মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের

ফিরোজ মাহবুব কামাল

আজকের মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ: তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সা:)’র ইসলামকে। এবং সে সাথে ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সা:)’র ইসলামের সঠিক পালনে। তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হলো ইসলাম থেকে দূরে সরায়। ফলে তাদের অহংকার যেমন জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, দলবাদ, ফেরকাবাদ, সেক্যুলারিজম ও ফ্যাসিবাদের উপর জীবন গড়ায়, তেমনি সে সব মতবাদের ভিত্তিতে সংগঠন ও রাষ্ট্র গড়ায়। ইসলাম থেকে দূরে সরার ফল হলো, এসব মুসলিমগণ শতভাগ সফল হয়েছে নবীজী (সা:)’র ইসলামকে মুসলিম দেশগুলি থেকে বিলুপ্ত করায়। তাদের বর্তমান লড়াইটি হলো ইসলামের সে বিলুপ্তিকে বহাল রাখা। তাই বলা যায়, মুসলিম দেশগুলিতে বিশাল বিজয়টি শয়তানের। সেটির প্রমাণ, আফগানিস্তান ছাড়া আর কোন মুসলিম দেশেই বেঁচে নাই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। বেঁচে নাই তাঁর এজেন্ডা।  

যারা ইসলাম থেকে দূরে সরেছে তাদের বিজয়টি বিশাল। সেটি ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের নামে মুসলিম ভূগোলকে বিভক্ত করায়। তাদের আরো গর্ব, তারা বিশাল বিজয় পৌঁছে দিতে পেরেছে ইসলামের শত্রু কাফিরদের ঘরে। তাই আরব মুসলিমগণ যেমন ১৯১৭ সালে আরবভূখণ্ডকে ২২ টুকরোয় বিভক্ত করে ইংরেজে ও ইহুদীদের বিজয় বাড়িয়েছে তেমনি ১৯৭১ সালে বাঙালি মুসলিমগণ বিজয় ও আনন্দ বাড়িয়েছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের। সেটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করে। ১৯১৭ সালে দশ লাখের বেশী আরব মুসলিম ব্রিটিশ বাহিনী যোগ দিয়ে খলিফার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিল। সমগ্র আরব ইতিহাসের সেটিই হলো সবচেয়ে কলংকিত ইতিহাস। তেমনি  ১৯৭১’য়ে প্রায় দুই লাখ বাঙালি মুসলিম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতীয় বাহনীর বিজয় বাড়িয়েছিল। এসব সেক্যুলারিস্ট বাঙালি মুসলিমদের সবচেয়ে গৌরবের কর্ম ছিল, ভারতে গিয়ে হিন্দু্দের সেবা নেয়া এবং তাদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাক সেনা ও বিহারীদের হত্যার পাশাপাশি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলামী ইত্যাদি পাকিস্তানপন্থী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের হত্যা করা। এবং ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের পর এদের অনেকেই লিপ্ত হয় বিহারী নারীদের ধর্ষণ এবং তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে দখলে নেয়ায়। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে এতবড় কলংকের কাজ কি কোন কালে হয়েছে? এসবই সম্ভব হয়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরা এবং সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ ও বামধারার স্রোতে ভেসে যাওয়ার কারণে।

নবীজী (সা:)’র ইসলাম বুঝায় এবং ইসলাম পালনে মুসলিমদের ব্যর্থতার নমুনা দেয়া যাক। আজকের মুসলিমদের ইবাদত সীমিত হয়ে গেছে নামাজ-রোযা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন পাঠ ও তাসবিহ-তাহলিলে। অথচ ইবাদত শুধু নামাজ-রোযা, হজ্জ-যাকাত কুর’আন পাঠ ও তাসবিহ-তাহলিল নয়। বরং ইবাদতের অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি দাসত্ব। ইবাদত হলো, তাঁর এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্মতা। পবিত্র কুর’আনের ভাষায় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা হলো: “লি’ইউয হিরাহু আলা কুল্লিহি।” অর্থ: সকল ধর্ম ও সকল মতবাদের উপর তার ইসলামের বিজয়। এ এজেন্ডার ঘোষণা এসেছে সুরা তাওবা, সুরা ফাতহা ও সুরা সাফে। সুরা আনফালে ঘোষিত এজেন্ডাটি হলো: “লি’ইউ’হিক্কাল হাক্কা ওয়া ইউব‌’তিলাল বাতিলা।” অর্থ: “সত্যকে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। এবং সেটি হলো:”ইয়াকতায়া তাবিরাল কাফিরিন।” অর্থ: “শয়তানী শক্তির শিকড় নির্মূল।  তাই ঈমানদারকে নামাজ-রোজার বাইরেও দ্বীন পালনে বহুদূর যেতে হয়, নইলে তার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার কাজটি হয়না। একাজে অবশ্যই জিহাদে নামতে হয়। কারণ জিহাদ ছাড়া মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার কাজটি হয়না। কিন্তু সেরূপ দ্বীন পালনে আজকের মুসলিমরা নাই।

 মুসলিম জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইসলামের দেশী-বিদেশী শত্রু ও নানারূপ দুর্বৃত্তদের থেকে মুসলিম দেশকে পাহারা দেয়া। শত্রুপক্ষের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা বাঁচলেই পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বাধীনতা বাঁচে। শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা গড়লে মুসলিম নর-নারীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না, তাতে পূর্ণ ইসলাম পালনের সহায়ক পরিবেশও মেলে না। সে জন্য চাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জিহাদ। এমন এক রাষ্ট্রেই মুসলিম পায় “আ’মারু বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার” অর্থাৎ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলের সহায়ক পরিবেশ। এটিই হলো মুসলিম জীবনের মিশন। সমাজে জিহাদ না থাকলে বিলুপ্ত হয় নবীজী (সা:)’র ইসলাম। তখন বিজয়ী হয় ইসলামের শত্রুগণ। নবীজী (সা:)’র ইসলাম সঠিক ভাবে বুঝলে তো আজকের মুসলিমদের মাঝেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ শুরু হতো এবং ইসলামী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হতো -যেমনটি নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে দেখা গেছে। কিন্তু সেটি হয়নি।  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে তাদের নিরেট ব্যর্থতাই বলে দেয় নবীজী (সা:)’র ইসলাম বুঝতে ও পালনে আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতা কত বিশাল।


বাংলাদেশের মত দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বিপুল সংখ্যায় গড়ে উঠেছে। সেগুলির যথেষ্ট আধুনিকীকরণও হয়েছে; আগে যে মসজিদ-মাদ্রাসা কাঠ, বাঁশ ও টিনের ছিল সেখানে আজ বহুতল বিশিষ্ঠ বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। দেখা যায় কারুকার্য খচিত দরজা-জানালা, সুন্দর মোজাইক করা মেঝে এবং মেঝেতে বিছানা সুদৃশ্য কার্পেট। শুধু শহরগুলিতে নয়, গ্রামেও। যেন প্রতিযোগিতা লেগে আছে মসজিদগুলিকে আরো সুন্দর ও আধুনিক করার। কিন্তু তাতে দ্বীনের প্রতিষ্ঠা বা বিজয় কতটুকু বেড়েছে? জনগণের মাঝে বেড়েছে কি কুর’আনের জ্ঞান? নামাজীদের মাঝে বেড়েছে কি তাকওয়া ও ইসলামকে বিজয়ী করার তাড়না? সংগঠিত হচ্ছে কি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ?

 নবীজী (সা:) জামানায় মদিনার মসজিদটি ছিল মাটির; খুঁটি ছিল খেজুর গাছের, ছাদ ছিল খেজুর পাতার। কিন্তু সেটিই ছিল ইসলামের দুর্গ।  শুধু জামায়াতে নামাজ আদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়নি, ব্যবহৃত হয়েছে কুর’আন শিক্ষার মূল কেন্দ্র, প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার, সাহাবীদের মিলন স্থল এবং জিহাদে মুজাহিদ সংগ্রহ ও জিহাদ পরিচালনার মূল কেন্দ্র রূপে। কিন্তু আজকের মসজিদগুলি নবীজী (সার)’ মসজিদের সে সূন্নত ধরে রাখতে পারিনি; পরিণত হয়েছে শুধু ৫ ওয়াক্ত নামাজের ঘরে। নামাজ শেষ হলে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। লক্ষ লক্ষ টাকায় গড়া মসজিদগুলির বিশাল ও সুন্দর অবকাঠামো এভাবেই অব্যবহৃত থাকছে। অথচ মুসলিমদের গৌরব যুগে মসিজদগুলি পরিণত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। মসজিদগুলি গড়া হতো বিশাল আকারে, মসজিদের কোনে কোনে বসতো শিক্ষককে ঘিরে ক্লাস। অথচ আজ ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ফেরকা, মজহাব ও গ্রাম্য রাজনীতির নামে গড়ে উঠা তিক্ততা ও বিভক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার হাতিয়ার রূপে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *