সেক্যুলারিস্টদের এজেন্ডা ও ইসলামের এজেন্ডা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

সেক্যুলারিস্টদের এজেন্ডা              

বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মাঝে ইসলাম-বিরোধী চরিত্রটি আজকের নয়, বরং এর শুরু দেশটির জন্মের বহু পূর্ব থেকেই। তাদের এজেন্ডাও গোপন বিষয় নয়। সেক্যুলারিস্টদের মূল এজেন্ডা বঙ্গীয় ভূমিতে ইসলামকে পরাজিত রাখা এবং বাঙালী মুসলিমদের ইসলামে অঙ্গিকারহীন করা। এ লক্ষ্যে তাদের ঘনিষ্ট কোয়ালিশনটি ভারতের ন্যায় ইসলামে শত্রুপক্ষের সাথে। এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের মূল যুদ্ধটি ইসলামপন্থিদের নির্মূলে। আলো ও আঁধারের মাঝে যে ফারাক, তেমনি ফারাক ইসলাম ও সেক্যুলারিজমের মাঝে। আঁধারের বিলুপ্তি যেমন আলোর আগমনে, তেমনি সেক্যুলারিজমের মৃত্যু ইসলামের বিজয়ে। ইসলামের বিজয়ের মাঝে শেখ মুজিব তাই নিজের ধর্মহীন রাজনীতির মৃত্যু দেখতেন। ফলে গায়ের জোরে ও আইন করে ইসলামী শক্তির উত্থানকে তিনি রহিত করেছিলেন। অথচ যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে এতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণ থেকে রায় নেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি কোন কালেই হয়নি।

১৯৭০ সালের নির্বাচনটি হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। সেখানে মূল ইস্যুটি ছিল ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন ও পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বৈষম্যের বিলুপ্তি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে সেক্যুলারিজম কোন ইস্যু ছিল না। জনসভাগুলিতে ভোট চাওয়া হয়নি সেক্যুলারিজমের পক্ষে। বরং ভোট নেয়া হয়েছে কোর’অআন-হাদীসের বিরুদ্ধে কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না -সে ওয়াদা দিয়ে। ভোট নেয়া হয়েছে পাকিস্তান ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। জনসভাগুলোতে শেখ মুজিব নিজে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগানও দিয়েছেন। পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে সরকারের দেয়া ৮ দফা লিগাল ফ্রেমওয়ার্কেও স্বাক্ষর করেন। অথচ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর শেখ মুজিব তার গোলপোস্টই পাল্টে ফেলেন। ত্রি-মুখি যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তান, গণতন্ত্র ও ইসলামের বিরুদ্ধে। মুজিবের পক্ষে ভারত, রাশিয়া ও ইসরাইলের ন্যায় ইসলামের শত্রুপক্ষ থাকায় পাকিস্তান পরাজিত হয়, গণতন্ত্র কবরে যায় এবং নিষিদ্ধ হয় ইসলামের পক্ষের শক্তির রাজনীতি।  

ক্ষমতা হাতে পেয়ে মুজিব তার আসল রূপে হাজির হন। ভারতের এজেন্ডা তখন তার নিজের এজেন্ডায় পরিণত হয়। নাস্তিক, কম্যুনিষ্ট, সমাজতন্ত্রি, জাতিয়তাবাদী, এমনকি পতিতাদেরও নিজ নিজ বিশ্বাস, কর্ম, আদর্শ ও জীবববোধ নিয়ে সংগঠিত হওয়ার অধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু যারা ইসলামের বিজয় চায় -তাদেরকে সে সুযোগ দেননি। কেড়ে নিয়েছেন তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার। ঈমান নিয়ে বাঁচার অর্থই হলো ইসলামের পক্ষ নিয়ে বাঁচা। তাই ইসলামের শত্রুপক্ষের মূল স্ট্রাটেজী হলো, ঈমানের ভূমিতে হামলা করা। সে কাজে ব্যবহৃত হয় দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, মিডিয়া ও প্রশাসন।

 

পাপ যেখানে নিরপেক্ষ থাকায়

ন্যায় ও অন্যায়, সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ নিয়েই মানব জাতির সমগ্র ইতিহাস। এ দ্বন্দে নিরপেক্ষ থাকাই মহাপাপ। ব্যক্তির ঈমান শুধু নামায-রোযায় ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে রাজনীতির অঙ্গণে কোন পক্ষ নিল -তা থেকেও। বরং সত্য তো এটাই, ইসলাম ও অনৈসলামের দ্বন্দে নিস্ক্রিয় থাকাটি শুধু অধমর্ই নয়, এটি চরমতম বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। একাজ কাফেরদের বা মুনাফিকের। সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, ব্যাভিচার ও সন্ত্রাসের নির্মূলে কোন ঈমানদার কি নিরপেক্ষ বা নিস্ক্রিয় থাকতে পারে? নিরপেক্ষ বা নিস্ক্রিয় থাকা চলে কি কাফেরদের প্রণীত আইন নির্মূলের যুদ্ধে? নিরপেক্ষ থাকলে কি ঈমান থাকে? ঈমান নিয়ে বাঁচার তাগিদে তাঁকে আপোষহীন হতে হয় যেমন দুর্বৃত্তির নির্মুলে, তেমনি শরিয়তের প্রতিষ্ঠায়।

নিজ নিজ ধর্মের পক্ষ নিয়ে বাঁচাটি এমন কি আরবের কাফেরদের কাছেও অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা ইসলামে অবিশ্বাসী হলেও নিজ নিজ ধর্মে অবিশ্বাসী ছিল না। সমাজের বুকে চলমান লড়াইয়ে নিরপেক্ষও ছিল না। নিজ ধর্মের রক্ষায় তারা প্রাণ দিতেও রাজী ছিল। কাফেরদের জীবনে সেটি দেখা গেছে বদর, ওহুদ ও হুনায়ুনের যুদ্ধে। তাই সেক্যুলারিজম তথা ধর্মে অঙ্গিকারহীনতা আদৌ যেমন ইসলামের পরিভাষা নয়, তেমনি আরবী পরিভাষাও নয়। এমন শব্দ আরবী ভাষার আদি রুপে নেই। সেক্যুলারিজম শব্দটির প্রচলন হয় পাশ্চাত্যে। সেক্যুলারিজম বোঝাতে অধুনা ‘আলমানী’ নামে একটি নতুন শব্দ আরবী ভাষাতে যোগ করা হয়েছে নিছক পাশ্চাত্যের প্রভাবে। মুসলিম বিশ্বে এটি সাম্প্রতিক আবিস্কার।

সংঘাতময় এ বিশ্বে ইসলামের পক্ষে না হলে অবশ্যই তাকে ইসলামের বিপক্ষে হতে হয়। নিরপেক্ষতা বলে মধ্যম পথ ইসলামে নাই। বিদ্রোহীদের গায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পড়ানো হয় স্রেফ ইসলাম বিরোধীতাকে গোপন করার লক্ষ্যে। এজন্যই বাংলাদেশে মত দেশে যারা ধর্ম নিরপেক্ষতার ভান কর তারাই আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার ঘোরতোর বিরোধী। এবং এটি তাদের গোপন বিষয়ও নয়। বাংলাদেশে এদের সংখ্যাটি বিশাল এবং এদের কারণেই শরিয়ত বিরোধী আইন -যা বৈধতা দেয় বেশ্যাবৃত্তি, সূদ, জুয়া, মদ্যপান তা এখনো টিকে আছে। অথচ এরূপ আচরণ কখনোই ঈমানদারের হতে পারে না। সাহাবায়ে কেরামদের কেউ মিথ্যা ও দুর্বৃত্ত নির্মূলের যুদ্ধে নিরপেক্ষ থেকেছেন -তার নজির নেই। অথচ সেক্যুলারিস্টগণ চায় মুসলিমগণ নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রয় হোক। ইসলামের বিজয়ে মুসলিমদের সংগঠিত হতে দেওয়ার অর্থ যে তাদের পরাজয় ডেকে আনা -সেটি সেক্যুলারিস্টগণ বুঝে। ফলে ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে এজন্যই তারা খড়গহস্ত। কিন্তু পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিস্ট শাসনে সে বিপদ নেই। কারণ ইসলাম সেখানে কোন রাজনৈতিক শক্তি নয়। এজন্যই ইসলামপন্থিদের নির্মূলে পাশ্চত্যের সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে সেরূপ যুদ্ধ নেই -যা রয়েছে বাংলাদেশ ও মিশরের ন্যায় সেক্যুলারিস্ট-অধিকৃত দেশগুলিতে।

 

জন্ম পাশ্চাত্যে

খৃষ্টান ধর্ম রাজনীতিবিদদের জন্য ফাঁকা ময়দান ছেড়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রপরিচালক রূপে হযরত ঈসা (আঃ) কোন আদর্শ রেখে জাননি। এমনকি রেখে যাননি তাঁর খলিফাগণও। ফলে অতিশয় ধর্মভীরু পাদ্রীরাও ধর্মবর্জিত শাসকদের বিরুদ্ধে বিকল্প কোন মডেল খাড়া করতে পারেননি। খৃষ্টান ধর্মযাজকগণ এজন্যই সেক্যুলারিস্টদের ন্যায় সেক্যুলার। ধর্মকে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গণে নিতে চান না। সেক্যুলারিস্টগণ তো সেটিই চায়। ফলে সেক্যুলারিস্ট রাষ্ট্রীয় নেতাদের সাথে তাদের কোন দ্বন্দ নাই। ধর্মীয় অনুশাসনকে গীর্জার চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখাকেই তারা পবিত্রতা ভাবেন। ফলে দুর্বৃত্ত শাসকদের পক্ষ থেকে যখন এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বুকে অন্য ধর্ম ও অন্য বর্ণের মানুষদের নির্মূলের কাজ শুরু হয় -তখনও তারা নিশ্চুপ থেকেছে। মুখ খুলেনি এমনকি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের নৃশংস লুন্ঠনের বিরুদ্ধেও।

খৃষ্টান জগত রাজনীতি শিখেছে খৃষ্টীয় চতুর্থ দশকে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের কাছ থেকে -যখন তিনি খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা নেন। খৃষ্টান হওয়ার পরও কনস্টানটাইনের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ছিল না। ছিল নৃশংস স্বৈরাচার। ছিল না কারো ধর্মীয় আজাদী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে রোমান সাম্রাজ্যের প্রজাদের বলপূর্বক খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বাঁচাটি অপরাধ রূপে গণ্য হয়। খৃষ্টান পাদ্রীদের কাজ হয়, স্বৈরাচারি শাসকদের সে নৃশংস কাজ গুলোকে জায়েজ বলে প্রচার করা। পরবর্তীকালে সেটিই মডেলে পরিণত হয়েছে সমগ্র পাশ্চাত্য জগতে। রাজনীতিতে ধর্মের প্রবেশ বন্ধ করে অধর্মকে এভাবেই সর্বস্তরে প্রতিষ্টা দেয়া হয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা যখন আফ্রিকার দুর্বল ও দরিদ্র মানুষদের গলায় রশি বেঁধে গবাদী পশুর ন্যায় বাজারে তুলে বা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের নির্মূলে লাগে -তখন পাদ্রীরা নিশ্চুপ থাকাটাই ধর্ম-কর্ম মনে করেছিল। অনেকে বরং এটিকে সভ্যতার বিস্তার বলে সে বর্বরতাকে প্রশংসাও করেছিল। পাশ্চাত্য সমাজে বিবাহ যে ভাবে প্রাচীন প্রথারূপে চিত্রিত হচ্ছে এবং প্রসার পাচ্ছে অবাধ যৌণতা, পর্ণগ্রাফি এবং সমকামিতা -সেটি তো ধর্মবর্জিত সেক্যুলার সংস্কৃতি ও রাজনীতির কারণেই। সেক্যুলারিজমের কাছে খৃষ্টান ধর্মীয় নেতাদের পরাজয় এতটাই গভীর হয়েছে যে সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস একই লিঙ্গের মানুষের মাঝে বিবাহকে বৈধতা দিয়েছেন।  

 

রাজনীতি যেখানে ফরজ

ইসলামের বিধান এক্ষেত্রে ভিন্ন। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাযী, রোযাদার বা হাজী হওয়া নয়, বরং রাজনীতির ময়দানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনও। গুরুত্বূর্ণ দায়িত্ব হলো, রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও রাজনীতির উপর নজরদারি রাখা ও তার সংস্কারে আত্মনিয়োগ করা। এটি শুধু নবীজীর (সাঃ) সুন্নতই নয়, ইসলামের এটি ফরজ বিধান। নবীজী (সাঃ) নিজেই ছিলেন আমুত্যু রাজনীতিবিদ। আমৃত্যূ রাজনীতিবিদ ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা, আশারায়ে মোবাশ্শেরা ও নবীজীর প্রতিটি সাহাবা। শত্রুর হামলার মুখে নবীজীর (সাঃ) ন্যায় সেদিনের মুসলিমগণ বিধর্মীদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, দেশ-শাসন করেছেন এবং বিপুল সংখ্যায় শহিদও হয়েছেন। মুসলিম হওয়ার অর্থ তো সে শিক্ষাটি নিয়ে বাঁচা। ইসলামের প্রতি অটুট ঈমান যেমন কাম্য, তেমনি কাম্য হলো রাজনীতির অঙ্গণে ইসলামের বিজয়ের অঙ্গিকার। সেটি না থাকলে কেউ কি মুসলিম থাকে?

 

প্রভাব পাশ্চাত্যের

মুসলিম বিশ্বে যারা সেক্যুলার রাজনীতির ধারক -তাদের জীবনে প্রভাবটি পাশ্চাত্যের খৃষ্টানদের, ইসলামের নয়। ইসলাম ও নবীজীর (সাঃ)’র শিক্ষা থেকে তারা অনেক দূরে। মুসলিম নাম ধারণ কর অনেকে যেমন সূদ, ঘুষ, মদ ও পতিতাবৃত্তির পথে নামে এবং নাস্তিক ও কম্যিউনিস্ট হয়, তেমনি অনেকে  ইসলাম-বিরোধী সেক্যুলারিস্টও হয়। তাদের কাছে ধর্মে অঙ্গিকার রাখার অর্থ মৌলবাদ। অনেকে কাছে সেটি সন্ত্রাস। পাশ্চাত্য দেশের নব্য-ক্রসেডপন্থি নেতাদের সাথে মুসলিম দেশের সেক্যুলারিস্টদের সখ্যতা এজন্যই এতটা গভীর। তবে পাশ্চাত্যের সাথে তাদের মিলটা নিছক ধর্মহীনতায়, পাশ্চাত্যবাসীর ভাল গুণগুলি তারা পায়নি। সেগুলি শেখানোও হয়নি। ফলে ধর্মহীনতার কারণে এদের বেড়েছে সীমাহীন চরিত্রহীনতা।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, তুরস্ক – এসব দেশগুলিতে বিগত অর্ধ-শতাব্দির বেশী কাল জুড়ে সেক্যুলারিস্টগণ ক্ষমতাসীন। কিন্তু এসব সেক্যুলারিস্টগণ নিজদের দেশের কোন গৌরবই বাড়াতে পাড়েনি। বরং দূর্নীতি, অপচেতনা ও অপসংস্কুতিতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে তারা বিবস্ত্র করে ছেড়েছে। আর এক্ষেত্রে সবাইকে হার মানিয়েছে বাঙালী সেক্যলারিস্ট। দেশকে তারা ৫ বার বিশ্বের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত করেছে। রাজনীতি যেখানে ইবাদত, সেটিকে এরা দুর্বৃত্তির পেশাতে পরিণত করেছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল পরিণত হয়েছে অপরাধীদের ট্রেড ইউনিয়নে। রাজনৈতিক দলের ক্যাডারগণ নেমেছে চাঁদা আদায় ও ভোট ডাকাতির সন্ত্রাসে। এরা এতটাই মনুষ্যত্ব-বর্জিত যে মানুষ খুন করা, যাত্রীভর্তি বাসে আগুণ দেওয়া, ব্যাংক ডাকাতি করা ও ভোট-ডাকাতি করা -এদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়।

 

বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতা ও ভাবনার বিষয়

দ্রুত নিচে ধাবমান বাংলাদেশকে বাঁচানোর সামর্থ্য যে সেক্যুলারিস্টদের নাই -সেটি ইতিমধ্যেই প্রমানিত। এরা শুধু বিপদ বাড়াতেই জানে। ৭০ বছরেরও বেশী কাল ধরে সেক্যুলারিস্ট প্রেসক্রিপশনের প্রয়োগ হয়েছে দেশের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, মিডিয়া ও আইন-আদালতে। কিন্তু রোগ সারেনি, বরং বেড়েছে। ফলে ইসলামের এ চিহ্নিত শত্রুপক্ষকে ক্ষমতায় রাখার অর্থ দেশকে আরো নিচে নামানো। তবে এটিও সত্য, ক্ষমতা ও অর্থের লোভে যারা বাঁচে ও রাজনীতি করে -তাদের পক্ষে সশস্ত্র সেক্যুলারিস্টদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়ায়ে বিজয়লাভ অসম্ভব। বরং এ কাজ তা তাদের, যারা এ লড়াইকে পবিত্র ইবাদত ভাবে এবং সে ইবাদতে নিজের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করে।  যুগে যুগে এমন চেতনাধারীগণই রাষ্ট্রে পরিবর্তন এনেছে। অতীতে যে দরিদ্র মুসলিমগণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল -তার পিছনে ছিল এমন এক বলিষ্ঠ চেতনা। তখন চাকরকে উটের পিঠে চড়িয়ে রশিধরে নিজে সামনে চলাকে বিশাল রাষ্ট্রের খলিফা নিজের জন্য সন্মানজনক ভেবেছেন।

 

ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক মুমুর্ষরোগীকে ঔষধ না খাওয়ানোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ এমন অবহেলায় রোগীর মুর্ত্যু অনিবার্য। রাষ্ট্রের সুচিকিৎসায় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রসক্রিপশন দিয়েছেন সর্ববিজ্ঞ মহান আল্লাহতায়ালা। এবং সেটি হলো পবিত্র কোর’আন। এটির ব্যবহার না হলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। বিশ্বের বহু জাতি অতীতে নিছক একারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে –দুর্ভিক্ষ বা মহামারিতে নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার প্রসক্রিপশন বাস্তবায়ন না করার শাস্তি শুধু পার্থিব অশান্তি বা বিপর্যয়ই নয়, বরং সে ব্যর্থতা পরকালে জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়। মুসলিম দেশগুলির সেক্যুলারিস্ট শাসকগণ ইসলামের বিধান প্রয়োগ না করে বস্তুতঃ সে মহা অপরাধটিই করছে। তবে তাদের অপরাধ আরো গুরুতর। নিজ দায়িত্ব পালন না করেই তারা থেমে নাই; বরং আইন করে  নিষিদ্ধ করেছে যেন জনগণ আল্লাহর দেয়া প্রেসক্রিপশনে প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর না হয়।

 

সুরা মায়েদার ৪৪ নম্বর আয়াতে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে সে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে, ‘‘— মান লাম ইয়াহকুম বিমা আনযালাল্লাহু ফা ঊলাইয়িকা হুমুল কাফিরুন।’’ অর্থ: ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম বিচারকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফের।’’ সুরা মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘‘— মান লাম ইয়াহকুম বিমা আনযালাল্লাহু ফা ঊলাইয়িকা হুমুল যালিমুন।’’ অর্থ: ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম বিচারকার্য পরিচালনা করে না তারা যালিম।’’ সুরা মায়েদার ৪৬ নম্বর আয়াতে আবার বলেছেন, ‘‘— মান লাম ইয়াহকুম বিমা আনযালাল্লাহু ফা ঊলাইয়িকা হুমুল ফাসিকুন।’’ অর্থ: ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম বিচারকার্য পরিচালনা করে না তারা ফাসিক।’’

 

উপরুক্ত সুরার পর পর তিনটি আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা যে বিষয়টির বার গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি তাঁর নাযিলকৃত বিধান বা প্রেসক্রিপশনের স্রেফ পাঠ নয়, বরং তার পূর্ণ প্রয়োগ। খুব কম বিষয়েই কোরআনের পর পর তিনটি আয়াতে একই বিষয়ের উপর এরূপ তাগিদ এসেছে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এরূপ সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পর সেক্যুলার হওয়া তথা রাষ্ট্রের বুকে ইসলামী বিধানের প্রতিষ্ঠায় অঙ্গিকারহীন হওয়ার সুযোগ থাকে কি? সেটি তো মহান আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে চরম অবাধ্যতা। সে অবাধ্যতার কারণে নামে বা বংশীয় সূত্রে মুসলিম হলেও সে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার খাতায় জালেম, ফাসেকও কাফের রূপে চিহ্ণিত হয়। তেমন একটি পরিচয় নিয়ে কেউ কি জান্নাত-প্রাপ্তির স্বপ্ন দেখতে পারে? বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এমন কি অতীতের স্বৈরশাসকদের কাছেও সেটি ভীষণ গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে মুসলিম দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শাসন ও তাদের তাঁবেদার সেক্যুলারিস্টদের শাসনের পূর্বে প্রতি জনপদে কোর’আনের আইনই ছিল বিচারকার্য পরিচালনার একমাত্র আইন। এমনকি সিরাজুদ্দৌলার শাসনাধীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ও সমগ্র ভারত ব্যাপী মোগল শাসনেও প্রতিষ্ঠিত ছিল কোর’আনের আইন। এ আইনের প্রয়োগে ভারতে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। সে শরিয়তি আইনেরই বিখ্যাত সংকলন হলো ফতোয়ায়ে আলমগিরি। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯০ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও দেশটিতে মহান আল্লাহতায়ালার আইনের প্রয়োগ নেই। বাঙালী মুসলিমের জীবনে এটি কি কম ব্যর্থতা? এ ব্যর্থতা নিয়ে  মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে তারা মুখ দেখাবে কি করে?

 

বাংলাদেশের মুসলিমদের ব্যর্থতা অনেক। আরব, ইরানী, তুর্কী বা আফগানদের ন্যায় ভিন্ দেশের ভূমিতে ইসলামের বিজয় আনা দূরের কথা, নিজ দেশেও তারা মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের বিজয় বাড়াতে পারেনি। অথচ এ কাজের জন্য সাহাবায়ে কেরামের জীবনে যেমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এসেছিল, বাংলাদেশে সেটির প্রয়োজন ছিল না। অর্থ ব্যয় বা শ্রম ব্যয়েরও প্রয়োজন ছিল না। ভোট দিয়েই সেটি সম্ভব ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলিমগণ সেটিও করতে পারেনি। তারা বরং গায়ে গতরে খেটেছে, লাঠি ধরেছে ও ভোট দিয়েছে আল্লাহর অবাধ্য সেক্যুলারিস্টদের বিজয় বাড়াতে। অতীতে স্বৈরাচারি মুসলিম শাসকদের প্রাসাদে অনাচার থাকলেও আদালত থেকে কোরআনের আইন হটিয়ে আল্লাহতায়ালার দরবারে কাফির, জালিম ও ফাসিক রুপে চিত্রিত হওয়ার সাহস দেখায়নি। এমনকি সে সাহস কারবালায় ইমাম হোসেন হত্যার ঘৃণ্য নায়ক ইয়াজিদেরও হয়নি। কিন্ত সে সাহস দেখিয়েছে বাংলাদেশের মুসলিম নামধারি সেক্যুলার রাজনীতিবিদগণ।

 

আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রটি শুধু ঘর, দল, ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, বরং সে অবাধ্যতায় পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশের আদালত, প্রশাসন ও রাজনীতি। ফলে বিশ্বব্যাপী দুর্বৃত্তে প্রথম হওয়ার যে অসম্মানটি কাফের বা শাপ-শকুন ভক্ষণকারি প্রকৃতি পুজারি জঙ্গলবাসিদের জুটেনি -সেটি জুটেছে বাংলাদেশীদের। তারা দূর্নীনিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথমই শুধু হয়নি, মুজিবামলে তলাহীন ভিক্ষার ঝুড়ির খেতাবটিও সংগ্রহ করেছে। এটি কি আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার শাস্তি নয়? এ ব্যর্থতার মূল কারণ যে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া কোর’আনী প্রেসক্রিপশনটি মেনে না চলা -তা নিয়েই বা ভাবনা ক’জনের? ইসলামের বিজয়ে যাদের মনে সামান্য অঙ্গিকার আছে, আল্লাহর দ্বীনের প্রতি মহব্বত আছে এবং ইজ্জত নিয়ে বাঁচায় আগ্রহ আছে অন্ততঃ তাদের এ নিয়ে ভাবা উচিত। ১ম সংস্করণ ২৪/০৬/২০০৭; ২য় সংস্করণ ০৭/১১/২০২০।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *