ওয়াজে তীব্রতর হতো শ্রোতাদের ঈমান ও তাকওয়া; তা থেকে পয়দা হতো লড়াকু মুজাহিদ ও শহীদ। তাদের সৃষ্ট জিহাদে নির্মূল হয়েছে দুর্বৃত্ত শাসক এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, সুশাসন ও সুবিচার। অথচ আজ হচ্ছে উল্টোটি। জ্ঞানের আলো মানুষকে আলোকিত করে; এবং অজ্ঞতা বাড়ায় মনের অন্ধকার। বাংলাদেশে ওয়াজ হচ্ছে বটে, তবে আলোকিত করার কাজটি হচ্ছে না। কারণ, ধর্মব্যবসায় সেটি হয়না। সেটির প্রমাণ, যতই বাড়ছে ধর্মব্যবসায়ীদের সংখ্যা ও ওয়াজ মাহফিল -ততই বাড়ছে গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের প্লাবন। পাপের জোয়ারে সামান্যতম কমতি আসছে না। সে আমলে ওয়াজ জিহাদ গণ্য হতো। ওয়াজের সে জিহাদে নবীজী (সা:) পাথর খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন; অথচ ধর্মব্যবসায়ীগণ ওয়াজে অর্থ কামাই করে। এটিই হলো ধর্মব্যবসায়ীদের সেক্যুলারিজম তথা ইহজাগতিকতা।
অর্থের প্রয়োজন কার না আছে? কিন্তু অর্থের সে প্রয়োজন মেটাতে অতি দরিদ্র সাহাবাগণ অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা ওয়াজ করে, জানাজা পড়িয়ে, দোয়া করে, ইমামতি করে বা আযান দিয়ে অর্থ নেননি। এগুলি তো ইবাদত; ইবাদতে কি অর্থ নেয়া যায়? কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী, তাদের তাড়নাটি ইবাদতে নয়, বরং অর্থ লাভে। ধর্মব্যবসায়ী বনি ইসরাইলী আলেমদের কদর্য চিত্রটি মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে তুলে ধরেছেন। তারা তাওরাতের আয়াত শুনিয়ে অর্থ আয় করতো। সুরা জুম্মাতে তাদেরকে ভারবাহী গাধা বলেছেন। গাধাগণ ভার বহন করতে মাত্র; পিঠের উপর জ্ঞানগর্ভ কিতাব থাকলেও গাধা তা নিয়ে ভাবতে পারে না। বনি ইসরাইলীরা ইসলামের ব্যর্থ ছাত্র। বনি ইসরাইলী আলেমদের কদর্য চরিত্রটি পবিত্র কুর’আনে তুলে ধরার অর্থ, মুসলিমগণ যেন সে পথ না ধরে। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়ার কাজটি হয়নি; ফলে সে রোগের বিস্তার ঘটেছে মুসলিম আলেমদের মাঝেও।
বিপ্লব কেন ব্যর্থ হচ্ছে?
বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার কারণ, জনগণ ব্যর্থ হচ্ছে নিজেদের মাঝে বিপ্লব আনতে। বিপ্লব আসছে না তাদের দর্শনে। লোকেরা নিজেদের মাঝে বিপ্লব না আনলে মহান আল্লাহতায়ালা কখনোই তাদের ভাগ্যে বিপ্লব দেন না। এটিই তাঁর সূন্নত। শ্রোতাদের দর্শন পাল্টাতে এবং তাদের জীবনে বিপ্লব আনতে ওয়াজের চেয়ে বক্তার আমল অধিক শক্তিশালী। নবীজী (সা:)কে তাই ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়াজ করতে হয়নি। সে কাজে তাঁর আমল নিজেই কথা বলতো এবং জনগণকে পথ দেখাতো। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের দ্বীনের দাওয়াত ছিল আমল নির্ভর, ওয়াজ নির্ভর নয়।
ওয়াজ মুসলিম জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের কৌশল। এ জিহাদের মূল অস্ত্রটি হলো পবিত্র কুর’আন। তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো: “জাহিদ’হুম বিহি জিহাদান কবিরা।” অর্থ: তাদের বিরুদ্ধে এই কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো। তাই নবীজী (সা:) তাঁর ওয়াজ করতেন পবিত্র কুর’আনের আয়াত দিয়ে। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী তারা ওয়াজে পবিত্র কুর’আনের আয়াতের চেয়ে নিজেদের বক্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দেন। তাদের ওয়াজে থাকে মঞ্চে অভিনয়ের নেশা। গুরুত্ব দেন কিচ্ছা-কাহিনীকে। তারা স্বাভাবিক ভাবে কথা না বলে সুর করে কথা বলেন। অথচ কোন শিক্ষিত মানুষ কি কখনো এভাবে সুর করে কথা বলে? কোন প্রফেসর কি ক্লাসে ছাত্রদের সামনে সুর করে বক্তব্য পেশ করে? অভিনয়ের ন্যায় এটি অস্বাভাবিক। এখানে লক্ষ্য, শ্রোতাদের প্রণোদনা দেয়া। অথচ ইবাদতে প্রণোদনা নিষিদ্ধ।
সুরা আল ইমরানের ১৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা কুর’আনকে তাঁর নিজের ওয়াজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিজের সে ওয়াজকে তিনি “মাও’য়েজাতুল হাসানা” অর্থাৎ “উত্তম ওয়াজ” বলে অভিহিত করেছেন। কথা হলো, মহান আল্লাহতায়ালার ওয়াজের চেয়ে উত্তম ওয়াজ আর কি হতে পারে? যারা ওয়াজের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ করতে চান, তাদের কাজ হতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার সে ওয়াজকে মানুষের সামনে পেশ করা। অর্থাৎ কুর’আনের আয়াত পাঠ করে তার ব্যাখ্যা পেশ করা। নবীজী (সা:) তো সেটিই করতেন। নিজের কথা কম বলে, বেশী বেশী মহান আল্লাহতায়ালার কথা পৌঁছে দিতেন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীদের সে দিকে নজর থাকে না, তাদের থাকে নিজেদের কথাগুলি ছড়িয়ে দেয়ার নেশা।
নাটকের মঞ্চে যারা অভিনেতা, সাধারণ মানুষদের থেকে ভিন্নতর হয় তাদের সাজগোজ ও পোষাক-পরিচ্ছদ। অথচ নবীজী (সা:)কে যারা কোন দিন দেখেনি তাঁরা মদিনায় মসজিদে নববীতে গিয়ে সাধারণ মুসল্লিদের মাঝে বসে থাকা নবীজী (সা:)কে চিনতে সমস্যায় পড়তেন। তাঁকে চিনতে অন্যদের জিজ্ঞাসা করতে হতো। কারণ, নবীজী (সা:)’র পোষাক-পরিচ্ছদ ছিল অন্যদের মতই অতি সাধারণ। শুধু নবীজী (সা:)কে নয়, খলিফায়ে রাশেদাদের চিনতেও সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়তো। খলিফা উমর (রা:) যখন মদিনা থেকে জেরুজালেমে পৌঁছান তখন স্থানীয় খৃষ্টানগণ উঠের পিঠে আসীন খলিফার সঙ্গি কর্মচারিকে খলিফা মনে করে। কিন্তু সেরূপ ভূল বাংলাদেশের ওয়াজের মহফিলে হয়না। কারণ, যিনি ওয়াজের মঞ্চে বক্তা -তাকে হাজার হাজার মানুষের মাঝেও সহজে চেনা যায়। সেটি তার পোষাকের অসাধারণ সাজগোজ ও চাকচিক্য দেখে। বিশেষ ঢংয়ের টুপি, পাগড়ি, জুব্বা দেখে অন্যদের থেকে সহজেই তাদেরকে ভিন্নতর মনে হয়। জলসায় তারা নিজেদের হাজির করেন এক অনন্য ব্যক্তি রূপে।
অভিনয়ের মাধ্যমেই এসব ধর্মব্যবসায়ীগণ শ্রোতাদের ঘন্টার পর ঘন্টা মাতিয়ে রাখে। কোন আলেম শ্রোতাদের কতটা মাতিয়ে রাখতে পারলো -তা দিয়ে তার ওয়াজের মুজুরি ধার্য হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর যত ওয়াজ মাহফিল হয় -তা বিশ্বের আর কোন দেশে হয়না। সেসব জলসায় হাজির হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ । বাংলাদেশে এক মাসে যত ওয়াজ মাহফিল হয় এবং যত মানুষ ওয়াজ শুনে -নবীজী (সা:) তাঁর ২৩ বছরের নবুয়তী জীবনে এতো ওয়াজ করেননি এবং এতো শ্রোতাও তিনি পাননি। ওয়াজ হয় বহু ঘন্টা ধরে। কোন কোন ওয়াজ চলে প্রায় সারা রাত ধরে। বাংলাদেশে তাবলিগ জামায়াতের ওয়াজে হাজির হয় ২০ লাখের বেশি মুসল্লি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা ওয়াজ করে এবং যারা সে ওয়াজ শুনে -এরূপ দীর্ঘ ওয়াজ থেকে উভয়ের মাঝে কতটা বাড়ছে তাকওয়া ও ঈমানদারী? শ্রোতাদের তাকওয়া বাড়লে তো দেশে নেক আমলের জোয়ার দেখা যেত। বিপ্লব আসতো রাষ্ট্র জুড়ে। নির্মিত হতো ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশে সেগুলি হয়নি; বরং প্রবল জোয়ার এসেছে দুর্বৃত্তিতে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেশে যতই বাড়ছে ওয়াজ, ততই বাড়ছে দুর্নীতি। ঔষধ খেলে যদি রোগের উপশমই না হয় -তবে সে ঔষধের ফায়দা কি? একই কারণে প্রশ্ন উঠে ওয়াজের কার্যকারিতা নিয়েও। ওয়াজ তো তখনই কাজ দেয় যখন তা শ্রোতাদের দর্শন পাল্টে দেয়। বাংলার মাটিতে যুগ যুগ যাবত বহু ওয়াজ হয়েছে, কিন্তু তাতে সমাজ ও রাষ্ট্র পাল্টায়নি। কারণ এ ওয়াজ ব্যর্থ হয়েছে জনগণের চেতনার ভূমিতে বিপ্লব আনতে। বিপ্লব আসেনি জনগণের দর্শনে। আর দর্শনে বিপ্লব না এলে কি রাষ্ট্রে বিপ্লব আসে?
ওয়াজ ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ, তাতে কুর’আনের জ্ঞান দান গুরুত্ব পায়নি। তাদের ওয়াজে জনগণের মাঝে কুর’আন বুঝার আগ্রহ যেমন বাড়েনি, তেমনি বাড়েনি কুর’আন বুঝার সামর্থ্য। গৌরব যুগের আলেমদের থেকে আজকের আলেমদের এখানেই মূল পার্থক্য। সে আমলে কুর’আন বুঝায় গুরুত্ব দেয়া হতো। ফলে কুর’আন বুঝার প্রয়োজনে মিশর, সুদান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, আলিজিরিবয়াসহ বহু দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে আরবী ভাষা শিখেছিল। জনগণের মাঝে সেরূপ কুর’আন বুঝার তাড়না সৃষ্টি করতে আজকের আলেমগণ ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তারা কুর’আন তেলাওয়াতে গুরুত্ব দেন, কুর’আন বুঝায় নয়। তেলাওয়াতে নেকী আছে -সে কথা শোনানো হয়। কিন্তু কুর’আন বুঝা যে ফরজ -সে কথা বলা হয়না। সত্য গোপনের এর চেয়ে বড় নমুনা আর কি হতে পারে? এটি তো কুর’আন থেকে জনগণকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র। ফলে জনগণের দর্শনে বিপ্লব আসবে কেমন? আর জনগণের দর্শনে বিপ্লব না এলে রাষ্ট্রের বুকে বিপ্লব আসবে কিরূপে? এভাবে ব্যর্থতা ব্যর্থতার জন্ম দিচ্ছে। ০৩/০৯/২০২৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018