সংস্কৃতির গুরুত্ব এবং অপসংস্কৃতির বিপদ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

সংস্কৃতি দেয় সভ্যতার পরিমাপ

জাতি কতটা সভ্য বা উন্নত সেটির পরিমাপে সংস্কৃতি একটি নির্ভূল মাপকাঠি। একটি জনগোষ্টির চিন্তা-চেতনা, রুচিবোধ, চালচলন বা জীবনবোধের সামগ্রিক পরিচয় মেলে সংস্কৃতিতে। পশু বা উদ্ভিদের জীবনে সময়ের তালে বাঁচার প্রক্রিয়ায় উন্নতি আসে না। কিন্তু মানুষ তার সমাজকে নিয়ে সামনে এগোয়, পূর্বের চেয়ে উন্নততর ও সভ্যতর হয়। হাজার বছর পূর্বে পশুরা যা খেত আজকের জন্তু-জানোয়ারের খাদ্য, পানীয় বা বাসস্থানে অবিকল একই। কিন্তু মানুষ সামনে এগিয়েছে। আর সামনে এগুনোর এই যে প্রক্রিয়া সেটিই হলো সংস্কৃতি। এটি হলো সংস্কারের প্রচেষ্টা। যে কোন জীবন্ত ও সুস্থ্য জাতির জীবনে এ প্রচেষ্টা ক্রীয়াশীল থাকা শুধু কাঙ্খিতই নয়, অপরিহার্য। সমাজে সে প্রক্রিয়া কতটা সফল এবং কতটা কার্যকর সংস্কৃতি সেটারই পরিমাপ দেয়। খনির স্বর্ণখন্ড আর অলংকারের স্বর্ণ এক নয়, উভয়ের মাঝে যে পার্থক্য তার পশ্চাতে থাকে দীর্ঘ পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। তেমনি সভ্য মানুষ আর অসভ্য মানুষও এক নয়। এক নয় উভয়ের মাঝে আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ এবং বাঁচবার রুচিবোধও। এ পার্থক্যের মূলে থাকে একটি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। সংস্কারের এ ক্রীয়াশীল প্রক্রিয়াই হলো সংস্কৃতি। সভ্য জাতির সভ্যতর হওয়ার পিছনে এটিই হলো মূল। তবে প্রশ্ন হলো কি সেই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া? কি সে উপাদান যার ভিত্তিতে একটি জাতি অন্য একটি জাতি থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির জন্ম দেয় বা জীবনবোধে ভিন্নতর হয়? সচারচরই বলা হয় মুসলিমগণ সংস্কৃতিতে অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। কিন্তু কি সে ভিন্নতা? কেন সে ভিন্নতা? জীবনমাত্রই গতিময়। এ গতি যেমন ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে, তেমনি অধোমুখীও হতে পারে। ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনে স্থিতিবস্থা বলে কিছু নেই। এগুতে না পারলে পিছিয়ে যেতে হয়। মানবজাতির ইতিহাস মূলতঃ উত্থান-পতনের ইতিহাস। এক কালের বহু সভ্য জাতি কালের গতিতে পিছিয়ে গেছে। মুসলিমগণ নিজেরাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজকের তুলনায় চৌদ্দশত বছর পূর্বেও তারা বহুগুণ উন্নত ছিল। এরূপ এগিয়ে ও পিছিয়ে যাওয়ার পিছনে কাজ করে একটি সুষ্ঠ সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকা বা না থাকাটি।

ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সংস্কারের প্রেরণা আসে ধর্মীয় বিশ্বাস বা দর্শন থেকে। মুসলিম জীবনে সে ধর্ম বিশ্বাস বা দর্শন হলো ইসলাম। ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ে ইসলামই হলো চুড়ান্ত মানদন্ড। সে মানদন্ডের ভিত্তিতে বাঁচবার মধ্যে পায় সভ্যতর রূপ ও রুচিবোধ। কর্ম, চরিত্র ও বাঁচবার প্রক্রিয়ায় আসে পরিশুদ্ধি। ভূমি,ভাষা, জলবায়ু বা গাত্রবর্ণ এমন একটি রুচিবোধ বা মানদন্ড দিতে পারে না। ফলে ভাষা, জলবায়ু, ভুগোল ও বর্ণ অভিন্ন হওয়া সত্বেও বিভিন্ন ধর্ম ও আদর্শের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়। ব্যক্তির জৈবিক সত্ত্বার চেয়ে নৈতিক সত্ত্বাই তাকে মনুষ্য পরিচয়টি দেয়। এর জন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ্র সৃষ্টি। এবং তার নৈতিক সত্ত্বাটি পুষ্টি পায় বিশুদ্ধ আদর্শ থেকে, ভূমি থেকে নয়। মুসলিমদের কাছে সেটি ইসলাম। অভিন্ন আরব ভূমিতে একারণেই বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। বহুবিধ অনৈসলামিক সংস্কৃতির পাশে জন্ম হয়েছে ইসলামি সংস্কৃতির।

 

পরিশুদ্ধি আনে সংস্কৃতি

ইসলামের কারণেই আমূল বিপ্লব এসেছিল মুসলিমদের বিশ্বাস, কর্ম, চরিত্র ও রুচিবোধে। তখন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারের প্রক্রিয়া। ফলে আরবের স্বভাসুলভ হানাহানীর পরিবর্তে স্থান পায় ইস্পাতদৃঢ় ভাতৃত্ব। যুদ্ব-বিগ্রহ ও অশান্তির স্থলে প্রতিষ্টা পায় পারস্পরীক সৌহার্দ্য ও সম্পৃতি। ইর্ষা, ঘৃণা ও হানাহানী নয়, উৎচারিত হয় একে-অপরের প্রতি সালাম বর্ষণের দোয়া। এভাবেই জন্ম নেয় মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া বা সংস্কৃতি। ইসলামকে বাদ দিয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে -সেটি আর যাই হোক মুসলিমদের সংস্কৃতি নয়। মুসলিম থেকে যেমন ইসলামকে পৃথক করা যায় না, তেমনি তাকে পৃথক করা যায় না ইসলামি সংস্কৃতি থেকেও। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির বিশ্বাস ও চেতনার প্রতীক। বিশ্বাস বা চেতনা দৃশ্যময় নয়, সেটি দৃশ্যময় হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। রোগের যেমন সিম্পটম বা লক্ষণ থাকে, স্বাস্থ্যেরও তেমনি বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনি আল্লাহতে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী উভয়েরই সনাক্তকরণের কিছু লক্ষণ থাকে। আল্লাহতে অবিশ্বাসীর জীবনে শ্লিলতার বদলে অশ্লিলতা প্রকাশ পাওয়াই স্বাভাবিক। সুনীতির বদলে থাকে দুর্নীতি। কারণ, ঈমান না থাকায় বেঈমানের জীবনের লাগামটি থাকে তার খেয়ালখুশী বা প্রবৃত্তির হাতে। ফলে তার পোষাক-পরিচ্ছদেই শুধু নয়, আনন্দ-উল্লাস তথা বাঁচার মধ্যেও প্রকাশ পায় অশ্লিলতা। কিন্তু ঈমানদারের প্রতিটি কর্মে প্রকাশ পায় মহান আল্লাহতায়ালার ভয়। সে ভয় তার চাওয়া-পাওয়া ও জীবনযাত্রার উপর লাগাম পড়িয়ে দেয়। ফলে তার জীবন হয় নিয়ন্ত্রিত। কি আনন্দ-উল্লাস, কি দুঃখ-বিষাদ -সব কিছুতেই থাকে আল্লাহর উপর তার নির্ভরতা। মুসলিমের শোকপ্রকাশ ও উৎসবের প্রক্রিয়া এজন্যই অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। শোকে-দুঃখে সে বলে ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হি রা’জীয়ুন। অর্থঃ নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য্ এবং আল্লাহতেই ফিরে যাবো। এটিই ঈমানদারের বাঁচবার মূল দর্শন। কিন্তু অমুসলিমদের মাঝে সেটি থাকে না। ফলে তার রুচি ও সংস্কার মুসলিম থেকে ভিন্নতর। বাংলাদেশে মুসলিম এবং অমুসলিম হাজার বছর পাশাপাশী বসবাস করলেও এজন্যই তাদের উভয়ের আনন্দ-উল্লাস বা  উৎসব কখনই একই মোহনাতে মিলিত হয়নি। পানি ও তেলের ন্যয় আলাদাই রয়ে গেছে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে কারো স্মরণে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন, বেদীমূলে বা ফটোতে মাল্যদানের যে সংস্কৃতি সেটি অমুসলিমদের, কখনোই সেটি মুসলিমদের হতে পারিনি। মুসলিমগণ বরং বিদেহী আত্মার মাগফেরাতে দোওয়া-দরুদের মজলিস বসিয়েছে, কবর জেয়ারত করেছে, গরীব মিসকিনকে দান খয়রাত করেছে। এটিই হলো ইসলামি সংস্কৃতি। শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, মাল্যদান, এবং দাড়িয়ে নীরবতা পালনের যে সংস্কৃতিকে আপামর বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলা হয়েছে সেটি সত্য নয়। ইসলামে অঙ্গিকারহীন সেকুলারেরা এর প্রবক্তা, কোন নিষ্ঠাবান মুসলিম নন। এটি কখনই ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সংস্কৃতি হতে পারে না।

সাংস্কৃতিক কর্ম মুসলিমের কাছে নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছবার মাধ্যম মাত্র। মানুষের গুণের উংকর্ষ ঘটিয়ে ইসলাম তাকে ফেরেশতার পর্যায়ে পৌঁছাতে চায়, এবং ইসলামি সংস্কৃতি হলো সে বিশুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া। তাই মুসলিমদের কাছে এটি কোন বিনোদন নয়, আনন্দ-উল্লাসও নয়, এটি ইবাদত। এ কাজে  তার প্রচ্ষ্টো জিহাদতূল্য। ইসলাম পবিত্রতা ও শ্লিলতার প্রতিষ্টা চায়। এবং সেটি শুধু মসজিদে নয়, বরং ব্যক্তি, পবিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। এমনকি আনন্দ-উৎসব ও শোক-দুঃখের আসরগুলিতেও। সমাজের কোন ক্ষুদ্রতর অংশ আনন্দ-উংসব বা সাংস্কৃতিক ক্রীয়াকর্মের নামে অশ্লিলতা ও নোংরামীতে আক্রান্ত হোক -ইসলাম তা চায় না। কারণ এগুলি হলো রোগ, আর এরূপ রোগ মাত্রই সংক্রামক। এগুলীর শুরু ক্ষুদ্রতর স্থান থেকে হলেও আস্তে আস্তে সমগ্র রাষ্ট্রকে গ্রাস করে। এ অশ্লিলতা নাটকের মঞ্চ, সিনেমা হল, যাত্রা দল বা নিষিদ্ধ পল্লীতে শুরু হলেও সেখানে সীমাবদ্ধ থকে না। আগুনের ন্যায় ঘর থেকে ঘর, গ্রাম থেকে গ্রামকে গ্রাস করে। এজন্যই ব্যক্তি ও জাতির পরিশুদ্ধির প্রয়োজনে ইসলাম সমাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গণ থেকেও অশ্লিলতার নির্মূল চায়। কোন স্থানকেই ইসলাম এরূপ পাপের কাজে লাইসেন্স দিতে রাজী নয়।

সমাজ পরিশুদ্ধির প্রয়োজনে শুধু মৌখিক কালেমা পাঠের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির দায়িত্ব শেষ হয়না। বরং একটি বিশেষ মডেলে তাকে গড়ে উঠতে হয়। আর সে মডেল হলো, রাসূলে পাকের (সা) মডেল। কালেমা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সেটি শুরু হয় বটে -তবে শেষ হয় না। এর জন্য তাকে চিন্তা-চেতনা, আমল-আখলাক বিশুদ্ধকরণের বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ইসলামি সংস্কৃতি হলো সে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। আরবীতে এটিকে বলা হয় তাহযীব যার অর্থ বিশুদ্ধকরণ। সমাজের বুকে এ বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াটি কাজ না করলে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম করার প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ মানুষ বইপত্র বা স্কুল-কলেজ থেকে যা শেখে -তার চেয়ে বহুগুণ বেশী শেখে সংস্কৃতি থেকে। মাছ যেমন পানিতে বেড়ে উঠে, মানুষও তেমনি বেড়ে উঠে তার সংস্কৃতির মধ্যে। জীবনের মূলপাঠ সে সেখান থেকেই লাভ করে। তাকে কেন সৎ হতে হবে, কিভাবে সৎ হতে হবে, কেন ধর্মে একনিষ্ট হতে হবে, কেন অপরের দুঃখে দুখী এবং সুখে সুখী হতে হবে, কিভাবে বড়দের সন্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে হবে, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বা মেহমানকেই বা কিভাবে আপ্যায়ীত করবে –ঈমানদার ব্যক্তি সে গুলো সে শেখে ইসলামী সংস্কৃতি থেকে। ইসলাম শুধু কালেমা বা নামাজ পাঠ শেখায় না। শুধু কালেমা বা নামাজ পাঠে সেটি সম্ভব হলে বহু কোটি নামাযীদের মধ্য থেকে বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যক মহামানব সৃষ্টি হতো। নবীজীর (সা) আমলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হাজারে হাজারে তৈরী হওয়ার কারণ, তিনি শুধু ধর্মীয় অঙ্গণেও বিপ্লব আনেননি; জন্ম দিয়েছেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরও।  নামায-রোযার পাশাপাশি প্রবল ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল এক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া।

সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণই হলো সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অথচ তারা কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হননি। আজ বিশ্বে দেড় শত কোটির বেশী মুসলিম। কিন্তু উন্নত মানব সৃষ্টিতে তাদের অবদান কতটুকু? এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাটি বিশাল। এর কারণ, বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। মুসলিম নামধারি স্বৈরাচারি শাসক এবং ঔপনিবেশিক কাফের শক্তির হাতে ইসলামের যে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াটি বিনষ্ট হলো -সেটি আর প্রতিষ্ঠা পায়নি। এর ফলে দুর্বৃত্তিতে ছাড়িয়ে গেছে অমুসলিমদেরও ।

 

শত্রুর হামলা কেন সাংস্কৃতিক অঙ্গণে?

ইসলামের শত্রুপক্ষ ভয় পায় ইসলামের উপর সরাসরি হামলাতে। তারা বরং ইসলামের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া বা সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে। বীজকে গজাতে দেওযার পর তাকে বেড়ে উঠার সুযোগ না দিলে সেটি নিস্ফল আয়ু পায় মাত্র, ফল দেয় না। জাতীয় জীবনে বেড়ে উঠার কাজটি হয় স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা ও সাহিত্যের অঙ্গণে। ইসলামের শত্রুগণ মুসলিমদের জন্ম বন্ধ করতে না পারলেও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে বন্ধ করেছে। ফলে দেড়শত কোটির অধিক মুসলিম নিজ ভূমিতে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে কোন অবদানই রাখতে পারছে না। বরং তারা নিজেরাই ইসলামী রাষ্ট্র, মুসলিম ঐক্য, শরিয়ত ও কোর’আন শিক্ষার শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এরই জাজ্বল্যমান উদাহরণ হলো বাংলাদেশের ১৭ কোটি মুসলিম। ফলে দেশটি রেকর্ড গড়ছে পশ্চাদপদতায়। পরিশুদ্ধির বদলে বেড়েছে কদর্যতা এবং বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে দূর্নীতিতে। চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, মিথ্যাচার, সন্ত্রাস ও ভিক্ষাবৃত্তি পরিণত হয়েছে শিল্পে। বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদেশে নারী রপ্তানী। ব্যাপকতর হচ্ছে পতিতাবৃত্তি ও উলঙ্গতার ন্যায় পাপাচার। বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার বদলে যে দূষিতকরণ প্রক্রিয়া উপনিবেশিক শত্রুরা চালু করেছিল তাকে উৎখাত না করে বরং আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। ফলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও অন্য মুসলিমদের কল্যাণে কিছু করা দুরে থাক নিজেদের কল্যানেও কিছু করতে পারছে না। বরং শত্রুপক্ষের সাথে তাল মিলিয়ে তাই করা হচ্ছে -যা ইসলামের শত্রু পক্ষটি চায়। চলমান অপসংস্কৃতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে হাতিয়ার রূপে।

সংস্কৃতির সৃষ্টিশীল মাধ্যম বহু। তেমনি বহুবিধ মাধ্যম হলো অপসংস্কৃতিরও। ইসলামী সংস্কৃতির নির্মাণে মূল ভূমিটি হলো মসজিদ। মর্তের বুকে এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই দ্বীনের আলো মহল্লার বুক থেকে জাহিলিয়াত তথা অন্ধকার সরায়। কিন্তু ইসলাম বিরোধী শক্তি ইসলামী সংস্কৃতির এ প্রাণকেন্দ্রকে বহুলাংশেই প্রাণহীন ও অকার্যকর করেছে। মহান আল্লাহতায়ালার এ পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্টানটি ব্যবহৃত হচ্ছে নিছক নামাজ আদায়ের স্থানরূপে। নামাজের সময় ব্যতীত লক্ষ লক্ষ মসজিদের গুরুত্পুর্ণ অঙ্গনগুলি অধিকাংশ সময় জনশূণ্য থাকে। ইসলামের গৌরব যুগে দ্বীনশিক্ষা, মানুষের মাঝে ভাতৃত্ব গড়া, সমাজসেবা, জুলুমের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ সংগঠিত করা এবং জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার যে কাজ মসজিদের মিম্বর থেকে হত -তা আজ বিস্মৃতপ্রায়। এসব কাজের জন্য সে সময় মসজিদ ভিন্ন মুসলিমদের অন্যকোন প্রতিষ্ঠানই ছিল না। অমুসলিমদের সংস্কৃতি যেমন মুসলিমদের থেকে ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন হলো তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও।  ক্লাব, মদ্যশালা, যাত্রাদল, সিনেমা ও নাট্যমঞ্চ এগুলি জন্ম ও পরিচর্যা পেয়েছে অমুসলিমদের সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে যে সংস্কৃতি চর্চা হয় সেটি মুসলিমের নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলি আদৌ সংস্কৃতি নয়, বরং অপসংস্কৃতি।

মুসলিমকে পবিত্রতা নিয়ে বাঁচতে হয় শুধু নামাজ-রোযায় নয়, বরং প্রতিটি কর্মে। কারণ, নামাজ-রোযার পাশাপাশি প্রতিটি কর্মের জন্যও মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে দায়বদ্ধ। মসজিদের জায়নামাজের যে পবিত্রতা -সেটি অন্যত্র সম্ভব নয়। তাই সমাজীকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনে অন্যরা ক্লাব-পাব গড়লেও পবিত্রতার স্বার্থে মুসলিমগণ শুধু মসজিদই গড়েছে। চেতনা ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির বিষয়টি এতো সহজ নয়। সে পরিশুদ্ধি নিছক কয়েক মিনিটের জন্য জায়নামাজে আসাতে সৃষ্টি হয় না। মহান নবীজী (সা) তাঁর সাহাবাদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আল্লাহর এ পবিত্র ঘরে কাটিয়েছেন, দ্বীনের আলোকে তাদেরকে আলোকিত করেছেন। জ্ঞানই সংস্কারের মূল উপাদান; চেতনায় পরিবর্তন সাধনে এর বিকল্প নেই। জ্ঞানই মানুষকে প্রকৃত মুসলিম বানায়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন পাকে বলেছেন, একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে। ফলে জ্ঞানহীন হওয়ার অর্থ আল্লাহতায়ালার প্রতি ভয়হীন হওয়া। তথা বেঈমান হওয়া। কোর’আনের প্রথম আয়াতে যে বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটিও অন্য কোন কর্মের নয়, সেটি ইকরা তথা পড়ার। নামাজ-রোযা ফরজ করার  আগে ইসলাম এভাবে ইলম চর্চাকে ফরজ করেছে। অথচ মুসলিমগণ চলেছে ভিন্ন পথে। তাদের অজ্ঞতা আজ অমুসলিমদের চেয়েও গভীরতর। সমাজের এ গাঢ় অন্ধকার দেখেই বলা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অন্ধকার সরাতে আল্লাহর এ প্রতিষ্ঠানটি সফলতা আনতে পারেনি। ফলে নির্মিত হয়নি সুস্থ্য সংস্কৃতি। দ্বীনের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকে রুখতে শত্রুশক্তি যেমন মসজিদগুলিকে নিষ্ক্রিয় করেছে, তেমনি সমাজ জুড়ে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নাচগান, যাত্রা, নাটক, সিনেমা, মদ্যপান, বেশ্যাবৃত্তি ও নানারূপ অশ্লিলতার। ফলে বলবান হয়েছে অপসংস্কৃতি। এতে মুসলিমদের চেতনা যেমন দিন দিন অসুস্থ্য হচ্ছে, তেমনি কদর্যতা বাড়ছে তাদের চরিত্র, রুচিবোধ ও আচার-আচরনে।

 

অপসংস্কৃতির বিপদ

সংস্কৃতির অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সাহিত্য। জ্ঞানের বিস্তারে ও চেতনার পুষ্টিতে সাহিত্য পাইপলাইনের কাজ করে। কিন্তু সাহিত্য অশ্লিল হলে তা মহাবিপদ ঘটায়। তখন ঘরে ঘরে সেটি রোগের বিস্তার ঘটায়। দূষিত খাদ্যে দেহ রোগগ্রস্ত হয়, এবং দুষিত সাহিত্যে রোগগ্রস্ত হয় ব্যক্তির বিবেক ও চেতনা। দেহের রোগে কেউ জাহান্নামে যায় না, কিন্তু যায় চেতনার রোগের কারণে। চেতনার এ রোগগ্রস্ততার কারণেই মানুষ চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ ও রাহাজানিতে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে আজ সেটিই হয়েছে। মাথাপিছু আয় বাড়লেও মানুষ রূপে বেড়ে উঠা যে যথার্থ ভাবে হচ্ছে না তার কারণ, সুসাহিত্যের আকাল।

সংস্কৃতি হলো মানুষকে সভ্যতর করার শিল্প। সুসাহিত্য হলো এ শিল্পের হাতিয়ার। কুসাহিত্যে রোগাগ্রস্ত হয় ব্যক্তির মনন ও চরিত্র। বাংলাদেশে আজ যেরূপ ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, গুম-খুনের সয়লাব, সেটি প্রমাণ করে, সাহিত্য পরিণত হয়েছে মানুষকে অসভ্য করার শিল্পে। অপসংস্কৃতির জোয়ারে মানুষ ছুটছে আঁধারের দিকে। এবং এরূপ আঁধারের দিকে নেওয়াই তো শয়তানের কাজ -পবিত্র কোর’আনে তো সেটিই বলা হয়েছে। সূদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচারের ন্যায় নানারূপ পাপের পথে মানুষের প্রচন্ড ভীড় দেখে তাই বলা যায়, শয়তান এ দেশে কতটা বিজয়ী। সংস্কৃতির লেবাসে শয়তান যুগে যুগে এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে মানুষকে বিদ্রোহী করেছে ও জাহান্নামের দিকে ধাবিত করেছে। এটিই শয়তানের সনাতন ধর্ম। শয়তানের এ ধর্ম কোন কিতাব নির্ভর নয়, বরং সংস্কৃতি ও আচার নির্ভর। সে সংস্কৃতি ও আচার অভিহিত হয় পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বা লিগাসী রূপে। আরবের কাফেরদের পৌত্তলিকতা বাঁচাতে তাই কোন ধর্মগ্রন্থের প্রয়োজন পড়েনি। প্রয়োজন পড়েনা তাদেরও যারা আজ অপসংস্কৃতির ধারক। তাই মুসলিমদের শুধু দেশের সীমানা পাহারা দিলে চলে না, সাংস্কৃতিক অঙ্গণও পাহারা দিতে হয়। নইলে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের নামে দূষিতকরণ শুরু চেতনা রাজ্যে। বাংলাদেশে সে কাজটি প্রবল ভাবে হচ্ছে সংস্কৃতির নামে।

 

অনিবার্য কেন বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ?

সংস্কৃতির ছদ্দবেশে শয়তান ও তার অনুসারিদের মূল এজেন্ডা হলো, পরিশুদ্ধি আনার ইসলামী প্রক্রিয়াকে বিলুপ্ত করা। এসব অসম্ভব করা হচ্ছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে ইসলামের উপর জঘন্যতম হামলাগুলি আসছে অপসংস্কৃতির সৈনিকদের পক্ষ থেকে। তাই যুদ্ধটি সীমান্তে হচ্ছ না। সেটি হচ্ছে প্রতি গৃহ, প্রতি শিক্ষাঙ্গণ, প্রতিটি সংগঠন ও প্রতিটি মহল্লার অভ্যন্তরে। মৌলবাদ নির্মূলের নামে এরাই ইসলামকে নির্মূল করতে চায়। চেতনার রাজ্যে এরা ঈমান-নাশক জীবাণু ছড়াচ্ছে; সেটি নাচ-গান, সাহিত্য, মিডিয়া, যাত্রা-নাটক ও সিনেমার নামে। এভাবে অসুস্থ্যতর করছে দেশবাসীর চিন্তা-চেতনাকে। সে অসুস্থ্যতার কারণে বাড়ছে উলঙ্গতা, অশ্লিলতা এবং মাদকাসক্তি। এরই ফলে ধর্ষণ ও গণ-ধর্ষণে উৎসাহ পাচ্ছে বখাটে ছেলেরা। লক্ষ্যনীয় হলো, পাড়ায় পাড়ায় যতই বাড়ছে নাচ-গান, নাট্যদল, ক্লাব, ভিডিও, সিনেমা হল ও পতিতা পল্লি -ততই বেড়ে চলেছে সমাজে অসুস্থ্য মানুষের ভিড়। ৫০ বছর পূর্বে নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধের বিচারে বাঙালী মুসলিমগণ যে অবস্থানে ছিল, এখন তা থেকে অনেক নীচে নেমেছে। সংস্কৃতি চর্চার নামে এ পতন-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ইসলাম ও মুসলিমদের পদানত  রাখতে কি শত্রুর একটি তীরও ছোঁড়ার প্রয়োজন পড়বে? বরং শত্রুর বিজয়টি শত্রু শিবিরে নিজ হাতে পৌঁছে দিবে।

সাংস্কৃতিক ভিন্নতাই রাজনৈতিক ভিন্নতার জন্ম দেয়। সে ভিন্নতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। সেটি বিলুপ্ত হলে ভৌগলিক ভাবে পৃথক থাকার যুক্তি বা ভিত্তিই বিলুপ্ত হয়। ফলে এ পথে ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব। ভারতপন্থি সাংস্কৃতিক কর্মীরা বাঙালী মুসলিমদের হিন্দুতে পরিণত করতে না পারলেও তেমন একটি লক্ষ্যে তাদেরকে ইসলাম থেকে  দূরে সরানোর কাজটিকে তীব্রতর করেছে। এদের প্রতিপালনে ভারতের নিজের বিনিয়োগটি বিশাল। এ অবধি কোন শিল্পে বিনিয়োগ না করলেও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিপুল সংখ্যক  সাংস্কৃতিক সৈন্য প্রতিপালনে। ভারত থেকে দলে দলে আসছে নাট্যকর্মী, কবি-সাহিত্যিক, গায়ক-গায়িকা ও সিনেমাকর্মী।

জাতিকে বাঁচাতে হলে চেতনার দূষিতকরণ এ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচাটি অতি জরুরী। যে পাইপ লাইনে ঘরে ঘরে সংস্কৃতির নামে জাতি-ধ্বংসের জীবাণু পৌঁছে দেয়া হয় -বিচ্ছিন্ন করতে হয় তার সংযোগ। স্বাধীন ভাবে বাঁচবার তাগিদে অতি অপরিহার্য হলো এরূপ অপসংস্কৃতির বিলোপ। জাতির সুস্থ্যতা আসতে পারে একমাত্র এ পথেই। তবে এ সাংস্কৃতিক যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে লোকবল বা অস্ত্রবল বাড়িয়ে শত্রুকে পরাজিত করা অসম্ভব। অসম্ভব জনগণের অর্থবল বাড়িয়েও। চেতনার ভূমির পাহারাদারির কাজটি যেমন অস্ত্র দিয়ে হয়না, তেমনি অর্থ দিয়েও হয়না। এজন্য চাই বিপুল সংখ্যায় বুদ্ধিবৃত্তিক মোজাহিদ। চাই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। সে জিহাদে চাই পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান। কিন্তু বাংলাদেশীদের জীবনে সে পবিত্র জিহাদের প্রস্তুতি কই? এবং কতজনই বা সে জিহাদের গুরুত্ব বুঝে? বাঙালী মুসলিমের জীবনে ভয়াবহ বিপদের কারণ তো এখানেই। ১ম সংস্করণ ১১/০৮/২০০৩; ২য় সংস্করণ ৫/১১/২০২০।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *