বিবিধ ভাবনা ৭৬

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিমের দেশ

যেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু, সে দেশের হিন্দুয়ানী একটি চরিত্র থাকে। তেমনি যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম, সে দেশেরও একটি মুসলিম চরিত্র থাকে। গৃহের ন্যায় দেশও সেখানে বসবাসকারীদের চরিত্র বহন করে। সে বিশেষ চরিত্রটি খালী চোখে দেখা যায়। সেটি প্রকাশ পায় দেশবাসীর চরিত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আদালতের বিচার ও আইন-কানূনের মাঝে। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শ শুধু ব্যক্তির অন্তরের বিষয় নয়, বাইরের বিষয়ও।

বাংলাদেশে ইসলামী বিধানগুলোর যেরূপ পরাজয়, মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের যেরূপ বিলুপ্তি, জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারজিমের যেরূপ প্রবল জোয়ার -সেটি কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ঘটার কথা নয়। মহান নবীজী (সা:) ও তাঁর মহান সাহাবাগণ শুধু আরব জনগণের ধর্মই পাল্টে দেননি, পাল্টে দিয়েছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রও। একটি দেশের চরিত্রে প্রতিফলন ঘটে দেশবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাসের। মুসলিমের নিজের পরিচয় ও রাষ্ট্রের পরিচয়ে থাকে ইসলামের প্রভাব। তাই একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন বিলুপ্ত হবে –সেটি কি কখনো ভাবা যায়? শরিয়তের বিলুপ্তি ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় বাতিল মতবাদ বিজয়ী হবে তো ভারতের ন্যায় দেশগুলিতে যে সব দেশে মুসলিমগণ সংখ্যালঘিষ্ঠ।

২. টুকটাক ধর্মপালনের প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের জনগণ টুকটাক ধর্মপালন নিয়েই অতি তৃপ্ত। তাদের সিংহভাগ মনযোগ অন্য দিকে। তারা চায়, চাকুরি, প্রফেশন ও ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে দুনিয়ার যে ব্যস্ত জীবন -তা ঠিকঠাক চলুক। অধিকাংশ মানুষের জীবন ব্যর্থ হয় মূলত এ কারণে। কারা প্রকৃত বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাবান -সেটি বুঝা যায় জীবনের এ প্রায়োরিটির দিকে নজর দিলে। যারা প্রকৃত বুদ্ধিমান তারা মনযোগী হয় ঠিকঠাক ধর্মপালন নিয়ে। কারণ, জীবনের প্রকৃত সফলতা জুটে ধর্মপালনের সফলতায়। বাঁচার আয়োজনটি টুকটাক হলেই তারা খুশি। এটাই ছিল নবী-রাসূলগণের রীতি। তাদের নজর ছিল মৃত্যুহীন তথা অন্তহীন জান্নাতী জীবনের দিবে। নবী-রাসূলগণ তাই সম্পদের পাহাড় বা প্রাসাদ গড়েননি। এ জীবনকে তারা টুকটাকের মাঝেই সীমিত রাখতেন। যে চেতনাটি তাদের মাঝে প্রবল ভাবে কাজ করতো সেটি হলো, অনন্ত-অসীম কালের জান্নাত লাভ। সে লক্ষ্যে গুরুত্ব পেত ধর্মকর্ম ও নেককর্মগুলো ঠিকঠাক ভাবে করা। কিভাবে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলা যায় -সেটিই ছিল তাদের মূল ভাবনা। এমন চেতনাতেই মানুষ ফেরশতায় পরিণত হয়। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার এটিই তো নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ।

তাই মানুষের বেকুপী ধরা পড়ে টুকটাক ধর্ম পালন ও দুনিয়ারীতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকা দেখে। এরূপ টুকটাক ধর্মকর্মের কারণেই বাঙালী মুসলিমদের জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে নবীজী (সা:) যেরূপ ইসলামের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন সেই ইসলাম। টুকটাক ধর্ম পালন করতে গিয়ে ইচ্ছামত ঘটেছে কাটছাঁট ও আপোষ। নবীজী (সা:)’র ইসলামে শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত ছিল না, বরং সে সাথে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের তা’লীম, শরিয়তী আইনের বিচার, মুসলিম ঐক্য, মৌলিক মানবিক অধিকার এবং দুর্বৃত্ত নির্মূলের জিহাদ। অথচ এগুলির কোনটাই আজ মুসলিমদের মাঝে বেঁচে নাই্। ইসলামের নামে যা বেঁচে আছে তা হলো ৫ ওয়াক্ত নামায, রমযানের মাসব্যাপী রোযা, হজ্জ ও যাকাত। মুসলিমদের মুসলিম হওয়াতে তাই দারুন অপূর্ণাঙ্গতা। এরূপ অপূর্ণাঙ্গ মুসলিমগণ কি জান্নাতে প্রবেশ পাবে?

অতি বুনিয়াদী বিষয় হলো, ইসলামে টুকটাক ধর্ম পালনের কোন স্থান নাই। ইসলাম-পালন পুরাপুরি নবীজী (সা:)’র সূন্নত মাফিক হতে হয়। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: উদখুলু ফিস সিলমে কা’ফফা” অর্থ: “প্রবেশ করো পূর্ণ ভাবে ইসলামের মধ্যে।” মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই পূর্ণ মুসলিম হওয়া, আংশিক তথা টুকটাক মুসলিম বলে কিছু নাই। তখন রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিচার-আচারসহ সর্বক্ষেত্রে মুসলিম হতে হয়। রাজনীতিতে জাতীয়তবাদী, অর্থনীতিতে সূদ, চেতনায় সেক্যুলারিস্ট হলে তো পূর্ণ মুসলিম হওয়া যায় না। পূর্ণ ইসলাম পালন করে তাদের জীবনে জিহাদ আসতে বাধ্য। কারণ, জিহাদ হলো ইসলামের এজেন্ডা নিয়ে বাঁচার লড়াই। সে এজেন্ডা হলো, অন্যায়ের নির্মূল এবং সুবিচার তথা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। নিজেকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলার এটিই একমাত্র পথ। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইসলামে যাদের বিশ্বাস ও আগ্রহ নাই –তাই জীবনে জিহাদ আসবে কীরূপে?

৩.মুরোদহীন জনগণ ও বার বার ভোটডাকাতি

ইজ্জত ও ন্যায্য অধিকার নিয়ে বাঁচতে সৌর্য-বীর্য তথা মুরোদ লাগে। গরুছাগল স্রেফ জবাই হওয়ার জন্য জন্মায়। তেমনি মুরোদহীন জনগণ বাঁচে স্রেফ গোলাম হওয়ার জন্য। এরা কখনো বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের গোলাম হয়; কখনো বা গোলাম হয় দেশী স্বৈরাচারীদের। ডাকাতদের ধরা ও তাদের শাস্তি দেয়ার মুরোদ না থাকলে সে ঘরে বার বার ডাকাতি হয়। তখন শুধু অর্থ নয়, ইজ্জতও লুন্ঠিত হয়। বীরত্ব লাগে নিজেদের ভোট ও নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা দিতেও। এগুলি দানখয়রাতের বিষয় নয়, নিজ শক্তি বলে অর্জনের বিষয়। ভোটের সুরক্ষা দেয়ার সামর্থ্য না থাকলে তা ভোটডাকাতদের হাতে তা বার বার ডাকাতি হয়ে যায়। তখন বিলুপ্ত হয়, সরকার নির্বাচনে জনগণের রায় দেয়ার হক।

২০১৮ সালে জনগণের ভোট ডাকাতি হয়ে যায়। ডাকাতি হয়ে যায় ২০১৪ সালের নির্বাচনও। ডাকাতি হয়েছে শেখ মুজিবের আমলেও। মুজিবের আমলে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো হয়। কিন্তু কোন বারই এসব ডাকাতদের সামান্যতম শাস্তি হয়নি। বরং ডাকাতির সাথে যারা জড়িত তাদেরকে জাতির পিতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রূপে সন্মান দেয়া হয়। এটি কি কম ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা।

বিচারহীনতা মাত্রই তো বন-জঙ্গলের অসভ্যতা। বনের হিংস্র পশুরা শিকার ধরলে কোন বিচার হয়না। কারণ বন-জঙ্গলে থানা-পুলিশ ও আদালত নাই। বাংলাদেশেও তেমনি এক জঙ্গল। এখানেও ভোটডাকাতদের ধরার জন্য থানা-পুলিশ নাই। বিচারের জন্য আদালতও নাই। সভ্য সমাজ নির্মাণের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি সেগুলোর প্রতিষ্ঠা দেয়ার ক্ষেত্রে বাঙালীর ব্যর্থতা বিশাল। বনের হিংস্রপশুগণ যেমন প্রয়োজন মত শিকার ধরে, বাংলাদেশের ভোটডাকাতগণও তেমনি প্রয়োজন মাফিক ভোটডাকাতি করে। ফলে নিশ্চিত বলা যায় আগামী বারও দেশ জুড়ে ভোটডাকাতি হবে। কারণ ডাকাতগণ শতভাগ নিশ্চিত যে, জনগণের ভোটে তাদের নির্বাচিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নাই। তাই এই ভোটডাকাতগণ এতটা বেকুপ নয় যে, সুষ্ঠ ও নিরেপক্ষ নির্বাচন হতে দিবে। তাছাড়া ডাকাতগণ একবার ডাকাতি করেই পেশা থেকে ইস্তাফা দেয় না, তারা একবার ডাকাতি শেষে পরবর্তী ডাকাতির পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশে সফল ভোটডাকাতগণও তাই পরবর্তী ভোটডাকাতির জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। প্রশ্ন হলো, জনগণ কি তবে বসে বসে শুধু আঙ্গুল চুষবে? কথা হলো, ডাকাতদের দখলে গেলে সে দেশ কি কখনো সভ্য সমাজ নির্মিত হয়? তখন তো জোয়ার গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাসে জোয়ার আসবে সটিই তো স্বাভাবিক।  

৪. বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মিথ্যা ও বিপদ

বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি হলো, জনসংখ্যার শতকারা ১০ ভাগ অমুসলিম বাদে বাঁকি শতকরা ৯০ ভাগ নাকি মুসলিম। এ মিথ্যাটি বাংলাদেশে ভয়ানক ক্ষতি করছে। মুসলিম বলতে কাকে বুঝায় এবং ইসলাম কাকে বলে –তা নিয়েই এক বিকট বিকৃত ধারণা জনগণের মগজে শক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মুসলিমের ভ্রান্ত মান তথা স্ট্যান্ডার্ড। নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবাগণ ইসলাম ও মুসলিমের যে ধারণা গড়ে তুলেছেন –সেটি বিলুপ্ত হয়েছে। এভাবে বিলুপ্ত হয়েছে “ফিগার অব হাইনেস” এর ধারণা। এটি এক বিশাল ক্ষতিকারক দিক। কথা হলো, বাংলাদেশে যেসব ঘুষখোর, সূদখোর, সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট ও শরিয়তবিরোধীগণ নিজেদের মুসলিম রূপে পরিচয় দেয় তাদেরকে মুসলিম বললে নবীজী (সা:)’র আমলে যারা জিহাদ করলো ও ইসলামকে বিজয়ী করতে শহীদ  হলো -তাদের কি বলা যাবে?  

নবীজী (সা)’র সময় মদিনার সবাই মুসলিম ছিল না। শতকরা ৩০ ভাগের কাছাকাছি ছিল মুনাফিক। তারা নামায-রোযা পালন করতো। আল্লাহতায়ালা ও নবীজী (সা:)কে বিশ্বাস করতো বলে ঘোষণাও দিত। পবিত্র কুর’আনে এই মুনাফিকদের কাফেরদের চেয়েও জঘন্য বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাদেরকে জাহান্নামের সর্ব নিন্ম স্তরে রাখা হবে। কাফেরদের চেয়ে তাদের জঘন্য হওয়ার হেতু কী? কারণটি হলো, কাফেরদের কথায় কোন ভন্ডামী নাই। তারা খোলাখুলি মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলেদের প্রতি অবিশ্বাসী এবং বিদ্রোহী। কিন্তু মুনাফিকগণ শুধু বিদ্রোহীই নয়, তাদের মাঝে রয়েছে মুসলিমের মুখোশে চরম ভন্ডামী। কাফেরদের ন্যায় তারাও চায় না দেশের আদালেত শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পাক। চায় না প্রতিষ্ঠা পাক ইসলামী রাষ্ট্র ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। তারা চায় না, স্কুল-কলেজে পবিত্র কুর’আন শিক্ষা ও জিহাদের সংস্কৃতি। অথচ জোর গলায় তারা বলে, “আমরাও মুসলিম”। তারা শুধু নামায-রোযা এবং হজ্জ-যাকাতই করে না, হাতে তাসবিহ, মাথায় টুপি ও মুখে দাড়ি দেয়া যায়।

ঈমানদারের জীবনে জিহাদ অনিবার্য। বাঁচার স্বার্থে বাঘ-ভালুককে যেমন চিনতে হয়, জিহাদে জিততে তেমনি শত্রুকে সঠিক ভাবে চিনতে হয়। কে ঈমানদার এবং কে বেঈমান ও মুনাফিক -সেটিও তাই সঠিক ভাবে জানতে হয়। নইলে দুর্বৃত্ত মুনাফিকগণও বন্ধু মনে হয়। তখন বিপদ বাড়ে। অতীত ইতিহাসে মুসলিমদের বড় বড় ক্ষতি হয়েছে মুনাফিকদের হাতে। তাদের চেনার মাধ্যম হলো নবীজী (সা) ও সাহাবাগণ মুসলিমের যে মডেল খাড়া করেছেন তার সাথে তাদের চরিত্র মিলিয়ে দেখা। অমিলগুলোই মুনাফিকির পরিচয় প্রকাশ করে দেয়।
 

৫. উন্নয়নের সঠিক সূচক ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণ কীরূপে?

দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হলো জনগণের কর্ম, চরিত্র ও মানবিক গুণের উন্নয়ন। দালান-কোঠা, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, জিডিপি বা মাথাপিছু আয় দিয়ে সে উন্নয়ন বুঝা যায়না। দুর্বৃত্ত কবলিত দেশেও প্রচুর রাস্তাঘাট, প্রাসাদ ও কারখানা নির্মিত হয়। মানব ইতিহাসের বিস্ময়কর সৃষ্টি পিরামিড নির্মিত হয়েছে ফিরাউনের ন্যায় নৃশংস দুর্বৃত্তদের আমলে। সেটিকে কি তাই উন্নয়ন বলা যায়? দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বুঝা যায় কতজন গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতি থেকে বাঁচলো -তা দেখে। তবে ইসলামে উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ডটি হলো, কতজন মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচলো এবং জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠলো -সেটি। সে বিচারে বাংলাদেশ কোন উন্নয়নই হয়নি। বরং হয়েছে চরম অবনতি। জনগণের চরিত্রের পতন ও দুর্বৃত্তির প্লাবন হলো সে অবনতির নির্ভূল সূচক। সে সূচকে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেছে। এ শতাব্দীর শুরুতে দুর্নীতিতে বিশ্বে পর পর ৫ বার প্রথম হয়ে সেটি প্রমাণও করেছে। রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠাগুলো পরিণত হয়েছে জনগণকে জাহান্নামের জ্বালানী রূপে প্রস্তুত করার হাতিয়ারে।

উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি বা সূচক হলো ব্যক্তির ঈমান ও নেক আমল। বস্তুত ঈমানই আমূল বিপ্লব আনে আমলে ও চরিত্রে। আগুন শিখা বাড়লে যেমন উত্তাপ বাড়ে, তেমনি ঈমান বাড়লে নেক আমলও বাড়ে। যার জীবনে নেক আমল নাই, সে ব্যক্তি যতই নামায-রোযা করুক -বুঝতে হবে সে একজন ভন্ড।

ইট দিয়ে যেমন ইমারত গড়া হয়, তেমনি উন্নত রাষ্ট্র ও উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয় ঈমানদারদের দিয়ে । যেমনটি ঘটেছিল মুসলিমদের গৌরব যুগে। তখন নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। ঈমানদারের প্রতিদিনের বাঁচাটি হয় মহান আল্লাহতায়ার দরবারে মাগফিরাত লাভ ও জান্নাতের মূল্য পরিশোধের তাড়াহুড়ার মধ্য নিয়ে। সেটি হয় লাগাতর নেক আমলের মাধ্যমে। এবং ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে বড় নেক আমলটি হলো রক্ত ও অর্থের বিনিয়োগে জিহাদ। জিহাদের মাধ্যমেই ঘটে জালেমের পরাজয় এবং আসে ইসলামের বিজয়। তখন নির্মিত হয় দুর্বৃত্তমুক্ত সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই প্রকৃত উন্নয়ন হলো উন্নত মানব, সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাণ।

৬. বিবেকের সুস্বাস্থ্য এবং জ্ঞানের গুরুত্ব

দেহ বাঁচাতে আমৃত্যু পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হয়। পানাহার বন্ধ হলে মৃত্যু অনিবার্য। ঈমান বাঁচাতে তেমনি লাগাতর লাগে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। এজন্যই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা নামায-রোযার আগে কুরআন শিক্ষা ফরজ করেছেন। তাই ঈমানদারকে শুধু খাদ্যের তালাশে লেগে থাকলে চলে না, তাকে জ্ঞানের তালাশেও আমৃত্যু লেগে থাকতে হয়। তাই নবীজী (সা:) বলেছেন, দোলনা থেকে কবর অবধি জ্ঞানের তালাশ করো। ঈমানদার এ জন্যই আজীবন ছাত্র। প্রতিদিনই তাঁকে নতুন কিছু শিখতে হয়। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটি হয়নি। ফলে বাংলাদেশে ঈমানদারের চেয়ে বেঈমান বেশী। এবং মুসলিমের চেয়ে মুনাফিক বেশি। এজন্য পরাজয় বেড়েছে ইসলামের এবং বিজয় বেড়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের।

বই যেহেতু জ্ঞানের ভান্ডার, তাই প্রকৃত ঈমানদারকে প্রচুর বই পড়তে হয়। পবিত্র কুর’আনের আগে আরবী ভাষায় কোন কিতাব ছিল না। অথচ আরবদের মাঝে ঈমানদারের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আরবী ভাষায় জ্ঞানের ভান্ডারে বিশাল সমৃদ্ধি আসে। আরবী ভাষা অতি দ্রুত পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায়। তবে ধর্মের লেবাসে যেমন নানারূপ অধর্ম থাকে, তেমনি জ্ঞানের নামে বহু অজ্ঞতাকেও বাজারে ছড়ানো হয়। এবং বইয়ে নামে বাজারে ছাড়া হয় বহু বাজে বই। বিষয়টি গুরুতর। কারণ, বিষপানে যেমন দেহের মৃত্যু ঘটে, বাজে বই পাঠে মৃত্য ঘটে বিবেকের। বিপদের আরো কারণ, বাংলাদেশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক বিষব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসায়ীর ন্যায় এরাও ভয়ানক ক্ষতিকর। তাই যুদ্ধ শুধু ড্রাগের বিরুদ্ধে করলে চলে না, যুদ্ধ তীব্রতর করতে হয় বিষাক্ত সাহিত্যের বিরুদ্ধেও। এটিই হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। তাই শুধু পুষ্টিকর খাদ্য বাড়ালে চলে না, বিশুদ্ধ জ্ঞানের বইয়ের সংখ্যাও বাড়াতে হয়। বিবেক একমাত্র তখনই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সে কাজটি আদৌ হয়নি।

বাংলাদেশ সবচেয়ে কম বই পড়ে তারা যারা নিজেদের ইসলামী দলের নেতাকর্মী রূপে পরিচয় দেয়। জ্ঞানের ভুবনে কোন দেয়াল নাই, সিলেবাসের কোন বাঁধন নাই। সেটি সীমাহীন এবং মুক্ত। কিন্তু ইসলামপন্থীরা দলগত বা ফেরকাগত সিলেবাস দিয়ে জ্ঞানার্জন সীমিত করেছে। অন্য মত বা অন্য ফিরকার বই -তা যত উত্তমই হোক তারা তা পড়তে রাজী নয়। ফলে তাদের জ্ঞান কুয়ার ব্যাংয়ের ন্যায় সীমিত। দেশে কত হাজার টন চাউল বিক্রি হয় -তা দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক হয়না, সেটি হয় কত হাজার ভাল বই বিক্রি হয় -তা দিয়ে। পানাহারের ক্ষুধা মাত্রই স্বাস্থ্যের লক্ষণ, তেমনি জ্ঞানের ক্ষুধা হলো স্বাস্থ্যবান বিবেকের লক্ষণ। আর জ্ঞানের ক্ষুধা বাড়লে বইয়ের চাহিদাও বাড়ে। বাংলাদেশে ভাল বইয়ের অতি কম চাহিদাই বলে দেয়, জনগণের মাঝে জ্ঞানের ক্ষুধা কত কম। জাতির পতন কখনোই দেহের পতনে ঘটে না, সেটি ঘটে চেতনার পতনের কারণে। রোগীর ক্ষুধা ফিরিয়ে না আনলে রোগী শীঘ্রই মারা যায়। তেমনি দেশবাসীর জীবনে জ্ঞানের ক্ষুধা ফিরিয়ে না থাকলে -সে জাতির পতন অনিবার্য। অথচ সে জ্ঞানের ক্ষুধা বৃদ্ধির কাজটাই বাংলাদেশে  যথার্থ ভাবে হচ্ছে না।  ০৯/১১/২০২১

 

 

One Responseso far.

  1. moen says:

    স্যার ৭১ নিয়ে নতুন বই চাই.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *