লুণ্ঠিত স্বাধীনতা এবং প্রহসনের নির্বাচন

গণতন্ত্র কি স্রেফ নির্বাচন? –                                                         

নির্বাচন এখন মুখোশে পরিণত হয়েছে বর্বর স্বৈরশাসকদেরও। দুশ্চরিত্র ব্যাভিচারিগণও যেমন ভদ্র লেবাসে জনসম্মুখে হাজির হয়, তেমনি অতিশয় বর্বর স্বৈরাচারীও ঘটা করে নির্বাচনের আয়োজন করে এবং সে নির্বাচন নিয়ে বড়াইও করে। সেসব নির্বাচনে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক স্বৈর-শাসক তো শতকরা ৯৫ ভাগের বেশী ভোট-হাছিল নিয়ে গর্ব করে। এর কারণ, নির্বাচনের আলংকারিক মূল্য। তাই স্বৈর-শাসকদের আগ্রহ স্রেফ নির্বাচন নিয়ে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে নয়। স্বৈর-শাসকগণ সে অতি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনকে নিজেদের গণতন্ত্রি হওয়ার পক্ষে সাফাই রূপে পেশ করে। স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ বিয়েশাদী, ঘরবাধা, খেলাধুলা ও পানাহারের স্বাধীনতা নয়, বরং সেটি রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচা। এটিই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। সে গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠিত হলে তাই লুণ্ঠিত হয় স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা জনগণকে দিলে তাতে বিপদ খাড়া হয়স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে সে ভয় থাকে না।

সরকার-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের  অর্থ হলো, নির্বাচনে কারা জিতবে সে বিষয়টি নির্ধারণের অধিকার ভোটারদের হাত থেকে ছিনিয়ে সরকারের হাতে সীমিত করা। এটি হলো উলঙ্গ ইলেকশন ইঞ্জিনীয়ারিং। সে কাজে ব্যবহৃত হয় সমগ্র প্রশাসন। এমন নির্বাচনে অসম্ভব হয় জনপ্রিয়তাহীন অতিশয় বর্বরস্বৈরাচারী সরকারকে পরাজিত করা। এর প্রমাণ সিরিয়া ও মিশরের নির্বাচন। সিরিয়ার স্বৈর-সরকার চার লাখের বেশী মানুষকে হত্যা করেছে। এবং ৬০ লাখের বেশী নাগরিককে দেশছাড়া করেছে। সরকার টিকে আছে রাশিয়া ও ইরানী সৈন্যদের সহয়তা নিয়ে। অথচ নির্বাচনে স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ শতকরা ৯০ ভাগের বেশী ভোট পায়। তেমনি ঘটে মিশরেও। ভোটারদের ভোট দিতে বাধ্য করা হয় স্রেফ নির্বাচনের কসমেটিক ভ্যালু বাড়াতে। মাঠে নিজ দলের রিফারি থাকলে খেলায় হেরে যাওয়ার ভয় থাকে না। প্রতিপক্ষের খেলাওয়াড়দের বিরুদ্ধে যেমন ইচ্ছামত পেনাল্টি দেয়া যায়, তেমনি লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরেও পাঠানো যায়। বাংলাদেশে তেমন লালকার্ড ইতিমধ্যে দেখানো হয়েছে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক জিয়াকে। লাল কার্ড দেখানো হয়েছে পুরা সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকেই। ঠুনকো বাহানায় জেলে পাঠানো হয়েছে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে।

অথচ গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক মানের একটি স্বীকৃত সংজ্ঞা রয়েছে। এর অর্থ স্রেফ ৫ বছর পর পর বিশেষ এক দিনে ঘটা করে নির্বাচন নয়। গণতন্ত্রের অর্থ স্রেফ জনগণের ভোটদানও নয়। বরং এটি হলো শান্তিপূর্ণ ভাবে শাসক নির্বাচন ও দেশ পরিচালনার একটি সভ্যতর সংস্কৃতি। সরকার কীরূপে নির্বাচিত হবে এবং প্রশাসনের অঙ্গণে জনগণের মতামত কীরূপে প্রতিফলিত হবে – তা নিয়ে গণতন্ত্র দেয় একটি উন্নত ও ভদ্র নীতি মালা। সরকার ও প্রশাসনের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণটিই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। জনগণ যখন সে নিয়ন্ত্রণটি হারায়, তখন সেটিকে আর সে গণতন্ত্র বলা যায় না। সেটি তখন নিরেট স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়। রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানের ময়দানে গণতন্ত্র হলো এক অতি কল্যাণকর আবিস্কার। এমন একটি সভ্য নীতি মানব ইতিহাসের বুকে সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল ইসলাম। যে যুগে রাজপুত্র না হলে কেউ ক্ষমতায় বসার স্বপ্নও দেখতো না, সে যুগে আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ), উসমান (রাঃ), আলী (রাঃ)’র ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রীয় প্রধান হয়েছেন কোন রাজপুত্র না হয়েই। এমন একটি ভদ্র রীতিতে রাষ্ট্রের প্রধান হতে যেমন যুদ্ধের প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি প্রয়োজন পড়ে না বাকশালী রাজনীতি ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনেরও।

 

লুণ্ঠিত স্বাধীনতা

রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং দেশের প্রতিরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ও বিদেশ নীতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জনগণ তাদের মতামতটি শুধু নির্বাচনের দিনে নয়, বরং প্রতি মাস, প্রতিদিন ও প্রতিমুহুর্তে জানায়। সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের সে মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। একমাত্র তখনই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত এবং রীতি-নীতির উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণটি নজরে পড়ে। জনগণের সে নিয়ন্ত্রণটিস্বৈরাচারী শাসনে থাকে না, বরং সেখানে নজরে পড়ে স্বৈর-শাসক, রাজা, রাজপুত্র, রাজকণ্যা, দলপতি বা গোত্রপতির নিয়ন্ত্রণ। সরকারের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণটি প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। তবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের অতি অপরিহার্য অঙ্গ হলেও তার চেয়েও গুরুত্পূর্ণ হলো সংসদের বাইরেও গণতান্ত্রিক পরিবেশের প্রতিষ্ঠা দেয়া। সেটি হলো স্বাধীন ভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।  মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না, তেমনি গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়াও মত প্রকাশের স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া বাঁচে না। সরকারের নীতিতে যেমন প্রতিদিন পরিবর্তন আসে, জনগণও তেমনি প্রতিদিন সে নীতির উপর নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করে। সে অভিমত লাগাতর প্রকাশের জন্য চাই কথা বলা ও লেখা-লেখির স্বাধীনতা। এক্ষেত্রে জনগণের অধীকার না বাঁচলে স্বাধীনতা বাঁচে না। অথচ বাংলাদেশে সে স্বাধীনতা বেঁচে নাই। দেশটিতে ৫ বছর পর পর নির্বাচন হলেও বিলুপ্ত করা হয়েছে মত প্রকাশের সে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। জনগণের মত-প্রকাশের বিষয়টি স্রেফ ৫ বছর পর ভোটদানের বিষয় নয়, বরং সেটি এক অবাধ ও বিরামহীন স্বাধীন প্রক্রিয়া। অথচ সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই বাংলাদেশে গুরুত্বই পায়নি। বরং ফ্যাসিবাদি কায়দায় হত্যা করা হয়েছে সে স্বাধীনতাকে।

জনগণ নিজেদের মতামত স্বাধীন ভাবে ব্যক্ত করে যেমন মিটিং-মিছল ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে, তেমনি টিভি,  পত্র-পত্রিকা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ওয়াজ মহফিল, ক্লাসরুম ও মসজিদের মিম্বরে। এগুলির কারণে সমগ্র দেশ পরিণত হয় সংসদে। জনগণের সে সংসদকে সমৃদ্ধ করতে অপরিহার্য হলো, কথা বলা ও লেখালেখির স্বাধীনতা। চাই, মিটিং-মিছিল ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মুক্ত অঙ্গণ। চাই, স্বাধীন পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। নির্বাচিত সদস্যদের সংসদে কথা বলতে হলে স্পীকারের অনুমতি লাগে। কিন্তু দেশব্যাপী বিস্তৃত সে সংসদে কথা বলতে কারো অনুমতি লাগে না। উম্মুক্ত এ গণসংসদে কথা বলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিচারপতি, উকিল, ধর্মীয় চিন্তাবিদ, রাজনৈতীক নেতাকর্মী, পত্রিকার কলামিস্ট, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, মানবাধীকার কর্মী, সমাজকর্মীসহ নানা পেশা ও নানা মতের মানুষ। ফলে সংসদে যা আলোচনা হয়, তার চেয়ে অধীক জ্ঞানগর্ভ আলোচন হয় জনগণের এ মুক্ত সংসদে। উদাহরণ স্বরূপ, বিলেতের পত্র-পত্রিকা গুলোতে যে মানের গভীর আলোচনা হয় তা কি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হয়? বরং বাস্তবতা হলো, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের লাগাতর শিখতে হয় পত্রিকার কলামগুলো থেকে। তাছাড়া আরো সত্য বিষয় হলো, বছরের বেশীর ভাগ দিন পার্লামেন্টের কোন বৈঠক বসে না। যখন বসে তখনও অধিকাংশ সময় কেটে যায় সরকারি ও বিরোধী দলীয় এমপিদের রাজনৈতিক বিতর্কে; ফলে সেখানে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বা গভীর চিন্তাভাবনার সুযোগ থাকে সামান্যই। অথচ বিলেতে পত্র-পত্রিকা একদিনের জন্যও বন্ধ হয় না। রাজপথে জনগণের সংসদ বসে প্রতিদিন। ফলে এমপিগণ পার্লামেন্টে বসে যা শেখে বা নির্দেশনা পায়, তার চেয়ে বহুগণ বেশী শেখে ও নির্দেশনা পায় পার্লামেন্টের বাইরে  জমজমাট মুক্ত গণ-পার্লামেন্ট থেকে। দেশের জনগণও নিয়মিত জ্ঞান পায় এবং আলোকিত হয় সে গণসংসদের আলোচনা থেকে।

 

নিষিদ্ধ জনগণের সংসদ

তাই গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ ও সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশব্যাপী বিস্তৃত উম্মুক্ত সংসদ। এ গণসংসদের আলোচনায় অংশ নেয় দেশের নীরব মেজোরিটি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ প্রসেফর, জ্ঞানসাধক বুদ্ধিজীবী, বিখ্যাত আলেম বা চিন্তাবিদদের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সামর্থ্য থাকে না। ফলে সংসদে প্রবেশ করে নিজের অভিমত ব্যক্ত করার দ্বার তাদের জন্য বন্ধ। তারা কথা বলেন উম্মুক্ত সংসদে। সংসদীয় নির্বাচনে জিতলে হলে তো চাই, দলীয় টিকেট। ময়দানে চাই, দলীয় ক্যাডার। দলীয় টিকিট ও দলীয় ক্যাডারদের সহযোগিতা পেতে হলে চাই, দল ও দলীয় নেতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। চাই, সদা ভাঁড় হওয়ার সামর্থ্য। সে সামর্থ্য জ্ঞান-তাপসদের থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের কল্যাণে তাদের সুচিন্তিত অভিমতগুলিকে কি অবহেলা করা যায়? সেটি করলে কি রাষ্ট্র বাঁচে ভয়ানক অকল্যাণ থেকে? তাদের মুখ দিয়ে চিন্তাশীল বিবেক কথা বলে। রাষ্ট্র পরিচালনাকে তাই উন্নততর ও সভ্যতর করার ক্ষেত্রে  নিরপেক্ষ নির্বাচনই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজপথ, ক্লাসরুম, মসজিদ-মাদ্রাসা, রেডিও-টিভি ও পত্রপত্রিকায় মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। স্রেফ নির্বাচনকে যারা গণতন্ত্র বলে -তাদের ভ্রান্তিটি মূলতঃ গণতন্ত্র না বুঝার। দেশের এ মুক্ত সংসদ বন্ধ করলে যেমন গণতন্ত্র বাঁচে না, তেমনি জনগণের স্বাধীনতাও বাঁচে না। দায়িত্বশীল ও জনকল্যাণশীল সরকারের দায়িত্ব তাই স্রেফ স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়, বরং চিন্তা-ভাবনা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং জনগণের সংসদ থেকে উত্থিত পরামর্শগুলো গ্রহণ করা। গণতান্ত্রিক রাজনীতির এখানেই প্রকৃত কল্যাণ। এতে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্টতা বাড়ে জনগণের। এবং সে সাথে সরকারের উপর আস্থা বাড়ে জনগণেরও।

সংসদের বাইরের মুক্ত সংসদের গুরুত্বটি অন্য দিক দিয়েও অপরিসীম। পার্লামেন্টের বাইরে যারা দেশ, সমাজ ও জনগণের কল্যাণ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তারা যেমন সরকার পক্ষের হতে পারে, তেমনি বিপক্ষেরও হতে পারে। যেসব দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪টির অধিক, সেসব দেশে ক্ষমতায় যেতে শতকরা ৩৫ ভাগের বেশী ভোটারের ভোট লাগে না। বাংলাদেশে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ এ দুটি বড় দলের কারোই দলীয় ভোটারদের সংখ্যা শতকরা ৩৩-৩৫ ভাগের বেশী নয়। ফলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা প্রতিনিধিত্ব করে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের। অথচ ক্ষমতাসীন দলের বাইরে থাকে বাঁকি ৬০% বা ৬৫% ভাগ ভোট। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বক্তব্য ধ্বনিত হয় পার্লামেন্টের বাইরে বসা জনগণের মুক্ত সংসদে। সেটি পত্র-পত্রিকা, মিটিং-মিছিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে। ফলে তাদের মতামত অগ্রাহ্য করলে মারা পড়ে গণতন্ত্র। তখন প্রতিষ্ঠা পায় নিরেট স্বৈরতন্ত্র। বাস্তবতা হলো,স্বৈরাচারী সরকার যেমন ভোট-ডাকাতির মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করে, তেমনি মতপ্রকাশের অধীকার কেড়ে নিয়ে অকার্যকর করে জনগণের মুক্ত সংসদকেও।স্বৈরাচারী সরকারের এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা। অবিকল সেটিই ঘটেছে বাংলাদেশে –সেটি যেমন হয়েছে মুজিবের বাকশালী স্বৈরাচারে, তেমনি এরশাদ ও মঈনের সামরিক স্বৈরাচারে।

 

অপরাধটি ভয়ানক নাশকতার

পত্র-পত্রিকা, রাজপথ, জনসভা বা ক্লাসরুমে যারা নিজ নিজ বিবেকের প্রতিধ্বনি ঘটায় কোন স্বৈরশাসকই তাদের সহ্য করে না। কারণ, তারা জানে বিবেকের স্বাধীনতায় স্বৈরাচার বাঁচেনা। বিবেকমান স্বাধীন মানুষদের নীরব করে দেয়াটি এজন্যই বিশ্বের সকলস্বৈরাচারী শাসকদের মূল এজেন্ডা। তাইস্বৈরাচারী শাসকদের হাতে  ঘটে নৃশংস নাশকতা। তাদের হাতে বিপুল হারে শুধু বিবেকহত্যাই হয়না, গণহত্যাও হয়। এজন্যই যেদেশস্বৈরাচারী শাসকের হাতে অধিকৃত হয়, সেদেশে বিরোধীদের বিরুদ্ধে গুম, খুন, ফাঁসি ও নির্যাতনের অপরাধও ব্যাপক আকার ধারণ করে। দেশের প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আদালত তখন শাসকের আজ্ঞাবহ  দাসে পরিণত হয়। বাংলাদেশ তাই ২০১৩ সালে শাপলা চত্ত্বরের ন্যায় গণহত্যা যেমন ঘটেছে, তেমনি মুজিবামলে বিচার-বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে ৩০ হাজারের বেশী মানুষ। একই কারণে প্রখ্যাত কলামিস্ট জামাল খাসোগীকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ডেকে নিয়ে সৌদি সরকারের সন্ত্রাসীগণ শুধু হত্যাই করেনি, হত্যা করে তার লাশকে টুকরো টুকরো করে এসিডে ঢেলে গায়েব করে দিয়েছে। নৃশংসতায় এতটাই বর্বর যে মৃত্যুর পর সামান্যতম পাওনা নামাযে জানাজাও তারা জন্য বরাদ্দ করেনি। এরাই আবার নিজেদেরকে মক্কা ও মদিনার ন্যায় পবিত্র স্থানের খাদেম বলে দাবি করে?

স্বৈরশাসকের আচরণ বাংলাদেশে কি কম নৃশংস ও ভয়ানক? একই রূপ নৃশংসতায় বাংলাদেশেও বহু নেতাকে যেমন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে, তেমনি বহু ইলিয়াস আলীকেও গায়েব করে দেয়া হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, দেশ স্বৈরচারিদের হাতে অধিকৃত হবে এবং এরূপ নৃশংসতা আসবে না -সেটিই বা কীরূপে ভাবা যায়? জনপদে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ঢুকলে সে জন্তুদের পেটে অনেককেই গায়েব হয়ে হতে হয়। সেটিই নিয়ম। তেমনিস্বৈরাচারী শাসকের হাতে কোন দেশ অধিকৃত হলে সে দেশের অসংখ্য মানুষকে গায়েব হতে হয় স্বৈর-শাসকের পেটে। বাংলাদেশে সেটি যেমন মুজিব আমলে হয়েছে, এখন হাসিনার আমলেও হচ্ছে। এজন্যই সভ্য মানুষেরা জনপদ থেকে শুধু হিংস্র জন্তু-জানোয়ারকেই তাড়ায় না, রাষ্ট্রের বুক থেকে স্বৈরাচারও নির্মূল করে। বস্তুতঃ এর মধ্যেই সভ্য মানুষের রুচিশীলতা। এজন্যই মানব জাতির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও গর্বের ইতিহাস হলো,স্বৈরাচারী শাসকের নির্মূল ও গণতান্ত্রিক সমাজের নির্মাণ। এবং অপমান, ভীরুতা ও নীচুতার ইতিহাস হলো, স্বৈর-শাসকের কাছে আত্মসমর্পণের। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের হাতে সে অপমানের ইতিহাসই নির্মিত হচ্ছে বিগত এক যুগ ধরে। পরিতাপের বিষয় হলো, বিরোধী দলগুলির পক্ষ থেকে প্রহসনের এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বৈরশাসকের নৃশংস অসভ্যতাকে ন্যায্যতা ও বৈধতা দেয়ার চেষ্টাও হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথে বাধা শুধু নৃশংস স্বৈর-শাসক নয়। প্রজ্ঞাহীন কিছু বিরোধী দলও। স্বৈরশাসকের পক্ষ থেকে কলা ঝুলালেই তারা সেদিকে দ্রুত ছুটে। তারা ভেবে দেখে না, হিংস্রপশু-কবলিত গহীন জঙ্গলের পেটে কিছু বিল্ডিং ও কিছু রাস্তা নির্মাণ করলেই সেখানে নিরাপদ সমাজ গড়ে উঠে না। তেমনি স্বৈরাচার-কবলিত দেশে কিছু রাস্তাঘাট, কিছু ইমারত, কিছু কলকারখানা এবং ৫ বছর পর পর প্রহসনের নির্বাচন হলেই সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয় না।

সভ্যতর রাষ্ট্র নির্মাণে জরুরী হলো, মানুষরূপী হিংস্র পশুদের নির্মূল ও বিবেকমান মানুষদের অবাধে বাড়তে দেয়া। পবিত্র কোর’আনের ভাষায় তা হলো, “আ’মিরু বিল মারুফ ওয়া নেহী  আনিল মুনকার” অর্থাৎ “অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা”। এটিই মুসলিম-জীবনের মূল মিশন। এমন মিশনের কারণেই মহান আল্লাহতায়ালা সমগর মানব জাতির মাঝে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ মানবের মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ এমন মিশন নিয়ে বাঁচে না। সারা জীবন নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত আদায় করেও যদি সে মিশনে অংশ নেয়ার সামর্থ্য গড়ে না উঠে -তবে বুঝতে হবে মুসলিম হওয়ার যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। এমন ব্যক্তি মুখে মুসলিম হওয়ার দাবি করলেও বুঝতে হবে সেটি তার মুনাফিকী। প্রতিদেশেস্বৈরাচারী শাসকগণ এদের মধ্য থেকেই অনুগত সৈনিক পায়। নইলে শাপলা চত্ত্বের গণহত্যা ও ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ড কি কোন মুসলিম সৈনিককে দিয়ে করানো যেত?

স্বৈরতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে রাজা-বাদশাহদের ন্যায় স্বৈরশাসক হওয়া যায়, কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চার পথে প্রকাণ্ড বাধা হলো এরূপ স্বৈর-চেতনা। এটি জরুরী নয়, প্রত্যেক নাগরিককে সরকারি দলে বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে হবে। সেটি সম্ভব দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গুণটি হলো, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের জন্য বিস্তৃত স্থান ছেড়ে দেয়। এভাবে নির্দলীয় ব্যক্তিদের জন্যও সুযোগ করে দেয় দেশের কল্যাণে সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখার। সেটি হতে পারে কথা, কর্ম ও লেখনীর মাধ্যমে। বস্তুতঃ এমন জ্ঞানবান ব্যক্তিরাই তো দেশবাসীর সামনে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রাখে এবং দেশবাসীকে অবিরাম পথ দেখায়। যে দেশে এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা অধিক সে দেশ দ্রুত সামনে এগুয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা বিলেতের ন্যায় শিল্পোন্নত দেশগুলির অধিকাংশ সৃষ্টিশীল মানুষগুলি তো এরূপ নির্দলীয় গোত্রের। অথচ স্বৈরশাসকদের কাজ জ্ঞানের সে মশালগুলো নিভিয়ে দেয়া। কারণ, চুরি-ডাকাতি ও নানারূপ অপরাধের জন্য প্রয়োজন পড়ে অন্ধকারের।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিমগণ তখনই সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল যখন তাদের মাঝে কোনরূপ রাজনৈতিক, মজহাবগত বা ফেরকাগত দলের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল না ভাষা, বর্ণ, অঞ্চলের নামে কোন দল। পরবর্তীকালে দলের সংখ্যা বেড়েছে এবং বেড়েছে রাষ্ট্রের উপর সে সব দলের নিরংকুশ অধিকৃতিও। স্বৈরশাসকদের সে অধিকৃতির কারণে রাষ্ট্রের অঙ্গন থেকে জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ দূরে হঠতে বাধ্য হয়েছেন। মানব সমাজের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নেক কর্ম হলো জ্ঞান বিতরণ। মানব উন্নোয়নের এটিই হলো মূল চাবি। পৃথিবীপৃষ্টে সে জ্ঞান হলো শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিনতাই হলে সমাজে সে নেক কর্মের অবসান ঘটে। দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ তখন বঞ্চিত হয় দেশ-সেবার মহত্তর কাজে সংশ্লিষ্ট হতে। তখন দেশে বাড়ে অজ্ঞতার অন্ধকার। রাষ্ট্রের উপর থেকে তখন বিলুপ্ত হয় চরিত্রবান, প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানবান দেশপ্রেমিকদের নিয়ন্ত্রণ। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র তখন কবরে যেতে বাধ্য হয়। তখন রাষ্ট্রের উপর প্রবলতর হয় স্বৈরাচারী শাসকের নৃশংসতা। এটিই হলো স্বৈরতন্ত্রের সবচেয়ে ভয়ংকর নাশকতা। বাংলাদেশ আজ সে নাশকতারই শিকার।

 

স্বৈরশাসকের এজেন্ডাঃ নির্বাচনি বিজয় ও বৈধতা অর্জন

দীর্ঘ ৫ বছর পর নির্বাচন আসে মাত্র একদিনের জন্য। কিন্তু ৫ বছর মেয়াদের বাঁকি দিনগুলি যদি কাটে স্বাধীনতাহীন নৃশংস দুঃশাসনে, তখন কি সে নির্বাচনের কোন মূল্য থাকে? তেমন একটি নির্বাচনকে কি গণতন্ত্রের অংশ বলা যায়? স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিয়েত কখনোই স্বৈর-সরকারের থাকে না। তারা চায়, নিজেদের অধীনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে স্বৈরাচারী সরকারের লক্ষ্য হলোঃ যে কোন রূপে বিজয়; এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে বৈধতা অর্জন। বিজয়ের ন্যায় বৈধতাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বৈধতা না থাকলে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। বৈধতা অর্জনের লক্ষ্যে স্বৈর-শাসকগণ তাই প্রয়োজনে বিপুল অর্থ দিয়ে ময়দানে সাঁজানো প্রতিদ্বন্দি নামায়। সে লক্ষ্য পূরণে জেনারেল এরশাদ প্রথমে জাসদকে ও পরবর্তীতে শেখ হাসিনাকে নামিয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের গায়ে গণতন্ত্রের কসমেটিক লাগাতে এরা কাজ করেছিল গৃহপালিত বিরোধী দল রূপে। সে কৌশলটি এখন স্বৈরশাসক হাসিনারও। পূর্বের ন্যায় এবারের নির্বাচনেও শেখ হাসিনা সাঁজানো প্রতিদ্বন্দিদের মাঠে নামানোর পরিকল্পনা করছে। স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অংশ নিয়ে কোন ভদ্র ও সভ্য মানুষের বিজয় অসম্ভব। তাতে বিপুল ব্যবধানে তাদের পরাজয়ই শুধু বাড়ে। এবং বিজয় বাড়ে একমাত্র স্বৈরচারি অপশক্তির। এজন্যই বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান। হাসিনা সেটি আদালতকে দিয়ে বিলুপ্ত করেছে স্বৈরশাসনকে ফিরিয়ে আনতে। ফলে আবার ফিরে এসেছে প্রহসনের নির্বাচন।

তবে সমস্যা হলো, বাংলাদেশে এরূপ প্রহসনের নির্বাচনের কদরও বিশাল। কারণ দেশে ছোট মন ও ছোট চিন্তার লোকদের সংখ্যাটি বিপুল। নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা যেমন বড় চেয়ারে বসতে চায়, তেমনি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রূপে পরিচিত হতে চায়। ফলে নির্বাচনে বিজয়ের সামান্যতম আশা না থাকলে কি হবে, প্রতিদ্বন্দি রূপে খাড়া হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের পরিচিতিটি বাড়ায়। ফলে নির্বাচন যতই নিয়ন্ত্রিত ও প্রহসনের হোক, এসব ছোট লোকদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখাটি অসম্ভব। পঙ্গপালের  মত ধেয়ে চলে সে নির্বাচনে অংশ নিতে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সে দৌড় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

গণতন্ত্র চর্চা তো তখনই ফায়দা দেয় যখন নির্বাচন ও নির্বাচনে ভোটদানের সাথে অধীক গুরুত্বপূর্ণ গণ্য হয় প্রতিদিনের বাক-স্বাধীনতা, লেখালেখী ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে জনগণ পায় প্রতিদিন ও প্রতিমুহুর্তে স্বাধীন ভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সেটি যেমন পায় সরকারি দলের সদস্যরা, তেমনি পায় নির্দলীয় ও বিরোধী দলের সদস্যগন। সবারই এখানে সম-অধিকার, কারো কোন বাড়তি অধিকার থাকে না। এমন পরিবেশে সরকারি দল লাভবান হয়, বিরোধীদলীয় ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের পরামর্শগুলি গ্রহণ করে। কিন্তু জনগণের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত যদি কাটে স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে, তখন বিলুপ্ত হয় সৃষ্টিশীল মানুষদের চিন্তাভাবনা ও সৃষ্টির সামর্থ্য। স্বৈর-শাসনের বিশাল নাশকতা ঘটে বস্তুতঃ এ অঙ্গণে।

 

পরাধীনতার নাশকতা

পরাধীনতা সব সময়ই দেশবাসীর জীবনে পঙ্গুত্ব ও বন্ধাত্ব আনে। অপরদিকে স্বাধীনতা বিস্ফোরণ ঘটায় প্রতিভা ও শক্তির। জনগণের জীবনে সে পরাধীনতাটি আনে যেমন বিদেশী লুটেরা শাসক, তেমনি দেশী স্বৈরশাসক। ব্যক্তিজীবনে সে পরাধীনতা হলো গণতান্ত্রিক অধিকারের বিলুপ্তি। সেটিই তো স্বৈরশাসকদের এজেন্ডা। ফলে দেশবাসীর বিরুদ্ধে নাশকতায় বিদেশী শাসক ও দেশী স্বৈরশাসক -উভয়ই সম-অপরাধী। অথচ সৃষ্টিশীল চিন্তা-ভাবনা ও আবিস্কারের ক্ষমতায় বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে যদি জনগণকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। ব্রিটিশদের জীবনে সে সৃজনশীল বিপ্লবটি তখন এসেছিল যখন রাজার স্বৈরশাসন থেকে তারা মুক্তি লাভ করেছিল। মুক্তির সে লড়াইয়ে ১৬৪৯ সালে তারা রাজা চার্লস-প্রথম’য়ের শিরোচ্ছেদ করেছিল। এরপর থেকে রাজা স্রেফ নামেমাত্র রাজায় পরিণত হয়। ব্রিটিশদের সৃজনশীল সে স্বাধীনতারই প্রমান, মাত্র সাড়ে ছয় কোটি মানুষের দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশী পুস্তক রপ্তানী করে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশ, যুক্তরাজ্য বিদেশে বছরে ৩.৪ বিলিয়ন পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বই রপ্তানি করে। অথচ ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ সবকিছু মিলিয়ে রপ্তানি করে ৩৬.৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের দুর্গতির বড় কারণ, স্বৈর-সরকারের নিয়ন্ত্রণটি শুধু ভোটদানের উপর নয়, চিন্তাভাবনা ও সৃজনশীলতার উপরও। আর সেটি ধরা পড়ে পত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে। বিলেতে বই ছাপাতে বা পত্রিকা প্রকাশে সরকার থেকে কোন অনুমতি লাগে না। অথচ বাংলাদেশে অতি দুরুহ ব্যাপার হলো সরকার থেকে পত্রিকা বা বই প্রকাশনার অনুমতি পাওয়া। ফলে জনসংখ্যায় তিনগুণ হলে কি হবে, গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায় বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকা ও পুস্তকের প্রকাশনা ৫০০ ভাগের একভাগও হবে না। বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে বাংলাদেশীদের ব্যর্থতাটি এভাবেই প্রবল ভাবে ধরা পড়ে। অথচ দেশের উন্নয়নে মূল ইঞ্জিনটি হলো দেশবাসীর বুদ্ধিবৃত্তিক বল; দেহের বল নয়। খনিজ বা কৃষি সম্পদও নয়। অথচ সেটিই সবচেয়ে বেশী নিয়ন্ত্রিত হয় বা মারা পড়ে স্বৈরশাসনে। প্রাথমিক যুগের মুষ্টিমেয় মুসলিমগণ যেরূপ দ্রুত সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভুত হয়েছিল তার কারণটি হলো, জনগণের ব্যক্তিস্বাধিনতায় আমূল বিপ্লব এসেছিল। তাতে জনগণের জীবনে এসেছিল প্রচণ্ড ক্ষমতায়ন। তখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষও প্রকাণ্ড একটি দেশদখলে বের হতো। বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মাত্র ১৭ জন সৈনিক দখল করেছিল বাংলাদেশ। তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র এক বাহিনী দখল করেছিল স্পেন। সাহাবাদের আমলে ক্ষমতায়নের প্রমাণ, একজন সাধারণ মুসল্লি জুম্মার নামাযে খোতবা দিতে দণ্ডায়মান খলিফা উমর (রাঃ)কে অতি নির্ভয়ে প্রশ্ন করেন, আপনার গায়ে ডবল সাইজের জামা কীরূপে এলো? কোথা থেকে পেলেন বাড়তি কাপড়? খলিফাকে সে প্রশ্নের কৈফিয়ত দিয়ে খোতবা দিয়ে হয়েছে। অথচ খলিফা উমর (রাঃ) ছিলেন বাংলাদেশের চেয় প্রায় ৫০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের শাসক। ব্যক্তির ক্ষমতায়নের এরূপ উদাহরণ সমগ্র মানব ইতিহাসের আর কোথাও কি নজরে পড়ে?

নিয়ন্ত্রনহীন ব্যক্তি-স্বাধীনতার ফলে সেকালে বিশাল বিপ্লব এসেছিল মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিতে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরবী ভাষায় গড়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার। অন্য যে কোন ভাষার তুলনায় আরবী ভাষা তখন দ্রুত সামনে এগিয়ে যায়। অথচ পবিত্র কোরআনের পূর্বে আরবী ভাষায় কোন কিতাবই ছিল না; ছিল স্রেফ কবিতা ও কাসিদা। জ্ঞানের ভাণ্ডারে সমৃদ্ধি এলে উন্নত হয় যেমন শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসন, তেমনি সমৃদ্ধ হয় রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও অর্থনীতি। তখন দ্রুত বাড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিও। মুসলিমদের হাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম হয়েছিল তো এ পথেই। অথচ স্বৈরাচারী শাসকের হাতে দেশ অধিকৃত হলে ঘটে উল্টোটি। নিজেদের স্বৈরশাসন বাঁচাতে তারা শক্তিহীন করে দেশবাসীকে। জনগণের শক্তিকে তারা ভয় পায় এবং তাদের দুর্বলতার মধ্যেই তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।

প্রশ্ন হলো, জনগণকে শক্তিহীন করলে কি দেশের স্বাধীনতা বাঁচে? তখন শক্তিহীন ও পরাধীন হয় দেশ। ফলে স্বৈরশাসকগণ জনগণের জীবনে শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পঙ্গুত্বই আনে না, বরং দেশকে বিদেশের গোলামে পরিণত করে। বাস্তবতা হলো, সে গোলামীই চেপে বসেছে বাংলাদেশীদের ঘাড়ে। তারই প্রমাণ, এক কোটি কাশ্মীরীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে যেখানে  ভারতকে ৬ লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করতে হয়; অথচ ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে পরাধীন ও পদানত রাখতে ভারতে একটি গুলিও ছুড়তে হয়না। খাঁচায় আবদ্ধ জীবকে পাহারা দিতে হয় না। দীর্ঘকাল খাঁচায় রাখলে সে বদ্ধ জীব স্বাধীনতার স্বাদ হারিয়ে ফেলে; ফলে খাঁচার দরজা খুলে দিলেও আর বেরুতে চায় না। ভারতের জন্য তেমন একটি সুবিধাজনক অবস্থা খাঁচায় আবদ্ধ বাংলাদেশ নিয়ে। শেখ হাসিনা পরিণত হয়েছে এ খাঁচার পাহারাদারে। মুজিব তেমন একটি ভূমিকা পালনের জন্যই ভারতের সাথে ২৫ সালা চুক্তি করেছিলেন।

পরাধীনতার আলামতগুলি এখন আর গোপন বিষয় নয়। ভারতভূমির মধ্য দিয়ে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক যেমন কলকাতা বা মোম্বাই যায়, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তেমনি আগরতলা ও চট্রগ্রামে যায়। অথচ একাত্তরের আগে এটি অভাবনীয় ছিল। শুধু তাই নয়, ভারতীয় নেতাদের দরজায় ধর্ণা দিতে শুধু সরকার-দলীয় নেতাগণই নয়, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারাও দল বেঁধে দিল্লিতে গিয়ে হাজির হয়। আগামী নির্বাচন কীরূপ হবে এবং বিরোধী দলকে কতটা ছাড় দেয়া হবে –সে বিষয়গুলি জানার জন্য তাদেরকে চেয়ে থাকতে হয় দিল্লির শাসকমহলের দিকে। হাসিনা নিজেও ক্ষমতায় টিকে আছে ভারতের দেয়া লাগাতর লাইফ সাপোর্টে। প্রশ্ন হলো, কোন স্বাধীন দেশে কি কখনো এমনটি হয়? একাত্তরের আগে এদেশের মাটিতেও কি কখনো এমনটি হয়েছে? প্রশ্ন হলো, এটাই কি একাত্তরের অর্জন? এর নাম কি স্বাধীনতা? এটিকে স্বাধীনতা বললে পরাধীনতা কাকে বলে? ৩/১১/২০১৮ Tweet:@drfmkamal; facebook.com/firozkamal.58

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *