বাংলাদেশী মুসলিমদের বিফলতাঃ সফলতা কীরূপে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 গাদ্দারি ও ভয়ানক ব্যর্থতার বিষয়

পশুর জীবনে সফলতা নিছক দৈহিক ভাবে বাঁচায়। কিন্তু মনুষ্য জীবনের সফলতা শুধু বাঁচায় নয়। সেটি যেমন মানবতা নিয়ে বেড়ে উঠায়, তেমনি উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণে। সংখ্যায় বিপুল ভাবে বেড়ে উঠা দিয়ে তাই কোন জাতির মর্যাদা নির্ণীত হয় না। তবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে সফতার এ মাপকাঠি আরো ভিন্নতর। তাঁকে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসারি হয়ে। তাঁর আসল সফলতাটি পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়াতে। নইলে সমগ্র বাঁচাটাই ব্যর্থ হয়। এবং এ ব্যর্থতা তাকে জাহান্নামে পৌঁছায়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মুসলিমদের এক্ষেত্রে সফলতা কতটুকু? উন্নয়ন পরিমাপের যতগুলো মাপকাঠি আছে সেগুলির বিচারে বাংলাদেশ দারুন ভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। গুম, খুন, ফাঁসি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি, মেরুদন্ডহীন অর্থনীতি, বিধস্ত শিল্প, দূর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন, অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা, ভেসে যাওয়া আইন-শঙ্খলা – সবকিছুই এ ব্যর্থতার প্রমাণ। ৫০ পঞ্চাশ বছর পূর্বেও বাঙালী মুসলিমের অবস্থা এমনটি ছিল না। বিজন মরু বা গভীর জঙ্গলের পথহারা পথিক যেমন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়, তেমনি অবস্থা বাংলাদেশেরও।

অথচ বাঙালী মুসলিমদের সামনে মুক্তির নির্ভূল পথ ছিল। সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোড ম্যাপ তথা পবিত্র কোর’আন। এটিই বান্দাহর কল্যাণে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এ দানের বরকতেই নিঃস্ব আরবগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। এবং গড়ে তুলেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।  কিন্তু অজ্ঞতা ও ইসলামে অঙ্গিকারহীনতার কারণে বাংলাদেশে এ শ্রেষ্ঠ দানের যথার্থ প্রয়োগ হয়নি। দেশের ধর্মীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতাও এক্ষেত্রে কম নয়। বিশ্বের অন্য কোন দেশে এতো নামাযী নেই, এতো মসজিদ-মাদ্রাসাও নেই। নেই এতো আলেম-উলামা। বাংলাদেশের আলেম-উলামাদের সংখ্যাই খোলাফায়ে রাশেদার আমলের মুসলিমদের চেয়ে অধিক। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশটিতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠিত নেই। অথচ শরিয়ত হলো সিরাতুল মোস্তাকিমের অবিভাজ্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটির প্রতিষ্ঠিত না থাকার অর্থ, সঠিক পথ ছেড়ে বিপদসংকুল জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া।

সভ্য মানুষ কোথাও বসতি গড়লে শুধু ঘর নয়, রাস্তাও গড়ে। রাস্তায় বাতি ও সিগনাল পোষ্টও স্থাপন করে। সে সিগনালগুলী মানতে হয়, নইলে পথ চলায় বিভ্রান্তি আসে, দূর্ঘটনায় প্রাণনাশও হয়। তেমনি জীবন চালনায় প্রতিটি ব্যক্তিকে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, শ্লিল-অশ্লিল, কল্যাণ-অকল্যাণ -এরূপ হাজারো পথের মোহনায় প্রতিনিয়ত দাঁড়াতে হয়। কোন দিকে যেতে হবে -সে পথটি নিজে আবিস্কার করতে গেলেই মহাবিপদ। কারণ সে সামর্থ্য দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। এমনকি নবীদেরও নয়। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা লাইলে বলেছেন, “ইন্না আলায়না লাল হুদা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার। মানুষকে যে সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে -সেটি হলো প্রদর্শিত সে পথের পূর্ণ অনুসরণের। কোর’আনে প্রদর্শিত এ পথটির ইসলামি পরিভাষা হলো শরিয়ত। কতটা সে পথের অনুসরণ করা হলো -সে হিসাব পরকালে দিতেই হবে। একমাত্র এ পথই  জান্নাতে পৌঁছার পথ। ফলে যারা এ পথে নাই, বুঝতে হবে তারা চলছে জাহান্নামের পথে।

 

ইসলামি রাষ্ট্রনির্মাণ: সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম

রাষ্ট্র বস্তুত কোটি কোটি মানুষ বহনকারী একটি জাহাজের ন্যায়। রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বটি রাস্তাঘাট, কলেক-বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকারখানা গড়া নয়, বরং সেটি হলো রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকদের জান্নাতে নেয়া। সেজন্য অপরিহার্য হলো, রাষ্ট্রের বুকে শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা দেয়া। কারণ জনগণকে জান্নাতে নেয়ার এটিই একমাত্র পথ। মক্কায় ১৩ বছর বসবাস কালে নবীজী (সাঃ)র পক্ষে তেমন একটি রাষ্ট্রের নির্মাণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর প্রথম দিন থেকেই তেমন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেন। আজও সকল দেশের সকল মুসলিমদের জন্যই এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত। নবীজী (সাঃ)র এ শ্রেষ্ঠ সূন্নতটি মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে তাঁর নিজ জমিনে বিজয়ী করার এবং মুসলিমদের বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার।

রাষ্ট্র তো বিশ্বের বহু জাতিই গড়ে। বহু দুর্বৃত্তও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা হয়। কিন্তু মুসলিমগণ রাষ্ট্র গড়লে সে রাষ্ট্রে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দিবে এবং সেটিকে জান্নাতে পৌঁছার বাহন রূপে গড়ে তুলবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি না হলে বুঝতে হবে নবীজীর সূন্নত পালন হয়নি। নবীজী (সাঃ) যে ইসলাম শিখিয়ে গেছেন -সে ইসলামেরও বাস্তবায়ন হয়নি। এভাবেই সুস্পষ্ট হয়, মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র ইচ্ছার সাথে গাদ্দারী।

ইসলামি রাষ্ট্র গড়া এবং সেখান শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া শুধু কোন দল বা নেতার দায়িত্ব নয়। প্রতিটি মুসলিমকে যেমন নামায-রোযা পালন করতে হয়, তেমনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে নিজের শ্রম, অর্থ, মেধা ও প্রাণের বিনিয়োগও করতে  হয়। নবীজী (সাঃ)র যুগে এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে জিহাদ করেননি। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়া ও সেটিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার কাজে প্রায় ৭০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। কোন ব্যক্তি বা দলকে বিজয়ী করার মধ্যে আখোরাতে কল্যাণ নেই। কল্যাণ তো ইসলামি রাষ্ট্র ও সে রাষ্ট্রে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মাঝে। কারণ, একমাত্র এ পথেই সভ্যতর জীবন যাপনে ও জান্নাতে পৌঁছার সঠিক রাস্তা পাওয়া যায়। এজন্যই মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতাল নির্মাণ নয়, সেটি হলো ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণ। এমন একটি রাষ্ট্র নির্মিত হলে সে রাষ্ট্রে উচ্চতর সভ্যতাও নির্মিত হয়।  রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতালের কল্যাণ অনেক; কিন্তু সেগুলি জান্নাতে নেয় না। কিন্তু  ইসলামি রাষ্ট্র নেয়। কারণ, ইসলামি রাষ্ট্রের মিশন তো অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা দেয়া। এবং রাষ্ট্রের কাজ হয়, এ পবিত্র মিশনের সাথে জনগণকে সংশ্লিষ্ট করা এবং সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে জনগণকে জান্নাতে নেয়া। তাছাড়া মাথা টানলে যেমন চোখ-কান-নাকও আসে, তেমনি ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণ করলে, আইনের শাসন, উন্নত প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ন্যায় সকল কল্যাণকর্মেরও জোয়ার সৃষ্টি হয়। পবিত্র কোর’আন যেমন মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত, তেমনি ইসলামি রাষ্ট্র হলো মানুষের গড়া সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতাল তো কাফের দুর্বৃত্তগণও গড়ে। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার সামর্থ্য সে দুর্বৃত্তদের থাকে না।

কথা হলো, ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্মে মুসলিম দেশে কোন আন্দোলন থাকবে না -সেটি কি ভাবা যায়? অথচ বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে সেটিই বাস্তবতা। এ লক্ষ্যে দেশে সুনির্দিষ্ট কোন আন্দোলন নেই। দেশের ইসলামি দল ও আলেম সমাজের মাঝেও এ নিয়ে কোন জিহাদ নাই। আন্দোলনের নামে যা হচেছ -সেটি হলো সরকার বদলের আন্দোলন। এমন আন্দোলন অতীতে বহুবার হয়েছে, বহু মানুষের রক্তও তাতে ঝরেছে। সরকারও পরিবর্তিত হয়েছে। নুতন দলও ক্ষমতায় এসেছে। অথচ যে মহান কাজটি সামনে এগুয়নি সেটি হলো ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণ ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৭ কোটি মুসলিমের দেশে যে আইনের ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা হয় -তা কাফেরদের রচিত। বাংলার মুসলিম ভূমিতে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া আইনের কোন স্থান নাই। মহান আল্লাহতায়ালার আইনের এ অবমাননা দেখে কোন ঈমানদার কি শান্তিতে ঘুমুতে পারে? শরিয়তকে দূরে সরানোর এ কাজ তো কাফের, জালেম ও ফাসেকদের -যা সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। যে শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে শিশু সন্তানেরা বেড়ে উঠছে -সেটিও ঔপনিবেশিক কাফেদের তৈরী।

 

পাপের উৎসব মুসলিম ভূমিতে

শুধু খাদ্য ও পানীয় সামগ্রী হালাল হলেই চলে না। হালাল হতে হয় শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত ও পোষাক-পরিচছদও। কিন্তু সে হালাল বিষয়গুলিতে আগ্রহ ক’জনের? ফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ঢুকেছে হারাম পৌত্তলিকতা ও অসভ্য অশ্লিলতার তান্ডব। শত শত মূর্তি স্থাপিত হয়েছে রাজপথে। নগরে বন্দরে গড়ে উঠেছে হাজারো পতিতা পল্লী। পতিতারা উপচে পড়ছে শহরের পার্কে, রাজপথে এমনকি আবাসিক মহল্লাতেও। ইসলামে যে অপরাধের শাস্তি প্রানদন্ড, সে অপরাধ উল্লাস ভরে হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রের পতিতা পল্লী গুলিতে। এ জঘন্য অপরাধও ব্যাবসারূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাজ্জবের বিষয়, এসব প্রকাশ্য পাপাচারের বিরুদ্ধে দেশের ইসলামি জনতার পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ নাই, আন্দোলনও নাই। বরং তাদের কাজ হয়েছে ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশ পালন করে এ পাপাচারের প্রতিরক্ষা দেয়া। এ পাপাচারের নির্মূলে বিক্ষোভ করে কোন আলেম মার খেয়েছেন বা কারারুদ্ধ হয়েছেন -সে ইতিহাসও নেই। অথচ মুসলিম জীবনের মূল মিশনটি হলো: ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল। অতীতের ন্যায় এখনও দেশে প্রচুর আন্দোলন হয়। এমনকি অতিশয় তুচ্ছ বিষয়েও হরতাল হয়। অথচ আন্দোলন নাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে। ইসলামে বড় পাপ হলো অনৈক্য গড়া এবং মুসলিম ভূগোলে বিভক্তি গড়া। এ পাপও কি বাংলাদেশে কম হচ্ছে? অথচ এ পাপ ভয়ানক আযাব নামিয়ে আনে। সে পাপ হচ্ছে দল, ফেরকা, ব্যক্তিত্ব, গোত্র ও ভাষার নামে। এ পাপের পথে নেমে কি ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়? অথচ এ পাপকর্ম নিয়ে আলেমদের মাঝেও কোন দুঃখবোধ নাই। বরং নিজেরাও সে বিভক্তির সাথে জড়িত। অপর দিকে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও দলের নামে উম্মাহর বিভক্তিকে অহংকার ও উৎসবের বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে।

রাজনীতিতে একজন মুসলিমের মূল এজেন্ডা তো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। যে রাজনীতি সে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তাই দেয় না, সে রাজনীতে কি কোন মুসলিম জড়িত হতে পারে? এ কাজ তো শতভাগ হারাম। অথচ পরিতাপের বিষয়, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার নাম মুখে আনতে রাজী নয় এমন নেতাকেও বাংলাদেশে ভোট দিয়ে, অর্থ দিয়ে ও শ্রম দিয়ে বিজয়ী করা হয়। এভাবেই তো মুসলিমের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় হচ্ছে ইসলামের পরাজয়ে ও শয়তানী এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজে। দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বাড়ছে। কিন্তু মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কি?  শুধু নামায-রোযা এবং ধর্মশিক্ষার মাঝে ধর্মকর্ম সীমিত হলে রাষ্ট্রীয় জীবনের ইসলামের প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? প্রতিটি ধর্ম বা মতবাদই সমাজে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চায়। প্রতিষ্ঠান চায় এমনকি পাপীষ্ঠরাও। পতিতাপল্লী, মদ্যশালা, জুয়ার আড্ডা, যাত্রা ও নাচের ক্লাব, সূদী ব্যাংক, সেক্যুলার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় –এসব তো তাদেরই প্রতিষ্ঠান। নির্জন কুঠিরে, বনে জঙ্গলে বা তাঁবুতে ইসলামি সমাজ বেড়ে উঠে না। এজন্য ইসলামি পরিবার চাই, মসজিদ চাই, সমাজ চাই, শিক্ষাকেন্দ্র চাই এবং সে সাথে পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্রও চাই। এগুলোর কোন একটি সঠিক ভাবে কাজ না করলে সে সমাজে মুসলিমও সঠিক ভাবে বেড়ে উঠে না।

 

 

অনৈসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা: ভ্রষ্টতার দলিল

ইঞ্জিনের হাজারো যন্ত্রের মাঝে একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ যদি যথাস্থানে না থাকে, উড়োজাহাজ উড়তে পারে না। তেমনি অবস্থা ইসলামেরও। পরিবার, সমাজ, মসজিদ, শিক্ষালয়, আইন-আদালত, প্রশাসন, হাটবাজার, রাষ্ট্র – সবগুলীই হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সমাজ পরিবর্তনের এগুলো হলো চালিকা শক্তি। ব্যক্তি ও সমষ্ঠির জীবনে ইসলামের প্রতিষ্ঠা পূর্ণাঙ্গতর করার ক্ষেত্রে এ সব প্রতিষ্ঠানের সক্রীয় ভূমিকা শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়, অপরিহার্য। আর রাষ্ট্রতো  ইঞ্জিন। আর এ ইঞ্জিনকে পথ দেখায় মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপ তথা শরিয়ত। ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে কোন পথে চলতে হবে শরিয়ত সেটিরই সিগনাল দেয়। যে সমাজে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নেই, সে সমাজে সত্য ও ন্যায়ের দিকে দিক-নির্দেশনাও নেই। তখন মানুষ ধাবিত হয় পাপচার, জুলুম ও কুফরির দিকে। এজন্যই মুসলিম যেখানেই ঘর বাঁধে সেখানে শরিয়তেরও প্রতিষ্ঠা দেয়। সে লক্ষ্যে ইসলামি রাষ্ট্রও গড়ে। মদিনায় হিজরতের পর নবীজী (সাঃ) এ কাজটিই প্রথমে করেছিলেন।

কিন্তু বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে সে কাজটিই হয়নি। ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নির্বিচারে সূদ খাচেছ, ঘুষ খাচেছ এবং যুবকেরা ঢুকছে অশ্লিল নাচ-গানের আসরে, এমনকি বেশ্যালয়েও। সিনেমা হলে বসে অগণিত মানুষ আনন্দ ভরে উলঙ্গতা দেখছে। নামাযী জনগণও ট্যাক্সের পয়সা জুগিয়ে পতিতা পল্লীতে পাহারাদারীর ব্যবস্থা করছে। যেসব নেতারা এমন পাহারাদারীর ব্যবস্থা করে, তাদেরকেই জনগণ গায়ে-গতরে খেটে নির্বাচিত করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তি গড়ার খরচও তারা জোগাচেছ। আদালেত কুফরি আইনের ফয়সালাও এরা মাথা পেতে মেনে নেয়। ইসলাম থেকে বিচ্যুতির এর চেয়ে বড় দলিল আর কি হতে পারে? এটি তো ভয়ংকর পাপ এবং নিশ্চিত জাহান্নামের পথ। নিছক মসজিদ গড়ে, নামাজ পড়ে, প্রতি বছর রমযানে রোজা রেখে, বার বার হজ্ব ও উমরাহ পালন করে কি এ পাপের সাজা থেকে মূক্তি মিলবে?

 

হেতু কী?            

মুসলিমদের এহেন বিচ্যুতির কারণ বহুবিধ। তবে মূল কারণ, ইসলামি প্রতিষ্ঠান সমূহের বিনাশ। ধর্মীয় চেতনার মূলোৎপাটনে এটিই শত্রুর মূল স্ট্রাটেজী। ইসলামের পরিচর্যা দেয় যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলির ধ্বংস করে শত্রুপক্ষ জন্ম দিয়েছে অসংখ্য ইসলাম-নাশক প্রতিষ্ঠানের। মুসলিম দেশগুলি দখলে নেয়ার পর বৃটিশেরা সেটিই করেছে। ইসলামের প্রতিষ্ঠানগুলি বিলুপ্ত হলে অবস্থা কতটা ভয়ানক হয় তারই উজ্বল দৃষ্টান্ত হলো বসনিয়া, কসোভো এবং সোভিয়েত রাশিয়ায় বসবাসকারি মুসলিমগণ। তারা সংযোগ হারিয়েছে ইসলামে সাথে। এককালে দাস হিসাবে আফ্রিকা থেকে যে অসংখ্য মুসলিমদের বলপূর্বক আমেরিকায় নেওয়া হয়েছিল তারাও হারিয়ে গেছে একই কারণে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম যেভাবে বিলুপ্ত হচেছ সেটিও ইসলামি প্রতিষ্ঠানসমূহ না থাকার কারণে।

তবে ইসলামের প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের যে কাজটি শুরু করেছিল বিদেশী কাফের শত্রুগণ, আজ সে একই রূপ নাশকতা হচেছ বাংলাদেশের ন্যায় সেক্যুলারিস্ট শাসিত দেশগুলোতে। কারণ, এসব মুসলিম দেশে ইসলামে অঙ্গিকারহীন পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের সংখ্যাটি বিশাল। মুসলিম দেশগুলোর শাসন ক্ষমতা মূলত তাদেরই হাতে। বৃটিশের শাসন বিলুপ্ত হলেও তাদের গড়া সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলি বিলুপ্ত হয়নি। ফলে টিকে আছে তাদের গড়া পতিতালয়, ক্লাব, জুয়া ও নাচের আড্ডা, সিনেমা হল, শিক্ষানীতি, আইন-আদালত ও শাসন ব্যবস্থা। ড্রেনে দুষিত পানি থাকলে যেমন মশার আবাদ বাড়ে, তেমনি এসব পাপের প্রতিষ্ঠানের কারণে বৃদ্ধি পায় পাপাচারি। বরং পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকায় এ পাপের প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন আরো আধুনিকতা পাচেছ। এ আধুনিকতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মোড়ল রাষ্ট্রগুলির পক্ষ থেকে অবিরাম আর্থিক, কারিগরি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্যও পাঠানো হচেছ।

 

কীরূপে সম্ভব শরিয়তের প্রতিষ্ঠা?

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা কীরূপে সম্ভব? ইরানী মডেলের বিপ্লব বা আফগান স্টাইলের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কি সেটি সম্ভব? বাংলাদেশ ইরান নয়, আফগানিস্তানও নয়। এখানে প্রেক্ষাপট যেমন ভিন্ন ,তেমনি শরিয়ত প্রতিষ্ঠার স্ট্রাটেজীও হতে হবে ভিন্ন। পার্বত্য এলাকার যুদ্ধ আর সমতলের যুদ্ধ এক হয় না। বাংলাদেশে সুবিধা হলো, এখানে মতামত প্রকাশের নানারূপ সুবিধা রয়েছে। ওয়াজ মহফিল, মসজিদের খোতবা, মিটিং-মিছিল ও জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্দোলনের যে সুযোগ রয়েছে সেটি ইরান ও আফগানিস্তানে ছিল না। এমন সুযোগ মুসলিম দেশসমূহের মাঝে খুব কম দেশেই রয়েছে। এটিও সত্য, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসাটি কোন ইসলামি দলের পক্ষেই নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব নয়। তবে এতদিন কি তারা অপেক্ষায় থাকবে? এমন অপেক্ষায় কি তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে? বরং অধিক বিলম্বে শয়তানী প্রতিষ্ঠানের ফসল এতই বাড়বে যে, সামান্য ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকাই তখন অসম্ভব হবে। 

ক্ষমতায় না গিয়েও সমাজ পরিবর্তনে অনেক কিছু করা যায়। সোসালিষ্ট ও কম্যুনিষ্টগণ ইংল্যান্ডে কোন কালেই ক্ষমতায় যায়নি। কিন্তু তারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের জন্য যে সব সুবিধ আদায় করেছে -তা কম্যুনিষ্ট দেশের শ্রমিকরাও পারেনি। ক্ষমতায় না গিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদাহরণ হলো পাকিস্তাান। সে দেশটিতে ইসলামপন্থিরা কোন কালেও ক্ষমতায় যায়নি। অথচ তারা কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা আদায় করে নিয়েছে জুলফিকার আলী ভূট্টোর মত একজন মদ্যপায়ীকে দিয়ে। আলেমদের সম্মিলিত আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হয়েছিল ২২ দফা মূলনীতি। সেকালের সেকুলারিষ্ট গুরুগণও সেটি মানতে বাধ্য হয়েছিল। আজও সেটি পাকিস্তানে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মূল বুনিয়াদ। দেশটির আইন ধাপে ধাপে ইসলামিকরণ হচেছ সে পথ ধরেই। ক্ষমতার বাইরে থেকেও সরকারকে ইসলাম পন্থিরা ব্লাসফেমি আইনের মত কঠোর প্রণয়নে বাধ্য করেছে। এতে সে দেশের তসলিমা নাসরিনদের ফাঁসীতে ঝুলানোর সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। সে দেশে সকল ব্যাংক থেকে সূদ ভিত্তিক ব্যাংকিং প্রথার বিলোপে দেশটির সৃপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছে। কামাল পাশার অনুরাগী জেনারেল মোশাররফ কঠোর ব্লাসফেমী আইনে সংশোধন আনতে চেয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় দলগুলির সম্মিলিত বিরোধীতার মুখে সরকার তৎক্ষণাৎ পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে ।

পাপ যখন বদ্ধঘরে গোপনে ঘটে তখন সে পাপ রোধে সাধারণ মানুষ বা সরকারের দায়বব্ধতা থাকেনা। কারণ, বিছানায় আবর্জনা নিয়ে ঘুমানোর গোপন অভ্যাস কেউ রুখতে পারে না। কিন্তু কেউ যখন আবর্জনা রাস্তায় বা লোকালয়ে নিক্ষেপ করে বা তা নিয়ে দোকান খুলে -তখন সেটি রুখার দায়িত্ব সবার। এবং সে দায়িত্ব সবচেয়ে বেশী সরকারের। নইলে সে দেশ বসবাসের অনুপোযোগী হয়। অথচ বাংলাদেশে সে অপরাধ রুখার দায়িত্ব যথাযথ পালিত হয়নি। বরং পুলিশের নাকের ডগার সামনে নানারূপ পাপাচার নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে প্রায় প্রতিটি জনপদে। অথচ এ আবর্জনা বা পাপাচার সরকারে না গিয়েও হটানো যায়। উদাহরণ,  নারায়নগঞ্জের কুখ্যাত টানবাজার পতিতাপল্লী উৎখাতে কোন আলেমের মন্ত্রী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তবে এজন্য প্রয়োজন ছিল ইসলামি শক্তিসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। ঐক্য যে কীরূপ ত্বরিত বিজয় আনতে পারে তারই আরেক উদাহরণ হলো, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সমূহের নামকরণ বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ সরকার সে আন্দোলনের মুখে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। শেখ হাসিনার মত একগুঁয়ে নেত্রীও জাহানারা ইমামের নামে রাখা হলের নামকরণ স্থাগিত করতে বাধ্য হয়েছিল। এরূপ ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মুখেই তাসলিমা নাসরিন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল দাউদ হায়দার।

কোন বিশেষ দল বা নেতাকে বিজয়ী করার বিষয়ে হয়তো অনেকেরই আপত্তি থাকে, কিন্তু এমন ধর্মীয় আন্দোলনে জনগণের সহায়তা মিলবেই। কারণ আপামর জনতা এ পূণ্য কাজকে ইবাদত ভাবে। তখন লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় নামে। এটিই তো জিহাদ। কোন বিশেষ ব্যক্তিকে ভোটদানে অনেক নামাযী মুসলিমেরই আপত্তি থাকে। কিন্তু এমন ইস্যুভিত্তিক জিহাদে সমর্থণ থাকে প্রতিটি প্রকৃত ঈমানদারের। এজন্যই ইস্যুভিত্তিক ধর্মীয় আন্দোলনের সাথে জনগণ যতটা একাকার হয়, ততটা কোন দলের সাথে হয় না। এভাবেই ধাপে ধাপে শয়তানী প্রতিষ্ঠানের নির্মূলের স্ট্রাটেজী নিতে হয়। এপথেই তখন দূর্বল বা নির্মূল করা যায় ইসলামবিরোধী শক্তিসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। লক্ষ্যণীয় হলো, টানবাজার পতিতা পল্লী উৎখাতে এমনকি অনেক সেক্যুলার নেতাও সমর্থন দিয়েছে। যেমন দিয়েছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সমূহের নামকরণ বিরোধী আন্দোলনে।

পরকালের ভয় জাগতে কোন দিন-ক্ষণ লাগে না। আজকে যারা ইসলামের বিরোধীতা করছে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হলে তাদের অনেকে শুধু অর্থ, সময় ও শ্রমই শুধু নয়, প্রাণও দিবে। নেতাদের দায়িত্ব হলো জিহাদ এবং শহিদ হওয়ার ১০০% বিশুদ্ধ ক্ষেত্র তৈরী করা। তখন জান্নাতের পথে কোরবানি পেশে লোকের অভাব হয় না। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের এটিই সুবিধা। বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর ব্যর্থতা হলো, শতভাগ বিশুদ্ধ জিহাদের ক্ষেত্র নির্মাণে তারা সফলতা দেখাতে পারেননি। নিজেরাও জিহাদে তেমন আগ্রহ দেখাননি। কোন বিশেষ দলের প্রার্থীকে এমপি বা প্রধানমন্ত্রী বানাতে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু যে কাজে সুস্পষ্ট নেকী, সে কাজে জনগণের সম্পৃক্ততা অবশ্যম্ভাবী। ফলে বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলীয় এমপির সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনই কি বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়? কারণ, ইসলামি দলগুলোর এমপির সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে ৫ গুণ বাড়লেও ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে এপথে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা কাজ সুদূর পরাহত। অথচ তাদের আন্দোলনের সামর্থ্যটি বিশাল। তাছাড়া আন্দোলন ছাড়া কোন সংগঠনই বেড়ে উঠে না। বস্তুত সংগঠন পুষ্টি পায় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। আন্দোলন না থাকলে সংগঠন শুধু দূর্বলই হয় না, বহু ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটে। স্রোতহীন নদীতে যেমন চরা জেগে উঠে, তেমনি আন্দোলনহীন সংগঠনগুলোতে বাড়ে কোন্দল ও স্থবিরতা। যেমনটি হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের ক্ষেত্রে। কারণ, ১৯৪৭ সালের পর তারা কোন জনপ্রিয় ইস্যুই সৃষ্টি করতে পারিনি। অপর দিকে কোন সংগঠন না থাকলেও মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী নিছক খেলাফত রক্ষার ইস্যুতে তৎকালীন উপমহাদেশে সর্ববৃহৎ গণআন্দোলনের সৃষ্ঠি করতে পেরেছিলেন, যা ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণআন্দেলন। বলা যায় আন্দোলনই সংগঠনের জন্ম দেয়। আন্দোলন যত গণমুখী ও বৃহত্তর হয়, সংগঠনও ততই শক্তিশালী হয়। তাছাড়া সব আন্দোলনই শুরু হয় ইস্যু নিয়ে।

 

ইসলামি সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা

বাংলাদেশের ইসলামি সংগঠনগুলোর বড় ব্যর্থতাটি হলো, তারা ব্যর্থ হয়েছে ইস্যু ভিত্তিক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে। মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। রাজনীতি থেকে যদি সে ইস্যুই বাদ পড়ে, তবে সে রাজনীতির আদৌ প্রয়োজন কি? এমন সেক্যুলার রাজনীতিতে যতই অর্থব্যয়, শ্রমব্যয় বা রক্তব্যয় হয়, ততই তা জাহান্নামের পথে টানে। মুসলিম এমপি হবে এবং প্রয়োজনে মন্ত্রীও হবে নিছক সেটি নিছক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় ও অন্যায়ের নির্মূলে। মন্ত্রীত্ব যদি সে লক্ষ্য অর্জনে সহাযক না হয় -তবে সে রাজনীতি ছেড়ে রাজপথের আন্দোলনই কি যথার্থ নয়। অথচ বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের মাঝে এমপি ও মন্ত্রি হওয়া নিয়ে যত ব্যস্ততা তা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে নাই। নির্বাচন এলে এজন্যই তারা প্রাণ ফিরে পান। নিছক এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য শরিয়তের স্বঘোষিত শত্রুদের সাথেও তারা জোট বাঁধতে ইতস্ততা করেন না। এজন্যই দেশে ইসলামের নামে নেতা বা দলের সংখ্যা বাড়লেও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান হচ্ছে না।

ইসলামের পরাজয়ের অর্থ এ নয়, দেশে মুসলিমদের নামায পড়া বা মসজিদ গড়ার অধিকার বিলুপ্ত হবে। মুসলিম ভূমি বহুবার অমুসলিমদের হাতে অধিকৃত হয়েছে। কিন্তু কোনকালেই তেমনটি হয়নি। বরং পরাজয়ের প্রকৃত অর্থ হলো, আল্লাহর আইনের পরাজয়। তেমনি বিজয়ের লক্ষ্য এ নয়, কাফেরের বদলে ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য কোন মুসলিম নামধারী ব্যক্তি ক্ষমতায় বসবে। মুসলিম তো বাঁচেই ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। সে লক্ষ্য পূরণে প্রাণ কোরবাণীতে দু’পায়ে খাড়া হননি এমন সাহাবা কি খুঁজে পাওয়া যাবে? একটি দেশে ইসলাম কতটা বিজয়ী -সেটির পরিমাপে সে দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বা মুসলিমদের সংখ্যা গণনা করার প্রয়োজন আছে কি? ভারতে মুসলিম শাসনামলে কোন কালেই মুসলিম ও মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা হিন্দু ও মন্দিরের চেয়ে অধিক ছিল না। কিন্তু বৃটিশের আগমনের পূর্বপর্যন্ত সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল মহান আল্লাহতায়ালার আইন। কাজীরা সেখানে বিচার চালাতো শরিয়ত ভিত্তিক আইনী গ্রন্থ ‘‘ফতোয়ায়ে আলমগিরি’’ অনুযায়ী। সেটি রহিত হয়েছে বৃটিশের হাতে অধিকৃত হওয়ার পর। নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতের মুসলিম শাসকগণের এতটুকু বোধ ছিল, শাসকের পদে বসে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা না দিলে সে আর মুসলিমই থাকে না। সেটি ইমামের নামায না পড়ার মত। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে যে সুস্পষ্ট ঘোষনা রয়েছে তা নিয়ে তাদের অজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু সে হুশ কি তাদের আছে -যারা বাংলাদেশের ন্যায় দেশে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন?

 

ব্যর্থতার হিসাব কি নিবে না?

ভারতের মুসলিম জীবনে বিপর্যয়ের শুরুটি তখন, যখন বৃটিশেরা শরিয়তকে সরিয়ে নিজেদের কুফরি আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়। এবং কোর’আনকে বন্দী করে মসজিদ-মাদ্রাসার বদ্ধ আঙ্গিনায়। মুসলিমদের জন্য তখন অসম্ভব করা হয় পূর্ণ ইসলাম পালন। এবং শুরু হয় ইসলাম থেকে দূরে সরা। সে পরাজয় থেকে আজও বাংলাদেশের মুসলিমদের সামান্যতম মুক্তি মেলেনি। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন দেশের আইন-আদালত ও প্রশাসন থেকে আজও অপসারিত। আল্লাহতায়ালার শরিয়তি আইন সরাতে বৃটিশ সরকার কখনোই কোন গণরায় নেইনি। তাদের প্রতিষ্ঠিত পেনাল কোড, বিচার-পদ্ধতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সূদীব্যাংক, পতিতাপল্লী, মদ্যশালার ন্যায় কোন আবর্জনাই নির্বাচনের মাধ্যমে চাপানো হয়নি। সেগুলি তারা চাপিয়েছে নিজেদের স্বৈরাচারি খায়েশ অনুযায়ী। তাই এসব সরাতেই বা  নির্বাচন লাগবে কেন? এগুলো হলো বৃটিশ আমলে জেঁকে বসা আগাছা-আবর্জনা। জাতীয় জীবন থেকে আগাছা ও আবর্জনা সরানোর দায়িত্ব তো প্রতিটি নাগরিকের। এ দায়িত্ববোধের প্রেরণাতেই শুরু হতে পারে এক গণআন্দোলন। এ আন্দোলনের সুস্পষ্ট দাবী হবে পাপের সকল প্রতিষ্ঠানের নির্মূল। সে সাথে বিলুপ্ত করতে হবে শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক সকল আইন। তাসলিমা নাসরীনদের মত ইসলামের শত্রুদের দমনে প্রণয়ন করতে হবে কঠোর ব্লাসফেমি আইন। করতে হবে শিক্ষার বিশুদ্ধকরণ। সে সাথে থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা।

পাপাচারের প্রতিষ্ঠানগুলো যতই বেঁচে থাকবে, ততই বাড়বে পাপীর সংখ্যা। রোগের ভাইরোসের ন্যায় পাপের ভাইরাসও দ্রুত ছড়ায়। ৫০ বছর পূর্বে দেশে পাপাচারির যত সংখ্যা ছিল, এখন সে সংখ্যা বহু গুণ। এ পাপাচারিরাই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের পর্যায়ে। কারণ, পাপের প্রতিষ্ঠানের নির্মূলে কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। ফলে পাপ বেড়েছে কোন রূপ বাধা-বিঘ্নতা ছাড়াই। এ কাজে প্রচুর বিলম্ব হয়েছে, অধিকতর বিলম্ব শুধু ইসলাম ও মুসলিমদেরই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেও বিপন্ন করবে।

তাছাড়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ও নয়। মহান আল্লাহতায়ালার খাতায় নিজেদের নাম যারা মুসলিম রূপে লেখাতে চায়, তাদের সামনে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। নইলে পরিচিতি মিলবে বিদ্রোহী কাফের রূপে। যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম, সে দেশে শরিয়ত আজও কেন প্রতিষ্ঠিত নয় -সে হিসাব কি মহান আল্লাহর দরবারে দিতে হবে না? বাংলাদেশের একটি থানার জনসংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক মুসলিম নিয়ে নবী পাক (সাঃ) শরিয়তের বিজয় এনেছিলেন। অথচ বাংলাদেশের মুসলিমগণ ১৬ কোটি হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ। এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে তারা মুখ দেখাবো কীরূপে?  মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেওয়ার আগে এ ব্যর্থতার হিসাব কি তারা নিবে না?  ১৭/১২/২০২০।

One Responseso far.

  1. Abdul Latif says:

    very good thinking.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *