বৌদ্ধদের উপর হামলা এবং দেশধ্বংসী সংকটে বাংলাদেশ
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 20, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
চুনকালি লাগলো মুখে
বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা ৮শত বছর আগে।শুরু থেকেই এদেশে বহু বৌদ্ধের বাস বিশেষ করে চট্টগ্রাম এলাকায়। বিগত ৮ শত বছরে বাংলার বুকে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ের উপর কোন হামলা হয়েছে তার কোন নজির নেই। কিন্তু সম্প্রতি চট্টগ্রামের রামু, পটিয়া এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যা ঘটে গেল তা যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি দেশের জন্য বিপদজনক।আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুখে আবার চুনকালি লাগলো। বিশ্বব্যাপী খবর রটলো,বাংলাদেশের মাটিতে সংখ্যালঘুদের জানমাল,ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিরাপদ নয়। কিন্তু কেন এটি ঘটলো? কোন ব্যক্তির মুখ দিয়ে যখন হঠাৎ রক্তবুমি শুরু হয় তখন বুঝতে হবে এটি ভয়ানক রোধ।ত্বরিৎ সে ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে হয়,রোগনির্ণয় এবং সে সাথে রোগের চিকিৎসাও শুরু করতে হয়। চট্টগ্রামে যেটি ঘটে গেল সেটি মামূলী বিষয় নয়,বাংলাদেশের দেহে যে ভয়ানক রোগ বাসা বেঁধেছে এ হলো তারই সুস্পষ্ট আলামত। এখন সেটির আশু নির্ণয় যেমন জরুরী,তেমনি জরুরী এর আশু চিকিৎসা।
ভারতে মুসলিম শাসনের শুরুর আগে পৃথিবীর এ ভূ-ভাগে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ভয়ানক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। একসময় শুধু বাংলাতে নয়,ভারতেও ছিল বৌদ্ধ শাসন। বিখ্যাত ভারতীয় সম্রাট অশোক ছিলেন বৌদ্ধ। পরবর্তীতে হিন্দুদের দ্বারা শুধু বৌদ্ধ শাসনই নির্মূল হয়নি,নির্মূল প্রক্তিয়ায় পড়েছে খোদ বৌদ্ধরাও। সে নৃশংস নির্মূল প্রক্তিয়াটি তীব্রতর হয় হিন্দুরাজা শংকরাচার্যের শাসনামলে। তার আমলে বৌদ্ধরা ভারত থেকে প্রায় নির্মূলই হয়ে গেছে। যারা বেঁচেছে তারা পালিয়ে বেঁচেছে। সে পলায়নপর বৌদ্ধরা ভারতের উত্তর,মধ্য ও পশ্চিম ভাগ ছেড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকাতে বসতি শুরু হয়। চট্টগ্রাম তখন উত্তরভারতীয় হিন্দু শাসনের বাইরে ছিল। বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পর বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাবাণিজ্যের উপর হামলা হয়েছে সে প্রমাণ নেই। ২৩ বছরের পাকিস্তানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রি শাসনামলেও সেটি হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে সেক্যুলারিস্টদের শাসনামলে কেন হলো? কারণটি অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে, নইলে অসম্ভব এ ক্ষতিকর রোগের চিকিৎসা।
আওয়ামী লীগ শাসনমালে শুধু যে বৌদ্ধরা নিরাপত্তা হারিয়েছে তা নয়। নিরাপত্তা হারিয়েছে বাংলাদেশের সাধারন মানুষও। নিরাপত্তা হারিয়েছে এমন কি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সেসব অফিসারগণ যাদের দায়িত্ব দেশকে নিরাপত্তা দেয়া। সে নিরাপত্তাহীনতাই প্রমাণিত হলো রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু পিলখানাতে ৫৭ সামরিক অফিসারের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাদেরকে শুধু প্রাণ হারাতে হয়নি,মৃতদেহকে নর্দমায় ফেলা হয়েছে। পরিবারের মহিলাদের অনেককে ধর্ষিতাও হতে হয়েছে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের নির্মূলের অভিযান যে শুধু বিভ্রান্ত সেপাইদের দ্বারা হয়েছে তা নয়। বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে যাদের গর্ব এমন নেতাদের দ্বারাও হয়েছে। এরই উদাহরণ,এককালে আওয়ামী লীগের ক্যাডার,একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,পরে জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নেতা এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হাসানূল হক ইনু গংদের দ্বারাও হয়েছে। তারা ১৯৭৫ য়ের নভেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমুদয় অফিসারদের নির্মুলের বিপ্লব শুরু করেছিল। বহু অফিসার সেদিন নৃশংস ভাবে নিহতও হয়েছিল।
ক্যান্সারের বীজ দেহের বাইরে থেকে আসে না। বেড়ে উঠে দেহের অভ্যন্তরেই। মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বড় হামলাগুলো হয়েছে এসব ভিতরের শত্রুদের হাতে। মুসলমানগণ তাদের খেলাফত হারিয়েছে এরূপ ভিতরের ক্যান্সারের কারণে। বাংলাদেশের বেলায়ও ঘটনা ভিন্নতর নয়। ইজ্জতের উপর হামলার ন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর হামলাও হচ্ছে এসব ঘরের শত্রুদের হাতে।প্রমাণ,বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরি কর্মের নায়ক রূপে যিনি ধৃত হয়েছেন তিনি কোন বিদেশী নয়,কোন রাজাকারও নন,বরং তিন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান এবং গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা লে, জেনারেল (অবঃ)হারুনর রশিদ। এ ব্যক্তিটি জনগণের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা চুরি করেছে ডেস্টিনী নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান রূপে। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা ব্রাঞ্চ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা যারা চুরি করলো তারাও বিদেশী নয়,রাজাকারও নয়,বরং তারাও আওয়ামী ঘরানার লোক। সীমাহীন দূর্নীতির মধ্য দিয়ে মুজিব আমলে যারা দেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুড়িতে পরিণত করলো তারাও তো একই ঘরানার। প্রশ্ন হলো,দেহের মাঝে এরূপ ক্যান্সার কীরূপে বেড়ে উঠলো? এ নিয়ে কি গবেষণা হয়েছে?
রোগটি চেতনায়
কোন গ্রামে বহু মানুষ যখন একত্রে কলেরায় আক্রান্ত হয় তখন ডাক্তারদের দায়িত্ব হয় সে গ্রামের মানুষের পানির উৎস্য তলিয়ে দেখা। কারণ কলেরা পানিবাহিত রোগ। ফলে সে গ্রামের পানিতে নিশ্চিয়ই যে কলেরার জীবাণূ আছে তা নিয়ে সন্দেহ চলে না। সে পানি পান থেকে গ্রামবাসীকে তখন বিরত রাখতে হয়। সে সাথে নিশ্চিত করতে হয় বিষুদ্ধ পানির সরবরাহ।তেমনি দেশে যখন ব্যাভিচার,চৌয্যবৃত্তি,পতিতাবৃত্তি,ডাকাতি,সন্ত্রাস,সূদ,ঘুষ,দূর্নীতি ও সাম্প্রদায়ীক সহিংসতার প্রসার বাড়ে তখন সে সেদেশের জলবায়ু,আলো-বাতাস,খাদ্য-পানীয় বা অর্থনীতি নিয়ে গবেষনা করে কারণ জানা যায় না।কারণ,এরোগের জীবাণু আলোবাতাসে ভেসে আসে না। খাবারে প্লেটেও আসে না।আসে ধ্যান-ধারণা,দর্শন ও মতবাদের ঘাড়ে চড়ে। ফলে দেখতে হয়,তারা মনের বা বিবেকের খাদ্য কোত্থেকে সংগ্রহ করে সেটি।ঘুষখোর,সূদখোর,চোর-ডাকাত,ব্যাভিচারি বা সন্ত্রাসীরা যে দেশের সৎ নাগরিকদের থেকে ভিন্ন জলবায়ুতে বাস করে বা ভিন্ন পানাহার গ্রহণ করে তা নয়। বরং তারা এক ভিন্ন ধরণের ধর্ম,ধ্যান-ধারনা ও চেতনার ধারক। এগুলো পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন আসে চরিত্র এবং আচরণেও ।
বাংলার যে মুসলমানগণ বিগত ৮শত বছরের ইতিহাসে বৌদ্ধদের ঘরে ও মঠে আগুণ দিল না,তাদের হঠাৎ কি হলো যে সে কুকর্মগুলো হাজার মানুষ এখন একত্রে শুরু করলো? এ পরিবর্তনটি সাম্প্রতিক। বাংলাদেশীদের ধ্যান-ধারণা ও দর্শনে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এ হলো তারই প্রমাণ। এ নৃশংস পরিবর্তনটি প্রথম ধরে পড়ে ১৯৭১য়ে। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম যারা হিংস্র কুকর্মের শিকার হয় তারা এদেশে বসবাসকারি অবাঙালীরা –বিশেষ করে বিহারীরা। তখন বাঙালীর হাতে বহু লাখ অবাঙালী মারা গেছে। তাদের লাশ কুকুর শৃগালে খেয়েছে বা নদীতে নদীতে পচে পচে নিঃশেষ হয়েছে। বহু হাজার অবাঙালী নারীও ধর্ষিতা হয়েছে। তাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ী সেদিন বাঙালীদের হাতে জবর দখল হয়েছে।এসবই বাঙালীর ইতিহাস, অস্বীকারের উপায় নাই। ঘরবাড়ী হারানো সে বহু লক্ষ অবাঙালীরা আজও ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করে সে বর্বরতার স্বাক্ষর বহন করছে। বাঙালীর বিবেক সেদিন এতটাই মারা পড়েছিল যে সন্ত্রাসী কুকুর্ম থেকে তাদের বাঁচাতে বাংলাদেশের কোন সরকার,কোন পুলিশ,কোন রাজনীতিবিদ,কোন বুদ্ধিজীবি ও কোন মিডিয়াকর্মী এগিয়ে আসেনি। অবাঙালীদের বর্বরতা নিয়ে বাংলাদেশে শত শত বই লেখা হয়েছে। বহু নাটক ও বহু সিনেমাও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু অবাঙালীদের উপর ঘটে যাওয়া এ বাঙালী বর্বরতা নিয়ে বই দূরে থাক বাঙালী সেক্যুলারিষ্টদের পক্ষ থেকে একটি নিবন্ধও লেখা হয়নি। বাংলাদেশী সেক্যুলারিষ্টদের দুর্বৃত্তির স্বাক্ষর তাই শুধু দূর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার শীর্ষস্থান দখল করাটা নয়,তার চেয়েও বড় স্বাক্ষর হলো বাঙালী বর্বরতার বিরুদ্ধে এমন নীরবতায়। একাত্তরের বাঙালী বর্বরতার কিছু চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে যিনি তুলে ধরেছেন তিনি কোন বাংলাদেশী নন,বরং এক ভারতীয় বাঙালী শর্মিলা বোস। তিনি সে চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর “ডেড রেকনিং” বইতে। যে জাতি নিজ দেহের ভয়ংকর ক্যান্সার নিয়ে ভাবে না, বরং খোঁজে বেড়ায় অন্যের দোষ সে জাতি কি ধ্বংস ও অপমান এড়াতে পারে?
নিহত হয়েছে মনের পুলিশ
মানুষ তখনই কুকর্ম করে যখন কোন জবাবদেহীতার ভয় থাকে না। সে ভয় তুলে নিলে সমাজের অনেক সুবোধ মানুষই চোর,ডাকাত,লম্পট ও ঘুষখোরে পরিণত হয়। মুসলমানের জীবনে সে জবাবদেহীতার ভয়টি হলো,রোয-হাশরের বিচার দিনে আল্লাহর কাছে হিসাব দেয়ার। এটিই মু’মিনের আখেরাতের ভয়। ইসলাম কবুলের সাথে সাথে বর্বর আরববাসীর জীবনে যে চারিত্রিক বিপ্লব শুরু হয়,হাজার হাজার আরব যার ফলে মহামানবে পরিণত হয় এবং জন্ম দেয় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার,তার মূলে ছিল এই আখেরাতের ভয়। একেই বলা হয় প্যারাডাইম শিফ্ট। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তারা যে মহান আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করতো না তা নয়। আল্লাহর উপর বিশ্বাসই শুধু নয়,নিজ সন্তানের নাম “আব্দুল্লাহ” বা আল্লাহর দাসও রাখতো। কিন্তু ছিল না আখেরাতের ভয়। ইসলাম কবুলের পর তাদের মনে প্রবেশ করে আখেরাতের ভয়। সে ভয় তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে ভয়টির কারণে ক্ষুদার্ত রোযাদার যেমন নির্জনেও পানাহার করে না,তেমনি সুযোগ পেলে কারো সম্পদে বা ইজ্জতে হাত দেয় না।
বাংলাদেশ যে কারণে এতকাল অপরাধ কর্মে বিশ্বরেকর্ড গড়েনি সেটি পুলিশ বা আদালতের ভয় ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন কালেই এত পুলিশ ছিল না,এত আদালতও ছিল না। হাওর-বাওর,খালবিল,নদনদী ও চরভূমিতে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের সর্বত্র পুলিশের পৌঁছার সামর্থও ছিল না। তবে যা ছিল তা জনমনে পরকালের ভয়। ছিল আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতার ভয়। এমন ভয় ব্যক্তির মনে সদাজাগ্রত পুলিশের কাজ করে। এমন ভয়ের কারণে আল্লাহর প্রতিটি হুকুম পালনে মু’মিন ব্যক্তি অতি নিষ্ঠাবান হয়। আর ঈমানদারের উপর মহান আল্লাহতায়ালা হুকুম হলো, “আমিরু বিল মারুফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার” অর্থাৎ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল। এটিই আল্লাহর নির্দেশিত মিশন। মু’মিনের জীবনে এ মিশন নিয়ে বাঁচার তাড়না না থাকলে বুঝতে হবে তার ঈমানও নাই। কারণ ঈমানদার রূপে বাঁচার লক্ষ্যটি তো এছাড়া পূরণ হয় না। তখন সে বাঁচে অন্য মিশন নিয়ে। তখন ঘটে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা। এমন অবাধ্যতায় রোজ হাশরের বিচার দিনে ভয়ানক বিপদ অনিবার্য। সে বিপদ এড়াতেই ঈমানদার অতি দায়িত্বশীল হয়,পরিণত হয় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে আমৃত্যু পুলিশ। সে মিশন নিয়ে সে যেমন রাজনীতি করে,তেমনি শিক্ষাকতা করে,লেখালেখি করে এবং প্রয়োজনে জিহাদও করে। ফলে গ্রামের বা মহল্লার কোন গৃহে ডাকাতের হামলা হয়েছে এ খবর শুনে ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে বিছায় শুয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পরে। এমন সদাজাগ্রত বিবেকের মানুষরা অতীতে ডাকাত ধরতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে ঈমান,সে বিবেক ও সে জবাবদেহীতা সুপরিকল্পত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেটি সেক্যুলার শিক্ষা ও সেক্যুলার রাজনৈতীক দর্শন ছড়িয়ে। এতে নিহত হয়েছে মনের পুলিশ। এবং নেমে এসেছ বিবেকের অন্ধত্ব। মানব মনের এটিই সবচেয়ে বড় রোগ। চোখের রোগে মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারায়,আর বিবেকের অন্ধত্বে হারায় হিতাহিত জ্ঞান।অতিশয় অন্যায় ও জঘন্য দুষ্কর্মও তখন ন্যায় মনে হয়। ন্যায় মনে হয় অন্যের ঘরে বা উপাসনালয়ে আগুন দেয়া।অথচ অমুসলমানদের উপাস্যকে গালি দিতে এবং তাদের উপাসনালয়কে ধ্বংস করতে নিষেধ করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা। অথচ অজ্ঞতার কারণে পবিত্র কোরআনের সে নির্দেশটি তাদের দেখতে পায় না।১৯৭১য়ে এমন জ্ঞানশূণ্য,বিবেকশূণ্য ও ধর্মশূণ্য বাঙালীদের কবলে পড়েছিল লক্ষ লক্ষ অবাঙালীরা। আর সম্প্রতি পড়েছে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা।
অথচ আজ থেকে ৬০ বছর আগেও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন ছিল। তখনও দারিদ্র ছিল, কিন্তু সে সাথে জাগ্রত বিবেকও ছিল। ফলে উদার মনে তারা নিজ ঘরের পাশে জায়গা করে দিয়েছিল পশ্চিম বাংলা,বিহার,আসাম ও ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে প্রাণ বাঁচাতে মুসলমানদের। অধিকাংশ মানুষের ঘরে তখন দরজা ছিল না।কাদামাটি,পাঠকাঠি ও চাটাইয়ের বেড়া ছাড়া ঘরে কোন বেড়া ছিল না। কাছে থানা বা পুলিশও ছিল না।তারপরও চুরি-ডাকাতি ও খুনখারাবী এতটা হতো না যা আজ হয়।নারীরা আজকের মত ধর্ষিতাও হতো না। লক্ষ লক্ষ নারী দেহবিক্রয়েও নামতো না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকলেও তখন তাদের মনে আল্লাহর ভয় ছিল। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা লক্ষ লক্ষ সার্টিফিকেট বিতরণ করলেও কেড়ে নিয়েছে ঈমান।কেড়ে নিয়েছে আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতার ভয়। ফলে সেক্যুলার মানুষটি পরিণত হয়েছে শিকার সন্ধানী জীবে। শিকার খুঁজছে অফিসে বসে,দোকানে বসে,রাজনৈতীক দলের অফিসে বসে,এমনকি মসজিদ-মাদ্রাসায় বসে। এরই ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে -মানুষ যেখানে নীতি-নৈতীকতা শিখতে যায়,সেখানেও ছাত্ররা অহরহ লাশ হচ্ছে,আহত হচ্ছে এবং ধর্ষিতাও হচ্ছে।
তবে আখেরাতে ভয়শূণ্য সেক্যুলার মানুষেরাও যে অপরাধ থেকে দূরে থাকে না তা নয়। তারা অপরাধ থেকে দূরে থাকে স্রেফ প্রশাসন,পুলিশ ও আদালতের ভয়ে। সে ভয় বিলুপ্ত হলে অপরাধ-কর্মের প্লাবন শুরু হয়। সে প্লাবন যে কতটা ভয়ানক হতে পারে সেটির প্রমাণ মিলেছে নিউয়র্ক শহরে কিছু কাল আগে রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায়।সে রাতে চুরি,লুটতরাজ ও ধর্ষণের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়েছিল। পাশ্চাত্য দেশে এজন্যই জরুরী হলো দেশবাসীর মনে প্রশাসন,পুলিশ ও আদালতের ভয় বৃদ্ধি করা। সে ভয় বাড়াতে দেশের প্রতিটি গলি,প্রতিটি মহল্লা,প্রতিটি পার্ক ও প্রতি নির্জন মেঠো পথে বসানো হয়েছে লুকানো ক্যামেরা। দিবারাত্র ২৪ ঘন্টা ধরে ক্যামেরার সে ছবিগুলো মনিটরিং করা হয়। সে সাথে গড়ে তুলেছে জেনেটিক টেস্টসহ অপরাধী সনাক্তিকরণের জটিল বিজ্ঞান (ফরেনসিক সাইন্স)।এর সুফল হলো,রাতের গভীর আঁধারে গ্রামের কোন মেঠো পথে বা নির্জন পার্কে কেউ খুণ হলে বা ডাকাতির শিকার হলে পাশ্চাত্য দেশের পুলিশ সে অপরাধিকে সহজেই ধরে ফেলে।আদালত এমন অপরাধীর দ্রুত শাস্তিরও ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেশে যখন এমন নজরদারি থাকে না এবং প্রশাসন,পুলিশ ও আদালত পরিণত হয় দুর্বৃত্তদের মিত্র বা প্রতিপালকে তখন জনগণের মন থেকে বিলুপ্ত হয় গ্রেফতারির ভয়। সন্ত্রাসীরা তখন অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে ঘুরে। তখন দিনে-দুপুরে ডাকাতি হয়। এবং লাশ হয় নিরীহ মানুষ। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে সেরূপ ঘটনা অহরহ ঘটছে। এরূপ অস্ত্রধারিদের চিত্র পত্রিকাতেও ছাপা হয়। তবে পুলিশের হাতে খুনি ও সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার হচ্ছে সে খবর নেই। কারণ ঘটনার নায়ক সরকারি দলের ছাত্ররা। তাদের স্পর্শ করার সামর্থ পুলিশের নেই। র্যাব বা সেনাবাহিনীরও নেই। বরং পুলিশই এদের হাতে অনেক সময় চড়থাপ্পর খাচ্ছে। লাথি খাচ্ছে আদালতের দরজা। কারণ অপরাধ কর্মের এসব নায়কদের সমর্থণে রয়েছে সরকারি দলের মন্ত্রী ও নেতা। মন্ত্রীদের চাপে পুলিশের কাজ হয়,সরকারি দলের অপরাধিদেরকে আদালতের শাস্তি থেকে বাঁচানো। আসামী করা হয় সরকারি সন্ত্রাসীদের হাতে আহতদের। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসের ঘটনায় সেটিই ঘটেছে। ছাত্রলীগের অস্ত্রধারিদের বিরুদ্ধে আহত ছাত্রদের মামলা পুলিশ নথিভূক্ত করতেও রাজি হয়নি।
এ বিপদ সেক্যুলারিজমসৃষ্ট
সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ ইহলৌকিকতা। এখানে পারলৌকিক বা আখেরাতের ধারণা নেই। আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতার কোন ভয়ও নাই। সেক্যুলার মানুষটি কাজকর্ম করে স্রেফ ইহলৌকিক সুখশান্তি ও সম্ভোগ বাড়াতে।পরকালের ভয় এবং সে ভয়ের কারণ যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মকর্ম –এগুলি তাদের কাছে সেকেলে ও সাম্প্রদায়িক মনে হয়। ভোগের আয়োজন বাড়াতে এমন সেক্যুলারগণ তাই প্রচণ্ড স্বার্থপর হয়। পার্থিব জীবনে আনন্দ-সম্ভোগ বাড়াতে এজন্যই সেক্যুলার সমাজে কদর বাড়ে মদ-জুয়া,নাচ-গান,অশ্লিলতা ও ব্যাভিচারের।সে সম্ভোগে প্রয়োজন পড়ে অর্থের। আর অর্থের আয়োজন বাড়াতে তখন আগ্রহ বাড়ে চুরি-ডাকাতি ও সন্ত্রাসে। অর্থের প্রয়োজনে আগ্রহ বাড়ে এমনকি বিদেশী শক্তির পক্ষে লেজুড়বৃত্তিতে।একারণেই কোন দেশে সবচেয়ে বড় সেক্যুলারিস্ট শুধু সেদেশের চোর-ডাকাত,সন্ত্রাসী ও দেহব্যবসায়ীগণ নয়,বরং তারাও যারা ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ,ঘুষখোর অফিসার,সুদখোর মহাজন এবং এনজিও নেতা-কর্মী। আখেরাতের ভয়-ভাবনা তাদের চেতনাতে থাকে না। ফলে দেশে সেক্যুলারিজমের প্রতিষ্টা বাড়লে শুধু চোর-ডাকাত,সন্ত্রাসী,খুনি এবং ব্যাভিচারির সংখ্যাই বাড়ে না,বিপুল হারে বাড়ে ক্ষমতালোভী রাজনৈতীক দল,বাড়ে রাজনৈতীক হানাহানি,বাড়ে এনজিও এবং বাড়ে অশ্লিলতা। এরই উজ্বল দৃষ্টান্ত হলো আজকের বাংলাদেশ। কারণ একাত্তরের পর যে দর্শনটির সবচেয়ে বেশী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা বাড়ানো হয়েছে সেটি সেক্যুলারিজম।ইহজাগতিক সম্ভোগ বাড়াতে পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিস্টগণ শুধু মদ,জুয়া,ব্যাভিচার,সেক্সট্যুরিজম,হোমোসেক্সুয়ালিটিই বাড়ায়নি,আন্তর্জাতিক ডাকাতেও পরিণত হয়েছে। তাদের সে আন্তর্জাতিক ডাকাতি কর্ম মানব ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ রূপে।আজ সেটিই পরিণত হয়েছে বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদে। অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধ,বিশাল দুটি বিশ্বযুদ্ধ,ইথনিক ক্লিনজিং ও সাম্রাজ্যবাদসহ বহু কুকীর্তির জনক এই পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিস্টগণ। সেক্যুলারিজম যে দেশে যায় সেদেশে এ বিপদ গুলোও সাথে নিয়ে যায়।ফলে বাড়ে বিপর্যয়।
এত কুকর্ম কেন আওয়ামী আমলে?
বিবেক ও ন্যায়নীতি সবার এক নয়।তেমনি এক নয় সবার বিবেকের পচন। জনে জনে তেমনি একই রূপ নয় সেক্যুলারিজমের তাণ্ডব। যার মাঝে এবং যে সংগঠনে সেক্যুলারিজমের প্রভাব যত বেশী,দুর্বৃত্তিও সেখানে তত অধিক। বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তি তাই সমভাবে বাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের উপর সেক্যুলারিরজমের যে প্রভাব,মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে সেটি নেই। উভয়ের মাঝে বিশাল পার্থক্য তাই অপরাধ কর্মে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যেরূপ ব্যাভিচার,সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তি সেটি মাদ্রাসাতে নেই। একই কারণে পার্থক্য গড়ে উঠেছে সেক্যুলার দল বা ইসলামি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম সবচেয়ে বেশী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে। দেশে সেক্যুলারিজমের তারাই মূল ফেরিওয়ালা। ফলে পার্থিব স্বার্থচেতনার ক্ষেত্রে দেশের বাঁকি নাগরিকদের থেকে তারা অনে বেশী অগ্রসর। তাই অতি অগ্রসর দুর্বৃত্ত মানব উৎপাদনেও। মুজিব আমলে ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের প্রধান ও তৎকালীন রেড ক্রসের প্রধান ছিল গাজী গোলাম মোস্তাফা। রিলিফসামগ্রী চুরি ও নানাবিধ দুর্নীতিতে সে রেকর্ড গড়েছিল। সেসময় দেশী ও বিদেশী পত্র-পত্রিকাতে তার কুকীর্তির বহু কাহিনী ছাপা হয়েছে। চুরিতে সম্প্রতি রেকর্ড গড়লো আরেক মুক্তিযোদ্ধা লে.জেনারেল (অবঃ) হারুন অর রশীদ। অপর দিকে ধর্ষণে সেঞ্চুরির যে রেকর্ড,সেটিও এক ছাত্রলীগ কর্মীর। সেক্যুলারিস্টদের বড় হতাশা,এমন চোর ও এমন ব্যাভিচারি তারা রাজাকারদের মাঝে এ অবধি খুঁজে পায়নি। মাছ যেমন তার ঝাঁক চিনতে ভূল করে না,দূর্নীতিবাজও তেমনি দল চিনতে ভূল করে না। গাজী গোলাম মোস্তাফা,লে.জেনারেল (অবঃ) হারুন অর রশীদ,সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন,মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনের মত লোকেরা তাই দল চিনতে ভূল করেনি।
আওয়ামী লীগের বড় গর্ব সেক্যুলারিস্ট হওয়া নিয়ে। একারণেই দুর্নীতির বড় রেকর্ডও নির্মিত হয়েছে আওয়ামী শাসনামলে। বাংলাদেশের অন্যরা যে ফেরেশতা -তা নয়। কিন্তু অন্যদের আমলে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর হামলা হয়নি।পাকিস্তান আমলেও হয়নি। অন্যদের আমলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে বা শেয়ার বাজারের বহু হাজার কোটি টাকা উধাও হয়েছে সে নজির নেই।দূর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ স্থগিত হয়নি। কিন্তু সেগুলি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় হচ্ছে।অথচ আওয়ামী লীগ নেতারা যে ভিন্ন জাতের ভাতমাছ খায় বা ভিন্ন আলোবাতাসে বাস করে -তা নয়। বরং বড় পার্থক্য হলো,তাদের মগজ পরিপূর্ণ পার্থিব স্বার্থচেতনায়।এবং তারা সেটি পেয়েছে সেক্যুলারিজম থেকে। পেয়েছে আখেরাতের ভয় বর্জন করার মধ্য দিয়ে।
তবে পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিস্টদের তুলনায় বাংলাদেশের বিপদটি আরো গভীর ও ভয়ানক। কারণ, সেক্যুলারিজমের প্রতিষ্টা বাড়িয়ে বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ বিপুল সংখ্যক মানুষের মন থেকে আখেরাতের ভয় বিলুপ্ত করতে সমর্থ হলেও ব্যর্থ হয়েছে পাশ্চাত্য দেশের ন্যায় অপরাধ দমনে সফল প্রশাসন,দক্ষ পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। ফলে ভেসে গেছে অপরাধ বিরোধী বেড়িবাঁধ। এতে দেশ ছেয়ে গেছে অপরাধ কর্মের প্লাবনে। ফলে অলিম্পিকে কোন মেডেল না জিতলে কি হবে, দুর্নীতে বিশ্বের ২০০টির বেশী দেশকে দ্রুত অতিক্রম করে ৫ বার প্রথম হয়েছে।
সরকারের এজেণ্ডা
বাংলাদেশের পুলিশ,প্রশাসন ও সরকারের মূল এজেণ্ডা অপরাধ দমন নয়। অপরাধীদের গ্রেফতার করা বা আদালতের কাঠগড়ায় তাদের খাড়া করাও নয়। বরং এজেণ্ডা হলো রাজনৈতিক শত্রুদের নির্মূল। এজন্য পুলিশের ও সরকারি উকিলদের মূল কাজ হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক শত্রুদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে জামিনের অযোগ্য মামলা খাড়া করা। অর্থাৎ মামলা উৎপাদন। সে সাথে আরো দায়িত্ব হলো,নিজ দলীয় অপরাধীদের পুলিশ ও জনগণের হাত থেকে সর্বদা প্রটেকশন দেয়া্। তাই ছাত্র লীগ বা যুব লীগের ক্যাডারগণ রাজপথে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানুষ খুন করলেও তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা নেয় না। বরং তাদের কাজ,ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক শত্রুগণ আজ থেকে ৪০ বছর আগে কি করেছিল তার অনুসন্ধানে লেগে যাওয়া এবং সেগুলি আদালতে প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্যসাবুদ তৈরী করা। অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থণ করাকে তারা ফৌজদারি অপরাধে পরিণত করেছে। আদালত পরিনত হয়েছে রাজনৈতীক হাতিয়ারে।
রাজনৈতীক বিরোধীদের নির্মূলের বিষয়টি সরকারের এতই গুরুত্ব পেয়েছে যে জনগণের জানমাল,ঘরবাড়ী,ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় তাদের নাই। এ কারণেই সেনাবাহিনীর অফিসারগণ যখন পিলখানায় নিহত হলো,তাদের বাঁচাতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারেনি। চট্টগ্রামে যা ঘটে গেল সেটি সরকারের সে চরিত্রটি আবার প্রকাশ করে দিল। পত্রিকাতে প্রকাশ, ২৯/৯/১২ তারিখের রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা মধ্যে রামুতে প্রায় শ’খানেক লোকের একটি মিছিল হয়। এরপর ভোর ৫ টা পর্যন্ত বৌদ্ধদের গৃহ,বিহার ও প্যাগোডায় লুটপাট,ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। পরের দিন পটিয়াতে একই ঘটনা ঘটে। ১৫টি বৌদ্ধ বিহার,মন্দির ও প্যাগোডা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়ানো হয়েছে ১৮টি বাড়ি। লুন্ঠিত হয়েছে সোনার মুর্তি।পত্রিকায় আরো প্রকাশ,আগুন লাগানো হয়েছিল গান পাউডার দিয়ে।
বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলো জনমানবশুণ্য গভীর জঙ্গলে ঘটেনি। ঘটেছে পুলিশের নাকের ডগার উপর। রামুর যে বৌদ্ধ বিহারটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেটি থানা থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে। সে স্থান থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে জেলার পুলিস সুপারের অফিস এবং মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে সেনা ক্যাম্প। এত কিছু থাকার পরও কেমন করে এতবড় বীভৎস কান্ডটি এত দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘটার সুযোগ পেল? গ্রামের কোন ঘরে আগুন লাগলে শুধু সে গ্রামের মানুষই নয়,পাশ্ববর্তি বহু গ্রামের মানুষ ছুটে আসে। কিন্তু রামুর বৌদ্ধ বিহারটি বাঁচাতে কোন পুলিশ যায়নি।খবর যে আধা কিলোমিটার দূরের থানা পায়নি সেটি কি বিশ্বাস করা যায়? গ্রামের কোন ঘরে আগুণ লাগলে সে খবরটি সমগ্র গ্রামবাসী ত্বরিৎ বেগে পেয়ে যায়। ঘুমন্ত মানুষও সে খবরে জেগে উঠে। এত কাছে থেকেও থানা যদি সংবাদ না পেয়ে থাকে তবে সমস্যা তো আরো ভয়ানক। দেহের এক অঙ্গে আগুন লাগলে যদি অন্য অঙ্গ টের না পায় তবে সেটি তো গুরুতর।এ রোগ তো জ্ঞান বা প্রাণ হারানোর। পুলিশ কি তবে সে রোগে আক্রান্ত? কিন্তু রোগ এখানে সেটি নয়। কোন আওয়ামী লীগ নেতার ঘরে হামলা হলে পুলিশ কতটা সজাগ ও শক্তি রাখে সেটি নিশ্চয়ই দেখিয়ে দিত। তখন বহু মানুষের মাজায় রশি ও হাতে পায়ে বেড়ি বেঁধে থানায় হাজির করতো। মূল প্রশ্নটি এখানে পুলিশ,প্রশাসন ও সরকারের এজেন্ডা নিয়ে। এজেন্ডা যদি হয়কোন ব্যবস্থা না নেয়া এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের ইজ্জত ডুবানো,তখন প্রচন্ড সোরগোলের সাথে লুটতরাজ,ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ সেটি টের পাবে না। থানার দরজায় লাগাতর ধাক্কা দিলেও পুলিশ তখন বাইরে বেরুবে না। পুলিশ ও প্রশাসন তখন জেগে জেগে ঘুমাবে। বৌদ্ধদের উপর হামলার সময় তো অবিকল সেটিই ঘটেছে।
পাশ্চাত্য দেশের কোন শহরে বা গ্রামে আগুন লাগলে বা কারো উপর হামলা হলে পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ীর সেখানে পৌঁছতে সাধারণতঃ ১০ মিনিটের বেশী লাগে না। এমন বিপদে মানুষ ৯৯৯য়ে ফোন করে। পুলিশের এ ফোন নাম্বারটি দেশের শিশুরাও জানে। পুলিশের দায়িত্ব হলো ফোন পাওয়া মাত্র ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে যাওয়া। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ফোনের সংখ্যা বেড়েছে,বেড়েছে গাড়ীর সংখ্যাও।কিন্তু গড়ে উঠেছে কি বিপদের মুখে জনগণের বাঁচানোর কোন সুব্যবস্থা? বাংলাদেশে সেটি হয়নি।কারণ সরকারের সেটি প্রায়োরিটি নয়। দেশের সরকার,প্রশাসন,পুলিশের মাথা ব্যাথা অন্যত্র। সরকার চায়,পুলিশকে রাজনৈতীক বিরোধীদের দমনে লাঠিয়াল রূপে ব্যবহার করতে। চোর-ডাকাত বা খুনিরা সরকারের গদীতে হামলা করে না। ফলে তারা সরকারের রাজনৈতীক শত্রুও নয়। তাদের ধরা তাই পুলিশের মূল প্রায়োরিটি নয়। জনগণের জানমালের পাহারা দেয়াও তাই পুলিশের মূল কাজ নয়। বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সে বিষয় গোপন রাখেননি। তিনি বলেছেন, “কারো বেডরুম পাহারা দেয়া পুলিশের পুলিশের কাজ নয়”। বরং পুলিশের কাজ হলো মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি ও বেডরুম পাহারা দেয়া। সে দায়িত্বপালনে পুলিশকে দিবারাত্র ক্ষমতাসীন লোকদের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে হয়। শহরের বা গ্রামে কোথায় মানুষ খুন হলো বা কার ঘরে আগুন লাগলো সে খবর নেয়ার সময় কোথায়? পথের মানুষ তাদেরকে ফোনে ডাকবে এবং সে ডাকে সেখানে গিয়ে হাজির হবে -সেটি ভাবাও তাদের কাছে অসম্মানজনক মনে হয়। প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সংস্কৃতিই ভিন্ন। দায়িত্বপালনে অবহেলায় কোন মন্ত্রীর বা দলীয় নেতার প্রাণ গেলে পুলিশের চাকুরি যায়। কিন্তু শত শত জনগণের প্রাণ গেলে বা মসজিদ,মন্দির বা মঠ আগুনে ভস্মিভূত হলে পুলিশের চাকুরি যাওয়া দূরে থাক, তাদের কি সামান্য তিরস্কারও করা হয়? বরং সরকার তখন পুলিশের পক্ষ নেয়। চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের সাথে যা কিছু ঘটেছে সে জন্য তাই কোন পুলিশ বা র্যাব অফিসারের চাকুরি যাইনি। তিরস্কার বা জবাবদেহীতার মুখেও পড়তে হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী এসব কুকর্মের জন্য দায়ী করেছেন স্থানীয় বিরোধীদলীয় নেতাদের।কারণ, সরকার প্রধানের কাছে এটি সবচেয়ে সহজ কাজ। এবং এমন দোষারপে সরকারের রাজনৈতীক লাভও।
সামনে মহাদুর্দিন
বাংলাদেশ ১৬ কোটি মুসলমানের দেশ। অমুসলিম বিশ্বজুড়ে আজ ইসলাম ভীতি। বিশ্বজুড়া সভ্যতার দ্বন্দে মুসলমানগণ গণ্য হচ্ছে পাশ্চাত্যের শত্রুপক্ষ রূপে। যে দেশে যত মুসলিম জনসংখ্যা,সেদেশ নিয়ে তাদের ততই ভীতি। বাংলাদেশ এজন্যই আজ শীর্ষতালিকায়। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের যেমন ভীতি,তেমনি ভীতি পাশ্চাত্যের আগ্রাসী শক্তিবর্গের। ফলে যারাই ইসলামপন্থিদের দমনে নিষ্ঠুরতা দেখায় তাদের সে জঘন্য অপরাধকর্মগুলিও তখন পাশ্চাত্যের কাছে ইম্যুনিটি পায়। তাই ইসরাইল যখন ফিলিস্তিনীদের হত্যা করে বা ভারত যখন কাশ্মীরীদের উপর গণহত্যা চালায় তখন সেটি মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের কাছে নিন্দনীয় হয় না। একই কারণে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নিন্দনীয় হচ্ছে না ইসলামপন্থিদের উপর আওয়ামী সরকারের নির্যাতন। আওয়ামী লীগের নেতারা সেটি বুঝে। ফলে তারা চায়,বাংলাদেশকে নিয়ে পাশ্চাত্যবাসীর মনে সে ভীতিকে আরো বাড়াতে। এবং ভারতসহ পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গের এ কথাও বুঝাতে চায়, বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের দমনের বিকল্প নাই। এবং বলতে চায়,আওয়ামী লীগ ছাড়া বিকল্প দল নাই। ইসলাম পন্থিদের উপর নির্যাতনে তারা যে পারদর্শিতা দেখিয়েছে তাতে পাশ্চাত্যের কাছে তাদের বাজারদরও বেড়েছে।
এ নিয়ে সন্দেহ নাই,ভারত এবং পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির উত্থানের বিরোধী। ফলে আওয়ামী লীগ যেভাবে ইসলামপন্থিদের নির্মূলে নেমেছে তাতে তারা প্রচণ্ড খুশি। অন্ততঃ এ বিষয়টিতে ইসলামের আন্তর্জাতিক শত্রুপক্ষের সাথে আওয়ামী লীগের ঐক্যটি অটুট। বিগত নির্বাচনে তাদের আশির্বাদ গিয়ে পড়েছিল তাই আওয়ামী লীগের পক্ষে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতীক কৌশলটি হলো নিজেদের রাজনৈতীক শত্রুদেরকে শুধু নিজেদের শত্রু রূপে নয়,পাশ্চাত্যের শত্রু রূপেও চিত্রিত করা। এবং এভাবে চায়,রাজনৈতীক প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের যেভাবে হত্যা,গুম ও জেলবন্দী করার উদ্যোগ নিয়েছে তার প্রতি াবেবিদেশী শক্তির লাগাতর সমর্থণ। এজন্যই চায়, সংখ্যালঘুদের কাছে বাংলাদেশকে একটি বিপদজনক রাষ্ট্র রূপে চিত্রিত করতে। এ লক্ষ্য পূরণে দলটির বুদ্ধিজীবীরা অতীতে বহুবই ও বহুভিডিও প্রস্তুত করে বিদেশীদের কাছে ছড়িয়েছে। তবে সেটি প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন হলো,সংখ্যালঘুদের উপর হামলা। অতীতে একই লক্ষ্যে হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে। মন্দিরও ভাঙ্গা হয়েছে। তবে সেসব হামলায় কোন ইসলামী দল বা মাদ্রাসার ছাত্ররা জড়িত ছিল তা আজ অবধি আদালত প্রমাণ করতে পারিনি। সে অভিন্ন স্ট্রাটেজীরই অংশ রূপে এবারে বলি হলো চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার প্রয়োজনে আরো অনেককে যে ভবিষ্যতে এভাবে বলি হতে হবে –সে বিষয়ে কি সন্দেহ আছে? ইরানের শাহ তার নিজের গদী বাঁচাতে দর্শকভর্তি সিনেমা হলে আগুন দিয়ে দোষ চাপিয়েছিল ইসলামপন্থিদের উপর। দেশে দেশে ইসলামের শত্রুপক্ষ যে কতটা বর্বর ও মানবতাশূন্য এ হলো তার প্রমাণ। ফলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা চাইলেও সংখ্যালঘুদের উপর হামলা রোধের ক্ষমতা তাদের হাতে নাই।ইসলামপন্থিদের এবং সে সাথে বাংলাদেশের মুখে কালিলেপনের কাজ অতীতে যেমন হয়েছে,তেমনি ভবিষ্যতে হবে।
দেশটি আজ বিবেকহীন স্বার্থশিকারীদের হাতে জিম্মি। তাদের কাছে নিজেদের রাজনৈতীক স্বার্থটিই মূল। দেশের স্বার্থ ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থ তাদের কাছে মূল্যহীন। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে এরা যেমন নদীর পানি বিদেশীর হাতে তুলে দিতে পারে,তেমনি দেশের মধ্য দিয়ে করিডোরও দিতে পারে।নির্মূল করতে পারে দেশের অর্থনৈতীক ও সাংস্কৃতিক সীমান্ত। তেমনি দেশকে চরমপন্থি-কবলিত প্রমাণ করতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গাও বাধাতে পারে। শুধু সংখ্যালঘুদের নয়,দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের জানমালও তাদের কাছে নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় দেশের স্বাধীন অস্তিত্ব।নিছক গদী বাঁচানোর স্বার্থে শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়েছিলেন। বাকশালী মুজিব কেড়ে নিয়েছিলেন জনগণের নূন্যতম মানবিক অধিকার। ভারতের সাথে মুজিব স্বাক্ষর করেছিলেন ২৫ সালা দাসত্বচুক্তি,-এভাবে শৃঙ্খলিত হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা। ভারতীয় পণ্যের জন্য খুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সীমান্ত। ভারতকে অধিকার দিয়েছিলেন ফারাক্কার পানি তুলে নিয়ে বাংলাদেশের বিশাল ভূ-ভাগকে মরুভূমি বানানোর প্রকল্প নিয়ে সামনে এগুনোর। এটিই শেখ মুজিবের ঐতিহ্য বা লিগ্যাসী। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামীগের বর্তমান নেতৃত্ব শেখ মুজিবের সে ঐতিহ্যের ষোলআনা প্রতিষ্ঠা চায়। বাংলাদেশের এখানেই মূল বিপদ। সামনে দুর্দিন তাই শুধু সংখ্যালঘুদের নয়,সমগ্র দেশবাসীর।১৫/১০/২০১২
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018