শিক্ষার নামে চলছে পরিকল্পিত নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মানব মাত্রই প্রতিটি মুহুর্ত বাঁচবে এ জীবনকে সফল করার প্রবল তাড়না নিয়ে -সেটিই তো কাঙ্খিত। এ জীবনে কেই পরাজয় বা বিপর্যয় চায় না। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হলো অনন্ত কালের জন্য জাহন্নামের আগুনে গিয়ে পড়া। পবিত্র কুর’আনে তাই যে বিষয়টির উপর বার বার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচা। যারা তা থেকে বাঁচে তারাই প্রকৃত সফলকাল। সে ঘোষণাটিও পবিত্র কুর’আনে বার এসেছে। জাহান্নামের সে আগুন থেকে বাচানোর কাজটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ খাত। ইসলাম সে কাজটি করে কুর’আনী জ্ঞানদানের মাধ্যমে। এটিই ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের মত একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হলো এ জীবনে পরাজয় বাড়ানোর। সেটি জাহান্নামে নেয়ার। বাংলাদেশে সে কাজটি করছে দেশের শিক্ষাখাত। বাংলাদেশে সরকারের রাজস্বের সবচেয়ে বেশী ব্যয় এ খাতে।

জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাটি নির্ভর করে ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদে ব্যক্তির নিজ জান ও মালের বিনিয়োগের উপর। একমাত্র তখনই একাত্মতা ঘটে পবিত্র কুর‌্’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে। একমাত্র এ পথেই সভ্য মানুষ ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয়। এজন্যই জিহাদ মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজেক্ট। এবং এটিই হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। আগুনের প্রকাশ ঘটে তার শিখা বা উত্তাপের মাঝে, তেমনি ঈমানের প্রমাণ মেলে ইসলামের বিজয়ে জিহাদের মাঝে। উত্তাপ না থাকলে আগুনকে যেমন আগুন বলা যায় না, তেমনি জিহাদ না থাকলে ঈমানকে ঈমান বলা যায়না। মহান আল্লাহতায়ালা সে সত্যটি জানিয়ে দিয়েছেন সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। ঈমানদার হওয়ার শর্তই হলো তাকে জীবনের প্রতি পদে মহান আল্লাহতায়ালার সত্য-বাণীর পক্ষে ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সাক্ষীদাতা রূপে খাড়া হতে হয়। এমন আমৃত্যু জিহাদ হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিজয় নিয়ে। সে এজেন্ডার পরাজয় একজন ঈমানদারের কাছে অসহ্য।

ঈমানদারের এজেন্ডা হলো, সকল ইসলামবিরোধী শক্তির নির্মূল। নইলে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা ঘটে না। সে কাজটি কোন কালেই স্রেফ দোয়া-দরুদ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সম্ভব হয়নি। সেটি সম্ভব হলে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের বার বার জিহাদের ময়দানে হাজির হতে হতো না। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবাকে শহীদ হতে হতো না। ইবাদতের নামে হাত-পা গুটিয়ে মসজিদে বা নিজ ঘরে স্রেফ জায়নামাজে বসে থাকাটি তাই নবীজী (সা)’র ইসলাম নয়। প্রকৃত ঈমানদারীও নয়। নবীজী (সা:)’র  যুগে সে নীতি ছিল কপট নামাজীদের –যারা চিত্রিত হয়েছে মুনাফিক রূপে। মুসলিম রূপে বাঁচতে হলে বাঁচতে হয় সমগ্র ইসলাম নিয়ে। পবিত্র কুর’আনে সে পূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচার হুকুম এসেছে এ ভাষায়: ‍“উদখুলু ফিস সিলমে কা‌’আফফা।” অর্থ: প্রবেশ করো ইসলামে পূর্ণ ভাবে। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে পূর্ণ ইসলাম অনুসরণ করে বাঁচার কাজটিই হচ্ছে না। ইসলাম পালিত হচ্ছে অতি আংশিক ভাবে।  সেটি শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সীমিত। এরূপ আংশিক ইসলাম যে ইসলাম নয়, সে বোধটুকুই বা ক’জনের মধ্যে?

প্রশ্ন হলো, ইসলামের এ মৌল বিষয়গুলি জানার জন্য কি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসার ডিগ্রি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে? মুসলিম উম্মাহর মাঝে যখন কোন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা ছিল না তখনও প্রতিটি মুসলিম সেটি বুঝতো। সে মৌলিক জ্ঞান ভেড়ার নিরক্ষর রাখালের মাঝেও ছিল। ফলে তাদেরকে শুধু নামাজের জামাতে দেখা যেত না, জিহাদের ময়দানেও দেখা যেত। দেখা যেত কুর’আন বুঝার কাজে। পূর্ণ ইসলাম পালনে আগ্রহী এরূপ মুসলিমগণই সেদিন কুর’আন বুঝার প্রয়োজন মাতৃভাষাকে বর্জন করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিল।

মুসলিমদের গৌরব কালে ইসলামের এ মৌলিক জ্ঞান বিতরনের কাজটি হতো যেমন মসজিদের মেঝেতে, তেমনি গাছের তলায়, রাস্তাঘাটে, হাটেবাজারে, বিয়ের মজলিসে ও খাওয়ার টেবিলে। জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জন তাদের সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। জ্ঞানের সে মজলিসে খোলা চোখ, খোলা কান ও খোলা মন নিয়ে হাজির হতো সর্বস্তরের ও সর্বপেশার মানুষ। শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং নবীজী (সা:)। তাতে কোন টিউশন ফি ছিল না। অথচ জ্ঞান-বিতরণের সে জলসাগুলিই ছিল মানব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্লাসরুম। সে ক্লাস রুম থেকে সৃষ্টি হয়েছে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তিগণ। কিন্তু আজ জ্ঞানদানের কাজও ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ক্লাসরুম ব্যবহৃত হচ্ছে ওহীর জ্ঞানের সত্যকে আড়াল করার কাজে। ফলে ঈমানী দায়বদ্ধতার কথা বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি ব্যর্থ হচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্রগণ। ফলে জনবল পাচ্ছে না জিহাদের ময়দান। একারণেই আসছে না ইসলামের বিজয়। ফলে শরিয়ত, হুদুদ, কেসাস, শুরা ও জিহাদের আয়াতগুলো স্রেফ কুর’আনেই রয়ে গেছে।

অথচ জিহাদের ময়দানে পা না রেখে জান্নাতের দরজায় পৌছা যে অসম্ভব –পবিত্র কুর’আনের সে হুশিয়ারিগুলি নিয়েও কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। অথচ যে পরীক্ষায় পাশ না করে জান্নাতে প্রবেশ অসম্ভব -সে পরীক্ষাটি হলো জিহাদে অংশ নেয়ার। অনিবার্য এই পরীক্ষার কথা পবিত্র কুর’আনে বার বার শোনানো হয়েছে। যেমন সুরা আল ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো প্রকাশ করেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করলো এবং কারা ছবর ধারণ করলো।“ সুরা আনকাবুতের ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে এ জন্য যে, তারা বলেছে আমরা ঈমান এনেছি এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না?”

সে অনিবার্য পরীক্ষার ক্ষেত্রটি হলো জিহাদ -তা নিয়ে কোন অস্পষ্টতা নাই। এখানে পরীক্ষা হয় আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার লড়াই’য়ে ব্যক্তির অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগের সামর্থ্যের। শিক্ষার মূল কাজ তো সে পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য বাড়ানো। সে সামর্থ্যের বলে ঈমানদার ব্যক্তি পরীক্ষায় পাশ করে ও জান্নাতে যায়। সে জন্য অপরিহার্য হলো, পবিত্র কুর’আন ও হাদীসের জ্ঞান। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা সে সামর্থ্য বাড়ায় না বলেই সেটি এ জীবনকে ব্যর্থ করার শয়তানী প্রকল্প। অথচ বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে শিক্ষার নামে সে নাশকতাটি প্রকট ভাবে হচ্ছে। এ শিক্ষাব্যবস্থা একমাত্র শয়তান ও তার অনুসারিদেরই খুশি করতে পারে। শয়তানের সে বিশাল বিজয়টি দেখা যায় দেশে গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ,সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতির ন্যায় নানারূপ বেঈমানী ও দুর্বৃত্তির প্লাবন দেখে।

মুসলিমগণ আজকের এই পরাজিত অবস্থায় একদিনে পৌঁছেনি। পৌঁছেছে এক সুদূর প্রসারি শয়তানী পরিকল্পনার বিজয় রূপে। ইসলামের বিপক্ষ শক্তির অধিকৃতিকে স্থায়ী করতে বহু পূর্ব থেকেই ইসলামের মৌল জ্ঞানকে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর সিলেবাস থেকে পরিকল্পিত ভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। প্রহসনের চুড়ান্ত রূপটি হলো, ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের এরূপ যুদ্ধাংদেহী নীতিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাজারজাত করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা বলে। প্রতরণা এখানে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে। ফলে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও অজ্ঞতা গভীরতর হয়েছে এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের মাঝে। কুর’আন-মুক্ত এ শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন মুসলিম দেশগুলিতে দুর্নীতির জোয়ার এনেছে, তেমনি আনন্দ ও বিজয় বাড়িয়েছে শয়তানের। ফলে আজ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের মধ্য থেকে ইসলামের শত্রুপক্ষ যেরূপ বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক পাচ্ছে তা নবীজী (সা:)’র যুগে এমন কি পৌত্তলিক কাফেরদের মধ্য থেকেও পায়নি। ফলে বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশের ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে ময়দানে পৌত্তলিক কাফিরদের সশরীরে নামতে হচ্ছে না। শয়তানের পক্ষে সে কাজটি মুসলিম নামধারী বাঙালিগণই করে দিচ্ছে। তারাই ইসলামপন্থীদের রাস্তায় পেটাচ্ছে, রিমান্ড নিয়ে নির্যাতন করছে, ইচ্ছামত গুম-খুন করছে। এমন কি ফাঁসিতেও ঝুলাচ্ছে। বাজেয়াপ্ত করছে ইসলাম বিষয়ক বই। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে জুম্মার খোতবা ও কুর’আনের তাফসির। কুর’আন-মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার এই হলো ভয়াবহ নাশকতা। অথচ বাংলাদেশে এই আত্মঘাতী ও ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতিটি বেঁচে আছে কোটি কোটি নামাজী, রোজাদার ও হাজীদের রাজস্বের অর্থে! জনগণ ও তাদের সন্তানেরা এভাবে জনগণের রাজস্বের খরচে বেড়ে উঠছে শয়তানের বিশ্বস্ত সৈনিক রূপে।

জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার প্রবল আগ্রহই ব্যক্তিকে অন্যায়, অসত্য ও জুলুমের নির্মূলে আপোষহীন করে। ব্যক্তির মাঝে তখন নৈতিক বিপ্লব শুরু হয়। জান্নাত পাওয়ার সে তীব্র স্বার্থচেতনা ব্যক্তিকে স্বার্থহীন করে এ পার্থিব জীবনে। কারণ, জান্নাতের যোগ্য হতে হলে অপরিহার্য হলো অন্যায়, অসত্য, মিথ্যাচার, দুর্বৃত্তি, সন্ত্রাস, স্বৈরাচার ও জুলুমবাজি থেকে নিজেকে মুক্ত করা। মাথা টানলে মাথার সাথে নাক, কান এবং চোখও আসে, তেমনি জান্নাতমুখী চেতনা নিয়ে বাঁচলে অনাবিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা আসে দুনিয়াবী জীবনে। তখন কল্যাণকর্মে আসে তীব্র সৃষ্টিশীলতা। ফলে জোয়ার আসে অর্থনীতিতে। জান্নাতের জন্য প্রস্তুত করার প্রচণ্ড তাড়নাতেই প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ জন্ম দিয়েছিলেন সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। এটি ছিল জান্নাতের পথে চলার বিশাল বাড়তি পুরস্কার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *