বিবিধ ভাবনা-৮০

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. নামাযের আযান ও জিহাদের আযান

নামাজের আযান প্রতি দিন ৫ বার। কিন্তু মিথ্যা, অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদের আযান প্রতি মুহূর্তে। নামাজের আযানে সাড়া না দিলে কাফের হতে হয়।‌ তেমনি কাফের হতে হয় জিহাদের আযানে সাড়া না দিলে। নামাজ-রোজা ঘুষখোর, মদখোর, সূদখোরদের ন্যায় মুনাফিকও করতে পারে। কিন্তু জিহাদের আযানে তারা কখনোই সাড়া দিতে পারে না। কারণ, এজন্য সত্যিকার ঈমানদার হতে হয়। অন্তরে মহান আল্লাহতায়ালার ভয় থাকতে হয়। কিন্তু মুনাফিকের সে সামর্থ্য থাকে না।

নামাজের আযান দেয় মসজিদের মোয়াজ্জেন। আর মিথ্যা, জুলুম ও দুর্বৃত্ত শাসকের নির্মূলে এবং ইসলামের বিজয়ে জিহাদের আযান দেন স্বয়ং‌ মহান আল্লাহ তাআলা।‌ তার সে আযানের পবিত্র ধ্বনি ধ্বনিত হয় পবিত্র ‌কুরআনের‌ ছত্রে ছত্রে। রমজানের রোজার হুকুম এসেছে পবিত্র কুর’আনের একটি মাত্র আয়াতে। সেটি সুরা বাকার ১৮৫ নম্বর আয়াতে। সে হুকুমের পর থেকেই রোজা ফরজ। অথচ জিহাদের আযান এসেছে অসংখ্য আয়াতে। যাদের হৃদয়ে ঈমান আছে এবং সত্যিকার শ্রবন শক্তি আছে -তারা মহান রাব্বুল আলামীনের দেয়া পবিত্র আযানের সে ধ্বনি সুস্পষ্ট শুনতে পায় এবং জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

জিহাদের আযানে সাড়া দিয়েছিলেন মহান নবীজী‌ সা: এবং তাঁর সাহাবীগণ। সে আযানে সাড়া দিতে গিয়ে শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছিলেন। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে সেদিন ইসলাম বিজয়ী হয়েছিল। ফলে মুসলিমগণ পরিণত হয়েছিল বিশ্বশক্তিতে। অথচ আজ জিহাদের আযানে‌ সাড়া দেয়ার লোক নাই। বরং তারা সাড়া দেয় শয়তানের দেয়া আযানে। শয়তান আযান দেয় জাতীয়তাবাদ, ভাষাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, সেক্যুলারিজমের পথে নিতে। শয়তানের আযানে সাড়া দেয় বলেই দেশে দেশে বিজয় ইসলাম বিরোধী শক্তির। আর তাতে মুসলিম দেশে বিলুপ্ত হয়েছে মহান অআল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। মুসলিমগণ যদি মহান আল্লাহতায়ালার আযানে সাড়া দিত তবে কি এমনটি হতো?

২. জান্নাতের মূল্য পরিশোধ

মৃত্যুর আগেই জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। মানুষ দোকান থেকে সবকিছুই মূল্য দিয়ে কেনে।‌ কিন্তু জান্নাত পেতে চায় বিনামূল্যে। ভাবে নামাজা-রোজা ও দোয়া-দরুদ করলেই জান্নাত পাওয়া যাবে।‌ নামাজ-রোজা ও দোয়া-দরুদে তো অর্থ ও রক্তের খরচ নাই। অথচ জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করতে হয় অর্থ, শ্রম ও রক্ত দিয়ে। জান্নাতের সে মূল্য পরিশোধে অধিকাংশ সাহাবী শহীদ হয়েছেন।

জান্নাতের মূল্য পরিশোধে সকল সামর্থ্য নিয়ে জিহাদের সাথে নানারূপ নেক আমলে নামতে হয়। তাই ঈমানদারের জীবনে থাকে আমৃত্যু নেক আমলের তাড়াহুড়া। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল হলো আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ। সেটাই হলো ঈমানদারের রাজনীতি। রাজনীতিতে নামলে অনিবার্য কারণে যুদ্ধ চলে আসে। কারণ, এ রাজনীতি হলো দুর্বৃত্ত শাসক নির্মূলের। আর শয়তানী শক্তি তো কখনোই নিরস্ত্র নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ সব সময়ের। তাই নবীজী (সা:)’ ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে রাজনীতি ও যুদ্ধ একত্রে দেখা গেছে। 

৩. জিহাদ নিয়ে ভূল বয়ান

 বাজারে ভুল বয়ান ছড়ানো হয়েছে যে, একমাত্র রাষ্ট্রই জিহাদ সংগঠিত করতে পারে এবং একাজে সাধারণ জনগণের কোন অধিকার নাই। এ বয়ান ছাড়া হয়েছে ক্ষমতাসীন স্বৈর শাসক ও রাজাবাদশাহদের পক্ষ থেকে। তাদের কথা, জিহাদের হুকুম আসতে হবে তাদের মত শাসকদের পক্ষ থেকে। এটি হলো জিহাদ বানচাল করার শয়তানী ষড়যন্ত্র। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের জিহাদ। শয়তান তো এটিই চায়।

অথচ ইসলামের বয়ান হলো, জিহাদের জন্য রাষ্ট্র বা সরকারি অনুমতি লাগেনা, জনগণ নিজেরাই জিহাদ সংগঠিত করতে পারে। যেমন ছিল আগ্রাসী শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, চেচনিয়া ও আলজিরিয়ার মুজাহিদদের জিহাদ। দেশে দেশে এই বেসরকারী জিহাদ নিয়ে আলেমদের মাঝে কোন কালেই কোন বিতর্ক ছিল না। তাছাড়া জিহাদ তো শুধু বিদেশী শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে নয়, সেটি হতে হবে নিজ দেশের দেশীয় দুর্বৃত্ত সরকারের নির্মুলের লক্ষ্যেও। ফলে সে জিহাদে ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্ত সরকারের অনুমতি লাগবে কেন? সে শর্ত বেঁধে দিলে কখনো কি কোন জিহাদ হবে?

নিজের জমি বা গৃহ কেউ দখলে নিলে লড়াই শুরু করি। সে লড়াইয়ে সামান্যতম দেরী সয় না। কোন বিশাল বাহিনী বা কারো অনুমতির অপেক্ষা করিনা। নিজ সামর্থ্য নিয়ে তৎক্ষনাৎ দখল আদায়ের লড়াই শুরু করি। অথচ গড়িমসি আল্লাহর পথে জিহাদে। নিজ দেশে মহান আল্লাহতায়ালার ভূমি দখলে নিয়েছে শয়তানী শক্তি। এবং তাঁর সে জমিন থেকে বিলুপ্ত করেছে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। অথচ কি বিস্ময়, শয়তানী শক্তির হাত থেকে এ দখলদারী মুক্তির জন্য ঈমানদারদের জীবনে জিহাদ নাই! এটি কি ভাবা যায়? মহান আল্লাহতায়ালা কি কখনো এরূপ নিষ্ক্রিয় মুসলিমদের নিয়ে খুশি হন?

অনেকেরই বয়ান, জিহাদের জন্য চাই বিশাল বাহিনী ও প্রস্তুতি। তাদের কথা, সে বিশাল বাহিনী ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না থাকলে জিহাদের দায় আল্লাহতায়ালার উপর ছেড়ে দাও এবং নামাজ-রোজায় কাটিয়ে দাও। অথচ এ ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ান অতি সুস্পষ্ট। জিহাদ শুরুর জন্য কোন বিশাল বাহিনীর অপেক্ষায় বসে থাকার অনুমতি নাই। এ প্রসঙ্গে সুরা সাবার ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশটি হলো এরূপ: “আপনি বলে দিন (হে রাসূল), তোমাদের প্রতি আমার একটিই ওয়াজ (নসিহত): খাড়া হয়ে যাও আল্লাহর জন্য (আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে), সম্ভব হলে কারো সাথে জোড়া বেঁধে, সেটি সম্ভব না হলে একাকীই্।” প্রস্তুতি কীরূপ হতে হবে তা নিয়ে সুরা তাওবার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “(হে ঈমানদারগণ) তোমাদের প্রস্তুতি কম হোক বা বেশী হোক বেরিয়ে পড়, জিহাদ করো আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের মাল ও জান দিয়ে। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে।” প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এই সহজ-সরল নির্দেশগুলি বুঝার জন্য কি বড় আলেম বা আল্লামা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে? নবীজী (সা:)’র যুগে ভেড়ার রাখালগণ এগুলি বুঝতো এবং সে নির্দেশে সাড়া দিত।

 ৪. জনগণ খোয়াড়ে বন্দী এবং আওয়ামী শিবিরে বিজয়-উৎসব

মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিবের শাসন শেষ হয়েছিল। কিন্তু হাসিনার শাসন বেঁচে আছে ২০০৮ সাল থেকে আজ ২০২২ সাল যাবত; অর্থাৎ ১৪ বছর। এর আগেও শেখ ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। অর্থাৎ তার শাসন কাল প্রায় ১৯ বছরের। শেখ মুজিব তার ফ্যাসিবাদী শাসনের শুরু করেছিলেন, কিন্তু  সেটিকে সফল করতে পারেননি। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়ায় বিশাল সফলতা ও বিজয় জুটেছে শেখ হাসিনার। বিরোধী দলীয় নেতাদের জুটেছে শুধু পরাজয় এবং জেল-জুলুম। শেখ হাসিনা যা কিছু করতে চেয়েছেন তাই করেতে পেরেছেন। কেউ তাকে রুখতে পারিনি। শেখ মুজিবের চেয়ে শেখ হাসিনা তাই অধিক কৌশলী ও সফল।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবরে প্রেরণ এবং সে কবরের উপর একদলীয় ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের জন্মদাতাও শেখ মুজিব। গণতন্ত্র হত্যাকারী মুজিবের এটিই হলো সবচেয় বড় পরিচয়। তার সে পরিচয়কে কখনোই ভূলা যাবে না। মুজিবের সেই গণহত্যাকারী চরিত্রকে শেখ হাসিনা পুণঃর্জীবিত করেছেন। ফলে বাকশালী জামানার ন্যায় আজও দেশে গণতন্ত্র কবরে শায়ীত। জনগণ হারিয়েছে ভোটের অধিকার। জনগণের ব্যালট নির্বাচনের আগের রাতেই দেশজুড়ে ভোটডাকাতি হয়ে যায়। কোন দেশে কোন কালে এমন ডাকাতী কি কেউ দেখেছে? পুরা দেশের উপর ডাকাতীর এ এক অভিনব পদ্ধতি। ফিরে এসেছে মুজিব আমলের বিনাবিচারে খুনের রাজনীতি।

তবে মুজিবের সাথে হাসিনার সামান্য কিছু পার্থক্য আছে। শেখ মুজিব ইসলামীপন্থীদের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেননি। এদিক দিয়ে শেখ হাসিনা তার পিতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে চড়িয়েছেন। এবং বহু আলেমকে জেলে ভরেছেন।

শেখ হাসিনার কারণে আওয়ামী শিবিরে আজ প্রতিদিন ঈদের খুশী। প্রতিদিনই তাদের বিজয়োৎসব। বিশাল বিজয়টি যেমন জনগণের ভোটের উপর সফল ডাকাতির, তেমনি গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর। বিজয় দেশটিকে জেলখানা বানানোর। তারা কাঁদাতে পেরেছে জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের। দেশকে দিয়েছে কবরের নীরবতা। খোয়াড়ে ঢুকিয়েছে দেশের জনগণকে। এবং বিরোধী শিবিরে দিয়েছে মহররমের মাতম।

৫. শুধু সরকারকে নয়, জনগণকেও পাল্টাতে হবে

 জনগণের মাঝে যখন মানবিক গুণে বেড়ে সাধ জাগে তখনই তারা স্বাধীনতা চায়। শুধু ভাতে-মাছে বাঁচা নিয়েই যারা খুশি তারা স্বাধীনতা নিয়ে ভাবে না। যেমন ভাবে না মাঠে চড়ে-বড়ে খাওয়া গরু-ছাগলেরা। স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার তাগিদে পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষ লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছে শ্রীলংকাতেও। মানুষ রাস্তায় নেমেছে তিউনিসিয়াতে। কিন্তু বাংলাদেশে সে লক্ষণ নাই। হেতু কী? হেতু আর কোথাও নয়, সেটি জনগণের মাঝে। মানুষ যতই মানবতার স্তর থেকে পশুর স্তরে নামতে থাকে ততই স্বাধীনতায় আগ্রহ হারায়। তখন স্বৈরাচারী ভোট ডাকাতকেও শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলে। একটি দেশের জনগণ কতটা নীচে নেমেছে সেটি বুঝা যায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শত্রু দুর্বৃত্তগণ সেদেশে কতটা স্বীকৃতি সম্মান পায় -তা দেখে। এদিকে বাংলাদেশের জনগণের ব্যর্থতাটি বিশাল।

যে ব্যক্তি গণতন্ত্রকে কবরে পাঠালো, কথা বলার অধিকার কেড়ে নিল, বিচার বহির্ভুত হত্যার প্রচলন করলো, একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা দিল এবং দেশকে ভারতে গোলাম বানালো -সে স্বৈরাচারীকে যে দেশে পিতা ও বন্ধুর সম্মান দেয়া হয় এবং তার মুর্তি গড়ে ফুলের মালা দেয়া হয়, সেদেশে কি কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়? পায় যে না তার প্রমাণ তার প্রমাণ বাংলাদেশ নিজেই। তাই দেশে যতই নৃশংস দুঃশাসন হোক, যতই হোক গুম-খুন-ধর্ষনের প্লাবন, জনগণ আন্দোলনে নাই। তাই বাংলাদেশের সমস্যাটি শুধু ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে নিয়ে নয়, মূল সমস্যাটি জনগণকে নিয়ে। তাই শুধু সরকারকে নয়, পাল্টাতে হবে জনগণকেও। নইলে সরকার পাল্টে গেলেও দেশ ও সমাজ পাল্টাবে না।

জনগণকে পাল্টাতে হলে মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র সূন্নত অনুসরণ করতে হবে। তিনি জ্ঞানদান দিয়ে শুরু করেছিলেন। জ্ঞানের সাহায্যেই তিনি মানুষের চেতনার ভূমিতে বিপ্লব এনেছিলেন। এজন্যই নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ফরজ করার বহু আগে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছিলেন। বাংলাদেশের ভাগ্য কখনোই দেশে সচিবালয়, মন্ত্রীপাড়া বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে নির্ধারিত হবে না। সেটি হবে জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্র থেকে। একাজে শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের সকল মিডিয়া, মসজিদ-মাদ্রাসা, ওয়াজমহফিল ও রাজনীতির ময়দানকে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে একই সাথে শিক্ষক ও ছাত্রে পরিণত হতে হবে।

৬. বাঙালীর ঐতিহাসিক ব্যর্থতা

 প্রতিটি রোগেরই দীর্ঘ ইতিহাস থাকে। রোগের চিকিৎসায় তাই ডাক্তারদের রোগের ইতিহাসটি সঠিক ভাবে জানতে হয়। নইলে চিকিৎসায় ভূল হয়। আজ বাংলাদেশ যে অবস্থায় পৌছেছে তারও একটি ইতিহাস আসে। যারা বাংলাদেশের কল্যাণ নিয়ে ভাবে তাদেরকে সে ইতিহাস অবশ্যই জানতে ও বুঝতে হবে।  বাস্তবতা হলো, গরু-ছাগলের জন্ম হয় জবাই হওয়ার জন্য। ঘাস খাওয়া ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তাদের ভাবনা নাই। তেমনি ভীরু-কাপুরুষদের জন্ম হয় দুর্বৃত্ত জালেম শাসকের গোলাম হওয়ার জন্য।পানাহারে বাঁচা ছাড়া তাদের জীবনে মহত্তর কোন লক্ষ্য থাকে না। এমন ভীরু-কাপুরষদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ, বহু রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ী এবং প্রচুর পরিমান ফসল, গবাদী পশু ও মৎস্য উৎপাদিত হলেও কখনোই সভ্য রাষ্ট্র ও উন্নত সভ্যতা জন্ম নেয় না। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে এই শ্রেণীর মানুষদের গবাদী পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর বলেছেন।

বুঝতে হবে, সভ্যতর রাষ্ট্র ও উন্নত সভ্যতা নির্মাণের কাজটি যেদেশে হয় না, সেদেশে জনগণের স্তরে চরিত্রগত গভীর সমস্যা আছে। ফলে চিকিৎসা শুরু করতে হবে সেখান থেকেই। বুঝতে হবে সভ্যতর রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি এ পৃথিবী পৃষ্টের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। সে সাথে অতি ব্যয়বহুল কর্মও। একাজটি লাগাতর জিহাদের। একাজ সাহসী ও লড়াকু মুজাহিদদের। একাজে বিনিয়োগ ঘটে বিপুল সংখ্যক মানুষের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের। সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াইটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে মহান আল্লাহতায়ালা এ লড়াইকে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদের মর্যাদা দিয়েছেন। এ কাজে যারা নিহত হন তাদের সরাসরি জান্নাতে নেন। অন্য কোন ইবাদতে এরূপ ফজিলত নাই। কোন দেশে এমন জিহাদ না হলে সভ্য মানুষ ও সভ্য সমাজ নির্মাণের কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বাংলাদেশের বুকে জিহাদে অংশ নেয়ার মানুষদের সংখ্যা অতি নগন্য। কারণ, দেশে সেরূপ মুজাহিদ গড়ার কাজটিই হয়নি। এবং সে ব্যর্থতার মূল কারণ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ন্যায় মানুষ গড়ার কারখানাগুলি বিকল।

বাঙালীর ব্যর্থতার ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষাপট আছে। সে ইতিহাসটি ভীরুতা ও কাপুরুষতার। ভীরু ও কাপুরুষদের স্বভাব হলো, তাদের উপর ডাকাতেরা বার বার হামলা করলেও তারা তার প্রতিবাদ করেনা। একারণেই কাপুরুষদের জনপদে বার বার ডাকাতের হামলা হয় –যেমন ভেড়ার পালে বাঘের হামলা বার বার হয়। এমন জনগণের মাথার উপর সবসময়ই ডাকাতগণ শাসক রূপে স্থান করে নেয়। ডাকাতগণও তন্ন তন্ন করে এমন জনগণেরই সন্ধান করে। এমন মানুষের সন্ধান পেয়েই বহু সাগর পাড়ী দিয়ে ইংরেজগণ বাংলায় ছুটে এসেছিল এবং বাঙালীর উপর ১৯০ বছর নিরাপদে রাজত্ব করতে পেরেছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বাঙালীরাই ব্রিটিশদের সবচেয়ে সিনিয়র গোলাম রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বাংলার আগে আর অন্য কোন মুসলিম দেশ ইংরেজদের হাত স্বাধীনতা হারায়নি। লক্ষণীয় হলো, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ন্যায় বিশাল ভূ-ভাগকে দখলে নিতে ইংরেজদের রাজকীয় সেনা বাহিনীর যুদ্ধ করতে হয়নি। সে কাজটি সমাধা করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাত্র কয়েক হাজার প্রাইভেট নওকর। অথচ এই ইংরেজগণ যখন -তাদের সৌর্য-বীর্যের শীর্ষ সময়ে আফগানিস্তান দখলে নিতে গেছে তখন সে দেশের সাধারণ জনগণ ইংরেজ তাড়াতে জিহাদ শুরু করেছে। ইংরেজদের দুইবার পরাস্ত করেছে।

শেখ হাসিনা বাঙালীর এই ভীরু ও কাপুরুষ চরিত্রটি যতটা সঠিক ভাবে বুঝেছে তা অন্য কোন নেতারা এতটা নিখুঁত ভাবে বুঝেনি। এক্ষেত্র হাসিনার সফলতা বিশাল। তাই বাংলাদেশের উপর দখল জমাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও ভোটের রাজনীতি ছেড়ে ভোটডাকাতির পথ বেছে নিয়েছে। এজন্য নৃশংস এক ডাকাত দল গড়েছে। ফলে তার অভিলাষ সহজেই পূরণ হয়েছে। শেখ হাসিনার আরো কৃতিত্ব হলো তিনি একা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ মাত্র কয়েক হাজার এজেন্ট নিয়ে ১৭ কোটি মানুষের এই দেশকে পুরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অথচ ৯০ লাখ মানুষের কাশ্মিরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৬ লাখ ভারতীয় সৈন্য ২০ বছর ধরে হিমশিম খাচ্ছে। এরূপ ভীরু ও কাপুরুষ চরিত্র নিয়ে কি কখনো সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায়?

৭. জিহাদ কেন অনিবার্য হয়?

 জনপদে বাঘ ঢুকলে যে কোন সাহসী জনগণ সে বাঘ মারতে তাড়া করবেই। সেটি না হলে বুঝতে হবে  জনগণ সভ্য মানুষ নয়, গরু-ছাগল থেকে তাদের মান সামান্যই উন্নত। তেমনি দুর্বৃত্ত শাসক ক্ষমতায় বসলে জিহাদ শুরু হবেই। না হলে বুঝতে হবে দেশে জনগণ যথার্থ ঈমানদার নয়। ঈমান থাকলে জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে। সে জিহাদ যেমন নিজের নফসের বিরুদ্ধে, তেমনি প্রতিষ্ঠিত শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে। যে জীবনে‌ জিহাদ নাই, বুঝতে হবে‌‌ তার ঈমানও নাই। আল্লাহতায়ালা প্রতিটি সুস্থ্য মানবকে চিন্তাভাবনা, সম্পদ ও কর্মশক্তি দিয়েছেন। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা পশুরাও করে। কিন্তু আল্লাহর দেয়া সামর্থ্যের কতটুকু ব্যয় হলো তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে ও দুর্বৃত্তের নির্মূলে -সেটিই ব্যক্তিকে জান্নাতে নিবে। তাই একটি দেশে জিহাদ দেখে বুঝা যায়, আ্ল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা রূপে বেড়ে উঠার আগ্রহ দেশবাসীর জীবনে কতটা প্রবল।

তবে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইও অতি উত্তম জিহাদ। দুর্বৃত্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলার কাজটি শুর হয় এই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ থেকেই। এ জিহাদ শুরু না হলে সশস্ত্র জিহাদে সৈনিক জুটে না। এ জিহাদের হাতিয়ার হলো পবিত্র কুরআনের জ্ঞান। তাই পবিত্র ঘোষনা এসেছে, “জাহিদু বিল কুর’আন।” অর্থ: “কুর’আন দিয়ে জিহাদ করো।” এজন্যই শয়তানী শক্তি কুর’আন থেকে মুসলিমদের দূরে রাখতে চায়। মহান নবীজী (সা:) এই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ দিয়ে তার মক্কী জীবনে ইসলামের বিজয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। সশস্ত্র জিহাদের হুকুম এসেছে অনেক পরে। এবং সেটি মাদানী জীবনে। না বুঝে কুরআন পড়ে ও কুরআনে চুমু খাওয়াতে কখনোই মুজাহিদ সৃষ্টি হয় না। অথচ বাংলাদেশে না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াতে কাজটিই বেশী বেশী হয়।

তাই মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কুর’আন বুঝা। প্রকৃত ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠার কাজের শুরু এখান থেকেই। তবে কুর’আন তেলাওয়াত করে ও কুর’আন বুঝেই বা কি লাভ -যদি কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ না থাকে? আল্লাহতায়ালাকে রব ও ইলাহ বলেই বা কি লাভ -যদি আদালতে তার শরিয়তী আইন মানা না হয়? এসব কি মুনাফিকী নয়? নিজেকে মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে হলে -এসব বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। এ ভাবার কাজটিও পবিত্র ইবাদত। কারণ কর্ম, চরিত্র, দর্শন ও রাজনীতিতে বিপ্লবের শুরু তো এই চিন্তাভাবনা থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশে সে চিন্তা-ভাবনার কাজটিই বা কতটুকু হচ্ছে? ১৬/০৪/২০২২।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *