মু’মিন, মুনাফিক ও কাফের এবং মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয় প্রসঙ্গ
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on October 10, 2021
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
তিনটি পরিচয় এবং ত্রিভাগের বিভাজন
পবিত্র কুর’আনের অতি ব্যবহৃত তিনটি পরিভাষা হলো মু’মিন, মুনাফিক ও কাফের। এ তিনটি পরিভাষা পরিচয় বহন করে তিনটি ভিন্ন বিশ্বাস, তিনটি ভিন্ন জীবন-পদ্ধতি ও তিনটি ভিন্ন জাতের মানুষের। এ তিনটি পরিচয়ের মধ্যেই মহান আল্লাহতায়ালা সমগ্র মানব জাতিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই তিন শ্রেণীর বাইরে চতুর্থ কোন শ্রেণী নাই। এ তিনটি বিশেষ পরিচয়ের যে কোন একটিকে নিয়েই প্রতিটি ব্যক্তির বাঁচা, বেড়ে উঠা এবং মৃত্যু। আখেরাতে কোন মৃত্যু নাই। সে অনন্ত-অসীম পরকালীন জীবনে কার কোথায় বাসস্থান হবে -জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে যাবে, সে চুড়ান্ত বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে এ দুনিয়ার বুকে যে পরিচয়টি নিয়ে ব্যক্তির জীবন কাটে, তার উপর। তাই কে কোথায় জন্ম নিল, কর্ম জীবনে কোন পেশাটি বেছে নিল এবং পেশাদারীতে কতটা সফল হলো, সেটি সে অনন্ত জীবনের হিসাব নিকাশে গুরুত্বহীন। সে বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উপরুক্ত তিনটি পরিচয়ের কোনটি নিয়ে বেড়ে উঠলো ও এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিল -তার উপর।
তাই মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়টি হলো মু’মিন, মুনাফিক ও কাফের বলতে কি বুঝায় এবং সে ভিন্ন তিনটি পরিচিতি নিয়ে বাঁচার যে ভিন্ন ভিন্ন পরিণতি -সেটি জানা। এ বিষয়টি জানায় ভূল হলে, পুরা বাঁচাটাই ভয়ানক বিপর্যয় ঘটায়। তখন এ জীবনের সকল সামর্থ্য ব্যয় হয় জাহান্নামের ইন্ধন হতে। নবী-রাসূলদের হাতে স্কুল-কলেজ ছিল না। তারা ছিলেন ভ্রাম্যমন সার্বক্ষণিক শিক্ষক। তাদের শিক্ষাদানে সর্বাধিক গুরুত্ব পেত ইহকালীন ও পরকালীন –এ উভয় জীবনে সাফল্য দেয়া। গুরুত্ব পেত উপরুক্ত তিনটি পরিচিতি ও তার পরিণতি তুলে ধরা। এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পেত মু’মিন রূপে গড়ে তোলা ও কাফের ও মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচানো। এটিই হলো ইসলামী শিক্ষার মোদ্দা কথা। এরূপ শিক্ষাদানের ফলে মানব জাতির ইতিহাসই পাল্টে গেছে; মুসলিমদের হাতে সৃষ্টি হয়েছে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। নবী-রাসূলদের শিক্ষক ছিলেন খোদ মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা। তাদের শিক্ষাদানে অনুসৃত হতো মহান আল্লাহতায়ালার নীতি। ফলে নবী-রাসূলদের অনুসারীগণ বিবেচিত হয়েছেন জান্নাতের যোগ্য রূপে। সে নীতিই পূর্ণতা পায় নবীজী (সা;)’র আমলে; এবং সেটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়ার মধ্য দিয়ে। তখন পবিত্র কুর’আন পরিণত হয় পাঠ্যদানের মূল টেক্সটবুকে। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় পরিত্যক্ত হয়েছে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল সে শিক্ষানীতি। ফলে এ শিক্ষাব্যবস্থায় ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী, ইত্যাদি নানা পেশার মানুষ গড়ে উঠলেও ছাত্ররা ব্যর্থ হচ্ছে মু’মিন তথা জান্নাতের যোগ্য বাসিন্দা রূপে বেড়ে উঠতে। বরং বিপুল সংখ্যক ছাত্র গড়ে উঠছে জাহান্নামের ইন্ধন রূপে। এদের সংখ্যাটি বিপুল হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামের পক্ষের শক্তি পরাজিত এবং বিজয়ী হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষ। ফলে আদালত থেকে বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়তী আইন। এবং প্লাবন এসেছে গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের রাজনীতির। দেশের রাজনীতি, শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতি পরিণত হয়েছে শয়তানকে খুশি করা এবং মহান আল্লাহতায়ালার আযাব ডেকে আনার হাতিয়ারে।
এ পৃথিবী পৃষ্ঠে কীরূপ চরিত্রের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মিত হবে -সে বিষয়টি পুরাপুরি নির্ভর করে মু’মিন, মুনাফিক ও কাফের -এই তিন শ্রেণীর মানুষের মাঝে কাদের হাতে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গণের নিয়ন্ত্রণ, তার উপর। মুনাফিক ও কাফেরদের হাতে সমাজ ও রাষ্ট্র অধিকৃত হওয়ার বিপদটি এজন্যই ভয়ানক। তখন পৃথিবী পৃষ্ঠের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান যে রাষ্ট্র -সেটিই তখন জনগণকে জাহন্নামে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়। এজন্যই মু’মিনদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, শয়তানের দখলদারী থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করা। বস্তুত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চুড়ান্ত লড়াইটি হয় রাষ্ট্রের উপর দখলদারী নি্য়ে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান রূপে টিকবে কি টিকবে না –তা নির্ভর করে এ লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার উপর। মুসলিম জীবনে এ লড়াইয়ের গুরুত্ব এতোই অধিক যে মহান আল্লাহতায়ালা এ লড়াইকে জিহাদ তথা সর্বোচ্চ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে্ন। মুসলিমদের দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের ন্যায় এ বিশাল প্রতিষ্ঠানকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে পরিণত করা। মু’মিনগণ সেটি করে ইসলামী রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দাওয়াতী কাজ, প্রকাশনা, প্রশাসন, আইন-আদালতের মাধ্যমে। এজন্যই ইসলাম শুধু উন্নত আখলাক ও ঈমান-আক্বিদার কথা শেখায় না, বরং গুরুত্ব দেয় মুনাফিক ও কাফেরদের অধিকৃতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার কথাও। কারণ রাষ্ট্রকে মুনাফিক ও কাফির শক্তির হাতে অধিকৃত রেখে মানুষকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলার কাজটি কখনোই সম্ভব হয় না। এজন্যই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতকে ফরজ করেননি, জিহাদকেও ফরজ করেছেন। বরং জিহাদকে সর্বোচ্চ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ, এ শ্রেষ্ঠ ইবাদতটি সঠিক ভাবে না হলে শয়তানের অধিকৃতি থেকে মুক্তি মেলে না। তখন অন্যান্য ইবাদতগুলো যত বেশীই হোক -তা কাঙ্খিত ফল দেয় না।
মানব জাতির বিভাজনে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মানুষের বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, গোত্র ও ভৌগলিক পরিচয় গুরুত্ব পায়নি। বরং গুরুত্ব পেয়েছে ব্যক্তির ঈমান তথা বিশ্বাস এবং আমল। এবং নেক আমল সমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার নির্মাণে জিহাদই হলো ইসলামের মূল হাতিয়ার। স্রেফ মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়িয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার কাজ হয়না। ঈমান যে আছে -সেটি বুঝা যায় জিহাদ থেকে। তাই মু’মিনকে শুধু নামাযী, রোযাদার ও হাজী হলে চলে না, তাকে অবশ্যই মুজাহিদ হতে হয়। সে যে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে তাঁর সৈনিক -সেটি জিহাদে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। যার মধ্যে জিহাদ নাই -সে ব্যক্তি বিস্তর নামায-কালাম করলেও গণ্য হয় মুনাফিক রূপে। নবীজী (সা:)’র আমলে যারা মুনাফিক রূপে চিহ্নিত হয়েছিল তারা যে নামায-রোযা কম করতো –বিষয়টি তা নয়। তারা নামায পড়তো নবীজী (সা:)’র পিছনে। তাদের মুনাফিক হওয়ার কারণ, তাদের জীবনে জিহাদ ছিল না। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ঈমানদার বান্দা থেকে শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত চান না, চান তাঁর দ্বীনের বিজয়ে জান, মাল, মেধা তথা সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ। নিয়ামত ভরা জান্নাতের মূল্য এরূপ বিনিয়োগের মাধ্যমে মৃত্যুর আগেই পরিশোধ করতে হয়। নবীজী (সা:)’র সাহাবাগণ তো সেটিই করেছেন। তাই শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা রণাঙ্গণে শহীদ হয়েছেন। ইসলাম বিজয়ী হয়েছে, মুসলিমগণ বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছে তো তার রক্তের বিনিময়ে। তাদের অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগ মহা করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালার বিনিয়োগ নামিয়ে এনেছে। তাছাড়া নিষ্ক্রীয়তায় বিজয় বাড়ে শয়তানী শক্তির। তখন পরাজিত হয় ইসলাম। এমন নিষ্ক্রীয়তা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অতি অপছন্দের, মুসলিম তাই নিষ্ক্রীয় হতে পারে না। জিহাদ-বিমুখ এমন নিষ্ক্রীয় মানুষেরাই নবীজী (সা:)’র যুগে ঘৃণীত হয় মুনাফিক রূপে।
মু’মিন, মুনাফিক ও কাফেরের পরিচয়
পবিত্র কুর’আনে মানব জাতির বার বার উল্লেখ এসেছে মু’মিন, মুনাফিক ও কাফের -এ তিনটি পরিচয়ের সূত্র ধরে। আখেরাতেও তাদের শেষ ঠিকানা এবং পুরস্কার বা শাস্তি নির্ধারিত হবে এ বিশেষ পরিচয়ের ভিত্তিতেই। ঈমানদারগণ যাবে জান্নাতে, কাফেরগণ যাবে জাহান্নামের আগুনে এবং মুনাফিকগণ যাবে জাহান্নামে সবচেয়ে বীভৎসতম ও নিন্মতম স্থানে। ঈমানদার তো তারাই যারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর সকল নবী-রাসূল, ফিরেশতা ও আসমানী কিতাবের উপর। তারা বিশ্বাস করে আখেরাত, রোজ হাশরের বিচার দিন, জান্নাত-জাহান্নাম ও তাকদীরের উপর। বিশ্বাস করে শরিয়তি আইনের উপর। এবং ইসলামকে তাঁরা মনেপ্রাণে মেনে নেয় একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান রূপে। ইসলামী পরিভাষায় এরূপ অটল এবং সামগ্রিক বিশ্বাসকেই বলা হয় ঈমান। উপরুক্ত বিশ্বাসগুলির সাথে কোন ভেজাল চলে না; এবং কোন একটিকে অবিশ্বাস করলে সে আর ঈমানদার থাকে না। সে কাফেরে পরিণত হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ঈমানকে শুধু বিবিধ বিশ্বাসগুলোতে সীমিত রাখলেও চলেনা, ঈমানের প্রকাশ ঘটাতে হয় চিন্তা, কর্ম ও আচরণে।
ঈমানদারের জীবনে থাকে মহান আল্লাহতায়ার ইচ্ছা ও এজেন্ডা পূরণের অদম্য বাসনা; চেতনায় থাকে তাঁকে খুশি করার বিরামহীন প্রেরণা। এ লক্ষ্যেই সে বাঁচে, লড়াই করে, সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ করে এবং প্রাণ দেয়। এভাবেই ঈমানদারের জীবনে আসে নেক আমলের প্লাবন। আসে আমৃত্যু জিহাদ। অনৈসলামী মতবাদ ও ধর্মমতের উপর ইসলামের বিজয়ের তাড়নায় সত্যিকার ঈমানদার মাত্রই তাই মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিকে পরিণত হয়। বস্তুত ঈমানের নির্ভেজাল ও চুড়ান্ত প্রকাশটি ঘটে জিহাদে। ইসলামের শত্রুপক্ষ জিহাদের সে শক্তি বুঝে। তাই তাদের এজেন্ডা মসজিদ-মাদ্রাসা ও নামায-রোযার বিনাশ নয়, বরং জিহাদহীন ইসলাম। তাই বেশী বেশী নামায-রোযা ও মসজিদ নিয়ে তাদের আপত্তি নাই; কিন্তু চায়, মুসলিমগণ জিহাদ থেকে দূরে থাকুক। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার হিসাব-নিকাশ অন্যরূপ। ঈমানের পরিমাপে জিহাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, জিহাদ না থাকার অর্থই হলো ঈমান না থাকা। সেটি ঘোষিত হয়েছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, যাদের জীবনে জান ও মালের জিহাদ আছে ঈমানের দাবীতে একমাত্র তারাই সত্যবাদী। এজন্যই জিহাদশূণ্য ব্যক্তিগণ ঈমানের দাবী করলে নবীজী (সা:)’র যুগে তারা চিহ্নিত হতো মুনাফিক রূপে।
অপর দিকে কাফেরদের পরিচয়টি গোপন থাকার নয়। কাফের তো তারাই যারা বিশ্বাস করে না মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলদের। তারা বিশ্বাস করে না পবিত্র কুর’আনকে। তাদের অনেকে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর কোন কোন নবীকে বিশ্বাস করলেও বিশ্বাস করে না পবিত্র কুর’আন ও শেষ নবী মহম্মদ (সা:)কে। এবং সে অবিশ্বাসের কথাটি তারা প্রকাশ্যেই বলে। অপর দিকে মুনাফিকদের চিনতে হলে তাদের চিন্তা-চেতনা, দর্শন ও কর্মের গভীরে নজর দিতে হয়। দেখতে হয় তাদের বন্ধুদের; বন্ধুদের মাঝেই প্রকৃত পরিচয় মেলে তাদের চিন্তা-চেতনার। কারণ, বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় নিজেদের মনের মত মানুষকে। তারা সর্বসময়ের চেষ্টা, নিজেদের আসল পরিচয়কে লুকিয়ে রাখায়। এজন্যই তোরা মুনাফিক। তারা জোরে-সোরে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলদের উপর বিশ্বাসের কথা বলে। তারা নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাতও পালন করে। পবিত্র কুর’আনের উপর বিশ্বাসের কথাও বলে। নবীজী (সা:)’র আমলে মুনাফিকগণ মসজিদে নববীতে গিয়ে নবীজী (সা:)’র পিছনে প্রথম সারিতে নামায পড়তো, রোযাও রাখতো। নবীজী (সা:) যে মহান আল্লাহতায়ালার রাসূল -সে ঘোষণাও তারা জনসম্মুখে দিত। কিন্তু এসবই করতো স্রেফ লোক দেখানোর জন্য। তাদের অন্তরের চিত্রটি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। অন্তরে তারা ছিল ইসলামের জঘন্য শত্রু। তারা মনে প্রাণে চাইতো কাফেরদের বিজয়। নবীজী (সা:)’র যুগে কাফেরদের বিজয় বাড়াতে তাদের সাথে চুক্তিও করেছিল। মুনাফিকগণ সেরূপ ষড়যন্ত্র প্রতি যুগেই করেছে এবং এখনো করে। এরাই হলো ইসলামের ঘরের শত্রু। অতীতে মুসলিমদের বড় বড় ক্ষতি গুলো হয়েছে এদের হাতে এবং এখনো লাগাতর হচ্ছে।
বনের বাঘের নখরে অধিক মানুষের মৃত্যু হয় না, কারণ হিংস্র বাঘের পরিচয়টি সবার জানা। ফলে জনপদে বাঘ নামলে সেটির হত্যায় শত শত মানুষ অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামে। এজন্যই বাঘের নখরে কারো মৃত্যু হলে সেটি বিশাল খবর হয়। কিন্তু প্রতি বছর শত শত মানুষের নীরবে মৃত্যু ঘটে ঘরের গর্তে লুকিয়ে থাকা স্বর্পের দংশনে। তেমনি দেশের উপর বিদেশী কাফেরদের হামলা হলে সেটিও বিশাল খবর হয়। কিন্তু মুসলিম দেশ ভেঙ্গে যাচ্ছে, ইসলামপন্থীগণ নিহত ও কারাবন্দী হচ্ছে, ছাত্রদের পাঠ্যসূচী থেকে কুর’আন শিক্ষা বিলুপ্ত হচ্ছে এবং আদালত থেকে শরিয়তী আইন অপসারিত হচ্ছে দেশজ মুনাফিকদের হাতে। কিন্তু বিস্ময়! ইসলামের এ জঘন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশে যুদ্ধ হয়না। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে ইসলাম ও মুসলিমদের মূল শত্রু হলো এই দেশী মুনাফিকগণ; বিদেশী কাফেরগণ নয়। এদের সফল কুকীর্তি হলো, বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামকে এরাই পরাজিত করে রেখেছে। মহান আল্লাহতায়ার কাছেও তাই সবচেয়ে ঘৃণীত ও বধযোগ্য হলো ইসলামের ঘরেরর শত্রু মুনাফিকগণ। মুসলিমদের জিহাদ তাই শুধু কাফেরদের বিরুদ্ধ নয়, বরং মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও। মহান নবীজী (সা:)’র ওফাতের পর প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা:)কে যে প্রকান্ড জিহাদ করতে হয়েছে সেটি ছিল এই মুনাফিকদের নির্মূলে। সে মুনাফিকগণ যে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা:)কে অবিশ্বাস করতো তা নয়। তারা যে নামায-রোযা পালন করা ছেড়ে দিয়েছিল, সেটিও নয়। তারা শুধু রাষ্ট্রের হাতে যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। তারা নিজেদের যাকাত নিজেদের পছন্দের লোকদের মাঝে বিতরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু হযরত আবু বকর (রা:)’র ঘোষণা ছিল, নবীজী (সা:)’র আমলে মানুষ যেরূপ যাকাতের উটগুলোই শুধু দিত না, উটগুলোকে বাঁধার রশিও দিত, সেরূপ না দিলে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ। নবীজী (সা:)’র ইসলাম থেকে তিনি সামাত্যতম সরতে রাজী ছিলেন না। সেদিন সে জিহাদ সফল না ইসলাম নবীজী (সা:)’র হাতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামের সে কুর’আনী রূপটি মুনাফিকদের হাতে বিলুপ্ত হতো। যেমনটি আজ হয়েছে। ইসলাম থেকে দূরে সরতে সরতে ইসলামের কুর’আনী রূপটি বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে আজ আর বেঁচে নাই। ইসলামের নামে আজ যা বেঁচে আছে তাতে নবীজী (সা:)’র আমলের ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, হুদুদ, তাকওয়া সমৃদ্ধ নেতৃত্ব, শুরা ভিত্তিক শাসন, মুসলিম ঐক্য ও জিহাদ –এর কোনটাই বেঁচে নাই। ইসলাম বেঁচে আছে অসংখ্য বিদ’আত ও বিকৃত রূপ নিয়ে।
কেন এ বিচ্যুতি ও বিপর্যয়?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর এরূপ অবস্থায় পৌঁছার মূল কারণ, মুনাফিক নির্মূলের কাজটি মুসলিম সমাজে হয়নি। অথচ মুনাফিকদের নির্মূলে মহান আল্লাহতায়ার নির্দেশটি হলো: “হে নবী, কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হন। তাদের ঠিকানা জাহান্নামে। সেটি কতোই না নিকৃষ্টতম স্থান!” –(সুরা তাহরীম, আয়াত ৯)। কি বিস্ময়! ইসলামের যেসব মুনাফিকরূপী শত্রুদের স্থান হবে জাহান্নামে, মুসলিমগণ তাদেরকে শাসনক্ষমতায় বসিয়ে মাননীয় প্রসিডেন্ট বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে কুর্ণিশ করে। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে এর চেয়ে জঘন্যতম অবাধ্যতা আর কি হতে পারে? অথচ মুসলিম জীবনে জিহাদকে হতে হয় অবিরাম। নামায-রোযাও যেমন বিরতি চলে না, তেমনি বিরতি নাই জিহাদেও। কারণ, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের যুদ্ধটিও বিরামহীন। বিদেশী শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদটি হয় সীমান্তে। কিন্তু মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদটি হয়ে দেশের অভ্যন্তরে। সেটি যেমন প্রতিটি জনপদে। তেমনি রণাঙ্গণের সশস্ত্র যুদ্ধসহ রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণে। সশস্ত্র যুদ্ধে মাঝে মধ্যে বিবতি আছে, কিন্তু রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির জিহাদে কোন বিরাম নাই।
কাফেরগণ যে ইসলামে অবিশ্বাসী –সে কথাটি তারা প্রকাশ্যেই বলে। এ নিয়ে কাফেরদের মাঝে কোন প্রতারণা বা ছলনা নাই। কিন্তু ঈমান নিয়ে প্রচণ্ড প্রতারণা করে মুনাফিকগণ। তারা মুসলিমের লেবাস পড়ে ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে মুসলিম দেশে। তাদের কুকীর্তিতে পরিপূর্ণ মুসলিম ইতিহাস। তাদের শাস্তি তাই শুধু শত্রুতার জন্য নয়, বাড়তি শাস্তিটা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার জন্য। সেটি মুসলিম দেশে বিদেশী কাফের শত্রুদের ডেকে আনে বিপদ বাড়ানোর জন্য। ইসলামে ঈমান এনেছি এবং “আমরাও মুসলিম” বলে তারা বার বার কসম খায়। এরূপ কসম খেত নবীজী (সা:)’র আমলের মুনাফিকগণও। কিন্তু তাদের কসম যে মিথ্যা -সে সাক্ষ্যটি মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন সুরা মুনাফিকুনে। বলা হয়েছে, “((হ নবী), যখন মুনাফিকগণ আপনার কাছে আসে এবং বলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ জানেন যে আপনি তাঁর রাসূল; এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন মুনাফিকগণ অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা নিজেদের ঈমানের শপথ বাক্যকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে, তারা যা কিছু করছে তা কতই না খারাপ।” –(সুরা মুনাফিকুন আয়াত ১-২)।
মুনাফিকগণ তাদের ঈমান নিয়ে খেলা করে। কখনো সামনে ঈমানদার সাজে, কখনো আবার বেঈমানে পরিণত হয়। এরূপ মুনাফিকি তাদেরকে আল্লাহতায়ালার দরবারে রহমত ও মাগফিরাত লাভের অযোগ্য করে গড়ে তোলে। তাদের ক্বালবের উপর এঁটে দেয়া হয় মোহর। ফলে তারা অযোগ্য হয় হিদায়েত লাভে। এভাবে হিদায়েতের অযোগ্য হওয়াটি মানব জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক প্রাপ্তি। ফলে কাফেরগণ ইসলামের ফিরে আসার সুযোগ পেলেও সে সুযোগ জুটে না মুনাফিকদের। ফলে তারাই সমাজের সবচেয়ে বিপর্যস্ত মানুষ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, কাফেরগণ কাফের সমাজে গড়ে উঠলেও মুনাফিকদের ন্যায় নিকৃষ্ট জীবগণ বেড়ে উঠে মুসলিম সমাজে। অথচ মুসলিমগণই পেয়েছে পবিত্র কুর’আনের ন্যায় মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। রাষ্ট্রের ভয়ানক শত্রুগণ কখনোই কৃষক বা শ্রমিক পাড়ায় সৃষ্টি হয়না, তারা গড়ে উঠে আশির্বাদ পুষ্ট সেনাবাহিনী বা মন্ত্রী পাড়ায়। মুনাফিকদের ব্যপারে বর্ণিত হয়েছে, “বিষয়টি এরূপ যে তারা ঈমান আনলো, তারপর আবার কুফরি করলো, অতঃপর তাদের ক্বলবের উপর মোহর মেরে দেয়া হয় এবং তাতে ব্যর্থ হয় কোন কিছু বুঝতে।” –(সুরা মুনাফিকুন আয়াত ৩)। সমঝবুঝের সামর্থ্যই মানব সন্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। সে গুণটি না থাকলে তাদের চেতনায় বিলুপ্ত হয় সত্য ও অসত্য এবং কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়গুলো বুঝার সামর্থ্য। এবং সে সামর্থ্যই কেড়ে নেয়া হয় মুনাফিকদের থেকে –সেটি ক্বলবের উপর মোহর লাগানোর ফলে। ফলে তারা বাঁচে অসত্য, অন্যায় ও প্রতারণা নিয়ে। সুরা তাওবার ৬৭ নম্বর আয়াতে তাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “মুনাফিক নর ও নারীর গতিবিধি এক রকম; তারা অসৎ কাজে নির্দেশ দেয় এবং সৎ কাজে বাধা দেয়, এবং কল্যাণকর কাজ থেকে নিজেদের হাত ফিরিয়ে রাখে। তারা আল্লাহকে ভূলে গেছে, কাজেই আল্লাহও তাদেরকে ভূলে গেছেন। নিঃসন্দেহে মুনাফিকরাই হলো নাফরমান।”
ঈমানদার হওয়ার শর্ত শুধু মুখে “আমিও মুসলিম” বলা নয়। বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি, কর্ম ও যুদ্ধ-বিগ্রহে প্রমাণ করতে হয়, সে ইসলামের পক্ষের শক্তি এবং ইসলামের বিজয় চায়। কিন্তু যাদের রাজনীতিতে ইসলামকে বিজয়ী করার ভাবনা নাই, ইসলামের পক্ষ নেয়াকে যারা সাম্প্রদায়িকতা করে, যারা নিজেদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও সময়সহ সকল সামর্থ্যকে ব্যয় করে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, দলতন্ত্র ও কোন ব্যক্তিকে বিজয়ী করতে এবং যাদের সৌহার্দ ও বন্ধুত্ব বিদেশী কাফের শক্তির সাথে –তারা আদৌ মুসলিম হওয়ার যোগ্য? ইসলাম কি এসবের অনুমতি দেয়? মুসলিমকে প্রতিপদে পথ চলতে হয় চেতনায় মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাকে বিজয়ী করার ভাবনা নিয়ে। এবং সেটি যেমন বুদ্ধিবৃত্তিতে, তেমনি রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহে। যাদের চেতনায় সে ভাবনা নাই, মহান আল্লাহতায়ালাও তাদেরকে ভূলে যান –উপরের আয়াতে তো সেটিই বলা হয়েছে। অথচ মুসলিম সমাজে ঘটছে উল্টোটি। মহান আল্লাহতায়ালা যে মুনাফিকদেরকে ভূলে গেছেন ও যাদেরকে তিনি জাহান্নামে নিতে চান -তাদেরকেই মুসলিমগণ বন্ধু ও জাতির পিতা বলছে এবং তাদের মুর্তি গড়ে সে মুর্তির পায়ে ফুল দিচ্ছে। এই হলো ইসলাম ও মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার সাথে তাদের গাদ্দারীর নমুনা।
মুনাফিকদের চরিত্রের বর্ণনা এসেছে সুরা নিসার ১৪৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “অবশ্যই মুনাফিকগণ প্রতারণা করেছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের সাথে প্রতারণা করে। বস্তুত তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন লোক দেখানোর জন্যে শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। এবং (তারা যেন) দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয়, ওদিকেও নয়। বস্তুত আল্লাহ যাকে গুমরাহ করে দেন, (হে নবী) আপনি তাদের জন্য কোথাও কোন পথই পাবেন না।” মুনাফিকদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও কর্মে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার ভাবনা থাকে না; এমন কি সেরূপ ভাবনা তখনও থাকে না যখন তারা নামাযে দাঁড়ায়। সেরূপ ভাবনামুক্ত চেতনা নিয়ে বাঁচাকেই তারা সেক্যুলারিজম বলে। পবিত্র কুর’আনে নামাযকে যিকর তথা আল্লাহতায়ালার স্মরণ বলে আখ্যায়ীত করা হয়েছে, কিন্তু মুনাফিকের নামাযে সে যিকর থাকে না। সেটিই বর্ণিত হয়েছে উপরুক্ত আয়াতে।
মুনাফিকদের চরিত্রের আরো কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে সুরা আনকাবুতের ১০-১১ নম্বর আয়াত। বলা হয়েছে, “কিছু লোক মনে বলে, আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তারা নির্যাতিত হয় তখন মানুষের পক্ষ থেকে কৃত নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মত মনে করে। যখন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে (ঈমানদারদের প্রতি) কোন সাহায্য আসে তখন তারা বলতে থাকে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। বিশ্ববাসীর অন্তরে যা আছে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন? আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা সত্যিকার বিশ্বাসী এবং কারা মুনাফিক।”
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “যার মধ্যে ৪টি দোষ পাওয়া যাবে সেই খাটি মুনাফিক। সে ৪টি দোষ হলো: ১). তার কাছে আমানত রূপে কিছু রাখলে সে তার খিয়ানত করে, ২). সে মিথ্যা কথা বলে, ৩). কোন ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে, এবং ৪). ঝগড়া-বিবাদ করলে সে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। আর যার মধ্যে উপরুক্ত দোষের একটি দোষ থাকবে, তার মধ্যে মুনাফিক হবার স্বভাব বিদ্যমান আছে যদি না সে সংশোধন করে। -(বুখারী ও মুসলিম)।
সেকালের মুনাফিক ও একালের মুনাফিক
নবীজী (সা:)’র যুগে যারা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করতো তাদের মাঝে মুনাফিকদের সংখ্যা ছিল শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। সেটি অনুমান করা যায় ওহুদের যুদ্ধে যাত্রাকালে ১০০০ জন মুসলিমদের মধ্য থেকে ৩০০ জন বেরিয়ে যাওয়াতে। মুসলিম ইতিহাসে এরাই মুনাফিফ রূপে পরিচিত। নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করা এবং নামায-রোযা পালন সত্ত্বেও এরা চাইতো ইসলামের পরাজয় এবং কাফেরদের বিজয়। নবীজী(সা:)’র প্রতি তাদের সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিলনা, তারা চোইতো তাঁর অপমান। সুরা মুনাফিকুনে মহান আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদের মনের সে চিত্রটি তুলে প্রকাশ করে দিয়েছেন এভাবে: “তারাই হলো সে সব ব্যক্তি যারা বলেছিল, আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে যারা থাকে তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করো না। অথচ আসমান ও জমিনের সকল ভান্ডার হলো আল্লাহর, কিন্তু মুনাফিকগণ সেটি বুঝে না। তারা বলেছিল, সন্মানিতগণ যখন শহরে (মদিনায়) পৌঁছবে তখন দুর্বলদের (নবীজী (সা:) ও তাঁর সঙ্গি মুহাজির সাহাবাদের) সেখান থেকে বের করে দিবে। অথচ সকল ইজ্জত আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের জন্য। কিন্তু মুনাফিকগণ সেটি জানে না।” –(সুরা মুনাফিকুন, আয়াত ৭-৮)। অথচ এই মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই মদিনার মসজিদে নববীতে নবীজী (সা:)’র পিছনে প্রথম সারিতে নিয়মিত নামায পড়তো এবং রমযানের মাসে রোযাও রাখতো। সেটি এ জন্য যে, নামায ও রোযা না রাখলে মদিনার মুসলিমদের মাঝে সে গণ্য হতো কাফের রূপে। মুনাফিকদের কাফের হওয়ার সাধ থাকলেও সাহস থাকে না, তাই তারা মুনাফিক হওয়ার পথটি বেছে নেয়।
প্রশ্ন হলো, নবীজী (সা:)’র আমলেই মুনাফিকদের সংখ্যা যদি শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ হয়, তবে আজকের দুর্বৃত্ত অধিকৃত সমাজে সে সংখ্যাটি যে বিশাল –তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? তাছাড়া তারা যে শুধু সংখ্যাতে বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে তাদের ঔদ্ধত্যও। নবীজী (সা:)’র যুগের মুনাফিকগণ ইসলামের বিরুদ্ধে যা কিছু করতো তা অতি ভয়ে ভয়ে গোপনে করতো। মদিনার রাস্তায় নেমে নবীজী (সা:) বা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তাদের ছিল না। সে সাহস দেখালে মদিনার মুসলিমদের হাতে তাদের নির্মূল হতে হতো। তাই তারা বেছে নেয় প্রতারণার পথ। তাই নিজেদেরকে মুসলিম রূপে জাহির করার জন্য নিয়মিত নামায পড়তো। রোযাও রাখতো। এবং মক্কার কাফের ও মদিনার ইহুদীদের সাথে ষড়যন্ত্রের সময় অতি সতর্কতা অবলম্বন করতো। সে গুলো এতোই গোপনে করতো যে নবীজী (সা:) সেগুলো জানতে পারতেন একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার প্রেরিত ওহী মারফত। সে তুলনায় আজকের মুনাফিকদের সংখ্যা ও শক্তি যেমন বিপুল ভাবে বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের ঔদ্ধত্য। ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রগুলো পেয়েছে ভিন্ন মাত্র। তাই তাদের যা কিছু এজেন্ডা সেগুলো তারা প্রকাশ্যেই দম্ভভরে বলে ও পালন করে। তারা শুধু মুনাফিকই নয়, সে সাথে যোগ হয়েছে কাফের সুলভ যুদ্ধাংদেহী উগ্রতা। তাই এক দিকে তারা যেমন নিজেদের মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়, নামায পড়ে এবং দোয়ার মজলিসে হাজির হয়, তেমনি তাদের রাজনীতিতে থাকে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে আবু জেহেল ও আবু লাহাবের ন্যায় নির্মূলমুখী যুদ্ধ। মুসলিমদের পরিচিত শত্রু ভারতীয় কাফেরদের সাথে ষড়যন্ত্রগুলো তারা গোপনে করার প্রয়োজন বোধ করে না, বরং প্রকাশ্যে তাদের সাথে কোয়ালিশন গড়ে এবং ভারতকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে যুদ্ধও করে। মদিনার মুনাফিকদের ন্যায় এরাও আনন্দ পায় কাফেরদের বিজয়ী হওয়াতে এবং মুসলিমদের ইজ্জতহানীতে।
হালাল বন্ধুত্ব ও হারাম বন্ধুত্ব
মুসলিমদের জন্য শুধু পানাহার হালাল হলে চলে না। হালাল হতে হয় বন্ধু নির্বাচনের বিষয়টিও। মহান আল্লাহতায়ালা হারাম করে দিয়েছেন কাফেরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করাকে। এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশ এসেছে সুরা আল-ইমরানের ২৬ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে: “মু’মিনগণ যেন অন্য মুমিনদের ছেড়ে কাফেরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে; যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তাদের (কাফেরদের) পক্ষ থেকে তোমরা যদি অনিষ্টের আশঙ্কা করো তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে। আল্লাহ তোমাদেরকে সতর্ক করছেন (তোমাদের নিয়ে) তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়ে; এবং তাঁর দিকেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে।” এ প্রসঙ্গে সুরা নিসার ১৪৫ নম্বর আয়াতে তাই বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা মুসলিমদের বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। এমনটি করে কি তোমরা আল্লাহর হাতে নিজেদের বিরুদ্ধে প্রামাণ্য দলীল তুলে দিবে? নিঃসন্দেহে মুনাফিকদের অবস্থান জাহান্নামের সর্বনিন্ম স্তরে। এবং তোমরা তাদের জন্য কখনো কোন সাহায্যকারী পাবে না।”
কাফেরগণও জাহান্নামে যাবে। কিন্তু জাহান্নামে মুনাফিকদের স্থান হবে কাফরেদের চেয়েও নিকৃষ্টতর ও বীভৎসতর স্থানে। উপরুক্ত আয়াতটির মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা সেটিই জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, মুনাফিকগণ কেন মহাজ্ঞানী মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্টতর বিবেচিত হলো? তারা তো মুখে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাসের কথাও বলে? এখানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। মহান আল্লাহতায়ালার উপরুক্ত বয়ানে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট তা হলো, মুনাফিকদের ঈমানের দাবীতে আদৌ কোন সত্যতা নাই। সেরূপ দাবী নিছক নিজেদের পরিচয় লুকানোর জন্য। মহান আল্লাহতায়ালার উপর সামান্যতম ঈমান থাকলে তাঁর দ্বীনের বিজয় আনতে তারা যুদ্ধে নামতো। কিন্তু তাদের আচরণ তো উল্টো। তারা রাজনীতি করে এবং যুদ্ধ করে স্রেফ ইসলামের পরাজয় বাড়াতে। তাদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহতায়ালার ক্রোধের কারণ, একসাথে তারা দুইটি অপরাধ করে। একটি মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের, অপরটি প্রতারণার। বিশ্বজুড়া মুসলিম উম্মাহর আজ যে পরাজয় ও পতিতদশা –সেটি যতটা বিদেশী কাফেরদের কারণে, তার চেয়ে অধিক ঘরের শত্রু মুনাফিকদের কারণে। মুসলিম দেশগুলো খন্ডিত হয়েছে এবং শত্রুর হাতে অধিকৃত হয়েছে তো এসব দেশী শত্রুদের কারণেই। এরাই নিজ ঘরে বিদেশী কাফেরদের ডেকে এনেছে। সেটি বাংলার বুকে যেমন ১৭৫৭ সালে দেখা গেছে, তেমনি দেখা গেছে ১৯৭১ সালেও। আরব বিশ্বে সেটি দেখা গেছে ১৯১৭ সালে। তখন ঘরের শত্রুরা বিদেশী শত্রুদের সাথে একাকার হয়ে গেছে। বিদেশী কাফেরদেরকে তারা অভিভাবক রূপে গণ্য করেছে।
সুরা নিসার ১৩৮ ও ১৩৯ নম্বর আয়াতে মুনাফিকদের ব্যাপারে বর্ণনা এসেছে এভাবে: “(হে নবী) এসব মুনাফিকদের সুসংবাদ জানিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নির্ধারিত আছে কষ্টদায়ক আযাব। (এরাই হলো তারা) যারা মুসলিমদের পরিত্যাগ করে নিজেদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করে কাফেরদের এবং তাদেরই কাছে সন্মান কামনা করে। অথচ যাবতীয় সন্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য। আর (ঈমানদারদের প্রতি) কুর’আনের মাধ্যেম এই হুকুম জারি করে দিয়েছেন যে, যখনই তোমরা আল্লাহর আয়াত সমূহের প্রতি অস্বীকৃতি ও বিদ্রুপাত্মক কথা শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে আর বসবে না, যতক্ষণ না (সে প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করে) তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। তা না করলে তোমরাও তাদের মতো হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক এবং কাফেরদের সবাইকে জাহান্নামে একত্র করবেন।” উপরুক্ত আয়াত দুটিতে মহান আল্লাহতায়ালা যে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন তা হলো, মুসলিমদের শুধু হালাল বন্ধু হলেই চলেনা, অন্যদের সাথে তাদের আলাপ-আলোচনাও হালাল হতে হয়। যেসব আসরে ইসলামের বিধান ও কুর’আনের আয়াতের প্রতি অবজ্ঞা হয় -সেখানে বসে থাকাও হারাম। ইসলামের বিরুদ্ধে কোন রূপ অবজ্ঞা ও অসন্মান সত্যিকার ঈমানদারের কাছে অসহনীয়। সে হারাম আলোচনাকারীদের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে বাঁচার শাস্তি হলো, অংশ নেয়া ব্যক্তিগণ ঈমানদার রূপে দাবী করলেও তারা গণ্য হয় মুনাফিক রূপে এবং মুনাফিকদের সাথেই জাহান্নামে তারা একত্রিত হবে। অথচ ইসলামের পরকালমুখী জীবনদর্শনের প্রতি অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞায় পরিপূর্ণ হলো সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তি। সে রাজনীতিতে চরম অস্বীকৃতি, অবজ্ঞা ও বিদ্রোহ জানানো হয় শরিয়তী আইনের প্রতিও। ফলে সেক্যুলারিস্টদের রাজনৈতিক আসরে ও তাদের রাজনীতিতে অংশ নেয়া হালাল হয় কী করে? কোন ঈমানদার কি তাদের সাথে কোন আসরে একত্রে বসতে পারে? তাদের রাজনীতির কি অংশীদার হতে পারে? যে ব্যক্তি সেটি করবে, সে যে মুনাফিক –সে ঘোষণাটি তো মহান আল্লাহতায়ালার।
মু’মিনের কাছে তো তাই গুরুত্ব পায় -যা গুরুত্ব পায় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। তাঁর পছন্দই মু’মিনের পছন্দ। যেখানেই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম, সেখানেই মু’মিন লাব্বায়েক বলে। “সামে’না ওয়া তা’য়ানা” অর্থ: শুনলাম এবং পালন করলাম -এটিই মু’মিনের চেতনা। যার মনে সামান্য ঈমান আছে -সেকি কখনোই মহান আল্লাহতায়ালার এই কুর’আনী হুকুমের অবাধ্য হয় এবং বেছে নেয় কি কাফেরদেরকে বন্ধু রূপে? অথচ বাংলাদেশে সেরূপ ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে ভারতীয় কাফের শক্তিকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করার মাধ্যমে। বাঙালী সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদীগণ সেদিন দিল্লির শাসক চক্রের কোলে উঠেছে। এ ভারতসেবী বাংলাদেশীদের রাজনীতির মূল চরিত্রটি হলো ভারতের এজেন্ডাপূরণ। ভারত চায় বাঙালী মুসলিমগণ ইসলাম থেকে দূরে সরুক, বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ ক্ষমতায় গিয়ে সে এজেন্ডাই পালন করে। ভারত চায়, ইসলামপন্থীদের নির্মূল। সে কাজেও এরা নেমেছে। ইসলামে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন নামায-রোযার ন্যায় ফরজ। কিন্তু বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে সে ফরজ পালিত হয় না। ফলে ২০ বছর বিদ্যাশিক্ষায় কাটিয়েও মুসলিম ছাত্রছাত্রীগণ পবিত্র কুর’আনের একটি আয়াতও বুঝার সুযোগ পায়না। এভাবেই অসম্ভব করা হচ্ছে মু’মিন রূপে বেড়ে উঠার কাজ।
জনসম্মুখে নিজেদেরকে মুসলিম রূপে দাবী করলেও ইসলামের এ স্বঘোষিত বিপক্ষ শক্তি দেশের আদালতে কখনোই মহান আল্লাহতায়ালার আইন (শরিয়ত) প্রতিষ্ঠার জন্য কোন স্থান ছেড়ে দিতে তারা রাজী নয়। আদালতের অঙ্গণ নির্দিষ্ট রেখেছে ব্রিটিশ কাফেরদের প্রণীত আইন অনুযায়ী বিচার-আচারের জন্য। স্কুল-কলেজে পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্রের অসংখ্য লেখা পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হলেও পড়ানো হয় না মহান আল্লাহতায়ার পবিত্র কুর’আন। স্কুলে ক্লাসের শুরু কুর’আন তেলাওয়াত দিয়ে হয়না, হয় রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গান দিয়ে। পৌত্তলিকতার প্রকাশই আজ বাঙালী মুসলিমের জাতীয় সঙ্গিত। নবীজী (সা:)’র যুগে আবু জেহল ও আবু লাহাব ইসলামের পক্ষের লোকদের লোকালয়ে ইসলামের প্রচার করতে দিত না, একই নীতি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের। এদের পুলিশ ঘরে ঘরে ঢুকে জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করে এবং ইসলামপন্থীদের গ্রেফতার করে। যেন জিহাদ ইসলামের কোন বিষয়ই নয়। অথচ ইসলাম হলো ইসলামের সর্বোচ্চ ইবাদত। বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের ইসলামবিরোধী এমন আচরণকে শুধু মুনাফিকি বললে চরম ভূল হবে। মদিনার মুনাফিকগণ ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ প্রকাশ্য যুদ্ধ বা বিদ্রোহ কখনোই করেনি। পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে কোয়ালিশন গড়ে কখনোই মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামেনি –যেমনটি ১৯৭১’য়ে বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ করেছে। মদিনার মুনাফিকগণ যা কিছু করেছে তা করেছে অতি গোপনে। তাদের মুনাফিকি ছিল জিহাদ থেকে দূরে থাকাতে।
সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম এবং সর্বনিকৃষ্ট ব্যর্থতা
যে কোন ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্পূর্ণ বিষয় হলো, ঈমানদার, কাফের ও মুনাফিক –এ তিন শ্রেণীর মানুষের মাঝে কাদের সাথে সে দন্ডায়মান সে বিষয়টি সঠিক ভাবে জেনে নেয়া। নিজের অবস্থানটি কাফের বা মুনাফিকের দলে হলে দুনিয়ার বাঁচাটি যেমন সুখের হয় না, তেমনি পরকালে জুটে জাহান্নামের আগুন। তখন জীবনের অন্য সব পাঠ যতই ভাল হোক এবং পেশাদারী বা আর্থিক সাফল্য যতই অর্জিত হোক –তাতে কল্যাণ জুটে না্। মুমিনের ভাবনা তাই শুধু কাফের হওয়া থেকে বাঁচা নিয়ে নয়, বরং মুনাফিকি থেকে বাঁচা নিয়েও। কাফের হওয়া থেকে বাঁচাটি যতটা সহজ, মুনাফিক হও্য়া থেকে বাঁচাটি ততো সহজ নয়। প্রকাশ্যে পবিত্র কালেমাগুলি পাঠ করলেই কাফের হওয়া থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু মুনাফিকি থেকে বাঁচতে হলে আরো বহুদূর এগুতে হয়। পরিশুদ্ধি আনতে হয় চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের জগতে। সে সাথে আল্লাহর এজেন্ডা পূরণে জান, মাল, মেধা ও শ্রমের বিনিয়োগে সর্বদা সচেষ্ট ও আন্তরিক হতে হয়। মানব জীবনে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম।
মু’মিনের জীবনে মুনাফিকি থেকে বাঁচার এ ভাবনা এতোই গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ যে হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা:)’র মত মহান সাহাবীকেও তা ভাবিয়ে তুলতো। অথচ তাঁর সম্বন্ধে নবীজী (সা:)’র হাদীস: “আমার পর কেউ নবী হলে হযরত উমর (রা:) হতো সেই নবী।” সেসময় হযরত হুজায়ফিয়া (রা:) নামক প্রখ্যাত সাহাবীর কাছে নবীজী (সা:)’র পক্ষ থেকে দেয়া আমানত স্বরূপ মদিনার মুনাফিকদের একটি তালিকা ছিল। হযরত উমর (রা:) হযরত হুজায়ফা (রা:)’র কাছে গিয়ে জানতে চাইতেন, ঐ তালিকাতে তাঁর নাম আছে কিনা। অথচ সে গুরুতর বিষয়টি নিয়ে ভাবনা আজ ক’জনের মুসলিমের? ক’জনের তাড়না মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচায়? এমন কি শিশুরাও গরু-ছাগল ও বাঘ-ভালুকের মাঝে পার্থক্য করতে জানে। কিন্তু ক’জন ডিগ্রিধারী ব্যক্তি মুমিন, মুনাফিক ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য বুঝে? ক’জন ছাত্র বা ছাত্রী অর্জন করে মু’মিন হওয়ার সামর্থ্য? সে জন্য তো পূর্ণ ঈমানদার হতে হয়। ক’জন অর্জন করে মুনাফিকি থেকে বাঁচার সামর্থ্য? পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে মুনাফিক থেকে বাঁচার পাঠটিই পাঠ্য বইগুলোতে উপেক্ষিত। ফলে শিক্ষালাভের নামে বড় বড় ডিগ্রি জুটলেও বিপুল হারে তারা কর্ম জীবনে শামিল হচ্ছে মুনাফিকের দলে। এদের কারণে দেশে পরাজয় বাড়ছে ইসলামের এবং লাগাতর বিজয় পাচ্ছে ইসলামের বিপক্ষ শক্তি। এরাই শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির নামে অধিকাংশ নর-নারীকে গড়ে তুলছে জাহান্নামের জ্বালানী রূপে। এবং আযাব ডেকে আনছে এ পৃথিবী পৃষ্ঠেও।
শিক্ষার মূল কাজটি হলো, সঠিক ধর্ম ও জীবনদর্শন নির্বাচনে ছাত্রদের সাহায্য করা। ওহীর জ্ঞানে মনকে আলোকিত করা এবং জান্নাতের কুর’আনী রোড়ম্যাপটি দেখিয়ে দেয়া। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানব সমাজে দ্বিতীয়টি নাই। একাজই বস্তুত নবী-রাসূলদের কাজ। জনগণের চেতনা, চরিত্র ও কর্মের গুণাগুণ কখনোই পানাহারে নির্ধারিত হয়না, হয় শিক্ষাঙ্গণ থেকে। ছাত্রগণ মুমিন হবে না মুনাফিক বা কাফের হবে -সেটি নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে। রাশিয়া ও চীনে গণহারে নাস্তিক উৎপাদিত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা নাস্তিক কম্যুনিস্টদের হাতে অধিকৃত হওয়ায়। একই ভাবে দুর্যোগ নেমে এসেছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। কারণ শিক্ষাদানের কাজটি হাইজ্যাক হয়ে গেছে তাদের হাতে যাদের নিজেদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও পথভ্রষ্টাটি প্রকট। তারা নিজেরাই পায়নি সঠিক ধর্মজ্ঞান ও জীবনদর্শন। এদের কেউবা নাস্তিক, কেউবা জাতীয়তাবাদী, কেউবা সেক্যুলারিস্ট এবং কেউবা ধর্মীয় জ্ঞানশূণ্য ফাঁকিবাজ দুর্বৃত্ত। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষায় নকলও তাদের কাছে কোন অপরাধ নয়। শিক্ষাকেন্দ্রগুলো পরিণত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, সেক্যুলারিজম, ফ্যাসিজম এবং নানারূপ শয়তানী মতবাদের সরকারী কোচিং সেন্টারে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণেই বাংলাদেশে যারা গুম-খুন-ধর্ষণ, চুরিডাকাতি-ভোটডাকাতি এবং দুর্বৃত্তির জোয়ার আনলো, তাদের বেড়ে উঠার জন্য তাই বন-জঙ্গল বা ডাকাত পাড়ায় বসবাসের প্রয়োজন পড়েনি। দুর্বৃত্ত রূপে বেড়ে উঠার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে দেশবাসীর রাজস্বে প্রতিপালিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। বস্তুত দেশ ধ্বংসের সবচেয়ে ভয়ংকর কাজগুলো হচ্ছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। “ইকরা” তথা “পড়” অর্থাৎ ওহীর জ্ঞানে জ্ঞানবান হও –এটিই বান্দার উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম নির্দেশ। অথচ সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা হচ্ছে সে নির্দেশ পালনে। শিক্ষার যে জায়গা থেকে সভ্যতর ও ঈমান-নির্ভর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি নবীজী (সা:) শুরু করেছিলেন, সে জায়গা দখলে নিয়েছে শয়তান ও তার পক্ষের শক্তি। ছাত্রদের ইসলামের মূল পাঠটি দেয়ার স্থানটি ঈমানদারদের দখলে নাই। ফলে দারুন ভাবে ব্যহত হচ্ছে মু’মিন গড়ার কাজ। মু’মিন গড়ার কাজটি না হলে অনিবার্য কারণে যেটি হয় সেটি তো মুনাফিক ও কাফের গড়ার কাজ। কাফিরের কাজ কি শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলকে অবিশ্বাস করা? প্রশ্ন হলো, যারা ইসলামী রাষ্ট্র, আদালতে শরিয়ত এবং শিক্ষালয়ে কুর’আন শিক্ষার বিরোধী -তাদের কি মু’মিন বলা যায়? তাদের মু’মিন বললে, কাফের ও মুনাফিক কারা? এসব নিয়ে ভাবনাই বা ক’জনের? মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার কারণ এই শিক্ষা খাতের ব্যর্থতা। এটিই সর্বনিকৃষ্ট ব্যর্থতা। মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের পরাজয় এবং মুনাফিক ও কাফিরদের বিজয়ের মূল কারণ এই ব্যর্থতা। তবে এ ব্যর্থতা ও বিপর্যয় এ পার্থিব জীবনে শেষ হবার নয়, এর চেয়েও ভয়ানক ব্যর্থতা ও বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আখেরাতে। পবিত্র কুর’আনে সে হুশিয়ারীই তো বার বার শোনানো হয়েছে। ১০/১০/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018