মুসলিম জীবনে কতটুকু সফল হচ্ছে রোজা?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 11, 2024
- Bangla বাংলা, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
অর্জিত হচ্ছে কি তাকওয়া?
কোন একটি বিশেষ লক্ষ্য ছাড়া কোন বিধানকেই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দার উপর ফরজ করেন না। রোজা কতটুকু সফল -সে বিচারটি করতে হবে সে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হচ্ছে তার ভিত্তিতে। প্রশ্ন হলো মাসব্যাপী রোজার সে লক্ষ্যটি কি? যে কোন ইবাদতের ন্যায় রোজারও লক্ষ্য হলো, ঈমানদারদের আমলে পরিশুদ্ধি আনা এবং তাদেরকে জান্নাতের উপযোগী করে গড়ে তোলা। জান্নাতে কোন ঈমানহীন ব্যক্তির স্থান নাই। জান্নাতে পৌছার অপরিহার্য গুণটি হলো ব্যক্তির তাকওয়া। তাকওয়া হলো জান্নাতের চাবি। এবং রোজার লক্ষ্যটি হলো, তাকওয়ার গুণে ব্যক্তিকে সমৃদ্ধ করা। সে লক্ষ্যটি ব্যক্ত করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা এভাবে: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’’ -(সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)। লক্ষ্য এখানে মুসলিমকে বা ঈমানদারকে তাকওয়াবান বা মুত্তাকী বানানো। এ থেকে বুঝা যায় মুসলিম ও ঈমানদার হওয়া এবং মুত্তাকী হওয়া এক নয়। তাই রোজার গুরুত্ব বুঝতে হলে প্রথমে তাকওয়ার গুরুত্ব বুঝতে হবে।
প্রশ্ন হলো, তাকওয়া কি? তাকওয়া অর্থ ভয়। কিসের ভয়? সে ভয় বাঘ-ভালুক-সিংহের ন্যায় হিংস্র জন্তুর ভয় নয়। সে ভয় এমনও নয় যা গভীর সমুদ্রে ঝড়ে পড়া জাহাজের যাত্রীর ন্যায় আতংকিত ও বিচলিত করবে। তাকওয়া হলো আল্লাহ-সচেতনতার এমন এক মানসিক অবস্থা যা সর্বদা স্মরণে রাখে জাহান্নামের আযাব। সে ভয় দূরে রাখে সকল প্রকার ভ্রষ্টতা ও পাপ কর্ম থেকে এবং সর্বক্ষণ প্রেরণা জোগায় নেক-আমলে। তখন জন্ম নেয় আল্লাহকে খুশী করার সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা। সে ভয় চেতনায় সব সময় জাগ্রত রাখে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে জবাবদেহীতার চেতনা। এমন চেতনায় জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত মনে হয় মহান আল্লাহতায়ালার অমূল্য নেয়ামত এবং এ জীবন গণ্য হয় অবিরাম পরীক্ষাপর্ব রূপে। তখন বিরামহীন ব্যস্ততা বাড়ে সে পরীক্ষায় কি করে ভাল ভাবে কৃতকার্য হওয়া যায় -তা নিয়ে। মটর হাইওয়েতে দ্রুত গাড়ি চালানোর সময় যে ভয়টি সব সময় কাজ করে সেটি দুর্ঘটনার। মুহুর্তের অসতর্কতায় চালকের ও অন্যান্য আরোহীর মৃত্যু ডেকে আনে। সে জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ভূলের প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষণিকের ভূল ও অসচেতনতা ও ঘুমই সে বিপদ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। চালককে তাই প্রতি মুহুর্তে সজাগ থাকতে হয়। চোখ, কান ও মন খোলা রাখতে হয়। মৃত্যূর ভয়ে তাকে সর্বমুহুর্ত সতর্ক থাকতে হয়। চালকের জন্য এটাই হলো তাকওয়া। আর মু’মিনের তাকওয়া তাকে সব সময় সতর্ক রাখে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে।
তাকওয়া মু’মিনের জীবনে নানা ভাবে কাজ করে। তাকওয়া থেকেই জন্ম নেয় সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হওয়ার সার্বক্ষণিক ভয়। যে কোন মুহুর্তে বিচ্যুত হতে পারে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে; অবাধ্য হতে পারে তাঁর হুকুমের। মু’মিনের তাকওয়া মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচারও। হযরত হুজাইফা (রা:) নামক এক বিখ্যাত সাহাবীর কাছে নবীজী (সা:) তাঁর মৃত্যুর আগে সে আমলের মুনাফিকদের একটি তালিকা দিয়ে যান। হযরত উমর (রা:) হযরত হুজাইফা (রা:)’র কাছে গিয়ে বলতেন, “হে হুজাইফা! দেখবেন কি মুনাফিকদের তালিকায় আমার নাম আছে কি?” এই হলো তাকওয়ার মান। হযরত উমর (রা:) সম্মন্ধে নবীজী (সা:) বলেছিলেন, “আমার পর কেউ নবী হলে, উমর হতেন সে নবী।
রোজার মূল কাজ এমন ভয় তথা তাকওয়ার বৃদ্ধি। তাই তাকওয়া নিছক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ্য নয়, বরং সর্বপ্রকার জৈবিক,আত্মিক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের প্রবল ঈমানী শক্তি। এমন তাকওয়া থেকেই প্রেরণা আসে আল্লাহপাকের হুকুমগুলি জানার এবং সে সাথে সেগুলি অনুসরণের। তাকওয়া-সমৃদ্ধ ব্যক্তিটি পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জনকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম রূপে গ্রহণ করে। কারণ সে বুঝে, অজ্ঞতা নিয়ে সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা অসম্ভব। ভয় এখানে অজ্ঞতার অন্ধকারে ভূল পথে হারিয়ে যাওয়ার। তাই তাকওয়া-সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য অসম্ভব হয় জাহেল বা অজ্ঞ থাকা। খাদ্যের সন্ধানের ন্যায় গুরুত্ব পায় জ্ঞানের সন্ধানও। কারণ হাজারো পথের মাঝে কোনটি সিরাতাল মুস্তাকীমের পথ আর কোনটি ভ্রষ্টতার পথ -সেটি জানতে বা বুঝতে হলেও তো জ্ঞান চাই। পথচলায় যে সিগনাল বা বিধিনিষেধ থাকে সেগুলোও তো জানতে হয়। নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের মাঝে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে তাই কোন অজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন না। সাহাদের শতকরা শতভাগই ছিলেন আলেম।
মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান ও প্রত্যাশা
মাহে রমযান হলো রহমত ও মাগফেরাতের মাস। এ মাসেই নাযিল হয়েছিল পবিত্র কুর’আন -অর্থাৎ মর্তের বুকে নেমে এসেছিল মহান আল্লাহর নিজস্ব বাণী। এভাবে মানব জাতি পেয়েছিল মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামতটি – মূক্তি ও সফলতার একমাত্র এবং সর্বশেষ পথ। ইসলামী পরিভাষায় এটিই হলো সিরাতাল মুস্তাকীম। মানব জাতির কল্যাণে আর কোন ঘটনা কি এতোটা গুরুত্বপূর্ণ? পবিত্র কুর’আন নাযিলই হলো সমগ্র মানব ইতিহাসে সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা। মানব জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এ কুর’আনের বরকতেই। এই একটি মাত্র ঘটনাই রমযানের এই মাসটিকে অন্য যে কোন মাসের তুলনায় সবচেয়ে অধিক সম্মানিত করেছে। এ ঘটনাটির বরকতেই এ মাসটিতে মহান আল্লাহতায়ালার অতি প্রিয় কাজটি হলো তিনি তাঁর বান্দার প্রার্থনাকে কবুল করা। এভাবেই এ মাসটি সম্মানিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। এবং সে সম্মানেরই প্রতীক হলো, এ মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাত লায়তুলু ক্বদর। সারা বছরের মাঝে দোয়া কবুলের এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ রাত।
মাহে রমযান থেকে তো তারাই ফায়দা নিতে পারে যারা ফায়দা নেয় পবিত্র কুর’আন থেকে। তবে কুর’আন থেকে সে ফায়দা নিতে হলে তো সে কুর’আন বুঝতে হয়। এখানেই মুসলিমদের সবচেয়ে ব্যর্থতা। মাহে রমযান এলে শুরু হয় কুর’আন খতমের প্রতিযোগিতা। প্রতি হরফ তেলাওআতে ৭০ নেকী -সেটিই তাদের ধাবিত করে সে কুর’আন খতমের প্রতিযোগিতা। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা কুর’আন খতম ফরজ করেননি। তিনি কুর’আন বুঝা ফরজ করেছেন। কুর’আন হিদায়েতের কিতাব। তাই কুর’আন পড়তে হয় সে কিতাব থেকে হিদায়েত লাভের নিয়েত নিয়ে। কুর’আন তেলাওয়াত তখনই সওয়াব দেয় যখন সেটি হয় কুর’আন থেকে হিদায়েত লাভের লক্ষ্যে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমের মনে সে নিয়েত নিয়ে কুর’আন পাঠ করে না। ফলে কুর’আন নাযিলের পিছনে মহান আল্লাহতায়ালার যে মূল উদ্দেশ্য সেটিই তারা ব্যর্থ করে দেয়। এখানে ভাবে ব্যর্থ হয় মাহে রমযানের লক্ষ্য।
তবে দোয়া কবুলটি নিঃশর্ত নয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আরোপিত শর্তটি হলো, কুর’আনে বর্নীত নির্দেশাবলীর পূর্ণ অনুসরণ। সে হুকুমগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আযাব ডেকে আনে। পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত সে শর্তটি বলা হয়েছে এভাবে, “..(হে মুহাম্মদ) এবং যখন আমার বান্দারা আমার ব্যাপারে আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, (তাদেরকে আপনি বলে দিন) বস্তুত আমি রয়েছি অতি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা আমি কবুল করি। অতএব তাদেরও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো, আমার হুকুম পালন করা এবং আমার উপর ঈমান আনা।” (-সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৬)। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, তিনি প্রতিটি বান্দার অতি নিকটে। সুরা ক্বাফে বলা হয়েছে, তিনি তাদের গর্দানের রক্তের শিরার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী। তিনি যে বান্দার প্রতিটি দোয়া শুনেন তাই নয়, তাদের দোয়া কবুলও করেন। তবে দোয়া কবুলের পূর্বশর্তও রেখেছেন। সে শর্তটি হলো, তাঁর উপর পূর্ণ ঈমান এবং তাঁর হুকুমগুলির প্রতিপালন। অর্থাৎ সর্বসামর্থ্য দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার পক্ষে খাড়া করা। সে জন্য কোন দল বা নেতার অপেক্ষায় বসে থাকারও অনুমতি নাই। তাই পবিত্র কুর’আনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “(হে মুহাম্মদ) বলে দিন, “তোমাদের জন্য আমার একটি মাত্র ওয়াজ (নসিহত): খাড়া হও আল্লাহর জন্য (আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য) জোড়ায় জোড়ায় অথবা (সেটি সম্ভব না হলে) একাকীই; অতঃপর তোমরা চিন্তাভাবনা করো।”–(সুরা সাবা, আয়াত ৪৬)।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে বান্দার চাওয়া-পাওয়ার তালিকাটি বিশাল। কিন্তু বান্দার কাছেও তাঁর প্রত্যাশা আছে। সে ন্যূনতম প্রত্যাশাটি হলো, তাঁরা দাঁড়াবে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে –যেমনটি দাঁড়িয়েছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। তাঁরা যখন এরূপ দাঁড়ায়, তখন তিনিও তাদের ডাকে সাড়া দেন। সেটিই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। অতীতে সাহাবাদের ডাকে তিনি ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন এবং বিশাল বিশাল শত্রুবাহিনীর উপর বিজয় দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিতে। বরং তারা সাড়া দিয়েছে শয়তানের ডাকে; এবং বিজয়ী করেছে শয়তানের এজেন্ডাকে। দোয়া পেশের সময় তারা নিজেদের এ গাদ্দারীর কথা ভূলে যায়। তারা এ কথাও ভূলে যায় যে, যারা শয়তানের পক্ষে দাঁড়ায়, তাদের জীবনে নেমে আসে প্রতিশ্রুত আযাব -সেটি শুধু এ দুনিয়ার জীবনে নয়, অনন্ত-অসীম আখেরাতের জীবনেও। পবিত্র কুর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে বার বার। কথা হলো, আজকের মুসলিমগণ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়ার বদলে যে শয়তানের পক্ষে খাড়া হয়েছে -সে প্রমাণ কি কম? মুসলিম ভূ-খন্ড আজ বিভক্ত, শরিয়ত বিলুপ্ত, বিজয় জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সূদ, ঘুষ, জুয়া, মদ ও দেহব্যবসা –এগুলো কিসের আলামত? মুসলিম ভূমিতে তারা যে শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করেছে –এগুলো কি তারই প্রমাণ নয়? তবে কি তাদের দোয়া কবুল করে শয়তানের বিজয়কে আরো বাড়িয়ে দিবেন?
ব্যর্থতা তাকওয়া অর্জনে
ব্যক্তির তাকওয়া দেখা যায়। যেমন দেখা যায় দিনের সূর্যকে। তাকওয়া দেখা যায় ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, চরিত্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের এজেন্ডা দেখে। শরিষার দানা পরিমান ঈমান আছে এমন ব্যক্তি কি কখনো দেশের আদালতে শরিয়তের বিলুপ্তি মেনে নেয়? মেনে নেয় কি কাফেরদের প্রণীত আইনের বিচার? অথচ বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে তো সেটিই হচ্ছে! নামাজ-রোজা নিয়মিত আদায় করে এমন মুসলিমদের সংখ্যা আজ পৃথিবীতে শত কোটির অধিক। কিন্তু সে তুলনায় তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে কতটুকু? যারা মাসব্যাপী রোজা পালন করে তাদের মাঝে কতজন ঘুষ, সূদ, মিথ্যাচার ও দুর্বৃত্তি ছেড়েছে? সমাজ জুড়ে কতটুকু বেড়েছে নেক আমল? বরং বিপরীতমুখী কর্ম ও চরিত্রই কি প্রবলতর হচ্ছে না?
নেক-আমলের বিপরীত হলো, মিথ্যা, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার , ঘুষ ও ধোকাবাজির ন্যায় নানাবিধ পাপাচার বা দুর্বৃত্তি। ইসলামী পরিভাষায় এগুলো হলো মুনকার। মুসলিম দেশ হওয়ার বরকতে এটাই কি কাঙ্খিত ছিল না যে, এদেশগুলি সুনীতি, সত্যবাদীতা ও সৎকর্মে বিশ্বে রেকর্ড গড়বে? সৃষ্টি হবে নেক আমলের প্লাবন। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টোটি। বেড়েছে দূর্নীতি। ফলে রোজা যে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হচ্ছে না -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? তবে এ বিফলতা নিয়েই বা ক’জন ভাবছে? অথচ মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিদ্রোহই তো শয়তানের অনুসরণ। এরূপ বিদ্রোহে বিজয়ী করা হয় শয়তান ও তার অনুসারীদের। অথচ প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে চলছে সে প্রবল বিদ্রোহ। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিটি মিথ্যা, প্রতিটি পাপ ও প্রতিটি দূর্নীতির মধ্য দিয়ে। এমন বিদ্রোহে মুসলিমরা বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। কাফেরদের হারিয়ে দূর্নীতিতে তারা বিশ্বে প্রথম হয়েছে। বাংলাদেশ দূর্নীতি প্রথম হয়েছে ৫ বার। প্রতিটি মুসলিম দেশে এমন বিদ্রোহীরাই বার্থ করে দিচেছ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার প্রতিটি উদ্যোগ। শুরুতে মুসলিমদের একাধিক রাষ্ট্র ছিল না, কিন্তু যেটি ছিল সেটি প্রতিষ্ঠিত ছিল শরিয়ত তথা আল্লাহর আইনের উপর। কুর’আনে বর্নীত আল্লাহর হুকুমকে তারা শুধু পাঠই করতো না, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগও করতো। কিন্তু আজ শুধু পাঠই হয়, প্রয়োগ নেই। মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে নানা ভাষা ও নানা জাতীয়তার নামে বহু জাতীয় ঝান্ডা। সে সাথে বেড়েছে আল্লাহর হুকুমের তথা শরিয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডাও। বিদ্রোহের সে ঝান্ডা উড়ানো হয়েছে মুসলিম দেশের ব্যাংকগুলিতে সূদকে হালাল করে। বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়ছে দেশের পতিতালয়গুলিতে। বিদ্রোহ চলছে মুসলিম দেশের আদালতে। সেটি কুর’আনী আইনের স্থলে কাফেরদের প্রণীত আইন প্রয়োগ করে। এ আইনের ব্যভিচার বা পতিতাবৃত্তিও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। এই কি তাকওয়ার নমুনা?
সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা তুলতে মহিলারাও পিছিয়ে নেই। তারা সে ঝান্ডা তুলেছে পর্দার হুকুম অমান্য করে এবং নারী-পুরুষের মাঝে অবাধ মেলামেশার মধ্য দিয়ে। বেপর্দাগী নিজেই মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা। এবং সে ঝাণ্ডা উড়িয়ে যারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করে তাদেরকে এসব নামাজী ও রোজাদার মুসলিমগণ নেত্রী গণ্য করে এবং তাদেরকে ভোটে নির্বাচিতও করে। তাদের পিছনে রাজপথে মিছিলও করে। আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী তাদের ভোট দিলে বা তাদের রাজনীতিকে সমর্থন করলে কি নামাজ-রোজা পালনের অর্থ থাকে? ইবাদত বান্দার মনে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের প্রতি আনুগত্য বাড়াবে -সেটাই কি কাঙ্খিত নয়? কিন্তু কোথায় সে আনুগত্য? কোথায় মহান আল্লাহতায়ালার পথে নিবেদিত প্রাণ সৈনিক? বরং অধিকাংশ মুসলিম যেন তাদের কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ঘোষণা দিচ্ছে, আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি তাদের কোন পরওয়া নাই। যা গুরুত্ব পাচ্ছে তা হলো তাদের ব্যক্তিগত, দলগত, জাতিগত ও গোষ্ঠিগত স্বার্থচিন্তা; আল্লাহতায়ালার হুকুম নয়। মহান প্রভুর হুকুমকে তারা সীমাবদ্ধ রেখেছে জায়নামাজ, বিয়ে-শাদী, মুর্দাদাফন, মসজিদের নামাজ এবং রোজা-হজ্জ পালনে। এবং তাঁর বিধানের প্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও আইন-আদালতের অঙ্গণে। এমন আচরণ কি মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ নয়? এমন বিদ্রোহী বান্দারা সারা বছর যদি রোজা রাখে, বছরের সারা রাত যদি নামাজ পড়ে এবং সারা রাত যদি কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করে -তবে কি সে ইবাদত ও মোনাজাত রাব্বুল আলামিনের কাছে কবুল হয়? কবুল যে হচ্ছে না -সে প্রমাণই কি কম? কবুল হওয়ার নমুনা কি এই – মুসলিম দেশে আগ্রাসী বিদেশী শক্তি আধিপত্য পাবে এবং মুসলিম নর-নারি প্রতিদিন নিহত, আহত, ধর্ষিতা ও নির্যাতিত হবে? মুসলিমদের অবস্থা হয়েছে এমন সব সৈনিকদের ন্যায় যারা প্রশিক্ষণ নেয় দেশের ক্যান্টনমেন্টে কিন্তু যুদ্ধ করে শত্রুর সেনাদলে এবং বিজয়ী করে শয়তানের পক্ষকে।
দোয়া কেন ব্যর্থ হয়?
তিরমীযি শরিফের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: তিন ব্যক্তির দোয়া কখনোই বৃথা যায় না। সে তিন প্রকার ব্যক্তি হলো: রোজাদার, ন্যায় পরায়ন শাসক এবং যিনি মজলুম। কিন্তু এ হাদীসটির পাশাপাশি এ হাদীসটিও এসেছে যে, দোয়া কবুলের শর্ত হলো তার রিযিক হালাল অবশ্যই হতে হবে। ফলে যে ব্যক্তির সেহরী ও ইফতার যদি হয় ঘুষ, সূদ, মদবিক্রয়, জুয়া, ধোকাবাজি ও নানা দূনীতির মধ্য দিয়ে উপার্জিত অর্থে, তার বসবাস যদি হয় সূদী অর্থে কেনা বা জবরদখল ও দূর্নীতির মধ্য দিয়ে অর্জিত গৃহে, তবে তার দোয়া কি কবুল হয়? দোয়া কবুলের জন্য রোজাদার হওয়ার পাশাপাশি ঈমানদার, চরিত্রবান ও নেককার হওয়াও তো শর্ত। পবিত্র কুর’আনে সে শর্তের কথাটি একবার নয়, বহুবার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা ফাসেক ও জালেম তাদের দোয়া কবুল করা দূরে থাক, মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে হিদায়েত পর্যন্ত দেন না। হিদায়েত লাভের শর্ত হলো,পাপের পথ তথা দূর্নীতি পরিত্যাগ করা। ঔষধ সেবনের আগে বিষ-পান ত্যাগ জরুরি, তেমনি হিদায়াত লাভের জন্য বর্জন করতে হয় পাপের পথকে। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে প্রতিট বিদ্রোহই তো পাপ। সিরাতাল
মহান আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে বড় দান ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি বা প্রতিপত্তি নয়, বরং সেটি এই হিদায়েত। সে হিদায়েত লাভের জন্যই প্রতি নামাজের প্রতি রাকাতে “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম” বলে দোয়া করতে হয়। এর চেয়ে বড় দোয়া যেমন নেই, তেমনি হিদায়েত প্রাপ্তির চেয়ে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে শ্রেষ্ঠতর প্রাপ্তিও নাই। জান্নাতের যোগ্য বিবেচিত হওয়ার জন্য এটিই প্রথম ধাপটি হলো। হিদায়েত প্রাপ্তিই ঈমানদারকে একজন কাফের থেকে আলাদা করে। হিদায়েত লাভের ফলেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয় সিরাতাল মোস্তাকিমে চলা। কাফের, জালেম ও ফাসেকের জীবনে হিদায়েত নাই; ফলে তাদের জীবনে সিরাতাল মোস্তাকিমও নাই। যা আছে তা নিছক বিভ্রান্তি। এমন বিভ্রান্তি কেবল জাহান্নামের যোগ্য রূপে গড়ে তোলে। ফলে যে দেশটি দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়, সে দেশের মসজিদগুলো মুসল্লিতে যতই পূর্ণ হোক না কেন -তারা কি রহমত পায়? হিদায়েত লাভের জন্য শুধু মুখে কালেমা পড়লেই চলে না। মূর্তিপুঁজা ছাড়াটাই যথেষ্ট নয়। দূর্নীতি ছেড়ে সুনীতি এবং দুষ্কর্ম ছেড়ে নেক আমলের পথও ধরতে হয়। আদালতে প্রতিষ্ঠা দিতে শরিয়তের আইনকে। দোয়া কবুল তো এ পথেই আসে।
রোজার পরিপূর্ণ ফায়দা নিতে যা জরুরি তা হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া। রোজা পালনের কুর’আনী আহবান তো এসেছে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য -জালেম, ফাসেক, কাফের ও মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে নয়। মূল লক্ষ্য, ঈমানদারের তাকওয়া বৃদ্ধি। প্রাসাদ গড়তে ভিতটা প্রয়োজন, তাকওয়ার নির্মাণে ঈমান হলো সেই ভিত। তবে ঈমানদারীর অর্থ শুধু আল্লাহকে বিশ্বাস করা নয়। মক্কার কাফেরগণও আল্লাহকে বিশ্বাস করতো। সন্তানদের নাম নবীজীর (সা:) জন্মের পূর্বেও তাদের আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান রাখত। কিন্তু কাফেরদের এ বিশ্বাস বেশীদূর এগুয়নি। এ বিশ্বাসে তাই তাকওয়া সৃষ্টি হয়নি, ফলে ব্যক্তি ও সমাজ কোনটাই বিশুদ্ধ হয়নি। মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান আনাতে ব্যক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি শুরু হয় মাত্র, পূর্ণ মুসলিম হতে আরো অনেক দূর এগুতে হয়। তাকে পরিপূর্ণ অংশ নিতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পিত প্রশিক্ষণে। শুধু একদিন দুদিন নয়, বরং জীবনের সবগুলো দিন ধরে। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ হলো সে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
রোজার ট্রেনিং কেন অপরিহার্য?
দক্ষ কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার গড়ার জন্য ট্রেনিং চাই। তেমনি ট্রেনিং চাই নিষ্ঠাবান মুসলিম গড়ার জন্যও। সে ট্রেনিংয়ের মূল কথা হলো জিহ্বা, পেট, নফস ও যৌনতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। জিহ্ববার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মিথ্যাচার, গিবত ও কলহ-বিবাদ থেকে নাযাত মেলে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে অশান্তির মূল কারণ হলো লাগামহীন জিহ্ববা। তেমনি পেটের লালসার উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে পানাহারে অবাধ্যতা হয় শরিয়তী বিধানের। মানুষ তখন উপার্জনে দূর্নীতির আশ্রয় নেয়। নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না পেলে মানুষ দুর্বৃত্ত স্বৈরাচারী, খুনি, ভোটডাকাত, ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়। তেমনি যৌন লালসার উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ ব্যাভিচারে ধাবিত হয়। নবীজী (সা:) বলেছেন, অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে জিহ্ববা ও যৌনাঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে। রমযানের মাস ব্যাপী রোজা মূলত সে নিয়ন্ত্রণকেই প্রতিষ্ঠা করে। রমযানের রোজা যদি সে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনেই ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে রোজাদারের মাসব্যাপী ট্রেনিং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। রোজা তাকে দিনভর উপবাসের কষ্ট ছাড়া আর কিছু্ই দেয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের রোজা যে তাদের জীবনে কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারিনি তা শুধু রমযানের মাসে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে ধরা পড়ে না, প্রকট ভাবে ধরে বিশ্বব্যাপী দূর্নীতিতে প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়েও। যেমন চোর-ডাকাত, দুর্বৃত্তদের বছরের পর বছর ট্রিনিং দিয়ে ভাল সৈনিক বানানো যায় না। তেমনি অসভ্য জাহেল ব্যক্তিকে বছরের পর বছর নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাতের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাল মুসলিম বানানো যায় না।
জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণটি নিছক শারীরিক কসরতের বিষয় নয়। সে জন্য চাই কুর’আনের জ্ঞান। কুর’আন নাযিলের মাসকে রমযানের মাস ধায্য করে বস্তুত কুর’আনী জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। ওহীর এই জ্ঞান ঈমানদারের জীবনে আনে রুহানী তথা আধ্যাত্মিক বিপ্লব। পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জিত জীবন নির্মাণের শুরু এখান থেকেই। লাগাতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া সেটি অসম্ভব। পশু পশুরূপে জন্ম নেয়, মারাও যায় পশু রূপে। এদের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কোনরূপ চারিত্রিক উৎকর্ষ নেই। তাই পশুকুলে সমাজ গড়ে উঠে না, সভ্যতাও নির্মিত হয় না। কিন্তু মানুষকে পশু থেকে ভিন্নতর ও উন্নততর হতে হয়। এটিই জীবনের মূল সাধনা। নইলে মানুষরূপে জন্ম নিয়েও সে মারা যেতে পারে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে। মানব সমাজে যে সেটি ঘটে সে সাক্ষ্যটি দিচ্ছেন খোদ আল্লাহতায়ালা। তাদের বিষয়েই পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে ‘‘উলায়িকা কা’আল আনয়াম, বাল হুম আদাল।’’ অর্থ: “তারাই পশুর ন্যায় বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট’’। অর্থাৎ এদের জীবনে উপরে উঠার কাজটাই হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে তাদের ঈমান ও আমল বাড়েনি, বরং বয়সের সাথে গতি বেড়েছে নীচে নামায়। নিষ্পাপ শিশু রূপে জন্ম নিয়ে এরাই কবরে যায় ভয়ানক অপরাধীর পরিচয় নিয়ে। বাংলাদেশের মত দুর্বৃত্ত অধিকৃত দেশগুলিতে এই নিচে নামার কাজটিই সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বেশী বেশী হচ্ছে।
অপর দিকে জ্ঞান-সাধনায় অর্জিত উচ্চতর গুণে মানুষ ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হতে পারে। এবং সে সামর্থ্য অর্জনের কাজটি ব্যক্তিকে জীবনভর করতে হয়। উচ্চতর সমাজ ও সভ্যতা নির্মিত হয় তো এমন মানুষের আধিক্যেই। আর এরূপ উচ্চতর মানুষ ও উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণের মধ্য দিয়েই তো যাচাই হয় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব; সাম্রাজ্য বিস্তার বা পারমানবিক বোমা নির্মাণের সামর্থ্য দিয়ে সেটি হয় না। বস্তুত ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আমৃত্যু আয়োজনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি পায় নেক আমলের সামর্থ্য। নেক আমল তখন ব্যক্তির জীবন-সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এমন সংস্কৃতির নির্মাণে রোজার অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোজায় শেখায় জীবন যাপনে সংযম, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তীতা। আনে আল্লাহ সচেতনতা, এবং সেটি সমগ্র দিন জুড়ে। প্রতি ওয়াক্তের নামাজ মাত্র কয়েক মিনিটের। এদিক দিয়ে রোজা সবচেয়ে দীর্ঘ ইবাদত। এবং সে ইবাদত ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও সংযমের মধ্য দিয়ে। একান্ত নির্জনেও ক্ষুধাগ্রস্ত ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে মুখে খাদ্য তুলে নেয় না। আল্লাহতায়ালা যে সব কিছু দেখেন -সে চেতনা এভাবেই রোজাদারের মনে আজীবন বদ্ধমূল হয়। সর্বকাজে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর এমন ভয় এবং এমন আল্লাহ-সচেতনতাই হলো তাকওয়া। এমন তাকওয়া অর্জিত হলেই বুঝতে হবে রোজাদারের রোজা সফল হয়েছে।
কেন ব্যর্থ হচ্ছে রোজার প্রশিক্ষণ?
সৈনিকের খাতায় নাম লেখালে বা প্রশিক্ষণ নিলেই কেউ ভাল সৈনিক রূপে গড়ে উঠে না। ভাল সৈনিক হতে হলে সৈনিক জীবনের মূল দর্শন ও মিশনের সাথেও পুরাপুরি একাত্ব হতে হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সংহতিতে তাকে পূর্ণ বিশ্বাসী হতে হয়। এখানে আপোষ চলে না। সৈনিকের জীবনের মূল মিশন তো দেশের স্বাধীনতা ও সংহতির সংরক্ষণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রটিতেই গাদ্দারী হলে ভাল সৈনিক হওয়া অসম্ভব হয়। সৈনিকবেশী এমন ব্যক্তিটির পক্ষে তখন বিদেশী শত্রুর চর হিসাবে কাজ করাও রুচিসিদ্ধ মনে হয়। কুর’আনের কসম খেয়েও এরা গাদ্দারী করে। এরাই কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে নিজ দেশের বিনাশে বা দেশকে ক্ষুদ্রতর করতে যুদ্ধ করে। মুসলিম ইতিহাসে এমন বিশ্বাসঘাতক সৈনিকের সংখ্যা কি কম? তেমনি আজীবন নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েও বহু মানুষের জীবনেই আদৌ পরিশুদ্ধি আসে না। বরং বাড়ে ইসলামের সাথে গাদ্দারী। বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে এরাই ইসলামের পরাজয় বাড়িয়েছে। পরিশুদ্ধি তো একমাত্র তখনই আসে যখন নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতের পাশপাশী একাত্ব হয় জীবন ও জগত নিয়ে ইসলামের মূল দর্শনের সাথে। প্রশ্ন হলো, সে দর্শনটি কি? সেটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালাকে একমাত্র প্রভূ, প্রতিপালক, আইনদাতা ও রেযেকদাতারূপে মেনে নেওয়া এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিজেকে আত্মসমর্পিত সৈনিক রূপে পেশ করা। দর্শনটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের। যাদের চেতনায় এ দর্শন কাজ করে না তারাই পরিণত হয় শয়তানের খলিফায়।
মুসলিমের মিশন তাই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এক আত্মসমর্পিত গোলামের মিশন। সে দায়িত্ব নিছক নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে পালিত হয় না। সে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রটি বরং বিশাল। সেটি সমগ্র দেশ, সমগ্র সমাজ, সমগ্র রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জুড়ে। দায়িত্বপালনের লক্ষ্যে ঈমানদার কখনো দ্বীনের প্রচারক হতে হয়, কখনো রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হয়, কখনো বা ইসলামের পক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক হয় আবার কখনো সশস্ত্র সৈনিকের বেশে রণাঙ্গণে যুদ্ধ লড়ে। মুসলিম শব্দটির উদ্ভব তো হয়েছে আত্মসমর্পণ থেকে, যার নমুনা পেশ করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ:)। যিনি আল্লাহর প্রতিটি হুকুমে -সেটি শিশু পুত্রের কুরবানী হোক বা নিজ দেশ ছেড়ে হিজরত হোক – সব সময়ই লাববায়েক (আমি হাজির এবং মেনে নিলাম) বলেছেন। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের মত কুর’আনী প্রশিক্ষণ তো এমন আত্মসমর্পিত মুসলিমদের জন্যই; বেঈমান ও মুনাফিকদের জন্য নয়। যারা জান্নাত চায়, তাদের জন্যই তো মহান আল্লাহতায়ালার এ প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণই তাদেরকে সে মহাপুরস্কার লাভের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলে। প্রতিটি ঈমানদার এ প্রশিক্ষণ থেকে যেমন ফায়দা পায়, তেমনি এর সাথে একাত্মও হয়।
অবমাননা হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার
ডাক্তারী বই ছাড়া কি ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ হয়? তেমনি কুর’আনের জ্ঞান ছাড়া কি মুসলিমদের প্রশিক্ষণ হয়? অথচ সে কুর’আন শিক্ষায় মুসলিমদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই্। অনেক মুসলিমদের ব্যস্ততা দেখা যায় শুধু তেলাওয়াতে, কিন্তু কুর’আন বুঝায় নয়। ছাত্রদের পক্ষ থেকে একজন শিক্ষকের সুস্পষ্ট অবমাননা হয় তখন, যখন তার কথাগুলি ছাত্ররা বুঝাতে চায় না এবং মানতেও চায় না। তেমনি কুর’আনের অবমাননা তখনই হয় যখন তা বুঝতে ও মানতে অস্বীকার করা হয়। অথচ বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে পবিত্র কুর’আনের সাথে সেরূপ অবমাননাই প্রতিনিয়ত হচ্ছে। তারাবিহ নামাজে কুর’আন খতমের আয়োজন হয় মসজিদে মসজিদে। কিন্তু আয়োজন নেই তেলাওয়াতকৃত আয়াতের অর্থ বুঝায়। কুর’আনের প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে? রমযান যেন কুর’আন অবমাননার মাস। এ অবমাননা শুধু পবিত্র কুর’আনের বিরুদ্ধে নয়, বরং যে মহান আল্লাহতায়ালা এ পবিত্র কুর’আন নাযিল করেছেন অবমাননা হচ্ছে তাঁরও। সাধারণ মুসলিমগণ তাঁর কথাগুলো বুঝতে ও মানতে রাজী নয়। এটি কি কম পাপ? ফলে এমন অবমাননাকারী ব্যক্তি মাসভর রোজা রাখলে কি হবে, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কি তার মর্যাদা বাড়ে? গৃহীত হয় কি তার ইবাদত ও দোয়া? জুটে কি ইজ্জত?
কথা হলো, যে ব্যক্তিটি চিন্তা-চেতনায় সেক্যুলার এবং যার সকল কর্মকান্ড ও অঙ্গিকার হলো আল্লাহর বিধানকে আইন-আদালত, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সকল অঙ্গণে পরাজিত রাখা -সে ব্যক্তি আজীবন নামাজ-রোজায় লিপ্ত হলেও কি তার চরিত্র ও কর্মে পরিশুদ্ধি আসে? সে তো কর্ম জীবনে মিথ্যুক, প্রশাসনে ঘুষখোর, রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট ও ব্যবসা-বাণিজ্যে দূর্নীতিবাজ হয়। এরাই দেশে-বিদেশে শয়তানী শাসক শক্তির একনিষ্ঠ সহযোগী হয়। দেশে বিপুল সংখ্যায় মসজিদ বাড়ছে। মসজিদে নামাজী ও রোজাদারদের সংখ্যাও বিপুল ভাবে বাড়ছে। কিন্তু তাতে ইসলামের বিজয় বাড়ছে না। দেশের ইজ্জতও বাড়ছে না। এ ব্যর্থতার কারণেই বছর ঘুরে বার বার মাহে রমযান এলেও মুসলিম জীবনে আদৌ পরিশুদ্ধি আসছে না। সভ্যতর হচ্ছে না সমাজ। রমযানের রহমতও জুটছে না। বরং দিন দিন দুর্বৃত্তির জোয়ার এবং বিশ্বজুড়া অপমানই প্রকটতর হচ্ছে। লন্ডন; ১ম সংস্করণ ২২/০৭/২০১২; ২য় সংস্করণ ১০/০৯/২০২১; ৩য় সংস্করণ ১১/০৩/২০২৪ ।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018