স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ ও ভারতীয় স্ট্রাটেজী
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on October 21, 2020
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
দেহে প্রাণ থাকলে যেমন রোগভোগের সম্ভাবনা থাকে, তেমনি কোন দেশের স্বাধীন মানচিত্র থাকলে শত্রুপক্ষও থাকে। তাই তেমন শত্রুপক্ষ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশেরও আছে। তবে কারা সে শত্রুপক্ষ সেটি বুঝতে হলে বাংলাদেশের ভৌগলিক প্রেক্ষাপট এবং সে সাথে ভারতের স্ট্রাটেজী বা রাজনীতিকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক প্রেক্ষাপট অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি থেকে ভিন্ন। মায়ানমারের সাথে সামান্য কয়েক মাইলের সীমান্ত ছাড়া তিন দিকেই ভারত। পার্শ্বে বা নিকটে কোন মুসলিম দেশ নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনভিজ্ঞ কোন অমুসলিমের কাছে দেশটির ভূগোল নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব এদের অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। বিষয়টিকে ইচ্ছা করেই আরো বিভ্রান্তিকর করা হচ্ছে ভারতে। ভারতের বিশাল ভূগোলের মাঝে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের অবস্থান সেদেশের স্কুল-ছাত্রদের কাছে উপস্থাপিত হয় এক বিরক্তিকর ও প্রশ্নবহ বিষয় রূপে। তাদের প্রশ্ন, কেমন করে তাদের বিশাল দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র বাংলাদেশ অস্তিত্ব পেল? এটি কি তাদের নিজেদের দূর্বলতা? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভারতীয় নাগরিক ও নতুন প্রজন্মদের জানানো হচ্ছে সম্পূর্ন ভিন্ন ও বিকৃত এক ইতিহাস, যার সাথে সত্যের কোন সংশ্রবই নেই।
বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ভারতের মুসলমানরা আজ যেভাবে হত্যা, নির্যাতন,বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা থেকে বাঁচবার তাগিদে। দেশটিতে মুসলমানেরা শতকরা ১৬ ভাগ হলেও সরকারি চাকুরিতে শতকরা ২ ভাগও নেই। উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান হলো এক কল্যানকর সৃষ্টি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলেই বাংলাদেশের ১৭ কোটি মুসলমান যে সংখ্যায় ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক অফিসার সৃষ্টি করেছে ভারতের ২০ কোটি মুসলমান তার সিকিভাগও সৃষ্টি করতে পারেনি। ২২ কোটি মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে করাচী ও লাহোরের ন্যায় মাত্র দু’টি শহরে যে পরিমাণ সম্পদ ও গাড়ি-বাড়ি দেখা যায় তার অর্ধেকও কি ভারতীয় মুসলমানের আছে? অথচ সে পাকিস্তানের জন্মকে চিত্রিত করা হচ্ছে সাম্প্রদায়ীক মুসলিম ও বৃটিশ ষড়যন্ত্রের ফসলরূপে। স্কুলের পাঠ্যবই, সিনেমা, পত্র-পত্রিকা, টিভি-সিরিয়াল, উপন্যাস ইত্যাদির মাধ্যমে এ বিকৃত ভাষ্যকে ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। ফলে শুধু পাকিস্তানেরই নয়, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকেও নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবহ ও অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এভাবে ভারতের সাধারণ নাগরিকদের কাছে অবৈধ ও ষড়যন্ত্র-মূলক এক অনাসৃষ্টি রূপে চিত্রিত হচ্ছে শুধু পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশও। সমাজের অবৈধদের প্রতি সচারচরই যেমন ঘৃণাবোধ থাকে, তেমনি এক তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও। এবং সেটি বুঝা যায় বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় নীতি বিশ্লেষণ করলে। পারস্পরিক সমতা, সম্পৃতি, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা প্রাধান্য পেলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় রাজনীতি, বাণিজ্যনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি কখনই এতটা বৈরী ও প্রতারণামূলক হত না। ভারতীয়দের বাংলাদেশ-বৈরী এমন আচরণ বুঝবার জন্য বেশী গবেষণার প্রয়োজন নেই, কয়েকটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট।
এক) একাত্তরের যুদ্ধের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত বহু হাজার কোটি টাকার সামরিক যানবাহন, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নৌযান ভারত কর্তৃক পুরাপুরি লুন্ঠিত হয় এবং তারা কিছুই রেখে যায়নি বাংলাদেশের জন্য। অথচ এ অস্ত্র শুধু পশ্চিম-পাকিস্তানীদের ছিল না। এ অস্ত্র কেনায় ব্যয় হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণেরও রাজস্বের অর্থ। তারাই ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। ফলে এ অস্ত্রের উপর নায্য অধিকার ছিল বাংলাদেশীদের, ভারতীয়দের নয়। কিন্তু ভারত বাংলাদেশীদের সে বৈধ অধিকার মেনে নেয়নি। বরং দস্যূ বাহিনীর ন্যায় ভারতীয় বাহিনী পরিকল্পিত ভাবে লুন্ঠন করেছে বাংলাদেশের এ সম্পদ। লক্ষ্য ছিল, সে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ নিজের প্রতিরক্ষা যেন মজবুত করতে না পারে।
দুই) দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মোতাবেক মুজিব সরকার ১৯৭৪এ বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাওনা তিনবিঘা ভারত বাংলাদেশকে সাথে সাথে দেয়নি।
তিন) মুজিব আমলে ভারত বাংলাদেশের কারেন্সি নোট ছাপানোর দায়িত্ব নেয়। যে পরিমাণ নোট ছাপতে দেয়া হয়েছিল তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশী নোট ছেপে কালো বাজারে ছেড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বহু বছরের জন্য সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দেয়। এবং আগমন ঘটায় এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষের।
চার) ১৯৭৫য়ে মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গা থেকে সর্বোচ্চ ১৬,০০০ কিউসেক পানি উত্তোলনের চুক্তি হয়। দীর্ঘকাল চুক্তি নবায়ন না করে ভারত অবিরাম অধিক পরিমাণে পানি সরিয়ে নেয়। ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে বহু হাজার কোটি টাকা।
পাঁচ) পদ্মার পানি অবিরাম লুন্ঠন করার স্বার্থে ভারত পানির দাবী করেছে তিন রকমের। ১৯৭৫য়ে ১৬,০০০, ১৯৭৭য়ে ৩০,০০০ এবং ১৯৯৬য়ে ৪৪,০০০ কিউসেক। এরূপ দাবীর মধ্যে ভারত এভাবে প্রকাশ ঘটিয়েছে তার এক স্বেচ্ছাচারি ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার।
ছয়) কিছু বছর আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের ভারত শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, তাদেরকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণও দিয়েছে। এভাবে ভারতের হাতে পরিকল্পিত ভাবে বিপন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ভৌগলিক সংহতি ও সার্বভৌমত্ব।
ভারতীয় বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠ্যবই এবং মিডিয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটিতে গড়ে উঠেছে এমন এক পাকিস্তান-বৈরী এবং সে সাথে বাংলাদেশ-বৈরী মানসিকতা -যার ফলশ্রুতিতে প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত ভারতীয়ই উনিশ শ’ সাতচল্লিশের পাক-ভারত বিভক্তিকে নিজেদের জন্য অভিশাপ এবং সে সাথে অগ্রহনযোগ্য মনে করে। তারা কাশ্মিরে ভারতীয় জবর দখল, দলন নীতি ও যুদ্ধের নামে ব্যাপক গনহত্যার যৌক্তিক ভিত্তি পেয়েছে এমনই এক বৈরী চেতনা থেকেই। ভারতীয় মানচিত্রের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থানের কারণে কাশ্মিরকে ভারতীয়রা নিজ দেশের মুকুট মনে করে। কাশ্মির ছাড়া ভারতের মানচিত্র পূর্ণাঙ্গ নয় এমনি এক ভাবনা দেয়া হয় এমনকি স্কুল ছাত্রদের। কাশ্মিরে নিহত হয়েছে লক্ষাধিক নারী-শিশু ও নিরীহ মানুষ। পঙ্গু হয়েছে অগণিত, ধর্ষিতা হয়েছে বহু হাজার এবং জ্বলছে হাজারো ঘরবাড়ী। কিন্তু এনিয়ে একটা “কুছ পরওয়া নেহী” ভাব ভারতের রাজনীতিতে। দেশটিতে মুসলমানদের রক্ত ও ইজ্জত যে কত তুচ্ছ ভাবা হয় তার নজির শুধু দাঙ্গার নামে বার বার মুসলিম গণহত্যাই নয়, কাশ্মিরের এ অবিরাম গণহত্যা, ধর্ষণ এবং জবরদখলও। একটি দেশে বার নির্বাচন হলেই যে সেদেশে মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা পাবে সে ধারণা যে কতটা মিথ্যা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাই শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সই নয়, আজকের গণতান্ত্রিক ভারতও।
সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সমরবিদরা বাংলাদেশকে ভাবে নিজ-দেশের পেটের মধ্যে বিষফোঁড়া। পূর্বাংশের ৭টি রাজ্যের সাথে সংযোগ স্থাপনে বাংলাদেশই সে পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বড় বাধা পূর্ব এশিয়ায় পথে পা বাড়ানোতেও। এ বাঁধাটি তাদের কাছে প্রকট ভাবে ধরা পড়ে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময়। তখন ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের উপর শুরু হয় চীনের প্রচন্ড হামলা। বাংলাদেশ ও ভূটানের মাঝে সরু ভারতীয় করিডোর দিয়ে তখন ভারতীয় সৈন্য ও রশদ সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়ে। তখন পাকিস্তানের কাছে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে করিডোর চায়। পাকিস্তান তা দিতে অস্বীকার করে। ভারতকে সে সুযোগ দিতে চাপ দেয় চীনের প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সে চাপের সামনে নতি স্বীকার করেনি পাকিস্তান। তখন থেকেই ভারতের টার্গেট, যেভাবেই হোক ট্রানজিটের সে সুযোগ হাসিল করতেই হবে। পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে ভারতের বিপুল পুঁজি বিণিয়োগ ও একাত্তরের যুদ্ধের অন্যতম কারণ এখানেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, দেশটির সামরিক ও অর্থনৈতিক মেরুদন্ড শক্ত করার বিষয়টি ভারতের বিবেচনায় সামান্যতম গুরুত্বও পায়নি|। সেটি যেমন একাত্তরে নয়, তেমনি এখনও নয়। এখনও তারা ট্রানজিটের দাবী নিয়ে অনড় সে অভিন্ন কারণেই।। তবে এখন সুবিধা হল, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রচন্ড ভারতপন্থিদের ক্ষমতাসীন হিসাবে পেয়েছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিবর্তনীয় নীতি হল প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরে লেন্দুপ দর্জিদের মত ভারতপন্থিদের বিপুল সংখ্যায় প্রতিপালন। সিকিমের লেন্দুপ দর্জিরা নির্বাচিত হযেছিল নিজ দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের নামে। কিন্তু বিজয়ের পর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্রথম দিনেই তারা ভারতভূক্তির ঘোষণা দেয়। আধিপত্য বিস্তারে একটি ব্যয়বহুল ও রক্তাত্ব যুদ্ধের চেয়ে এটিই অতি সহজ ও সস্তা পথ। প্রতিবেশী দেশগুলির বিরুদ্ধে ভারতের এ স্ট্রাটেজী বিপুল সফলতা দিয়েছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় হাসিলে ব্যর্থ হয়ে ভারত এ পথই বেছে নেয়। একটি যুদ্ধবিমানের খরচে ভারত বহু হাজার লেন্দুপ দর্জি পালছে প্রতিটি প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরে। এদের সংখ্যা বাংলাদেশে অসংখ্য। এরাই ফারাক্কা বাঁধের মধ্যে বাংলাদেশের কল্যাণ দেখতে পায়। বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ দিলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনায় পানি থৈ থৈ করবে, সে খবরও শোনায়। এরাই কোরাস ধরেছিল, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জোয়ার বইবে। এরাই একাত্তরের পর সীমান্ত বাণিজ্যের নামে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়। এরূপ মীর জাফরদের কারণেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখলে পলাশির আম্রকাণনে ব্রিটিশ বাহিনীকে একটি গুলিও ছুঁড়তে হয়নি। এদের কারণেই ভারতকে একটি তীরও ছুঁড়তে হয়নি স্বাধীন দেশ সিকিম দখলে। এবং একটি ঢিলও ছুঁড়তে হয়নি বাংলাদেশের বেরুবাড়ী দখলে।
প্রতিটি দেশের কাছেই তার স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আপোষ চলে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি? স্বাধীনতার শত্রুমিত্র কারা? দেশটি কি আদৌ টিকবে? স্বাধীনতার গ্যারান্টি বা রক্ষা-কবচই বা কি? এ সব প্রশ্ন আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে টিকে থাকবে কি থাকবে না -তা নির্ভর করবে এসব প্রশ্নের উত্তর কিভাবে খোঁজা হয় এবং তা থেকে কি ভাবে শিক্ষা নেওয়া হয় তার উপর। কালের বিবর্তনে জনগণের ভাষা, বর্ণ বা ধর্মে পরিবর্তন আসে সামান্যই। অথচ রাজনৈতিক ও ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটে সচারচরই। বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ে পরিবর্তন এসেছে মাত্র একবার। এবং সেটি ইসলামের আগমনে। কিন্তু এর ভূগোল পাল্টে গেছে বার বার। বিগত পঞ্চাশ বছরেই অন্তত দুইবার। ভূগোলের স্থায়ীত্ব নিয়ে তাই বড়াই চলে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর নেতারা বলতো, পাকিস্তান এসেছে টিকে থাকবার জন্য। কিন্তু এতে যতটা জজবা ছিল ততটা বাস্তবতার সম্যক উপলদ্ধি ছিল না। তেমনি বাংলাদেশ আবহমান কাল টিকে থাকবে, এটুকু বললেই এর আয়ু দীর্ঘায়ীত হবে না। শুধু আবেগ দিয়ে দেশের স্থায়ীত্ব বাড়ে না। নদী যেমন চলার গতিপথে বার বার বাঁক নেয়, তেমনি একটি দেশ এবং জাতিও। নদীর বাঁক নির্ধারিত হয় পাহাড়-পর্বত, বৃষ্টি-বাদল, মৃত্তিকার গঠন ও অন্যান্য ভূপ্রকৃতিগত কারণে। কিন্তু স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতির হাতে নয়। নিয়ন্ত্রিত হয় জনগণের চিন্তা-চেতনা, ত্যাগের প্রেরণা, রাজনীতির তাগিদ ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। এগুলোর তারতম্যে পরিবর্তিত হয় দেশের ভৌগলিক মানচিত্রও। শুধু ভাষা বা ভূগোলই একটি দেশের স্বাধীনতার একমাত্র উপাদান নয়। তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের কোন যৌক্তিক ভিত্তিই থাকে না। যুক্তি থাকে না এদেশটির সৃষ্টিরও। পশ্চিম বঙ্গের সাথে মিলে এক অখন্ড ভারতে লীন হওয়ার বিপক্ষেও তখন বলার মত কোন যুক্তি থাকে না।
রাজনীতি হল, দেশবাসীর চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্খা ও বিশ্বাসেরই বিমূর্ত প্রতীক। আস্তিক ও নাস্তিক – উভয়েরই ধর্ম নিয়ে যা ধারণা সেটিরই প্রতিফলন ঘটে রাজনীতিতে। রাজনীতি গণতান্ত্রিক হলে তাতে জনগণের বিচিত্র বিশ্বাসেরই সম্মিলিত প্রতিফলন হয়। বিভিন্ন জাতির চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্খা যেমন এক ও অভিন্ন নয়, তেমনি অভিন্ন নয় সেসব দেশের রাজনীতিও। এক ও অভিন্ন নয় তাই ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতি। প্রতি ফুলের যেমন নিজস্ব রঙ ও গন্ধ আছে, তেমনি প্রতি জনগোষ্ঠির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্টও আছে। এ বৈশিষ্ট গুলোকে আরো বিশিষ্টময় করার জন্যই প্রয়োজন পড়ে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের। নইলে ভারতের বুকে মাত্র একটি রাষ্ট্র হত। এবং বিশ্বেও এক রাষ্ট্র হত। এদেশের মানুষ এককালে পাকিস্তান গড়েছিল একারণেই। আজকের বাংলাদেশ তারই ধারাবাহিকতা, ফলে জন্ম সূত্রেই এটি বিশিষ্টময়। ফলে স্বাধীনতার চেতনা খুঁজতে হলে একাত্তর নয় বরং আরো অতীতে যেতে হবে। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান, এবং অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ। ফলে এদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব থাকবে -সেটাই স্বাভাবিক। যারা ধর্মপ্রাণ তারা ধর্ম নিয়ে শুধু মসজিদেই যায় না, বরং যেখানে যায় সেখানেই সে ধর্মীয় চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। ধর্ম লেবাস নয় যে ক্ষণে ক্ষণে সেটি কেউ খুলবে এবং প্রয়োজনে আবার পরিধান করবে। এটি ব্যক্তির অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেমন ফুল থেকে তার রং, রূপ ও গন্ধকে পৃথক করা যায় না, তেমনি পৃথক করা যায় না ব্যক্তি থেকে তার ধর্মকে। কি রাজনীতি, কি ব্যবসা-বাণিজ্য, কি শিল্প, কি সাহিত্য -যেখানেই তার বিচরণ সেখানেই সে ঈমানের প্রতিফলন ঘটায়। তাছাড়া রাজনীতি ইসলামের অতি মুখ্য বিষয়। ঈমানের গভীরতার অনুপাতে এর বিস্তার ঘটে মুসলমানের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। ইসলামে এটি উচ্চতর ইবাদত। ফলে প্রকৃত মুসলমানের কাছে নামাজ-রোজা, হজ্ব-যাকাতই শুধু গুরুত্বের নয়, গুরুত্বপুর্ণ হলো রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণও। ইসলামের নবী রাজনীতির ময়দানে যতটা সময় ব্যয় করেছেন অন্য কাজে ততটা করেননি। মানুষের মঙ্গলে অথবা অমঙ্গলে রাষ্ট্রের সামর্থ তুলনাহীন। রাষ্ট্রকে বলা হয় সামর্থ্যদাতা, মুক্তিদাতা এবং রক্ষাকর্তা। রাষ্ট্র জাহান্নাম ও জান্নাত – দুইটি দিকেই মানুষকে সমানে টানতে পারে। রাষ্ট্রের এ সামর্থ্যকে আস্তিক-নাস্তিক, মার্কসবাদী-পূঁজিবাদী, জাতিয়তাবাদী-আধিপত্যবাদী, ইসলামী-অনৈসলামি সবাই কাজে লাগাতে চায়। মানব জাতির ইতিহাসে এ নিয়েই যত যুদ্ধ। অনেকে আইন করে বিপক্ষীয় শক্তিকে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে রাখতে চায়। যেমনটি হয়েছে মিশর, তুরস্ক ও আলজেরিয়ায় ইসলামী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে। মুজিবও বাংলাদেশে সেটিই করেছিল। ইসলামের বিপক্ষ শক্তি আজও বাংলাদেশে সেটিই চায়। এ নিয়েই ভারতের আধিপত্যবাদী শক্তির সাথে বাংলাদেশের ইসলামের বিপক্ষ শক্তির মূল কোয়ালিশন। এ কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে হামলা শুরু হয়েছে শুধু বাংলাদেশের ভূমি, পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিরুদ্ধেই শুধু নয়, লাগাতর হামলা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধেও।
শুধু দান খয়রাত আর তাবলিগের উপর নির্ভর করে আর যাই হোক সমাজের ইসলামীকরণ সম্ভব নয়। মুসলমানের ঈমান বাঁচানোও সম্ভব নয়। সেটি সম্ভব হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের কাজে নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ যুদ্ধ করতেন না। এটুকু এতই মোদ্দা কথা যে সেটি বুঝবার জন্য আলেম বা ইসলামে পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের সংস্কারে অমনোযোগী হলে ইসলামের সত্যিকার অনুসরণ হয় না। বসত-ঘরের পূর্ণ ফায়দা পেতে হলে তাকে জঞ্জালমূক্ত রাখতে হয়। তেমনি রাষ্ট্রের বেলায়ও। ইসলামে জঞ্জাল সরানোর কাজটাই হল জিহাদ। মুসলমানের নামাজে কাজা আছে, কিন্তূ এ কাজে কাজা নেই। প্রায় সত্তর ভাগ সাহাবা একাজে শুধু অর্থ, সময় ও মেধাই দেননি, জীবনও দিয়েছেন। তাদের রক্তের বরকতেই আমদের মত গাফেলরাও আজ জন্মসুত্রে মুসলমান।
স্বাধীন বাংলাদেশে এক অপূর্ব সুযোগ মিলেছে মুসলিমদের। এ সুযোগ ভারতের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীরও নেই। আর সেটা হল ইসলামের আঙ্গিকে রাষ্ট্রের সংস্কার। যারা সংখ্যালঘু রূপে অমুসলিম দেশে বাস করে তাদের দ্বারা একাজ হয় না। কারণ সে সামর্থ সংখ্যালঘু হওয়ার কারনে তাদের থাকে না। মানুষ যেখানে ঘর বাঁধে তার প্রতি কিছু দায়িত্ববোধও থাকে। ইসলামী পরিভাষায় এটিই হল খেলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ববোধ। জন্মসূত্রে সব মানুষ তার জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ববান। এ দায়িত্বপালনে অবহেলায় ভূগতে হয় তাকে এবং তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। শুধু ট্যাক্স দিলে এ দায়িত্ব পালিত হয় না। মেধা, শ্রম, অর্থ ও রক্ত বিনিয়োগেও তাকে সচেষ্ট হতে হয়। ইসলামে এরূপ দায়িত্বপালনের নামই ইবাদত। ইবাদতের এ প্রেরণায় মুসলমানেরা এমনই এক রাষ্ট্র স্থাপনে সচেষ্ট হয়। এমন রাষ্ট্রে পাপের প্রকাশ্য পথগুলো রাষ্ট্রীয় তদারকিতে রুদ্ধ হয়ে যায় এবং প্রশস্ততর হয় পূণ্যের পথ। তখন রাষ্ট্রে শুধু বৈষয়ীক সমৃদ্ধিই আসেনা, বৃদ্ধি পায় মনের পূর্ণময় প্রশান্তিও। এ সুযোগের সন্ধানে অতীতে বহু অর্থ আর রক্ত ব্যায় হয়েছে মুসলিমদের এবং এখনও হচ্ছে। মুসলিমগণ যেখানে ঘর বাঁধে সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রও গড়ে। ইসলামের বিজয়ে নিজ দায়িত্বপালনে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ হলো প্রথম ধাপ।আল্লামা মহম্মদ ইকবাল এ লক্ষেই এ উপমহাদেশে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। অথচ যারা সেকুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী তাদের কাছে এমন রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি কখনোই গুরুত্ব পায়না। গ্রহণযোগ্যও হয়নি। এমনকি এ বিষয়টি সে সব আলেমও বুঝেনি যারা মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে ইসলামকে বন্দি রাখতে চায়।
ঘর বাঁধলে যেমন তার দেওয়ালটাও জরুরী, তেমন জাতির জন্য জরুরি নিরাপদ সীমান্ত রেখা। প্রয়োজন হলো সুরক্ষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের মুসলিমগণ ভারতের ন্যায় এক প্রবল প্রতিপক্ষের অভ্যন্তরেও এক নিরাপদ বাসস্থান দিয়েছে বাংলাদেশের ন্যায় একটি পৃথক রাষ্ট্রে বসবাস করার কারণেই। হিন্দু্স্থানি মুসলমানদের তুলনায় বাংলাদেশের মুসলমান এ কারণেই নিরাপদ। ফলে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মুসলিম যত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার প্রশিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি করেছে, ভারতের বিশ কোটি মুসলমান তার সমানতো দূরে থাক সিকি ভাগও পারেনি। সে সাথে দিয়েছে আপন বিশ্বাসের বাস্তবায়নের সুযোগ। এমন এক সুযোগের খোঁজেই কাশ্মিরী মুসলমানেরা রক্ত ঢালছে বিগত ৭০ বছর ধরে।
মুসলমানের শক্তিবৃদ্ধিকে যারা নিজেদের বিপদ মনে করে তাদের কাছে বাংলাদেশের এরূপ স্বাধীনতা অসহ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুমিত্র নির্ণয়ে এ সত্যকে অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে। ইসলামে যারা আত্মনিষ্ঠ ও বুঝে স্বাধীনতার কদর, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাদের নিষ্ঠা প্রশ্মাতীত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তারা নেয়ামত ভাবে। স্বাধীনতার বিপরীতে যা ঘটতে পারে তা হল পরাধীনতা তথা ভারতভুক্তি। পরাধীনতার অর্থই অন্যের অধীনতা, এখানে অন্য বলতে ভারত ভিন্ন আর কে হতে পারে? ভারতভূক্তিতে বাংলাদেশের ধর্মহীন বা ধর্মে অঙ্গিকারহীন সেকুলারদের হারানোর কিছু নেই। বরং অখন্ড ভারতে ইসলামে আপোষহীনদের নিধনে তারা সাম্প্রদায়িক হিন্দুদেরও সর্বাত্মক সহযোগিতা পাবে। বাংলাদেশে এদের একার পক্ষে এ কাজটা দুরূহ। কিন্তু দেশটির ভারত-ভূক্তিতে তারা পাবে দীর্ঘকালীন বিজয়ের স্বাদ। ইসলামের জোয়ার যেভাবে দেশে দেশে বেগবান হচ্ছে তাতে তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের নিজেদের রাজনৈতিক আয়ু সংকটের মুখে। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা বিদেশী শত্রুকেও আহবান করবে সেটিই স্বাভাবিক। এজন্যই ভারতের সাথে এ পক্ষটির কোয়ালিশন দিন দিন জোরদার হচ্ছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় প্রকৃত বিশ্বাসী তাদেরকে এ বিষয়টিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। একাত্তরের চেতনা ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরূপে যাদের অহংকারপূর্ণ গলাবাজী, ধর্মের প্রতি অঙ্গিকারহীন হওয়াতে ইসলামের বিপক্ষে যাওয়াই তাদের জন্য স্বাভাবিক। তাদের গলাবাজীর লক্ষ্য, নিজেদের আসল মতলবকে গোপন করা। এরূপ লক্ষে মুজিবও এককালে অসংখ্যবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়েছে। ফলে আজও যারা জয়বাংলার জয়োধ্বণি তুলছে তারাই যে দেশের মানচিত্র খাবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে তাই সমগ্র বিষয়টাকে দেখতে হবে এমন এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে। শুধু একাত্তরের ভূমিকাকে ধর্তব্যে আনলে চিত্তরঞ্জন সুতারের ন্যায় বেতনভোগী ভারতীয় এজেন্টগণকেও মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার মিত্র মনে হবে। এমন এক সংকীর্ণ মূল্যায়নে স্বাধীনতা নয়, পরাধীনতার পথই উন্মূক্ত হবে। এতে ত্বরিৎ বিজয় আসবে শত্রুপক্ষের। ভারতীয় স্ট্রাটেজীর মূল লক্ষ্য তো তেমন একটি বিজয়কে দ্রুত সমাধা করা। ২১/১০/২০২০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018