ইরানে প্রথম দিনের স্মৃতি
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 24, 2021
- Bangla Articles, আমার স্মৃতিকথা
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ইরানে পৌঁছি ১৯৮০ সালের মে মাসে এবং দেশে ফিরি ১৯৯০ সালের জুনে। পুরো দশটি বছর ইরানে কাটিয়েছি। এর মধ্যে বহুবার আশা যাওয়া করেছি। তখন সারা দুনিয়ার মানুষের নজর ইরানের দিকে। কারণ, দেশটিতে তখন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেছে। প্রতিদেশের পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে ইরানের খবর তখন লাগাতর শিরোনাম পাচ্ছে। যথন দেশে বেড়াতে আসতাম নানা মানুষ তখন নানা ধরণের প্রশ্ন করতো। ইরান সম্মদ্ধে জানতে তারা যে কতটা উৎস্যুক ছিল সেটি বুঝতাম তাদের জানার আগ্রহ ও প্রশ্নের ধরণ থেকে। ইরানের বিরুদ্ধে তখন পাশ্চাত্য মিডিয়ার মাধ্যমে এতো বেশী মিথ্যা প্রচার হয়েছে যে দেশটি সম্মদ্ধে সঠিক খবর পাওয়াই অসম্ভব ছিল। অনেকেই ইরানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র ভাবত। তবে দেখতাম, সবাই জানতে চাইতো ইরানের বিপ্লব, ইরানর মানুষ ও সে দেশের নেতা ইমাম খোমেনী সম্মদ্ধে।
দীর্ঘ দশটি বছর ডাক্তার রূপে কাজ করেছি ইরান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে। কর্মস্থল ছিল তেহরান থেকে মাত্র ১০৫ কিলোমিটার পূর্বে গরমসার নামক এক জেলা শহরে। এ জেলারও একটি ইতিহাস আছে। এ জেলার মানুষের মাঝে শিক্ষার হার বেশ উঁচু। এ জেলারই সন্তান জনাব আহমেদী নেজাদ ইরানের প্রেসিডেন্ট হন। গরমসার বিখ্যাত উন্নত মানের খরবুজা, ডালিম ও ডুমুরের জন্য। জেলার দক্ষিণে অবস্থিত ইরানের বিশাল মরুভূমি দাশতে কবীর। রাজধানী শহর তেহরান কাছে হওয়ায় ঘন ঘন সেখানে যেতাম। বাসে মাত্র দেড় ঘন্টা লাগতো। তেহরানে আমার কিছু ঘনিষ্ট বন্ধু পরিবার নিয়ে থাকতো, তাদের বাসায় আমিও পরিবার নিয়ে হাজির হতাম। আমার বাসায় তারাও আসতো। তারা ছাড়াও ৩০ কিলো মিটারের মধ্যে ৭/৮ জন বাংলাদেশী ডাক্তার কাজ করতো। ছুটির দিনে আমরা কোন একজন ডাক্তারের বাসায় একত্রিত হতাম। তাতে বিদেশে থাকার ক্লান্তি দূর হতো। প্রায় ৮ বছর কাজ করেছি গরমসার জেলার একমাত্র হাসপাতালে। একই জেলার গ্রামীন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করেছি প্রায় ২ বছর। ইরান তখন ইসলামী বিপ্লবের দেশ। এ বিপ্লবের শুরু ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে মহম্মদ রেজা শাহের রাজতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ এ দশটি বছর ইরানে অবস্থান কালে অতি কাছে থেকে ইরান, ইরান বিপ্লব ও ইরানের মানুষদের দেখার সুযোগ পেয়ছি। আমার জীবনের সে এক লম্বা ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
সে সময় ডাক্তার হিসাবে কাজের সুবিধা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে ইরানে কাজের সুযোগ দিয়েছিলেন। অন্যদেশে কাজে অধিক অর্থপ্রাপ্তি হলেও তাতে মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ বিপ্লবকে এতো কাছে থেকে দেখার সুযোগটি মিলতো না। ইরানে তখন বিপ্লবের পাঠশালা। শাহকে হঠাতে পারলেও বিপ্লব তখন নিরাপদ তথা মজবুত অবস্থান পায়নি। তখন লাগাতর অভ্যন্তরীন যুদ্ধ চলছিল। শুধু দেশের ইসলাম বিরোধী নানা গ্রুপের বিরুদ্ধেই নয়, যুদ্ধ চলছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানারূপ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও। মহম্মদ রেজা শাহ ছিল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্টতম মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র তার এ ঘনিষ্ট মিত্রের এমন অপমানজনক উৎখাতকে কখনই মেনে নেতে রাজি ছিল না। প্রতিটি বিপ্লবের পরই প্রতি বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে। ইরানে সে সম্ভাবনা আরো প্রবল ছিল। কারণ সেনাবাহিনীসহ সর্বত্র তার ভক্তরা ছিল। প্রশাসনে ও সামরিক বাহিনীতে ছিল শক্তিশালী সেক্যুলারিষ্ট ফোর্স। মার্কিনী উস্কানীতেই তখন ইরানের উপর প্রকান্ড হামলা করে বসে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন। তাকে সর্বাত্মক সমর্থণ দিচ্ছিল কুয়েত, সৌদি আরব, জর্দান, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল স্বৈরাচারি শাসকচক্র। মার্কিনীদের পাশাপাশি ইরানের উপর সাদ্দামের সে আগ্রাসনকে তখন সর্বাত্মক সমর্থন করছিল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ প্রায় সকল বিদেশী শক্তবর্গ। তাদের কাছে সে যুদ্ধটি ছিল প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামী বিপ্লবের প্রসার রোধের একটি সুপরিকল্পিত স্ট্রাটেজী। সাদ্দাম হোসেনকে এ কাজে তারা সুকৌশলে ব্যবহার করছিল। পাশ্চাত্যের সে খায়েশ পুরনে ইরান ও ইরাকের প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের প্রাণনাশ হয়। এবং ৮ বছর ব্যাপী সে যুদ্ধে বিনষ্ট হয় শত শত বিলিয়ন ডলার। ইসলামের শত্রুপক্ষটি সে সময় মুসলিম উম্মাহর বিশাল ক্ষতিতে আনন্দে ডুগডুগি বাজিয়েছে।
যে কোন দেশে ডাক্তার হিসাবে কাজের বড় সুবিধাটি হলো, সুযোগ মেলে দেশের সর্বপ্রকার মানুষের সাথে নিবীড় মেলামেশার। ডাক্তারী পেশায় এ হলো বড় রকমের এক বাড়তি সুবিধা। অন্য পেশায় এরূপ সুযোগ জুটে না। ডাক্তারদের শুধু রোগীর দেহের খবর জানলে চলে না, রোগ বুঝতে তাকে তার ঘরের খবর, মনের খবর এবং আপনজনদের খবরও জানতে হয়। কারণ ব্যক্তির শারিরীক, মানসিক ও সামাজিক রোগগুলি একে অপরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ফলে জানা হয়ে যায় তার প্রাত্যহিক অভ্যাস, রীতিনীতি ও সংস্কৃতিসহ তার নিজ ঘরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরই। রোগী হিসাবে আমাদের কাছে শুধু আম মানুষই আসতো না, অনেক খাস মানুষও আসতো। দশ বছরের চাকুরি কালে জেলার জামে মসজিদের ইমাম, জেলা প্রশাসক, এমপি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, পুলিশ প্রধান ও পুলিশ কর্মকর্তা, বিপ্লবী রক্ষিবাহিনী, বাসিজ বা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যসহ নানা ধরণের ক্ষমতাধর মানুষের সাথেও আমার পরিচয় গড়ে উঠে। কাছে থেকে দেখার সুযোগ মেলে তাদের কর্ম ও আচরণ।
বেশীর ভাগ সময় কাজ করেছি হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বা জরুরী বিভাগে। কখনও কখনও সেখানে ডিউটি হত ২৪ ঘন্টা ব্যাপী। এ সময়টাতেই মানুষের সাথে সংযোগ ও কথাবার্তার সুযোগটা হতো বেশী। কথা হতো ইরানী নার্স, প্যারামেডিক, ফার্মাসিস্টসহ হাসপাতালের অনেক কর্মচারির সাথেও। দশ বছর একই জেলাতে থাকায় ঐ জেলার মানুষকে এতো মানুষের সাথে এতো জানা-শোনা ও বন্ধুত্ব হয়েছিল যে আমার নিজ থানা বা নিজ জেলাতেও এতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়নি। যখন শহরে বাজার করতে বা বেড়াতে বের হতাম তখন রাস্তাঘাটে ও দোকানে প্রচুর পরিচিত মানুষ পেতাম। দোকানদের প্রায় সবাই হয়ে পড়েছিল পরিচিত। ভেড়ার-রাখাল থেকে শুরু করে, সাধারণ কৃষক, ব্যবসায়ী, ইরানী ডাক্তার, স্কুল ও কলেজ শিক্ষক ইত্যাদি নানা পেশার অনেকেই যেমন আমার বাসায় আসতো, তেমনি আমিও সপরিবারে তাদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। তারা আমাকে ও আমার পরিবারকে দাওয়াত করতো। বিদেশী হওয়ার ফলে তারা আমাদের সাথে নির্ভয়ে মনের কথা বলতো। বিপ্লবের বিরোধীরাও তাদের মনের কথাগুলো বলতো। ইরানী সংস্কৃতির সাথে হাসপাতালে রোগী দেখার মধ্য দিয়ে যে পরিচয়টি পেয়েছিলাম তাদের ঘরে আসা যাওয়ার মাধ্যমে সে পরিচয়টি আরো গভিরতর হয়েছিল। আমার আরেকটি বাড়তি সুবিধা ছিল। সেটি হলো, মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনার কারণে দীর্ঘ দিন পাকিস্তানে থাকায় আমি আগে থেকেই উর্দু ভাষা পড়তে ও বলতে জানতাম। আমি ডাক্তারী পাশ করেছিলাম লাহোর থেকে। উর্দু ও ফার্সি এ উভয় ভাষার বহু শব্দই আরবী থেকে নেওয়া। ফল দাঁড়িয়েছিল, ফার্সী ভাষা পড়তে বা বলতে অভ্যস্থ হতে বেশী সময় লাগেনি।
ইরানে যাওয়ার আগে থেকেই দেশটি আমার কাছে এক ভিন্ন মর্যাদার দেশ রূপে গণ্য হয়েছিল। দুনিয়ায় ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু এ দেশগুলোর কোনটিতেই জনগণ এত বিপুল সংখ্যায় ইসলামের পক্ষে রাস্তায় নামেনি। কোন দেশেই ইসলামের নামে এতো মানুষ প্রাণ দেয়নি বা বিপ্লবও করেনি। অন্য কোন দেশে শরিয়তও প্রতিষ্ঠা পায়নি। অথচ মুসলিম দেশে এর আগে আন্দোলন বা বিপ্লব যে হয়নি -তা নয়। কোন কোন মুসলিম দেশে আন্দোলন হয়েছে এবং বিপ্লব হয়েছে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের নামে। বহুদেশে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছে ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য সেক্যুলারিস্টদের হাতে। এবং বহু মুসলিম দেশ ফিরে গেছে মধ্যযুগীয় বর্বর রাজতন্ত্রের দিকে -যেখানে মানুষের মৌলিক নাগরিক অধিকার বলে কিছু নেই। বিপ্লবের আগে ইরানে ক্ষমতাসীন ছিল মহম্মদ রেজাশাহ নামে এক স্বৈরাচারী বাদশাহ। তার পিতা রেজা শাহ ছিল তাঁর বংশের প্রথম রাজা। মহম্মদ রেজা শাহ নিজেকে ইরানী রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি এবং বিখ্যাত পারস্য সম্রাট সাইরাস ও দারিয়ুসের উত্তারাধিকারি রূপে চিত্রিত করতো। রেজা শাহকে একজন সৈনিকের স্তর থেকে তুলে নিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল ইঙ্গো-মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ। মহম্মদ রেজা শাহ ১৯৬৯ সালে ইরানী রাজতন্ত্রের দুই হাজার বছরের উৎসব পালন করে। শিরাজ নগরীর শহরতলীতে অবস্থিত পারসেপলিস নগরীতে অনুষ্ঠিত অতি জাঁকজমকপূর্ণ সে উৎসবে বহু দেশের রাজা-রানী ও প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীদের সমাবেশ ঘটেছিল।
মহম্মদ রেজা শাহের সামরিক শক্তি যেমন মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন শাসকের চেয়ে বেশী ছিল, তেমনি সবচেয়ে গভিরতর মিত্রতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনসহ সকল নব্য ও পুরোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে। ১৯৫২ সালে ইরানের জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী শরীফ মোসাদ্দেক রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে মহম্মদ রেজা শাহকে নির্বাসনে পাঠান। তিনি ইরানকে প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষনা দেন এবং তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করেন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট-ব্রিটেনসহ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে ইরানী তেলের লুন্ঠন। স্বৈরাচারি রাজতন্ত্রের এমন উৎখাত এবং ইরানের তেল সম্পদের উপর ইরানী জনগণের এমন একচ্ছত্র মালিকানা সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। অতি অল্পদিনের মধ্যেই মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে সামরিক ক্যু করে তাঁকে অপসারিত করে। এবং তারা আবার ক্ষমতায় বসায় মহম্মদ রেজাশাহকে। মোসাদ্দেকের সামরিক ক্যু করে শাহকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর পর শাহের বিদেশী বন্ধুরা এবার অতি সতর্ক হয়ে যায়। শাহের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তার চারপাশে পরামর্শদাতার বেশ ধরে মজবুত প্রতিরক্ষা-বেষ্ঠনি গড়ে তোলে। ফলে বিদেশী মদদপ্রাপ্ত এমন এক ক্ষমতাধর স্বৈরাচারি শাসককে উৎখাত করে বিপ্লব ঘটানো সহজ ছিল না। এবং তাও ইসলামের নামে। কারণ ইসলামের নামে কোন বিপ্লবে নামলে অন্য কোন দেশের সামান্যতম সাহায্য পাওয়াও সে সময় অচিন্তনীয় ছিল। এখানেই ইমাম খোমেনীর কৃতিত্ব। মানব ইতিহাসে তিনি এক অসাধারণ বিপ্লবের সফল নেতা। তাই বিশ্ববাসীর কাছে তিনি ছিলেন এ অবাক বিস্ময়। ফলে অতি তাড়াতাড়ি তিনি বিশ্বের কোটি কোটি ইসলামপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। সমকালীন বিশ্বে আর কোন মুসলিম নেতাই এ মর্যাদা পাননি।
১৯৭৯ সালের শাহের উৎখাতের পর ইমাম খোমেনী ও তাঁর অনুসারিগণ হুশিয়ার হয়ে যান। বিপ্লব সফল হলেও প্রতিবিপ্লবের ভয় তখন সর্বত্র। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ বিতাড়িত শাহকে আবার যাতে পুণঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ না পায় সে দিক দিয়ে তাঁরা সতর্ক হয়ে যান। এমনই এক অতিসতর্ক পরিবেশে ছাত্ররা হামলা করে বসে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে। তারা সেটিকে বিপ্লব-বিরোধী ষড়যন্ত্রের সাম্রাজ্যবাদী ঘাঁটি আখ্যায়ীত করে দূতাবাসের অফিসারদের চোখবেঁধে ও হাত পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে জিম্মি বানিয়ে ফেলে অজানা স্থানে নিয়ে যায়। বিশ্বের আর কোন দেশে মার্কিনীদের আর কখনই এত বড় অপমানের মুখোমুখি হতে হয়নি। এসব ঘটনা ঘটেছিল আমার ইরানে পৌঁছার কয়েক মাস আগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন জিমি কার্টার। বন্দীদের উদ্ধারের চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। যে মার্কিন বাহিনী হেলিকপ্টার যোগে তাদের উদ্ধারে ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকেছিল তাদের সবাই ঝড়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় মারা পড়ে। তখন টিভির পর্দায় বিশ্বব্যাপী দেখানো হয় মরুভূমিতে পড়ে থাকা মার্কিন সৈনিকদের জ্বলন্ত লাশ। ইরানীদের অনেকেই ভাবে এটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট রহমত। আল্লাহতায়ালা যে তাদের পক্ষে সেটি তাদের মনে আরো বদ্ধমূল হয়ে যায়। ফলে আরো বেড়ে যায় তাদের মনবল। অনেকেই এটিকে সুরা ফিলে বর্নিত ক্বাবা ধ্বংসে আগত আবরাহার বিশাল বাহিনীর ধ্বংস হওয়ার সাতে তুলনা করে। মার্কিন বাহিনী বিধ্বস্ত হয় তেহরান থেকে কয়েক শত মাইল দূরের দাশতে কবীরের মরুভূমিতে। এরপর মার্কিনীরা তাদের বন্দীদের উদ্ধারে দ্বিতীয়বার কোন সামরিক চেষ্টা করেনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র আরেকটি দেশ শুধু ইসলামের নামে অর্জিত হয়েছিল।মুসলিম ইতিহাসে এ ছিল আরেক গণবিপ্লব। এবং সে দেশটি হল পাকিস্তান। ভারতের বুক চিড়ে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানগণ অনেক কোরবানী দিয়ে এ দেশটি গড়েছিল। বহু লক্ষ মানুষ সেদিন নিজ বাপদাদার পৈতীক ভিটা, চাষাবাদ, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানে পাড়ী জমিয়েছিল। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। সারা বছরের বহু শ্রম, বহু কষ্ট, বহু অর্থ ব্যয়ে ফলানো ফসল কি প্রতি বছর ঘরে উঠে? কতবারই তো তা প্লাবনে ভেসে যায়। তেমনি লাখো মুসলিমের বহু রক্ত, বহু শ্রম ও বহু কষ্টের বিপ্লব অনেক সময়ই বাঁচে না। সাতচল্লিশের পাকিস্তানও বাঁচেনি। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ইসলামের শত্রুপক্ষ দেশটির অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই বিরোধীতা শুরু করে। পাকিস্তানের সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রীরা দেশটিকে মেনে নিতে পারিনি। মেনে নিতে পারেনি দেশটিতে বসবাসকারীরা সংখ্যালঘুরাও। তাদের সাথে দেশের ঘরের শত্রুতে পরিণত হয় দেশটির সেক্যুলার এবং সে সাথে চরিত্রহীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর জেনারেল, আদালতের বিচারপতি, মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ইসলামের নামে একটি দেশ প্রতিষ্ঠা পাবে, সেখানে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পাবে –সেটি ইসলামে অঙ্গিকারহীন দুর্বৃত্তদের কাছে অসহ্য ছিল। তাই দেশটির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে জন্ম থেকেই গড়ে উঠে ইসলামের শত্রুপক্ষের বৃহত্তর কোয়ালিশন। তাদের সাথে যোগ হয় ভারত, ইসরাইল ও সোভিয়েত রাশিয়াসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তিও। অপর দিকে দেশটির দুভাগ্য যে, শত্রুপক্ষের এতবড় কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জুটেনি ইমাম খোমেনীর ন্যায় দূরদর্শী ও কৌশলী নেতা। জুটেনি আত্মত্যাগী কর্মীবাহিনী। বরং নেতৃত্বের আসনে বসেছে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের ন্যায় বহু দুর্বৃত্ত স্বৈরাচারি নেতা। ফলে ধ্বসে গেছে উপমহাদেশের মুসলমানদের বহু দিনের স্বপ্ন।
তবে ইসলামের পরাজিত দশা শুধু পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ন্যায় উপমহাদেশের মুসলিম দেশেই নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশেও। হাজার বছরেরও বেশী কাল ধরে মুসলিম বিশ্বের বুকের উপর জেঁকে বসে আসে নানারূপী স্বৈরাচারি শাসন। তাদের সামনে ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শরিয়তের নামে আওয়াজ তোলাই সন্ত্রাস। এরই মাঝে ইরানীরা ইসলামের নামে আওয়াজ তুললো, বিপ্লব ঘটালো এবং সে বিপ্লবকে বাঁচিয়েও রাখলো -সেটা ছিল অভাবনীয়। আমার মনে প্রচন্ড সাধ ছিল ইসলামের শক্তির উৎস্যটি কোথায় সেটা দেখার। হটাৎ সে সুযোগও এসে গেল। ইরানে চাকুরি জুটিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে যেন সে সুযোগই করে দিলেন। মানুষ বহু দেশে বহু পেশায় বহু কাজে যায়। কিন্তু আমার কাছে ইরানে যাওয়ার আনন্দটাই ছিল ভিন্ন। নিছক চাকুরি নয়, এটি ছিল অতি স্বপ্নের এক অজানা রহস্যকে নিজ চোখে দেখার আনন্দ। এতদিন যেটি নানা পত্র-পত্রিকা পড়ে জানার চেষ্টা করতাম, এখন সেটিই জনপদে ঘুরে ঘুরে দেখবো, মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলে জানবো –এটি কি কম সৌভাগ্যের? তাই ইরানে কাজের সুযোগ পাওয়ায় আমার জীবনে যেন নতুন শিক্ষা জীবন শুরু হল।
কিন্তু তেহরান বিমানবন্দর থেকে নেমেই প্রচন্ড আঘাত পেলাম। এটি ছিল স্বপ্নভঙ্গের আঘাত। পাশে নরনারীর পোষাক-পরিচ্ছদের যে চিত্র দেখলাম তাতে তেহরানকে কোন ইসলামী বিপ্লবের দেশের রাজধানী দূরে থাক, কোন মুসলিম দেশর নগর মনে হয়নি। সে তুলনায় ঢাকা, করাচী, লাহোর, ইসলামাবাদ আমার কাছে বেশী ইসলামী মনে হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট তখন ড. বনি সদর। ইরানে যখন বিপ্লব শুরু হয়েছে তখন তিনি প্যারিসে থাকতেন। সেখানেই অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন। বিপ্লবের পর পরই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠায় লেগে যান। শুরুতে তিনি নিজেকে বিপ্লবের ঘোর সমর্থক হিসাবে জাহির করেন। ইমাম খোমেনীর অনুসারি ও ইসলামি বিপ্লবের সমর্থক রূপেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেন এবং বিজয়ী হন। তাঁর আমলে মন্ত্রীদের কম সংখ্যকই ছিলেন পুরাপুরি ইসলামী। তারা অনেকেই ছিলেন ইরানী জাতীয়তাবাদী। কেউবা মধ্যমপন্থি ইসলামী। তারা রাজনীতিতে শাহের স্বৈরাচারের বিরোধী হলেও শাহের আমলে যে সেক্যুলার সংস্কৃতি গড়ে উঠে তার আমূল সংস্কার বা বিলোপ তাদের কাম্য ছিল না। মার্কিনীদের প্রতিও তাদের মনভাব এতটা তীব্র ছিল না। বিপ্লবের পর পরই প্রধানমন্ত্রী হন মেহেদী বাজারগান ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হন ড. ইব্রাহীম ইয়াজদী । এরা দু’জনই ছিলেন মধ্যমপন্থি ইসলামিক। ইসলামের অনুশাসনের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা এতটা আপোষহীন ছিলেন না। ফলে তখন শাহ না থাকলেও তাদের সময় শাহের আমলে গড়ে উঠা সংস্কৃতিকে তেমন পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তনের চেষ্টাও হয়নি। তেহরান বিমান বন্দরে নেমেই সেটির নমুনা দেখলাম। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য, পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ ও তাদের সেক্যুলার অনুসারিগণ মুসলিম জাহানের যে দুটি দেশে সরকারি পরিচর্যায় অতি দ্রুততার সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল তার একটি হলো ইরান। এবং অপরটি হলো তুরস্ক। শাহের আমলে ইরানে গড়ে উঠা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সে প্রবলতর রূপই তেহরানে নেমেই দেখলাম। শাহ চলে গেলেও শাহ আমলে গড়ে উঠা সংস্কৃতির গায়ে তখনও কোন আঁচড় লাগেনি। দেশে একটি রাজনৈতিক বিপ্লব হলেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাজ তখন শুরুই হয়নি।
বিপ্লবের বয়স তখন এক বছরও হয়নি। বিপ্লবের সময় স্বৈরাচারি শাহের বিরুদ্ধে নানা দলের ও নানা বিশ্বাসের মানুষ একত্রে কাজ করেছিল। ইসলামপন্থিরা যেমন ছিল, তেমনি বামপন্থি, ডানপন্থি, জাতীয়তাবাদীরাও ছিল। শাহ বিতাড়িত হওয়ার পর যুদ্ধ নয়া রুপ নেয়। এবারের যুদ্ধ শুরু হয় তাদের নিজেদের মধ্যে। বামপন্থি মোজাহিদে খালক, তুদেহ পার্ট (ইরানী কম্যুনিষ্টদের সংগঠন) এবং জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের কাছে এটি কখনোই কাম্য ছিল না যে, শাহের রাজতন্ত্র-বিরোধী বিপ্লব একটি সফল ইসলামী বিপ্লবে পরিণত হোক। কিন্তু এ লড়ায়ে তারা লাগতর হারতে শুরু করে ইসলামপন্থিদের হাতে। অতিদ্রুত রাজপথ তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়; দ্রুত দখল জমিয়ে বসে ইসলামপন্থিরা। তখন মোজাহেদীনে খালকের ন্যায় সংগঠনের লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, ইসলামপন্থি নেতাদের গুপ্তহত্যা করা। বেছে নেয় সন্ত্রাসের পথ। এসব সন্ত্রাসীদের হাতেই নিহত হয় ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম প্রথমসারির বুদ্ধিজীবী আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহারি, আয়াতুল্লাহ তালেগানী ও আয়াতুল্লাহ বেহেশতীসহ আরো অনেকে। নিহত হয়েছেন দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জনাব রেজায়ী এবং প্রধানমন্ত্রী বাহানূর। সন্ত্রাসীরা এমন কি তেহরানে জুম্মাহর নামাযেও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে।
তেহরান বিমান বন্দর থেকে ট্যাক্সিতে শহরের কেন্দ্রবিন্দু তোপখানে এলাকাতে গিয়ে পৌঁছলাম। ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দু যদি বায়তুল মোকাররাম মসজিদকে ধরা যায় তবে তোপখানা হল তেহরানের সেরূপ কেন্দ্রবিন্দু। এখানে অবস্থিত বহুতল বিশিষ্ঠ বিশাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বিল্ডিং। পরে এ বিল্ডিং বহুবার বহু প্রয়োজনে আমাকে যেতে হয়েছে। এখানে এসে জমা হয় তেহরানে নানা কোন থেকে আসা শত শত বাস। হোটেল-মুখী যাত্রাপথে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফারসীতে আলাপ করছিলাম। ইরানে চাকুরিতে সিলেক্ট হয়েছি এ খবর যখন পেলাম তখন আমি লাহোরে। লাহোরের বিখ্যাত মল রোডে ফিরোজ সন্সের বিশাল বইয়ের দোকান। সেখান থেকে ফার্সী শেখার বই কিনে এনে রীতিমত পড়াশুনা করে দেই। এবং ফার্সী ভাষার সে প্রাথমিক জ্ঞান কাজ দিয়েছিল ইরানে পৌঁছার সাথে সাথেই। হোটেলে ব্যাগ রেখেই আমার শুশুর সাহেবের দেওয়া ঠিকানার খুঁজে বের হলাম। ঠিকানাটি ছিল পরবর্তীতে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং অতি অমায়ীক ব্যক্তি জনাব ফরিদুদ্দীন খানের। পরবর্তীতে তিনি পারিবারীক বন্ধুতে পরিণত হন, বহুবার তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছেন এবং আমিও তার বাসায় গেছি। তাঁর দেশের বাড়ী ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার নবী নগরে। শাহের আমলে তিনি ইরানে আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করেন। নিজ চেষ্টায় তিনি ফার্সি ভাষা ও ফার্সিতে লেখা ইসলামি দর্শনের উপর প্রচুর পড়াশুনা করেন। তেহরান রেডিও’তে তিনি বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বেশ কিছু বইও লিখেছেন। বিখ্যাত ইরানী দার্শনিক মোল্লা ছদরার দর্শন নিয়ে বহু আলোচনা তার মুখে শুনেছি। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি ঢাকার এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখেন এবং পলিসি ফোরাম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন।
তোপখানার বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হল। আমি এক টুকরা কাগজে জনাব ফরিদুদ্দিন খানের ঠিকানাটি ইংরাজীতে লিখে নিয়েছিলাম। বাসস্টপে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো কযেকজন যুবককে আমি জিজ্ঞেস করছিলাম কিভাবে আমি সেখানে যেতে পারি সেটি জানার জন্য। অপূর্ব আগ্রহ দেখলাম তাদের মাঝে। সবাই আমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারে সে বিষয়ে উদগ্রীব। একজন আমাকে বললো চলুন আমার সাথে। আমি সে যুবকটির সাথে বাসে উঠে পড়লাম। প্রায় বিশ মিনিট পর সে বাস থেকে নেমে হাটা ধরলো। অনেক পথ হাঁটার পর আমার সে ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্য সে বিল্ডিংয়ের ভিতর থেকে খবর এলো জনাব ফরিদুদ্দীন খান সেখানে থাকেন না। তবে সৌভাগ্য সেখান থেকে খবর পেলাম তাঁর বর্তমান ঠিকানার। জীবনে এই প্রথম দেখলাম বাসার দরজায় লাগানো মাইক্রোফোনের সাহায্যে বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরের কারো সাথে কথা বলা যায়। কাউকে এজন্য গেটে এসে দরজা খুলতে হয় না। এবং সেটি ছিল ১৯৮০ সালের কথা।
এবার আবার যাত্রা শুরু হল, তবে কোন বাসে বা ট্যাক্সিতে নয়। এবার পায়ে হেঁটে। অনেক পথ হাঁটলাম। মনে মনে বড় অপরাধী মনে হল। চিনি না, জানি না এমন এক অজানা যুবককে বিপদে ফেললাম! কিন্তু অবাক হলাম সে যুবকের হাস্যজ্জ্বল চেহারা দেখে। আমাকে সাহায্য করতে পারছে সে জন্যই যেন তার মনভরা আনন্দ। ভেবে অভিভূত হলাম। অনেক হাঁটাহাঁটির পর অবশেষে আমরা সে কাঙ্খিত ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছলাম। তখন সন্ধারাত। খবর পেয়ে হাজির হলেন জনাব ফরিদুদ্দীন খান। তার মুখেও তখন আনন্দ ভরা হাঁসি। তাঁকে এর আগে কোন দিনই দেখিনি। প্রথম পরিচয়েই মনে হল তিনি যেন আমার বহু দিনের পরিচিত ঘনিষ্ট বন্ধু। আমার শ্বশুর জনাব এ্যাডভোকেট সা’দ আহম্মদ সাহেব ইরানের বিপ্লবী সরকারের দাওয়াত পেয়ে এর আগে তেহরান এসেছিলেন। তখন ফরিদ ভাইয়ের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল। সে সূত্রেই তাঁর ঠিকানা তাঁর কাছে ছিল।
ফরিদ ভাইকে বল্লাম ইরানী যুবকটির সাথে পরিচয়ের কাহিনী এবং সে যে আমার জন্য যে কষ্ট করেছেন এবং মূল্যবান সময় দিয়েছেন -সেসব কথা। ফরিদ ভাই তাঁকে ফার্সীতে অনেক ধন্যবান জানালেন। আমিও যতটা পারলাম তাঁকে বার বার ধন্যবাদ জানালাম। তেহরান এক বিশাল শহর। সে শহরের কোন এক গলি থেকে প্রথম দিনেই কোন একজনকে খুঁজে বের করা নিতান্তই অতি কঠিন কাজ। সে কাজ অতি সহজ করে দিলেন এই ইরানী যুবক। হাঁসিমুখে আমাকে জড়িয়ে ধরে যুবকটি বিদায় নিল। কিন্তু রেখে গেল এমন এক স্মৃতি যা আমার মনের বহু হাজার স্মৃতির ভীড়ে অতিশয় ভাস্বর হয়ে আজও বেঁচে আছে। এমন মহৎ দিলের মানুষেরা গড়ে উঠে দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থেকে। সে ঘটনাটির পর নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছি, আমরা কি পেরেছি সেরূপ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্ম দিতে? আমি নিশ্চিত, এ স্মৃতি আামার জীবনে আমৃত্যু বেঁচে থাকবে। একটি জাতির সংস্কৃতি, চেতনা ও মূল্যবোধ তো এভাবেই বিদেশীদের চোখে ধরা পড়ে।
ইরানে দশ বছরে সঞ্চিত এরূপ বহু স্মৃতিই অহরহ মনে পড়ে। আর বার বার মিলিয়ে দেখেছি আমার নিজ দেশের সংস্কৃতির সাথে। সংস্কৃতি মাঠে ঘাটে গড়ে উঠে না। এর জন্য চাই হাজার বছরের নিরলস প্রচেষ্টা। চাই বিদ্যালয়। চাই শত শত দার্শনিক, লেখক, কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতা। তারাই তো সংস্কৃতির নির্মাতা। সে সাথে চাই হাজার হাজার উন্নত মানের বই। সেগুলিই চেতনা ও চরিত্রের গঠনে বিপ্লবী ভূমিকা রাখে। মুখের ভাষা সব জাতির মানুষেরই থাকে। পশু পাখিরও থাকে। কিন্তু সব ভাষা সংস্কৃতির ভাষা নয়। এবং সে সত্যটি ফার্সি ভাষার সাথে পরিচিত হওয়ার পর আমার কাছে আরো প্রকটতর হল। মনে হয়েছে ফার্সি ভাষা যথার্থই একটি সংস্কৃতির ভাষা। এ ভাষার সমৃদ্ধিতে কাজ করেছেন শেখ সাদী, হাফিজ সিরাজী, জালালুদ্দীন রুমি, ফরিদুদ্দীন আত্তার, ওমন খাইয়ামের মত শত শত কবি। ভারত বর্ষে ভাষার সংখ্যা বহু শত। কিন্তু শত শত বছর ধরে এ ফার্সিই ভারতবাসীর সংস্কৃতির ভাষা রূপে কাজ করে। ফার্সির চর্চা ছিল এমনকি রাজা রামমোহন, রবীন্দ্রনাথের ন্যায় বিখ্যাত বাঙালী পরিবারেও। আজও বাংলা ভাষায় যে ক’টি চরিত্র গঠনমূলক কবিতা বা গল্প স্কুলে পড়ানো হয় তার বেশীর ভাগ ফার্সি থেকে ধার নেওয়া। যেমন স্কুলের পাঠ্য বইয়ের “জীবন খানা ষোল আনাই মিছে” “কুকুরে কামড় দেওয়া কি মানুষের শোভা পায়” ইত্যাদি কবিতাগুলো।
আরেক উপলদ্ধি হলো, যে ব্যক্তি কোন দিনই তার নিজ দেশের বাইরে যাইনি তার পক্ষে নিজ দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের তূলনামূলক বিচার বা মূল্যায়নের সুযোগ মেলে না। তার অবস্থা অনেকটা কূয়ার ব্যাঙয়ের মত। এমন কূপমন্ডক ব্যক্তির কাছে তখন নিজ দেশবাসীর অজ্ঞতা ও অপসংস্কৃতিও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি মনে হয়। এমন কি তা নিয়ে অনেক সময় অহংকারও জেগে উঠে। ইরানে দশ বছর থাকা কালে যে অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছে সেগুলিকে বার বার মিলিযে দেখিছে আমার নিজ দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে। ভেবেছি, ঢাকার কোন বাসস্টপে কোন বিদেশী যদি এরূপ সাহায্য চাইতো তবে তার জন্য আমি নিজে কতটুকু সময় ব্যয় করতাম? হয়তো মুখে মুখে বা হাতের ঈশারায় পথ বাতলিয়ে দিয়ে তার থেকে দ্রুত বিদায় নিতাম। বড় জোর হয়ত কয়েক কদম তার সাথে হাঁটতাম। কিন্তু কখনই তাকে ঠিকানা চেনাতে নিজ খরচে গুলিস্তান থেকে বাসে উঠে মীরপুরে যেতাম না। এখানেই আমার ও আমাদের দেশের জনগণের চেতনা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সমস্যা।
আমাদের দারিদ্র্যতা যতটা অর্থনৈতিক, তার চেয়েও অনেক বেশী হল সাংস্কৃতিক ও নৈতিক। ইরানী যুবকটি হাত বাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করতে এসেছে। সে যেন সে সুযোগটিই অধীর আগ্রহে খুঁজছিল। আচরনে ও কর্মে ইসলামী সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে তো এভাবেই। সুস্থ্য সংস্কৃতির অর্থ নাচ-গান নয়। নাটকে অভিনয় বা গল্প-উপন্যাস লেখাও নয়। বরং সেটি হলো নিজ পায়ে দাঁড়ানো ও অন্যকে সাহায্য করার সামর্থ্য। উচ্চতর সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠে তো এমন মহৎ গুণের কারণেই। তাই ইসলামী সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ মুসলিমগণ শুধু স্বনির্ভরই হয় না, অপরের সাহায্যেও অগ্রনী হয়। এমন এক সংস্কৃতির বলে অতীতে তৃষ্ণার্থ মুসলিম সৈনিক মূর্মর্ষ অবস্থাতেও নিজে পানি পান না করে পাশের আহত সৈনিককে দিয়েছে। অথচ অপসংস্কৃতিতে বাড়ে পরনির্ভরতা, বাড়ে ভিক্ষাবৃত্তি। বাড়ে স্বার্থপরতা ও দুর্বৃত্তি। এবং বাংলাদেশ ইতিহাস গড়েছে এগুলোতে। আরো ভয়ংকর দিক হল, এ নিয়ে দেশবাসীর মাঝে তেমন দুশ্চিন্তাও নেই। হয়ত বাংলাদেশে অবস্থান করলে আমার মনেও আমাদের সাংস্কৃতিক ও নৈতিক রোগগুলো এতটা প্রকট ভাবে ধরা পড়তো না। দুশ্চিন্তাও বাড়তো না। কারণ, সব সময় হেঁসেলে যার বসবাস তার কাছে হেঁসেলের গন্ধই স্বাভাবিক মনে হয়। ইরানসহ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘকাল থাকার ফলে তূলনামূলক বিচারের যে সুযোগটি মেলেছে আমার কাছে আজও যেন সেটিই অমূল্য।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018