মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি প্রসঙ্গে
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 26, 2020
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
কিসে শ্রেষ্ঠত্ব?
অন্যান্য ধর্ম ও মতের অনুসারিদের থেকে মুসলিমগণ যে কারণে বিশিষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ -সেটি তাদের দেহের গঠন, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভাষা, ভূগোল বা অন্য কারণে নয়। সেটি হলো আল-কোরআন। একমাত্র তাদের কাছেই রয়েছে বান্দাহর উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত সর্বশেষ এ ভাষণটি। মহান আল্লাহতায়ালার নিজের বর্ণনায় এটি হলো “হুদালিন্নাস” অর্থাৎ “মানব জাতির জন্য প্রদর্শিত পথ”, এবং “মাওয়েজাতুন হাসানাহ” অর্থাৎ “উত্তম ওয়াজ”। হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে যখন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানো হলো তখন তাঁদের নিজেদের এবং তাঁদের বংশধরদের জান্নাতের সুসংবাদও জানানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, জান্নাতের পথ দেখাতে বহু নবী ও রাসূল আসবেন। নবীদের কাছে ওহী নিয়ে ফেরেশতাগণও আসবেন। লক্ষাধিক নবী-রাসূল বস্তুতঃ পথ দেখানোর সে কাজটিই করেছেন। মানবের দায়িত্ব হলো তাদের অনুসরণ করা। মুসলিমগণ এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অধিক ভাগ্যবান। একমাত্র তাদের কাছেই রয়েছে পবিত্র কোরআন –যা জান্নাতের পথে চলার সর্বশেষ রোডম্যাপ। এটিই হলো সেই “সিরাতুল মোস্তাকিম”। মানব জাতির কল্যাণে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া এটিই হলো সবচেয়ে বড় নিয়ামত। সুস্বাস্থ্য, সুখাদ্য ও ধনসম্পদে দুনিয়ার বুকে বাঁচাটি আনন্দময় হয়। কিন্তু পরকালে আনন্দময় স্থানে পৌঁছতে চাই সিরাতুল মুস্তাকীম। এবং সে পথের সন্ধান দিয়েছেন হযরত মহম্মদ (সাঃ)। সে জন্যই তিনি রাহমাতুল্লিল আ’লামীন অর্থাৎ সর্বসৃষ্টির জন্য রাহমাত।
বহু বিস্ময়কর আবিস্কারের জনক হলো মানব। কিন্তু জান্নাতে পৌঁছার রোডম্যাপ আবিস্কারের সামর্থ্য তাদের নাই। অথচ শুধু জান্নাতে পৌঁছার জন্যই নয়, উন্নত মানব ও মানবিক সভ্যতার নির্মাণের জন্যও অতি অপরিহার্য হলো এই রোডম্যাপ। এখান থেকেই মানুষ য় সঠিক নীতিবোধ, মূল্যবোধ ও জীবনবোধ। পায় ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুষ্ঠ বিচাপারবোধ। পানাহার ছাড়া যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি এ নীতিবোধ, মূল্যবোধ, বিচারবোধ ছাড়া মানবতাও বাঁচে না। তখন মানুষ বর্বর পশুতে পরিণত হয়। বাঘের ধারালো নখর যেমন হিংস্রতা বাড়ায়, তেমনি বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষকে পশুর চেয়েও হিংস্রতর করে। বিগত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মৃত্যু, বহু কোটি মানুষের পঙ্গুত্ব, হাজার হাজার নগর-বন্দরের বিনাশের ন্যায় বর্বরতা কি আদিম যুগে কোন অসভ্য জাতির দ্বারা সাধিত হয়েছিল? হালাকু-চেঙ্গিজের অপরাধ এ তুলনায় তো নস্যিতূল্য। অথচ সর্বকালের সবচেয় জঘন্য এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তাদের দ্বারা যারা জ্ঞানবিজ্ঞান, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রচন্ড অহংকারী। আজও সে বর্বরতায় তারা ইতিহাস গড়ছে ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও কাশ্মিরে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ধ্বংস করা হচ্ছে অসংখ্য ঘরবাড়ী ও ঘরবাড়ি; এবং ধর্ষিতা হচ্ছে নারী। এরূপ নৃশংস বর্বরতা কি সমুদয় পশকুলও কোন কালে করতে পেরেছে? অথচ সেটি হচ্ছে বিশ্বের অত্যাধুনিক রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা। পারমানবিক বোমা আবিস্কার করলেও নিজেদের মাঝে উন্নত নীতিবোধ ও মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বিস্ময়কর যান্ত্রিক অগ্রগতি হলেও মানবতা এগোয়নি। পিরামিড নির্মাণে পাথর চাপায় প্রাণ হারিয়েছিল বহুসহস্র মানুষ; অত্যাচারিত হয়েছিল মিসরের সাধারণ প্রজা। তেমনি সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের জৌলুস বাড়াতে প্রাণ হারাচ্ছে দরিদ্র বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। পিরামিড যেমন নির্যাতনের প্রতীক, পাশ্চাত্য সভ্যতা তেমনি প্রতীক হলো দুর্বল জাতি সমূহের উপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, শাসন ও বর্বরতার। অথচ আজ থেকে ১৪শত বছর আগে মানবতা তার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। তখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আইনের শাসন, সার্বজনীন জ্ঞানচর্চা, ধনিদরিদ্রের সম-অধিকার, নারী স্বাধীনতা ও সম্পদে নারীর অংশীদারিত্ব। বিলুপ্ত হয়েছিল বর্ণবাদ, রাজতন্ত্র, সামন্তবাদ ও দাসপ্রথা। বিশাল রাষ্ট্রের খলিফা হয়ে আটার বস্তা পিঠে নিয়ে গরীবে ঘরে পৌঁছে দেযা ও চাকরকে উটে চড়িয়ে নিজে রশি টানার মত বিস্ময়কর ঘটনাও সেদিন সম্ভব হয়েছিল। মানুষের মহাশূণ্যে ভ্রমনের চেয়েও মুসলিমদের সে অর্জনটি ছিল বেশী বিস্ময়কর। আরবের দরিদ্র জনগণ সেদিন জন্ম দিয়েছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মানবিক সভ্যতাটির।
দৈহিক ভাবে মানুষ তো সে ভাবেই বেড়ে উঠে -যা সে খায় বা পান করে। তাই সুখাদ্য না খেলে বা বিষ পানে মৃত্যু ঘটে। তেমনি নৈতীক ভাবে মানুষ সে ভাবেই বেড়ে উঠে -যা সে পাঠ করে বা যা থেকে সে শিক্ষালাভ করে। বিবেকের মৃত্যু এ জন্যই অনিবার্য হয় অশিক্ষা ও কুশিক্ষায়। ফলে মানুষ যা কিছু খায় –সেটি যেমন অতি গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো সে কি পাঠ করে সেগুলিও। তাই মহান আল্লাহতায়ালা যেমন পানাহারের বিধান দিয়েছেন, তেমনি পাঠের জন্য দিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব। এবং এর সুফল দেখা গেছে প্রাথমিক যুগের মুসলিম জীবনে। তারা সেদিন নৈতিকতায় শীর্ষস্থানে পৌঁছতে পেরেছিলেন এ কারণে যে, তারা জ্ঞানার্জন করতেন পবিত্র কোর’আন থেকে। তারা সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণে সফল হয়েছিলেন এ কারণে যে, তাঁরা অনুসরণ করেছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার প্রদর্শিত কোর’আনী রোডম্যাপ। ভ্রান্ত পথে আজীবন ঘুরলেও গন্তব্যে পৌঁছা না। অথচ সঠিক পথে দ্রুত পৌঁছা যায় –প্রথম যুগের মুসলিমগণ সেটিই প্রমাণ করেছেন। মাত্র কয়েক দশকে একটি পশ্চাদপদ জনপদের জনগণ বিশ্বশক্তি ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিয়েছেন। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে সৃষ্টি করে ফেরেশতাদের মহফিলে যে গর্ব প্রকাশ করেছিলেন বস্তুতঃ সেটিই সেদিন সার্থকতা পেয়েছিল। বান্দা তখন তার মহান মা’বুদের লক্ষ্য পূরণে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। বান্দার সে আচরণে তিনি এতোই খুশী হয়েছিলেন যে সে সন্তুষ্টির কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন এভাবে: “রাদীআল্লাহু আনহু ওয়া রাদূউ আনহু।” অর্থঃ আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও সন্তুষ্ট আল্লাহর উপর।”
কেন এ ব্যর্থতা?
তবে মুসলিমগণ আজ ব্যর্থতায় ইতিহাস করেছে। প্রশ্ন হলো, কেন এতো ব্যর্থতা? পবিত্র কোর’আন তো আজও অবিকৃত। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের যে গুরুতর ব্যধিগুলো ১৪ শত বছর পূর্বে আরোগ্য পেল সেটি কেন আজ মুসলিম বিশ্বে জেঁকে বসে আছে? পথ সঠিক হলে গাধার পিঠে বা পায়ে হেঁটেও গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যায়। কিন্তু ভ্রান্ত পথে উন্নত যানেও সেটি অসম্ভব। মহান আল্লাহতায়ালার প্রদর্শিত রোডম্যাপের গুরুত্ব এখানেই। মুসলিমদের বর্তমান ব্যর্থতাই বলে দেয়, সঠিক পথে তারা চলছে না। সন্ত্রাস, গুম-খুন, দুর্নীতি, অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের যে স্থানে তারা পৌঁছেছে, সিরাতুল মুস্তাকীম সেখানে কখনোই নেয় না। ইসলাম যে সর্বক্ষেত্রে সফলতার সঠিক পথ সেটি ১৪ বছর পূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে। এ পথের গুণেই মুসলমানগণ ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সফলতার উচ্চমার্গে পৌঁছেছিল। তখন বিশ্বের অন্যান্য জাতিরা নিমজ্জিত ছিল অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অপসংস্কৃতির গভীর অন্ধকারে। বিশ্বজুড়ে ছিল বর্বরতম স্বৈরাচার। ছিল রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ। ধর্মের নামে মানুষ তখনও মূর্তি, অগ্নি, পাহাড়-পর্ব্বত, নদ-নদী এমনকি সাপ-শকুনকেও দেবতা বলে পূজা করতো। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ছিল উলঙ্গতা। নারী ছিল অধিকার-বঞ্চিত ভোগ্যসামগ্রী। বিশ্বজুড়ে ছিল বর্ণবাদ, ছিল দাসপ্রথা। কিন্তু সে অন্ধকারের যুগে দ্রুত উন্নতির রেকর্ড গড়েছিল মুসলিমগণ। কিন্তু আজ কেন এ দুর্গতি?
রোডম্যাপ কাউকে গন্তব্যস্থলে টানে না। এটি পথ দেখায় মাত্র। পথটি জেনে নিতে হয় এবং সেটির অনুসরণ করতে হয় ব্যক্তিকেই। এজন্য যেটি অপরিহার্য সেটি হলো রোডম্যাপ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ ও সামর্থ্য। সে সামর্থ্য বাড়াতেই ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরয। কারণ, জ্ঞান ছাড়া মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপ থেকে পাঠোদ্ধার অসম্ভব? সম্ভব নয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা লাভ। জ্ঞানের অভাবে হালাল-হারাম ও ন্যায়-অন্যায়ের পাঠটি অজানা থেকে যায়। ইসলামে জ্ঞানার্জন তাই নেশা, পেশা, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা কারিগরি বিষয় নয়, এটি উচ্চমার্গীয় ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। তাই না বুঝে কোর’আন তেলাওয়াতে বা সেটি জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়াতে দায়িত্ব পালন হয় না। জ্ঞানার্জনের ফরযও আদায় হয় না। আদায় হয় না বলেই না বুঝে কোর’আন তেলাওয়াত ফরয করা হয়নি, বরং ফরয করা হয়েছে বুঝে সুজে কোর’আন থেকে শিক্ষালাভকে। তথা জ্ঞান-লাভকে। অথচ বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে গুরুত্ব পেয়েছে নিছক তেলাওয়াত, কোর’আন থেকে জ্ঞান লাভ নয়। তেলাওয়াতে কি হেদায়ত মেলে? অথচ হেদায়াত না পেলে মুসলিম থাকাই তো অসম্ভব। আর হেদায়াত যে মেলেনি -সে প্রমাণ কি কম? হেদায়েত না পাওয়ার কারণেই কোর’আন তেলাওয়াতকারি সূদ খায়, ঘুষ খায় এবং নানাবিধ দূর্নীতিতে লিপ্ত হয়। কোর’আন তেলওয়াত হচ্ছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। যে অফিসে ঘুষ ও দূর্নীতির সয়লাব, সেখানেও প্রচুর নামাযী। কোর’আন তেলওয়াতকারীর সংখ্যাও অফিসগুলিতে অনেক। অথচ দেশে দূর্নীতির প্লাবন। সয়লাব চলছে বেপর্দা, অশ্লিলতা, ধর্ষণ ও ব্যভিচারের। নগর-বন্দরে বিশাল বিশাল বাজার বসেছে পতিতাবৃত্তির।
কোর’আন থেকে শিক্ষাগ্রহণ ও সেগুলির পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে করূণাময় মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “কিতাবুন আনযালনাহু ইলাইকা মুবারাকুল্ লি’ইয়াদ্দাবারু আয়াতিহি ওয়া লি’ইয়াতাযাক্কারা উলুল আলবাব।” (সুরা সোয়াদ, আয়াত ২৯) অর্থঃ “রহমতপূর্ণ এ কিতাব আপনার উপর এজন্য নাযিল করেছি যে, যেন এর আয়াতগুলো নিয়ে তারা (ঈমানদারেরা) ভাবতে পারে এবং যারা সমঝদার ব্যক্তি তারা যেন হুশিয়ার হয়ে যায়।” এ আয়াতে কোর’আন নাযিলের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে। কোর’আন এ জন্য নাযিল হয়নি যে, ঈমানদারগণ এ পবিত্র কিতাব শুধু তেলাওয়াত করবে। বরং এ জন্য যে, আয়াতগুলো নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করবে। এবং যে নির্দেশাবলী দেয়া হয়েছে তা থেকে শিক্ষা নিবে। এভাবে নিজেদের ইহকাল ও আখেরাত বাঁচাতে হুশিয়ার হবে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এ হুশিয়ারির পরও কি কোন মুসলিম নিছক কোর’আন তেলাওয়াত নিয়ে খুশি থাকতে পারে? তাছাড়া প্রশ্ন হলো, কোন কিছু না বুঝে কি তা নিয়ে ভাবা যায়? সম্ভব হয় কি তা থেকে শিক্ষা লাভ?
কোন বিষয়ে ভাবতে হলে সেটি প্রথমে বুঝতে হয়। চিন্তা-ভাবনা জ্ঞানশূণ্যতায় হয় না। ভূতের গল্প শুনে শিশুও জানতে চায় ভূতের হতা-পা-মাথা কেমন, দেখতে কেমন ইত্যাদি। কারণ ভূতকে নিয়ে শিশুও ভাবতে চায়। কিছু বুঝতেও চায়। এটিই স্বাভাবিক। এটিই মানুষের ফিতরাত। কিন্তু মুসলিমগণ সে ফিতরাত-সুলভ স্বাভাবিক আচরণ করেনি পবিত্র কোর’আনের সাথে। বাংলাদেশের মানুষ দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়েই শুধু বিশ্বকে অবাক করেনি, বরং তার চেয়ে বেশী অবাক করেছে কোর’আন শিক্ষার নামে অর্থ না বুঝে স্রেফ তেলাওয়াত শিখিয়ে। বাংলাদেশের আলেমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং সে সাথে বুদ্ধিহীনতা হলো এটি। তারা জ্ঞানার্জনের ফরয কাজটির গুরুত্ব সেরেছে তেলাওয়াত শিখিয়ে। তেলাওয়াতে যে জ্ঞানার্জনের ফরয আদায় হয় না -সে সত্যটি তারা নিজে যেমন বুঝেনি তেমনি ছাত্রদেরও বুঝতে দেয়নি। কোন রাজা কি শুধু এটুকুতে খুশি থাকে, প্রজারা তার হুকুমগুলি শুধু পড়বে ও সেগুলিতে চুমু খাবে? এবং সেগুলি তারা বুঝবে না এবং পালনও করবে না? প্রজাদের এমন আচরণে কি রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। বাড়ে কি সামাজিক শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি?
ভাবনাশূণ্যতা ও জ্ঞানশূণ্যতার বিপদ
মুসলিম মাত্রই তো মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক। সৈনিক বলতে বুঝায় কিছু দায়িত্ব নিয়ে বাঁচা ও তা নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। ঈমানদারের সে দায়ভারটি কোন ব্যক্তি, দল বা মতবাদকে বিজয়ী করা নয়, বরং ইসলাম ও তার শরিয়তি বিধানকে বিজয়ী করা। নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ তো সেটিই করেছেন। এবং সেটিই তো সর্বকালে ও সর্বদেশে মুসলিম জীবনের মিশন ও নবীজী (সাঃ)’র মহান সুন্নত। কিন্ত সে মিশন পালনে সফল হতে হলে সৈনিকদের তো সে মিশন বুঝতে হয়। সে জন্য জরুরী তো মহান রাব্বুল-আলামীনের হুকুমগুলি পবিত্র কোর’আন থেকে সরাসরি বুঝা ও মান্য করা। কিন্তু সেটি না করে শুধু তেলাওয়াতে ব্যস্ত হলে কীরূপে বিজয়ী হবে তাঁর দ্বীন? কীরূপে প্রতিষ্ঠা পাবে তাঁর শরিয়ত? বান্দার এমন আচরনে কি আল্লাহতায়ালা খুশী হন? এরূপ অপরাধে ভয়ানক আযাব এসেছিল বনী ইসরাইলের উপর। তাদের প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার হুশিয়ারি এসেছিল এভাবেঃ “ওয়া আনতুম তাতলু’ঊনাল কিতাবা আফালা তা’ক্বীলুন” (সুরা বাকারা, আয়াত ৪৪) অর্থ: “এবং তোমরা এ কিতাবকে তেলাওয়াত করো অথচ সেগুলো নিয়ে কি চিন্তাভাবনা করোনা।” আল্লাহপাক তাঁর কিতাবের সাথে বনী ইসরাঈলীদের আচরণে কতটা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন –এ আয়া
তে তো সেটিই প্রকাশ পেয়েছে। কথা হলো, পবিত্র কোর’আনের সাথে বাংলাদেশী মুসলিমদের আচরণ কি তা থেকে ভিন্নতর? না বুঝে তেলাওয়াতে কোর’আনের প্রতি যে অসম্মান হয় এবং তাতে যে আল্লাহতায়ালা অসন্তুষ্ট হন –সে বিষয়টি বুঝা কি এতোই কঠিন?
অথচ কোর’আন শিক্ষার নামে বাংলাদেশে যত দ্বীনি মাদ্রাসা আছে দুনিয়ার আর কোন দেশে তা নেই। বাংলাদেশের একটি জেলাতে যত মাদ্রাসা তা খোলাফায়ে রাশেদার সময় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মাঝে ছিল না। দ্বীন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এসব মাদ্রাসা থেকে তৈরী হয়েছিল বহু মোফাচ্ছের কোর’আন, হাজার হাজার মোজাহিদ, শহীদ ও ধর্ম-প্রচারক। দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে তাঁরা নদ-নদী, মরুভূমি ও পাহাড়-পর্ব্বত অতিক্রম করেছেন। অসংখ্য জিহাদ লড়েছেন। অথচ বাংলাদেশের মাদ্রাসা থেকে যারা তৈরী হচ্ছেন তাদের সামর্থ্য মিলাদ, মুর্দাদাফন, বিবাহ পড়ানো ও ইমামতির বাইরে সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন, যুদ্ধবিগ্রহ, দর্শন, অর্থনীতি, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে নজরে পড়ার মত নয়। বাজারে নাই তাদের লেখা কোন তাফসির গ্রন্থ্য। বাংলাদেশে প্রকাশিত বইয়ের ৫% ভাগের লেখকও তাঁরা নন। অথচ সমাজে তারাই আলেম বা জ্ঞানীর টাইটেল ধারি। ইসলামের গৌরব কালে চিত্রটি ভিন্ন ছিল; প্রায় শতভাগ বইয়ের লেখক ছিলেন আলেমগণ।
নিষিদ্ধ জিহাদ এবং শত্রুর অধিকৃতি
আরো বিস্ময়ের বিষয়, বহু আলেম এবং মসজিদের বহু ইমাম রাজনীতিকে দুনিয়াদারি বলে তা থেকে দূরে থাকেন। অথচ রাজনীতি তো তাই যা নির্ধারণ করে দেশ কোন দিকে পরিচালিত হবে, কি ভাবে পরিচালিত হবে এবং কোন বিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি। রাজনীতির গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। কারণ, ইসলামের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। আছে শরিয়তি বিধান। রাজনীতিতে অংশ না নিয়ে সে এজেন্ডা ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা কীরূপে সম্ভব? সেটি কি সম্ভব ইসলামের শত্রুপক্ষকে ক্ষমতায় বসিয়ে? সম্ভব কি ইসলামের এজেন্ডা ধর্ম-কর্ম ও নামায-রোযায় সীমিত করে? নবীজী (সাঃ)’র আদর্শ তো এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। ইসলামের এজেন্ডা পূরণে স্বয়ং নবীজী (সাঃ)কে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসতে হয়েছে। এবং তাঁর ইন্তেকালের পর সে আসনে তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ বসেছেন।
মুসলিম জীবনে রাজনীতি তাই কোন পেশা নয়; নেশাও নয়। এটি ইসলামকে বিজয়ী করার শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এটি নবীজী (সাঃ)’র শ্রেষ্ঠ সূন্নত। যেখানে সে সূন্নতের পালন নাই, সেখানে ইসলামের বিজয় নাই। মুসলিমদের ইজ্জতও নাই। রাজনীতির এ ইবাদতে বিনিয়োগ হয় ঈমানদারের অর্থ, সময়, শ্রম ও রক্ত। এবং একমাত্র এ ইবাদতের মাধ্যমেই অর্জিত হয় আল্লাহর দ্বীনের বিজয়। এবং প্রতিষ্ঠা পায় শরিয়ত। এটিই ইসলামের পবিত্র জিহাদ। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবাদের যুগে এ জিহাদ সংগঠিত হয়েছে মসজিদে নববীর মেঝে থেকে। অথচ সে জিহাদকে দেশের বহু আলেম শুধু নিজ জীবনেই নিষিদ্ধ করেননি, নিষিদ্ধ করে রেখেছেন মসজিদ-মাদ্রাসার অঙ্গণেও। রাজনীতিকে তারা অপবিত্র বলেন। এবং তা থেকে নিজেদের দূরে রাখাকে সওয়াবের কাজ মনে করেন। অথচ তারা বুঝতে চান না, ইসলামে শত্রুদের সাথে লড়াইটি মসজিদের মেঝেতে হয় না। সেটি হয় রাজনীতির অঙ্গণে। সেখানেই নির্ধারিত হয় জয়পরাজয়। সিদ্ধান্ত হয়, রাষ্ট্র আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে হবে না শয়তানের পথে চলবে। সে লড়াইয়ে ইসলামের পক্ষে যারা প্রাণ দেয় তাদেরকে শহিদ বলা হয়। তাদের মর্যাদা এতই অনন্য যে মৃত্যুর পরও মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে পানাহার দিয়ে থাকেন। জীবনের প্রতিটি রাতের সবটুকু সময় ইবাদতে কাটালেও কি এ সম্মান জুটে?
মহান রাসূলে পাক (সাঃ) শরিয়ত প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে মসজিদের জায়নামায থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে নিয়ে গেছেন। অসুস্থ্য ব্যক্তিকে বাঁচানো বা অজ্ঞ ব্যাক্তিকে জ্ঞানদান ইসলামে অতি উত্তম ইবাদত। কারণ প্রথমটি মানুষের দেহ বাঁচে। এবং দ্বিতীয়টিতে বাঁচে বিবেক। তাই অতীতে ঈমানদারগণ চিকিৎসক, শিক্ষক বা মসজিদের খতিব হওয়াকে পচ্ছন্দ করতেন। কিন্তু পুরা একটি জাতিকে বাঁচানোর কাজ তো সেগুলির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। জাতি বাঁচলেই তো সভ্যতা গড়ে উঠে। তখন ইসলামও বিজয়ী হয়। এবং জাতি বাঁচানো এবং সে সাথে ইসলাম বাঁচানোর কাজটি হয় রাজনীতির অঙ্গণে। তাই রাজনীতির সমকক্ষ একমাত্র রাজনীতিই। মুসলিমদের রাজনীতিতে তাই নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং নবীজী (সাঃ)। রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসেই তিনি পরাজিত করেছেন আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের নেতৃত্বকে। মসজিদের জায়নামাজে সীমিত থেকে কি সেটি সম্ভব হতো? রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটের ন্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে কি তাই ইসলামের শত্রুকে বসানো যায়? তাতে তো বিজয় শত্রুর হাতে তুলে দেয়া হয়। অথচ অধিকাংশ মুসলিম দেশের মুসলিমগণ নিজেদের ভোট, অর্থ, শ্রম ও রক্তের খরচে ইসলামবিরোধী অপশক্তিকেই ক্ষমতায় বসিয়েছে। এতে কি মুসলিম স্বার্থের সুরক্ষা হয়? আসে কি ইসলামের বিজয়? দেশে দেশে শরিয়তের যেরূপ বিলুপ্তি, মুসলিমদের যেরূপ বিপন্নদশা -তার মূল কারণ তো শত্রুশক্তির অধিকৃতি। এবং এ অধিকৃতির কারণ, মুসলিমগণ রাজনীতিকে জিহাদ রূপে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং দ্বীনদারি রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে রাজনীতি থেকে দূরে থাকাটি। শূণ্যস্থান কখনোই শূণ্য থাকে না। ফলে বিনা যুদ্ধেই রাষ্ট্র দখলে নিয়েছে ইসলামে অঙ্গিকারহীন সেক্যুলারিস্টগণ।
অঙ্গিকারহীনতাই ঈমানহীনতা
কথা হলো, ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকারহীন হলে কেউ কি মুসলিম থাকে? মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান ও ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকার –এক সাথে চলে। ইসলামে অঙ্গিকারহীনতার অর্থই তো ঈমানহীনতা। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকারবদ্ধতা। সেটি যেমন ব্যক্তি জীবনে, তেমনি রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে। সে জন্য সে যেমন অর্থ, শ্রম ও মেধা দেয়, তেমনি রক্তও দেয়। ঈমান আনার পর মুসলিমদের ইবাদত তাই শুধু নামায-রোযা পালনে থেমে যায়নি, ইসলামের বিজয় আনতে তারা যেমন অকাতরে অর্থ ও শ্রম দিয়েছেন, তেমনি প্রাণও দিয়েছেন। ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকার নিয়ে যেমন রাজনীতিতে নামে, তেমনি শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও নামে। প্রতিটি মুসলিম দেশে যাদের রাজনীতি বহু পূর্বেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত ছিল, তা হলো সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি। কারণ, এরাই হলো শয়তানের পক্ষ। শয়তানের পক্ষকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় হওয়ার অনুমতি দিলে গাদ্দারি হয় ইসলামে সাথে। এদের রাজনীতি বস্তুত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে পরাজিত করার রাজনীতি। তাতে বিজয়ী হয় চরিত্রবিনাশী অসভ্যতা। এমন রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশে প্লাবন এসেছে গুম, খুন, ফাঁসি, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতিসহ নানারূপ দুর্বৃত্তির। ফলে এ পৃথিবী পৃষ্টে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হলো শয়তানী পক্ষের এ রাজনীতি। কিছু লোকের খুনখারাবী, মদ্যপাণ, পতিতাবৃত্তি বা চুরি-ডাকাতিতে সমগ্র জাতি পরাজিত হয় না। দেশও ধ্বংস হয় না। আদালত থেকে শরিয়তও বিলুপ্ত হয় না। তাদের কারণে দেশে খুন, গুম, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতির জোয়ার আসে না। এমন পাপীগণ নবীজীর (সাঃ) আমলেও ছিল। কিন্তু সেক্যুলার রাজনীতি বিজয়ী হলে তাতে বিপন্ন হয় ইসলাম, বিলুপ্ত হয় শরিয়ত এবং প্রতিষ্ঠা পায় শয়তানী অসভ্যতা। তখন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতিতে অংশ নেয়াটি গণ্য হয় ফৌজদারি অপরাধ রূপে। এ অপরাধে বহু মুসলিম দেশে মুসলিম নির্যাতন রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের পক্ষ নেয়ায় অনেককে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে। ইসলামের তাবত শত্রুপক্ষ সেটিকে সমর্থণও দিচ্ছে।
লক্ষণীয় হলো, ইসলামের শত্রুপক্ষের কাছে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার যে কোন প্রচেষ্টাই গণ্য হয় প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রূপে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সে বয়ানটি অতি প্রবল। এর কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারাই বিজয়ী পক্ষ। অথচ তারাও নিজেদেরকে মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়। তাদের অনেকে নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতও আদায় করে! প্রশ্ন হলো, ইসলামের প্রতিষ্ঠার যারা বিরোধী -তারা ঈমানদার হয় কি করে? ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা কি তারা বুঝে? এটিতো মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা তো ইসলামের বিজয় (লি ইয়ুযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি)। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে মুসলিম নামধারী সেক্যুলারিস্টগণ যা বলে, নবীজী (সাঃ)’র যুগে মুনাফিকগণও তা প্রকাশ্যে বলতে ভয় পেত।
তান্ডব জাহিলিয়াতের
মুসলিম সমাজে আজ যেটি ঘটছে তার মূল কারণ, নিরেট জাহিলিয়াত। ইসলাম বিরোধীতায় এ নব্য জাহিলিয়াত আদিম জাহিলিয়াত থেকে সামান্যই ভিন্নতর। এরূপ জাহিলিয়াতের কারণেই মানুষ মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। জাহিলিয়াতের এ রোগ সারাতে হলে যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, কোর’আনী জ্ঞানের গভীর চর্চা; নিছক তেলওয়াত নয়। এটিই অজ্ঞতার একমাত্র antidote তথা প্রতিষেধক। নবী করীমের (সাঃ) সময় কোরআন বুঝাটি এতোই গুরুত্ব পেয়েছিল যে দূর-দূরান্ত থেকে সাহাবাগণ নবীজীর (সাঃ) কাছে ছুটে আসতেন এটুকু জানতে যে, মহান আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে কোন নতুন ওহী এসেছে কিনা। ওহী নাযিল হলো অথচ সেটি জানা হলো না এবং মান্য করা হলো না –একজন মু’মিনের জীবনে সেটি অভাবনীয় ছিল। না জানা ও না মানার অপরাধে জাহান্নাম যেতে হবে -এ ভয়ে প্রতিটি সাহাবী ছিলেন সদা জাগ্রত। নাযীলকৃত আয়াতগুলোকে তারা শুধু মুখস্থ্যই করতেন না, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনাও করতেন। দর্শনের জন্ম তো চিন্তা থেকেই। এবং চিন্তাবিদগণই তো দার্শনিক হয়। তাই কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় না গিয়েও চিন্তা ভাবনার বলে প্রতিটি সাহাবী পরিণত হয়েছিলেন বিখ্যাত আলেম ও দার্শনিকে। মুসলিম বিশ্বের নানা জনপদে তারাই সেনাপতি, গভর্নর, প্রশাসক, বিচারক, মুফতি, মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিসের দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ তারা ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ভেড়ার রাখাল বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
জ্ঞানার্জন করার কাজটি স্রেফ মাদ্রাসার শিক্ষক বা মসজিদের ইমামদের দায়িত্ব নয়, সে দায়িত্বটি তো প্রতিটি মুসলিমের। সাহাবায়ে কেরামগণ তারই দৃষ্টান্ত। তাই রাসূলে পাকের সাহাবা ছিলেন অথচ আলেম ছিলেন না সে নজির নেই। জ্ঞানার্জনে তৎপর ছিলেন পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও। বস্তুতঃ মুত্তাকী হওয়ার জন্য নারী-পুরুষের জন্য এ ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক সে ঘোষণাটি দিয়েছেন এভাবেঃ “ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা (সুরা ফাতির, আয়াত ২৮)” অর্থঃ “বান্দাহদের মাঝে একমাত্র জ্ঞানবান তথা আলেমগণই আমাকে ভয় করে।” অর্থাৎ যার মধ্যে জ্ঞান বা ইলম নেই, তার মধ্যে আল্লাহর ভয়ও নেই। তাকওয়া সৃষ্টির জন্য তাই অপরিহার্য হলো ইলম চর্চা। ইলম অর্জন এজন্যই ফরয। নিজের নামায-রোযা যেমন নিজে করতে হয়, তেমনি এ ফরযটিও নিজে আদায় করতে হয়। নামায-রোযায় ক্বাজা আছে। কিন্তু জ্ঞানার্জনের গাফলতিতে ক্বাজা নেই, তখন বাঁচতে হয় অজ্ঞতার অভিশাপ নিয়ে। ফলে ইসলামের গৌরব যুগে ইসলাম কবুলের সাথে কোর’আন বুঝাটিও গুরুত্ব পেত। এটিকে তাঁরা অপরিহার্য ভাবতেন। সেদিন কোর’আনের এ ভাষা নবদীক্ষিত মুসলিমদের আত্মায় পুষ্টি জোগাতে পাইপ লাইনের কাজ করেছিল। এ ভাষাটির মাধ্যমে ব্যক্তি সংযোগ পেয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত জ্ঞানের বিশাল মহাসমূদ্রের সাথে। ফলে সেদিন পুষ্টি পেয়েছিল তাদের আত্মা ও বিবেক। ফলে গড়ে উঠেছিল কোর’আনী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি। নির্মিত হয়েছিল অতি-মানবিক সভ্যতা।
অথচ আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতা এক্ষেত্রে প্রকট। কারণ, কোর’আনের সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে তাদের আত্মা বা রুহ সে কাঙ্খিত পুষ্টিই পায়নি। এমন সংযোগ-হীনতায় মানুষ শুধু পশু নয় বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। তখন জন্ম সূত্রে মুসলিম হলেও চেতনার ভূমিতে তখন মৃত্যু ঘটে ইসলামী চেতনার। বিলুপ্ত হয় ইসলামি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। বাংলাদেশে দূর্নীতি, সন্ত্রাস, ব্যাভিচার ও নগ্নতার প্রসার বেড়েছে একারণেই। মানুষ চালিত হচ্ছে নিছক বেঁচে থাকার জৈবিক স্বার্থে। বিদ্যাশিক্ষায় অর্থব্যয় পরিণত হয়েছে ব্যবসায়ীক বিনিয়োগ। এরূপ অর্থপ্রাপ্তির ভাবনায় মানুষ মনযোগী হয় বিদেশী ভাষা শিক্ষায়। কারণ এতে রয়েছে বেশী উপার্জনের সম্ভাবনা। অধিক অর্থপ্রাপ্তির লোভেই বিপুল অর্থব্যয়ে সন্তানদের বিদেশে পাঠানো হয়। ফলে ইংরেজী, ফরাশী, জাপানীসহ বহু বিদেশী ভাষাও তারা শিখছে। কিন্তু যে ভাষাটি না জানা হলে জীবনের মুল মিশনটিই অজানা থেকে যায় এবং অসম্ভব হয় মুসলিম হয়ে বেঁচে থাকা -তা নিয়ে ভ্রক্ষেপ নেই। ফলে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মূল ফরযটিই আদায় হচ্ছে না। ফলে সম্ভব হচ্ছে না আল্লাহভীরু মোত্তাকী রূপে মুসলমানের বেড়ে উঠাটিও। আজকের মুসলমানদের এটিই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। ১৯/১২/২০২০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018