সেক্যুলারিস্টদের প্রতারণা ও নাশকতার রাজনীতি
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 11, 2020
- Bangla Articles, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
নাশকতা সভ্যতর সমাজ নির্মাণের বিরুদ্ধে
মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিস্টদের নাশকতাটি যেমন ভয়ংকর, তেমনি বহুমুখি। তাদের লক্ষ্য, মুসলিম জীবন থেকে তাদের মূল পরিচিতি তথা আইডেন্টিটির বিলুপ্তি। এবং দিতে চায় এমন এক নতুন পরিচিতি যাতে অসম্ভব হয় মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। অধিকাংশ দেশে তাদের সে প্রকল্প সফলও হয়েছে। তাতে মুসলিম জীবনে যেমন পরাজয় এসেছে, তেমনি পথভ্রষ্টতা বেড়েছে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে। মুসলিমদের মর্যাদা শুধু এ জন্য নয় যে তাঁরা মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলদেরকে উপর বিশ্বাস করে। বরং এ জন্য যে, একমাত্রই তারাই এ জমিনের বুকে মহান আল্লাহতায়ালার নির্বাচিত খলিফা। ধনসম্পদ, জনসম্পদ,খনিজ সম্পদ তিনি বহু জাতিকেই দিয়েছেন, কিন্তু নিজের খলিফার মর্যাদাটি নির্ধারিত করেছেন একমাত্র মুসলিমদের জন্য। কোন রাষ্ট্রে বা প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হয়, সে কি ধরনের কাজ করে বা কি তার রোল (role) বা ভূমিকা –তা থেকে। তাই দেশে একজন কেরানী ও রাষ্ট্র প্রধানের ভূমিকা যেমন এক নয়, তেমনি এক নয় উভয়ের মর্যাদাও। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে খলিফা রূপে নিযু্ক্তি পাওয়ার বিষয়টি দেখতে হবে তেমনি এক দৃষ্টিকোণ থেকে। কোন ব্যক্তির মর্যাদা –সে যত বড় রাজা-মহারাজাই হোক না কেন, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার সমকক্ষ হতে পারে না। এ মহান মর্যাদাটি তিনি এমন কি ফেরেশতাদেরও দেননি। এ বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফেরেশতাগণ হযরত আদম (আঃ)’কে সন্মানসূচক সেজদা করেছিলেন। রোজ হাশরের বিচারদিনে চাষাবাদ, ব্যবসা-বানিজ্য ও চাকুরি-বাকুরীর সফলতা নিয়ে বিচার হবে না। বরং বিচার হবে, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার দায়িত্ব পালনে কতটা ছিল সামর্থ্যের বিনিয়োগ।
সেক্যুলারিস্টদের বড় নাশকতাটি হলো, তারা অধিকাংশ মুসলিমের মন থেকে বিলুপ্ত করতে পেরেছে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ পরিচিতিটি। সেটি সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। নিজের পরিচিতিটি ব্যক্তির জীবনে দেয় ভিশন এবং মিশন। এমন কি খেলার মাঠেও প্রতিটি খেলাওয়াড়কে জানতে হয় কোথায় তাকে খেলতে হবে। ফলে গোলরক্ষক কখনই গোলপোস্ট ছেড়ে মধ্যমাঠে আসেনা। সে কান্ডজ্ঞানটুকু না থাকলে তাকে মাঠ থেকে তুলে নেয়া হয়। বস্তুত ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে বড় অজ্ঞতাটি হলো তার নিজের রোল (role)টি না জানা। সে অজ্ঞ ব্যক্তিটি তখন ব্যর্থ হয় নিজের দায়িত্ব পালনে। অথচ মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় অজ্ঞতাটির প্রকাশ ঘটছে চাষাবাদ বা ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়, বরং নিজের রোল বা পরিচিতিটি জানার ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসেফর, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা সেনাবাহিনীর জেনারেল হওয়ার পরও সে অজ্ঞতা থেকে মুক্তি মিলছে না। ফলে তারা সানন্দে বাঁচে শয়তানের খলিফা রূপে। এবং নিজ সামর্থ্যের বিনিয়োগ করে ইসলামকে পরাজিত করার কাজে। বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে সেক্যুলারিস্টদের এখানেই বিশাল বিজয়। মুসলিম হওয়ার অর্থ যে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বাঁচা – সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে তারা মুসলিম চেতনা থেকে বিলুপ্ত করতে পেরেছে। সেটি রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন, মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ফলে মুসলিম দেশে যতই বাড়ছে জনসংখ্যা, ততই বাড়ছে শয়তানের খলিফার সংখ্যা। তাই ইসলামপন্থিদের ফাঁসিতে ঝুলাতে, লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে নিরীহ নাগরিক মারতে বা শাপলা চত্ত্বরে মুসল্লীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ঘটাতে বিদেশী শত্রুদের পড়ে না। সে কাজে শয়তানের দেশী খলিফারাই যথেষ্ট।
সেক্যুলারিস্ট-শাসনে অপরাধ গণ্য হয়, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার পরিচিতিটি নিয়ে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত ও প্রশাসনের অঙ্গণে হাজির হওয়া। এবং দন্ডনীয় অপরাধ গণ্য হয়, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর দেয়া শরিয়তের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে আন্দোলনে নামা। অপরদিকে তারা ব্যক্তিকে গোলাম বানায় নিজ নফস বা প্রবৃত্তির। গোলাম বানায় দলীয় নেতা ও গোত্রীয় প্রধানের। ফলে মুর্তিপূজা কমলেও তারা বাড়িয়েছে ব্যক্তিপূজা। এভাবে বাড়িয়েছে শিরক। এ হলো ঈমান-আক্বিদার বিরুদ্ধে সেক্যুলারিস্টদের নাশকতা।এমন এক নাশকতামূলক চেতনা নিয়েই শেখ মুজিব মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বদলে নিজের হুকুমকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। জায়েজ করেছিল একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার; এবং নিষিদ্ধ করেছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে দলগড়া ও রাস্তায় নামা। একই রূপ অপরাধে নেমেছে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা। দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে গুম, খুন, নির্যাতন ও ফাঁসির রাজনীতি। তবে সেক্যুলারিস্টদের এ যুদ্ধটি নিছক মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধ নয়, বরং সেটি খোদ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। লক্ষ্য, ইসলামকে পরাজিত রাখা এবং শয়তানী প্রজেক্টকে বিজয়ী করা। পৃথিবী পৃষ্ঠে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে? ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এরূপ যুদ্ধ মহান নবীজী (সাঃ) এবং খলিফায়ে রাশেদার যুগে শুরু হলে নিশ্চয়ই প্রাণদন্ড দেয়া হত। কারণ, সমাজের বুকে এরাই হলো ফিতনা সৃষ্টিকারি। এরা অসম্ভব করে ঈমান-আক্বিদা নিয়ে সভ্য ভাবে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বমাঝে ৫ বার প্রথম হয়েছে তো এদের কারণেই।
এক সাথে দুই নৌকায় পা রাখা যায় না। ফলে সেক্যুলারিস্ট হতে হলে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার পদটি অবশ্যই ছাড়তে হয়। এ বিশ্বমাঝে মানুষের পরিচিতি মাত্র দু’টি। হয় সে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা, নয় সে খলিফা শয়তানের। তৃতীয় কোন পরিচিতি নেই। তাই মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার পদটি ছাড়লে শয়তানের খলিফা হ্ওয়া ছাড়া অন্য পথ থাকে না। শয়তানের পথে পা পাড়ালে তখন বহু কিছুই ছাড়তে হয়। তখন বন্ধ হয়ে যায় লড়াইয়ের ময়দানে সাহায্যকারী রূপে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের আগমন। কারণ সেরূপ সাহায্য তো একমাত্র ঈমানদারদেরই প্রাপ্য। রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রশাসনের অঙ্গণে কাফের থেকে একজন মুসলিমের যে বহুবিধ ভিন্নতা, সেগুলি ভাষা, বর্ণ বা জলবায়ুর কারণে নয়, বরং মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা হওয়ার কারণে। খেলাফতের সে চেতনাটি থাকাতে ঈমানদার কখনোই সেক্যুলারিস্টদের ন্যায় ধর্মশূর্ন, ধর্মে অঙ্গিকারশূর্ন বা ধর্ম ও অধর্মের মাঝে নিরপেক্ষ হয় না। তাকে বরং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদে নামতে হয়। সে জিহাদে নিজের জান, মাল, মেধা ও প্রাণের বিনিয়োগও করতে হয়। ঈমানী দায়বদ্ধতার কারণেই শিক্ষার অঙ্গণে তাকে শুধু অংক, বিজ্ঞান, চিকিৎসা-বিজ্ঞান, ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করলে চলে না, কোর’আন-হাদীসের উপর জ্ঞানার্জনেও একনিষ্ট হতে হয়। নইলে মুসলিম হওয়াতেই অপূর্ণতা থেকে যায়। পেশাদারি কাজকর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গণে তার সামর্থ্যের বিনিয়োগ গণ্য হয় মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার মাধ্যেম রূপে। তার প্রতিটি মুহুর্ত কাটে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হওয়ার ভাবনায়। সভ্যতর সভ্যতা তো এভাবেই নির্মিত হয়। অতীতে মুসলিমদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তো এরূপ মহৎ ভাবনাতেই। অথচ সেক্যুলারিস্টদের লক্ষ্য, সভ্যতর সমাজ নির্মাণের সে কাজকে অসম্ভব করা। মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়ানক নাশকতাটি তাই কোন হিংস্র পশু, মহামারি বা সুনামীতে হয়নি, বরং হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে সেক্যুলারিস্টদের হাতে।
সবচেয়ে ক্ষতিকর যে অপরাধকর্মটি
সেক্যুলারিস্টদের দাবী, তারা ধর্ম-বিরোধী নয়। এবং একথাও বলে, তারা ধর্ম-নিরপেক্ষ। এটি শুধু অসত্যই নয়, চরম প্রতারণাও। তারা ধর্ম-নিরপেক্ষতার ভান করে স্রেফ মূল লক্ষ্যকে আড়াল করতে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে নিজেদের ইসলামবিরোধী প্রকল্পের কথাটি খোলাখোলি বলার সাহস নাই বলেই তারা এরূপ নিরপেক্ষতার ভান করে। রাজনীতির ময়দানে এমন ছলনাকে তারা জায়েজও মনে করে। সেক্যুলারিজমের জন্ম ইউরোপ। সেক্যুলারিস্টদের বিজয় ঘটে রাষ্ট্রের উপর থেকে খৃষ্টান চার্চের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার মধ্য দিয়ে। সেক্যুলারিজমের কথা, চার্চের কাজে রাষ্ট্রের শাসকগণ কোন হস্তক্ষেপ করবে না। এবং চার্চের ধর্মযাজকগণ কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন হলো সেক্যুলারিজমের এ মডেল কি কোন মুসলিম গ্রহণ করতে পারে? কারণ এতে নিষিদ্ধ হয় রাষ্ট্রের অঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের প্রবেশ। শরিয়তের কর্মসীমা সীমিত হয় স্রেফ ব্যক্তি জীবনে। বড় জোর মসজিদ ও পরিবারের মধ্যে। অথচ মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচী থেকে কোন প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও ব্যক্তিই প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে না। নীতি, আদর্শ বা আইন –তা যত উত্তমই হোক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়া বাস্তবায়ীত হয় না। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর মানব সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন, এবং তাদের কল্যাণে তিনি শরিয়তের বিধান দিয়েছেন। মানব জাতির জন্য এটিই মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আখেরাতের সাফল্য নির্ভর করে সে বিধান কতটা পালিত হলো তার উপর। ফলে মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চাষাবাদ, ব্যবসা-বানিজ্য বা চাকুরি-বাকুরি নয়, বরং সেটি কোর’আন বিধান মেনে চলা। নইলে অনিবার্য হয় জাহান্নাম।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যদি মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় -তবে সে কোর’আনী বিধান বাস্তবায়ীত হবে কীরূপে? সেক্যুলারিস্টদের এ ষড়যন্ত্রটি তো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। তাদের অবস্থান এখানে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিপক্ষ রূপে। প্রশ্ন হলো পৃথিবী পৃষ্টে এর চেয়ে বড় অপরাধ দ্বিতীয়টি আছে কি? এ অপরাধ কর্মটির মধ্য দিয়ে কোটি কোটি মানুষের জান্নাতে যাওয়ার পথটি বন্ধ করা হয়। চোর-ডাকাতেরা অর্থ লুন্ঠন করে, খুনিরা মানুষ খুন করে, ধর্ষকেরা নারী ধর্ষণ করে। কিন্তু তাদের এ অপরাধের ঘটনাটি কাউকে জাহান্নামে টানে না। কিন্তু সেটি করে সেক্যুলারিস্টগণ। অতএব এরাই হলো সমাজের সর্বনিকৃষ্ট অপরাধী। তাই সবচেয়ে পবিত্রতম জিহাদটি হলো সেক্যুলারিস্ট নির্মূলের জিহাদ। এ জিহাদ জাহান্নামের আগুন থেকে কোটি কোটি মানুষ বাঁচানোর।
মুসলিমের সকল কর্ম ও ধর্ম পরাকালমুখি। এখানে সার্বক্ষণিক কাজ করে পরকালে সফল হওয়ার চেতনা। অথচ পরকালের সে ভাবনাটি সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বরং তারা চায়, পরকালমুখি জীবনের সে গতিধারাকে ঘুরিয়ে দিতে। ফলে সে কাজে তারা একটি পক্ষ নেয়। অতএব তাদেরকে কি নিরপেক্ষ বলা যায়? ঈমানদারগণ যেমন নিরপেক্ষ নয়, তারাও নয়। আগুনকে তার উত্তাপ থেকে কখনই আলাদা করা যায় না। তেমনি একটি অবস্থা প্রতিটি মুসলিমের। যেখানেই সে যায়, ঈমানকে সে সাথে নিয়েই যায়। তাই মুসলিমের ইবাদত-বন্দেগী ও পোষাক-পরিচ্ছদের পাশাপাশি তাঁর রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিচার-আচারের মাঝেও প্রকাশ পায় ঈমানের উত্তাপ। প্রকাশ পায় পরকালমুখিতা। কিন্তু সেক্যুলারদের দাবী, মুসলিমদেরকে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, আইন-আদালত ও জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে ইসলামের প্রচার বা প্রকাশ না ঘটিয়েই। কিন্তু সেটি কি সম্ভব? সেটি সম্ভব একমাত্র ঈমানের আগুনকে নিভিয়েই। সেক্যুলার রাজনীতিতে তাই মুসলিমের ঈমান বাঁচেনা। প্রতিটি মুসলিমকে প্রতিদিন ও প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় ঈমানকে হৃদয়ে নিয়ে। তাই সেটি কি জায়নামায বা মসজিদের মেঝেতে ফেলে রাখার বিষয়? বিদ্যুতের সুইচ অন-অফ করার ন্যায় সেটি বার বার জ্বালানো বা নিভানোর বিষয়ও নয়। ফলে রাজনীতি থেকে জায়নামায এবং জায়নামায থেকে রাজনীতি –ঈমানের ভূমিতে এরূপ বার বার অন-অফ করা যায় কি?
নিরপেক্ষতা যেখানে পাপ
সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায় এবং ইসলাম ও অনৈসলামের দ্বন্দ তো নিত্যদিনের। রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি তথা সর্বক্ষেত্রে এর বিস্তার। এটি কখনও সরবে ঘটে, কখনও নীরবে। কখনও বা অতি সহিংস ভাবে। কথা হলো, এতো দ্বন্দ-সংঘাতের মাঝে কি নিরপেক্ষতা চলে? অন্যায়কে ন্যায়ের, অসত্যকে সত্যের সমকক্ষতা দিলে কাউকে কি সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ বলা যায়? চোখের সামনে চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, স্বৈরাচার, হত্যা, সন্ত্রাস, ব্যাভিচার হতে দেখে কি নিশ্চুপ বা নিরপেক্ষ থাকা যায়? অন্যায়ের সামনে এমন নিরপেক্ষতায় প্রশ্রয় পায় দুর্বৃত্ত। এবং পরাজিত হয় সত্যের পক্ষ। মুসলিম মাত্রই সূর্যকে সূর্য এবং আঁধারকে আঁধার যেমন বলবে, তেমনি মিথ্যাকে মিথ্যাই বলবে। ইসলাম ও অনৈসলামের দ্বন্দে নিরপেক্ষ থাকাটি কবীরা গুনাহ। মুসলিমের উপর ফরয শুধু এ নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। বরং সাক্ষ্য দিবে সত্য বা হকের পক্ষে। সেটি যেমন মুখের কথা দিয়ে তেমনি লেখনীর মাধ্যমে। এবং সেটি রাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন-আদালত ও বুদ্ধিবৃত্তিসহ জীবনের প্রতিক্ষেত্রে। শাহাদতে হক হবে তার জীবনের মূল মিশন। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এরূপ সৈনিক না থাকলে সমাজে সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে কি করে?
তাছাড়া নিরপক্ষতার খোলসে সত্যের বিরুদ্ধাচারন তো চিরকালের। এমন প্রতারণার কারণে অতীতে ইসলামের উপর্যোপরি পরাজয় বা গৌরবহানি হয়েছে। এবং আজও সে ষড়যন্ত্র চলছে। নিরপেক্ষতার গুরুত্ব রয়েছে ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিচার বিশ্লেষণে। এমনকি পবিত্র কোরআনেও নিরপেক্ষ নিরীক্ষণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম কবুলের পর মুসলিম আর নিরপেক্ষ থাকে না, সে তখন আল্লাহর পক্ষের শক্তি। কোরআনী পরিভাষায় হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দলভুক্ত। তখন বাঁচবার প্রধানতম লক্ষ্যে পরিণত হয় আল্লাহর দ্বীনের বিজয়। তখন বিলুপ্ত হয় নিরপেক্ষতার নামে ইসলামকে অন্য ধর্মের সম-পর্যায়ভূক্ত করার প্রবণতা। মুসলিম হওয়ার শর্তই হলো ইসলামকে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্মরূপে কবুল করা এবং সর্বক্ষেত্রে ইসলামের পক্ষ নেয়া। ধর্ম গ্রহনে জবরদস্তি নেই। তবে ইসলাম কবুলের পর ইসলাম-অনৈসলামের দ্বন্দে নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ নেই। সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়াটি ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। কিন্তু যোগ দেওয়ার পর নিরপেক্ষ থাকার অনুমতি থাকে না, তখন যুদ্ধে যেতে হয়, প্রয়োজনে স্বপক্ষে প্রাণও দিতে হয়। নইলে কোর্ট মার্শাল হয় এবং অবাধ্যতার শাস্তি পেতে হয়।
নিরপেক্ষ লোকদের নিয়ে যেমন সেনাদল গড়া যায় না, তেমনি গড়া যায় না মুসলিম উম্মাহও। কোরআনে বর্ণিত ‘‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন’’ যার অর্থঃ ‘‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে এবং আমার ধর্ম আমার কাছে’’ -এটি কোন নিরপেক্ষতার কথা নয়। এতে নাই আপোষমুখিতা। বরং এ আয়াতে ধ্বনিত হয়েছে নিজ ধর্মে সুদৃঢ় অবস্থান ও অঙ্গিকারবদ্ধতার কথা। কিন্তু সেক্যুলারগণ অঙ্গিকারবদ্ধতার সে সুদৃঢ় অবস্থান থেকে মুসলিমদের হটাতে চায়। অথচ ব্যক্তির অঙ্গিকারহীন নড়বড়ে অবস্থানটি সব সময়ই চিহ্ণিত হয়েছে মোনাফিকি রূপে। তাছাড়া পবিত্র কোরআনের উপরুক্ত আয়াতে দ্বীন বলতে যা বোঝানো হয়েছে সেটি প্রচলিত অর্থে ধর্ম বলতে যা বোঝায় -তা নয়। এটির অর্থ নিছক নামায-রোযা বা হজ্ব-যাকাত নয়, বরং এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা পুরাপুরি মেনে চলতে হয় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে। তাই নিছক ব্যক্তিজীবনে সেটি পালিত হলে দ্বীনের মূল লক্ষ্যই ব্যহত হয়।
আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান বা বিশ্বাসের শর্ত হলো, অন্য সব উপাস্যকে অবিশ্বাস করা। ‘ইল্লাল্লাহ’র পূর্বে তাই ’লা ইলাহ’ বলতে হয়। অন্যান্য ধর্মগুলোকে অবিশ্বাস করা তাই মুসলিম হওয়ার পূর্বশর্ত। শুধু মুখের কথায় নয়, কাজের মধ্য দিয়ে সেটির প্রকাশও ঘটাতে হয়। মুসলিম হওয়ার দাবী একজন দুর্বৃত্তও করতে পারে। অথচ কে কতটা মুসলিম বা ইসলামের পক্ষের সে বিষয়ে ব্যক্তির নিজস্ব রূপটি যতটা রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রকাশ হয় সেটি অন্যত্র হয় না। এটি এমন এক ক্ষেত্র যেখানে অতিশয় কপট মুনাফিকও তার কপটতাকে গোপন রাখতে পারে না। মুনাফিকের কপট বিশ্বাস মসজিদের জায়নামাযে ধরা পড়ে না। ধরে পড়ে না রোযা বা হজ্বে। সেটিই দৃশ্যমান হয় রাজনীতিতে। ব্যক্তি তার জান, মাল, মেধা ও প্রাণ কোন পক্ষকে বিজয়ী করতে বিনিয়োগ করে –তা থেকেই ধরা ব্যক্তির ঈমান। এমনকি নবীর যুগেও বহু মুনাফিক তাদের কপট বিশ্বাসকে বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের সে ভন্ডামি ধরা পড়েছিল রাজনীতি ও জ্বিহাদের ময়দানে। কার পক্ষে কে ভোট দিল, অর্থ দিল, লড়াই করলো বা প্রাণ দিল সেটি কি কখনো লুকানোর বিষয়? এখানে ব্যক্তি হাজির হয় তার নিজস্ব বিশ্বাস ও চরিত্র নিয়ে। তাই রাজনীতি মানব জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরিস্টটলের কাছে এটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ গণ্য হয়েছিল যে, তিনি পশু থেকে মানুষকে পৃথক করেছেন এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যটির কারণে। শুধু মুসলিম হওয়ার জন্য নয়, মানুষ হওয়ার জন্যও এটি জরুরী।
ঈমানদারি তো জিহাদ নিয়ে বাঁচাতে
ইসলামে রাজনীতি হলো ও রাষ্ট্রে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদ। একাজে সে শুধু ভোটই দেয় না, অর্থ, শ্রম এমনকি প্রাণও দেয়। শহিদ হওয়ার প্রেরণা তাই ফ্যানাটিসিজম বা ধর্মান্ধতা নয়, এটিই প্রকৃত ঈমান। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘‘ইন্নাল্লাহা আশতারা মিনাল মো’মিনিনা আনফুসাহুম ওয়া আমওয়ালাহুম বি আন্নালাহুমুল জান্নাহ, ইউকাতিলুনা ফি সাবিলিল্লাহি ফা ইয়াকতুলুনা ওয়া ইয়ুকতালুন’’ অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মুমিনের জান ও ধনসম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, অতঃপর (শত্রুদের যেমন) হত্যা করে তেমনি নিজেরাও নিহত হয়।’’ –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)। কোরআন পাকের এ ঘোষণাটির প্রতিফলন ঘটেছে পবিত্র হাদিসপাকেও। মহান নবীজী (সাঃ) বলেছেন,‘‘যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম রূপে পরিচয় দিল অথচ আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে জিহাদ করলো না এবং জিহাদের নিয়েতও করলো না -সে ব্যক্তি মুনাফিক।’’ এমন একটি চেতনার ফল হলো, নবীজীর (সাঃ) যুগে তাঁর কোন সাহাবী বা সহচরই ছিল না যিনি শারিরীক ভাবে সুস্থ্য ছিলেন অথচ জিহাদে অংশ নেননি। এবং এটিই হলো সনাতন ইসলামি চেতনা। অথচ সেক্যুলারিস্টগণ তেমন একটি চেতনাকে সহ্য করতে রাজী নয়।
শত্রুর হামলার মুখে মুসলিম ও ইসলামের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিছক বেতনভোগী সৈনিকের নয়; এ দায়িত্ব প্রতিটি মুসলিমের। এমন একটি চেতনার কারণেই মুসলিম মাত্রই রাজনীতির দর্শক যেমন নয়, তেমনি নীরব এবং নিরপেক্ষও নয়। বরং এটি ফরয গণ্য করে। এ কাজে সে বিনিয়োগ করে তার সমগ্র সামর্থ্যের। অথচ সেক্যুলারিষ্টগণ বাধা দেয় সে বিনিয়োগে। কারণ ঈমানদারদের সে বিনিয়োগের মাঝে তারা নিজেদের রাজনৈতিক মৃত্যু দেখতে পায়। ফলে মুসলিমদের জানমালের এরূপ বিনিয়োগ রুখতে বৃটিশ সরকার গোলাম আহম্মদ কাদিয়ানীকে ভন্ড নবী বানিয়ে তাকে দিয়ে “জিহাদের প্রয়োজন নেই” -এরূপ ফতওয়াও প্রচার করেছিল। গোলাম আহম্মদ কাদিয়ানী মুসলিম সমাজে তেমন বাজার পায়নি। তবে সে অভিন্ন প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে সেক্যুলারিস্টগণ। হাতে ক্ষমতা পেয়ে এরাই ইসলামপন্থিদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল তুরস্ক, মিশর, তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া, সিরিয়াসহ বহু মুসলিম দেশে। বাংলাদেশেও সে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল শেখ মুজিব। ইসলামে যারা নিষ্ঠাবান তাদের সাথে সেক্যুলারিষ্টদের এখানেই মূল বিরোধ। ঈমানদারগণ সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে আল্লাহর শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায়। তারা চায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। অথচ সেক্যুলারিস্টগণ তার ঘোরতর বিরোধী। রাষ্ট্রের বিশাল অঙ্গণে ইসলামকে তারা স্থান দিতে রাজি নয়। ফলে এ নিয়ে সংঘাত অনিবার্য। মুসলিমগণ যতই শান্তিবাদী হোক, তাদের পক্ষে এ লড়াই এড়িয়ে চলা অসম্ভব। এড়াতে পারেননি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তিবাদী নেতা শেষ নবী হযরত মহম্মদ (সাঃ)।
শুধু নামায-রোযা, হ্জ্ব-যাকাতের মাঝে ইসলামকে সীমাবদ্ধ রাখলে জিহাদের মত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের প্রয়োজন কি? পবিত্র কোর’আনে বার বার জিহাদের তাগিদই বা আসবে কেন? প্রয়োজন হতো কি নবীজী (সাঃ)’র যুগে অসংখ্য যুদ্ধের এবং অধিকাংশ সাহাবীর প্রাণদানের? ইসলামের বিজয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)কে বহুবার যুদ্ধে নামতে হয়েছে এবং প্রতিটি যুদ্ধে মৃত্যৃর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু যারা ইসলামে অঙ্গিকারহীন তারা জিহাদে নেমে নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করতে চায় না। তাই জায়নামাযে অসংখ্য মুনাফিকের অনুপ্রবেশ ঘটলেও জিহাদের কাতারে সেটি ঘটেনি। সত্যিকার মুসলিম বাছাইয়ে জিহাদ এভাবে ফিল্টার বা ছাঁকুনির কাজ করে। “সংঘাতে নিরপেক্ষ হওয়াটি মহৎ গুন” -এরূপ কথার মধ্য দিয়ে বহু কপট ব্যক্তি শান্তির অবতার সাজে। এভাবে এরা আড়াল করে নিজেদের ইসলামবৈরীতাকে। অথচ সুযোগ পেলেই এরাই নৃশংস হালাকু-চেঙ্গিজ সাজে। প্রশ্ন হলো, জালেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী না হলে তাকে ঈমানদার দূরে থাক – আদৌ কি সভ্য মানুষ বলা যায়? পশুও হামলার মুখে ধেয়ে আসে। ইসলামের আগমন এজন্য ঘটেনি যে, অনুসারি মুসলিমগণ প্রতিবাদহীন উদ্ভিদ-জীবন পাবে। ইসলাম এসেছে মানবকে জান্নাতমুখি করতে। এসেছে আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ এক উন্নত সভ্যতার নির্মানে। সে লক্ষ্যে অপরিহার্য হলো কোরআন-ভিত্তিক রাষ্ট্র-নির্মান। এটি না হলে সেখানে নির্মিত হয় জাহান্নামের পথ। এবং সে কাজে তখন ব্যয় হয় জনগণের রাজস্বের অর্থ। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে মানুষ এভাবেই নিজ খরচে ধাবিত হয় মহাআযাবের পথে। শয়তানি শক্তিবর্গ তো সেটিই চায়। কোন মুসলিম কি সেটি মেনে নিতে পারে? এবং মেনে নিলে কি তার ঈমান থাকে?
লক্ষ্য যেখানে ইসলামমুক্ত রাজনীতি এবং জিহাদমুক্ত ইসলাম
জান্নাতমুখি সভ্যতার নির্মানকাজে যেমন বিরোধীতা আছে, তেমনি লাগাতর সংঘাতও আছে। সে সংঘাতে কোন মুসলিম নীরব ও নিরপেক্ষ দর্শক হবে -সেটি কি ভাবা যায়? নবীজীর (সাঃ) আমলে মুসলিম দূরে থাক, মুনাফিকগণও নিজেদেরকে নিরপেক্ষ রূপে পেশ করিনি। কারণ, নিরপেক্ষতার অর্থই ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। এভাবে নিজেকে অপরাধী রূপে চিহ্নিত করা। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস বাঁচাতে মুসলিমগণ যেখানে নিজ দেশ ও নিজ ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয় এবং আহত ও নিহত হয় -সেখানে কি নিরপেক্ষতা চলে? পবিত্র কোর’আনে ঈমানদারের গুলাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে ’আশাদ্দু আলাল কুফ্ফার ওয়া রুহামাও বায়নাহুম’ অর্থাৎ কাফেরদের বিরুদ্ধে তারা কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি রহমদিল তথা দয়াশীল। তাছাড়া উম্মাদ ও মৃতরা ভিন্ন এ সমাজে কে নিরপেক্ষ? যে ব্যক্তির স্বার্থ আছে, তার একটি পক্ষও আছে। আর মুসলিম তো বাঁচে পরকালের স্বার্থ নিয়ে। আর পরকালীন স্বার্থ বাঁচাতে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের স্বার্থটি অনিবার্য ভাবেই এসে যায়। ফলে এ সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ কোথায়? বরং যারা ইসলামের পক্ষে নয়, তারা নিশ্চিত ভাবেই যে বিপক্ষে –সে প্রমাণ তো অসংখ্য। একারণেই মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে -এমন ধারণা ইসলামের অতীত ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এ শব্দটি নিতান্তই আধুনিক কালের অভিনব আবিস্কার। সেটিও প্রতারণার স্বার্থে। এবং সেটি সেক্যুলারিজম শব্দের বিকৃত তরজমার মধ্য দিয়ে।
‘মুসলিম’ শব্দটি নিজেই একটি অর্থবহ পরিচয় বহন করে। শব্দটির অর্থ আত্মসমর্পণকারি। ফলে এটি তুলে ধরে ব্যক্তির বিশ্বাস, ধর্ম-কর্ম ও আচরণগত একটি বিশেষ পরিচিতি। আত্মসমর্পণের মূল লক্ষ্য, ব্যক্তি তার প্রতিটি কর্মে বা সত্য-অসত্যের বাছ-বিচারে আল্লাহর নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। অর্থাৎ মেনে চলবে তাঁর প্রতিটি হুকুম। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) হলেন আত্মসমর্পণের আদি মডেল। কি ইবাদত, কি হিযরত, কি দ্বীনের প্রচার, কি সন্তানের কোরবানী – মহান আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন অতি সফল ভাবে। মুসলিম শব্দটিও তাঁরই দেওয়া। ফলে এমন আত্মসমর্পিত ব্যক্তি নিরপেক্ষ বা অন্য পক্ষের হয় কি করে? আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশের প্রতি এমন আনুগত্যই হলো আত্মসমর্পণের মূল কথা। এখানে আত্মসমর্পণ বলতে বুঝায় নিজের গলার রশিটি মহান আল্লাহতায়ালার হাতে তুলে দেয়া। অপরদিকে নিরপেক্ষ হওয়ার অর্থ তো আল্লাহর পক্ষ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া। মহান আল্লাহতায়ালা চান বিশ্বের সকল ধর্মের উপর তাঁর কোরআনী বিধানের উপর বিজয়। তার নিজের ভাষায় সেটি হলোঃ ’লি ইয়ুযহিরাহু আলা দ্বীনে কুল্লিহি’। আত্মসমর্পণকারি রূপে প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সে বিশেষ ইচ্ছাটির কাছে আত্মসমর্পণ করা। এবং সে ইচ্ছা পূরণে তাঁর আনছার বা সাহায্যকারি হয়ে যাওয়া। মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই শুধু ইসলামের পক্ষে সাক্ষ্যদান নয়, বরং তার বিজয়ে জিহাদে নামা। সাহাবীদের জীবন থেকে তো সে শিক্ষাই পাওয়া যায়। সে শিক্ষা থেকে দূরে সরলে যা অনিবার্য হয় তা হলো, শত্রু শক্তির হাতে পরাজয় ও অধিকৃতি। অথচ সেক্যুলারিজম অসম্ভব করে এরূপ আত্মসমর্পণ। বরং আত্মসমর্পণ বাড়ায় শয়তানের প্রতি।
তাছাড়া কোন ব্যক্তি মুসলিম হয় তো ইসলামের পক্ষ নেওয়ার কারণেই। নইলে মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন কি? কাজই বা কি? গরুছাগলের সামনে কেউ খুন হলে বা ধর্ষিতা হলে তাদের ঘাস খাওয়ায় বিরতি হয় না। তাদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ উঠে না। সে সব গরুছাগল থেকে নিরপেক্ষ ও নীরব মানুষদের পার্থক্য কোথায়? ইসলামের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান, তারা নিজেদেরকে যতই ধর্মনিরপেক্ষ রূপে জাহির করুক না কে, সেটি নিছক ধোকাবাজী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেলে এ পক্ষটি ধর্মবিরোধী কর্মেরই ব্যপ্তি ঘটায়। ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে কামাল পাশা ও তার অনুসারিরা তুরস্কে ইসলামের যেরূপ বিরোধীতা করেছে -তা অনেক কাফের শাসকদের হাতেও ঘটেনি। নিষিদ্ধ করেছিল আরবীতে আযান দেওয়া। নিষিদ্ধ করেছে ইসলামের প্রতিষ্ঠাকল্পে সংগঠিত হওয়া। পানির ন্যায় অবাধ করেছে মদকে। বাণিজ্যরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে বেশ্যাবৃত্তিকে। মুর্তি গড়েছে পথে ঘাটে। নিষিদ্ধ করেছে মহিলাদের পর্দা –এমন কি মাথায় রুমাল বাঁধা। এবং উলঙ্গতাকে চালু করেছে আর্ট বা শিল্পরূপে। ইসলামী অনুশাসনের এমন উগ্র বিরোধীতার পরও তাদের দাবী, তারা ধর্ম-নিরপেক্ষ।
সেক্যুলার এ পক্ষটি মুসলিম বিশ্বের যে দেশেই ক্ষমতায় গেছে সেখানেই ধর্মের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশেও সেটিই হয়েছে। সত্তরের দশকে এরাই পাঠ্যবই থেকে সরিয়েছিল পবিত্র কোরআনের আয়াত। রাস্তাঘাটে শুধু মুর্তিই গড়েনি, মুর্তির সামনে সন্মান প্রদর্শনের ন্যায় শির্ককে তারা সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। এভাবে মুর্তিপূজার ন্যায় সেক্যুলারিজম আবির্ভুত হয়েছে এক নতুন ধর্ম রূপে। এ ধর্ম বাঁচাতে সংকুচিত করছে ইসলামী শিক্ষা। ইসলামী চেতনার নির্মূলে ব্যবহার করছে রেডিও, টিভি ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমকে। এ পক্ষটি রাজনীতিকে যেমন ইসলামমুক্ত করতে চায়, তেমনি জিহাদমুক্ত করতে চায় ইসলামকে। এবং এরূপ পক্ষপাতদুষ্টতার নাম দিয়েছে নিরপেক্ষতা! এটি যে নিরেট প্রতারণা -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে কি? অথচ বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম দেশে প্রতারণার এ রাজনীতিই আজ প্রবল ভাবে বিজয়ী। আর এতে পরাজয় বাড়ছে ইসলামের। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি যাদের সামান্যতম ভালবাসা আছে -তারা কি তাঁর দ্বীনের এরূপ শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে পারে? ১ম সংস্করণ ০২/০৬/২০০৬; ২য় সংস্করণ ১১/১১/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018