অধিকৃত মসজিদ ও বিপন্ন ইসলাম
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 26, 2018
- ইসলাম
- No Comments.
দেশে দেশে ইসলাম যেমন প্রবল ভাবে বিজয়ী হতে পারে, তেমনি পরাজিত, অবহেলিত বা বিপন্নও হতে পারে। আল্লাহর দ্বীনের সবচেয়ে বড় বিজয় এসেছিল মহান নবী হযরত মহম্মদ (সাঃ) এর হাতে। সমগ্র ইতিহাসে সেটিই হল মানবের সবচেয়ে গৌরবময় কীর্তি। অপর দিকে মানব জাতির পথভ্রষ্টতা, পাপাচার ও আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইতিহাসও বড্ড দীর্ঘ। অতীতে পথভ্রষ্ট মানুষেরা ইসলামকে বিপন্ন বা আল্লাহর দ্বীনের চর্চা অসম্ভব করেছে খোদ আল্লাহর ঘর -ক্বাবার অভ্যন্তরেও। সেখানে মুর্তি বসিয়ে সেগুলির পুঁজা করেছে। আল্লাহর ঘর এভাবে ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিচর্যা বাড়াতে। আল্লাহর ঘর ও আল্লাহর জমিন শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃত হলে ইসলাম যে কতটা বিপন্ন হয় এবং ইসলামের বিজয় যে কতটা অসম্ভব হয় -এ হল তার নজীর। তবে আল্লাহর ঘর তাঁর অবাধ্যদের হাতে অধিকৃত হবার ঘটনা এই প্রথম নয়, শেষও নয়।
মুসলিম জাহানে আজ লক্ষ লক্ষ মসজিদ- মাদ্রাসা। মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দেড় শত কো্টি। কিন্তু কোথাও কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত? আল্লাহর দ্বীনের এর চেয়ে বড় বিপন্ন দশা আর কি হতে পারে? তাই জনসংখ্যা বা মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা নিয়ে কি গর্ব করা যায়? এ বিপন্নদশার মূল কারণ, মুসলিম রাষ্ট্রগুলিই যে শুধু অধিকৃত হয়েছে তা নয়, আল্লাহর অবাধ্য ও বিদ্রোহীদের হাতে অধিকৃত হয়েছে এমন কি তাঁর নিজের ঘরও। মক্কার মুশরিকদের ন্যায় আল্লাহর ঘরে মুর্তি না রাখলেও তারা অসম্ভব করেছে সেখানে ইসলামের মূল শিক্ষার চর্চা। ইসলামের মৌল শিক্ষাকে তারা বলেছ মৌলবাদ। এসব মসজিদে নামাযীর সংখ্যা বাড়লেও লড়াকু মোজাহিদের সংখ্যা বাড়েনি। ফলে বাড়েনি মুসলিম ও ইসলামের প্রতিরক্ষা। তাদের ব্যর্থতা শুধু নামায আদায়ে নয়, ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকার নিয়ে বেড়ে না উঠায়। ফলে দেশে দেশে ইসলামের পরাজয় ও মুসলমানদের দুর্দশা বাড়লেও তা নিয়ে তাদের মাঝে মাতম উঠেনা।
নবীজী (সাঃ)র আমলে কি এমন কোন সাহাবী ছিলেন যিনি শুধু নামাযীই ছিলেন এবং আল্লাহর রাস্তায় মোজাহিদ ছিলেন না? প্রকৃত মোমেনকে যেমন তার নামায থেকে পৃথক করা যায় না, তেমনি পৃথক করা যায় না আমৃত্যু জিহাদ থেকেও। আর জিহাদ হলো লাগাতর প্রচেষ্ঠা। এবং সে প্রচেষ্ঠা হল আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার। সে জিহাদের প্রেরণা ও নির্দেশনা আসে মসজিদের মিম্বর থেকে, আসে আল্লাহর ঘরের জায়নামাজে বসে ধ্যানমগ্নতা ও জ্ঞানমগ্নতায়। এমন নামাযী তখন রাজনীতির নীরব দর্শকে পরিণত হয় না, বরং পরিণত হয় ইসলামের বিজয়ে লড়াকু যোদ্ধায়। আল্লাহর দ্বীনের এটিই হল মূল প্রতিষ্ঠান। মোমেনের জীবনে জিহাদ না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আল্লাহর শত্রুদের হটানো যাবে কীরূপে?
ইসলামের শত্রুদের ভয় মুসলিম রাষ্ট্রসংখ্যা ও জনসংখ্যা নয়। নামায-রোযাও নয়। ভয়ের মূল কারণ জিহাদ। কারণ মুসলিম উম্মাহ হামলার মুখে প্রতিরোধের প্রেরণা পায় জিহাদী জজবা থেকে। তাই জিহাদ-শূণ্য হলে এক অরক্ষিত জনপদে পরিণত হয় মুসলিম উম্মাহ। তখন আল্লাহর ঘরই শুধু শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃত হয়না, অধিকৃত হয় মুসলিম ভূমিও। তখন সর্বক্ষেত্রে পরাজিত হয় ইসলাম। এমন এদেশে শাসনতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নির্মিত হয় আল্লাহর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী বিদ্রোহকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে। তখন আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়ে চলেন দেশের শাসক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, বিচারক, প্রশাসক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ প্রায় সকল পেশার মানুষ। বাংলাদেশের মত শতকরা ৯০ জন মুসলমানের দেশেও সে বিদ্রোহ যে কতটা প্রকট, দুর্বৃত্ত বিদ্রোহীরা যে কতটা বিজয়ী এবং আল্লাহর দ্বীন যে কতটা পরাজিত সে প্রমাণ কি কম? বাংলাদেশের সংবিধানে সার্বভৌমত্ব তথা দেশের মালিক-মোখতার, আইন তৈরীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হল জনগণ। অথচ সে ক্ষমতা একমাত্র মহান আল্লাহর। পবিত্র কোরআনে সে আইন দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা। আল্লাহর এ ক্ষমতার সাথে কাউকে শরীক করার অর্থই শিরক। মহান আল্লাহর ক্ষমতার শরিকদার যেমন কোন রাজা-বাদশাহ হতে পারে না তেমনি জনগণও হতে পারে না। তাই এমন শিরকী সাংবিধানিক ঘোষণা কি কোন ঈমানদারের মুখে শোভা পায়? এতে কি ঈমান বাঁচে? একাজ তো আল্লাহদ্রোহী বিদ্রোহীদের। এমন বিদ্রোহীরা মসজিদ দখলে নিবে, তাদের হাতে মুসলিম ভূমি অধিকৃত হবে এবং এবং সে ভূমিতে আল্লাহর অআইনকে আস্তাকুঁড়ে ফেলবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
মসজিদের জায়নামাযে যদি প্রকৃত ইসলামের চর্চা হত তবে নামাযীদের চেতনারাজ্যে প্রতিষ্ঠা পেত ইসলামের বিপ্লবী শিক্ষা। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উপর প্রতিষ্ঠিত এ সংবিধানীক ঘোষণার বিরুদ্ধে তখন রাজপথে প্রচন্ড লড়াই শুরু হত। অথচ বাংলাদেশে সেটি হয়নি। বরং তারা নিজ ভোটে এমন সব ব্যক্তিদেরকে বারবার নির্বাচিত করেছে যারা আল্লাহর নির্দেশিত হারাম-হালালের বিধানকে বর্জন করেছে এবং সূদ, মদপান ও পতিতাবৃত্তির ন্যায় জঘন্য পাপকর্মকেও আইন-সিদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই বাংলাদেশের ন্যায় দেশে ইসলাম যে শুধু আল্লাহর ঘরে বা রাষ্ট্রের প্রশাসনে বা আদালতে পরাজিত হয়েছে তা নয়, পরাজিত হয়েছে সেসব লোকদের চেতনা রাজ্যেও যারা নিজেদেরকে নামাযী ও রোযাদার মুসলমান রূপে দাবী করে। শয়তানের দখলে গেছে তাদের মনের রাজ্য। ফলে অআল্লাহর রাস্তায় মোজাহিদ হওয়া ও সে রাস্তায় শ্রম, অর্থ ও রক্তদান নিয়ে এমন নামাযীদের কোন ভাবনা নেই। বরং তাদের শ্রম, মেধা, অর্থ ও ভোটের বিনিয়োগ বেড়েছে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির রাজনৈতীক প্রতিষ্ঠা।
অথচ মুসলমানের চেতনা রাজ্যে ইসলামকে বিজয়ী করার মূল কাজটি হয় মসজিদের মেঝেতে। নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ সে কাজটিই আমৃত্যু করেছেন। নামাযীর চেতানায় ইসলামের মূল আক্বীদা বা বিশ্বাসকে যেমন গভীরতর করেছেন, তেমনি প্রবলতর করেছেন ইসলামকে বিজয়ী করার অঙ্গিকার। এ কাজ অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে হয়না। নবীজী (সাঃ)র আমলে একাজে মসজিদ ছাড়া আর কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। মসজিদের অআভিধানিক অর্থঃ সিজদার জায়গা। বান্দাহ এখানে গিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে মাথা মাটিতে ঠ্যাকায়। এবং সেটি প্রতিদিন একবার নয়, বরং ৫ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি রাকাতে দুইবার। এভাবে প্রতিদিন বহুবার। এ আনুগত্য শুধু নামাযের জায়নামাযে নয়, বরং প্রতিদিন এবং প্রতিক্ষণে। এবং সেটি আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের প্রতি। এভাবে আল্লাহর আনুগত্যকে মোমেনের জীবনে চিরস্থায়ী অভ্যাসে পরিণত করাই নামাযের মূল লক্ষ্য। আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাই মোমেনের জীবনে অভাবনীয়। তাই যে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত ও হালাম-বিধানের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা – বুঝতে হবে মসজিদের কাজ সেখানে যথার্থ ভাবে হয়নি। মসজিদের কাজ নিছক নামাযের আয়োজন নয়। সে কাজ যে কোন গৃহ,যানবাহন এমন কি উম্মূক্ত ময়দানেও সম্ভব। বহু শ্রম, বহু অর্থ ও বহু সময় ব্যয়ে তাই মসজিদের নির্মান কেন?
নবীজী (সাঃ) মক্কায় ইসলামের মূল ইন্সটিউশন গড়ার সুযোগই পাননি। ইব্রাহীম (আঃ) যে মহান ইন্সটিউশন গড়ে গিয়েছিলেন সেটিকেও তিনি ব্যবহার করার কোন সুযোগ পাননি। আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এ ঘরটি তখন শয়তান ও তার অনুসারিদের কবজায়। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার যে মহান লক্ষ্য নিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ)কে সাথে নিয়ে যে ক্বাবা ঘর নির্মান করেছিলেন সেটি তার মূল লক্ষ্য থেকেই বিচ্যুত হয়। ফলে বিপন্নতা বাড়ে ইসলামের। পৃথিবী জুড়ে আল্লাহর দ্বীনের পথ আর কি দেখাবে, ক্বাবার নিজের মেঝেতেই তখন মুর্তিপুজা। সমগ্র আরবভূমি জুড়ে মুর্তিপুজা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পেত এ ঘর থেকে। অসম্ভব হয়ে পড়ে আল্লাহর এ ঘরকে কেন্দ্র করে ইসলামের চর্চা ও ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লব। ফলে অনিবার্য হয়ে পড়ে হিযরত।
মদিনায় হিজরত সে বাধা দূর করে দেয়। মদীনায় পৌঁছেই তিনি প্রথম যে কাজে হাত দিলেন সেটি নিজের বাসগৃহ নির্মান নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বা রুটিরুজীর তালাশও নয়। বরং মসজিদের নির্মান। নবীজী (সাঃ)র উষ্ঠিটি মদীনায় পৌঁছে যেখানে গিয়ে আসন গাড়লো সেখানেই শুরু হল মসজিদ নির্মানের কাজ। অথচ সে সময় তাঁর সমগ্র দেহ-মন জুড়ে ছিল মক্কা থেকে মদিনা – এ দীর্ঘ সফরের গভীর ক্লান্তি। সে ক্লান্তি ছিল ৭ দিন ব্যাপী পাহাড়-পর্ব্বত ও ধূসর মরুভূমি অতিক্রমের। ছিল রক্তপিপাসু কাফের সন্ত্রাসীদের লাগাতর তালাশের মুখে তিন দিন অন্ধকার গুহা-বাসের চরম পেরেশানি। কিন্তু সে গভীর ক্লান্তি বা পেরেশানি নিয়ে তিনি কালক্ষেপন করেননি। বরং প্রচন্ড উদ্যোম নিয়ে মসজিদ গড়ায় হাত দিলেন। কিন্তু কেন সে গভীর ক্লান্তি নিয়ে মদীনায় পৌঁছা মাত্রই মসজিদ গড়ায় হাত দিলেন -সে প্রশ্নটি আজ ক’জনের? অথচ নবীজীবনে এবং সে সাথে ইসলামের ইতিহাসে সেটাই হল অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরবর্তীতে এ মসজিদই মানবজাতির ইতিহাস পাল্টে দেয়। মদিনার বুকে এটিই ছিল আল্লাহর দ্বীনের প্রথম ইন্সটিটিউশন। সেখান থেকে জন্ম নেয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠতম সভ্যতা -যার কোন তুলনা সমগ্র মানব-ইতিহাসে নাই। তাই মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত শুধু মুসলিম ইতিহাসে নয়, সমগ্র মানব ইতিহাসেও অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লবের পথে যাত্রা শুরু হয় এ হিজরত থেকেই। নবীজী (সাঃ)র মদিনায় আগমনের দিনটি থেকেই শুরু হয় হিজরী সাল গণনা। মুসলিম ইতিহাসে দিনটিকে এভাবে শুধু সম্মানিতই করা হয়নি, দিনটির অপরিসীম গুরুত্বও বুঝানো হয়েছে।
ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লবের কাজে আত্মনিয়োগর সামর্থ সবার থাকে না। তাজমহল নির্মানের সামর্থের চেয়ে এ সামর্থের গুরুত্ব অধিক। এ সামর্থের পুরস্কারও অসীম। আল্লাহতায়ালা এমন সামর্থবান ব্যক্তির কাজের পুরস্কার দেন অনন্তু অসীম কালের জন্য জান্নাত দিয়ে। তবে সে সামর্থ বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যালাভে আসে না। আসে কোরআনী জ্ঞানের গভীরতা থেকে। আসে ধ্যানমগ্ন ইবাদতে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালার ঘোষণা হল, একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই আমাকে ভয় করে। অর্থাৎ আল্লাহভীরু হওয়ার জন্য জ্ঞানবান হওয়াটাও জরুরী। অজ্ঞতাই ইসলামের বড় শত্রু। এটিই শয়তানের বড় হাতিয়ার। তাই সমাজ বিপ্লবের কাজের শুরু হয় অজ্ঞতা সরানোর মধ্য দিয়ে। এবং সেটি করতে হয় জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান গড়ে। সেখানে গভীর জ্ঞানচর্চা না হলে আল্লাহভীরু মানুষ সৃষ্টির কাজ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন অসম্ভব হয় দ্বীনের প্রতিষ্ঠা বা বিজয়। আর জ্ঞানচর্চায় ইসলামের প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হল মসজিদ। তাই নবীজীর (সাঃ)র যুগে মসজিদের মেঝে যতটা ব্যবহৃত হয়েছে নামায আদায়ের কাজে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী ব্যবহৃত হয়েছে জ্ঞানচর্চায়। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ে ঘন্টার বেশী ব্যয় হয় না। অথচ নবীজী ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করেছেন দ্বীনের তালিমে। তাছাড়া কোরআনের জ্ঞান গভীর না হলে নামাযে বা ইবাদতে একাগ্রতাই বা আসে কতটুকু?
জ্ঞানের গভীরতা ও এবাদতে একাগ্রতা একত্রে উঠানামা করে। জ্ঞান বাড়লে যেমন ইবাদতে নিষ্ঠা বাড়ে, তেমনি অজ্ঞতায় বাড়ে গাফলতি। নামাযের বা ইবাদতের ওজন তো এভাবেই বাড়ে। ইসলামে তাই শুধু নামায ফরয করা হয়নি, বরং নামাযের আগে জ্ঞানার্জন ফরয করা হয়েছে। তাই নামাযে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা বাড়াতে হলে লাগাতর ও গভীরতর জ্ঞানচর্চা জরুরী। তাই জ্ঞান-বিতরণ শুধু জুম্মার সংক্ষিপ্ত খোতবাতে সীমাবদ্ধ রাখা হলে চলে না, জ্ঞান-বিতরণের কাজ হতে হয় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ ও প্রতি সকাল-সন্ধায়। নবীজী (সাঃ) মসজিদে নববীর জায়নামাযে বসে সেই কাজটিই আজীবন করেছেন। মুসলিম ইতিহাসে এতবড় সফল বিশ্ববিদ্যালয় আর কোন কালেই নির্মিত হয়। মসজিদে নববীর সে জায়নামায থেকে যতজন জ্ঞানীব্যক্তি তৈরী হয়েছেন, সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে তারাই সর্বাধিক গর্বের। মুসলমানদের আজ সংখ্যা বেড়েছে, মসজিদ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ও বেড়েছে। কিন্তু সে মাপের জ্ঞানী ব্যক্তি নবীজী (সাঃ)র ওফাতের পর আজ অবধি সৃষ্টি হয়নি। সৃষ্টি হয়নি সে মানের নামাযীও। ফলে সে আমলে কয়েক লাখ মুসলমানের হাতে বিশাল ভূ-খন্ড জুড়ে ইসলামি রাষ্ট্র নির্মিত হলেও আজকের প্রায় দেড় শত কোটি মুসলমান সেটি ভাবতেও ভয় পায়।
মুসলমানদের আজকের ব্যর্থতা অনেক। তবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল ইসলামি রাষ্ট্র নির্মানে ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার মূল কারণ, মুসলিম বিশ্বের মসজিদগুলো মসজিদে নববীর মডেলে গড়ে উঠেনি। ফলে মুসলমানগণ ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সাঃ)র মডেলে গড়ে উঠতে। ইঞ্জিন অচল হলে গাড়ী সামনে এগুয় না। আজকের মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে সে অচল ইঞ্জিনটি হল মসজিদ। ফলে ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র কোন কিছুই আল্লাহর শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠায় এক কদমও সামনে এগুচ্ছে না। বরং পিছনে হটছে। উপনিবেশিক শাসনের আগে বাংলাসহ সকল মুসলিম দেশের আদলতে ছিল শরিয়তী আইন। উপনিবেশিক আমলে সেটিকে সীমিত করা হয় বিবাহশাদী, তালাক, সম্পদের বন্ঠন ইত্যাদী পারিবারীক বিষয়গুলীর মাঝে। আর এখন সে পারিবারীক আইন থেকেও শরিয়তের হুকুমগুলোকে হঠানো হচ্ছে।
মহান নবীজী (সাঃ) বলেছেন, “নামায মোমেনের মীরাজ।” প্রশ্ন হল, মীরাজের অর্থ কী? নবীজী (সাঃ)র জীবনে মীরাজ হল আল্লাহর মারেফত লাভ। মীরাজের রাতে নবীজী (সাঃ) আসমান জগতের উচ্চমার্গে আরোহন করেছিলেন। পৃথিবীর সীমাবদ্ধতা ডিঙ্গিয়ে তিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি অজানা সত্যজ্ঞান পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। স্বচোখে দেখতে পেয়েছিলেন জান্নাত-দোযখ। সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন অন্যান্য নবীদের। তেমন মীরাজ সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আজও যেটি সম্ভব সেটি হল মহান আল্লাহর মারেফত। আর সেটি গড়ে উঠে নামাযের মাধ্যমে। এ লক্ষে ইসলামে বনে-জঙ্গলে গিয়ে ধ্যানে বসা বা সাধু-সন্ন্যাসী হওয়ার বিধান যেমন নেই, তেমনি প্রয়োজন নেই কোন পীরের দরবারে ধর্ণা দেওয়ার। নবীজী (সাঃ)ও সাহাবায়ে কেরামদের যুগে এজন্যই পীরদের ব্যবসা জমেনি। বরং সে আমলে যা বেড়েছে তা হল প্রকৃত নামাযীর সংখ্যা ও মারেফত। বেড়েছে মোজাহিদ। ফলে বিজয় এসেছে লাগাতর। এবং সেটি সম্ভব হয়েছিল ইবাদতের সাথে গভীর কোরআনী ইলমের সংমিশ্রণ হওয়ায়। ইলমহীন জাহেল ব্যক্তির নামাযে সেটি ঘটে না। এমন নামাযে মহান আল্লাহর সাথে মজবুত সম্পর্কও গড়ে উঠে না। বাড়ে না মহান আল্লাহর মিশনের সাথে একাত্মতা । ফলে বাড়ে না শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিষ্ঠা। বরং যা বাড়ে তা হল মুনাফেকী। এমন নামাযীরাই ঘুষ খায়, সূদ খায়, সূদী ব্যাংকে চাকুরী নেয় এবং আদালতে বিচারক সেজে শরিয়তের বিধানকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে। আর রাজনৈতীক লড়ায়ে এরা ইসলামের আত্মস্বীকৃত বিরুদ্ধপক্ষকে শুধু ভোটই দেয় না, তাদের বিজয়ে অর্থ দেয়, শ্রম দেয় এবং প্রয়জেনে রক্তও দেয়। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে সেসব রাজনৈতীক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তরা আল্লাহর শরিয়তী বিধান পরাজিত করে রেখেছে তারা কি তাদের মদদে নয়?
ইসলামে নামায পড়া ফরয। আর জামায়াতে নামায আদায় ওয়াজেব -তথা ফরযের কাছাকাছি। বোখারী শরিফের হাদীসে বলা হয়েছে, জামায়াতে নামায পড়ার সওয়াব একাকী নামায আদায়ের চেয়ে ২৭গুণ অধিক। আর সে সওয়াব আরো অধিক যদি সে নামায মসজিদের জামায়াত আদায় হয়। নবীজী(সাঃ)র কাছে মসজিদে জামায়াতে শামিল হওয়াটি নিছক সওয়াব হাসিলের বিষয় রূপে গণ্য হয়নি, বরং মসজিদের জামায়াত থেকে দূরে থাকাটি তাঁর কাছে গণ্য হয়েছে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে। আর সে শাস্তিটি তিনি দিতে চেয়েছেন তাদের ঘরবাড়ী জ্জালিযে দিয়ে। মসজিদ থেকে দূরে থাকার জন্য এর চেয়ে কঠোর হুশিয়ারি আর কি হতে পারে? এ বিষয়ে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্নীত হাদীসটি হল নিম্মরূপ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “ যাঁর হাতে আমার জান তাঁর কসম! আমি মনস্থ করেছি, আমি জ্বালানি কাঠের সংগ্রহে নির্দেশ দিব। তারপর নামায আদায়ের নির্দেশ দিব। নামাযের ইক্বামত বলা হবে এবং লোকদের ইমামতি করার জন্য কোন একজনকে নির্দেশ দিব। এরপর আমি নামাযে অনুপস্থিত লোকদের বাড়ী যাব এবং বাড়ীগুলো জ্বালিয়ে দিব।” -সহীহ আল বোখারী। মসজিদের মূল কাজ আল্লাহর বান্দাহকে আল্লাহমুখি করা। সে লক্ষ্যে নামায হলো আল্লাহর রশি। প্রতিদিন সে রশির টানেই সে আল্লাহর দিকে আসে।
ইসলামে গণমুখিতা, দুনিয়ামুখিতা বা মুক্তচিন্তার কোন সুযোগ নেই। এগুলো মূলতঃ শয়তানমুখিতা। এ দুনিয়ার জীবনে চলার পথ মাত্র দুইটি। একটি হল, “ফি সাবিলিল্লাহ” অপরটি “ফি সাবিলিসশায়তান”। একটি অআল্লাহর পথ, অপরটি শয়তানের। এর মাঝে যে কোন একটিকে বেছে নিতে হয়। মোমেনকে শুধু জায়নামাযে দাঁড়িয়ে একথা বললে চলে না যে “ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাতারাস সামাওয়াতি ও ওয়াল আরদা হানিফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন”। অর্থঃ “আমি সত্য-সত্যই তাঁর দিকে মুখ করলাম যিনি আসমান জমিনের সৃষ্টিকর্তা। এবং আমি মুশরিকদের দলভূক্ত নই।” বরং তাকে সর্বকাজে ও সর্বাবস্থায় আল্লাহমুখি হতে হয়। সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়ে কাফের, মুশরিক, ফাসেন তথা সর্বপ্রকার আল্লাহদ্রোহী শক্তি থেকে। নামাযের মূল শিক্ষা তো এটাই। এ শিক্ষার কারণেই, প্রকৃত নামাযী তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয় মহান আল্লাহর ঘোষিত আহকাম থেকে। নামাযীর রাজনীতি,সংস্কৃতি,অর্থনীতি ও রীতিনীতিতে এজন্যই আল্লাহমুখিতা প্রকট। যার মধ্যে সে আল্লাহমুখিতা নেই, বুঝতে হবে তার উপর নামায কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। নামাযের কসরত শুধু উঠাবসাতেই শেষ হয়েছে, সে ব্যক্তি নামায থেকে কিছুই পায়নি। পরকালেও যে কিছু পাবে না সেটিও নিশ্চিত। এমন শিক্ষাহীন, আমলহীন নামাযীরা চিন্তা-চেতনা ও কর্মক্ষেত্রে শয়তানমূখি। এমন শয়তানমুখি নামাযীর উঠাবসা, গলাগলি ও রাজনীতি জমে উঠে শয়তানের অনুসারি নাস্তিক,মুশরিক বা সেকুলারদের সাথে। বার বার হজ্ব করে আসলেও তারা ইসলামের উত্থান ঠেকাতে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটের আগ্রাসেন সহযোগী হতে সদাপ্রস্তুত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তো মুসলিম দেশগুলিতে অবিরাম গণহত্যায় সক্রীয় সহযোগী পাচ্ছে তো এদের মাঝ থেকেই। কোন রাষ্ট্র বা সমাজে এমন নামাযীর সংখ্যা বাড়লেও সে রাষ্ট্র ও সমাজ শয়তানমুখি হতে বাধ্য। তখন সেসব অতি কঠিন হয়ে পড়ে ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লব। অধিকাংশ মুসলিম দেশে তো সেটিই হয়েছে।
মসজিদে জামায়াতে নামায পড়ার প্রতি সাহাবাদের আগ্রহ এতটাই গভীর ছিল যে কোন মসজিদের জামায়াতে নামায পেলে তাঁরা অন্য মসজিদে ছুটতেন। এরূপ ছুটাছুটির প্রতি কদমে রাখা হয়েছে প্রচুর সওয়াব। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণীত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যখন ভাল ভাবে ওজু করে মসজিদের দিকে বের হয় এবং একমাত্র নামাযের জন্যই বের হয় তখন তার প্রতিটি কদমে পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং মাফ করে দেওয়া হয় তার একটি গুনাহ। নামায পড়ে যতক্ষণ সে জায়নামাযের উপর অবস্থান করে ফেরেশতাগণ তার জন্য ততক্ষণ এই বলে দোওয়া করে, “হে আল্লাহ! তাকে তোমার রহমত দান কর, তার প্রতি অনুগ্রহ কর।” – সহীহ আল বোখারী। মোমেনের মর্যাদা এভাবে আল্লাহর ঘরে দিনে পাঁচবার ছুটাতেই বাড়ে, নিজ ঘরে বা পীরের দরবারে ধ্যানে বসাতে নয়। মহান আল্লাহতায়ালা নেকী বা রহমত বিলি করেন তাঁর নিজ ঘর মসজিদ থেকেই, পীরের খানকাহ বা মৃত পীরের কবর থেকে নয়। ফেরেস্তারাও তাঁদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। হাদীসে বলা হয়েছে,“যতক্ষণ সে মসজিদে নামাযের অপেক্ষায় থাকে ততক্ষণ তার জন্য নামাযের সওয়াব লেখা হয়। অপেক্ষাকালীন সে সময়টুকু ধরে সে মহান আল্লাহর মেহমান।”
আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ সে ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব যার মধ্যে সর্বাবস্থায় কাজ করে আল্লাহর ভয়। বিরাজ করে আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতার চেতনা। যার মধ্যে আল্লাহর যিকর বা স্মরণই নেই সে ব্যক্তি এ কাজে ভাবনাহীন ও আগ্রহহীন। আল্লাহর স্মরণশূণ্য এমন ব্যক্তির মাঝে তখন যেটি কাজ করে বা স্মরণে থাকে সেটি হল ব্যক্তি, গোষ্ঠি, বর্ণ, জাতি,দল বা ফেরকাগত স্বার্থ চেতনা। আল্লাহর দ্বীনের বিজয়-ভাবনা তার কাছে মূল্যহীন ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।
সমাজ বা রাষ্ট্র জুড়ে পবিত্রতা প্রতিষ্ঠার আগে ইসলাম চায় ব্যক্তির চেতনায় পবিত্রতা। চায় চেতনায় আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের নিরবিচ্ছিন্ন ভাবনা। এবং সেটি সম্ভব অবিরাম যিকরের মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, নামায নিজেই সেই যিকর তথা আল্লাহর স্মরণ। প্রতিদিন ৫ বার মসজিদে নামাযে হাজির হওয়াতে মোমেনের জীবনে সে যিকর বা স্মরণ গভীরতর হয়। মানব জীবনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কারণ দারিদ্র্য নয়, স্বাস্থ্যহীনতাও নয়। বরং সেটি আল্লাহরর যিকরশূণ্যতা। আল্লাহর যিকর তথা স্মরণ বিলুপ্ত হলে লোপ পায় আল্লাহর ভয়। এমন যিকরশূণ্য ব্যক্তিরাই ঈমানশূণ্য হয়। তখন ভূলে যায় আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি নিজ দায়বদ্ধতার কথা। এমন ব্যক্তিরাই পাপকর্মে লিপ্ত হয় এবং পথযাত্রী হয় জাহা্ন্মামের। আর মোমেনের মনে নামায আল্লাহর সে স্মরণকেই সব সময় জাগ্রত রাখে। তবে আল্লাহর যিকরের অর্থ শুধু তাঁর নামে তাসবিহ পাঠ নয়, বরং আল্লাহতায়ালার কোরআনী হুকুম ও সে হুকুমের প্রতি নিজ দায়িত্বের স্মরণ। ঈমানদারের প্রতি মহান আল্লাহর আহবানটি এসেছে এভাবেঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহাযকারী হয়ে যায়।” –সুরা সাফ। আরো বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন। এবং তোমাদের পদযুগলকে মজবুত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করবেন।” -সুরা মুহাম্মদ। প্রশ্ন হল, মোমেন আল্লাহর সাহায্যকারি হবে কোন কর্মে? সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ঘোষণাট এসেছে পবিত্র কোরআনে। সেটি হল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। বলা হয়েছে, “তোমরা সংখ্যায় কম হও বা অধিক হও, বেরিয়ে পড় আল্লাহর রাস্তায় এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর নিজেদের জানমাল দিয়ে। সেটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝতে।” –সুরা তাওবাহ। এখানে বিশাল রাষ্ট্রগড়া, বিশাল বাহিনী গড়া বা উন্নত অস্ত্রশস্ত্র বা সমরসজ্জা গড়ে তোলার অপেক্ষায় বসে থাকার অবকাশ নেই। প্রশ্ন জাগতে পারে, মোমেন কেন আল্লাহর রাস্তায় বের হবে এবং কেনই বা জিহাদ করবে। তাদের সে লড়ায়ে লক্ষ্য বা এজেন্ডা কি? মোমেনের জীবনে সে এজেন্ডাটি হল মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য ও এজেন্ডার সাথে পরিপূর্ণ একাত্মতা। আল্লাহর লক্ষ্য অর্জনে আল্লাহতায়ালার পূর্ণ সাহায্যকারি হয়ে যাওয়া। মহান রাব্বুল আলামিনের স্বঘোষিত সে লক্ষ্যটি হল, “সকল ধর্ম,মত ও মতবাদের উপর আল্লাহর সত্যদ্বীনের (বিশ্বব্যাপী) পরিপূর্ণ বিজয়।–সুরা সাফ। মহান আল্লাহর এ এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার চেয়ে মোমেনের জীবনে আর কোন গুরুত্বপূর্ণ বা মহৎ এজেন্ডা, ব্যবসা-বাণিজ্য বা কাজকর্ম কি থাকতে পারে? থাকতে পারে কি নাযাতের ভিন্ন পথ? আল্লাহর আযাব থেকে মৃক্তির উপায় যে ঘরে বসে নিছক তাসবিহ পাঠ নয় বা নিছক নামায-রোযার মাঝে ইবাদত-বন্দেগীকে সীমাবদ্ধ করা নয় বরং সেগুলির সাথে জিহাদের পথে নিজের জানমালের পরিপূর্ণ বিণিয়োগ -সে বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালা কোনরূপ অস্পষ্টতা রাখেননি। বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার কথা স্মরণ করিয়ে দিব যা তোমাদেরকে জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দিবে? সেটি হল, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস কর। এবং জানমাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর।” -সুরা সাফ। মহাল আল্লাহর আরো ঘোষণা দিয়েছেনঃ “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা ন্যায়কর্মের আদেশ দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হল সফলকাম।” -সুরা আল ইমরান।
আর যেখানেই অন্যায়কে রুখার প্রচেষ্ঠা, সেখানে জিহাদ অনিবার্য। কারণ ফিরাউন-নমরুদ-আবু লাহাব-আবুজেহেলের মত সমাজের দুর্বৃত্তরা তাদের দুর্বৃত্তি বন্ধ রাখবে সেটি ভাবা যায় না। যে রাষ্ট্রে এমন দুর্বৃত্তরা থাকবে সে সমাজে দুর্বৃত্তি থাকবে না সেটি কি হতে পারে? কারণ এমন অধর্মই তাদের জীবন-ধর্ম। এমন দুর্বৃত্তিই তাদের কর্ম ও সংস্কৃতি। সে অধর্ম ও দুর্বৃত্তি রুখতে গেলে সংঘাত অনিবার্য। তাছাড়া ফিরাউন-নমরুদ-আবু লাহাব-আবুজেহেলরাই ইতিহাসের একমাত্র দুর্বৃত্ত নয়। প্রতিটি অনৈসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের দ্বারা পরিপূর্ণ। মুসলিম দেশগুলোতে আজ যারা আল্লাহর শরিয়তের প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে রেখেছে তারা নামে মুসলমান হলেও তাদের দুর্বৃত্তিটা ফিরাউন-নমরুদ-আবু লাহাব-আবুজেহেলদের থেকে কি কম? আর তাই যে রাষ্ট্রে ঈমানদারের বসবাস আছে সে সমাজে এসব দুর্র্বত্তদের বিরুদ্ধে জিহাদ বা প্রচেষ্টাও থাকে। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা জিহাদ না থাকাটি সে সমাজে অভাবনীয়। জ্বলন্ত আগুণে উত্তাপ থাকবে না সেটি কি ভাবা যায়? ঈমানদারের ঈমান থাকবে অথচ অনৈসলামের বিরুদ্ধে জিহাদ থাকবে না সেটিই কি ভাবা যায়? ন্যায়ের স্থলে অন্যায়-অধর্মকে সয়ে যাওয়ার রীতি নবীজী (সাঃ)র ছিল না, মুসলিম সমাজে আজও সেটি থাকতে পারে না। এটি মুসলমানের মৌলিক দায়িত্ববোধ ও দায়িত্বপালনের বিষয়। এমন দায়িত্ববোধের কারণে প্রতিটি মুসলমান তাই আমৃত্যু সৈনিক। এবং প্রতিটি মুসলিম জনপদই হল সেনানীবাস। আর মসজিদ হল সে সেনানীবাসের হেডকোয়ার্টার। প্রতিটি মসজিদের ইমাম হল স্থানীয় কমান্ডার। একটি মুসলিম দেশের প্রদেশে, বিভাগ, জিলা, থানা, ইউনিয়ন বা গ্রামের মূল নেতা তারাই। খোলাফায়ে রাশেদার আমলে খলিফা, গভর্নর, জেলা ও এলাকার প্রশাসকেরা নিজেরাই সে ইমামের দায়িত্ব পালন করতেন। মুসলিম সৈনিক পায় সেখানে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ। পায় জ্ঞান। পায় শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্ট্রাটেজী ও কমান্ড। পায় তার নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে প্রত্যহ ৫ বার তাগিদ। কোন সৈনিক যদি সেনানীবাসের প্রতিদিনের মহড়ায় হাজিরা না দেয় তাকে কি সৈনিক বলা যায়? বিনা কারণে হাজিরা না দিলে সৈনিক জীবনেরই অবসান ঘটে। কারণ যে ব্যক্তি প্রশিক্ষণেই অনুপস্থিত সে রণাঙ্গণে শত্রুর সম্মুখে দাঁড়াবে কোন বলে? তেমনি অবস্থা মুসলমানেরও। যে ব্যক্তি তার মহল্লার মসজিদে নামাযে হাজির হয় না তাকে কি মুসলমান বলা যায়? হাদীসে তাই বর্নীত হয়েছে, “পর পর তিন দিন যে ব্যক্তি জুময়ার নামাযে অনুপস্থিত থাকে সে ব্যক্তি মুসলমান নয়। সে মুনাফিক।”
প্রতিটি মুসলিম দেশে অধর্ম,অনাচার,অশ্লিলতা ও দুর্বৃত্তি আজ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যেটি নাই সেটি হল জিহাদ। নাই মুসলমানদের মাঝে অন্যায়ের প্রতিরোধ বা উৎখাতের প্রচেষ্ঠা। নেই আল্লাহর আইন শরিয়ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। অথচ মসজিদে ছেয়ে গেছে প্রতিটি মুসলিম জনপদ। সেখানে ৫ বার আযান ও জামায়াতে নামায ঠিকই হচ্ছে।, কিন্তু যেটি হচ্ছে না তা হল নামাযীদের মাঝে আল্লাহ ও তার হুকুমের স্মরণ এবং সে হুকুম-পালনের প্রস্তুতি। নামায হয়েছে যিকরশূণ্য। নামাযীর চেতনা হয়েছে জিহাদে আগ্রহশূণ্য। মসজিদের দেওয়াল ঘেঁষে পাপাচার জমে উঠলেও নামাযীদের মাঝে প্রতিরোধের জজবা জাগে না। দেশের আইন-আদালতে শরিয়তে বিধান পরিত্যক্ত হলেও তা নিয়ে মুসল্লীরা প্রাতিবাদে রাস্তায় নামে না। ইমাম সাহেবের খোতবাও সে বিষয়ে নিশ্চুপ। তিনি ব্যস্ত নবীদের কিসসা শুনাতে। কিন্তু আজকের মুসলমানদের কী করণীয় তা নিয়ে তার ভাবনা নেই। দিক-নির্দেশনা বা হেদায়েতও নেই। কিছু করারও চেষ্টা নেই। বড় জোর জোর দেওয়া হয় বেশী বেশী দোয়া বা তাসবিহ পাঠে। কিন্তু দোয়া ও তাসবিহের বাইরেও নবীজী যে জিহাদে নেমেছেন, বাতিলের উৎখাতে যে অস্ত্র ধরেছেন তা নিয়ে কোন নসিহত নাই। নবীজী(সাঃ)র সূন্নত এভাবেই পদদলিত হচ্ছে মসজিদের মিম্বর থেকে। মুসলমানেরা এক কালে রাজা দাহিরের অধর্ম ঠেকাতে হাজার মাইল দূরের সিন্ধু দেশে ছুটে এসেছিলেন। অথচ মসজিদের ইমাম সাহেব ও তার মুসল্লীরা মহল্লার গলিতে নেমে সূদ-খোর, ঘুষখোর, জিনাকারী, সন্ত্রাসী, শরিয়ত-প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধবাদী দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদদের বাধা দিতে রাজী নন। এমন দুর্বৃত্তদের হাতে মার খেয়ে নবীজী (সাঃ) দাঁত হারিয়েছেন, প্রচন্ড আহত হয়েছেন। হাজার হাজার সাহাবা প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ ধর্মের লেবাসধারীদের এসব ইমাম ও মুসল্লীরা দুর্বৃত্তদের হাতে আঘাত দূরে থাক গালী খেতেও নারাজ। তারা সমাজের দুর্বৃত্তদের কাছে শত্রু হতে চান না। কিন্তু প্রশ্ন হল, ইসলামের স্বঘোষিত শত্রুদের সাথে এমন সম্পৃতির নীতিতে কি মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া যায়? মুসলমানের মূল লক্ষ্য তো শুধু মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া, দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদ, সশস্ত্র সন্ত্রাসী, শরিয়তের বিরুদ্ধবাদী বুদ্ধিজীবীদের কাছে গ্রহনযোগ্য হওয়া নয়।
মসজিদের ইমামতি যখন চাকুরিতে পরিণত হয় তখন সে ইমাম থেকে কি কল্যাণকর কিছু আশা করা যায়? চাকুরি শুধু অর্থমুখিই করে না, মনের গভীরে চাকর-সুলভ দাস মানসিকতাও গড়ে। অথচ ইমামের কাজ তো নেতৃত্বদান। তার দায়িত্ব তো কমান্ডারের। এমন চাকর-সুলভ মানসিকতায় কি নেতৃত্ব বা কমান্ডারের কাজ চলে? হযরত ওমর (আঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ)এর মত মহান সাহাবীদের কোন তেমন ধন-সম্পদ ছিল। ব্যবসা বানিজ্যও ছিল না। সংসার চালাতে তাঁরা মদিনার আনসারদের জমিতে বর্গাচাষ করতেন। অনেক সাহাবী ভেড়া চড়াতেন। কেউবা বা ইহুদীর ঘরে পানি টানতেন। এমন কাজে তাদের সম্মানহানি হয়নি। বরং তাতে স্বনির্ভরতা বেড়েছে। এবং বাড়েনি দাস-মানসিকতা। অথচ আজকের ইমামেরা চাকুরিগিরির চেয়ে সম্মানজনক কোন কাজই খুঁজে পান না। চাকুরী বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে তারা দাসত্ব করছেন মসজিদ কমিটির। এমন চাকুরীজীবী ইমামেরা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রচারের ক্ষেত্রে শুধু নিরবতাই নয়, এমন কি ইসলামের মৌল শিক্ষার বিরুদ্ধাচারণেও রাজী। অথচ নবীজী (সাঃ)র যুগে ইমামতি কোন চাকুরী ছিল না। যে আসনটিতে নবীজী স্বয়ং বসেছেন সে আসনে বসা চাকুরী হয় কি করে? এটি ছিল মহৎ ইবাদত। ছিল নবীজী (সাঃ)র মহান সূন্নত। ছিল আপোষহীন পবিত্র জিহাদ। আর ইবাদতে বা জিহদে তো মূল দায়বদ্ধতা ও জবাবদেহীতা থাকে একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে। মসজিদ কমিটির মেম্বরদের কাছে নয়। কথা হল, পবিত্র ইবাদতকে কি চাকুরীর স্তরে নামানো যায়?নবীজী (সাঃ) আমলে একমাত্র তারাই মসজিদ নির্মান করতেন ও মসজিদের ইমাম বা খাদেম হতেন যারা নিজেরা শরিয়তের পূর্ণ অনুসারি ছিলেন। এবং সে শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠায় তারা আপোষহীন ছিলেন। এবং এ লক্ষ্যে তারা লাগাতর জিহাদ লড়তেও প্রস্তুত ছিলেন।
কিন্তু আজকের যুগে হচ্ছে উল্টোটি। মসজিদ কমিটির সদস্য এমন ব্যক্তি যে ব্যক্তি তার কর্ম জীবনে পদদলিত করছেন শরিয়তের বিধান। অনেকে ঘুষ খাচ্ছেন, সূদ খাচ্ছেন এবং সূদ দিচ্ছেনও। রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা এমন দলের সদস্য যাদের মূল শত্রুতা ইসলামের প্রতিষ্ঠা তথা শরিয়তী বিধানের বিরুদ্ধে। দেশ জুড়ে মসজিদ গড়ে উঠছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা নিছক নামায পড়ার প্রয়োজনে। কোথাও বা সেটি বিশেষ কোন পীর সাহেবের বা মৌলানা সাহেবের নিজস্ব ফেরকা বা মাযহাব বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে, সমাজে বা রাষ্ট্রে ইসলামের বিজয় বা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়। ফলে শুরু থেকে মসজিদে অধিকৃত হয়ে আছে তাদের হাতে যারা ইসলামের চিহ্নিত শত্রু বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় অনাগ্রহী বা অঙ্গিকারহীন। ফলে এমন অধিকৃত মসজিদ সমাজে বা রাষ্ট্রে দ্বীনের বিজয় বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা আনবে কী করে? মসজিদ নিজেই তো শত্রুর অধিকার মূক্ত নয়। ফলে এমন মসজিদের সংখ্যা দশগুণ বা শতগুণ বাড়লেও কি ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা আছে? বাংলাদেশের একটি জেলায় যত মসজিদ আছে খোলাফায়ে রাশেদার সময় সমগ্র মুসলিম জাহানে তা ছিল না। কিন্তু সে মসজিদগুলোই ইসলামের শিক্ষা ও প্রচার বাড়িয়েছিল। বাড়িয়েছিল মুসলমানের বিজয়। শরিয়তির প্রতিষ্ঠাও নিশ্চিত করেছিল। অথচ বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটি। দেশে যতই বাড়ছে মসজিদের সংখ্যা ততই বাড়ছে ইসলামের পরাজয়। তিনশত বছর আগেও বাংলাদেশে শরিয়তী আইনে বিচার হত। অথচ আজ সেটি অপসারিত। ৫০ বছর আগে এত দূর্নীতি ছিল না। অথচ আজ দেশ দূর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ছে। লক্ষ লক্ষ বাতি জ্বেলেও দেশ থেকে যদি অন্ধকার কমানো না যায় তবে সে বাতিগুলোকে কি বাতি বলা যায়? তেমনি দেশে লক্ষ লক্ষ মসজিদ গড়েও যদি ইসলামের বিজয় বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা না যায় তবে সে মসজিদগুলোকে কি বলা যাবে? লন্ডন, ২৫/০৭/১০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018