ভোট-ডাকাতদের অসভ্য অধিকৃতিঃ জনগণ কি বাঁচবে আত্মসমর্পণ নিয়ে?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on July 24, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
অপরাধঃ নৃশংস দেশ ডাকাতির
বাংলার মানুষ দেশটির সমগ্র ইতিহাসে দুইবার ভয়াবহ অপরাধকর্মের শিকার হয়েছে। প্রথমবার সেটি ঘটে ১৭৫৭ সালে ঔপনিবেশিক ইংরেজ ডাকাতদের হাতে। তাতে বাংলার স্বাধীনতার উপরই শুধু ডাকাতি হয়নি, ডাকাতিতে নিঃস্ব হয়ে গেছে দেশের রাজভাণ্ডার, গ্রামে-গঞ্জে জনগণের অর্থভাণ্ডার এবং কৃষিভাণ্ডার। তাতে নেমে আসে ১১৭৬ সালের ভয়ানক দুর্ভিক্ষ -তাতে মারা যায় দেশটির এক-তৃতীয়াংশ জনগণ। দ্বিতীয়বার ভয়ানক অপরাধকর্মটি ঘটে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরে। সেটি ঘটে দেশীয় ডাকাতদের হাতে। তাতে ডাকাতির খপ্পরে পড়ে সমগ্র দেশ; ডাকাতির শিকার হয় প্রতিটি প্রাপ্ত-বয়াস্কা নর-নারী। সেদিনটিতে ছিনতাই হয়ে যায় দেশের ভাগ্য নির্ধারণে জনগণের স্বাধীনতা। সে নৃশংস ভোট-ডাকাতির ফলে জনগণ পরিণত হয় ডাকাতদের হাতে জিম্মি দর্শকে। দেশের রাজস্বভাণ্ডার, বিদেশ থেকে পাওয়া লোনের অর্থ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও বীমা কোম্পানী, সরকারি জায়গাজমি এবং বনভূমির উপর পূর্ণ-দখলদারি প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষমতাসীন ডাকাতদের।
বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনারূপে এ বর্বর ঘটনাও যুগ যুগ বেঁচে থাকবে যে, ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর দেশে একটি সংসদীয় নির্বাচন হয়েছিল। সে নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার দাবী নিয়ে শেখ হাসিনা আজ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে সংসদীয় নির্বাচনের দোহাই দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্টিত -সেটি যে আদৌ কোন নির্বাচন ছিল না তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? নির্বাচন সুষ্ঠ হওয়ার শর্ত হলো তাতে প্রতিফলন ঘটতে হবে জনগণের রায়ের। কিন্তু সে নির্বাচনে সেটি হয়নি। বরং তাতে প্রকাশ পেয়েছে স্রেফ ভোট-ডাকাতদের ইচ্ছার। সেদিনের সে বিশাল ভোট-ডাকাতির অপরাধটি আজ দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে দিনের আলোয় প্রকাশ পাচ্ছে। সেরূপ এক অকাঠ্য প্রমাণ ২৩/০৭/১৯ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশ করেছে; এবং সেটি সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’য়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত রিপোর্টের বরাত দিয়ে।
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট-ডাকাতির সে নগ্ন চিত্রটি হলোঃ ১). ১ হাজার ২৮৫টি ভোট কেন্দ্রে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে কোনো ভোটই পড়েনি; ২). ধানের শীষ ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে ৬ হাজার ৭৫টি কেন্দ্রে; ৩). বিএনপি জোটের প্রার্থীরা ১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ৩ হাজার ৫০১টি কেন্দ্রে এবং ৪). ২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৫৩৫টি কেন্দ্রে। ৪০ হাজার ১৫৫টি কেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণ করে সুজন বলছে, অধিকাংশ কেন্দ্রেই নৌকা ও ধানের শীষের ভোটের পার্থক্যটি অস্বাভাবিক। তাদের অভিমত হলো, যে কোন বিচারে নির্বাচনের ফলাফলটি বিস্ময়কর। বিএনপির প্রার্থীগণ দেশের কোন একটি কেন্দ্রে শূণ্য ভোট পাবে বা প্রদত্ত ভোটের মধ্যে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ ভোট পাবে সেটি কি বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু সে অবিশ্বাস্য কাণ্ডটিই সেদিন ঘটেছে নির্বাচনের নামে। এরূপ বিস্ময়কর কাণ্ড একমা্ত্র ডাকাতির মাধ্যমেই সম্ভব, কোন নির্বাচনে নয়। ডাকাতির মাধ্যমে নিঃস্ব মানুষও মুহুর্তের মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়; এবং বহু কোটি টাকার মালিক মুহুর্তের মধ্যে নিঃস্ব ভিখারীতে পরিণত হয়। গত নির্বাচনে সেটিই করা হয়েছে অতি পরিকল্পিত ভাবে। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলি সেদিন পরিণিত হয়েছিল এক ভয়াবহ ডাকাত দলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ বর্বরতাও যুগ যুগ বেঁচে থাকবে।
নির্বাচনের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন আসনের ফলাফলে নৌকা প্রতীকের বিপরীতে ধানের শীষের যে ভোট পড়েছে, সেটি বিস্ময়কর। অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যত ভোট পেয়েছেন, বিএনপির প্রার্থী তার মাত্র ১০ ভাগের ১ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলে নির্বাচন কমিশনের ফলাফলে দেখানো হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগ, এমনটি সম্ভব হয়েছে ভোটের আগের রাতে নৌকায় সিল দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার কারণে। কয়েকটি আসনের ভোট পর্যালোচনা করে বিবিসি তার প্রতিবেদনে বলে, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন বিএনপির রুমানা মাহমুদ ও আওয়ামী লীগের হাবিবে মিল্লাত। হাবিবে মিল্লাত পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ৮০৫ ভোট। অন্যদিকে রুমানা মাহমুদ পেয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার ৭২৮ ভোট। অর্থাৎ বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৭ ভোট বেশি পেয়েছে। অথচ এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির রুমানা মাহমুদ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নরসিংদী-২ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান ১৯৯১ সাল থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়ী হন। ২০০৮ সালে এ আসনে বিএনপি পরাজিত হলেও আবদুল মঈন খান ৭০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৭ হাজার ১০০ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোট। সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। সিলেট-১ আসনটিতে অধিকাংশ ভোটার সিলেট মহানগর এলাকায় বসবাস করেন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একই জায়গায় বিএনপির প্রার্থী কীভাবে এত বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন, সেটি অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে। ৩ জানুয়ারি প্রথম আলো রিপোর্ট করে, ভোটের ব্যবধানে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবারের নির্বাচন। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট যেখানে ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, সেখানে বিএনপি জোট পেয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট। অথচ এর আগের নির্বাচনগুলোতে এই দুই দলের ভোট ছিল প্রায় সমান। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ৪টিতে জিতেছিল। সেবার তারা চট্টগ্রামে ৪৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ জোট জিতেছিল ১১টি আসনে। তাদের ভোট ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ওই ১৬টি আসনেই আওয়ামী লীগ ও তার জোটের প্রার্থীরা জয়ী হন। এবার আওয়ামী লীগ জোট মোট প্রদত্ত ভোটের ৮৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট পায়। অন্যদিকে ১৬টি আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ ভোট। জামানত হারিয়েছেন ১০ জন প্রার্থী।
নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেটি পর্যালোচনা করে সুজন বলছে, ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে যতগুলো বৈধ ভোট পড়েছে, তার সবগুলোই পেয়েছে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। এসব কেন্দ্রে ধানের শীষ কিংবা অন্য প্রার্থী কোন ভোটই পাননি। সুজন তুলে ধরেছে, চট্টগ্রাম-১০ আসনের কথা। এই আসনে গণসংহতি আন্দোলনের সৈয়দ মারুফ হাসান রুমী শূন্য ভোট পেয়েছেন। সেটি জানিয়েছিলেন রিটার্নিং অফিসার। কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে কাশিত কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, তিনি ২৪৩ ভোট পেয়েছেন। সেটি জানিয়েছে সুজন।সুজনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ১০৩ টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এ বিষয়টিও কি বিশ্বাসযোগ্য?এরূপ শতভাগ ভোট তো তখনই পড়ে যখন ভোট দিতে ভোটারকে আসতে হয় না, সে কাজটি করে রাতের আঁধারে বসে ডাকাতেরা।
মীর জাফর সুলভ ভূমিকা নির্বাচনি কমিশনের
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চোর-ডাকাত ও ভোট-ডাকাতদের মত অপরাধীদের সংখ্যাটি বিশাল। ফলে নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হওয়ার সম্ভাবনাটিও বিশাল। কিন্তু ডাকাত ধরার দায়িত্ব তো নির্বাচনি কমিশনের। সে কাজে তাকে সহায়তা দেয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল দেশের বহু লক্ষ সামরিক ও বেসামরিক মানুষের জনবল। যাতে ছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর লোকেরা। তবে দলে লোকবল থাকলেই চলে না, নির্বাচনি কর্তাব্যক্তির ডাকাত ধরার যুদ্ধে আপোষহীন ইচ্ছাও থাকতে হয়। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মীর জাফরের ন্যায় ময়দানে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলে যুদ্ধ জয় না। নির্বাচন কমিশনার বস্তুতঃ সেটিই করেছেন। চোখের সামনে ডাকাতি হলেও ডাকাত ধরায় তিনি কোন সদিচ্ছা দেখাননি। বরং ডাকাত না ধরে তিনি ডাকাতির কাজটি নিরাপদে করতে দিয়েছেন। এবং এভাবে দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন ভোট-ডাকাতির নির্বাচন।
সুষ্ঠ নির্বাচন এবং ডাকাতির নির্বাচনের ফলাফলের মাঝে পার্থক্যটি যে কতটা বিস্ময়কর বা অস্বাভাবিক হতে পারে –৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনটি ছিল তারই প্রমাণ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও সাংবাদিকদের একথা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, বিভিন্ন কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীরূপে ঘটলো সে অস্বাভাবিক ঘটনা? শত ভাগ ভোট বিশেষ একটি দলের পক্ষে পড়া যে স্বাভাবিক নয় –এটুকু বললেই কি নির্বাচনি কমিশনারের দায়িত্ব শেষ হয়? তাঁর দায়িত্ব কি স্রেফ ফলাফল ঘোষণা করা? ভোট কেন্দ্রগুলিতে কেন এবং কীরূপে এরূপ অস্বাভাবিক ফলাফল ঘটলো –সে বিষয়ে তদন্তের দায়িত্বটি তো জনগণের নয়। বিরোধী দলেরও নয়। বরং সে দায়িত্ব তো নির্বাচনি কমিশনারের। সে কাজের জন্যই তিনি বেতন পান। অথচ সে সাংবিধানিক দায়িত্বটি তিনি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন –যেন নির্বাচনে অনিয়মের কিছুই ঘটেনি। তার সে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেও একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল –যেমনটি ছিল মীর জাফরের। সেটি ছিল আওয়ামী লীগের ঘরে নির্বাচনি বিজয়কে পৌঁছে দেয়া।
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যে আদৌ সঠিক ভাবে হয়নি তা নিয়ে কারো মনেই কোন রূপ সন্দেহ থাকার কথা নয়। সুজনের রিপোর্ট সেটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ভোট-ডাকাতির অপরাধকে শেখ হাসিনা আদৌ লুকাতে পারেনি। ভোট ডাকাতি যে বিশাল ভাবে হয়েছে সে প্রমাণ বিপুল ভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ যেমন সেগুলি নিজ চোখে দেখেছে। তেমনি টের পেয়েছে জনগণও। তাছাড়া যত চেষ্টাই হোক, অপরাধীরা কখনোই তাদের অপরাধের আলামত পুরাপুরি লুকাতে পারে না।
ভোট-ডাকাতরাও জানে তাদের ডাকাতি কতটা ব্যাপক ও নৃশংস ভাবে হয়েছে। কিন্তু সেটি তারা কখনোই স্বীকার করে না; সেটি করে ডাকাতের মাল ঘরে রাখার স্বার্থ্যে। ডাকাতেরা তাই শুধু অতি জালেম ও নৃশংসই হয় না, অতিশয় মিথ্যাবাদীও হয়। তাই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের নেতাগণ বলছে, ধানের শীষের প্রার্থীদের শূণ্য ভোট পাওয়ার কারণ, বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বয়কট করেছে এবং তাদের ভোটারগণ ভোটই দিতে আসেনি।
কে দিবে অপরাধীদের শাস্তি?
২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের মাটিতে যে ভয়ংকর অপরাধ ঘটে গেছে এবং তাতে দেশ যে ডাকাতদের হাতে অধীকৃত হয়েছে -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে? সভ্য ও সুশীল সমাজের আলামত হলো সেখানে প্রতিষ্ঠা পায় আইনের শাসন এবং কার্যকর হয় অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার রীতি। সেটি না থাকাটিই জঙ্গলের অসভ্যতা। সভ্য মানুষের পরিচয় তাই শুধু পোষাক-পরিচ্ছদ, পানাহারে বা গৃহনির্মাণে ধরা পড়ে না। স্রেফ টুপি-দাড়ি ও নামায-রোযাতেও ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে অপরাধীদের নির্মূলের আয়োজন দেখে। তাছাড়া মশামাছি নির্মূলে ব্যর্থ হলে তার আযাবটিও কি কম? তখন রোগব্যাধীর মহামারিতেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে অকালে মরতে হয়। তেমনটি ঘটে অপরাধীদের নির্মূলে ব্যর্থ হলে। তখন চোর-ডাকাত, খুনি, ধর্ষকগণও দেশের নেতা, পিতা, বন্ধু ও শাসকের পরিচয় নিয়ে ঘাড়ের উপর চেপে বসে। তখন পথে ঘাটে নিরপরাধ মানুষকে গুম, খুণ ও ধর্ষিত হতে হয়। তখন বিচারের নামে কারাবাসে বা ফাঁসিতে ঝুলেও মরতে হয়। বাংলাদেশে তো অবিকল সেটিই হচ্ছে্।
অপরাধীদের নির্মূলে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশনামাও কি কম গুরুত্বপূর্ণ? পবিত্র কোরআনে সুরা ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। এবং কেন তাদের প্রাপ্য এ বিশেষ মর্যাদাটি, সেটিও তিনি উক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন। এ বিশেষ মর্যাদার কারণ এ নয় যে, মুসলিমেরা বেশী বেশী নামায-রোযা পালন করে, হজ্বে যায় বা দান-খয়রাত করে। বরং সে কারণটি হলো, তারা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা দেয় এবং রাষ্ট্রের বুক থেকে নির্মূল করে অপরাধীদের। অথচ বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টোটি। যারা চোর-ডাকাত ও ভোট-ডাকাত এবং যারা খুন-গুম-সন্ত্রাসের রাজনীতির হোতা -তাদেরকে নির্মূল না করে শাসক রূপে মেনে নেয়া হচ্ছে। এমন কি বিচার চাওয়া হচ্ছে চোর-ডাকাতদের কাছে! তাদেরকে মহামান্যও বলা হচ্ছে। চোর-ডাকাতদের এভাবে মাথায় তোলার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় দুই শতটি রাষ্ট্রকে হারিয়ে দুর্নীতিতে ৫ বার প্রথম হয়েছে। এ হলো অপরাধীদের মেনে নেয়া এবং অপরাধ পরিচর্যা দেয়ার ফল। তারা অপরাধে বেঈমান কাফেরদেরও হার মানিয়েছে! এ জগতজোড়া ব্যর্থতা নিয়ে তারা পরকালেই বা মুখ দেখাবে কী করে?
গত নির্বাচনে অতি কুৎসিত ও অস্বাভাবিক কাণ্ডটি ঘটিয়েছে নির্বাচনি কমিশনার নিজে। এটি নিজেই শাস্তিযোগ্য এক বিশাল অপরাধ। সেটি হলো, শতভাগ ভোট পড়া যে একমাত্র ভোট-ডাকাতিতেই সম্ভব –সেটি অন্যরা বুঝলেও তা নিয়ে তিনি কোন কথাই বলেননি। বরং সে অস্বাভাবিক ডাকাতির নির্বাচনকে তিনি সুষ্ঠ নির্বাচন বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এবং এভাবে তিনি ভোট-ডাকাতদের হাতে বিজয় তুলে দিলেন। এটি যে তার সাংবিধানিক দায়িত্বের সাথে চরম গাদ্দারি -সেটি বুঝার সামর্থ্য কি তার আছে? বিবিসির সাংবাদিক ও কোটি কোটি সাধারণ মানুষ সেটি টের পেলেও তিনি নিজে টের না পাওয়ার ভান করেছেন। এটি হলো এক চরম বিবেকশূণ্যতা। এমন বিবেকশূণ্য মানুষেরা চোখের সামনে ডাকাতি হতে দেখেও সেটি না দেখার ভান করে। বরং ডাকাতকে বাঁচাতে ডাকাতদের পক্ষ নেয়।
নিজের দায়িত্ব এড়াতে নির্বাচনি কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনকালীন অথবা গেজেট প্রকাশের আগে কেউ যদি সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করতো, তবে নির্বাচনকমিশন তা তদন্ত করে দেখতো। তার কথা, যে বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি বা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসেনি, গেজেট নোটিফিকেশন করার পরে আর কিছু করার থাকে না। এমন অস্বাভাবিক কথা একমাত্র চরম দায়িত্বহীন ব্যক্তিরাই বলতে পারে। কথা হলো, তার অবস্থান ছিল অপরাধের ঘটনাস্থলে এবং অপরাধীদের মাঝে। সংঘটিত অপরাধকে নিজ চোখে দেখার যে সুযোগ তার হয়েছে সেটি দেশের অন্য কোন ব্যক্তির ভাগ্যে জুটেনি। কিন্তু তিনি দেখেও না দেখার ভান করেছেন। এটিও কি কম অপরাধ।
কথা হলো, অপরাধ কি কখনোই তামাদি হয়? যত দেরীতেই হোক অপরাধীকে শাস্তি দেয়াই সভ্য সমাজের রীতি। চুরি-ডাকাতি বা খুনের সাথে জড়িত অপরাধীগণ ১০ বা ২০ বছর পরে ধরা পড়লেও তাদেরকে শাস্তি পেতে হয়। তাছাড়া কোথাও চুরি-ডাকাতি বা হত্যার ঘটনা ঘটলে অপরাধীদের ধরার কাজটি দুয়েক দিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে -সেটি কি কোন সভ্য আইন-আদালতের বিধান? বরং সুবিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে অপরাধীদের ধরার কাজে ইতি টানা যায় না, বরং বছরের পর বছর লেগে থাকতে হয়। অতীতে এমন কি বাংলাদেশেও দেখা গেছে নির্বাচিত হওয়ার দুই-তিন বছর পরও বিজয়ী প্রার্থীর বিজয়কে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জনগণ কি বাঁচবে আত্মসমর্পণ নিয়ে?
চোর-ডাকাতদের ধরার কাজটি তো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে তাই বাদী হয়ে আসামীদের ধরতে হয় এবং তাদের শাস্তিও দিতে হয়। জনগণ রাষ্ট্র থেকে ঘরবাড়ি ও পানাহার চায় না, চায় সুবিচার। এজন্যই জনগণ সরকারকে রাজস্ব দেয়। কিন্তু গত নির্বাচনে নির্বাচনির কমিশন সে দায়িত্বটি আদৌ পালন করেনি। বরং পাশে দাড়িয়েছে ডাকাতদের। ফলে দেশ অধিকৃত হয়েছে ভয়ানক ভোট-ডাকাতদের হাতে। কোন সভ্য দেশেই ডাকাতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বা ক্ষমতার মালিক কোনদিনই কোন ডাকাত হতে পারে না। সেটি দশ বছর বা বিশ বছর পরে হলেও। যে দেশে আইন-আদালত আছে সেদেশের নিয়ম তো এটাই, স্রেফ ডাকাতির মাল ফেরত নিলেই বিচার শেষ হয় না। ডাকাতি করার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও ডাকাতদের দিতে হয়। কিন্তু সে সভ্য কাজটি কি বাংলাদেশের চলমান অসভ্য প্রেক্ষাপটে সম্ভব?
ডাকাতদের হাতে যখন দেশ অধিকৃত হয়, তখন তাদের হাতে অধিকৃত হয় দেশের আইন-আদালতও। কাদেরকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হবে এবং বিচারের নামে শাস্তি দেয়া হবে -সে হুকুমটিও তখন ডাকাতদের পক্ষ থেকে আসে। তখন বিচারের নামে শাস্তি দেয়া হয় সরকার বিরোধীদের। তাই এমন আদালত থেকে বিচার চাওয়াটিও চরম বুদ্ধিহীনতা। বিচারের দায়িত্ব তখন জনগণকে নিতে হয়। তাছাড়া ডাকাতগণ ডাকাতির মাল কখনোই স্বেচ্ছায় ফেরত দেয়। আদায় করে নিতে হয়। ফেরত নেয়ার সে কাজটি অতি ব্যয়বহুল। সে কাজ তাই দায়িত্বশীল প্রতিটি সভ্য রাষ্ট্রের। কিন্তু সেরূপ সভ্য রাষ্ট্র কখনোই স্রেফ জনগণের রাজস্ব দানে বা ভোট দানে গড়ে উঠে না। একাজে ব্যয় হয় জনগণের অর্থ, রক্ত, শ্রম ও মেধা। ইসলামে এটি সর্বোচ্চ ইবাদত তথা জিহাদ; এ পথেই অপরাধীদের শাসন নির্মূল হয় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। তখন নির্মিত হয় উচ্চতর সভ্যতা। এটিই নবী-রাসূলদের পথ। মুসলিমদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল তো এ পথেই।
নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতের ন্যায় সকল ইবাদতের কাজ হলো এরূপ সর্বোচ্চ ইবাদতের জন্য ঈমানদার তৈরি করা। এ পবিত্র কাজে যারা প্রাণ দেয় তারা পায় বিনা হিসাবে জান্নাত। পবিত্র কোরআনে সে প্রতিশ্রুতি এসেছে বার বার। নবীজী (সাঃ)র সাহাবাগণ সেটি বুঝতেন এবং তার উপর আমলও করতেন। ফলে এ পবিত্র জিহাদে শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। যাদের মাঝে সে বিনিয়োগ নাই, তাদেরকে বাঁচতে হয় চোর-ডাকাতদের কাছে নীরব আত্মসমর্পণ নিয়ে। চোর-ডাকাতগণ তখন মাথায় উঠে এবং জনগণের অর্থে তারা বিরামহীন বিজয়োৎসবও করে। তখন অসম্ভব হয় সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জনগণ কি বাঁচবে ভোট-ডাকাতদের কাছে এরূপ অসভ্য আত্মসমর্পণ নিয়ে? ২৪/০৭/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018