শত্রুশক্তির সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং বাঙালি মুসলিমের পরাজয়
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on June 17, 2023
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
প্রবল যুদ্ধটি সাংস্কৃতিক অঙ্গণে
সশস্ত্র যুদ্ধে মাঝে মধ্যে বিরতি থাকলেও শত্রুর পক্ষ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধটি চলে অবিরাম। তেমনি একটি যুদ্ধের কবলে বাঙালি মুসলিমগণ। এমন যুদ্ধে শত্রুর মূল লক্ষ্য হলো, মুসলিমদের প্রকৃত মুসলিম রূপে বাঁচাকে অসম্ভব করা। তেমন একটি লক্ষ্যকে সামনে বাংলাদেশে ইসলামের উপর জঘন্যতম হামলাগুলি আসছে শয়তানের অনুসারী সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মীদের পক্ষ থেকে। মৌলবাদ নির্মূল করার নামে এরাই ইসলামকে নির্মূ ল করতে চায়। তারা নির্মূল বা দুর্বল করতে চায় ইসলামের দর্শন, রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে। চলমান সাংস্কৃতিক যুদ্ধে শত্রুশক্তির বিজয় ও অর্জনটি বিশাল। এবং বাঙালি মুসলিমের পরাজয়টি ভয়াবহ।
ইসলাম থেকে কে কতটা দূরে সরলো সেটি সুস্পষ্ট দেখা যায় পাপাচার তথা দুর্বৃত্তির বিজয় দেখে। ইসলামের পথে চলার অর্থ সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা। এ পথটি নেক কর্ম, সততা, সুবিচার ও প্রতিক্ষণ আল্লাহতায়ালার ভয় তথা তাকওয়া নিয়ে বাঁচার। একমাত্র এ পথটিই হলো জান্নাতের। অপর দিকে ইসলাম থেকে দূরে সরার অর্থ অবিচার, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, সন্ত্রাস তথা দুর্বৃত্তির পথে চলা। এ পথটি নিশ্চিত জাহান্নামের। বিশাল বিজয়টি এখানে শয়তানের। এ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করে রেকর্ড গড়ে প্রণ করেছে এ দেশটিতে শয়তানী শক্তির বিজয় কতটা বিশাল। এবং বাঙালি মুসলিমের পরাজয় কত ভয়ানক।
শয়তানী শক্তির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য, মুসলিম সন্তানদের পূর্ণ মুসলিম রূপে তথা নবীজী (সা:)’র প্রবর্তিত মৌল ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠাকে বন্ধ করা। সে জন্য চায়, মুসলিমের চেতনার ভূমিতে ঈমাননাশী বিষাক্ত দর্শনের বীজ-রোপন। সে বিষাক্ত বিষ হলো সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম, জাতীয়তাবাদ ও হিডোনিজম তথা ভোগবাদ। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির রণাঙ্গণে শয়তানের বাহিনীটি বিশাল। তাদের দখলে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ফ্রন্টিয়ার অনেক। যুদ্ধ চলছে বুদ্ধিবৃ্ত্তি, পত্র-পত্রিকা, টিভি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অঙ্গণে। বাংলাদেশে যত বই লেখা হয়, তার প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগের বইয়ের লেখক তারাই। এগুলি তাদের অস্ত্র। আলেমগণ মাসলা-মাসায়েলের উপর কিছু বই লিখছেন। কিন্তু আক্বলের প্রয়োগ তথা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চাতে তারা নাই। সে ময়দানটি শয়তানী শিবিরের দখলে। দেশে যত পত্র-পত্রিকা ও টিভি নেটওয়ার্ক তার প্রায় সবগুলোর মালিক তারাই। তাদের লাউড স্পিকার ও টিভি স্ক্রিন এখন দেশবাসীর শয়ন কক্ষে। সেগুলো কাজ করে দিবারাত্র।
বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে ইসলাম যেভাবে পরাজিত এবং শরিয়তের বিধান যেরূপে বিলুপ্ত –সেটি কোন অস্ত্রের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে হয়নি। সেটি ঘটেছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে পরাজয়ে। সে পরাজয়ের ফলে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে প্লাবন এসেছে ইসলাম-বিরোধী সেক্যুলার ভোগবাদী সংস্কৃতির। বর্ষবরণ, বসন্তবরণ, ভালবাসা দিবসের নামে প্রতিবছর সেটি দেখা যায় ঢাকার রাজপথে। সে সাথে প্লাবন এসেছে দুর্বৃত্তিরও।
শত্রুর বিজয়ে পাল্টে গেছে বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নের জগতও। মুসলিম মাত্রই স্বপ্ন দেখে ইসলামী বিধানের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বমাঝে মুসলিমের শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি নিয়ে। এরূপ স্বপ্নের মধ্যেই তো মুসলিমের ঈমান দেখা যায। কিন্তু সেরূপ স্বপ্ন বাঙালি মুসলিমগণ দেখে না। তাদের স্বপ্ন একমাত্র বাঙালি রূপে বেড়ে উঠা নিয়ে এবং সেটি হিন্দুত্ববাদী ভারতের হাত ধরে। সেখানে ইসলামের কোন স্থান নাই। মুসলিম ইতিহাসের যারা হিরো, তারা তাদের কাছে ভিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসন থেকে যে মুসলিম বীর ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি মুক্তি দিয়েছিলেন, তাদের কাছে তিনি বিদেশী আক্রমণকারী। তাদের বিপুল গর্ব ও উৎসব বরং ভারতীয় হিন্দুদের বিজয় এবং মুসলিমের বিভক্তি ও শক্তিহানী নিয়ে। হিন্দুত্ববাদীদের গলাজড়িয়ে বাঙালি মুসলিম জীবনে সেরূপ একটি বিজয় উৎসব দেখা গেছে ১৯৭১’য়ের ১৬ই ডিসেম্বরে। বহু বাঙালি মুসলিমের জীবনে আজও সেটি সর্বোচ্চ গর্বের। এবং এটিই প্রমাণ করে, তারা কতটা দূরে সরেছে নবীজী (সা:)’র প্রবর্তিত ইসলাম থেকে।
সাংস্কৃতিক যুদ্ধের নাশকতা
শত্রুর সংস্কৃতি কী রূপে আগ্রাসী হয়? এবং কী রূপে পরিচালিত হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন? সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নাশকতাই বা কী? বাস্তবতা হলো, সামরিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের চেয়েও অধিক আগ্রাসী হতে পারে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। নিছক সামরিক আগ্রাসনে লুন্ঠিত হয় দেশের সম্পদ, নিহত হয় নারী-পুরুষ এবং বিধ্বস্ত হয় নগর-বন্দর। কিন্তু যুদ্ধটি যদি শুধুমাত্র রণাঙ্গণে সীমিত থাকে তবে জনগণের নিজ ধর্ম ও নিজ সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচা ও বেড়ে উঠাটি পুরোপুরি মারা পড়ে না। এটি কোন গৃহে ডাকাত পড়ার মত। ডাকাতগণ অর্থলুট নিয়েই খুশি হয়। কিন্তু শয়তান শুধু অর্থলুট বা ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা নিয়ে খুশি নয়। শয়তান ও তার অনুসারিদের প্রজেক্ট তো মানব সন্তানদের জাহান্নামে নেয়া। তাই সামরিক আগ্রাসনে শয়তানের প্রজেক্ট শেষ হয়না। সামরিক বিজয়ের পর শয়তানী শক্তি এগোয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে। তখন বিলুপ্ত হয় বা দূষিত হয় একটি জাতির বিপুল সংখ্যক মানুষের ঈমান-আক্বিদা ও নীতি-নৈতিকতা। এভাবেই মানুষ অযোগ্য হয় জান্নাতের জন্য এবং প্রস্তুত করে জাহান্নামের জন্য। এজন্যই শয়তানী শক্তির বিশাল বিনিয়োগটি সাংস্কৃতিক অঙ্গণে। সাংস্কৃতিক সে আগ্রাসনে দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্র-পত্রিকা, টিভি কেন্দ্রগুলো ব্যবহৃত হয় শয়তানের সৈনিকদের ঘাঁটি রূপ। ঔপনিবেশিক ইংরেজগণ একই লক্ষ্যে এরূপ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়েছিল। বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে লাগাতর হামলা হচ্ছে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত সে ঘাঁটিগুলো থেকেই।
ব্যক্তির অমূল্য সম্পদটি হলো তার আদর্শিক বা নৈতিক সম্পদ। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে একমাত্র এই সম্পদই মূল্য পায়; সে হিসাব-নিকাশে দৈহিক বল, অর্থ সম্পদ ও পেশাদারী যোগ্যতা গুরুত্ব পায় না। ব্যক্তির মুসলিম পরিচয়টিও মূলত তাঁর একটি আদর্শিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পরিচয় বহনকারী সাইনবোর্ড। ঈমানদারের সে আদর্শ বা নীতি হলো মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে বাঁচার। ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ অন্যরাও করে। কিন্তু একজন মুসলিমকে প্রতিক্ষণ বাঁচতে হয় তাঁর মুসলিম পরিচয়টি নিয়ে। সে পরিচয়টি মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের। কোন রূপ বিদ্রোহ কাফিরে পরিণত করে। মুসলিমগণ অতীতে গৌরবময় যে সভ্যতা গড়েছিল সেটির মূলে জনবল বা সম্পদের বল ছিল না। সেটির মূলে ছিল তাদের আদর্শিক বা নৈতিক বল। এবং সেটি তারা পেয়েছিল পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান, নবীজী (সা:)’য়ের শিক্ষা ও মসজিদ-মাদ্রাসার ন্যায় সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে। কিন্তু অপসংস্কৃতির জোয়ারের বিপদটি হলো, তাতে বিলুপ্ত করা হয় সে জ্ঞান দানের প্রক্রিয়া এবং বিধ্বস্ত হয় মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি।
পুকুর থেকে পানি সরিয়ে নিলে কোন মাছই সেখানে বেঁচে থাকে না। তেমনি কুর’আনী জ্ঞানদান এবং মসজিদ-মাদ্রাসা অচল করে দিলে এমন মুসলিম পরিবারের সন্তানদের পক্ষে ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠাও বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে। ঈমান ধ্বংসের অনুরূপ কাজটি সোভিয়েত রাশিয়া এবং চীনেও হয়েছে। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মিত হলেও জনগণের মাঝে পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানদানের কাজটি হচ্ছে না। কুর’আন শিক্ষার কাজটি স্রেফ না বুঝে তেলাওয়াতের মাঝে সীমিত রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের মসজিদগুলো নবীজী (সা:)’র হাতে গড়া মদিনার মসজিদের আদর্শ নিয়ে বেঁচে নাই। নবীজী (সা:)’র আমলে কোন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। মুসলিম ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তিগণ গড়ে উঠেছেন মসজিদ-ভিত্তিক সে মাদ্রাসা থেকে। সে মাদ্রাসার সার্বক্ষণিক শিক্ষক ছিলেন নবীজী (সা)’র ন্যায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মসজিদের মেঝে কখনোই মুসল্লীশূণ্য থাকতো না। কিন্তু সে জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জনের সূন্নত বিলুপ্ত হয়েছে আজকের মসজিদ থেকে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ন্যায় মহান আল্লাহতায়ালার এই পবিত্র ঘরও অধিকৃত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের হাতে যারা ইসলামের বিজয় নিয়ে ভাবে না। ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠায় তাদের জীবনে বেজায় ফাঁকিবাজী রয়ে গেছে। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচার বদলে তারা বাঁচে নিজ দল ও নিজ ফেরকার এজেন্ডা নিয়ে। সেরূপ ফাঁকিবাজীর কারণেই তারা দুবৃত্তি নির্মূলের জিহাদে নাই। বরং বিশ্ব রেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে। দেশের কোনে কোনে গড়ে তুলেছে পতিতা পল্লী, ক্লাব, ক্যাসিনা, সিনেমা হল, সেক্যুলার রাজনৈতিক দল, মিডিয়া নেট ওয়ার্ক, সূদী ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান, নাচের ঘর -এরূপ শয়তানের খলিফা উৎপাদনের ইন্ডাস্ট্রি। এগুলির নাশকতা বুঝা যায় দেশে চোর-ডাকাত, খুনি, ধর্ষক, ব্যভিচারি ও সন্ত্রাসীদের বিপুল উৎপাদন দেখে। এরূপ ফাঁকিবাজীর কারণেই বাংলাদেশের জনগণ বাঁচছে স্রেফ মুসলিম নাম নিয়ে, মুসলিমের চরিত্র ও ইসলামের এজেন্ডা নিয়ে নয়।
ইসলামের সাংস্কৃতিক এজেন্ডা এবং বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতা
জিহাদের রণাঙ্গনে যেমন অস্ত্রধারী যোদ্ধা চাই, তেমনি ইসলামী সংস্কৃতির নির্মাণে ও পরিচর্যার জন্য চাই বিপুল সংখ্যক প্রজ্ঞাবান যোদ্ধার। চাই, ইসলামী প্রতিষ্ঠান। চাই, কুর’আনী জ্ঞানের গভীরতা। ইসলামী সংস্কৃতি নির্মিত হয় মুসলিম পরিবারে, মহল্লায়, স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মাদ্রাসায়। সংস্কৃতির নির্মাণে এ প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই নতুন প্রজন্ম ভাল-মন্দ, শিষ্ঠ-অশিষ্ঠ, পাপ-পূণ্য এবং শ্লীল-অশ্লিল বুঝতে পারে। এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠা উন্নত চরিত্রের মডলগুলোই নীরবে ছেলেমেয়েদের পথ দেখায়। তখন একজন শিশু জানতে পারে, এ জীবনে বাঁচার মূল লক্ষ্যটি কি? শেখে, কি ভাবে সে লক্ষ্যে বাঁচতে হয়? শেখে, বড়দের কিভাবে সমীহ করে চলতে হয়? শেখে, অতিথিকে কিভাবে স্বাগত জানাতে হয় এবং কিভাবে বিদায় জানাতে হয়? এরূপ শিষ্ঠাচার শিখতে স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। কিন্তু আগ্রাসী অপসংস্কৃতির ধারকগণ ইসলামী সংস্কৃতির এরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বিনষ্ট করে দেয় এবং পাল্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে সংস্কৃতির অঙ্গণে তাদের নিজেদের ধারাকে প্রতিষ্ঠা দিতে। বাংলাদেশে সে শয়তানী ধারাটি এতোটাই বিজয়ী যে কাউকে দেখে “আসসালামু আলাইকুম” বলার ইসলামের অতি মৌলিক রীতিও বহু মুসলিমের জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। বিদায় নিয়েছে মিছিল-মিটিংয়ে আল্লাহু আকবর ধ্বনি তোলার সনাতন রেয়াজ।
শত্রুপক্ষের স্ট্রাটেজী ইসলামের মূল বিশ্বাসের উপর হামলা নয়। তারা বরং বিনষ্ট করে ইসলামের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া বা সংস্কৃতিকে। হামলার লক্ষ্য, ইসলামের সাংস্কৃতিক পাওয়ার হাউসগুলোকে বিকল করে দেয়া। বীজকে গজাতে দেওয়ার পর তাকে বেড়ে উঠার সুযোগ না দিলে সেটি নিস্ফল আয়ু পায় মাত্র, ফল দেয় না। মুসলিমের জন্ম বন্ধ করতে না পারলেও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে তারা বন্ধ করেছে। এবং সেটি ইসলামের সাংস্কৃতিক পাওয়ার হাউসকে বিকল করার মধ্য দিয়ে। শত্রুর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এটিই হলো বড় সফলতা। ফলে দেড়শত কোটির অধিক মুসলিম ইসলামের বিজয়ে আজ কোন অবদানই রাখতে পারছে না। এহেন নিস্ফল জীবনের সবচেয়ে জ্বাজল্যমান ও নিকৃষ্টতর উদাহরণ হলো বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম। মানব উন্নয়ন ও সমাজ উন্নয়নের পথে সফল রোডম্যাপ হলো কুর’আন। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের ঘরে সে পবিত্র কুর’আন অক্ষত থাকলেও দেশটি রেকর্ড গড়েছে পশ্চাদপদতায়। ঘিরে ধরেছে ভয়ংকর নৈতিক বিপর্যয়।
পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানই ব্যক্তিকে সত্যিকার মুসলিম বানায়। সে জ্ঞানের বলে জন্ম নেয় সংস্কারপ্রাপ্ত একটি বিশুদ্ধ মন। পবিত্র কুর’আন পাকে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা: “ ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা।” অর্থ: “বান্দাদের মধ্য থেকে একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে।” উপরুক্ত এই আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, মহান আল্লাহতায়ালার ভয় কতোটা অর্জিত সেটিই সঠিক পরিমাপ দেয় জ্ঞানের। সে ভয় না থাকলে বুঝতে হবে, অভাবটি জ্ঞানের। তখন বুঝা যায়, অজ্ঞতা কত গভীর। সে ভয়শূণ্যতার সঠিক ধারণা পাওয়া যায় দেশে দুর্নীতির জোয়ার দেখে। মহান আল্লাহতায়ালার ভয় থাকলে জনগণ দুর্নীতি থেকে অবশ্যই দূরে থাকতো। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বহু হাজার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয়েছে। সেগুলিতে যা শেখানো হয় তাতে উপার্জনের সামর্থ্য বাড়লেও মহান আল্লাহতায়ালার ভয় সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে দুর্নীতিও কমছে না। ফলে শিক্ষা খাতের এ বিশাল বিনিয়োগ ব্যয় হচ্ছে দেশের বিপর্যয় বাড়াতে। প্রশ্ন হলো, জীবনের মূল লক্ষ্য কি -তা নিয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক ধারণা টুকুও দেয় না, স্রষ্টা কে এবং কীরূপে তাকে খুশি করা যায় -সেটিও শেখায় না, এবং মৃত্যুহীন ও অন্তহীন পরকালীন জীবনে কীরূপে সফল হওয়া যায় -তা নিয়েও কিছু বলে না –এমন শিক্ষাকে কি আদৌ শিক্ষা বলা যায়? অজ্ঞতার দূরীকরণই তো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এ শিক্ষাব্যবস্থায় তো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই অজানা থেকে যায়।
যে ব্যর্থতা আলেম ও ইসলামপন্থী নেতা-কর্মীদের
অপসংস্কৃতির জোয়ার রোধে ইসলামপন্থীদের যে বিশাল ব্যর্থতা, সে জন্য অলেম ও ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীগণ কি কম দায়ী? রাজনীতির যুদ্ধে তাদের উপস্থিতি কিছুটা দেখা গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধে তারা নাই। তাদের কাছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ গুরুত্ব না পাওয়ায় নিজেরা সাংস্কৃতিক যোদ্ধা রূপে গড়ে উঠেনি। গুরুত্ব পায়নি বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। তারা বরং জোর দিয়েছে রাজনৈতিক ক্যাডার গড়ায়। ক্যাডারদের কাজ হয়েছে, দেয়ালে পোষ্টার লাগানো, মিছিলে যোগ দেয়া, পার্টির জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা এবং নির্বাচনে ভোট সংগ্রহ করা। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে তারা নাই। চিন্তা-ভাবনার জগতেও তারা নাই। কারণ, দলের কর্মী ও ক্যাডার হতে জ্ঞান লাগে না, লাগে দলীয় নেতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং দলের জন্য অর্থ ও ভোট সংগ্রহের সামর্থ্য। দলের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে সেগুলিই শেখানো হয়। অথচ ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো চিন্তা-ভাবনা করা। কিন্তু চিন্তা-ভাবনার সে সামর্থ্য ছাত্র, দলীয় ক্যাডার ও সাধারণ মানুষের মাঝে গড়া হয়নি। ধর্মীয় দলের নেতাগণ মনে করে চিন্তাভাবনার কাজটি শুধু নেতাদের, কর্মীদের নয়। কর্মীদের কাজ শুধু নেতাদের হুকুমের আনুগত্য। চিন্তাভাবনার সামর্থ্যকে বরং দলীয় নেতাদের জন্য হুমকি মনে করা হয়। সেনাবাহিনীর সেপাইরা যেমন চিন্তা-ভাবনার কাজ জেনারেলদের উপর ছেড়ে দেয়, তেমনি অবস্থা ইসলামী দলগুলোর ক্যাডারদের।
একই রূপ চিন্তুাশূণ্যতা ভর করেছে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অনুমতি নাই নিজ নিজ মজহাব ও ফেরকার বাইরের ব্যক্তিদের লেখা কিতাব পাঠের। কোন বই পড়তে হবে এবং কোন বই পড়া যাবে না -তার একটা সীমানা তারা বেঁধে দেয়। অথচ জ্ঞান কোন বিশেষ মজহাব ও বিশেষ ফিরকার মাঝে সীমিত নয়। অন্য মাজহাব ও অন্য ফিরকার বই থেকেও শেখবার বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ওহীর জ্ঞানের বাইরেও পদার্থ বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়েই বহু কিছু শেখার আছে। গৌরব যুগের মুসলিমগণ তাই নানা ভাষায় কাফিরদের লেখা বইও পড়েছেন এবং জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
রাজনৈতিক ও সশস্ত্র যুদ্ধের শুরুটি শূণ্য থেকে হয় না, শুরুটি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণ থেকে। নবীজী (সা:)’র জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের শুরুটি হয় নবুয়তের দায়িত্ব লাভ ও কুর’আন নাজিল শুরু হওয়ার পর থেকে। মক্কার কাফিরদের থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পথ তাঁরা বেছে নেন। মক্কার বুকে ১০ বছর যাবত জুড়ে চলে সে যুদ্ধ। বদর, ওহুদ, খন্দকের ন্যায় সশস্ত্র যুদ্ধগুলি এসেছিল মদিনায় হিজরতের পর। রাজনীতির যুদ্ধে জিততে হলে অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধে জিততে হয়। ইসলামের সাংস্কৃতিক যোদ্ধাগণ ক্ষেত-খামারে গড়ে উঠেনা, সৈনিক গড়ার সে ক্ষেত্রটি হলো ইসলামী শিক্ষাদান ও ইসলামী সংস্কৃতি নির্মাণের প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা ইসলামী আক্বিদা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ্য হয়, একমাত্র তারাই রাজনীতির ময়দানে ইসলামের সৈনিক হয়। তাই নবীজী (সা:)’র জামানা থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সে যুগে মর্যাদা পেয়েছে শুধু অস্ত্রের যুদ্ধের মুজাহিদগণই নয়, বুদ্ধিবৃত্তির যুদ্ধের মুজাহিদগণও।
বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে মূল অস্ত্র হলো বই। যাদের হাতে বই নাই, বুঝতে হবে তারা নিরস্ত্র। ফলে এ রণাঙ্গণে তাদের পরাজয় অনিবার্য। অথচ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত শতকরা ৯০ ভাগের বেশী বইয়ের লেখক হলো, হিন্দু, সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, বামপন্থী ও নাস্তিক চরিত্রের লোক। ইসলামপন্থীরা এ ময়দানে খুব একটি নাই। বড় জোর তারা কিছু ধর্মীয় মাসলা-মাসায়েলের বই লেখেন। ফলে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে বিজয়টিও ইসলামের শত্রুপক্ষের। সে বিজয়ই তাদের রাজনৈতিক বিজয় দিয়েছে। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় ও রাজনৈতিক বিজয় একত্রে চলে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের হাতে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের সবচেয়ে সফল অস্ত্রটি তুলে দিয়েছেন। সেটি হলো পবিত্র কুর’আন। উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুর’আনের পূর্বে আরবী ভাষায় কোন বই ছিল না। সে কুর’আনী জ্ঞান দিয়েই তারা তৎকালীন জামানার মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা আক্বিদা ও মিথ্যা মতবাদের উপর ইসলামকে সহজেই বিজয়ী করতে পেরেছিলেন। তাদের জ্ঞান সাধনার বদৌলতেই আরবী ভাষা তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়।
অথচ আজকের মুসলিমদের মাঝে গৌরব যুগের মুসলিমদের বেশী বেশী বই পড়া ও বেশী বেশী বই লেখার সে অতি গুরুত্বপূর্ণ সূন্নতটি বেঁচে নাই। দেশের অধিকাংশ আলেম এ পথে নাই। তারা কুর’আন তেলাওয়াত করার ন্যায় নফল কাজের উপর তাগিদ দিলেও কুর’আনের বুঝার উপর গুরুত্ব দেয়নি। লেখালেখির উপর তো নয়ই। ইসলামী দলগুলোর নেতাগণও তাদের কর্মীদের জ্ঞানের সাধক তথা বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক বানানো নিয়ে আগ্রহী নন। তাদের নজর কর্মীদের রাজনৈতিক ক্যাডার রূপে গড়ে তোলা নিয়ে। অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ইসলামের শত্রুদের সৈন্য-সংখ্যাটি বিশাল। তারা শুধু রাজনীতির ময়দানে ক্যাডারদের সংখ্যাই বাড়ায়নি, বরং সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ময়দানে বিপুল ভাবে বৃদ্ধি ঘটিয়েছে লড়াকু কলম যোদ্ধার। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে তাদের যে বিজয় -তার কারণ তো এই বিপুল সংখ্যক কলম যোদ্ধা। অবস্থা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীগণ ইসলামের বিজয় নিয়ে তারা ভাবে না। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা ভাবে না। বরং চলমান বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্রোতে কোন রকম নাক ভাসিয়ে ভেসে যাওয়াকেই নিজেদের নিয়তি রূপে মেনে নিয়েছে।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018