বিবিধ ভাবনা ৭৪
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 1, 2021
- Bangla Articles, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
১. সভ্য দেশ ও অসভ্য দেশ
একটি দেশ কতটা সভ্য বা অসভ্য -সেটি বুঝা যায় সে দেশের পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আদালত দেখে। কোন সভ্য দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যগণ কখনোই এ কথা ভাবে না, কোন স্বৈর শাসককে বাঁচাতে জনগণের উপর তারা গুলী চালাবে। তেমনি সভ্য দেশের বিচারকগণও ভাবে না যে, স্বৈর শাসকের নিরাপত্তা দিতে নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলাবে। তারা জানে, জনগণ তাদের রাজস্ব দিয়ে প্রতিপালন দেয় তাদের সুরক্ষা ও সুবিচার দিতে। জনগণের কোন সদস্যকে হত্যা ও তার উপর নির্যাতনের জন্য নয়। তারা সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে। তারা এও জানে, সরকারের বিরুদ্ধে খাড়া হওয়ার অর্থ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খাড়া হওয়া নয়। রাষ্ট্র সবার। কিন্তু সরকার সবার নয়। সরকার গঠিত হয় স্রেফ শাসকদলের সদস্যদের নিয়ে। ফলে শাসকদলের বিরুদ্ধে জনগণের নানা স্তরে অভিযোগ থাকতেই পারে। তাই দেশের সকল জনগণ সরকারকে সমর্থণ দিবে -সেটি কোন সভ্য দেশেই ভাবা হয়না। এজন্যই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে করা কোন সভ্য দেশেই কোন অপরাধ নয়, সেটি প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। শুধু ভোট দিয়ে নয়, জনগণ তাদের মতামত প্রকাশ করে রাস্তায় নেমেও। সভাসমিতি এবং মিছিল করতে এজন্যই কোন সভ্যদেশেই সরকার থেকে অনুমতি নেয়া লাগে না। কারণ, রাস্তাঘাট ও মাঠ-ময়দান সরকারের নয়, সেগুলি জনগণের। তেমনি পত্র-পত্রিকায় সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করাও কোন অপরাধ গণ্য হয় না।
তবে অসভ্য দেশের চরিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশ স্বৈরশাসকের দখলে গেলে রাষ্ট্র আর সভ্য থাকে না। তখন দেশ এক অসভ্য জঙ্গলী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলায় পুলিশ গ্রেফতার করবে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করবে -এটিই হলো অসভ্য রাষ্ট্রের চরিত্র। তখন নাগরিকদের অধিকার যেমন কেড়ে নেয়া হয়, তেমনি প্রশাসন, আদালত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দায়িত্ব এবং তাদের কাজের ধরণে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। জনগণের সেবক বা রক্ষকের হওয়ার বদলে তাদেরকে স্বৈরশাসকের রক্ষক ও সেবকে পরিণত করা হয়। জনগণ যেমন অধিকার হারায়, তেমনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগণ নিজেদের মর্যাদা হারায়। তারা পরিণত হয় স্বৈরশাসকের পদলেহী চাকর-বাকরে। তাদের কাজ করতে হয় গৃহপালিত কুকুরের ন্যায়। মনিব ধর্ষক হোক, ডাকাত হোক বা খুনি হোক –কুকুরকে সে মনিবের পা যেমন ভক্তি ভরে চাটতে হয়, তেমনি তাকে পাহারাও দিতে হয়। নইলে বিপদ ঘনিয়ে আসে তার জীবনে। এমন অধিকৃত দেশে জনগণের কাজ হয়, এমন এক প্রশাসন, আদালত, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রতিপালনে রাজস্ব জোগানো যাদের পেশা হয় নৃশংস ও দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসককে বাঁচাতে জনগণের উপর নির্যাতন করা ও তাদের হত্যা করা।
২. অপরাধীর বন্দনা: বাঙালীর জাতীয় অপরাধ
মহান আল্লাহতায়ালা ইসলামের প্রচার শুরু করেছিলেন কুর’আন শিক্ষা দেয়ার মধ্য দিয়ে। নামায-রোযার বিধান এসেছে অনেক পরে। নবীজী (সা:)’র প্রতি পবিত্র কুর’আনের প্রথম বাণী ছিল “ইকরা বিসমে রাব্বিকাল্লাযী খালাকা” (অর্থ: পড় তথা জ্ঞানার্জন করো তোমার সেই প্রতিপালকের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন)। জ্ঞানই হলো ঈমান ও ইসলামের চাবী। তাই জ্ঞানহীন তথা জাহেল থাকা সবচেয়ে বড় গুনাহ। এবং কুর’আন শিক্ষাদান হলো মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র সূন্নত। তাই কোন ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই কুর’আন শিক্ষার বিরোধী হতে পারে না। একাজ নিরেট কাফের ও মুনাফিকদের। অর্থাৎ ইসলামের শত্রুদের। কে ইসলামের শত্রু এবং কে মিত্র –সেটি তো এভাবেই ধরা পড়ে। কুর’আন শিক্ষা বন্ধ করার অর্থ, ইসলামের প্রচার রোধ করা। কোন ঈমানদার ভাবতেই পারে না যে, মুসলিম দেশের কোন স্কুল-কলেজে কুর’আন শেখানো হবে না। কারণ সেটি ভাবলে ও মেনে নিলে সে আর ঈমানদারই থাকে না। তেমনি যারা কুর’আন শিক্ষার বিরোধী কোন মুসলিম তাকে সন্মান করতে পারে না, বরং তাকে ঘৃণা করা এবং তাকে শত্রু গণ্য করার মধ্যেই ঈমানের প্রকাশ।
এবার দেখা যাক কুর’আন শিক্ষার সাথে শেখ মুজিবের আচরণ। পাকিস্তান আমলে হাই স্কুলে “দ্বীনিয়াত” নামে একটি বই পড়ানো হতো। সেখানে ইসলামের অতি মৌল বিষয়গুলো শেখানো হতো। সমগ্র পাঠ্য বিষয়গুলির মধ্যে এটিই ছিল বিদ্যাশিক্ষার ফরজ বিষয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর মুজিব সে বইটি পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দেয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “ইকরা বিসমে রাব্বিকা”(পড় রবের নামে) পবিত্র কুর’আনের এ পবিত্র বাণীটি শোভা পেত। একজন মুসলিমের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার বাণীর চেয়ে একজন মুসলিমের চেয়ে পবিত্রতম ও প্রিয়তম বাণী আর কি হতে। কিন্তু মুজিবের সে পবিত্র বাণী সহ্য হয়নি, সেটিও তাই বিলুপ্ত করেছিল। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তান আমলে প্রতিদিন তরজমাসহ পবিত্র কুর’আন পাঠ করা হতো, বেতারের সকল কার্যক্রমের মাঝে এটিই ছিল সবচেয়ে পবিত্র কর্ম। মুজিব সেটিও বন্ধ করে দেয়। চাপে পড়ে সেটি পুণরায় শুরু করা হলেও সাথে গীতা, বাইবেল ও ত্রিপঠক পাঠ যোগ করা হয়। ঢাকার নজরুল ইসলাম কলেজ থেকেও ইসলাম শব্দটি তুলে দিয়ে স্রেফ নজরুল কলেজ করা হয়। জাহাঙ্গির নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি কেটে দেয়া হয়। পঞ্চাশের দশকেই আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটিও বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ করা হয়।
কথা হলো, ইসলাম ও মুসলিম শব্দগুলি যাদের কাছে এতো অসহ্য তারা নিজেরা মুসলিম থাকে কী করে? মুসলিমের কাজ তো ইসলাম ও মুসলিমের নামকে বিশ্বময় বিস্তৃত ও প্রবলতর করা, বিলুপ্ত করার কাজ তো কাফের ও মুনাফিকদের। সে সাথে আরো দায়িত্ব হলো, মহান আল্লাহতায়ালার নিজের পবিত্র নামকে মাঠে ময়দানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মহামান্বিত করা। এর মধ্যেই তো ঈমানের প্রকাশ। আগুণে যেমন উত্তাপ থাকে, তেমনি ঈমানদারের মধ্যে থাকে ঈমানের এরূপ প্রবল প্রকাশ। সেটি না থাকাটি তো সুস্পষ্ট বেঈমানী ও মুনাফিকি। পবিত্র কুর’আনের সুরা মুদাচ্ছেরে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: “ওয়া রাব্বাকা ফাকাব্বের”। অর্থ: “এবং (হে নবী), আপনার প্রতিপালকের নামকে আপনি মহামান্বিত করুন।” তাই মহান আল্লাহতায়ালার নামকে মহামান্বিত করা নামায-রোযার ন্যায় ফরজ। মুসলিম তাই রাজপথে গলার সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহু আকবর ধ্বণি তোলে। এক কালে বাংলার নগরে-বন্দরে মিছিল বেরুলেই জনগণ জোর কন্ঠে সে ধ্বণি তুলতো। কিন্তু শেখ মুজিব সে আল্লাহু আকবর ধ্বণি নিজ দলে নিষিদ্ধ করে দলীয় কর্মীদের “জয় বাংলা” দিতে বাধ্য করে। মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে এ ছিল মুজিবের চরম গাদ্দারী ও ঘৃণ্য যুদ্ধ। বাঙালীদের চেতনা থেকে ইসলাম বিলুপ্ত করায় এই হলো মুজিবের ভূমিকা। এরূপ কাজ কি কোন মুসলিমের হতে পারে?
বিস্ময়ের বিষয় হলো, বাঙালী মুসলিমগণ ইসলামের এ শত্রুকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলে সন্মান করে। বস্তুত এটি পরিণত হয়েছে বাঙালীর জাতীয় অপরাধে। মুজিবের অপরাধ কি শুধু ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে? গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে মুজিব একদলীয় বাকশাল উপহার দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছিল মিছিল-মিটিংয়ের স্বাধীনতা। বন্ধ করেছিল সকল বিরোধী পত্রিকা। মুজিব দেশকে ভারতের গোলাম রাষ্ট্র বানিয়েছে এবং ভারতীয় লুটপাটের দরজায় খুলে দিয়ে প্রাণনাশী দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছে। এবং তাতে বহু লক্ষ মানুষের জীবনে মৃত্যু ঘটিয়েছে।
নিজ হাতে অপরাধ করাই শুধু অপরাধ নয়; বরং গুরুতর অপরাধ হলো অপরাধীকে সমর্থণ করা ও অপরাধীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো। একাজ তো অপরাধীদের; ঈমানদারের হয় কী করে? এরূপ করলে কি ঈমান থাকে? ঈমানদারের জীবনের মিশন তো অপরাধীদের নির্মূল। সুরা ফুরকানে ঈমানদারের বৈশিষ্ঠ বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তাঁরা কখনোই অপরাধীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়না। সাক্ষ্যদানের কাজ যেমন আদালতে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষী দেয়াতে হয়, তেমনি হয় অপরাধীর পক্ষে নির্বাচনে ভোটদানে, রাজপথে জিন্দাবাদ দেয়ায় এবং মাঠে-ময়দানে তার প্রতি জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু বলে সন্মান দেখানোতে। সে অপরাধে কোটি কোটি বাঙালী গুরুতর অপরাধী। এরূপ অপরাধ কর্ম বাঙালীর সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আজ বাংলাদেশে গুম, খুন,ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতির যে জোয়ার তার মূল ভিত্তি তো দুর্বৃত্তি ও অপরাধীদের প্রতি ভক্তি দেখানোর রাজনীতি ও সংস্কৃতি। বাঙালী মুসলিমগণ ইসলাম থেকে যে কতটা দূরে সরেছ এ হলো তার নমুনা।
এক সাথে দুই নৌকায় কখনোই পা দেয়া যায় না। তেমনি একই সাথে দুইজনকে ভক্তি ও সিজদা দেয়া যায়না। চেতনার ভূমিকে যে কোন একজনকে সঁপে দিতে হয়। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের শত্রুকে যারা জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলে শ্রদ্ধা দেখায় -তারা কি মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখানোর যোগ্যতা রাখে? বাঙালী মুসলিমদের এ নিয়ে বোধোদয় হওয়া উচিত, কাকে তারা মাথায় তুলেছে? এর হিসাব কি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে দিতে হবে না? ফিরাউনের প্রতি নোয়ানো মাথা দিয়ে কি কখনো মহান রাব্বুল আলামীনকে সিজদা দেয়া যায়?
৩. মুসলিম ভূমিতে কাফের ও মুনাফিকের নাশকতা
নবীজী (সা:)’র আমলে মুনাফিকদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক শতকরা ৩০ ভাগ। সেটি সবার চোখে ধরা পড়ে ওহুদ যুদ্ধের সময়। ১০০০ সৈন্যের মধ্য থেকে ৩০০ মুনাফিক জিহাদের কাফেলা থেকে ভেগে যায়। মুসলিম ইতিহাসে এরাই মুনাফিক রূপে পরিচিত। তাই যে সমাজে জিহাদ থাকে, সে সমাজে মুনাফিকদের নিজের পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ থাকেনা, তারা এভাবে সনাক্ত হয়। মুনাফিকদের আলাদা করার কাজে জিহাদ বস্তুত ছাঁকনির কাজ করে। মুনাফিকগণ নবীজী (সা:)’র পিছনে নামায পড়তো, রোযা রাখতো। নিজেদের ঈমানদার রূপে দাবীও করতো। নিজেদের পরিচয় লুকানোর এ ছাড়া তাদের কাছে অন্য উপায় ছিল না। কারণ, যারা নামায-রোযা পালন করে না, তারা মুনাফিক নয়। তারা পরিচিতি পায় সুস্পষ্ট কাফের করে। মদিনায় বুকে মুনাফিকগণ কখনোই কাফের রূপে পরিচিত হতে চায়নি। কারণ, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে কাফের রূপে চিত্রিত হওয়ার মাঝে তারা নিজেদের বিপদ দেখতো। তবে ইসলামের বিনাশে কাফের ও মুনাফিকদের এজেন্ডা সব সময়েই পুরাপুরি এক ও অভিন্ন। তবে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মুনাফিকগণ কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট। তার যাবে জাহান্নামের ভয়ংকরতম স্থানে। তাদের অপরাধ শুধু কাফিরদের ন্যায় বেঈমানী নয়, বরং মুসলিমের মুখোশ পড়ে ইসলাম ও মুসলিমের ক্ষতিসাধন। মদিনার মুনাফিকগণ গোপনে মুসলিমদের বিনাশে মদিনার ইহুদী ও মক্কার কাফেরদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করেছিল। মুনাফিকগণ সব সময়ই ঘরের শত্রু। এবং এরা বন্ধু খোঁজে কাফেরদের মাঝে। মুনাফিকদের এটিই প্রকৃত চরিত্র। অপরদিকে দেশী-বেদেশী কাফেরগণও মুনাফিকদের মাঝে নিজেদের যুদ্ধে পার্টনার খোঁজে। পাকিস্তান ধ্বংসের কাজে ভারত এসব মুনাফিকদের মধ্য থেকেই বিপুল সংখ্যায় কলাবোরেটর পেয়েছে। ফলে সহজ বিজয় পায় ১৯৭১ সালে।
বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগের কম। বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য তারা কোন বড় সমস্যা নয়। মূল সমস্যাটি মুনাফিকদের নিয়ে। বাংলাদেশীদের মাঝে নবীজী (সা:) নাই। ফলে নবীজী (সা:)’র অবর্তমানে মুনাফিকদের সংখ্যা যে কতটা বিশাল হবে -সেটি অনুমান করা কি এতোই কঠিন? তাদের সংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগ বললেও বোধ হয় কম বলা হবে। কথা হলো মুনাফিক কারা? মদিনার মুনাফিকদের ন্যায় বাংলাদেশের মুনাফিকগণ সমাজে কাফের হতে চিত্রিত হতে ভয় পায়। এজন্য তারা বলে, “আমরাও মুসলিম, আমরাও নামায পড়ি, এবং আমরাও কুর’আন ও তাহাজ্জুদ পড়ি।” মুনাফিক হওয়ার শর্তই হলো, তারা বেনামাযী কাফের হবে না। তারা হবে ইসলামের মুখোশধারী। তারা হবে নামায-রোযা-হজ্জ পালন কারী। নিজেকে তারা জোর গলায় মুসলিম রূপেও পরিচয় দিবে। কিন্তু তাদের এ মুনাফিকি নামায-রোযা, দাড়ি-টুপি দিয়ে গোপন করার বিষয় নয়। সেটি মুনাফিকি ধরা পড়ে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ইসলামের বিরুদ্ধে কাফেরদের ন্যায় তীব্র শত্রুতা দেখে। কোথাও তারা ইসলামী শক্তির বিজয় ও ইসলামী বিধানের প্রতিষ্ঠা সহ্য করতে রাজী নয়। শরিয়তী বিধান তাদের কাছে অসহ্য। ইসলামপন্থীদের হত্যা করা, নির্যাতন করা, এবং তাদের ফাঁসি দেয়ার মধ্যেই তাদের উৎসব। তাদের ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব চিহ্নিত দেশী-বেদেশী কাফেরদের সাথে।
তারা কল্যাণ চায় না এমনকি কোন মুসলিম রাষ্ট্রেরও। কোন মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙ্গে গেলে মুনাফিকগণ হিন্দু কাফেরদের ন্যায় খুশি হয়। একাত্তরের পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে যেমন হিন্দুদের সাথে মিলে খুশিভরে উৎসব করেছে, তেমনি প্রচণ্ড খুশি হবে যদি আজকের পাকিস্তানও ভেঙ্গে যায়। আজও তারা সে অপেক্ষায় বসে আছে। ঈমানদারের রাজনীতিতে সব সময়ই থাকে ইসলামকে বিজয়ী করা ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার ভাবনা। থাকে মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গার বদলে ভূগোল গড়া ও বৃদ্ধির ভাবনা। থাকে সে লক্ষ্যে জিহাদ ও রক্তদানের প্রেরণা। একাত্তরে এরাই ভারতীয় সেবাদাসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে হাজারে হাজার রাজাকার হয়েছিল ও প্রাণ দিয়েছিল। অপরদিকে মুনাফিকদের থাকে ইসলামের পরাজয় এবং মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গার ভাবনা। সে লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করে এবং অর্থ দেয় ও রক্ত দেয়। বিশ্বের সবদেশেই কাফেরদের এজেন্ডা ও মুনাফিকদের এজেন্ডা এক সাথে চলে। ফলে কাফের ও মুনাফিকগণ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনও গড়ে। একাত্তরে বাংলাদেশের এই মুনাফিকগণই ভারতীয় হিন্দু কাফেরদের সাথে কোয়ালিশন গড়েছিল। এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধও করেছিল।
সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ আয়াতে বলা হয়েছে যারা শরিয়তের আইন অনুযায়ী আদালত পরিচালনা করে না তারাই কাফের, তারাই জালেম ও তারাই ফাসেক। মুসলিম রূপে বাঁচার তাই জন্য জরুরি হলো শরিয়ত নিয়ে বাঁচা। অথচ শরিয়তের আইন ছাড়াই বাংলাদেশে বিচারের কাজ চলছে। পূর্ণ মুসলিম হওয়ার পথে এটি এক বিশাল বাধা। দেশে শরিয়ত প্রতিষ্ঠায় মূল বাধাটি কোন কাফেরদের পক্ষ থেকে আসছে না, আসছে মুনাফিক তথা মুখোশধারী মুসলিমদের পক্ষ থেকে। শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দাবী তুললে সন্ত্রাসী আখ্যায়ীত করে জেলে তোলা হয়। মুসলিম ইতিহাসে কাফের ও মুনাফিকদের কুকীর্তির দীর্ঘ বর্ণনা আছে। ফলে মুসলিম দেশে কাফের ও মুনাফিকদের পরিচয় আড়াল করার কৌশলও কম নয়। মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত হলো তিনি পবিত্র কুর’আনে কাফেরদের কাফেরদের কাফের বলেছেন এবং মুনাফিকদের মুনাফিক বলেছেন। কুর’আনে অমুসলিম শব্দটির উল্লেখ নাই। অথচ আজ অমুসলিম শব্দটি ব্যবহার করা হয় কাফিরদের পরিচয় আড়াল করার লক্ষ্যে। অপর দিকে আলোচনা নাই সমাজের বুকে লুকিয়ে থাকা ঘরের শত্রু মুনাফিকদের ভয়াবহ নাশকতা নিয়ে।
৪. মহান আল্লাহর শত্রু ও জনগণের শত্রু
প্রতিটি স্বৈরশাসকই আল্লাহর শত্রু ও জনগণের শত্রু। ইসলাম এবং মুসলিমদেরকে পরাজিত রাখাই তাদের এজেন্ডা। এবং এজেন্ডা হলো জনগণকে মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা। স্বৈরশাসনের অধীনে থেকে পূর্ণ ধর্মপালন অসম্ভব। ফলে অসম্ভব হলো পূর্ণ মুসলিম হওয়া। অসম্ভব হলো ভদ্র নাগরিক রূপে জীবন যাপন করা। কারণ গরুছাগলের পানাহার হলেই চলে। কিন্তু সভ্য জীবন যাপনে তো মানবিক অধিকার নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা লাগে। কিন্তু স্বৈরশাসকগণ সে স্বাধীনতাই কেড়ে নেয়। এমন স্বৈর-অধিকৃত দেশে স্বাধীনতা শুধু স্বৈরশাসকের। তখন অসম্ভব হয়, মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক রূপে কাজ করা। কারণ, স্বৈরশাসক চায়, দেশবাসী তাকে বাঁচাতে শুধু রাজস্বই দিবে না, তার গোলাম এবং একনিষ্ট খাদেমও হবে। ফিরাউনকে তো খোদা বলে মান্যতা দিতে হতো। তবে আজ খোদা না বললেও এক ভোটচোর দুর্বৃত্তকে মাননীয় বলে ঘাড় নোয়াতে হয়। এবং তার স্বৈরাচারি পিতার মুর্তির পদতলে ফুল দিতে হয়।
স্বৈর শাসনের নির্মূল না করে কি পূর্ণ ইসলাম পালন ও ইসলামের বিজয় সম্ভব? এজন্যই তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ। ঘরে আগুণ লাগলে নিষ্ক্রিয় থাকাটি এক গুরুতর অপরাধ। তেমনি গুরুতর অপরাধ হলো, দেশ স্বৈরশাসকের দখলে গেলে জিহাদ থেকে দূরে থাকা। অতীতে তো এমন নিষ্ক্রিয়দের মুনাফিক বলা হয়েছে। এবং সামাজিক ভাবে তাদের বয়কট করা হয়েছে। সে জিহাদ থেকে দূরে থাকার কারণে বনি ইসরাইলীদের উপর গযব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
৫. কাফের ও মুনাফিকদের চেনার গুরুত্ব
জনপদের হিংস্র পশুদের যেমন চিনতে হয়, তেমনি চিনতে হয় কে কাফির এবং কে মুনাফিক -তাদের। কারণ সভ্য মানুষের যুদ্ধটি শুধু হিংস্র পশুদের বিরুদ্ধে নয়, বরং রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধটি মুনাফিক ও কাফেরদের বিরুদ্ধে। হিংস্র পশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটি সব সময় হয় না। কারণ জঙ্গল ছেড়ে হিংস্র পশুগণ সব সময় জনপদ ছেড়ে জনপদে নেমে আসেনা। কিন্তু মুনাফিক ও কাফেরদের অবস্থান তো জনগণের অভ্যন্তরে। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে কোন বিরতি নাই। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ঈমানদারের জিহাদটি লাগাতর, এক মুহুর্তের বিরতি নাই। ফলে ভিতরে লুকিয়ে থাকা এ শত্রুদের না চিনলে যুদ্ধ হবে কীরূপে? অথচ এ যুদ্ধই তো হলো মুসলিম জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ ইবাদতে নিহত হলে সরাসরি জান্নাত জুটে। আর এ যুদ্ধে না জিতলে পরাজয় অনিবার্য। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কুর’আনে তাঁর নিজের শত্রু ও মুসলিমদের শত্রু মুনাফিক ও কাফেরদের বর্ণনা অতি বিষদ ভাবে বর্ণনা করেছেন -যাতে তাঁর সৈনিকগণ সে শত্রুদের চিনতে ভূল না করে।
অনেকের যুক্তি, ঈমান তো চোখে দেখা যায় না, অতএব কাউকে কাফের বা মুনাফিক বলা যাবে কীরূপে? কতটা যুক্তিহীন। একথা তারাই বলে যারা নিজেদের বেঈমানী ও মুনাফিকি লুকাতে চায়। ব্যক্তির ঈমান ও মুনাফিকি জ্বলন্ত সূর্যের ন্যায় দেখা যায়। আগুন চেনা যায় তার শিখা ও উত্তাপ দেখে, তেমনি ঈমান ও মুনাফিকি দেখা যায় ব্যক্তির কথা, কর্ম, আচরণ, বু্দ্ধিবৃত্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনীতি দেখে। যে ব্যক্তি রাজনীতি করে ইসলাম ও তার শরিয়তী বিধানকে পরাজিত রাখতে, বিজয়ী করতে চায় জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় কুফরি মতবাদকে, প্রশিক্ষণ নেয় হিন্দু দেশে গিয়ে, যুদ্ধ করে মুসলিম দেশ ভাঙ্গতে, কোয়ালিশন গড়ে হিন্দু কাফেরদের সাথে -তাকে কি ঈমানদার বলা যায়? ইসলামের যে দৃশ্যমান শত্রুদের ঈমানের পরিচয় জানার জন্য কি কোন নবী হওয়া বা ওহীর প্রয়োজন পড়ে? তাদের বেঈমানী ও মুনাফিকি তো দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। তাছাড়া কাফের ও মুনাফিকদের না চিনলে মুসলিমগণ শত শত বছর ধরে যুদ্ধ করলো কাদের বিরুদ্ধে?
মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাযী ও রোযাদার হওয়া নয়, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বক্ষণিক সৈনিক হওয়া। সৈনিকের জীবনে সর্ব সময়ে জিহাদ থাকে এবং ইসলামকে বিজয়ী করার অবিরাম ভাবনা থাকে। যার মধ্যে সে ভাবনা ও জিহাদ নাই -সে নামায-রোযা করলেও বিশুদ্ধ মুনাফিক। সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে ঈমানদার চেনার পদ্ধতি যেমন শেখানো হয়েছে, তেমনি আলামত পেশ করা হয়েছে মুনাফিকের। পবিত্র কুর’আনের এটি এক গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। ঈমানদার হওয়ার দাবী অনেকেই করে। কিন্তু উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ঈমানের দাবীতে একমাত্র তারাই সত্যবাদী যাদের জীবনে ঈমানের সাথে নিজের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ আছে। যার মাঝে সে জিহাদ নাই সে ঈমানের দাবীতে মিথ্যাবাদী। এমন ব্যক্তি নামায-রোযা করলেও আসলে মুনাফিক।
৬. হিন্দুদের বিজয় বাড়াতে বাঙালী মুসলিমের অবদান
ভারত ১৯৭১’য়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যুদ্ধ করেনি। বরং যুদ্ধ করেছে তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ১). চিরপ্রতিদ্বন্দী পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা ও দুর্বল করা; ২). বাঙালী মুসলিমদের বাংলাদেশ নামের ভারত নিয়ন্ত্রিত একটি জেলে করারুদ্ধ করা; ৩). দক্ষিণ এশিয়ার বুকে অপ্রতিদ্বন্দী শক্তি রূপে ভারতকে শক্তিশালী করা। ভারত তার প্রথম লক্ষ্যে সফল হয়নি। ১৯৭১’য়ের পর পাকিস্তান দুর্বল না হয়ে একটি পারমানবিক বোমার অধিকারী শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে ভারতের সবচেয়ে বড় বিজয়টি ঘটেছে বাংলাদেশের অঙ্গণে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পরিণত হয়েছে ভারতের নিয়ন্ত্রিত একটি বিশাল জেলখানায়। এবং শেখ হাসিনা হলো সে জেলাখানার একজন ভারাপ্রাপ্ত কারারক্ষক। দিল্লি যা বলে সেভাবেই হাসিনা সে জেলে ভারত বিরোধীদের তোলে এবং তাদের উপর নির্যাতন করে। শেখ হাসিনার শাসনের অবসান হলে সে আসনে ভারত আরেক কারারক্ষিকে বসাবে।
ইসলামের সাথে বিপুল সংখ্যক বাঙালী মুসলিমদের গাদ্দারীও কি কম? মদ-ব্যভিচার যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো কোন মুসলিম দেশ টুকরো করা। ইসলাম ভূগোল গড়তে ও বড় করতে শেখায় এবং সে গড়ার কাজকে পবিত্র জিহাদের মর্যাদা দেয়। ভূগোল বাড়ানোর সে চেতনা নিয়ে মদিনার ক্ষুদ্র এক গ্রামীন শহর থেকে শুরু করে মুসলিমগণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ই্উরোপ জুড়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে। পরাজিত করেছে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায় সে সময়ের দুইটি বিশ্বশক্তিকে। বৃহৎ ভূগোল গড়ার সে চেতনা নিয়েই ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের মুসলিমগণ সে সময়ের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ পাকিস্তান গড়ে। তাই পাকিস্তান শুধু একটি দেশের নাম ছিল না, ছিল একটি আদর্শ, একটি স্বপ্ন এবং ইসলামী সভ্যতা নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে বেড়ে উঠার নাম। সে প্যান-ইসলামিক প্রকল্প নিয়েই ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার উদ্ধে উঠে বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান পাকিস্তানের জন্ম। এটি ছিল এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
দেশের ভূগোল ভাঙ্গার কাজকে ইসলাম সব সময় হারাম গণ্য করে। অপর দিকে মুসলিম দেশ ভাঙ্গার কাজে সহযোগিতা দিতে কাফেরগণ সব সময়ই হাজির। সে লক্ষ্যে কাফেরগণ অস্ত্র দেয়, প্রশিক্ষণ দেয় এবং প্রয়োজনে যুদ্ধও করে। তাদের কারণেই মুসলিম বিশ্বজুড়ে আজ শুধু বিভক্তি আর বিভক্তি। আরবগণ বিভক্ত হয়েছে ২২ টুকরোয়। যেখানেই মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রকল্প, সেখানেই কাফের ও মুনাফিকদের প্রকল্প সেটি বানচালের। তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র ছিল দেশটির জন্মের পূর্ব থেকেই। সে কাজে নেতৃত্বে ছিল ভারতের হিন্দুত্ববাদীগণ। হিন্দুত্ববাদী সে ভারতীয় প্রকল্পের সাথে যোগ দেয় মুজিবের নৃতৃত্বে বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ। যোগ দেয় ইসরাইল ও সোভিয়েত রাশিয়া। একাত্তরে বিজয়ী হয় হিন্দুত্ববাদী ভারত ও তাদের বাঙালী মিত্রগণ।
এমন কি ক্রিকেট খেলায় ভারতের কাছে পাকিস্তান হেরে গেলে একজন সাধারণ মুসলিমও মনে দুঃখ পায়। মুসলিমের কাছে যে কোন মুসলিমের যে কোন ময়দানে পরাজয়ই বেদনাদায়ক। এটিই তো মুসলিম ভাতৃত্ববোধ। এটুকু না থাকলে বুঝতে হবে তার মধ্যে বিন্দু মাত্র ঈমান নাই। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ লিখেছিলেন, বলকানের যুদ্ধে কোন তুর্কী সৈনিকের পায়ে গুলী লাগলে সে গুলীর ব্যাথা যদি তুমি হৃদয়ে অনুভব না করো তবে খোদার কসম তুমি ঈমানদার নও। এজন্যই বলা হয়, মুসলিম উম্মাহ এক দেহের ন্যায়। দেহের এক অঙ্গ ব্যাথা পেলে, অন্য অঙ্গ তা অনুভব করে। জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় নাশকতা হলো, বাঙালী মুসলিমের চেতনা থেকে সে মুসলিম ভাতৃত্ববোধই বিলুপ্ত করেছে। ধ্বংস করেছে ঈমান ও চরিত্র। এরূপ নাশকতায় শেখ মুজিব ও তার অনুসারী আওয়ামী কাপালিকদের সফলতাটি বিশাল। বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের কাছে তাই বাংলাভাষী একজন মুসলিম রাজাকারের চেয়ে ভারতের হিন্দু বাঙালী বেশী আপন। তাই সে রাজাকারকে গালী দেয়, কিন্তু ভারতের যে সৈনিক বাংলাদেশের সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করে কাঁটা তারে ঝুলিয়ে রাখে তাকে বাঙালীর মুক্তিদাতা বন্ধু বলে সন্মান করে। এবং ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলে। অপর দিকে একাত্তরে ভারতের বিজয়ের পর ধর্ষণ, লুটলাট ও ব্যবসা-বানিজ্য দখলে বাঙালীগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারত থেকে বাঁচতে আসা বিহারীদের উপর।
পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভারতের ন্যায় কাফের দেশের হাতে হেরে গেল ও ভেঁঙ্গে গেল এবং তাতে যদি কেউ মনে কষ্ট না পায় তবে যে তার মধ্যে শরিষার দানা পরিমান ঈমান নাই – তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? সে যদি নিজেকে ঈমানদার রূপে দাবী করে এবং নামায-রোযা পালন করে তবে সে তো মুনাফিক। অথচ এ পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি যে ছিল বাঙালী মুসলিমদের -সেটি পাকিস্তানীরাও স্বীকার করে। কারণ মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকার। এবং মুসলিম লীগের হাতে সরকার ছিল একমাত্র বাংলায়। অন্যান্য প্রদেশে ক্ষমতা পায় অনেক পরে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ভাবতেও পারিনি যে ভারতীয় হিন্দুদের নিয়ে বাঙালী মুসলিমগণ পাকিস্তান ভাঙ্গবে।
বাঙলী মুসলিমগণ একাত্তরে মুসলিমদের বিজয় ও গৌরব বাড়াতে নয়, হিন্দুদের বিজয় ও গৌরব বাড়াতে বিস্ময়কর ভূমিকা রেখেছে। হিন্দুগণ এরূপ বিজয় বিগত হাজার বছরেও পায়নি। ইন্দিরা গান্ধির মূল্যায়ন তাই সঠিক। হিন্দুদের হাজার বছরের সাধ একাত্তরে পূরণ হয়েছে। হিন্দুদের ঘরে এ বিজয় তুলে দিয়েছে বাঙালী মুসলিমগন। নইলে তাদের পক্ষে এ বিজয় লাভ কখনোই সম্ভব হতো না। অন্য কোন কারণে না হোক, অন্ততঃ অতি কদর্য এই ইতিহাস নিয়ে সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে বাঙালী মুসলিমগণ নিশ্চিত একটি স্থান পাবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয়ে শুধু পাকিস্তান, ভারত, কাশ্মিরের মুসিলমদের গৃহেই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মুসলিমদের ঘরে ঘরে দুঃখের মাতম উঠেছিল। সে খবর কি বাঙালী মুসলিমগণ কখনো নিয়েছে? অথচ সেটি জানা আদৌ কঠিন নয়। সে সব দেশের মুসলিমদের জিজ্ঞেস করলে আজও সেটি জানা যায়। সেদিনের বিশাল বিজয়ে ইন্দিরা গান্ধি পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বলেছিলেন: “হাজার সালকা বদলা লে লিয়া।” অর্থ: (মুসলিমদের থেকে) হাজার বছরের প্রতিশোধ নিলাম। ভারতীয় হিন্দুদের ঘরে ঘরে সেদিন আনন্দের যে বন্যা বয়েছিল, তাতে যোগ দিয়েছিল ভারতসেবী তৎকালী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী মুসলিমগণ। ভারতের সে বিজয় নিয়ে আজও বাংলাদেশের সেক্যুলার শিবিরে প্রতি বছর উৎসব হয়। আজ যে ভারত ও তার দাসদের হাতে বাংলাদেশ অধিকৃত -তা তো একাত্তরের অর্জন।
মুনাফিকের সংখ্যা যেসর মুসলিম দেশে অধিক, সেসব দেশে ভারতের ন্যায় কাফের দেশের পক্ষে যুদ্ধ করার লোকের কমতি হয় না। তাই একাত্তরের ভারতের পক্ষে যুদ্ধ লড়তে লাখ লাখ বাঙালী খুঁজে পেতে দিল্লির শাসকচক্রের কোন অসুবিধাই হয়নি। কথা হলো, যারা কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলে যুদ্ধ করে -তাদের কি আদৌ ঈমানদার বলা যায়? পবিত্র কুর’আনের মহান আল্লাহতায়ালা একাধিক আয়াতে একাজকে হারাম বলা হয়েছে। হারাম বলেছেন নবীজী (সা:)ও। একাত্তরে তাই কোন ইসলামী পন্থী দল, কোন আলেম এবং কোন পীর পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেননি। ইসলামপন্থী মানেই যে রাজাকার –ভারতসেবী বাঙালীদের এ কথা বলার যুক্তির মূল ভিত্তি তো সেদিনে বাস্তবতা।
৭. রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুরুত্ব
অন্যদের কাছে রাজনীতি ব্যবসা বা পেশাদারী। কিন্তু ঈমানদারের কাছে রাজনীতি হলো জিহাদ তথা সর্বোচ্চ ইবাদত। পবিত্র কুর’আনে রাজনীতি বলে কোন শব্দ নাই। আছে জিহাদ। কুর’আন অন্যায়ে নির্মূলে কথা বলে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার কথা বলে, আইনের শাসন ও ইনসাফের কথা বলে। সেগুলি প্রতিষ্ঠা দেয়া যে ঈমানদারের কাজ -সে কথাও বলে। সে কাজে মূল হাতিয়ারটি নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত নয়। সেক্যুলার রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। সেটি হলো পবিত্র জিহাদ। মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার এটাই হলো মু’মিনের হাতিয়ার।
রাজনীতি থেকেই নির্ধারিত হয় দেশের নীতি। তাই যারা দেশের নীতি পাল্টাতে চায় এবং ইসলামী নীতির প্রতিষ্ঠা চায় -তাদেরকে মসজিদ, খানকাহ, হুজরাহ বা ঘরে বসে থাকলে চলে না। ময়দানের দখল নিতে জিহাদে নামতে হয়। নবীজী (সা) জিহাদ করেছেন ও রাষ্ট্রনায়কের পদে আসীন হয়েছেন। রাজনীতির অঙ্গণে জিহাদ তাই নবীজী (সা:)’র শ্রেষ্ঠ সূন্নত। মুসলিমগণ আজ সে ময়দানে নাই বলেই দখল জমিয়েছে ইসলামের শত্রুগণ।
নামায-রোযা দেখে ব্যক্তির ঈমান বুঝা যায় না। কারণ মুনাফিকও নিয়মিত নামায-রোযা করে। ঈমান বুঝা যায় তাঁর জিহাদ দেখে। ঈমানদারের কাছে রাজনীতি পরিণত হয় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে বিজয়ী করা ও তাঁকে খুশি করার আমৃত্যু জিহাদে। তাতে সে বিনিয়োগ করে নিজের সকল সামর্থ্য। বস্তুত ঈমানদারের ঈমানের প্রকাশ ঘটে জিহাদের রণাঙ্গণে।
ভাল কাজ ও অপরাধ কর্ম –উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা অতি বিশাল। দেশবাসীর জীবনে ভয়ানক বিপদ নেমে আসে যদি দেশ অপরাধীদের হাতে অধিকৃত হয়। তখন দেশে দুর্বৃত্তির জোয়ার আসে। তখন লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়েও লাভ হয়না। তখন বরং মাদ্রাসাতে সে সব স্বৈরাচারি তখন দুর্বৃত্তের ছবি টানিয়ে সেটি সন্মান জানাতে হয়। দুবৃত্তি নির্মূলের ফরজ কাজটি তখন অসম্ভব হয়। এভাবে দেশবাসীর সংস্কৃতিতে ভয়নাক দূষণ ঘটে। বাংলাদেশে তো অবিকল সেটিই হয়েছে। তাই জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো ইসলামী রাষ্ট্র গড়া। অথচ বাংলাদেশে এ সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্মটিই সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। নবীজী (সা:)’র বহু সূন্নতই গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু গুরুত্ব পায়নি এ বিশাল সূন্নতটি। অথচ এ সূন্নতের বদৌলতেই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছে। এবং নির্মিত হয়েছে সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। ০১/১১/২০২১
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018