সভ্যরাষ্ট্র নির্মাণে বাঙালি মুসলিমের এতো ব্যর্থতা কেন?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on June 25, 2022
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণ কীরূপে?
আইনের শাসন যেদেশে বিলুপ্ত, গণতন্ত্র যেদেশে কবরে শায়ীত, শাসন যেখানে অসভ্য ফ্যাসিবাদী ভোটডাকাতদের এবং প্লাবন দেশে গুম-খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাসের -সে রাষ্ট্রকে আর যাই হোক সভ্যরাষ্ট্র বলা যায়না। সভ্য ও অসভ্য ব্যক্তির ন্যায় সভ্য ও অসভ্য রাষ্ট্রেরও সুনির্দিষ্ট কিছু আলামত ও পরিচিতি আছে। সেগুলি খালি চোখেও দেখা যায়। তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, খুনি, ধর্ষক ও সন্ত্রাসীগণ দেখতে যতই মানুষের মত হোক না কেন, তাদেরকে সভ্য মানুষ বলা যায় না। দেখতে পশু না হলেও তারা পশুর চেয়েও বর্বর, হিংস্র ও নৃশংস। হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, পুলিশ রিমান্ডে অত্যাচার ও গণধর্ষণের ন্যায় মানব সমাজের ভয়ংকর অপরাধগুলো কখনোই পশুদের দ্বারা হয়না, সেগুলি হয় মানবরূপী পশুদের হাতে। একটি দেশকে এরাই অসভ্য দেশে পরিণত করে। যেদেশে গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, ব্যাংক লুট, সরকারি তহবিল লুটের ন্যায় দুর্বৃত্তির তান্ডব -সে দেশকে কি কখনো সভ্য দেশ বলা যায়? এমন দেশকে সভ্য দেশ বললে, অসভ্য দেশ বলতে কোন দেশকে বুঝায়? জনগণের কথা বলা, লেখালেখি, মিটিং-মিছিল, স্বাধীন ভাবে ভোট দেয়া ও রাজনৈতিক লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়ার মৌলিক অধিকার যদি কেড়ে নেয়া হয় –তবে অসভ্য দেশ হতে আর কিছু বাকি থাকে কী?
প্রতিটি ব্যক্তি ও জাতিকে প্রতি মুহুর্ত লড়াই নিয়ে বাঁচতে হয়। সে লড়াইটি শুধু ঘর বাঁধা, উপার্জন ও পানাহারে বাঁচার নয়। বরং সবচেয়ে বড় লড়াইটি হয় সভ্যতর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে। এ লড়াইটি যে দেশের জনগোষ্ঠির জীবনে অতি তীব্র, সভ্য ভাবে বেড়ে উঠার সম্ভাবনাও সেখানে সর্বাধিক। মানব জীবনের মূল পরীক্ষাটি এখানেই। পশু জীবনে এরূপ লড়াই থাকে না বলেই সে পশু। পশুরা বন-জঙ্গলের জীবন নিয়েই খুশি। কিন্তু মানব জীবনের মিশন ও ভিশন ভিন্ন। কোন মানব গোষ্ঠির জীবনে যদি সভ্য ভাবে বেড়ে উঠার লাগাতর লড়াইটি না থাকে, তবে সে জনগোষ্ঠির জীবনেও অসভ্যতা নেমে আসে। সভ্যতর, পরিশুদ্ধতর ও পবিত্রতর হওয়ার যে লাগাতর লড়াই –সেটিই হলো মুসলিম জীবনের জিহাদ। এটিই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। মানব কতটা মহামানব হবে এবং ফেরেশতাদের চেয়ে কতটা উপরে উঠবে এই জিহাদের উপর। পবিত্র কুর’আন নাযিল হয়েছে এ মহত্তর কাজে পথ দেখাতে। নবীজী (সা)’র হাদীস: আল্লাহর কাছে সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে শ্রেষ্ঠ তাকওয়া ও চরিত্রের বিচারে। তাই মানব জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো তাকওয়া সম্পন্ন উন্নত চরিত্রের সভ্য মানব রূপে বেড়ে উঠা। ব্যক্তির নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, তাসবিহ-তাহলিল ও কুর’আন পাঠ যদি তাকে উন্নত চরিত্র ও তাকওয়া না দেয় তবে বুঝতে হবে সেগুলি ব্যর্থ। তবে উন্নত ব্যক্তির নির্মাণে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ। কারণ, এ কাজ ঘরে বা গুহায় বসে একাকী সম্ভব নয়। এজন্য চাই, সভ্য পরিবারের সাথে সভ্য রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজ। একজন সুস্থ শিশুকে সভ্য নাগরিক রূপে গড়ে তোলার দায় শুধু তার পিতামাতা ও তার পরিবারের নয়। সেটি তাদের পক্ষে একাকী সম্ভবও নয়। সে দায়িত্বটি শিশুর প্রতিবেশীর, স্কুলের, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের, সমাজের ও রাষ্ট্রের। দেশের সিকি ভাগ লোক চাষাবাদ করলে সমগ্র দেশবাসীর জন্য খাদ্য জোগাতে পারে। কিন্তু দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লক্ষ শিক্ষক জনগণের শিক্ষাদানের কাজটি সমাধা করতে পারে না। এ দায়িত্ব প্রতিটি পিতা, প্রতিটি মাতা, প্রতিটি অভিভাবক ও প্রতিটি নাগরিকের। নিজে জ্ঞানার্জন করা এবং অন্যকে জ্ঞান দেয়া –ইসলামে তাই পবিত্র ইবাদত। নবীজী (সা:) প্রতিটি সাহাবা যেমন ছাত্র ছিলেন, তেমনি শিক্ষকও ছিলেন। এমন মিশন নিয়ে বাঁচলেই সমগ্র দেশ পাঠশালায় পরিণত হয়। এটিই তো ইসলামের ভিশন। ইসলাম জাহেল বা অজ্ঞদের ধর্ম নয়। তাই জনগণকে অজ্ঞ বা জাহেল রেখে ইসলামের মিশনকে কখনোই সফল হয় না। এজন্যই নামাজ-রোজার পূর্বে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। এবং ইসলামই একমাত্র ধর্ম যে ধর্মে অজ্ঞ থাকা পাপ এবং জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক। এরূপ বিধান অন্য কোন ধর্মে নাই।
রোজ হাশরের বিচার দিনে বিচার হবে নিজেকে কে কতটা সভ্যতর করলো –শুধু তা নিয়েই নয়। বরং সমাজ ও রাষ্ট্রকে সভ্যতর করার জিহাদে কার কি ভূমিকা ছিল –বিচার হবে তা নিয়েও। জীবনে সভ্যতর হওয়ার এ লড়াইটি না থাকার অর্থ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিচারে পিছিয়ে পড়া তথা অসভ্য হওয়া। কারণ, স্বাস্থ্য হারাতে মেহনত করা লাগে না; স্বাস্থ্য রক্ষায় অমনযোগী হওয়াটাই সে জন্য যথেষ্ট। তেমনি মেহনত লাগে না অসভ্য হতে; সভ্য হওয়ার লড়াইটি না থাকাটাই যথেষ্ঠ। মিথ্যা, অবিচার ও দুর্বৃত্তি থেকে নিজেকে ও সমাজকে মুক্ত করার যে লাগাতর লড়াই –সেটিই ইসলামের মূল মিশন। সত্যের চেয়ে মিথ্যা অধিক শক্তিশালী। কোভিড ভাইরাসের চেয়েও মিথ্যা অধিক সংক্রামক। এজন্যই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ সত্য দ্বীনকে ভূলে মিথ্যার অনুসারী। ফলে মুর্তি, নদী, পাহাড়, পুরুষের লিঙ্গ, গরু, সাপ ইত্যাদিও পূজা পায়। তাই পবিত্র জিহাদ হলো মিথ্যার নির্মূলের মধ্য দিয়ে ইসলামের শাশ্বত সত্যকে বিজয়ী। আর মিথ্যার নির্মূলে জরুরি হলো মিথ্যা-ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদের নির্মূল করা। কারণ দুর্বৃত্তরাই মিথ্যার পক্ষের সৈনিক। মিথ্যাকে এই দুর্বৃত্তরাই সযত্নে বাঁচিয়ে রাখে। পবিত্র কুর’আনের সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা যে কারণে মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহর মর্যাদা দিয়েছেন সেটি অধিক হারে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালনে জন্য নয়, বরং এই দুর্বৃত্তদের নির্মূলের জিহাদ নিয়ে বাঁচার জন্য। কারণ অসভ্যতার নির্মূলে ও উচ্চতর সভ্যতার নির্মূলে একাজটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বৃত্তদের নির্মূলের পরই সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
ইসলামের লাগাতর জিহাদের রয়েছে দুইটি সুনির্দিষ্ট ফ্রন্ট। জিহাদটি যেমন নিজের অশুভ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে, তেমনি বাইরের শত্রু-শক্তির নির্মূলে। এ দুই ফ্রন্টের জিহাদের কোনটিতেই কোনরূপ বিরতির অবকাশ নাই। কারণ ভিতরে ও বাইরে –উভয় জায়গাতেই শয়তানী শক্তির হামলায় কোন বিরতি নাই। শয়তানের সে অবিরাম হামলা থেকে বাঁচতে চাই লাগাতর প্রতিরক্ষা। মুসলিম জীবনে এটিই হলো মূল চ্যালেঞ্জ। লাগাতার প্রতিরক্ষা ও পরিশুদ্ধির প্রচেষ্ঠা না থাকলে পরাজিত হয়ে হারিয়ে যেতে হয়। সে পথটি নীচে নামার তথা অসভ্যতার। এ পথটি জাহান্নামের। শয়তানের হামলার কেন্দ্র বিন্দু হলো ব্যক্তির আত্মার ভূমি তথা নফস। শয়তান সেখানেই তার ঘাঁটি নির্মাণ করতে হয়। তাই ঈমানদারের জীবনে জিহাদের শুরুটি হয় নিজ নফসের অঙ্গণকে শয়তানের দখল থেকে মুক্ত রাখতে। ইসলামে সে যুদ্ধটিই হলো জিহাদে আকবর। ব্যক্তির চরিত্রের পরিশুদ্ধির যুদ্ধটি শুরুটি হয় নফসের পরিশুদ্ধি থেকে। এ যুদ্ধে যে বিজয়ী হয়, সেই সত্যিকার অর্থে সফলকাম। পবিত্র কুর’আনে তাই বলা হয়েছে: “ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কাহা।” অর্থ: “সেই সফল হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো তথা পরিশুদ্ধির লড়াই নিয়ে বাঁচলো।” –(সুরা শামস, আয়াত ৯)। লাগাতর পরিশুদ্ধ হওয়ার চেষ্টায় লেগে থাকার অর্থই হলো লাগাতর সভ্যতর হওয়া। এটিই হলো মুসলিম জীবননের মিশন। কুর’আনের জ্ঞানার্জন, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতের ন্যায় ইবাদতের সকল বিধানই হলো মুসলিম জীবনে সে পরিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা ও তীব্রতর করা। এ মিশনের বাইরে যে জীবন সেটি দিন দিন অসভ্য ও দুর্বৃত্ত হওয়ার, তথা জাহান্নামের উপযোগী হওয়ার।
নবীজী (সা:) বলেছেন, ঈমানদার ব্যক্তি কোন জনশূণ্য পথে একাকী চললেও তাঁর পিছনে শয়তান তার ষড়যন্ত্র নিয়ে হাজির হয়। তাই ঈমানদার যুদ্ধ না চাইলেও শয়তান তার উপর এক বিরামহীন যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। তাই ঈমান নিয়ে বাঁচতে হলে প্রতি পদে জিহাদ নিয়ে বাঁচা ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। এ জন্যই কে ঈমানদার এবং কে বেঈমান –সেটি বুঝা যায় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে সে লাগাতর জিহাদটি আছে কিনা, সেটি দেখে। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত বহু মুনাফিকের জীবনেও থাকে। কিন্তু তাদের জীবনে জিহাদ থাকেনা। তারা বরং ভেসে চলে শয়তানী শক্তির সৃষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্রোতে। যদি দেশ শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃত হয় এবং আদালত থেকে বিলুপ্ত হয় শরিয়ত, তবুও যদি মুসলিম নামধারী কোন ব্যক্তির জীবনে জিহাদ শুরু না হয় -তবে বুঝতে হবে ঈমানের দাবীতে সে ভন্ড। ধর্মীয় লেবাস পড়ে ও মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে নিজেকে সে মুসলিম রূপে জাহির করে মাত্র। জিহাদ ও ঈমান যে মুসলিম জীবনে একত্রে চলে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, ঈমানের দাবীতে একমাত্র তারাই সাচ্চা যাদের জীবনে জিহাদ আছে এবং সে জিহাদে নিজেদের জান ও মালের বিনিয়োগ আছে।
সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র কখনোই বেশী বেশী নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের কারণে গড়ে উঠে না। সেটি সম্ভব হলে বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্ব রেকর্ড না গড়ে গড়ে তুলতো সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র। কারণ, এতো মসজিদ ও এতো নামাজী বিশ্বের আর কোন দেশে আছে? ব্যক্তি ও জাতির জীবনে পরিশুদ্ধি আসে এবং রাষ্ট্র সভ্যতর হয় জনগণের জীবনে লাগাতর জিহাদের কারণে। তাই জিহাদ মুসলিমদের জন্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়, মহান আল্লাহতায়ালা পক্ষ থেকে নির্ধারিত এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ফরজ ইবাদত। যারা এ জিহাদে শহীদ হয় তাদেরকে তিনি শহীদের মর্যাদা দিয়ে বিনা বিচারে জান্নাতে নেন। এ পৃথিবীতে মানবের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দানটি হলো পবিত্র কুর’আন; আর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি হলো শাহাদত। এ পুরস্কারটি জিহাদবিমুখ ভন্ডদের জুটে না। এ পুরস্কারটি সবচেয়ে বেশী পেয়েছিলেন সাহাবাগণ। অর্ধেকের বেশী সাহাবা তাই শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের বিজয় ও গৌরবের মূল কারণ হলো তাদের জিহাদ এবং সে জিহাদে অর্থদান ও প্রাণদান। কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামবিরোধী শক্তির বিজয় ও দুর্বৃত্তির তান্ডব দেখে এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, শয়তানী শক্তির নির্মূলে সে দেশে কোন জিহাদ সংগঠিত হয়নি। বরং ইতিহাসটি এখানে আত্মসমর্পণের। বাংলাদেশ হলো তারই জাজ্বল্যমান উদাহরণ।
শুধু বিশ্বের পন্ডিতজন ও ইতিহাসবিদদের চোখেই নয়, মহান আল্লাহতায়ালার রাডারেও সভ্য রূপে বেড়ে উঠার লড়াইয়ে ব্যক্তি, জাতি বা জনগোষ্ঠির আত্মনিয়োগ, সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়গুলো প্রতি মুহুর্তে মনিটরিং হয়। পবিত্র কুর’আনে বহু জাতির ব্যর্থতার কাহিনীগুলো যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাদের নিজ হাতে অর্জিত আযাবের কথাও। সেটি এই জন্য যে, ভবিষ্যতের মানবগণ যেন তাদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয় এবং সাবধান হয়ে যায়। সভ্যতর রূপে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার এ ইতিহাস থেকে শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। এমন কি মানব রচিত ইতিহাসের বইয়েও বহু জাতির ভয়ানক দুর্বৃত্তি ও ব্যর্থতার চিত্র পাওয়া যায়। পবিত্র কুর’আনই হলো মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সর্বশেষ গ্রন্থ । যদি আর কোন ধর্ম গ্রন্থ ভবিষ্যতে নাযিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো তবে বাংলাদেশীদের ব্যর্থতা নিয়ে মহান স্রষ্টার নিজের বয়ানটি বিশ্ববাসী অবশ্যই জানতে পারতো –যেমন জানতে পারছে আদ, সামুদ ও ফিরাউনের অনুসারীদের ব্যর্থতার কথা। কারণ, দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে চমক দেখিয়েছে কী ভাবে দ্রুত নীচে নামতে হয়। বিশ্ব মাঝে এরূপ অর্জন একমাত্র বাংলাদেশের। এ রায়টি ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ন্যায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার -যার কাজ হলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির উপর লাগাতর মনিটরিং করা। ফলে শত শত বছর পরও বিশ্ববাসীর জন্য বাংলাদেশ শিক্ষণীয় মডেল হতে পারে। কীরূপে একটি রাষ্ট্র ও জনগোষ্ঠি দ্রুত ব্যর্থ হয় এবং দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে বার বার প্রথম হয় –সে বিষয়ে নানা দেশের মানুষ জ্ঞান লাভ করতে পারে। বাংলাদেশ চমক দেখিয়েছে দেশ জুড়ে ভোটডাকাতি করে। চমক দেখিয়েছে কী ভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়। স্বাস্থ্য বাঁচাতে হলে প্রাননাশী রোগ গুলো চিনতে হয়। তাই দুর্নীতি প্লাবন ও ফ্যাসিবাদের নৃশংসতা থেকে যারা বাঁচতে চায় –সেগুলির চরিত্র ও পথকেও চিনতে হয়। ইতিহাস বিজ্ঞানে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব এখানেই।
ব্যর্থতার দলিল
বাংলাদেশের বুকে অসভ্য কর্ম ও ব্যর্থতার তালিকাটি বিশাল। দুর্নীতিতে বিশ্ব মাঝে পর পর পাঁচ বার প্রথম হওয়ার বিষয়টি যে কোন সভ্য ও দেশপ্রেমিকের মগজে ধাক্কা দিবে –সেটিই স্বাভাবিক। ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর যেরূপ দেশজুড়ে ভোটডাকাতি হলো -সেটিও কি আজ অবধি অন্য কোন সভ্য দেশে হয়েছে? তাক লাগিয়ে দেয়ার ন্যায় এ কর্মটিও একমাত্র বাংলাদেশের। ২০১৪ সালে সংসদের ১৫৩ আসনে কোন রূপ নির্বাচন না করে যেরূপ সরকার গঠিত হলো -সেটিও কি কোন গণতান্ত্রিক দেশে কখনো ঘটেছে? বাংলাদেশীগণ রেকর্ড গড়েছে আরেকটি ক্ষেত্রেও। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশই হলো একমাত্র দেশ যে দেশে শেখ মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্র হত্যাকারী, ফ্যাসিবাদী, গুম-খুনের নায়ক ও বাকশালী স্বৈরচারীকে জাতির পিতা ও বন্ধু বলে শ্রদ্ধা দেখানো হয়। পৃথিবীর আর কোন দেশে এরূপ গুরুতর অপরাধীকে কি কখনো সম্মানের আসনে বসানো হয়েছে? একজন ভয়ংকর অপরাধীকে জাতির পিতা বা বন্ধু বলে সম্মান দেখানোর রুচি কোন সভ্য জনগণেরই থাকে না। অপরাধ করাই শুধু অপরাধ নয়, অপরাধ হলো অপরাধীকে সম্মান করা। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে হত্যা, ধর্ষণ ও চুরি-ডাকাতি করার জন্য নয়, বরং খুনি, ধর্ষক ও চোর ডাকাতের পক্ষে রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে খাড়া হওয়ার কারণে। তাদের সমর্থণের কারণেই দুর্বৃত্তগণ বিজয়ী হয় ও দুর্বৃত্তির প্লাবন আসে। সভ্য মানুষের সভ্য রুচি ও বিবেক তো ধরা পড়ায় খুনি ও স্বৈরাচারীদের ঘৃণা করার মাঝে। যে কোন উন্নত দেশেই ঘৃণা ভরে তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফেলা হয়। অপরাধীকে সম্মান দেখালে অন্যরাও তখন অপরাধী হওয়ার পথ ধরে। খুন, দুর্বৃত্তি ও স্বৈরাচারী নৃশংসতাতেও যে সমাজে শ্রদ্ধা জুটে –সে কুশিক্ষাটি তখন প্রচার পায়। জীবাণুর ন্যায় দুর্বৃত্তরাও তখন দ্রুত বংশ বিস্তার করে। দুর্বৃত্তির নির্মূল না করলে দুর্বৃত্তির জোয়ার তখন অনিবার্য হয়ে উঠে। বাংলাদেশে সে জোয়ার তো প্রবল। দুর্বৃত্তের প্রতি সম্মান দেখানোর বিকৃত ও অসুস্থ রুচিটি তাই কোটি কোটি বাঙালির। সে অসুস্থ রুচি এমন কি তাদেরও যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বুদ্ধিজীবী, বিচারক, মিডিয়া কর্মী, সেনা অফিসার, সচিব ও পেশাজীবী। তারাও একজন ভোটডাকাতকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে। শুধু তাই নয়, শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশে বাঙালি মুসলিমদের রয়েছে এমন আরেকটি ইতিহাস যা যুগ যুগ অন্য মুসলিমদের অবাক করবে। তারাই একমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পৌত্তিলক হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়েছে তাদের হাজারো বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয়। ভারতী হিন্দুদের ইতিহাসে এটিই হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে একমাত্র যুদ্ধজয়। তাই প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর এলে সমগ্র ভারত জুড়ে হিন্দুত্ববাদী মহলে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়। পৌত্তলিক কাফেরদের ঘরে এরূপ বিজয় অতীতে আর কোন কালেই কোন মুসলিম জনগোষ্ঠি তুলে দেয়নি। সমগ্র মানব ইতিহাসে এ কাজটি একমাত্র বাঙালি মুসলিমের। হাজার বছর পরও এজন্য বাঙালি মুসলিমদের মুসলিম উম্মাহর আদালতে কাঠগড়ায় তোলা হবে এবং সেদিনের মুসলিম প্রজন্ম এরূপ কদর্য কর্মের জন্য ধিক্কার দিবে। তাই এটি নিশ্চিত, এ কদর্য ইতিহাস নিয়েই বাংলাদেশ ইতিহাসে যুগ যুগ বেঁচে থাকবে।
বিস্ময়ের আরো বিষয়, শেখ হাসিনার ন্যায় একজন ভোটডাকাতকে বাংলাদেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। একজন ডাকাত সর্দারনী এভাবে ১৬ কোটি মুসলিমের দেশে সম্মানিত হবে -সেটি কি কখনো কোন সভ্য দেশে ভাবা যায়? যে দেশে আইন-আদালত ও আইনের শাসন আছে -সেখানেই এরূপ চোর-ডাকাতদের শাস্তি হয়। তাদের কারাবন্দী হতে হয়। বিজয়ী হওয়া দূরে থাক, নির্বাচনে এসব চোরডাকাতদের আমৃত্যু প্রার্থী হওয়ার সুযোগও থাকে না। নির্বাচিত হ্ওয়ার পর যদি কেউ চোর বা মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয় -তবে মন্ত্রীপদে টিকে থাকার কোন নৈতিক অধিকার তার থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশ এরূপ সততা ও নীতি-নৈতিকতার কোন স্থান নাই। দেশটি যেন ডাকাতের গ্রাম। ডাকাতের গ্রামে যে ডাকাতটি সবচেয়ে নৃশংস, সবচেয়ে বর্বর ও অসভ্য -সেই বেশী প্রশংসিত হয়। তাকেই ডাকাতদের সর্দার বা সর্দারনী করা হয়।
ডাকাতকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলাই ডাকাত পাড়ার সংস্কৃতি। ভোটডাকাতিতে শেখ হাসিনার ন্যায় বিশাল সফলতা শুধু বাংলাদেশে কেন, সমগ্র বিশ্বে কোন ডাকাতই দেখাতে পারিনি। তেমন এক ডাকাতপাড়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে শেখ হাসিনার ন্যায় ডাকাত-সর্দারনীকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। দেশজুড়ে ভোটডাকাতি হওয়ার অর্থ, সমগ্র দেশের মালিকানা ডাকাতদের হাতে ডাকাতি হয়ে যাওয়া। তখন দেশের প্রশাসন, রাজস্ব-ভান্ডার, উন্নয়ন বাজেটের অর্থ, বিচার ব্যবস্থাসহ সব কিছুই ডাকাতির শিকার হয়। তখন দেশের পুলিশ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কর্মচারী ডাকাতদলের চাকর-বাকর ও পাহারাদারে পরিণত হয়। জনরোষ থেকে চোরডাকাতদের বাঁচাতে পদলেহী পুলিশ ও সেনাবাহিনী তখন জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস গণহত্যা ঘটায়। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে তেমন একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দ্বারা। অথচ এ সেনাবাহিনীর সদস্যদের পায়ের জুতা, গায়ের জামা, গৃহের রেশন ও জমকালো বাড়ী নির্মাণের খরচ জুগায় দেশের জনগণ। জনগণের বিরুদ্ধে এরূপ নৃশংসতার ইতিহাস কি কেউ ভূলতে পারে?
বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ। ইসলাম চোর-ডাকাত, খুনি ও দুর্বৃত্তদের নির্মূলের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ দেয় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার। অপরাধীদের সমীহ করা ও তাদের প্রতি সম্মান দেখানো হারাম। চোরকে চোর, খুনিকে খুনি, স্বৈরাচারীকে স্বৈরাচারী বলাই ইসলামের রীতি, শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলা নয়। তাই শরিষার দানা পরিমান ঈমান আছে এমন কোন ব্যক্তি কি কখনো কোন ডাকাত সর্দারনীকে সম্মানিত বলতে পারে? অথচ সেটিও ব্যাপক ভাবে হচ্ছে বাংলাদেশে। দুর্বৃত্তদের সম্মান করা তো বেঈমানীর লক্ষণ। ঈমান নিয়ে বাঁচতে হলে মিথ্যাচার, দুর্বৃত্তি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গভীর ঘৃণা নিয়ে বাঁচতে হয়। সেগুলির প্রতি প্রবল ঘৃণা না থাকলে সেসব অপরাধীদের নির্মূলের পবিত্র জিহাদে সে ব্যক্তি নামবে কী করে? কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টোটি। অপরাধীদের নির্মূল না করে তাদের প্রতি সম্মান দেখানোই রীতিতে পরিণত হয়েছে। দুর্বৃত্তদের বাঁচিয়ে রাখা হয় রাজস্ব জুগিয়ে পুলিশের পাহারা নিশ্চিত করে। সভ্য ব্যক্তি, সভ্য সমাজ, সভ্য প্রশাসন ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণে বাংলাদেশীদের ব্যর্থতা যে কতটা বিশাল -সেটি বুঝতে কি এরপরও কিছু বাকি থাকে?
ব্যর্থতা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ায়
ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় না তাদের পা একই গর্তে বার বার পড়ে। এরাই ব্যর্থ হয় সামনে এগুতে। তাদের দুর্দিনও কখনো শেষ হয়না। ব্যর্থতা, অজ্ঞতা, অসভ্যতা, নৃশংসতা ও দুর্বৃত্তিও তখন অহংকারে পরিণত হয়। যেমন হিন্দুদের কাছে অতি অহংকার হলো ধর্ম নিয়ে তাদের সনাতন অজ্ঞতা ও মিথ্যাচারগুলি। ফলে স্বর্পপূজা, নদীপূজা, লিঙ্গপূজা, গোপূজা এবং গোমুত্র সেবনও তাদের কাজে পবিত্র ধর্মকর্ম মনে হয়। সাধুদের ভিক্ষা করা ও জনসম্মুখে উলঙ্গ থাকাটাও পরম আধ্যাত্মিকতা মনে হয়। একই রূপ ব্যর্থতার আবর্তে আটকা পড়েছে বাংলাদেশীগণ। যারা চিন্তাশীল ও দেশপ্রেমিক, তাদের চেতনার রাডারে সব সময় যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল তা হলো, দেশবাসী কতটা সফল বা বিফল হচ্ছে সভ্য জাতি রূপে বেড়ে উঠায় তার উপর নিগূঢ় মনিটরিং করা।তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও লেখনীতে সে মূল্যায়নগুলি নিয়মিত প্রকাশ পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতাটি বিশাল। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রেও চলছে চরম ফ্যাসিবাদী তান্ডব। দেশের প্রকান্ড ব্যর্থতাগুলি নিয়ে সত্য কথাগুলি বলাও গণ্য হয় রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা রূপে। একাত্তর নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে মিথ্যা বলাটি চিত্রিত হচ্ছে দেশপ্রেম রূপে। এভাবেই প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে একাত্তরে ৩০ লাখ নিহত হওয়ার বিকট মিথ্যাটি। অতীতে কোথায় ভূল হলো এবং আজও কোথায় ভূল হচ্ছে -তা নিয়ে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ নাই। বুদ্ধিবৃত্তির নামে চলছে মিথ্যা বয়ান ও মিথ্যা তত্ত্বের চর্বিত চর্বণ ও দুর্বৃত্তদের গুণকীর্তন। ফলে অবিরাম ভূল হচ্ছে আগামী দিনের পথ চলাতেও। বরং মিথ্যাচার, গালিগালাজ ও দুর্বৃত্তি নিয়ে বাঁচাটিই সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
একাত্তরের রক্তাক্ত যুদ্ধ, হাজার হাজার বাঙালি ও বিহারী নিধন, বিহারীদের গৃহদখল ও সম্পদ লুন্ঠন, সীমাহীন ভারতীয় লুন্ঠন, শেখ মুজিবের বাকশালী স্বৈরাচার, ভয়ানক দুর্ভিক্ষ, এরশাদের সামরিক স্বৈরাচার, হাসিনার ভোট ডাকাতি ও নৃশংস ফ্যাসিবাদ -এসব নিয়েই তো বাংলাদেশের ইতিহাস। পঞ্চাশের দশকে সংসদের মধ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ডিপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলীকে। সে খুনের খুনিরা বস্তির খুনি ছিল না, তারা ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। খুনের কান্ড ঘটেছে দিবালোকে। কিন্তু সে খুনের অপরাধে কাউকেই পুলিশ গ্রেফতার করেনি, কাউকেই আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়নি, কারোই কোন শাস্তিও হয়নি। খুন হলো অথচ কারো শাস্তি হলো না –এমনটি কি কোন সভ্য দেশে হয়? কিন্তু বাংলাদেশে সেটিই ঘটে। সেটি দেশটি রাজনৈতিক আচার। অথচ সভ্য দেশে কেউ আইনের উর্দ্ধে থাকে না। সেটি জঙ্গলের রীতি। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের শত শত নিহতদের খুনিদের শাস্তি হয়নি। শাস্তি হয়নি ২০০৬ সালে ৩০ অক্টোবরের ১২ খুনের আসামীদের। অপরাধীদের খুঁজে বের করা ও তাদের শাস্তি দেয়ার সভ্য সংস্কৃতিই দেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। বনের বাঘ-ভালুক কাউকে খেয়ে ফেললে যেমন বিচার হয়না, তেমনি বিচার ও শাস্তি হয় না ফ্যাসিবাদী সরকারের হাতে কেউ নিহত হলে। ফ্যাসিবাদের এটিই আদি ও আসল রূপ। আইনের শাসনকে এভাবে বিলুপ্ত করলে কি সভ্য দেশ গড়া যায়? তখন তো দেশ অসভ্যতায় ইতিহাস গড়ে। অথচ সে পরিচয়টি এখন বাংলাদেশের জন্য বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেহ থাকলে তাতে নানা রূপ রোগও হানা দেয়। সভ্যতার পরিচয় তো সে রোগের সুচিকিৎসায়। একটি জাতির সভ্যতর চেতনাটি ধরা পড়ে দুর্নীতির নির্মূলে আপোষহীন আগ্রহ দেখে। একই পরিবারে বার বার ডায়রিয়া দেখা দিলে বুঝতে হবে কোথাও পানাহারে নিয়মিত জীবাণুর সংক্রমণ ঘটছে। রোগ থেকে বাঁচতে হলে সে সংক্রমণ দূর করতে হয়। তেমনি দেশে বার বার অসভ্য স্বৈরশাসন নেমে আসলে বুঝতে হবে দেশবাসীর চেতনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে দারুন সমস্যা আছে। বুঝতে হবে সমস্যা আছে দেশের আইন-আদালত, প্রশাসন, পুলিশ ও সেনা বাহিনীতে। মশামাছি সর্বত্র বসে না। গলিত আবর্জনা খুঁজে। তেমনি দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসকগণও পতিত চেতনার জনগণ খুঁজে। শেখ মুজিব যে বর্বর বাকশালী স্বেরাচার প্রতিষ্ঠা দিল, হুসেন মহম্মদ এরশাদ যে সামরিক স্বৈরাচার চাপিয়ে দিল এবং শেখ হাসিনা যেরূপ ভোটডাকাতি করলো -সেটি কি ইংল্যান্ড, জার্মানী বা ফ্রান্সের মত দেশ কোন জেনারেল বা ফ্যাসিবাদী নেতা করতে সাহস পেত? ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালের মত দেশেও কি সেটি সম্ভব? সেটি অসম্ভব। কারণ, এসব দেশের জনগণ এরূপ অসভ্য শাসন মেনে জন্য আদৌ প্রস্তুত নয়।
অপরাধ শুধু চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি ও মানুষ খুন নয়। যে কোন সভ্য দেশে অতি ঘৃণীত অপরাধটি হলো স্বৈরাচারী হওয়া। এখানে ডাকাতি হয় জনগণের মৌল অধিকারের উপর। ডাকাতগণ যেমন অস্ত্র দেখিয়ে গৃহবাসীকে জিম্মি করে, স্বৈরশাসকগণ তেমনি অস্ত্রের জোরে জিম্মি করে সমগ্র দেশবাসীকে। অতীতে স্বৈরাচারী এ অপরাধীদের জনগণ শুধু তাদেরকে ক্ষমতা থেকেই নামায়নি, তাদের মস্তকও কর্তন করেছে। ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র আকাশ থেকে নাযিল হয়নি; গণতন্ত্রের জন্য তাদের লড়াই লড়তে হয়েছে। ব্রিটিশ জনগণ আজ থেকে প্রায় ৫ শত বছর আগে ১৬৪৯ সালে তাদের রাজা প্রথম চার্লস’য়ের গর্দান কেটেছিল স্বৈরাচারী হওয়ার অপরাধে। ১৭৮৯ সালে ফ্যান্সের জনগণ স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটায় ও বিপ্লবের জন্ম দেয়। এমন কি তুরস্কেও ২০১৬ সালের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে নিরস্ত্র জনগণ রাস্তায় নেমে রক্ত দিয়ে প্রতিহত করেছে। প্রেসিডেন্ট আরদোগানের গণতান্ত্রিক সরকার সামরিক কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি দিয়েছে। যারা সামরিক ক্যু’র জড়িত ছিল ও সমর্থণ করেছিল এমন বহু হাজার সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়েছে। চোর-ডাকাতদের শাস্তি না দেয়া যেমন অপরাধ, তেমিন গুরুতর অপরাধ হলো স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের সহচরদের শাস্তি না দেয়া। কিন্তু বাংলাদেশে সে অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার কাজটি হয়না। বরং উল্টোটি হয়। এদেশে মুজিবের ন্যায় একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচারী ও গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্টকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু রূপে সম্মানিত করা হয়। এরশাদের ন্যায় গণতন্ত্রহত্যাকারী স্বৈরাচারীকে গ্রামবন্ধু বলা হয়েছে। এবং হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাত ফ্যাসিস্টকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। এরপরও কি বুঝতে বাকি থাকে, বাংলাদেশে মূল সমস্যাটি কোথায়?
একটি দেশের জনগণের বিবেক, চরিত্র ও মূল্যবোধের পরিচয় মেলে সে দেশে কাদেরকে সম্মান করা হয় ও ঘৃণা করা হয় -তা দেখে। অতীতের অসভ্য সমাজগুলিতে এমনকি নবীরাসূলগণও ঘৃণীত ও হত্যার যোগ্য গণ্য হয়েছেন। এবং নন্দিত হয়েছে নমরুদ, ফিরাউন, আবু লাহাব ও আবু জেহেলের মত নৃশংস দুর্বৃত্তগণ। তেমন এক অসভ্যতা নেমে এসেছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের মূল সমস্যাটি এখানেই। পচনটি চেতনা ও চরিত্রে এবং চরম বিভ্রাট জনগণের রুচিতে। এবং সে রোগটি শুধু নিরক্ষর জনগণের নয়। বরং অপরাধীদের সম্মানিত ও মাননীয় বলার অসভ্য অভ্যাসটি প্রবল ভাবে দেখা যায় তাদের মাঝেও যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, পত্রিকার সম্পাদক, কলামিস্ট, বিচারক, আইনবিদ ও সচিব। চেতনার পচনটি যে কতটি গভীর -সেটি বুঝা যায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুশত প্রফেসর দল বেঁধে বিবৃতিতে বলে ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনটি সুষ্ঠ হয়েছে।
চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, খুন ও ধর্ষণের ন্যায় গুরুতর অপরাধ হলো চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, খুন ও ধর্ষণকে সমর্থন করা। অথচ সেরূপ অপরাধ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রফেসর, বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের পক্ষ থেকে সংঘটিত হয় তখন তো বিষয়টি ভয়ংকর? যাদের কাজ হলো ছাত্রদের মাঝে বিবেকের পরিচর্যা দেয়া, তারাই যদি বিবেকহীন হয় এবং গুণকীর্তন করে নৃশংস অপরাধীদের -তবে ছাত্রগণ কাদের থেকে শিখবে এবং কাদেরকে আদর্শ মডেল রূপে গ্রহণ করবে? এমন দেশে কি কখনো গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব? গণতন্ত্র তো সভ্য ও রুচিবান মানুষের জন্য সরকার পরিবর্তনের সভ্য পদ্ধতি। বীজ কখনোই পাথরের উপর গজায় না। ঝোপ-ঝাড়ে গজালেও তা বেড়ে উঠে না। তেমনটি গণতন্ত্রের বেলায়ও। গাছ জন্মাতে হলে আগাছা নির্মূল করতে হয়, তেমনি গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে চোরডাকাত, ভোটডাকাতদের ন্যায় নানারূপ দুর্বৃত্তের নির্মূল করতে হয়। জনপদে হিংস্র পশু ছেড়ে দিয়ে কি সেখানে শান্তিতে বসবাস করা যায়? তেমনি দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ভয়ানক দুর্বৃত্তদের আবাদ বাড়িয়ে কি গণতন্ত্র চর্চা করা যায়? এরা যেমন গণতন্ত্রের শত্রু, তেমনি শত্রু সভ্য জীবন-যাপনের। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় আরো জরুরি হলো, জনগণের চেতনায় সুস্থতা ও রুচি ফিরানো। জরুরি হলো, ডাকাতকে ডাকাত, দুর্বৃত্তকে দুর্বৃত্ত এবং স্বৈরাচারীকে স্বৈরাচারী বলতে শেখানো। মৃত ফিরাউনকে গালি দিয়ে লাভ নেই। সেরূপ গালি পঙ্গু ভিক্ষুকও দিতে পারে। বরং জীবিত ফিরাউনদেরকে প্রকাশ্যে গালি দিয়ে, ঘৃণা দিয়ে, অভিশাপ দিয়ে ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে বুঝিয়ে দিতে হয় তাদের প্রতি জনগণের ঘৃণা কতটা তীব্র। রাষ্ট্রে তেমন একটি গণচেতনা নির্মিত হলেই দুর্বৃত্তগণ ফিরাউন-নমরুদ হতে ভয় পায়। এরূপ তীব্র গণঘৃণার ভয়েই ভদ্র মানুষ কখনোই চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতিতে নামে না। কিন্তু দুর্বৃত্তগণ যদি সমাজে শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য রূপে গণ্য হয়, তখন তারা রাজনীতিতে নামে এবং নির্বাচনে প্রার্থী হয়। এবং শাসনের পদেও আসীন হয়। বাংলাদেশে তো অবিকল সেটিই হয়েছে।
ভ্রান্ত দর্শনের মডেল
সবদেশেই কোভিড, কলেরা বা যক্ষার ন্যায় রোগের লক্ষণ যেমন একই রূপ, তেমনি একই রূপ চেতনা ও চরিত্র হলো ব্যর্থ মানুষদের। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও বিজিনেস সায়েন্সের গবেষণালব্ধ মোদ্দা ছবকটি হলো, জীবনে তারাই সফলকাম হয় যারা অন্যদের ত্রুটি তালাশে সময় ব্যয় না করে নিজেদের ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলোকে যথাযথ সনাক্ত করে এবং সেগুলো দ্রুত সংশোধনের ব্যবস্থা করে। নিজেদের ব্যর্থতার জন্য তারা অন্যদের দায়ী করে না। বরং তারা বিশ্বাস করে, উন্নয়নের মূল পাওয়ার হাউসটি অবস্থান করে তার নিজের গভীরে। ফলে তারা সচল করে নিজের ভিতরে অবস্থিত সে পাওয়ার হাউসকে। এরা কখনোই নিজেদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে না পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা অন্যদের। রোজ হাশরের বিচার দিনে মহান আল্লাহতায়ালা প্রতিকুল পরিবেশ, অন্যদের অপরাধ বা ত্রুটির কথা জিজ্ঞেসা করবেন না। প্রতিটি ব্যক্তিকে জবাব দিতে হবে তার নিজের ঈমান, নিজের আমল ও নিজের ব্যর্থতাগুলি নিয়ে। অন্যদের দোষের ফিরিস্তি বয়ান করে সেদিন নিজের দোষ ঢাকা যাবে না। মুক্তিও মিলবে না।
সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতাগুলি অতি বিশাল। প্রতিটি ব্যর্থতার পিছনেই একটি ব্যর্থ দর্শন কাজ করে। দর্শন থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তির সাথে দেশবাসীর রাজনীতি, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। কম্যুনিজমেরর ন্যায় একটি ব্যর্থ দর্শনই বিশাল সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটালো। একটি জাতির পতনের কারণ বুঝতে হলে তাই জনগণের দর্শন বা ধারণার মডেলটি বুঝতে হয়। তাই শুধু দুর্বৃত্ত সরকার পরিবর্তন করলে চলে না, পাল্টাতে জনগণের দর্শনের ভ্রান্ড মডেল। তখন জনগণও পাল্টে যায়। বাংলাদেশীদের চেতনায় যে ধারণাটি কাজ করে তা হলে “তারা নিজেরা নির্দোষ এবং যত দোষ অন্যদের” চিন্তার এরূপ একটি ভ্রান্ত মডেল। এখানে কুর’আনের বিপ্লবী দর্শনের কোন স্থান নাই। চিন্তার এ ভ্রান্ত মডেলটি বাঙালি মুসলিমদের জীবনে যে কতটা প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল সেটি বুঝা যায় একাত্তরের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে। বাংলাদেশীদের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো একাত্তরের যুদ্ধ। গণতন্ত্রের দাফন, ফ্যাসিবাদের উত্থান, ভারতীয় আধিপত্য, হিন্দু সাংস্কৃতির প্লাবন, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ও বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং ইসলাম থেকে দূরে সরা–এসব কিছুর মূলে দর্শনের যে মডেলটি কাজ করেছে সেটি হলো সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের মডেল। এ দর্শনটি বাঙালিদের অবাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড হিংস্র করেছে বটে, কিন্তু মানবিক গুণে কোন বৃদ্ধি ঘটায়নি। বরং প্লাবন এনেছে দুর্বৃত্তি, গুম, খুন, ধর্ষণ, বিহারীদের গৃহ ও দোকান দখল ও সন্ত্রাসের।
সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের মডেল পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশীদের চিন্তা, চরিত্র, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, মূল্যবোধ, ধর্মবোধ ও সংস্কৃতি। একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালি মুসলিমের জীবনে একটি ঐতিহাসিক মাইল ফলক। এ যুদ্ধ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমের জীবনে যে ইসলামী মূল্যবোধ, মুসলিম ভাতৃত্ববোধ ও প্যান-ইসলামীজমের প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে একাত্তরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এবং সে স্থলে প্রতিষ্ঠা পায় মুজিবের ভারতসেবী বাকশালী স্বৈরাচার, সেক্যুলারিজমের নামে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ, নৃশংস আওয়ামী ফ্যাসিবাদ, ভোটডাকাতির নির্বাচন এবং হিন্দু আধিপত্য। বাঙালি মুসলিমদের চেতনা ও মূল্যবোধের অঙ্গণে অবক্ষয় এতটাই গভীরতর হয়েছ যে, ১৯৪৭’য়ে বাঙালি মুসলিমগণ যেরূপ ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে অবাঙালি মুসলিমদের সাথে মিলে পাকিস্তান গড়লো তেমন একটি ভাতৃত্বের কথা আজকের বাঙালি মুসলিমগণ কল্পনাও করতে পারেনা। তেমনটি ভাবাও তাদের কাছে আজ অসম্ভব। বিভক্তি গড়া ইসলামে হারাম। অথচ আজ বিভক্তি গড়া নিয়ে বাঙালি মুসলিমদের মাঝে উৎসব হয়। অথচ মুসলিমকে শুধু নামাজ-রোজা নিয়ে বাঁচলে চলে না, মুসলিম ভাতৃত্ববোধ নিয়ে বাঁচাটি ফরজ। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ভয়ানক আযাব শুধু মুর্তিপূজার কারণে আসে না, আসে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের নামে বিভক্তি গড়াতেও। যার হুশিয়ারী শোনানো হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে।
রক্তাক্ত যুদ্ধের স্মৃতি দেশবাসীর চেতনায় একটি বিশেষ ধরণের নতুন স্মৃতি তথা নতুন মিমোরীর জন্ম দেয় -যা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও পরবর্তী দিনের ইতিহাস। সে স্মৃতি ভূলিয়ে দেয় পুরনো দিনের স্মৃতি। কারা শত্রু ও কারা মিত্র এবং কারা শ্রদ্ধেয় ও কারা ঘৃণ্য -তারও একটা নতুন কাঠামো খাড়া হয়। এভাবেই আসে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন। এজন্য রাজনৈতিক স্বার্থে প্রচণ্ড মিথ্যাচার হয় ইতিহাসের বইয়ে। তখন রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের সাথে শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদ। শুরু হয় ইতিহাস দূষণ। ইতিহাস-দূষণের সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নতুন প্রজন্মের বাঙালি মুসলিমদের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে বাঙালি মুসলিমদের গৌরবের অতীত ইতিহাস। এমন কি শহীদ তিতুমীর, হাজী শরিয়াতুল্লাহ, হাজী মহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া, হাজী মহসিন, নবাব সলিমুল্লাহ, মুনশি মেহেরুল্লাহ, শেরে বাংলা ফজলুল, হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, শহীদ সহরোওয়ার্দী, আকরাম খাঁ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও ফররুখ আহমেদের ন্যায় যেসব বাঙালি মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীগণ ইসলাম ও মুসলিমের পক্ষে খাড়া হয়েছিলেন তাদেরও সে নতুন জাতীয় মেমোরি বা স্মৃতি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সে স্থানে বসানো হয়েছে একাত্তরের ভারতসেবী ও ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের।
মিথ্যাই মানবজাতির বড় দুষমন। জীবাণুর আক্রমণে দেহ মারা পড়ে। কিন্তু মিথ্যার আক্রমণে মারা পড়ে বিবেক ও সত্য ধর্ম। তাই শুধু রোগ-জীবাণু থেকে বাঁচলে চলে না, মিথ্যা থেকেও বাঁচতে হয়। কোন দেশে মিথ্যা বিজয়ী হলে ইসলাম বাঁচে না। মিথ্যাই হলো শয়তানের মূল অস্ত্র। শয়তান সে মিথ্যার অস্ত্র প্রথম প্রয়োগ করে আদি পিতা হযরত আদম (আ:)’র উপর। মিথ্যা বয়ানে শয়তান হযরত আদম (আ:)কে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফ্ল খেতে প্রলুব্ধ করেছিল। তাই শুরু থেকেই ইসলামের মূল যুদ্ধটি হলো মিথ্যার নির্মূলে। তাই জাতিকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে হলে মিথ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তীব্রতর করতে হয়। শয়তানের লক্ষ্য: ধর্ম, ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে মিথ্যার বিজয়। এজন্যই ইসলামের পবিত্র জিহাদ শুধু রণাঙ্গণে শত্রু নিধন নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি জিহাদ হয় বুদ্ধিবৃত্তি ও ইতিহাসের অঙ্গণ থেকে মিথ্যার নির্মূল। এ জিহাদের লক্ষ্য, ইসলামের বয়ানে, ইতিহাস রচনায় ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল্যায়নে সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। প্রতিষ্ঠা দিতে হয় সত্যকে সত্য রূপে; নির্মূল করতে হয় মিথ্যাকে। এখানে মিথ্যাচার হলে দূষণ ঘটে বিবেকের ভূমিতে। তখন খুনি, ধর্ষক, দস্যু, শত্রু এবং শত্রুর দেশী-বিদেশী মিত্রগণ বরেণ্য বীর ও মাননীয় গণ্য হয়।
সাপ, শকুন, গরু, পুতুল, পাহাড়-পর্বত যেভাবে ভগবান রূপে কোটি কোটি হিন্দুর মনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার পিছনে কোন নবী বা রাসূলের ধর্মবানী নাই। বরং তার ভিত্তি হলো যুগ যুগ ধরে চলে আসে ধর্মের নামে আদিম মিথ্যাচার। কোন একটি মিথ্যা হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকলে মিথ্যার পক্ষে সেটিই বড় দলিল হয়ে দাঁড়ায়। বেঁচে থাকার সে সামর্থ্যকেই মিথ্যার পক্ষে প্রমাণ রূপে পেশ করা হয়। এজন্যই শত্রু পক্ষের এজেন্ডা হয় ইতিহাসের বইয়ে মিথ্যার প্লাবন বইয়ে দেয়া এবং সে মিথ্যাকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখা। তখন মিথ্যাও কোটি কোটি মানুষের মগজে স্থান করে নেয়। খেয়াল খুশিমত মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার এটিই হলো সহজতম উপায়। ভারতর হিন্দুত্ববাদী বিজিপি সরকার তাই ভারতের ইতিহাস পাল্টাতে লেগেছে। তারা দেখাতে চাচ্ছে ভারতে ইতিহাসে মুসলিমদের কোন অবদান নাই। তারা ছিল বহিরাগত ও অত্যাচারী। এভাবে প্রমাণ করতে চায় ভারতে মুসলিমদের কোন স্থান নাই। এভাবে দলিল তৈরি করা হচ্ছে মুসলিম নির্মূলের। তেমনি ভারতসেবী বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের দাবী, দেশটিতে বসবাসের অধিকার একমাত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের। তাই যারা ইসলামের কথা বলে এবং ১৯৭১’য়ে যারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তাদেরকে বাংলাদেশ ছাড়তে বলে।
বাংলাদেশে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে। ইসলামপন্থীগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু –সে মিথ্যাটি প্রতিষ্ঠা দিতে ইতিহাস রচনার নামে ভূয়া দলিল তৈরি করা হচ্ছে। এ অভিযোগে তাদের নির্মূলের পক্ষেও যুক্তি পেশ করা হচ্ছে। এভাবে একাত্তরের ইতিহাস পরিণত হয়েছে বাংলাদেশীদের মাঝে সংঘাতের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার হাতিয়ারে। জাতীয় ফুল ও জাতীয় ফল রয়েছে। তেমনি জাতীয় মিথ্যা রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তিরিশ লাখ নিহতের মিথ্যাটি। একাত্তরের সংঘাতকে তীব্রতর এবং সে সাথে সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই এ মিথ্যাকে জাতীয় মিথ্যায় পরিণত করা হয়েছে। ইসলামপন্থীগণ যেহেতু একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়েছিল, পাকিস্তানের অপরাধকে বিশাল করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে চিত্রিত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের কলোনী রূপে। প্রশ্ন হলো, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কি করে পাকিস্তানের কলোনী হলো সে ব্যাখ্যা কি তারা কখনো দিয়েছে? কলোনিয়ালিজমের নিজস্ব প্রক্রিয়া আছে। কোন দেশকে কলোনী বানাতে হলে সে দেশ দখলে নিতে প্রথমে যুদ্ধ লড়তে হয়। তেমন একটি যুদ্ধ করতে ইংরেজগণ পলাশীতে হাজির হয়েছিল। কিন্তু বলা হয়না, পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোন রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছিল? বলা হয় না, পূর্ব বাংলা পাকিস্তান ভূক্ত হয়েছিল বাঙালি মুসলিমদের ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। একথাও বলা হয় না, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল অবধি যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ২৩ বছর পূর্ব পাকিস্তানে দখল জমাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কতজন বাঙালিকে হত্যা করেছে? একথাও বলে না, ২৩ বছরে কতজন বাঙালি মহিলা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হয়েছে। অথ চ তখন পূর্ব পাকিস্তানে অনেকগুলি ক্যান্টনমেন্ট ছিল। সেখানে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাস করতো। বাঙালি নির্মূল ও বাঙালি রমনীদের ধর্ষণই যদি তাদের এজেন্ডা হতো তবে একাত্তরের যুদ্ধ শুরুর আগেই ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ অবধি ২৩ বছরে বহু বাঙালি নিহত ও ধর্ষিত হতো। আরো প্রশ্ন থাকে, পূর্ব পাকিস্তান যদি পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনীই হয়ে থাকে তবে কলোনীতে জন্ম নেয়া দুই জনকে কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ও তিন জনকে প্রধানমন্ত্রী বানালো? ১৯০ বছর যাবত বাংলা ব্রিটিশের কলোনী ছিল। এ কলোনী থেকে কি একজন বাঙালিকেও ব্রিটিশগণ তাদের প্রধানমন্ত্রী বা ক্ষুদ্রতম একজন মন্ত্রীও বানিয়েছে? কলোনীবাসীর কি সে মর্যাদা থাকে? কি বিস্ময়! মিথ্যাকে জন্ম দিতে এবং সে মিথ্যাকে বাঁচাতে ইতিহাসের বইয়ে কত মিথ্যারই না জন্ম দেয়া হয়েছে!
একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে বাঙালি ফ্যাসিস্টদের আরেক প্রকান্ড মিথ্যা হলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের বিজয়টি অর্জন করেছে নাকি মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় সেনা বাহিনীর নাম সচরাচর নেয়না। অথচ ১৯৭১’য়ে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় সেনা বাহিনীর যুদ্ধ শুরুর আগে মুক্তিবাহিনী কোন একটি জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দখলে নিতে পারিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তখন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সৈন্য ছিল মাত্র ৪৫ হাজার। এর বিপরীতে পূর্ব রণাঙ্গণে ভারতের সৈন্য ছিল কয়েকগুণ অধিক।
মিথ্যার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও নাশকতা
তিরিশ লাখ বাঙালির নিহতের কাহিনীর পিছনে পরিকল্পিত ভাবে কাজ করেছে একটি গুরুতর অসৎ এজেন্ডা। ইসলাম চায় মানুষকে সত্যবাদী করতে। শয়তান চায় মানুষকে মিথ্যাবাদী করতে। মিথ্যাই পাপের পথ খুলে দেয়। নবীজী (সা:) এজন্যই মিথ্যাকে পাপের মা বলেছেন। শয়তানের লক্ষ্য, বাংলাদেশীদের মিথ্যুকের জাতিতে পরিণত করা। মুর্তিপূজারীর বদলে মিথ্যাপূজারী বানানোতে শয়তানের লাভ কি কম? দুটোই তাই জাহান্নামের পথ। ইসলামের দুশমনিতে মুর্তিপূজারী হিন্দু ও মিথ্যাচারী বাকশালীগণ উভয়ই সমান। উভয়ের কোয়ালিশন ইসলামীপন্থীদের নির্মূলে ও ইসলামের বিজয় রোধে। বাংলাদেশে মিথ্যাচারী বানানোর শয়তানী প্রকল্প যে অতি সফল হয়েছে সেটি বুঝা যায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাল প্রফেসর বিবৃতি দিয়ে শেখ হাসিনাকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত বৈধ মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বলে। এর চেয়ে বড় চারিত্রিক ভ্রষ্টাচার আর কি হতে পারে? বঙ্গীয় ভূমিতে শয়তানের এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিজয়।
মিথ্যুকের পক্ষে অসম্ভব হয় ঈমানদার বা মুসলিম হওয়া। মুসলিম হওয়ার পূর্বশর্ত হলো মিথ্যা পরিহার করে সত্যবাদী হওয়া। মিথ্যুকের পক্ষে অসম্ভব হলো সভ্য ও ভদ্র মানুষ হওয়া। এবং সেটির প্রমাণ মেলে সম্প্রতি শেখ হাসিনার দেয়া সাম্প্রতিক এক বক্তৃতা থেকে। উক্ত বক্তৃতায় শেখ হাসিনা প্রফেসরকে ইউনুসকে পদ্মার পানিতে চুবানো এবং খালেদা জিয়াকে পদ্মার ব্রিজ থেকে ঠুস করে ফেলে দেয়ার কথা বলেছে। এটিই হলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের নিরেট অসভ্যতা ও অভদ্রতার নমুনা। শেখ হাসিনা এরূপ স্বভাব বন-জঙ্গল ও গরুর গোয়াল থেকে পায়নি। পেয়েছে কীটের ন্যায় আওয়ামী মিথ্যাচারের নর্দমায় বেড়ে উঠার কারণে। এমন অসভ্য ও অভদ্র চরিত্রের অসংখ্য মানুষ গিজ গিজ করে আওয়ামী শিবিরে। এরাই বাংলাদেশের বুকে চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরন ও সন্ত্রাসের জোয়ার এনেছে।
পাথরের উপর যেমন বীজ গজায় না, তেমনি ইসলামের সত্য বাণী গজায় না মিথ্যুকের মনে। মিথ্যুকের পক্ষে যা সহজ ও স্বাভাবিক তা হলো, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে শয়তানের সৈনিক হওয়া। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামতটি হলো হিদায়েত। যে ব্যক্তি হিদায়েত পায়, একমাত্র সেই জান্নাত পায়। করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ এই নিয়ামতকে কখনোই কোন পাপীষ্ট মিথ্যুককে দিয়ে পুরস্কৃত করেন না। মিথ্যুকদের হিদায়েত না দেয়াই মহান আল্লাহতায়ালার নীতি। পবিত্র কুর’আনে সে হুশিয়ারী বার বার শোনানো হয়েছে। তাদের জন্য যা ধার্য তা হলো জাহান্নামের আগুন। এবং সেটি অনন্ত কালের জন্য। হিদায়েত যে দেন না –সে প্রমাণ তো অনেক। হিদায়েত না পাওয়ার কারণে ইসলামের পক্ষে খাড়া হওয়ার সামর্থ্য মিথ্যুকদের থাকে না। মিথ্যাবাদীদের পক্ষে অসম্ভব হয় সভ্য ও নীতিবান মানুষ হওয়াও। ফলে এরাই হয় চোরডাকাত, ভোটডাকাত, সন্ত্রাসী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী ও গুম-খুনের রাজনীতির নেতাকর্মী। মিথ্যুকের পক্ষে ঈমানদার হওয়া অসম্ভব। নামাজ পড়তে হলে ওজু করতে হয়। তেমনি মুসলিম হতে হলে সত্যবাদী হতে হয়। বান্দার জন্য একমাত্র তখনই নিয়ামতের দরজা খুলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ মিথ্যা পরিত্যাগ করা এবং সত্যবাদী হওয়া সরকারি ভাবেই অসম্ভব করা হয়েছে। কারণ প্রতিটি স্কুল ছাত্র বা ছাত্রীর উপর তিরিশ লাখ নিহতের কথাটি বিশ্বাস করা সরকারি ভাবে বাধ্যতামূলক। পরীক্ষার খাতায় সে মিথ্যাটি না লিখলে পাস জুটে না। এ মিথ্যাটি স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইয়ের অংশ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিরিশ লাখের পক্ষে বক্তৃতা না দিলে দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। এবং সে মিথ্যাকে মিথ্যা বললে দেশদ্রোহী বলে আদালতে তোলা হয়।
মিথ্যাচারীতার আরেক অভিশাপ হলো, এটি কেড়ে নেয় সত্যকে খুঁজে বের করার স্পৃহা। তাই যেসব মিথ্যাবাদীগণ রামকে ভগবান বা যীশুকে গড রূপে বিশ্বাস করে তারা কখনোই এ কথা জিজ্ঞাসা করে না, মানবের গর্ভে কীরূপে ভগবান বা গডের জন্ম হলো? গাঁজার প্রকোপে হুশ পুরাপুরি বিলুপ্ত হলে এরূপ মিথ্যা কথা কেউ বলতে পারে না। কোটি কোটি নক্ষত্র ও গ্যালাক্সীর মহাশক্তিমান স্রষ্টাকে নিয়ে মিথ্যা যে নিয়ে কত জঘন্য কুৎসিত ও ভিত্তিহীন হতে পারে -এ হলো তার নজির। মিথ্যুকদের চিন্তা-ভাবনায় রুচি থাকে না। সেটি বুঝা যায় একাত্তরে ৩০ লাখ নিহতের কাহিনীতে যারা বিশ্বাস করে তাদের দিকে নজর দিলে। তারা আদৌ ভাবে না, তিরিশ লাখ নিহত হতে যুদ্ধকালীন ৯ মাসের প্রতিদিন ১১ হাজারের বেশী মানুষকে নিহত হতে হয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। তাই ৩০ লাখ নিহত হতে হলে প্রতি ২৫ জনে একজনকে মারা যেতে হয়। একজন স্কুল ছাত্রও সেটি হিসাব করে বের করতে পারে। কিন্তু প্রতি ২৫ জনে একজনের মৃত্যু কীরূপে সম্ভব? সেটি হলে যে গ্রামে ১ হাজার লোকে বাস সে গ্রামে কম পক্ষে ৪০ জনকে মারা যেতে হয়। উক্ত গ্রামে কেউ মারা না গেলে পাশের গ্রামে ১ হাজার লোক থাকলে ৮০ জনকে মারা যেতে হবে। বাংলাদেশ প্রায় ৬৮ হাজার গ্রাম। বাংলাদেশ নদ-নদী, বিল-হাওরে ভরা দেশ। সবগুলো গ্রামে পৌঁছা কি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন ৪৫ হাজার যুদ্ধরত সৈন্যের পক্ষে সম্ভব ছিল? গ্রামে গ্রামে ঘুরলে সীমান্তে যুদ্ধ করলো কারা? দেশ জুড়ে জরিপ করলে এ মিথ্যা মারা পড়বে –এ ভয়ে মিথ্যার রচিয়েতাগণ নিহতদের সংখ্যার উপর আজ অবধি কোন জরিপ চালায়নি। ফ্যাসিস্টদের কাজ শুধু মানব হত্যা ও গণতন্ত্র হত্যা নয়, বরং জীবিত মানুষদের বিবেক হত্যাও। আওয়ামী ফ্যাসিস্টগণ বাংলাদেশের জনগণের বিবেক হত্যায় যে কতটা সফল হয়েছে –সেটি দেশ জুড়ে চলা তিরিশ লাখের মিথ্যার প্লাবনই বলে দেয়।
প্রাসাদ গড়তে হলে ভাল ইট লাগে। তেমনি সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র গড়তে সভ্য মানব লাগে। সভ্য মানব রূপে গড়ে উঠতে হলে সত্যবাদী হওয়া লাগে। হযরত আলী (রা:) বলেছেন: মানুষের ব্যক্তিত্ব তার জিহ্বাতে। মিথ্যুকেরা তাই ব্যক্তিত্বহীন এবং চরিত্রহীন হয়। তাই মিথ্যুকদের দিয়ে আর যাই হোক সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র গড়া যায় না। সম্পদ লুণ্ঠিত হলে মানুষের এতো ক্ষতি হয়না, যতটা ক্ষতি হয় মানুষ মিথ্যুকে পরিণত হলে। মিথ্যুক মাত্রই পাপাচারী। এবং পাপের জন্ম মিথ্যা থেকে। মানব জাতির পুরা ইতিহাসটি হলো, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের জিহাদের। এজন্যই শয়তানের এজেন্ডা মানুষকে শুধু মুর্তিপূজারী বা আল্লাহতায়ালাতে অবিশ্বাসী করানো নয়, বরং মিথ্যুকে পরিণত করা। আর বাংলাদেশের বুকে শয়তানের সে এজেন্ডাকে সফল করার দায়িত্ব নিয়েছে ভারতসেবী বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ।
মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে পাকিস্তানীদের অবশ্যই তাদের কৃত অপরাধের হিসাব দিতে হবে। কিন্তু তাতে তো বাঙালিদের অপরাধ মাফ হবে না। বাঙালিদের রচিত ইতিহাসের লক্ষণীয় দিকটা হলো, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অপরাধগুলিকে বিশাল আকারে দেখালো হলেও দেখানো হয়না নিজেদের অপরাধগুলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী প্রায় ৬ লাখ বিহারীর প্রত্যেকের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থসম্পদ কেড়ে নিয়ে বস্তিতে পাঠানো হয়। এরূপ নৃশংস অপরাধ রোহিঙ্গাদের সাথেও হয়নি। এখনো ৭ বা ৮ লাখ রোহিঙ্গা মায়ানামারে নিজ ঘরে বাস করে। কিন্তু সে ভাগ্য বাংলাদেশে একজন বিহারীরও হয়নি। একাত্তরে বহু হাজার বিহারী নারী, শিশু ও পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার বিহারী নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু সে বর্বরতার উল্লেখ বাঙালির রচিত ইতিহাসের বইয়ে মেলে না। অপরাধটি এখানে সত্য লুকানোর। খুনি, ধর্ষক ও লুটেরাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার স্বার্থেই তাদের কুকীর্তীগুলো লুকানো হয়েছে।
একাত্তরের ইতিহাসে মিথ্যা ঢুকানো হচ্ছে বাঙালিদের প্রতিশোধ পরায়ন হিংস্র জীব রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে। ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে পাকিস্তানীরা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে -এ কথা শ্রবন করার পর যে কোন বাঙালির ক্রোধ বাড়বে এবং প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী হবে। পাকিস্তানী কোন সৈন্য এখন বাংলাদেশে বাস করে না। যখন ছিল তখন কোন পাকিস্তানী সৈনিককে শাস্তি দিতে পারিনি। কিন্তু লক্ষ লক্ষ এমন মানুষ রয়েছে যারা একাত্তরে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ৩০ লাখ নিহতের মিথ্যাটি বলার লক্ষ্য, বাঙালিগণ প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ুক তাদের হত্যায় যারা একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারও সেটিই চায়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী হিন্দুগণ সেটিই করছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের মিথ্যাগুলি হলো: মুসলিমগণ বিদেশ থেকে আগত দস্যু, মুসলিম শাসনামলে তারা হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করেছে, হিন্দুদের ঘর লুট করেছে, মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ গড়েছে এবং হিন্দুদের ভূমি কেড়ে নিয়ে তাজমহলের মত বহু সৌধ বানিয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ভারতীয় মুসলিমদের পাকিস্তানের দালাল রূপে চিত্রিত করা হয়। রাজপথে হিন্দুত্ববাদীরা স্লোগান দেয়: “মুসলমানো কি লিয়ে দো স্তান: পাকিস্তান ইয়া কবরস্তান।” অর্থ: মুসলিমদের জন্য দুই স্থান: হয় কবরস্থান নয় পাকিস্তান। এভাবেই হিন্দুত্ববাদীগণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে হিন্দুদের রাস্তায় নামিয়েছে। এরাই মুসলিমদের রাস্তা-ঘাটে দাড়ি ধরে টানে, মসজিদ ভাঙ্গে এবং মুসলিমদের গৃহে ও দোকানে আগুন দেয়। বাংলাদেশের বুকেও ভারতসেবীগণ আওয়ামী ফ্যাসিস্টগণ ইসলামপন্থীদের বাঙালির শত্রু ও স্বাধীনতার শত্রু রূপে চিত্রিত করছে। তাদের কোন রাজনৈতিক অধিকার দিতে রাজী নয়। এভাবে হিন্দুস্থানের ন্যায় বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আরেক হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে। ভারত এমন একটি লক্ষকে সামনে রেখেই ১৯৭১’য়ে বিপুল বিনিয়োগে যুদ্ধ করেছিল। এখন তার ফসল তুলছে।
মানুষ যা বিশ্বাস করে বা কল্পনা করে -সেটিই ইতিহাস নয়। ইতিহাস তো তাই যা বাস্তবে ঘটে তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ। ইতিহাস তো তখনই কল্যাণ দেয় যখন সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা এবং ষড়যনন্ত্রকে ষড়যন্ত্র বলা হয়। এবং মিত্রকে মিত্র এবং শত্রুকে শত্রু রূপে দেখার সামর্থ্য দেয়। ইতিহাসের পাঠের লক্ষ্য তো লাগাতর প্রকৃত সত্যকে আবিস্কার করা। কিন্তু বাংলাদেশ সে কাজটি হয়নি। বাংলাদেশে অত্যাধিক দূষণ হয়েছে ইতিহাসের বইতে। ফলে বাংলাদেশীগণ ব্যর্থ হচ্ছে দেশের প্রকৃত বন্ধু ও শত্রুকে চিনতে। বরং ইতিহাস পরিণত হয়েছে প্রপাগান্ডার হাতিয়ারে। তাই ইতিহাসের বই পরিণত হয়েছে নাশকতার অস্ত্রে।
ব্যহত হচ্ছে সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ
ঈমানদারকে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের সামর্থ্য থাকলে চলে না। থাকতে হয়, সত্য ও ন্যায়কে ভালবাসা ও অপরাধীদের ঘৃণা করার সামর্থ্য। এটি মানবের শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। এ সামর্থ্য হিদায়েতের পথ খুলে দেয়। মিথ্যাকে ঘৃণা ও সত্যকে ভালবাসার সামর্থ্য একত্রে চলে। নবীজী (সা:)’র আমলে যারা আরব সমাজের চলমান দুর্বৃত্তি ও পাপাচারকে ঘৃণা করার সক্ষমতা রাখতো তারাই সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেন। তাই প্রশ্ন হলো, যারা বাকশালী মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রহত্যাকারী স্বৈরাচারী বাকশালী ফ্যাসিস্টকে জাতির পিতা ও বন্ধু বলে এবং ভোটডাকাত শেখ হাসিনার ন্যায় নৃশংস ফ্যাসিস্ট ভোটডাকাতকে মাননীয় ও সম্মানিত বলে, তারা কি আদৌ ঈমানদার হতে পারে? তারা কি সভ্য মানুষ হওয়া ও সভ্য সমাজ নির্মাণের সামর্থ্য রাখে? এরূপ মিথ্যাচার তো নৃশংস ও অসভ্য চেতনার প্রতীক। বাংলাদেশে এমন অসভ্য চেতনার মানুষের সংখ্যা বেশী বলেই সভ্য সমাজ নির্মাণের কাজটি চরম ভাবে ব্যহত হচ্ছে। অপরাধীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ তাকে সমর্থন করা। শুধু দেব-দেবীকে পূজা দেয়ার কারণে কেউ কাফির হয় না, কাফির হয় পৌত্তলিকতাকে সত্য ধর্ম বলে সমর্থন দেয়াতে। সমর্থণের মধ্য দিয়েই চেতনা ও বিবেক কথা বলে। তাই পৌত্তলিকতার ন্যায় আদিম অজ্ঞতা ও পাপাচারকে যারা ধর্মের মর্যাদা দেয় তাদের পক্ষে অসম্ভব হয় ঈমানদার হওয়া। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, ধর্ষণ বা চুরি-ডাকাতির কারণে নয়, বরং কাফির , দুর্বৃত্ত ও ইসলামের শত্রুদের সমর্থন করার কারণে।
সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র শুধু চাষাবাদ, পশুপালন, ব্যবসা-বানিজ্য ও শিল্পে গড়ে উঠে না। বাঘ-ভালুকের ন্যায় হিংস্র পশুদের বধের সামর্থ্যও থাকতে হয়। তেমনি ঈমানদারকে বাঁচতে হয় ন্যায় ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা এবং চোরডাকাত, ভোটডাকাত ইত্যাদি দুর্বৃত্তদের নির্মূলের অঙ্গীকার নিয়ে। ফলে তাদের সম্মানিত বা মাননীয় বলার সুযোগ কোথায়? কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ সে সাহস ও সামর্থ্য দেখাতে পারিনি। তারা বরং ইতিহাস গড়েছে দুর্বৃত্ত শাসকের কাছে আত্মসমর্পণে। এখানেই সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের পথে বড় বাধা। যে কোন সভ্য দেশে পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আদালতের কাজ হয় দেশবাসীর জানমাল, ভোট ও মৌলিক অধিকারের পাহারা দেয়া। কিন্তু সেটিও তারা তা দিতে পারিনি। তারা বরং পাহারাদারে পরিণত হয়েছে গণবিরোধী ভোটডাকাত স্বৈরাচারী শাসকের।
প্রতিটি অপরাধই শাস্তি যোগ্য। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে শরিষার দানা পরিমাণ অপরাধেরও বিচার হবে। সে হুশিয়ারি বার বার এসেছে পবিত্র কুর’আনে। গুরুতর অপরাধ করেও রাষ্ট্রের পুলিশ ও আদালতকে ফাঁকি দেয়া যায়, কিন্তু সর্বদ্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালাকে কি ফাঁকি দেয়া যায়? অপরাধের শাস্তি যে শুধু আখেরাতে মিলে তা নয়, দুনিয়াতেও মেলে। আদ ও সামুদ জাতি ও লুত (আ:)’য়ের কওমকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ফিরাউনকে তার বাহিনীসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসব শাস্তিই ছিল তাদের অর্জিত আযাব। এছাড়া তাদের জন্য রয়েছে অন্তহীন আখেরাতের শাস্তি। সুরা নিসার ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তুমি যা কিছু উত্তম পাও সেটি পাও আমার পক্ষ থেকে, এবং তোমাকে যা কিছু খারাপ আঘাত হাতে –তা হলো তোমার নিজ হাতের কামাই।” যে কোন ঘটনার ন্যায়, বাংলাদেশে আজকের পরিস্থিতিরও মূল্যায়ন করতে হবে পবিত্র কুর’আনের উপরুক্ত আয়াতের আলোকে।
আজ বাংলাদেশে চলছে ভারতের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার অসভ্য ও নৃশংস শাসন। এ সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। এসেছে দিনের ভোট রাতে ডাকাতি করে। ডাকাতগণ কখনোই ভদ্র ভাবে দেশ শাসন করে না। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় না আসায় জনগণের প্রতি তাদের কোন জবাবদেহীতা ও দায়বদ্ধতা নাই। তারা বরং জনগণের ভোটের দোয়ারে না গিয়ে আবার সফল ডাকাতির পথ খোঁজে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রেখেছে গুম-খুন-সন্ত্রাসের রাজনীতি, মানবাধিকারের বিলুপ্তি, বিলুপ্ত আইনের শাসন এবং রিম্যান্ডে নিয়ে পুলিশী নির্যাতনের মাধ্যমে। এভাবে অসম্ভব করা হয়েছে সভ্য জীবন-যাপন। এবং রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তশাসিত কারাগারে। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলাও এদেশে অপরাধ। এটি এক দুঃসহ আযাব। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম না হলে গাছের পাতা নড়ে না। তাই তার হুকুম না হলে এতবড় নৃশংস শাসন আসে কীরূপে? এরূপ নৃশংস স্বৈরাচারী শাসন কি কখনো নিয়ামত হতে পারে? এটি যে অর্জিত আযাব -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? নেক শাসক যেমন মহান আল্লাহতায়ালার অন্যতম নিয়ামত, তেমনি জালেম শাসককে চাপানো হয় আযাবের হাতিয়ার রূপে।
একটি জনগোষ্ঠিকে দুইটি অবস্থার একটিকে ধারণ করে বাঁচতে হয়। একটি হলো, বিজয়, সম্মান, সুনীতি ও শান্তির জীবন। এরূপ জীবন নিয়ামতের। অপরটি পরাজয়, অপমান, অশান্তি ও দুর্বৃত্তির জীবন। এরূপ জীবন আযাবের। নিয়ামত ও আযাব –এ দুটি অবস্থাই মানুষের নিজ হাতের কামাই। এ জমিনে মহান আল্লাহতায়ালা কোন আযাবই এমনিতেই দেন না, আসে বান্দার কৃত অপরাধের শাস্তি স্বরূপ। অপর দিকে নিয়ামত আসে সুকর্মের পুরস্কার স্বরূপ। তাই আযাব দেখলেই বুদ্ধিমানের কাজ হয় আযাবের কারণ খোঁজা। প্রশ্ন হলো, বাঙালি মুসলিমের কি সে অপরাধ -যা আজকের এই আযাবকে অনিবার্য করলো? সেটি জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইতিহাসের দিকে নজর দেয়া এবং অতীতের কৃত কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ অডিট তথা পর্যালোচনা করা। এবং অতীতের ভূলগুলি থেকে শিক্ষা নেয়া। এবং যারা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় ও নিজেদের পরিশুদ্ধ করে নেয়, তারাই তো নিয়ামত পায়। অতীত ইতিহাস নিয়ে এরূপ গবেষণা হলো ইতিহাস বিজ্ঞান। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো এই ইতিহাস বিজ্ঞান। ইতিহাস হলো অতীতের পোস্টমর্টেম -যা দেয় সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় ব্যাধির পাথোলজিকাল রিপোর্ট। এ বিজ্ঞান অতীতের ভূলগুলি থেকে বেঁচে সভ্যতর হওয়ার ও সফল হওয়ার পথ দেখায়। এভাবে পথ দেখায় বিপর্যয় থেকে বাঁচার।
কিন্তু সে ইতিহাস বিজ্ঞানের অঙ্গণে মিথ্যাদূষণ হলে বিপর্যয় অনিবার্য। যেমন বিপর্যয় হয় ঔষধে ভেজাল হলে। মিথ্যাদূষণের ফলে পাঠক ব্যর্থ হয় ইতিহাস থেকে সঠিক শিক্ষা নিতে। বাংলাদেশীগণ সে বিপর্যয়ের পথটিই বেছে নিয়েছে। বিকৃত ইতিহাস তাদের বিপর্যয়ই বৃদ্ধি করছে। রোগভোগ যেমন শরীরের বেড়ে উঠাকে ব্যাহত করে, স্বৈরাচারী শাসক তেমনি ব্যাহত করে জাতির বেড়ে উঠাকে। সেটি ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন ও ইতিহাসে মিথ্যার দূষণ ঘটিয়ে। বুঝতে হবে, স্বৈরশাসক মাত্রই নৃশংস ঘাতক শক্তি। কিন্তু বহু বাঙালি ব্যর্থ হয়েছে তাদের জঘন্যতম শত্রুকে চিনতে। সে ব্যর্থতার কারণে তারা নিজেরাই শত্রুর সৈনিকে পরিণত হয়েছে।
বাঙালি মুসলিমের ঐতিহাসিক ব্যর্থতা
বাংলাদেশে আজ যে নৃশংস ফ্যাসিবাদী শাসনের আযাব, সেটি বাঙালির চাষাবাদ, পশুপালন, বাণিজ্য ও শিল্পের অঙ্গণে ব্যর্থতার কারণে নয়। সে ব্যর্থতার শুরু দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণ থেকে। রাজনীতির অঙ্গণে ঘটেছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। প্রতিটি বিদ্রোহই শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ। বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে চলছে ইসলামের বিরুদ্ধে লাগাতর যুদ্ধ। জনগণের ঈমানী দায়িত্ব হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবচেয়ে উত্তম ও মোত্তাকী ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করা। প্রতিটি নাগরিকের উপর এ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক দায়িত্ব। কাউকে ভোট দেয়ার অর্থ তার সততা ও যোগ্যতার প্রতি সাক্ষ্য দেয়া। ঈমানদার তাই কখনোই কোন দুর্বৃত্ত ও বেঈমানের পক্ষে সাক্ষি দেয় না। এটি হারাম। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই ভোটে দুর্বৃত্তকে বিজয়ী করার অপরাধে আযাব অনিবার্য হয়। তখন জনগণের ঘাড়ে সে আযাব চেপে বসে নৃশংস ও দুর্বৃত্ত শাসকের বেশ ধরে। বস্তুত সে আযাবের মধ্যেই বাংলাদেশের আজকের জনগণ।
নেশাখোর, মদ্যপ, দুর্বৃত্ত ও প্রতারক গাড়ির যাত্রী হতে পারে, চালক নয়। চালক সুস্থ হলে সকল যাত্রী মাতাল হলেও গাড়ি সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে। কিন্তু চালক মদ্যপ হলে যাত্রীদের দোয়া-দরুদে কাজ দেয় না। তাই গণতন্ত্রের শত্রু, বিদেশের দালাল, নৃশংস ফ্যাসিস্ট ও দুর্বৃত্তকে রাষ্ট্রের চালকের সিটে বসালে বিপর্যয় অনিবার্য। তাই এরূপ কোন দুর্বৃত্তকে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসানো পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। এটি কবিরা গুনাহ। এমন দুর্বৃত্ত শাসকের পক্ষ নেয়াও অপরাধ। বরং শ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো জালেম শাসকের বিরুদ্ধে হক কথা বলা ও তার উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়ে জিহাদে নামা। অর্ধেকের বেশী সাহাবা সে জিহাদে শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সা:)’র আমলে রাষ্ট্র প্রধানের আসনে বসেছেন খোদ নবীজী (সা:)। তাঁর ইন্তেকালের পর সে আসনে বসেছেন হযরত আবু বকর (রা:), হযরত উমর (রা:), হযরত উসমান (রা:) ও হযরত আলী (রা:)’র ন্যায় নবীজী (সা:)’র শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ। কিন্তু বাঙালি মুসলিমগণ মহান নবীজী (সা:)’র সে সূন্নত আদৌ ধরে রাখতে পারেনি। গুরুতর অপরাধ হয়েছে এ সূন্নত অমান্য করার মধ্য দিয়ে। বাঙালি মুসলিমের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা ভয়ানক ভ্রান্ত পথে চলা শুরু করেছে বস্তুত সে সূন্নত বিলুপ্ত হওয়াতে।
শাসকের যে আসনে বসেছেন খোদ মহান নবীজী (সা:), সে আসনে অতীতে বাঙালি মুসলিমগণ নিজেদের ভোট দিয়ে বসিয়েছে শেখ মুজিবের ন্যায় ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য, গণতন্ত্র হত্যাকারী, ফ্যাসিবাদী এবং ভারতীয় স্বার্থের এক সেবাদাসকে। তাই বাংলাদেশে আজ শেখ হাসিনার যে অসভ্য ও নৃশংস শাসনের তান্ডব, সেটির বীজ জনগণ নিজ হাতে বপন করেছিল ১৯৭০ সালে মুজিবের ন্যায় ফ্যাসিস্টকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। শেখ মুজিব ও তাঁর সহচরগণ হঠাৎ করে ১৯৭২ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে গণতন্ত্রের হত্যাকারী ফ্যাসিস্ট ও ইসলামের শত্রুতে পরিণত হয়নি। সে রোগ তার রাজনীতিতে বহু পূর্বেই প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচন কালে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নূরুল আমিনের পিডিপ ইত্যাদি দলগুলির জনসভাকে শেখ মুজিব শান্তিপূর্ণ ভাবে হতে দেয়নি। নির্বাচনে ছিল জাল ভোটের বিপুল ছড়াছড়ি। মুজিব ও তাঁর দলের সেরূপ আচরণটি ছিল গণতন্ত্র বিরোধী নিরেট ফ্যাসিবাদ। জনগণ মুজিবের সে ফ্যাসিবাদ দেখেও না দেখার ভান করেছে এবং তাকে বিপুল সংখ্যায় ভোট দিয়েছে। অথচ সে সময় এমন বহু নেতা ছিল যারা মুজিবের ন্যায় ফ্যাসিবাদী, ভোটডাকাত ও ভারতের সেবাদাস ছিল না।
মুজিবের হাতে ফ্যাসিবাদের যে বীজ পাকিস্তান আমলে বপন করা হয়েছিল আজ সে বীজ বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে ইতিহাস পড়ানো হয়না। বাংলাদেশের জনগণ আজ ফ্যাসিবাদী অসভ্য শাসনের কাছেই আত্মসমর্পিত। এ দুর্বৃত্ত-শাসনের নির্মূলে তাদের জীবনে কোন জিহাদও নাই। এবং সে জিহাদে রুচিও নাই। অথচ মু’মিনের জীবনে জিহাদ ও ঈমানের শিখা একত্রে জ্বলে। ঈমান ঝিমিয়ে পড়লে জিহাদও বিলুপ্ত হয়। এবং ঈমানে জোয়ার এলে জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে। মুসলিম ভূমিতে তখন সভ্য রাষ্ট্র ও সভ্য সভ্যতা নির্মিত হয়। মানব জীবনে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। অথচ সে কাজে বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতাটি বিশাল। ফলে বাংলাদেশে নির্মিত হচ্ছে নানারূপ ব্যর্থতা ও দুর্বৃত্তির ইতিহাস। ১ম সংস্করণ ১৫/১২/২০২১; ২য় সংস্করণ ২৫.০৬.২০২২
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018