ভারতীয় নির্বাচনঃ বিশাল বিজয় অপরাধীদের
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on June 14, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, আর্ন্তজাতিক
- No Comments.
অপরাধীদের নিরংকুশ বিজয়
২০১৯ সালের ভারতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় জুটলো ভয়ানক অপরাধীদের। তাদের বিজয়ে ভারতের ২০ কোটি মুসলিম এবং বহু কোটি খৃষ্টান ও তথাকথিত দলিত বা অচ্ছুৎদের জীবনে যে দ্রুত দুর্গতি নেমে আসবে -তা নিয়ে সন্দেহ অতি সামান্যই। জোরদার হবে আসাম থেকে ৪০ লাখ মানুষের গায়ে বাংলাদেশীর লেবেল লাগিয়ে যে দেশত্যাগে বাধ্য করার ন্যায় বহুবিধ মুসলিম বিরোধী উদ্যোগ। সে নৃশংসতা ছড়িয়ে পড়বে পশ্চিম বাংলাতেও। কিন্তু তাতে পরিনামে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে খোদ ভারত -তা নিয়েও কি কোন সন্দেহ আছে? অপরাধীদের বিজয়ে কোন দেশই লাভবান হয়না। বরং বাড়ে অপরাধ কর্ম ও অশান্তি। তাছাড়া বিজয়ী অপরাধীগণ যে ভয়ানক অপরাধী -সে বিষয়টি কোন গোপনীয় বিষয় নয়। নরেন্দ্র মোদী ও তার সেনাপতি অমিত শাহের হাতই শুধু গুজরাতের মুসলিম রক্তে রঞ্জিত নয়, রক্তের গন্ধ আসে আরো অনেক বিজয়ী এমপি ও মন্ত্রীদের গা থেকেও। নিছক অহিন্দু হওয়ার অজুহাতে যে দেশের ২০ কোটি মানুষকে –যা জার্মান, ইংল্যান্ড বা ফান্সের জনসংখার তিনগুণের অধীক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গণ থেকে পরিকল্পিত ভাবে দূরে রাখা হয়, সে দেশে কল্যাণকর কিছু কি আশা করা যায়? কল্যাণমুখি সরকারের কাজ তো ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাত-পাতের উর্দ্ধে উঠে দেশের বেকার নাগরিকদের কাজ দেয়া, কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রাখা নয়। অথচ ভারতে ২০ কোটি মুসলিমদের অবহেলিত রাখাই হলো সরকারি নীতি।
ভারতীয়গণ অতীতের ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। প্রায় দেড় শত বছর আগে বাংলার হিন্দুদের জীবনেও রেনাসাঁ এসেছিল। কিন্তু পরিণামে সে রেনাসাঁ বাঙালী হিন্দুদের তেমন কোন কল্যাণ দেয়নি। কারণ, হিন্দুরা নিজেদের কল্যাণ চেয়েছিল প্রতিবেশী মুসলিমদের অকল্যাণ ঘটিয়ে। তারা এগিয়ে যেত চেয়েছিল শিক্ষা-দীক্ষা, চাকুরি-বাকুরি ও অর্থনীতিতে , মুসলিমদের বাদ দিয়েই। তাদের সে অপরাধের কারণেই ১৯৪৭’য়ে বাংলা বিভক্ত হয়েছে। এবং বাঙালী হিন্দুরা শুধু ভারতীয় রাজনীতিতেই প্রভাব হারায়নি, প্রভাব হারিয়েছে নিজ প্রদেশ পশ্চিম বাংলাতেও। এবারের নির্বাচনের পর পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতার বানার্জির আশংকা, গুজরাতের উগ্রবাদী হিন্দুদের খুনোখুনি ও মুসলিম নিপীড়নের রাজনীতি শুরু হতে যাচ্ছে খোদ পশ্চিম বাংলায়।
মমতার বানার্জির আশংকাটি আদৌ ভিত্তিহীন নয়। এবারের সংসদ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজিপি)’র সবচেয়ে বড় বিজয়টি এসেছে পশ্চিম বাংলায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজপি পেয়েছিল রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মাঝে মাত্র ২টি; এবার পেয়েছে ১৮টি। এ বিশাল বিজয়ে বলীয়ান হয়ে বিজিপি ইতিমধ্যেই কলকাতাসহ পশ্চিম বাংলার নানা শহরে রাজনৈতিক পরিবেশ লাগাতর অশান্ত ও উত্তপ্ত করে চলেছে। অরাজকতার দোহাই দিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে মমতা বানার্জীর সরকারকে হটিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন বলবৎ করার। তাছাড়া বিজিপি কোন রাজ্যে শক্তিশালী হলে সে রাজ্যে যা দ্রুত বিনষ্ট হয় তা হলো সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি ও শান্তির পরিবেশ। ছিটানো হয় ঘৃনার পে্ট্রোল। সৃষ্টি হয় যে কোন মুহুর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠার উপযোগী পরিবেশ। মোদীর শাসনামলে এমনটিই হয়েছে গুজরাতে, এবং আজ তা হতে যাচ্ছে উত্তর প্রদেশে। উত্তর প্রদেশে ঘরে গরুর গোশতো রাখার সন্দেহে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে গরু-ব্যবসায়ীদের। ভারতীয় মুসলিমদের প্রাণের মূল্য গরুর চেয়েও নীচে নেমেছে। সরকারের প্রায়োরিটি যতটা গরুর নিরাপত্তা দিতে, সেটি নেই মুসলিমের জান-মাল ও ইজ্জত বাঁচাতে। অবস্থা এতটাই নাজুক যে, মুসলিম মায়েরা টুপি মাথায় দিয়ে সন্তানদের মসজিদে পাঠাতে ভয় পায়। আশংকা এখানে বজরং দল বা আরএসএস গুন্ডাদের হাতে পথে নিহত হওয়ার। তেমন একটি মুসলিম বিরোধী সন্ত্রাসের হাওয়াই বেগবান হচ্ছে পশ্চিম বাংলায়। তবে পশ্চিম বাংলায় খুনোখুনি শুরু হলে সেটি যে শুধু যে পশ্চিম বাংলা সীমিত থাকবে না -তা বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে সমগ্র পূর্ব-ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে। ভারতে ২০ কোটি মুসলিমের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বটি মূলতঃ ভারত সরকারের। কিন্তু ভারত তাতে ব্যর্থ হলে ২০ কোটি মুসলিম কি তবে বিলীন হয়ে যাবে? প্রতিবেশী রূপে সুস্থ্য আচরণে হিন্দুগণ ব্যর্থ হলে তাদের জন্য পৃথক ভূমির দাবী তখন অনিবার্য হয়ে উঠবে। এ ২০ কোটি মুসলিম বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে গিয়ে সেখানে ঘর বাঁধেনি। আসমান থেকেও তারা নাযিল হয়। জন্মসূত্রে তারা ভারতীয়; ফলে ভারত ভূমিতেই নিরাপদ বাসস্থান পাওয়াটি যে তাদের বৈধ মানবিক অধিকার -সেটি কি অস্বীকারের উপায় আছে?
মৃত গণতন্ত্র এবং বিজয় ফ্যাসিবাদের
শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধে জনগণের স্তরে বিপ্লব না এলে নির্বাচনে বিপুল ভাবে বিজয়ী হয় চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত, খুনি, ধর্ষক ও সন্ত্রাসীর ন্যায় ভয়ানক অপরাধীরা। তখন স্বৈরাচারি খুনিরা শুধু এমপি বা মন্ত্রী হয় না, বরং দেশের নেতা, পিতা, বন্ধু রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। এর উদাহরণ শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সবচেয়ে বড় উদাহরণটি হলো ভারত। গণতন্ত্রের নামে সেখানে শুরু হয়েছে হিন্দু মেজরটির বর্বর স্বৈর শাসন। ডাকাত আরেক ডাকাতকে কখনোই নিন্দা করে না। ফলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ভোটচুরি, ভোটডাকাতি এবং গুম-খুন ও সন্ত্রাসের যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তা বিপুল প্রশংসিত হচ্ছে ভারতীয় শাসক মহলে। মোদীর শাসনামলে ভারতের অর্থনীতিতে কোন উন্নয়ন ঘটেনি, বরং বেড়েছে বেকারত্ব এবং এসেছে অর্থনৈতিক মন্দা। ঋণের দায়ভারে আত্মহত্যা করছে হাজার গরীব কৃষক। অথচ এরপরও এবারের নির্বাচনে বিজেপি’র বিজয়টি ২০১৪ সালের বিজয়ের চেয়েও বিশাল। এর কারণ, মোদী অর্থনীতিতে উন্নতি আনতে না পারলেও এনেছে উগ্র হিন্দুত্বের জোয়ার। ভারতের ন্যায় দেশগুলোতে অর্থনীতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্ম –সেটি হিন্দু ধর্ম। এরই ফল হলো, ৫৪৩ সিটের পার্লামেন্টে ২০১৪ সালে বিজিপি পেয়েছিল ২৮২ সিট এবং এবার পেয়েছে ৩০৩ সিট। ২০১৪ সালে পেয়েছিল ৩১.৩% ভোট এবং এবার পেয়েছে ৩৭.৪%।
গণতন্ত্রকে যদি বলা হয় জনগণের ভোটে যোগ্যবানদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া -তবে এ নির্বাচনে গণতন্ত্র শুধু পরাজিতই হয়নি, তার মৃত্যু হয়েছে। বিজয়ী হয়েছে নিরেট ফ্যাসিবাদ। ভারতের রাজনীতি অধিকৃত হয়েছে ভয়ানক খুনি ও অপরাধীদের হাতে। এরই প্রমাণ, নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় এবার যারা স্থান পেল তাদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধে বিচারাধীন আসামি হলো ৩৯ শতাংশ। গতবারে তাদের সংখ্যা ছিল ৩১ শতাংশ। বিজয়ীদের মধ্যে ২০১ এমপি এমন যারা নানারূপ অপরাধের আসামি। ভারতীয় গবেষণা সংস্থা এডিআর’য়ের মতে মন্ত্রিসভার ৫৭ সদস্যের মাঝে ২২ জনের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা আছে। বিষয়টি কোন গোপন বিষয়ও নয়। অপরাধ জগত থেকে আসা এসব মন্ত্রীরা নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামাতে তারা নিজেরাই উল্লেখ করেছিল যে, ফৌজদারি মামলায় তারা আসামী। কিন্তু তাতে তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বা বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়াতে কোন বাধা পড়েনি। তাদের মধ্যে ১৬ জন হলো এমন অপরাধী যারা খুন ও ধর্ষণের ন্যায় গুরুতর অপরাধের আসামী। আদালতে সাতটি মামলা আছে এমন ব্যক্তিও মন্ত্রী হয়েছেন। নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে রয়েছে চারটি মামলা।
এবারের নির্বাচনী যুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীর মূল সেনাপতি ছিল অপরাধ জগতের অমিত শাহ। মোদীর ন্যায় অমিত শাহের বাড়ীও গুজরাতে। তাদের উভয়ের হাতই শিক্ত হয়েছে ২০০২ সালে গণহত্যার শিকার মজলুম মুসলিমদের রক্তে। মুখ খুললে এখনো রক্তের গন্ধ বেরুয় তাদের মুখ থেকে। দুর্বৃত্তি বিপুল সমৃদ্ধি দিয়েছে তাদের সম্পদে। ২০১২ সালে নির্বাচনী হলফনামায় অমিত শাহ তার পরিবারের সম্পদ দেখিয়েছিল ১২ কোটি ভারতীয় রুপি। ২০১৯ সালে দেখিয়েছে ৩৯ কোটি। ৭ বছের তার সম্পদে বেড়েছে ২৭ কোটি রুপি। এত বিপুল অর্থ আকাশ থেকে পড়েনি, বরং তা হলো অপরাধের কামাই। ভারতে অতি দ্রুত ধনি হওয়ার সহজ ব্যবসাটি হলো সরকারি দলে যোগ দেয়া। এ ব্যবসায় কোন পুঁজি লাগে না, লাগে স্রেফ সন্ত্রাসের সামর্থ্য। সে সামর্থ্য থাকলে রাজনৈতিক পদ এবং ক্ষমতা -উভয়ই জুটে।
ডাকাত দলে সবচেয়ে নৃশংস ডাকাতকে সর্দার করা হয়, তেমনি সন্ত্রাসের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসীকে। সন্ত্রাসের সে সামর্থ্য না থাকলে স্থান জুটে ভোটারের কাতারে, মন্ত্রী বা এমপি রূপে না। এক কালের “টি বয়” নরেন্দ্র মোদীর কপাল খুলে তখন যখন বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানীর নেতৃত্বে হিন্দুত্বের জোয়ার শুরু হয়। মোদি আদবানীর দৃষ্টি কেড়েছিল ১৯৯২ সালে। সেটি গুজরাত থেকে হাজার হাজার উগ্র হিন্দুদের অযোধ্যা নিয়ে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ গুড়িয়ে দেয়ার কাজে নিয়ে। বাবরী মসজিদ ধ্বংসে মোদী ছিল আদভানীর অন্যতম সেনাপতি। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পুরস্কার স্বরূপ বিজিপির পক্ষ থেকে মোদিকে দেয়া হয় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পদটি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার পরই তার নেতৃত্বে শুরু হয় আরেক নৃশংস পর্ব। সেটি গুজরাতের মুসলিমদের উপর হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের ঘরবাড়ী ও দোকানে আগুণ দেয়ার প্রক্রিয়া। ২০০২ সালে শুরু হয় মুসলিম নির্মূলের গণহত্যা। মুখ্যমন্ত্রী রূপে সে সময় মোদীর উপর মূল দায়িত্বটি ছিল পুলিশকে নিষ্ক্রীয় রেখে হত্যা, ধর্ষণ এবং ব্যবসায় আগুণ দেয়ার কাজে হিন্দু গুন্ডাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া। সে নিধনযজ্ঞে মৃত্যু ঘটে ২ হাজারের বেশী নরনারী ও শিশুর। পুড়িয়ে ছাই করা হয় বহু হাজার মুসলিমের গৃহ ও দোকানপাট। যে সব আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে গৃহহীন অসহায় মুসলিমগণ স্থান নিয়েছিল মোদী সেগুলিও বন্ধ করে দেয়। সেগুলি চিহ্নিত হয়েছিল শিশু উৎপাদনের কারখানা রূপে।
খুন-ধর্ষণের বিচারে অনুমতি নিতে হবে অপরাধী থেকে!
অপরাধীদের বিপুল বিজয়ে পরিস্থিতি এতটাই পাল্টে গেছে যে, কোন খুনি বা ধর্ষকের বিচারের আগে সে অপরাধী থেকে প্রথমে অনুমতি নিতে হবে। কারণ তারাই মন্ত্রী ও এমপি। গুজরাতে মুসলিম দলন প্রক্রিয়া এবং ২০০২ সালে মুসলিম গণহত্যার কাজে নরেন্দ্র মোদীকে যে অমিত শাহ সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়েছিল সেই এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে থাকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব। গুজরাতে যখন মুসলিমদের হত্যা ও তাদের ঘরাড়ী পোড়ানোর কাজ মহা ধুমধামে চলছিল তখন সে হত্যাযজ্ঞ থামাতে পুলিশ বাহিনী কোন দায়িত্ব পালন করেনি। বরং যেসব পুলিশ অফিসারগণ নিজ উদ্যোগে দাঙ্গা থামাতে তৎপর হয়েছিল তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল অন্যত্র বদলী করে। যাদের নেতৃত্বে সেদিন গুজরাতে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিল তাদের হাতেই এখন ভারতের শাসন ভার। ফলে গুজরাত হয় এখন সমগ্র ভারত। আসাম থেকে তাই ৪০ লাখ মুসলিমের বিতাড়নের ষড়যন্ত্র। স্মরণীয় হলো, কলকাতায় মুসলিম এলাকার মধ্য দিয়ে এবার এক নির্বাচনি মিছিল নেতৃত্ব দিয়েছিল অমিত শাহ। সে মিছিল থেকে অকথ্য ভাষায় দু’পাশের মুসলিমদের উদ্দ্যশ্য করে গালি গালাজ করা হয়। অসহায় মুসলিমেরা সেদিন সে অকথ্য গালিগালাজ মুখ বুজে সহ্য করেছে। প্রতিক্রিয়া দেখালে সেদিনই শুরু হতো মুসলিম নিধনমুখি দাঙ্গা।
নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের ৯ দিন পর নরেন্দ্র মোদি শ্রীলঙ্কায় যান। লক্ষ্য ছিল, চার্চের উপর সাম্প্রতিক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত খ্রিষ্টানদের প্রতি সহানুভূতি জানানো। এটি ছিল নির্লজ্জ ভন্ডামী। মোদি কি ভূলে গেছে ভারতীয় খৃষ্টানদের উপর তার নিজ দলের নেতাকর্মীদের নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা? মোদির মন্ত্রীসভায় স্থান পেয়েছে উড়িষ্যার হি্ন্দু চরমপন্থিদের নেতা প্রতাপ চন্দ্র সারাঙ্গী। প্রতাপ সারাঙ্গী সাতটি ফৌজদারি মামলার আসামি। সে হলো আরএসএস-বিজেপি রাজনৈতিক গোষ্ঠির সবচেয়ে আক্রমণাত্মক সংগঠন বজরং দল উড়িষ্যার রাজ্যের সভাপতি। এই দলের কর্মীরাই ১৯৯৯ সালে উড়িষ্যায় অস্ট্রেলিয়ান খ্রিষ্টান যাজক গ্রাহাম স্টেইনকে দুই ছেলেসহ ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করে।এরূপ এক বীভৎস খুনের সাথে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও প্রতাপের রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠায় কোন ছেদ পড়েনি। ২০০২ সালে ‘বজরং দল’, ‘দুর্গাবাহিনী’ এবং ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ মিলে উড়িষ্যার বিধানসভা ভবনের যে হামলা করে, তাতেও নেতৃত্বে ছিল প্রতাপ সারাঙ্গীর। সে সময় তাকে আটকও করা হয়েছিল। অথচ এ খুনি প্রতাপকে একটি নয় দুটি দপ্তরের মন্ত্রী করা হয়েছে। বিজেপির কর্মীদের কাছে সে হলো ‘উড়িষ্যার মোদি। সন্ত্রাস ও খুনের সামর্থ্য থাকলে বিজিপিতে যে কীরূপ মূল্য মেল -প্রতাপ হলো তারই প্রমাণ।
তবে নৃশংস অপরাধের সাথে জড়িত হওয়ার কাহিনী কারো কারো জীবনে অমিত শাহ ও প্রতাপ চন্দ্রের চেয়েও অধীকতর বর্বর ও নৃশংস। তাদেরই একজন হলো ভূপালের প্রাগ্য ঠাকুর। এখনো তাকে মন্ত্রী করা হয়নি। তবে প্রতাপ চন্দ্রের মন্ত্রিত্ব পাওয়াতে রাস্তা খুলে গেল প্রাগ্য ঠাকুরের পথ। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে ভারতজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্থানে স্থানে যে লাগাতর বোমা হামলা চালানো হয় তার মূল আয়োজক ছিল প্রাগ্য ঠাকুর। কোথাও কোথাও আবার মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় হিন্দুদের উসকে দিতে হিন্দু স্থাপনার উপরও সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে হামলার কাজে ব্যবহৃত প্রাগ্যের মোটরসাইকেলও। পুলিশী তদন্তে প্রাগ্যের সংশ্লিষ্টতা ধরা পড়ে ‘রাষ্ট্রীয় জাগরণ মঞ্চ’, ‘অভিনব ভারত’ ইত্যাদি নামে বহু গোপন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাথে। বহুহত্যার সাথে জড়িত এ সন্ত্রাসীকে বিজিপি ভূপাল আসনে প্রার্থী রূপে খাড়া করে। মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দ্বিগবিজয় সিংকে প্রায় চার লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বিজয়ী হয় প্রাগ্য ঠাকুর।
ভোটের মধ্য দিয়ে ভোটারের মন কথা বলে। প্রাগ্য ঠাকুর, অমিত শাহ প্রতাপ সারাঙ্গীর মত অপরাধীদের বিপুল ভোটে বিজয়ে প্রমাণ মেলে ভারতীয় ভোটারদের অন্তরে মুসলিম বিদ্বেষী রূপটি কতটা প্রকট। এমন বিষাক্ত মনের ভোটারদের মাঝে কি গণতন্ত্র বাঁচে? বাঁচে কি মানবিক সভ্যতা? এরূপ দেশে সহজেই সন্ত্রাসী দল গড়া যায়, কিন্তু সভ্য গণতান্ত্রিক সরকারও কি গড়া যায়? নির্বাচনী প্রচারকালে গান্ধীর হত্যাকারীকে নাথুরাম গড়সে’কে প্রাগ্য ঠাকুর প্রকাশ্যেই দেশপ্রেমিক রূপে অভিহিত করেছে। কিন্তু তার সে উক্তি বিজিপি’র কাছে আপত্তিকর মনে হয়নি। ফলে দলীয় প্রার্থী পদ থেকে তাকে প্রত্যাহারও করেনি। আর সন্ত্রাসে তার জড়িত থাকার বিষয়? প্রাগ্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগকে মিথ্যা বলছে বিজিপি প্রধান অমিত শাহ। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো, প্রাগ্য ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রধান তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হেমন্ত কারকারে’কে রহস্যমূলক ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রাগ্যের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তদন্তে নামায় তাকেও প্রাণ হারাতে হয় সন্ত্রাসী হামলায়।
ভারতীয় গবেষণা সংস্থা এডিআর’য়ের রিপোর্ট মতে লোকসভায় নির্বাচিত এমপি’দের মাঝে ২৩৩ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে। গত সংসদের চেয়ে এ সংখ্যাটি ১৪ শতাংশ বেশি। এখন বিষয়টি সুনিশ্চিত যে, আগামী দিনে ভারতের নীতি নির্ধারণ করবে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, প্রতাপ চন্দ্র, প্রাগ্য ঠাকুরের মত ভয়ানক অপরাধীরা। প্রশ্ন হলো, উগ্রবাদিদের হাতে অধিকৃত ভারতের ভবিষ্যৎ চেহারাটি যে কতটা হিংসাত্মক হবে -তা নিয়ে অনুমান করাটি কি আদৌ কঠিন? ভারতীয় জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলিম। সরকারি চাকুরিতে তাদের সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগও নয়। উত্তর প্রদেশে প্রায় ৫ কোটি মুসলিমের বাস। কিন্তু বিগত পার্লামেন্টে তাদের মধ্য দিকে একজনও এমপি হতে পারেনি। এবার ২০ কোটি মুসলিমের মধ্য থেকে এমপি’র সংখ্যা মাত্র ২৫ জন। ঢাকা, করাচী বা লাহোরের মত একটি শহরে যত জন মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, উকিল, সরকারি অফিসার, পুলিশ অফিসারের বাস ভারতের ২০ কোটি মুসলিমের মাঝে তার সিকি ভাগও নেই। এরূপ অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বললে বলা হয় মুসলিমের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব। বলা হয় মুসলিম তোষণ। সেটিকে চিত্রিত করা হচ্ছে অপরাধ রূপে। মানবতা তো পশুত্ব নিয়ে বাঁচে না, সেজন্য মানবিক পরিচয়টি তো অপরিহার্য। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে সে মানবিক রূপটি এখন মৃত। আর মানবতার মৃত্য হলে নরহত্যা, নারী-ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও যে উৎসবে পরিণত হবে সেটিই তো স্বাভাবিক। উৎসবের সে প্রচণ্ড রূপটি দেখা যায় মুসলিম গণহত্যামুখি দাঙ্গাগুলিতে।
শুরুটি বহু আগে থেকেই
তবে ভারত জুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেরূপ হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও পথেঘাটে দাড়ি টেনে অপমান করার যে অভিযান চলছে -সেটি হঠাৎ করে শুরু হয়নি। শুরুটি শত বছর আগে থেকে। ভারত আজকের এ অবস্থায় পৌঁছেছে সংঘবদ্ধ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ফলে। এরূপ একটি অবস্থা সৃষ্টিতে লাগাতর কাজ করেছে বহু হিন্দু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু ও মিডিয়া কর্মী। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাগরণ ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বাণী নিয়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিটি রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণ উত্তপ্ত করেন তিনি হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। তার চিন্তাধারায় পুষ্ট হয়ে ভারত জুড়ে প্রতিষ্ঠা পায় আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ এবং আজকের বিজিপি। নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতির শুরু হয় আরএসএস থেকে। সাভারকারই জোরে জোরে বলা শুরু করেন, “হিন্দুদের মূল শত্রু হলো মুসলিম, ইংরেজগণ নয়। -(সূত্রঃ (Jaffrelot (2009). Hindu Nationalism: A Reader. Princeton University Press. pp. 14–15, 86–93. ISBN 1-4008-2803-1) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি হিন্দুদেরকে ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতেও উৎসাহ দেন। এবং অধিকৃত আরব ভূমিতে ইংরেজদের হাতে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলে সেটিকেও তিনি সমর্থণ দেন। কংগ্রেসের ব্রিটিশ বিরোধী “ভারত ছাড়” আন্দোলনেরও তিনি বিরোধীতা করেন। তিনিই বলেন, “যেসব মুসলিম ভারতের পুলিশ ও সেনাবাহিনী রয়েছে তারা হলো ” traitors” তথা গাদ্দার। ভারত সরকারকে তিনি পরামর্শ দেন সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সরকারি প্রশাসনে মুসলিমদের সংখ্যা কমাতে। নিষিদ্ধ করতে বলেন মুসলিমদের অস্ত্র কারখানার মালিক বা শ্রমিক হওয়া থেকে। -(সূত্রঃ McKean, Lise (1996), Divine Enterprise: Gurus and the Hindu Nationalist Movement, University of Chicago Press, ISBN 97-0-226-56009-0)।
সাভারকারের পর হিন্দুত্ববাদী উগ্রতার আরেক তারকা হলো মাধব সদাশিব গোয়ালকার। সাভারকারের ন্যায় গোয়ালকারও ছিল মারাঠী। ১৯৩৮ সালে হিন্দুভারতের যে রূপরেখাটি তিনি পেশ করেন তা হলো নিম্নরূপ: “The non-Hindu people of Hindustan must either adopt Hindu culture and language, must learn and respect and hold in reverence the Hindu religion, must entertain no idea but of those of glorification of the Hindu race and culture…..In a word, they must cease to be foreigners, or may stay in the country wholly subordinated to the Hindu nation, claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment—not even citizens’ rights.” (“Pakistan and a World in Disorder—A Grand Strategy for the Twenty-First Century”, p.78)।
গোয়ালকারের কথা, “হিন্দুস্থানের অহিন্দুদের অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু ভাষাকে গ্রহন করতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই শিখতে হবে এবং ভক্তি করতে হবে হিন্দু ধর্মকে। হিন্দু বর্ণ ও হিন্দু সংস্কৃতির জয়কীর্তন ছাড়া অন্য কোন চেতনাকে তারা প্রশ্রয় দিতে পারবে না। তারা কিছু দাবীও করতেও পারবে না –এমনি মৌলিক নাগরিক অধিকারও নয়।” হিন্দু ভারত নিয়ে সাভারকার ও গোয়ালকারের এটিই হলো সেই রূপরেখা যা আজ কোন কিতাবে বন্দি নয়; বরং সেটির বাস্তবায়নে নেমেছে বিজিপি, আরএসএস, বজরং দল, শিব সেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ন্যায় অসংখ্য সংগঠন। তাদের ভারতে মুসলিমদের কোন স্থান নেই। হিটলারের ন্যায় তারাও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে ব্যবহার করছে স্রেফ মই রূপে। কিন্তু তাদের আসল পথটি হলো ফ্যাসিবাদের। তাদের কাছে তাই অনুকরণীয় বীর পুরুষ হলো জার্মানীর হিটলার ও ইতালীর মুসোলিনী–যা সুস্পষ্ট সাভারকারের লেখাতে। জার্মান ইহুদীদের যে স্থানে বসিয়ে হিটলার তাদের নির্মূলে নেমেছিল, ভারতীয় মুসলিমদের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানটিও হলো সেটি। তবে হিটলারে নৃশংস নীতি থেকে শিক্ষা নিলেও তারা শিক্ষা নেয়নি তার ভয়াবহ পরিণতি থেকে। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে হিটলারের জার্মানী ছিল বিশ্বশক্তি। তা সত্ত্বেও হিটলারের ফ্যাসিবাদ জার্মানীকে যা দিয়েছে তা হলো নিদারুন পরাজয়, নৃশংস বর্বরতা ও বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ। প্রশ্ন হলো, বিজিপির ফ্যাসিবাদ ভারতকেও কি ভিন্ন কিছু দিবে? ১৪/০৬/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018