বিবিধ ভাবনা (১৪)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১.

আলেমদের পক্ষ থেকে বহু দোয়া শেখানো হয়। এটি ভাল কাজ। দোয়াকে বলা হয় “মুখয়ুল ইবাদাহ” তথা ইবাদতের মগজ। দোয়া সংযোগ গড়ে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে। দোয়ার মধ্যে দিয়ে ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর মহান রব’য়ের কাছে নিজের আরজি পেশ করে। কিন্তু দোয়া শেখানোর সাথে একটি গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয় শেখানো হয় না যে, দোয়া কবুলের শর্ত আছে। সেটি হলো, দোয়াকারীকে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমগুলোও পালন করতে হয়। মহান আল্লাহতায়ালা তো তাঁর কথাই শোনেন, যে তাঁর কথাগুলো শোনে। হুকুম পালনে যে কোন অবাধ্যতা মহান আল্লাহতায়ার বিদ্রোহী বান্দায় পরিণত করে। আর বিদ্রোহী বান্দার দোয়া কবুল দূরে থাক, তাকে শাস্তি তথা আযাব দেয়াই তাঁর সূন্নত। পবিত্র কোর’আনে সে বিষয়গুলো বার বার বলা হয়েছে।

পরিতাপের বিষয় হলো, সমাজের দোয়ার আয়োজন বেড়ছে কিন্তু মহান আল্লাহতায়াল হুকুম পালনের আয়োজন বাড়নি। বরং বেড়েছে বিদ্রোহ। বাংলাদেশে সে বিদ্রোহের আলামত হলো, আদালতে রাব্বুল আলামীনের শরিয়তী আইনকে বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে কুফরি আইন। প্রতি দেশের রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। সেটি হলো সর্বক্ষেত্রে ইসলামী বিধানের বিজয়। সে সাথে শয়তানেরও এজেন্ডা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিজয় পেয়েছে শয়তানের এজেন্ডা।

লম্বা লম্বা দোয়া করলেও মুসলিমগণ তাদের রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি পরিচালিত করছে ইসলামকে পরাজিত করার শয়তানী এজেন্ডা নিয়ে। ফলে বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিলুপ্ত রেখেছে শরিয়তকে। ইসলামের এ পরাজয় দেখেও নামাযী জনগণের হৃদয়ে দুঃখ জাগে না, বরং তারা আরামে ঘুমায়। এটি কি মহান আল্লাহতায়ার সাথে ইশক বা সংযোগের আলামত? এটি তো বিচ্ছিন্নতার প্রমাণ। এমন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে কি  দোয়া কবুল হয়?  

২.

যে কোন দেশেই আইন অমান্য করা অপরাধ। তার শাস্তি আছে। তেমনি শাস্তি আছে মহান আল্লাহতায়ালর আইন অমান্য করাতেও। অথচ মুসলিমগণ তাঁর আইন অমান্য করে সূদ, ঘুষ, জুয়া, দেহব্যবসা ও নানারূপ দুর্বৃত্তির বাজার সৃষ্টি করছে। সে জন্য কি সাজা পাবে না? নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতে কি শাস্তি মাফ হয়? শাস্তিমাফের শর্ত হলো পাপকে ছাড়তে হয়, তাওবা করতে হয় এবং নেক কর্মে লেগে যেতে হয়।   

৩.
১৫ জানুয়ারি ছিল ভারতে কুম্ভু মেলার দিন। এ দিন লাখ লাখ হিন্দু গঙ্গা নদীর পানিতে নেমে স্নান করেছে – এ বিশ্বাসে যে তাদের সকল পাপ পানিতে ধুয়ে যাবে। এবং অতীত পাপের জন্য কোন শাস্তি পেতে হবে না। কথা হলো, পাপ কি পানিতে ধোয়ার জিনিষ। সেটি তো কর্ম ও চরিত্রের বিষয়। পাপ তো তখনই দূর হয় যখন কর্ম ও চরিত্র পরিশুদ্ধ হয়। সে পরিশুদ্ধি কি পানিতে আসে? এ আধুনিক যুগেও মানুষ কত জঘন্য জাহিলিয়াতই  নিয়েই না বেঁচে আছে! ভারতে বহু হাজার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠতি হয়েছে, কিন্তু আদিম জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা এখনো প্রকান্ড ভাবে বেঁচে আছে।

একই রূপ জাহিলিয়াত বেঁচে আছে খৃষ্টান জগতে। খৃষ্টানদের বিশ্বাস, পাপ যতই হোক, বিশ্বের সকল পাপীদের পাপের কাফফারা হযরত ঈসা (আ:) শূলে চড়ে আদায় করে গেছেন। পাপমূক্তির উপায় হলো শুধু হযরত ঈসা (আ:)কে আল্লাহতায়ালার পুত্র রূপে মেনে নেয়া। নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক। কথা হলো কোন সুস্থ্য বিবেকমান মানুষ কি এসব যুক্তিহীন কথা বিশ্বাস করতে পারে? পাশ্চাত্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিপ্লব আসলেও এরূপ বহু অজ্ঞতা ও বুদ্ধি-বিবর্জিত বহু কথা বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে বেঁচে আছে। এরূপ বহু মিথ্যা ও অজ্ঞতা বৌদ্ধ ধর্ম, শিখ ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের মধ্যে বেঁচে আছে। এ হলো মানব জাতির বিশাল শিক্ষাগত ব্যর্থতা।

৪.
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মুসলিমের মূল পরিচয়টি হলো তাঁর খলিফা রূপে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় গাদ্দারীটা হচ্ছে খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। ১৫০ কোটি মুসলিম তাঁর খলিফা রূপে কাজ করলে কি তাঁর শরিয়তী আইন মুসলিম দেশগুলোতে পরাজিত হতো? এবং প্রতিষ্ঠা পেতো কি কাফেরের আইন ও বিজয়ী হতো কি শয়তানের খলিফাগণ? মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেয়ার আগে এ ব্যর্থতার হিসাব নেয়া কি উচিত নয়?

৫.
প্রতিটি স্বৈরাচারি সরকারই আইন তৈরী করে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে এবং নিজের শক্তি বাড়াতে। কারণ, স্বৈরাচারি সরকার ভয় পায় জনগণের শক্তিকে। জনগণকে কাবু রাখতে তখন আদালত ও পুলিশ পরিণত হয় সরকারী গুণ্ডা বাহিনীতে। তখন দেশে অপরাধ হয়, কিন্তু বিচার হয় না। তখন সবচেয়ে বেশী বেশী অপরাধ কর্মগুলো ঘটে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারি বাহিনীর পক্ষ থেকে কেউ নিহত হলেও খুনিকে আদালতে তোলা হয়না। বাংলাদেশে যেভাবে ভোট-ডাকাতি হলো -সেটি কোন গোপন বিষয় নয়। কিন্তু সে জন্য কি কারো বিচার হয়েছে? বরং আদালত থেকে সে ভোট-ডাকাতিকে জায়েজ করা হয়েছে। এসবই হলো একটি অসভ্য সমাজের আলামত। আর সে অসভ্যতা নিয়েই বাংলাদেশ। কোন সভ্য মানুষ কি এ অসভ্যতা মেনে নিতে পারে?

৬.
ইতিহাসের বইয়ে অতীত লোকদের ঈমান ও বেঈমানীর পরিচয় পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সুকর্ম ও কুকর্মের পরিচয়। কারা ইসলামের পক্ষে এবং কারা অপরাধী কাফেরদের পক্ষে -ইতিহাস সে পরিচয়টি তুলে ধরে এবং এভাবে চিনতে সাহায্য করে মানব জাতির শত্রুদের। জানা যায়, শয়তানের এজেন্টগণ কীরূপ স্ট্রাটেজী নিয়ে কাজ করে সেগুলোও। সে স্ট্রাটেজীগুলো না জানলে তার মোকাবেলা কীরূপে সম্ভব? ইতিহাস পাঠ তাই এতো জরুরি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই শেখায় দেহের শিক্ষা, আর ইতিহাসে বই শেখায় সমাজ ও সভ্যতার শিক্ষা। পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লহতায়ালা তাই বার বার ইতিহাসে দলিল খাড়া করেছেন। অথচ বাংলাদেশে সে ইতিহাস বিজ্ঞানই হলো সবচেয়ে উপেক্ষিত বিজ্ঞান।

তবে ইতিহাসেও বড় নাশকতা হয় অপরাধী দুর্বৃত্তদের পক্ষ থেকে। তারা ইতিহাসের বই থেকে তাদের কু-কীর্তিগুলো সরানোর চেষ্টা করে। বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বড় কু-কর্মগুলো সংঘটিত হয়েছে বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের হাতে। সেটি ১৯৭১ সালে। তারা লক্ষাধিক অবাঙালীদের হত্যা করেছে, তাদের ঘরাড়ী-দোকানপাট লুট করেছে, হাজার হাজার অবাঙালী মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। হত্যা করা হয়েছে শত শত আলেমে দ্বীনকে। হত্যা করা হয়েছে গণতন্ত্রকে। বাঙালীর সমগ্র ইতিহাসে এরূপ কুৎসিত অপরাধ আর কোন কালেই হয়নি। প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে ভারতের অধিকৃতিকে। অথচ ইতিহাস বিকৃত করে বলা হচ্ছে এ অপরাধী বাঙালীরাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। অপরাধীদের অপরাধ লুকানো কবিরা গুনাহ। তাই প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তির দায়িত্ব হলো, বাংলার ইতিহাসের ঘৃন্য অপরাধীদের অপরাধগুলোকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা। অন্ততঃ এতে তাদের ইতিহাসে বিচার হবে। এতে মানুষ বাঁচবে এ অপরাধীদের পদাংক অনুসরণ করা থেকে। পরিতাপের বিষয় হলো, এ গুরুত্বপূর্ন কাজটি বাংলাদেশে হয়নি। এবং এখনো হচ্ছে না।  

৭.

পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীদের শয়তানের ভাই বলেছেন। তবে মানব জীবনে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি অর্থের অপচয় নয়, সেটি হলো সময়ের অপচয়। অর্থের চেয়েও সময় অধিক মূল্যবান।
তাছাড়া সময়ের অপচয়ে শুধু অর্থের অনর্থক ব্যয় হয়। কিন্তু সময়ের অপচয়ে বিনষ্ট হয় ব্যক্তির দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক তথা নেক আমলের সকল সামর্থ্যের। সময়ের সাথে তখন সবকিছু্ই ক্ষতির খাতায় যায়। তাই মানব জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয় সময়ের অপচয়ে। সুরা মুদাচ্ছেরে বলা হয়েছে, জাহান্নামের বাসিন্দাদের যখন জিজ্ঞাসা করা হবে তোমরা কীরূপে এখানে পৌঁছলে, তখন তারা বলবে, “আমরা সময় কাটিয়েছি গল্পগুজবের বাজে আড্ডায়।” অথচ মানুষ বাঁচছে জাহান্নামের মানুষের সে সর্বনাশা সংস্কৃতি নিয়ে।

৮.

ঈমানদার প্রতি মুহুর্ত বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে। সে জন্য তাঁকে প্রতি মুহুর্তে নেক আমলে লেগে থাকতে হয়। আর নেক আমলের খাত তো শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সংস্কার ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ফলে কোন দেশে জনগণের ঈমানদারী বাড়লে, দেশেশিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও অর্থনীতিতে বিশাল উন্নয়ন আসে। সাহাবায়ে কেরামদের আমলে তো সেটিই ঘটেছিল্। অথচ বেঈমানদের হাতে ঘটে উল্টোটি। বাংলাদেশ আজ যেরূপ চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের জোয়ার –তার কারণ তো এই বেঈমানীর জোয়ার।

৯.
ভারতের কাছে বাংলাদেশ কতটা পরাধীন সেটা আবার ধরা পড়লো ভারত থেকে করোনা ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে।বাংলাদেশ চুক্তি করেছিল ভারত থেকে ভ্যাকসিন নিবে। ভারত বলেছে তাদের জনগণকে প্রথম দিবে, এরপর বাংলাদেশ। অতএব বাংলাদেশের মানুষ ততদিন অপেক্ষা কবে। বাংলাদেশের মানুষের প্রাণে বাঁচাটি ভারতীয়দের কাছে যে কতটা গুরুত্বহীন -এ হলো তার প্রমাণ। এমন একটি চেতনা নিয়েই শেখ মুজিবের আমলে ভারত বাংলাদেশকে একটি দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েছিল।

১০.

ভারত ভ্যাকসিন কিনেছে প্রতিটি ২ ডলার দিয়ে। গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহর বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ, বাংলাদেশকে ভারত থেকে কিনতে হচ্ছে প্রতিটি ভ্যাকসিন সোয়া ৫ ডলার দিয়ে। এখানেও ভারতের বাণিজ্য। কথা হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোথায়? প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ সরকারের কি সামর্থ্য নাই অন্যদেশ থেকে সরাসরি ভ্যাকসিন কেনার? তবে কি জনগণের প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে ভারতের গোলামীই শেখ হাসিনার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ?  ১৬/০১/২০২১।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *