মানবসৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব ও বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on October 23, 2020
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
যে কারণে মানব শ্রেষ্ঠ
নাস্তিকদের কাছে মানুষের পরিচয়টি বিশেষ এক প্রজাতির জীব রূপে। কিন্তু সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্ঠা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে পরিচয়টি ভিন্নতর। সেটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির। নাস্তিকদের অপরাধ এখানে মানবকে খাটো করার। মহান আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করেছেন সর্বোত্তম দৈহীক রূপ ও বিস্ময়কর বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য দিয়ে। তিনি যেমন তাঁকে শিখবার সামর্থ্য দিয়েছেন, তেমনি নিজে হাজির হয়েছেন মানবের সর্বোত্তম শিক্ষক রূপে। এবং যে জ্ঞান তিনি মানুষকে দিয়েছেন, সে জ্ঞান ফেরশতাদেরও দেননি। আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত সে জ্ঞানের বরকতেই হযরত আদম (আঃ) ফেরেশতাদের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করেছিলেন। ফেরেশতাদেরকে যখন বিভিন্ন জিনিষের নাম বলতে বলা হয়, তখন তারা তা বলতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তা সঠিক ভাবে বলতে পেরেছিলন হযরত আদম (আঃ)।
কোন কিছুর নাম এখানে নিছক নাম ছিল না, বরং সে নামের মধ্যে ছিল তার সামগ্রিক পরিচয়। জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় এনে মানব যে ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর সেটি মহান আল্লাহতায়ালা ফেরশতাদের চোখের সামনে প্রমাণিত করেছিলেন। এবং ফেরশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ এ মানব সৃষ্টিকে সেজদা করতে। অন্য কোন জীবকে মহান আল্লাহতায়ালা সে মর্যদা দেননি। মানব ভিন্ন অন্য কোন জীবকে সিজদা করতে তিনি ফেরশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন -সে নজিরও নাই। একমাত্র ইবলিস ছাড়া সকল ফেরেশতাই সেদিন হযরত আদম (সাঃ)’কে সেজদাও করেছিল। যে কারণে ইবলিস সেদিন মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের অবাধ্য হয়েছিল -সেটির কারণ তার শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না, বরং সেটি ছিল তার অহংকার। অহংকার যে মানবকে পাপের পথে কতটা বেপরোয়া করতে পারে এ হলো তার নজির। সে বর্ণনাটি পবিত্র কোর’আনে এসেছে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে।
তবে মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদাটি নিছক ফেরেশতাদের সেজদা করার কারণে নয়। সুন্দরতম দেহাকৃতি, শারিরীক বল, কথা বলা ও লেখনীর সামর্থ্য বা পেশাদারি দক্ষতার কারণে নয়। বরং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার একান্ত প্রতিনিধি তথা খলিফা রূপে পৃথিবীপৃষ্ঠে নিয়োগপ্রাপ্তির কারণে। রাজা অতি সুযোগ্য ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিকেই তার প্রতিনিধি করে। রাজার পক্ষ থেকে কোন এক ব্যক্তির এটি এক বিশেষ সন্মান। সমগ্র বিশ্বজগতের প্রভু মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা বা প্রতিনিধি হওয়ার সন্মানটি যে কতটা বিশাল -তা এ থেকেই অনুমান করা যায়। এবং সেটি তিনি দিয়েছেন তাঁর মানব সৃষ্টিকে। সে বিশেষ মর্যাদা তিনি ফেরেশতাদেরও দেননি। অথচ মানব গৌরব খোঁজে রাজা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, নেতা বা পীরের খলিফা হওয়ার মাঝে। বিশ্বজগতের সর্বশক্তিময় মহান আল্লাহর খলিফা হওয়ার মাঝে যে মর্যাদা -তার সাথে কি তার তুলনা চলে? বস্তুতঃ মহান আল্লাহতায়ালা মানবকে তাঁর নিজস্ব খলিফা বা প্রতিনিধি নির্বাচিত করে সকল সৃষ্টির মাঝে সন্মানিত করেছেন। তাছাড়া সে দায়িত্ব পালনে মানবকে প্রয়োজনীয় সামর্থ্যও দিয়েছেন। সেটি হলো ভাববার সামর্থ্য; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে বেড়ে উঠার সামর্থ্য। সেটি লাগাতর শেখা ও শেখানোর সামর্থ্য। সে সামর্থ্যই হলো মানবের মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রষ্ঠ আমানত। সে আমানত একমাত্র তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে ব্যয় হবে -সেটিই কাঙ্খিত। সে সামর্থ্য বা আমানতকে শয়তানের বিজয়ে কাজে লাগানো হলো সবচেয়ে গুরুতর খেয়ানত তথা অপরাধ।
মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং পচন শারিরীক অসুস্থ্যতা নয়; সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার মহান মর্যাদাটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া। এ ব্যর্থতা এবং পচন ব্যক্তিকে শয়তানের অনুসারি করে এবং জাহান্নামের যাত্রী করে। সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ তাই মানব হত্যা, ব্যভিচার বা মদ্যপান নয়, বরং সেটি হলো শয়তানের খলিফা বা সৈনিক রূপে নিজেকে গড়ে তোলা। তখন চুরি-ডাকাতি, মানব হত্যা, ব্যভিচার বা মদ্যপানের ন্যায় গুরুতর অপরাধও অতি মামূলী হয়ে দাঁড়ায়। সে মৌলিক অপরাধটি ব্যক্তির সকল অর্জনকে বিফল করে দেয়। এবং পরিণামে জাহান্নামে পৌঁছায়। মহান আল্লাহতায়ালার যোগ্য খলিফা রূপে সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ তাই প্রকৃত ঈমানদারের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ।এবং তার কাছে গুরুত্ব পায় শয়তানের খলিফা হওয়া থেকে বাঁচার বিষয়টি।
যে অজ্ঞতা জাহান্নামে নেয়
প্রশ্ন হলো, জ্ঞানের রাজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি –যা জানলে তার সমগ্র বাঁচাটাই ব্যর্থ হয়? খাদ্য ও অখাদ্যের জ্ঞান পশু-পাখীরও থাকে। কিন্তু মানুষকে শুধু সেটুকু জানলে চলে না। তাকে জানতে হয় তার প্রভুর ভিশন বা উদ্দেশ্যকেও। মানব সৃষ্টির মূলে প্রভুর ভিশন বা লক্ষ্য না জেনে কেউ কি তাঁর যোগ্য খলিফা বা দাস হতে পারে? প্রভুর ভিশন জানাটি এজন্যই ফরজ। এক্ষেত্রে অজ্ঞতা তাই ভয়ানক কবিরা গুনাহ। এ অজ্ঞতায় অসম্ভব হয় খলিফার দায়িত্ব পালনের ন্যায় ফরজ কর্ম। এ অজ্ঞতা জাহান্নামে পৌঁছায়।
প্রশ্ন হলো, পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার ভিশনটি কি? সেটি হলো, তাঁর দ্বীন ইসলামকে সকল ধর্ম ও সকল মতাদর্শের উপর বিজয়ী করা। পবিত্র কোর’আনে সেটি তিনবার ঘোষিত হয়েছে -সুরা তাওবাহ, সুরা সাফ ও সুরা ফাতাহ’তে। বলা হয়েছে, “লিইউযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি”। অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপর তাঁর নিজের দ্বীন তথা ইসলামের বিজয়। ঈমানদারের দায়ভার হলো এ ভিশনের বিজয়কে নিজ জীবনের মিশনে পরিণত করা। তাই সমগ্র পৃথিবী পৃষ্টে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি পারমানবিক বোমা বানানো নয়, চাঁদের উপর পা রাখা বা উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্র আবিষ্কারও করা নয়। বরং সেটি ইসলামের বিজয়। খেলাফতের মূল দায়ভারটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা। তাতে প্রতিষ্ঠা ঘটে শরিয়তি আইনের। তখন মানুষের পথচলাটি হয় সিরাতুল মোস্তাকীমের পথে। সে রাষ্ট্রে গড়ে উঠে পবিত্র কোরআনে নির্দেশনা অনুযায়ী উচ্চতর সভ্যতা। এ ভূ-পৃষ্ঠে এটিই হলো শান্তির একমাত্র পথ। সে সাথে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বাঁচার পথও। এবং এরূপ বিজয় যে পুরাপুরি সম্ভব -সেটি প্রমাণ করে গেছেন প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ।
মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্বপালনের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কখনোই অজ্ঞতায় সম্ভব নয়। তবে সবচেয়ে বড় অজ্ঞতা নিরক্ষর হওয়া নয়। জ্ঞানবিজ্ঞানের জটিল বিষয়ে অজ্ঞ হওয়াও নয়। বরং সেটি মহান আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত খেলাফতের দায়ভারের কথাটি না জানা। আসমান-জমিন,গ্রহ-নক্ষত্র বা বিজ্ঞানের জ্ঞানে অজ্ঞ হওয়াতে মানব জীবনের মূল মিশনটি ব্যর্থ হয় না। কিন্তু ব্যর্থ হয় খেলাফতের দায়ভারটি কি এবং কীরূপে সেটি পালিত হবে -সেটি না জানায়। ইসলামের গৌরবকালে বহু নিরক্ষর ভেড়ার রাখালও এ জ্ঞানের বলে মহান আল্লাহতায়ালার সফল খলিফা হওয়ার বিশাল সামর্থ্য দেখিয়েছেন। অফিস-আদালতে চাকুরির প্রথম দিনেই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তার নিজ দায়-দায়িত্বটির কথাটি জেনে নিতে হয়। সেটি জানায় ব্যর্থ হলে সে ব্যর্থ হয় দায়িত্ব পালনে। সে তখন চাকুরিচ্যুত হয়। চাকুরি জীবনে নিজ দায়িত্বের সে জ্ঞানটুকু প্রতি পদে কম্পাসের কাজ করে।
মু’মিনের জীবনে তাই নামায-রোযা, হজ-যাকাত ফরজ করার আগে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। দায়িত্বপালনের কাজে ঈমানদারকে প্রতি পদে অনুসরণ করতে হয় পবিত্র কোরআনের নির্দেশাবলি ও নবীজী (সাঃ)র সূন্নতকে। যার মধ্যে কোরআন-সূন্নাহর জ্ঞান নাই তার দ্বারা খেলাফতের দায়িত্বপালন কীরূপে সম্ভব? তাই যার জীবনে নামায-রোযা আছে অথচ জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ নাই –বুঝতে হবে তার মাঝে প্রকৃত ঈমানদারি নাই। ঈমানের সে ঘাতক রোগ নিয়ে কোন ইবাদতই সঠিক হওয়ার কথা নয়। মানব জাতির ব্যর্থতা এক্ষেত্রে বিশাল। খেলাফতের দায়িত্বপালনে নিজ জানমাল ও নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগ দূরে থাক, অধিকাংশ মানুষ পরকালে পাড়ি জমাচ্ছে সে দায়ভারটির কথা না জেনেই। মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত নিয়ামতের এর চেয়ে বড় খেয়ানত বা অপচয় আর কি হতে পারে?
অনিবার্যতা যেখানে জিহাদের
মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত খেলাফতের দায়ভারের কারণে বেঈমানের রাজনীতি থেকে ঈমানদারের রাজনীতি সব সময়ই ভিন্নতর হয়। ঈমানদারের রাজনীতিতে জনগণের, রাজার বা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের নাই। সার্বভৌমত্ব একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। সার্বভৌমত্বের দাবিদার হওয়াই অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাই সেটি কুফরি। মুসলমানের রাজনীতি তাই গদীলাভ,অর্থলাভ বা ক্ষমতা লাভের জন্য নয়, বরং তার সবটুকুই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এ রাজনীতিতে জিহাদ তাই অনিবার্য হয়ে পড়ে। এমন রাজনীতির সবটুকুই তাই ইবাদত। ফলে এখানে সন্ত্রাস থাকে না, বরং থাকে পরম পবিত্রতা। থাকে মহান আল্লাহতায়ালার পথে ধনসম্পদ ও প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার ঈমানী জজবা। থাকে জান্নাত লাভের প্রেরণা। ঈমানদারের রাজনীতিতে এজন্যই গণহত্যা থাকে না। কারণ গণহত্যার পথ তো জাহান্নামের পথ। নবীজী (সাঃ)র আমলে মক্কা বিজয়ে তাই রক্তপাত হয়নি। রক্তপাত হয়নি জেরুজালেম বিজয়েও।
অপর দিকে সেক্যুলার রাজনীতিতে খেলাফতের বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের ধারণা থাকে না। বরং থাকে ইহকালীন স্বার্থ-উদ্ধারের লোভ। ফলে সে রাজনীতিতে থাকে না আল্লাহর পথে জিহাদের ধারণা। থাকে না আত্মত্যাগ বা শাহাদতের ধারণা। যা থাকে তা হলো ক্ষমতাদখল এবং ক্ষমতাদখলের পর সার্বভৌম ও স্বৈরাচারি শাসক হওয়ার লিপ্সা। সেক্যুলার রাজনীতিতে এ জন্যই অনিবার্য হয় পশুসুলভ হিংস্রতা। থাকে গদি দখল ও গদি বাঁচানোর লাগাতর লড়াই। রাজনীতিতে রক্তপাত তখন অনিবার্য হয়। সেক্যুলার রাজনীতি এভাবেই বিশ্বের বুকে অশান্তি ও আযাব ডেকে আনে। বাংলাদেশের রাজনীতি হলো এর বাস্তব উদাহরণ। এজন্যই এতো রক্তপাত। শেখ মুজিবের গদী রক্ষার রাজনীতিতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের রক্ত ঝরেছে, এবং অবিরাম ঝরছে হাসিনার রাজনীতিতেও। রাজনীতি ও ডাকাতির মধ্যে তখন কোন পার্থক্যই থাকে না।
মুসলমানের দেশ ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হবে, শরিয়তি বিধান আস্তাকুঁরে স্থান পাবে, প্রতিষ্ঠা পাবে কাফেরদের আইন, দেশ প্লাবিত হবে জুলুমের জোয়ারে এবং ইসলামের পক্ষের শক্তি নিহত, নির্যাতিত ও কারারুদ্ধ হবে – এমন এক দেশে জিহাদ থাকবে না তা কি ভাবা যায়? এমন দেশে মুসলমানগণ কি স্রেফ নামায-রোযা,হজ-যাকাত,দোয়া-দরুদের মধ্য ধর্মপালন সীমাবদ্ধ রাখবে? নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম কি এভাবে ইসলাম পালন করেছেন? তা হলে আবু জেহেল ও আবুল লাহাবদের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের নির্মূল করলো কারা? কিভাবে প্রতিষ্ঠা পেল শরিয়তের বিধান? কারাই বা রোমান ও পারসিক -এ দুই বিশাল সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে মুসলমানদের বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করলো? ইসলাম কি করে বাংলাদেশে এলো? “আমিরু বিল মা’রুফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার” অর্থঃ “ন্যায়ের হুকুম এবং অন্যায়ের নির্মূল” –এ হলো মু’মিনের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত মিশন। এ মিশন নিয়ে ঈমানদারকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয়। নইলে ঈমানের দায়ভার পালিত হয় না। পালিত হয় না খেলাফতের দায়ভার। নামায-রোযায় কাজা আছে, কিন্তু এ মিশনে কাজা নেই। এ মিশনে নিষ্ক্রীয় থাকাটি মুনাফেকি। ফলে মু’মিনের জীবনে এরূপ মিশনে আত্মনিয়োগ অনিবার্য কারণেই এসে যায়। সেটিই হলো ঈমানদারের জীবনে জিহাদ।
ঈমানদারের দুই অবস্থা
ঈমানদারের জীবনে দুই অবস্থা। হয় সে জিহাদের ময়দানে যুদ্ধাবস্থায় থাকবে, নতুবা জিহাদের প্রস্তুতি নিবে। এছাড়া তৃতীয় অবস্থা নেই। একমাত্র জিহাদের মাধ্যমেই সে ইসলামের শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে। তখন বিলুপ্ত করে জুলুম এবং প্রতিষ্ঠা দেয় শান্তির। জিহাদ মু’মিনকে এখানে জান্নাতের দরজার সামনে এনে খাড়া করে। জিহাদে জানমালের বিনিয়োগের মাধ্যমে সে পায় শহীদ বা গাজী হওয়ার মর্যাদা। মু’মিনের জীবনে শহীদ ও গাজী – এ দুটি পরিচয় ছাড়া ভিন্ন পরিচয় নাই। তৃতীয় কোন পরিচয় সাহাবীদের জীবনে ছিল না। শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী তাই শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। নবী-রাসূলের মর্যাদার পর মানবজীবনে এটিই শ্রেষ্ঠ মর্যাদা। শহীদগণ মূলত মহান আল্লাহতায়ালার মেহমান। জান্নাতের অপেক্ষায় এ মহান মেহমানদের হাজার হাজার বছর অপেক্ষায় থাকার রেওয়াজ নাই। তাদের জীবনে কবরের জীবন,আলমে বারযাখ এবং পুল সিরাত পাড়ি দেওয়ার মহাপরীক্ষাও নাই্। নেই রোয হাশরের বিচার দিনে “ইয়া নফসি”,“ইয়া নফসি” বলার যাতনা। শহীদ হওয়ার সাথে সাথে তাদের প্রবেশ ঘটে সরাসরি জান্নাতে। জিহাদ যে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কত প্রিয় সে বর্ণনাটি পবিত্র কোরআনে এসেছে এভাবে,” নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর পথে যুদ্ধ করে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধ ভাবে।”–(সুরা সাফ আয়াত ৪)। নবীজী (সাঃ)র কাছে একবার কিছু সাহাবী প্রশ্ন করেছিলেন,“হে আল্লাহর রাসূল! মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কোন কাজটি সবচেয়ে প্রিয়?” তারা চাচ্ছিলেন,সবচেয়ে প্রশংসনীয় সে কাজটি জানা গেলে তারা সে কাজে অংশ নিবেন।” তাদের সে প্রশ্নের জবাবে উপরুক্ত আয়াতে ব্যক্ত হয় মহান আল্লাহতায়ার কাছে মু’মিনের জীবনের সবচেয়ে পছন্দের আমলটি।
তাড়না শাহাদতের
মানব জীবনে শাহাদত লাভের চেয়ে বড় বিজয় নেই। বড় অর্জনও নেই। সাহাবীদের জীবনে এ মর্যাদা লাভে যেমন প্রচন্ড আকুতি ছিল, তেমনি তাড়াহুড়াও ছিল। সে সাথে জানমালের বিপুল বিনিয়োগ বা কোরবানিও ছিল। মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সে মর্যাদাটি লাভে তারা নিজেরা যেমন বার বার দোয়া করতেন,তেমনি অন্যকেও দোয়া করতে অনুরোধ করতেন। সে মর্যাদা লাভে তারা নিত্য-নতুন জিহাদের ময়দান খুলতেন। যেখানেই জিহাদ, সেখানেই তাদের ভিড় শুরু হতো। নিজ অর্থ, নিজ উঠ, নিজে ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে তারা জিহাদে হাজির হতেন। মুসলিমের জিহাদ স্রেফ প্রতিরক্ষামূলক ছিল তা নয়। ছিল আক্রমণাত্মকও। এ পৃথিবীর প্রতিইঞ্চি ভূমিই মহান আল্লাহতায়ালার। সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা একমাত্র তারই। কিন্তু সে ভূমি আজ কাফেরদের হাতে অধিকৃত, ফলে ঈমানী দায়ভার হলো সে দখলদারি থেকে অধিকৃত ভূমির মুক্তিদান। এ লক্ষ্যেই শুরু হয় লাগাতর জিহাদ। ইসলামি রাষ্ট্র তাই স্রেফ আরব ভূমিতে সীমিত থাকেনি। লাগাতর বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া, আব্বাসীয় ও ওসমানিয়া খলিফাদের শাসন এসেছে। খলিফাদের পক্ষ থেকে প্রায প্রতিবছর সংঘটিত হতো জিহাদ। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জিহাদ সংঘটিত না হলে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে গজব আসবে সে ভয়ও তাদের ছিল। ফলে প্রতি বছরই মুসলিম রাষ্ট্রের ভূগোলে বৃদ্ধি ঘটতো।
বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতা
মু’মিনের কাজ শুধু নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে মসজিদ খুঁজে বের করা নয়। জিহাদের অঙ্গণও খুঁজে বের করা। জিহাদের মিশন নিয়েই সূদুর তুর্কভূমি থেকে বাংলার মাটিতে ছুটে এসেছিলেন মহান বীর ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। সুজলা-সুফলা এ বঙ্গভূমির উপর তার যুদ্ধজয়ের ফলে দেশের বিশাল জনগণ মুক্তি পেয়েছিল মুর্তি পুজার জঘন্য পাপ থেকে। সুযোগ পায় ইসলামের অনুসরণের মধ্য দিয়ে জান্নাত লাভের। বাংলার মুসলিমদের জন্য এ মহাকল্যাণটি কি কোন বাঙালী করেছে? করেছে একজন অবাঙালী তুর্কী মোজাহিদ। অথচ বাঙালী মুসলিম ইতিহাসের এ মহান ব্যক্তিটির স্মৃতি আজ অবহেলিত। তার জীবন নিয়ে কমই আলোচন হয়। বরং ষড়যন্ত্র হচ্ছে তাঁকে ভূলিয়ে দেয়ার। মুসলিম শাসনের শুরুতে বঙ্গভূমিতে আজকের ন্যায় শতকরা ৯১% মুসলমানের বাস ছিল না। কিন্তু সে জন্য কি শরিয়তের প্রতিষ্ঠা করতে এক মুহুর্ত বা এক দিনও দেরী হয়েছিল? ওয়াক্ত হলে যেমন নামায আদায় করা ফরজ, তেমনি একখন্ড রাষ্ট্র পেলে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা করাও ফরজ। অখন্ড ভারতের সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের মাঝে সেটি সম্ভব ছিল না বলেই ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন এ দেশটি সেক্যুলারিস্টদের হাতে অধিকৃত হওয়ায় শরিয়তের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।
ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে আজকের বাংলাদেশে। দেশ অধিকৃত ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। বাংলার ১৬ কোটি স্বঘোষিত মুসলমানগণ ভূলে গেছে খেলাফতের দায়িত্ব পালনে নিজ নিজ দায়বদ্ধতার কখা। তাদের চেতনায় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে যেমন ভাবনা নেই, তেমনি ভাবনা নেই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়েও। কোনরূপ তাড়না নেই দুর্বৃত্তদের দখলদারির নির্মূলে। সে লক্ষ্যে জিহাদও নাই। মুসলিম জীবনের প্রায়োরিটি আজ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ইসলামের অপমানকর পরাজয়কে তারা নীরবে মেনে নিছে। অথচ হৃদয়ে ঈমান থাকলে ইসলামের এ পরাজয় কি তাদের মনে আগুণ ধরিয়ে দিত না? মুসলিম হওয়ার অর্থই তো আমৃত্যু মহান আল্লাহতায়ালার লড়াকু সৈনিকে পরিণত হওয়া।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিমের গাদ্দারিটা খোদ আল্লাহতায়ালার সাথে। গাদ্দারি এখানে খেলাফতের দায়ভার পালন না করার। সংখ্যায় বিপুল হয়েও ইসলামের শত্রুপক্ষের বিজয়কে নীরবে মেনে নেওয়ায় তারা ব্যস্ত। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের বদলে তারা নিজেরা ভোট দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের সার্বভৌমত্ব। বাংলাদেশের সংবিধান তাই আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গাদ্দারির দলিল। তাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আল্লাহর শরিয়তি নিজামের প্রতিষ্ঠাকে সংবিধানিক ভাবে অসম্ভব করে রেখেছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগকে আখ্যায়ীত করছে ধর্মীয় উগ্রবাদ রূপে। জিহাদ আখ্যায়ীত হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রূপে। সে অভিযোগ এনে হাজার হাজার মুসলিমকে কারাগারে তোলা হয়েছে। অথচ ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা জঙ্গিবাদ হলে খোদ নবীজী (সাঃ) ও তাঁর মহান সাহাবীগণও যে জঙ্গি ছিলেন -তা নিয়ে কি সন্দেহ চলে? সেরূপ জঙ্গি হওয়ার মধ্যেই কি তবে নবী জীবনের অনুসরণ নয়? অথচ সে সহজ সত্যটুকু বুঝতেও তারা ব্যর্থ হচ্ছে। বাঙালী মুসলিমের এটিই কি সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নয়? মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে তারা কি এ ব্যর্থতা নিয়ে হাজির হবে? তাদের পরিণাম যে তাতে কতটা ভয়াবহ হবে সে ভাবনা কি আছে? ১ম সংস্করণ ২৭/২/২০১৫; ২য় সংস্করণ ২৩/১০/২০২০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018