বাম ষড়যন্ত্র, ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং রাজনীতিতে যুদ্ধাবস্থা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on February 28, 2022
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
রাজনীতিতে নির্মূলের এজেন্ডা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বুঝতে হলে অবশ্যই বুঝতে হবে উপমহাদেশের বাম রাজনীতি -বিশেষ করে কম্যুনিস্টদের রাজনীতি। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থরক্ষার রাজনীতি সব সময় বামদের কাছে ঘৃণীত হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রূপে। শুরু থেকেই মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি গণ্য হয়েছে তাদের কাছে শত্রু রূপে। এমন একটি চেতনার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুসলিমদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনীতি তাদের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন তারা চায়নি, তেমনি দেশটি বেঁচে থাকুক -সেটিও তারা চায়নি। লক্ষণীয় হলো, পাকিস্তানের জন্মকাল থেকেই শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার স্নায়ু যুদ্ধ। সে সময় পাকিস্তান ছিল কম্যুনিজম বিরোধী মার্কিন শিবিরে। ভারত ছিল সোভিয়েত শিবিরে। ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে সোভিয়েত রাশিয়া সব সময়ই ভারতকে সমর্থন করে। তখন সে স্নায়ু যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার এজেন্ডা হয় মার্কিন শিবিরের দেশ পাকিস্তানের ক্ষতি সাধন। এবং সেটি পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে। এ লক্ষ্যে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে গড় উঠে কোয়ালিশন। এবং সে কোয়ালিশনের চুড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্টগণ মেনে চলতো ভারতীয় কম্যুনিস্টদের নির্দেশাবলী। অপর দিকে ভারতীয় কম্যুনিস্টগণ মেনে চলতো সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্টদের নির্দেশাবলী। যে কোন আদর্শের ন্যায় কম্যুনিজমের কোন ভৌগলিক সীমা রেখা ছিল না। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার নীতি, ভারতীয় কম্যুনিস্টদের নীতি ও বাঙালী কম্যুনিস্টদের নীতি একই মোহনায় একাকার হয়ে যায়। পাকিস্তান বেঁচে থাকুক সেটি ভারতীয় রামপন্থীদের ন্যায় বামপন্থীগণ ও বাঙালী ফ্যাসিস্টগণও চাইতো না। ফলে পাকিস্তানের বিভক্তিকরণে বামপন্থী, রামপন্থী ও আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের মধ্য গড়ে উঠে রাজনৈতিক কোয়ালিশন। পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। ফলে সে সময় কম্যুনিস্টগণ যোগ দেয় ভাষানীর প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তথা ন্যাপে। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টগণ সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন –এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। এতে বিভক্ত হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্টগণও। তবে যশোরের আব্দুল হকের পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গার বিষয়ে সকল কম্যুনিস্টগণই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট্দের পার্টনারে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কম্যুনিস্টগণ প্রকাশ্য রাজনীতি আসে। তখন সোভিয়েত রাশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন লাইনের রাজনীতির পথ অনুসরণ করতে থাকে। শেখ মুজিব যেভাবে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র কবর পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা দেয় তার পিছনে ছিল সোভিয়েতপন্থী কম্যুনিস্টদের প্রভাব। মুজিবকে সে বাকশালের পথেই উস্কে দেয় মনি সিংহ’য়ের ন্যায় কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দ। কারণ বহুদলীয় গণতন্ত্রে যেমন রাশিয়ান কম্যুনিস্টদের আগ্রহ ছিল না, তেমনি আগ্রহ ছিল না সোভিয়েত অনুসারী বাঙালী কম্যুনিস্টদেরও। তেমন এক স্বৈরাচারী চেতনার কারণে বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদ ইসলাম কিছু কাল আগে বলেছেন, “হাসিনার বিকল্প নাই্।” লক্ষ্য যখন ইসলামপন্থীদের নির্মূল ও এক দলীয় ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা, নির্মূলমুখী সে রাজনীতিতে হাসিনার ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিকল্প না থাকারই কথা।
যারা ইসলামপন্থী এবং ভারত বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সৃষ্টির পর থেকেই দেয়া হচ্ছে নির্মূলের হুংকার। তেমন এক যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরই। এটিই হলো বাংলাদেশের মাটিতে ভারতসেবী বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্ট রাজনীতির মূল এজেন্ডা। ভারতও সেটিই চায়। নির্মূলের সে ধ্বনিকে তীব্রতর করতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে গণ-আদালত গড়া হয়েছিল। গণ-আদালতে বিচার হয় না, বরং কার্যকর করা হয় বিশেষ একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দাবীকে। তবে নব্বইয়ের দশকে সে এজেন্ডার বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ, তখন ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার সরকার। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার শাসনামলে সে গণ-আদালতকে ঢাকা হাইকোর্টের কক্ষে বসানো হয়। নাম দেয়া হয় মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক আদালত। অথচ এই আদালত কোন মানদন্ডেই আন্তর্জাতিক ছিল না। এ আদালতে বাংলাদেশের বাইরের আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকে কোন বিচারপতি আনা হয়নি। কোন বিদেশী আইনবিদকেও কোন আসামীর পক্ষে মামলা পরিচালনার অধিকার দেয়া হয়নি। বরং গণ-আদালতের কোন কোন বিচারককে এই আদালতের বিচারক রূপেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
তান্ডব নৃশংস ফ্যাসিবাদের
নিরপেক্ষ বিচার ও আদালতে ফ্যাসিস্টদের রুচি থাকে না। তারা বরং আদালতকে ব্যবহার করতে চায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের হাতিয়ার রূপে। হাসিনা যখন ক্ষমতায়, আদালতকে নতজানু হতে বাধ্য করতে গড়ে তোলা হয় শাহবাগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল উদ্যক্তা ছিল বামপন্থী, রামপন্থী ও আওয়ামী রাজনীতির ফ্যাসিস্টগণ। জনসভায় স্লোগান তোলা হয়, “বিচার নয়, ফাঁসি চাই।” বিচার নিয়ে ফ্যাসিস্টদের যে সামান্যতম আগ্রহ থাকে না –এ হলো তারই প্রমাণ। শাহবাগ আন্দলোন সেদিন সফল হয়। কারণ, যে আন্দোলন গড়ে তোলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে সে দিন সফল হতে বাধা কোথায়? এরই ফলে বিচারকগণ ফ্যাসিস্টদের কাছে নতি শিকারে বাধ্য হয়। ফলে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায় ফাঁসিতে রূপান্তরিত হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কখনোই নির্মূলের রাজনীতি চলে না, সে জন্য চাই ফ্যাসিবাদ। তখন পুলিশ, আদালত, দলীয় গুন্ডা বাহিনী ও সেনা বাহিনীকে নির্মূলের কাজে যথেচ্ছাচারে ব্যবহার করা যায়। তাই গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো হয় এবং প্রতিষ্ঠা দেয়া হয় নিরেট ফ্যাসিবাদকে। এরই ফলে শাপলা চত্বরের গণহত্যা, গুম, অপহরন, ক্রসফায়ারে হত্যা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন ও বিচারের নামে ফাঁসি বাংলাদেশে রাজনীতির আচারে পরিণত হয়। ভারত গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু তারা পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী বাকশালীদের এই ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে নির্মূলের হুংকার এখন ক্ষমতাসীন বাকশালী কর্তাব্যক্তিদের মুখে মুখে। মশামাছি নির্মূলের ন্যায় প্রতিপক্ষ নির্মূলে নেমেছে সরকারের পুলিশ, RAB ও সরকারি দলের ক্যাডারদের। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও বিজিবি’কেও ময়দানে নামানো হচ্ছে। সভ্য রাজনীতির নিজস্ব কিছু ভদ্র রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি থাকে। কিন্তু সে ভদ্রতা, সভ্যতা ও ন্যায়নীতির রাজনীতি বাংলাদেশে বেঁচে নাই। কারণ ফ্যাসিবাদী শাসনে এগুলি বাঁচে না। তবে রাজনীতিতে নির্মূলের এ ধারাটি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, বরং পরিকল্পিত ভাবে সেটি গড়ে তোলা হয়েছে। সেটি বাংলাদেশের জন্মের প্রথম দিন থেকেই। এমন আত্মঘাতী নীতি প্রতি দেশেই আনে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ। বাংলাদেশ তেমন একটি আত্মঘাতী যুদ্ধের মধ্য ময়দানে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী বাকশালীদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে রাজপথে বিপুল সেনা সদস্য নামে। চারি দিকে গুলী বর্ষিত হয়, বোমা পড়ে, গাড়ি-বাড়ী জ্বলে এবং শত শত মানুষ লাশ হয়। বহু মানুষ গুমও হয়। তেমন একটি চিত্র দেখা গেছে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। যুদ্ধাবস্থায় মানুষ খুন হয়, কিন্তু কারো বিচার হয় না। বাংলাদেশেও তাই বিচার হয় না। শাপলা চত্বরে যে শত শত মানুষ নিহত হলো তাদের কেউই বিচার পায়নি। অসংখ্য অপরাধ হয়েছে, কিন্তু কারোই কোন শাস্তি হয়নি। ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য: অপরাধ ঘটানো, বিচার করা নয়। নির্মূলমুখী এ রাজনীতির জনক শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বে গড়ে উঠা আওয়ামী-বাকশালী ফ্যাসিস্ট শক্তি। এরূপ ঘাতক রাজনীতির পিছনে যেমন বিপুল বিদেশী বিনিয়োগ আছে, তেমনি দেশধ্বংসের পরিকল্পনাও আছে। লক্ষ্য, বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত করা।
বিজয় ভারতের
বিশ্বের দুই শতাধিক রাষ্ট্রের মাঝে সবচেয়ে বেশী দরিদ্র মানুষের বাস ভারতে। অথচ ভারত হলো সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা। গড়ে তুলেছে আনবিক বোমা, বোমারু বিমান ও মিজাইলের বিশাল ভান্ডার। এ বিশাল অস্ত্র ভান্ডার দিয়ে কি ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? সে সামর্থ্য কি ভারতের আছে? বরং উক্ত দেশগুলোর সাথে ভারত বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বাড়াতে ব্যস্ত। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উষ্ণ ভারত সফর এবং প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরের মধ্য দিয়ে তো সেটিই ধরা পড়ে। ভারত তারা সীমাবদ্ধতা বুঝে। বিশ্বজয়ের বদলে দেশটি দক্ষিণ এশিয়া জয়ে দৃষ্টি দিয়েছে। লক্ষ্য, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালের ন্যায় প্রতিবেশী দেশগুলোকে নতজানু রাখা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বুকে একমাত্র শক্তি রূপে নিজের আধিপত্য বহাল রাখা। তবে পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালের ন্যায় দেশে ভারত সফলতা না পেলেও বাংলাদেশে তার বিজয়টি বিশাল।
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতিকে বুঝতে হলে ভারতের বিদেশ নীতির মূল দর্শনটি বুঝতে হবে। ভারতের বিদেশ নীতি পরিচালিত হয় প্রাচীন ভারতীয় পন্ডিত চানক্যের নীতিতে। সে নীতির মূল কথা: প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুই রকমের। হয় সেটি শক্তিশালী শত্রুদেশ হবে, নতুবা দাস বা আশ্রীত রাষ্ট্র হবে। এছাড়া তৃতীয় ধরণের কোন প্রতিবেশী দেশ হতে পারে না। ভারত তাই পাকিস্তানকে শত্রু মনে করে এবং বাংলাদেশ হলো তাদের কাছে দাস বা আশ্রীত রাষ্ট্র। ভারত চায়, বাংলাদেশ একটি ভারত-অনুগত দাস রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে বেঁচে থাকুক। পাকিস্তানের ন্যায় শক্তিশালী আরেকটি প্রতিদ্বন্দী দেশে পরিণত হোক -ভারত কখনোই সেটি হতে দিবে না। বাংলাদেশের প্রতি এটিই ভারতের পররাষ্ট্র নীতি।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে ভারতের ব্যবহৃত অস্ত্রটি ঘাতক যুদ্ধাস্ত্র নয়। বরং সেটি হলো রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অস্ত্র। সামরিক অস্ত্রে ভারত পাকিস্তানকে ১৯৪৮ সাল এবং ১৯৬৫ সালে পরাজিত করতে পারিনি। কিন্তু রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অস্ত্রে পাকিস্তানকে একাত্তরে নতজানু করে ফেলে। পাকিস্তানের ১৯৬৫য়ের যুদ্ধে বিজয় না পাওয়ার পর ভারত শেখ মুজিব ও লেন্দুপ দর্জি (সিকিমের ভারতপন্থী নেতা)’র ন্যায় তাঁবেদার নেতা ও শত শত পদসেবী বুদ্ধিজীবী প্রতিপালনে মনযোগী হয়। শুরু করে আগরতলা ষড়যন্ত্রের ন্যায় নানারূপ ষড়যন্ত্র। এমন চানক্য নীতির ফলে ভারত পায় বিশাল সফলতা। ভারতের অর্থক্ষয় এবং রক্তক্ষয়ও এতে কমেছে। এ নীতিতে ভারত যেমন সিকিমকে বিনা রক্তব্যয়ে ভারতভূক্ত করতে পেরেছে, তেমনি বাংলাদেশকে একটি নতজানু আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পেরেছে। তাজুদ্দীনকে দিয়ে ৭ দফা এবং শেখ মুজিবকে দিয়ে ২৫ সালা দাসচুক্তিও স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু ভারতের বিপদ অন্যত্র। কারণ, বাংলাদেশের ১৬ কোটি নাগরিকের সবাই মুজিব বা তাজুদ্দীন নয়, লেন্দুপ দর্জিও নয়। যে চেতনা নিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে স্বাধীন পাকিস্তান বানিয়েছিল সে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশেও তারা স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চায়। ভারতের কাছে এমন স্বাধীনতার চেতনা অসহ্য। এমন স্বাধীনতা দিতে ভারত ১৯৭১’য়ে ভারত যুদ্ধ করেনি। ভারত চায় বাংলাদেশীরা মুজিব, তাজুদ্দীন ও লেন্দুপ দর্জির ন্যায় ভারতরে পদসেবী চেতনা নিয়ে বাঁচুক। এবং দূরে সরে আসুক প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনা থেকে। ইসলামশূণ্য এরূপ ভারতমুখী চেতনাকেই তারা বলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এরূপ চেতনার যারা বিরোধী, ভারতের কাছে তারা ভারতবিরোধীও। তারা চিত্রিত হচ্ছে ইসলামী সন্ত্রাসী রূপেও। ভারত তাই তাদের নির্মূল করতে চায়। নির্মূলের এ কাজে ভারত শুধু আওয়ামী লীগকেই নয়, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশি বাহিনী, RAB, বিজিবিকেও পার্টনার রূপে পেতে যায়। সেনাবাহিনীকে সে কাজের উপযোগী করতেই ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ও বিজিবি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হয়েছে হিন্দুদের। ভারত বিরোধীদের নির্মূলে ভারতে অর্থে প্রতিপালিত সেবাদাসেরা তো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বানিয়ে সত্তরের দশক থেকেই তৎপর। এরাই গণআদালত বসিয়েছে, জনতার মঞ্চ গড়েছে এবং আজ গণআদালতের মডেলে ঢাকার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ফাঁসিদানের প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে। মুজিব ও তাজুদ্দীন তো এরূপ নির্মূল কাজে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তুরে অনুপ্রবেশের অধিকার দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ভারতপন্থী নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মুখে আজও যেরূপ দিবারাত্র নির্মূলের হুংকার –সেটি তো ভারতের অর্থ, প্রশ্রয় ও উস্কানিতেই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত হওয়ার পূর্বে পাকিস্তানের ২৩ বছরে এমন নির্মূলের রাজনীতি কি দেশটিতে কোনকালেও ছিল? অথচ তখনও নানা দল ছিল, নানা মত ছিল। এবং রাজনীতিতে ক্ষমতাদখলের তীব্র প্রতিযোগিতাও ছিল। বাংলাদেশে আজ যে যুদ্ধাবস্থা তার মূলে যে ভারত -তা নিয়ে কি তাই সন্দেহ চলে?
ভারতীয় নাশকতা
১৬ কোটি মানুষই একটি দেশের এক বিশাল শক্তি। বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের ভয় এখানেই। ভারত চায় না এ বিশাল জনশক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হোক। আল্লাহতায়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তেল, গ্যাস বা সোনা-রূপা নয়। তা হলো মানুষ। বাঙালী মুসলিমের এ বিশাল জনশক্তিই হিন্দু ও ব্রিটিশ –এ দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে অখন্ড ভারত ভূমিকে ভেঙ্গেছিল এবং পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। ভারতের যত অস্ত্রবল বা অর্থবলই থাকুক, ১৬ কোটি মানুষকে হত্যা করার সামর্থ্য রাখে না। কিন্তু সামর্থ্য রাখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ধ্বংসকে করার। তাই ১৯৭১’য়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অধিকৃত করার পর ভারতের মূল কাজ হয় বাংলাদেশের অবকাঠামো ধ্বংস করা। এ কাজে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পদসেবী দালাল শ্রেণীও পেয়েছিল। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত লুন্ঠন শুধু পাকিস্তানের ফেলা যাওয়া অস্ত্র লুন্ঠনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ব্যাংক, সরকারি ভবন, সরকারি বাসভবন, সামরিক ও বেসামরিক যানবাহন এবং কলকারখানাও সে লুন্ঠন থেকে রেহাই পায়নি। লুন্ঠনে লুন্ঠনে দেশটিকে ভারত ও তার নওকর বাহিনী দ্রুত ভিক্ষার তলাহীন পাত্রে পরিণত করে এবং ডেকে আনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। একমাত্র ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমল ছাড়া সুজলা-সুফলা এ উর্বর দেশে এমন দুর্ভিক্ষ আর কোন কালেই আসেনি। ২৩ বছরের পাকিস্তানে ২ বার যুদ্ধ এসেছে, তখনও দুর্ভিক্ষ আসেনি।
মুজিবামলে ভারতসেবীরা এক দেশ, এক দল ও এক নেতার শ্লোগান দিয়ে ভারতবিরোধী নেতাকর্মীদের নির্মূলের মহাযজ্ঞে নামে। অন্য দল ও অন্য মতের লোকদের রাজনীতি দূরে থাক, তাদের বাঁচার অধিকার দিতেও তারা রাজী হয়নি। প্রতিপক্ষ নির্মূলের প্রয়োজনে তখন গড়ে উঠে বিশাল রক্ষি বাহিনী। মুজিবের গড়া এ ঘাতক বাহিনীটি ৩০ হাজারের বেশী মানুষকে মৃত্যুর ওপারে পৌঁছে দেয়। আর প্রতিটি হত্যাই তো গভীর ঘৃণার জন্ম দেয়। জন্ম দেয় প্রচন্ড প্রতিশোধ-পরায়নতা। তখন কি বাঁচে সৌহার্দ সম্পৃতির রাজনীতি। অর্থনীতির ভাষায় সমাজের এরূপ সৌহার্দসম্পৃতির পরিবেশ হলো গুরুত্বপূণূ সামাজিক পুঁজি বা সোসাল ক্যাপিটাল। এ সোসাল ক্যাপিটাল যেমন গণতান্ত্রের চর্চায় জরুরি, তেমনি জরুরি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নগদ পুঁজির চেয়ে এরূপ সোসাল ক্যাপিটালের গুরুত্ব অধিক। হত্যার রাজনীতিতে সে পুঁজি সৃষ্টি হয় না। নগদ অর্থের পুঁজি এমন নিরাপত্তাহীন পরিবেশে হয় বেকার পড়ে থাকে, অথবা দেশ ত্যাগ করে। মুজিবের নির্মূলের রাজনীতি তাই শুধু বহুদলীয় রাজনীতিতেই শুধু নয়, অর্থনীতিতেও দ্রুত মড়ক আনে।
বাংলাদেশের রাজনীতি বিগত ৫০ বছরে একটুও সামনে এগোয়নি। বরং পিছিয়েছে দীর্ঘ পথ। রাজনীতি পরিণত হয়েছে দেশধ্বংস, সংস্কৃতি ধ্বংস, হত্যা ও গুমের হাতিয়ারে। এ অভিন্ন দেশেই ৬০ বছর আগে ১৯৫৪ সালে একটি দলীয় সরকারের অধীনে যেরূপ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হয়েছিল, সেরূপ নির্বাচনের কথা এখন ভাবাই যায় না। দেশ পিছিনে ফিরে গেছে ৪০ বছর পুরনো বাকশালী স্বৈর শাসনের দিকে। মুজিবের রক্ষি বাহিনীর স্থানটি নিয়েছে সেনা সদস্যদের নিয়ে গড়া RAB। তবে প্রতিপক্ষ নির্মূলে রক্ষি বাহিনীর ন্যায় RAB একাকী নয়। RAB’য়ের পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী এবং সরকারী দলের ঘাতকগণ। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রাজনীতিতে নানা মত, নানা পথ ও নানা বিশ্বাসের বিচিত্র লোক থাকে। তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলও থাকে। সবার জন্য স্থান করে দেয়াটিই সভ্য রাজনীতির নীতি। এমন রাজনীতি একই অঙ্গণে নিজের বাঁচার সাথে সাথে অন্যের বাঁচাকেও সুনিশ্চিত করে। রাজনীতি এভাবেই জনগণের মাঝে সংহতি ও সম্পৃতি আনে। ফলে গোত্র, ভাষা, বর্ণ ও দলের পরিচয়ে অতীতে যেরূপ রক্তাত্ব হানাহানি হতো, সে রূপ হানাহানি এখন কোন সভ্য দেশে হয় না। বরং নানা গোত্র, নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা দল ও নানা অঞ্চলের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশাল বিশাল রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমত গবেষণা হয়, বিভক্তির সুত্র গুলো খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলির ভিত্তিতে কীরূপে নির্মূলমুখী যুদ্ধ শুরু করা যায় -তা নিয়ে।
হারাম রাজনীতি ও হালাল রাজনীতি
মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি শুধু হারাম পানাহার, হারাম উপার্জন ও হারাম কর্ম থেকে বাঁচা নয়, বরং অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো হারাম রাজনীতি থেকে বাঁচা। নইলে দেশ অসভ্য ও নৃশংস পাপাচারে পূর্ণ হয়। প্লাবন আসে দুর্বৃত্তির। তখন স্বার্থ শিকারী ক্ষুদ্র মনের সাথে দেশের মানচিত্রও ছোট হতে থাকে। চেতনার সে ক্ষুদ্র মানচিত্রে অন্যদের জন্য কোন স্থান থাকে না। বিশাল মুসলিম উম্মাহ আজ যেরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ও শক্তিহীন -তা তো এরূপ অসভ্য ও আত্মঘাতী চেতনার কারণেই। দেশ তখন রক্তাত্ব হয়। বাংলাদেশে এটিই একাত্তরের চেতনা। অথচ রাজনীতিতে যখন সুসভ্য দর্শন থাকে, তখন রাজনীতিতেও শক্তি আসে। তখন বিভেদের বদলে সংহতি গড়ে উঠে। সে সভ্য নীতির কারণেই পৃথিবীর বুকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র গড়তে কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহকে লগি, বৈঠার রাজনীতিতে নামতে হয়নি। শত্রুশক্তির দেয়া অস্ত্র কাঁধে নিয়ে একাত্তরের ন্যায় কোন যুদ্ধ করতে হয়নি। তাঁকে রক্ষিবাহিনী বা RAB গড়ে প্রতিপক্ষ নির্মূলেও নামতে হয়নি।
সভ্য রাজনীতির নীতি হলো,“নিজে বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচতে দাও”। জিন্নাহর সে সভ্য ও ভদ্র রাজনীতিতে বাংলার ফজলুল হক, নাজিমুদ্দীন, সহরোয়ার্দি যেমন স্থান পেয়েছিলেন, তেমনি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের শত শত মুসলিম নেতাকর্মীও স্থান পেয়েছিলেন। সেখানে কারো ভাষা বা গায়ের রঙ দেখা হয়নি। রাজনীতি এরূপ সভ্য ও ভদ্র নীতি প্রতিষ্ঠা না পেলে কারো বাঁচাটাই নিরাপদ হয়না। জিন্নাহর রাজনীতিতে শুধু যে জিন্নাহ বেঁচে ছিলেন তা নয়, বাংলার ফজলুল হক, নাজিমুদ্দীন, সোহরাওয়ার্দীও বেঁচেছিলেন। তাদের কাউকে কারারুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে হয়নি বা গুমও হতে হয়নি। কিন্তু মুজিবের রাজনীতির সবটুকু জুড়ে শুধু মুজিব নিজে ও মুজিববন্দনা। তার রাজনীতিতে মুসলিম লীগের বন্দী নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী যেমন বাঁচেননি, তেমনি সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদারও বাঁচেননি। এমন কি মুজিব নিজেও বাঁচেনি। মুজিবের মৃত্যুতে বরং খুশির বন্যা বয়েছিল আওয়ামী লীগের বহু প্রথম সারির নেতাদের মনেও। মুজিবের লাশ সিঁড়িতে ফেলে প্রচন্ড খুশি নিয়েই তারা খোন্দকার মুশতাকের মন্ত্রীসভাতে যোগ দিয়েছেন। সে খুশিটি ধরা পড়ে আওয়ামী লীগের মুজিবপরবর্তী সভাপতি আব্দুল মালেক উকিলের ঘোষণাতে। তিনি বলেছিলেন “ফিরাউনের মৃত্যু হয়েছে”।
রাজনীতি মূলত দুই প্রকার। দুর্বৃত্ত ডাকাতদের ক্ষমতাদখলের রাজনীতি। এ রাজনীতি হারাম। এবং দুর্বৃত্তদের নির্মূল, সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং আদালতে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন চালু করার রাজনীতি। এ রাজনীতি শুধু হালালই নয়, বরং প্রতিটি ঈমানদারের উপর এটি ফরজ। ইসলামে এটি পবিত্র জিহাদ। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহবাগণ এই জিহাদী রাজনীতিকে বিজয়ী করতে নিজেদের জান ও মালের বিশাল কুর’বানী পেশ করেছেন। অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই জিহাদের রাজনীতিতে লোকবল নাই। দেশের উপর পুরা দখলদারিটা এখন অসভ্য, নৃশংস ও স্বৈরাচারী ভোটডাকাতদের রাজনীতির। এমন অসভ্য ও নৃশংস রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ মিছিল ও জনসভার সুযোগ থাকে না। স্বাধীন মতপ্রকাশ ও নিরপেক্ষ পত্র-পত্রিকা বলেও কিছু থাকে না। রুচি থাকে না আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার নিষ্পত্তির। এমন রাজনীতিতে যা প্রবলতর হয় তা হলো প্রতিপক্ষ নির্মূলের সহিংসতা। তখন লাশ পড়ে রাজপথে, গৃহে ও অফিস-আদালতে। মানুষ তখন গুম হয়, অত্যাচারিত হয়, ফাঁসিতে ঝুলে এবং বস্তাবন্দী লাশ হয়ে নদিতে বা ডোবার পানিতে পচা দুর্গন্ধ নিয়ে ভেসে উঠে। হারিয়ে যাওয়াদের খুঁজে বের করার বদলে পুলিশের ব্যস্ততা বাড়ে গুম, খুন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদে মিছিলে নামে তাদের জেলে তোলায়। সরকার প্রধানও তখন মৃতদের নিয়ে মস্করা করে। সেটি যেমন শেখ মুজিব করেছিল, এখন তেমনটি শেখ হাসিনাও করছে। এমন অসভ্য রাজনীতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রাজনীতির অধিকার দূরে থাক, বাঁচার অধিকারটুকুও দেয়া হয় না। তাদের বিরুদ্ধে তখন শুরু হয় নির্মম নির্মূল অভিযান।
বাংলাদেশের জন্ম থেকেই সংঘাতের রাজনীতিকে তীব্রতর করা হয়েছে; এবং সেটি স্বৈরাচারী শাসক দলের পক্ষ থেকে। রাজনীতির ময়দান থেকে সকল প্রতিদ্বন্দীদের বের করে দিয়ে সমগ্র মাঠ জুড়ে মুজিব একা খেলেছে। সারা মাঠে অন্য কোন দলের খেলোয়ার ছিল না, গোলরক্ষক ছিল না, কোন রিফারিও ছিল না। হঠাৎ বল হাতে পেলে অবুঝ শিশু যেমন ঠাউর করতে পারে না হাত দিয়ে খেলবে পা দিয়ে না খেলবে, তেমন একটি অবস্থা হয়েছিল শেখ মুজিবের। ক্ষমতা হাতে পেয়ে অতিশয় উদভ্রান্ত হয়েছিল মুজিব। তাই কখনো খেলেছে প্রধানমন্ত্রী রূপে, কখনো বা প্রেসিডেন্ট রূপে। খেলার রুলটিও ছিল তার নিজের তৈরী, রিফারির দায়িত্বটাও ছিল তার নিজ হাতে। ফলে মনের খুশিতে মুজিব যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে গোল দিয়েছে। বিজয় সবসময়ই ছিল তার নিজের। বার বার পেনাল্টি করলেও তাকে শাস্তি দেয়ার লোক ছিল না। সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে কোথায় আজ সিরাজ সিকদার বললেও তাকে লাল কার্ড দেখানোর লোক ছিল না। রাজনীতির এমন এক প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের অবদানটি যে কোন বিচারেই ছিল বিশাল। রাজনীতির অঙ্গণে তিনিই প্রথম সকল দলের জন্যই স্থান করে দেন। শুধু মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী নয়, এমন কি মুজিবের হাতে দাফনকৃত আওয়ামী লীগও সেদিন কবর থেকে বেরিয়ে স্বনামে রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিল।
ধাবিত করা হচেছ যুদ্ধের পথে
শেখ মুজিব মারা গেলেও প্রতিপক্ষ নির্মূলের অসভ্য ও নৃশংস রাজনীতি আজও বেঁচে আছে। বরং নির্মূলের সে রাজনীতিকে শেখ হাসিনা মুজিবের চেয়েও অধিক সহিংস ও রক্তাত্ব করেছে। তাই গুম ও হত্যা এখন মামূলী ব্যাপার। প্রতিপক্ষ নির্মূলের কাজকে তীব্রতর করতে শেখ হাসিনা শুধু যে নিজ দলের গুন্ডাদের ব্যবহার করছে তা নয়, ব্যবহার করছে দেশবাসীর রাজস্বে পালিত পুলিশ, RAB, বিজিবি এবং সেনাবাহিনীকেও। রাজনৈতিক শত্রুদের হত্যাকে জায়েজ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে শৃঙ্খলিত আদালত। প্রণীত হচ্ছে নতুন আইন। ভদ্র্র, সভ্য ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতির অপরিহার্য উপকরণ হলো দল গড়া, সভাসমিতি করা, মিছিল করা, পত্র-পত্রিকা ও টিভিতে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।
সভ্য রাজনীতির আরো রীতি হলো নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের স্বাধীনতা। রাজনীতির শান্তিপূর্ণ পট পরিবর্তনের এটিই তো একমাত্র পথ। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকদের কাছে ক্ষমতার পট পরিবর্তনটাই অসহ্য। তার তো চায় আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে। তাদের কাছে অসহ্য তাই নির্বাচন। তাই ক্ষমতার পট পরিবর্তন যেমন শেখ মুজিব চায়নি, তেমনি শেখ হাসিনাও চায় না। ফলে হামলা হয় তখন জনগণের দল গড়া, সভাসমিতি করা, মিছিল করা, পত্র-পত্রিকা ও টিভিতে মতামত প্রকাশের ন্যায় মৌলিক স্বাধীনতার উপর। তখন বন্ধ করা হয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের রীতি। অথচ এরূপ স্বাধীনতা না থাকাটাই পরাধীনতা। এবং এরূপ পরাধীনতাই বড় অসভ্যতা। বাংলাদেশের জনগণ আজ সে পরাধীনতা ও অসভ্যতার শিকার। এবং আওয়ামী লীগ পরিণত হয়েছে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিতে। সভাসমিতি ও মিছিলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে সরকার বিরোধী দলগুলোকে বাধ্য হয় অবরোধ ও হরতালের রাজনীতি বেছে নিতে। তবে অবরোধ ও হরতালের রাজনীতিকেও সরকার এখন অসম্ভব করেছে। অথচ শান্তিপূর্ণ রাজনীতির এটিই সর্বশেষ ধাপ। এরপর যা বাঁকি থাকে সেটি শান্তিপূর্ণ রাজনীতির পথ নয়, সেটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পথ। বাংলাদেশের জনগণকে আজ সেদিকেই ধাবিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
লিগ্যাসি একাত্তরের
বাংলাদেশের বুকে সহিংস সংঘাতের শুরু হঠাৎ হয়নি। এরও দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এর কারণ বুঝতে হলে অবশ্যই মুজিব ও তার অনুসারিদের ভারতসেবী রাজনীতিকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভারতের লক্ষ্য ও তার ভূ-রাজনীতিকে। বাংলাদেশে সহিংস রাজনীতির মূলে ভারত। এ যুদ্ধের শুরু স্রেফ একাত্তর থেকে নয়,বরং ১৯৪৭ থেকেই। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা চায়নি। ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রুখতে ব্যর্থ হয়ে ভারতের স্ট্রাটেজী হয় অখন্ড পাকিস্তানের বেঁচে থাকাকে অসম্ভব করা। পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার লক্ষ্যে যে কোন যুদ্ধ ভারত নিজ খরচে ও নিজ সেনা বাহিনী দিয়ে লড়বার জন্য ১৯৪৭ থেকেই প্রস্তুত ছিল। ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে শেখ মুজিব ও তার অনুসারীগণ ছিল ভারতের সেবাদাস সৈনিক মাত্র। শেখ মুজিব যুদ্ধের ঘোষণা দিবে – সে ঘোষণার জন্য ভারত অপেক্ষায় বসে ছিল না। নিজেদের যুদ্ধ তারা নিজেরাই শুরু করেছে। তবে ভারতে সে যুদ্ধটি স্রেফ পাকিস্তান ধ্বংসের লক্ষ্যে ছিল না, ছিল বাংলাদেশের বুকে ইসলামপন্থীদের নির্মূলের লক্ষ্যেও। লক্ষ্য স্রেফ পাকিস্তানকে খন্ডিত করা হলে ১৯৭১’য়ে যুদ্ধ জয়ের পর বাংলাদেশে ভারতসেবীদের মুখে নির্মূলের রাজনীতি বহাল থাকার কথা নয়।
তাছাড়া যুদ্ধ একবার শুরু হলে সেটি কি সহজ্জে শেষ হয়? আফগানিস্তের যুদ্ধ ৪০ বছরেও শেষ হয়নি। ইরাকের যুদ্ধ না থেমে বরং সে যুদ্ধ সিরিয়াকেও গ্রাস করেছে। মার্কিনীদের শুরু করা কোন যুদ্ধই এখন থামার নাম নিচ্ছে না। বাংলাদেশের বুকে একাত্তরের যুদ্ধও শেষ হয়নি। বরং রাজনীতির নামে আজ যে যুদ্ধাবস্থা সেটি মূলতঃ একাত্তরেরই লিগ্যাসি। একাত্তরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরাপুরি দখলদারি প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের। আজকের যুদ্ধটির মূল লক্ষ্য তো সে ভারতীয় দখলদারিকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখার। এবং সে জন্য আওয়ামী বাকশালীদের ক্ষমতায় রাখা ভারতের কাছে এতো জরুরি। আর নিয়েত যুদ্ধের হলে সমস্যার শান্তিপূণ সমাধান কি তখন সম্ভব? তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার ফিরে আসছে একাত্তর। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের চেতনায় তাদের বিরোধীদের বাঁচাটি গুরুত্ব পায়নি। তাদেরকে যেমন একাত্তরে হত্যা করেছে, তেমনি এখনো হত্যা করতে চায়। এজন্যই তাদের রাজনীতিতে নির্মূলের সুর। তাদের কাছে যা গুরুত্ব পায় তা হলো একমাত্র নিজেদের বাঁচাটি। সেরূপ বাঁচার স্বার্থে তারা ভারতের লাগাতর সাহায্য চায়। ভারতের সাহায্য ছাড়া তারা যে বাঁচতে পারে না -সেটি তারা বুঝে।
আওয়ামী বাকশালীদের ন্যায় ভারতও চায় না বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা বেঁচে থাকুক। ইসলামপন্থীদেরকে তারা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। ভারতের খায়েশ পূরণে মুজিব তাই শাসনক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্রই সকল ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ করে। অথচ ১৯৭০’য়ের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা ছিল না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলদারী প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই মুজিবের রাজনীতিই পাল্টে যায়। হাজার হাজার ইসলামপন্থী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়,এবং জীবিতদের জেলে তোলা হয়। একাত্তরের পূর্বে গণতন্ত্র, স্বায়ত্বশাসন ও বাক স্বাধীনতার নামে শেখ মুজিব যা কিছু জনসম্মুখে বলেছিলেন -তা ছিল অভিনয় মাত্র। তাঁর স্বৈরাচারী আসল রূপটি প্রকাশ পায় নির্বাচনী বিজয়ের পর। সে রূপটি ছিল এক নৃশংস স্বৈর শাসকের। সে অভিন্ন স্বৈরাচার নিয়ে শেখ হাসিনা আজ ক্ষমতাসীন এবং সেটি তার পিতার অপূর্ণ ধারাকে পূর্ণতা দিতে। ভারত মুজিবকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু এবার বদ্ধপরিকর হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কারণ, হাসিনা বাঁচলেই বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় স্বার্থ বাঁচানোর রাজনীতি বাঁচবে।
চক্রান্ত নব্য মালাউনদের
কাফেরদের কাফের বলা যেমন মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত, তেমনি সূন্নত হলো মালাউনকে মালাউন বলা। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার এ সূন্নত পালনে আজকের মুসলিমদের মাঝে আগ্রহ নাই। এমন কি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফেরদের কাফের বলতে যেমন তারা রাজি নয়, তেমনি রাজি নয় ষড়যন্ত্রকারী মালাউনদেরও মালাউন বলতে। তারা ভাবে, এ বিষয়ে বিচারের কাজ একমাত্র আল্লাহতায়ালার। প্রশ্ন হলো, কে কাফের আর কে মুসলিম, কে শত্রু আর কে মিত্র –সে বিচারে সামর্থ্য না থাকলে ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে সে জিহাদ লড়বে কীরূপে? কীরূপেই বা বাঁচবে করবে কাফের দলের পক্ষ নেয়া থেকে? সে কি তবে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ওহীর অপেক্ষায় বসে থাকবে? প্রতিটি ঈমানদারের মৌলিক দায়িত্ব হলো, কুর’আন ও হাদীসের আলোকে কে কাফের এবং কে ঈমানদার সেটি চেনার সে সামর্থ্যটি সে অর্জন করবে। নইলে অসম্ভব হয় সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা। সে ন্যূনতম সামর্থ্যটুকু না থাকার কারণেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জেনারেল ওসমানীর ন্যায় হাজার হাজার মুসলিম যোগ দিয়েছে ব্রিটিশ কাফেরদের ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর সৈনিক রূপে। অথচ এদের প্রথম জন হলেন জাতীয় কবি, দ্বিতীয় জন হলেন জাতীয় বীর। তাদেরই ঈমানের সামর্থ্যই যখন এরূপ, সাধারণ বাঙালী মুসলিমদের সামর্থ্য যে কীরূপ তা বুঝতে কি বাঁকি থাকে? অথচ মুসলিমকে তো ইসলামের পক্ষে আমৃত্যু জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়। তাই তাকে শুধু বাঘ-ভালুককে চিনলে চলে না, তাকে যুদ্ধাংদেহী কাফের ও মালাউনদেরও চিনতে হয়। তবে মুসলিমদের ঈমানের দুর্বলতা কি শুধু এতে? ভারতের হিন্দুগণ তাদের গো-দেবতাকে বাঁচাতে যতটা কট্টর ও আপোষহীন, মুসলিমগণ কি আল্লাহর দ্বীন বাঁচাতে তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠায় এতটা আপোষহীন? এরূপ দুর্বল কান্ডজ্ঞান ও ঈমান নিয়ে জান্নাত জুটবে?
মাবন জাতির ইতিহাসে যত দুর্যোগ ও যত রক্তপাত তার জন্য কি শুধু স্বৈরাচারী ফিরাউন ও নমরুদেরা দায়ী? দায়ী দরবারের মালাউনগণও। মালাউন শব্দটি পবিত্র কুর’আনের পরিভাষা। মালাউনদের একটি কদর্য ইতিহাস আছে। মালাউন হলো তারাই যারা জালেম শাসকের সভাষদ বা সাহায্যকারী। ফিরাউনের দরবারে এমন মালাউন ছিল হামান ও কারুন। পবিত্র কুর’আনে এদের নামের উল্লেখ আছে। নমরুদ-ফিরাউনের পক্ষে মালাউনগণই রণাঙ্গনে নেমেছে। মানব-ইতিহাসের প্রতি পর্বেই এরা আবির্ভূত হয়েছে স্বার্থপর, নৃশংস ও দুর্বৃত্ত চরিত্রের জীব রূপে। তাদের থাকে রাজনৈতিক অভিলাষ। তবে সে অভিলাষ পূরণে তাদের থাকে না নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য। ফলে প্রতি যুগেই এসব মালাউনগণ নমরুদ ও ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় বাস করা ও তাদের সেবাদাস হওয়ার সুযোগ খোঁজে। হযরত মূসা (আ:)’র যুগে এরাই ফিরাউনের দরবারে ভিড় করেছিল; এবং ফিরাউনকে ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সে সাথে হযরত মূসা (আ:) ও তাঁর অনুসারিদের হত্যাযোগ্য রূপে চিত্রিত করেছিল। হযরত মূসা (আ:) ও তার অনুসারিদের নির্মূলে তারাই ফিরাউনের বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছে। ভারতের বুকে যখন ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসন চেপে বসে তখন তাদের মালাউন ছিল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। তখন ভারত জুড়ে দুই শ্রেণীর বাবু ছিল। এক). গোরা বাবু; দুই). বাঙালী বাবু। বাংলাদেশেও স্বৈরাচারী শাসকদের দরবার সবসময়ই পূর্ণ হয়েছে এরূপ কুচক্রি মালাউনদের দিয়ে। মুজিবের পাশে সে মালাউন ছিল বামপন্থী ও রামপন্থীরা। রক্তাত্ব সংঘাত ও দুর্বৃত্তির কারণ শুধু স্বৈরাচারী শাসকগণ নয়, বরং এ মালাউনগনও। পবিত্র কুর’আনে এজন্যই তাদের বিশেষ উল্লেখ।
এই মালাউনগণ ফিরাউনকে যেমন ভগবানের আসনে বসিয়েছে, তেমনি মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্র হত্যাকারী এক নৃশংস ফ্যাসিস্টকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী আখ্যায়ীত করে উপাস্যে পরিণত করেছে। এবং হত্যাকান্ড চালিয়েছে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। যুগে যুগে এভাবেই মুর্তিপূজার পাশাপাশি মানব পূজার প্রচলন হয়েছে। এবং চক্রান্ত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের নির্মূলে। তবে বাংলাদেশের নব্য মালাউনগণ দেশবাসীকে মুর্তিপুজায় ডাকে না। ইসলামের উপর তারা প্রকাশ্যে হামলাও করে না। ইসলামের আলো থেকে মানুষকে দূরে সরানোর কাজে তাদের কৌশলটি ভিন্নতর। তারা হামলা করে শরিয়ত, খেলাফত, জিহাদ, হুদুদের ন্যায় ইসলামের বুনিয়াদি বিধিগুলোর উপর। রাষ্ট্রের উপর ইসলামপন্থীদের অধিকার জমানোকে তারা শাসনতান্ত্রিক ভাবে নিষিদ্ধ করে। সে লক্ষ্যে তারা নিষিদ্ধ করে তাদের রাজনীতির উপরও। ইসলামের বিধানগুলোকে তারা মধ্যযুগী বর্বরতা বলে।
ষাটের দশকে এই বামপন্থী মালাউনগণ জামায়াতে ইসলামী ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মতো বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলগুলোকে চিত্রিত করতো মার্কিনী প্রজেক্ট রূপে। এখনো তাদের মুখে একই সুর। সিরিয়া-ইরাকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদকে তারা মার্কিন প্রজেক্ট বলে। এই জিহাদীদের উপর মার্কিন বাহিনীর সহস্রাধিক বার বিমান হামলা হলেও তাতে তাদের ভূল ভাঙ্গেনি। তাদের মনে মহান আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বের ধারণা যেমন নেই, তেমনি নেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে মু’মিনদের যে বিশুদ্ধ নিয়েত থাকতে পারে এবং সে নিয়তের সাথে নিজস্ব জানমালের বিনিয়োগ থাকতে পারে –সে ধারণাটিও। এটি তাদের চেতনাগণ বিকলাঙ্গতা। মু’মিনদের তাই শুধু হিংস্র জীবজন্তু ও নমরুদ-ফিরাউনদের চিনলে চলে না, ইসলামের শত্রু এসব মালাউনদেরও চেনাটিও জরুরি। কারণ রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে মু’মিনদের আমৃত্যু যুদ্ধটি তো এ মালাউনদের বিরুদ্ধে। প্রতিদেশে ও প্রতিযুগে ফিরাউনদের মাঠ-সৈনিক তো তারাই।
অতীত যুগের নমরুদ-ফিরাউন ও তাদের দরবারী মালাউনদের ঘৃন্য চরিত্র নিয়ে ইতিহাসের বইতে কোন বর্ণনা নাই। তবে সে কারণে এসব দুর্বৃত্তদের চরিত্র ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাইনি। বরং সেটিকে ক্বিয়ামত অবধি তুলে ধরার দায়্ত্বি নিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। তিনি তাদের কদর্য চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর পবিত্র গ্রন্থ আল কুর’আনে। তাই কুর’আনের জ্ঞানে যারা জ্ঞানী, তারা আধুনিক ফিরাউন ও তাদের মালাউনদের চিনতে কোন যুগেই ভূল করেনা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে শুধু যে ফিরাউন আছে তা নয়, বিপুল সংখ্যক মালাউনও আছে। এরা যেমন স্বৈরাচারী মুজিবের দরবারে ছিল, তেমনি হাসিনার দরবারেও আছে। তেমনি স্বৈরাচারী এরশাদের দরবারেও ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতি, মিডিয়া, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দান এ মালাউনদের হাতে অধিকৃত। এসব মালাউনদের মাঝে যত রামপন্থি, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী হলো বামপন্থী। এরা নাস্তিক, এরা স্বার্থ শিকারী, এরা অর্থপুজারী, এরা পেটপুজারী এবং চাটুকার।
রামপন্থী ও বামপন্থী মালাউনদের চরিত্রের অভিন্ন রূপটি হলো ইসলাম বিরোধীতা। বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং ইসলামপন্থীদের যত রক্ত ঝরেছে তার অধিকাংশের মূলে এই মালাউনগণ। ভারতীয় হিন্দুদের ন্যায় বাংলাদেশের বাঙালী বামপন্থী মালাউনগণও পাকিস্তানের সৃষ্টিকে ১৯৪৭ সাল থেকেই মেনে নিতে পারিনি। বাঙালী মুসলিমগণ নবীজী (সা:)’র আমলের ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠুক – সেটি রামপন্থীদের ন্যায় বামপন্থীগণও চায় না। বামপন্থী মালাউনদের একই রূপ কৌশল ছিল পাকিস্তান আমলেও। কম্যুনিজমের নামে দল গড়ে মুসলিম দেশে ক্ষমতায় যাওয়া দূরে থাক, অস্তিত্ব বাঁচানোই কঠিন। তাই তারা স্থান নেয় অন্যদের আশ্রয়ে। বামপন্থীদের সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ আজ তাদের হাতেই অধিকৃত। তারা বেশী তৎপর হয় বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে। পাকিস্তান আমল তারা পরিকল্পিত ভাবে দখল করে নেয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকে। মুসলিম লীগের প্রতিষ্টিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা), সাপ্তাহিক বিচিত্রার ন্যায় পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলো তাদের দখলে চলে যায়। তারা প্রবেশ করে রেডিও-টিভিতেও। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকারের বামপন্থী আমলাদের সহায়তায় তারা দখলে নেয় দেশের রেলস্টেশনের বুকস্টলগুলোকে। বুকস্টলগুলোকে ব্যবহার করে চীন ও রাশিয়া থেকে প্রকাশিত বামপন্থী সাহিত্য বিতরণের কাজে। সে ঘাতক মার্কসীয় জীবাণুর কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনা রাজ্যে শুরু হয় প্রচন্ড মহামারি যা ধ্বসিয়ে দেয় প্যান-ইসলামী চেতনার উপর নির্মিত পাকিস্তানের মূল ফাউন্ডেশনকে।
বাম মালাউনদের ষড়যন্ত্র ও বিজয় ফ্যাসিবাদের
গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় বামপন্থীদের কোন কালেই কোন আগ্রহ ছিল না। না পাকিস্তান আমলে, না বাংলাদেশ আমলে। পাকিস্তান আমলে এসব বামপন্থীদের বেশীর ভাগ আশ্রয় নেয় মাওলানা ভাষানীর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ও পরবর্তীতে ন্যাপে। মাওলানা ভাষানীর পীরমুরিদীর ব্যবসা থাকলেও ইসলামের শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠায় একটি বারও তিনি রাজপথে নামেননি। রাষ্ট্রের বুকে ইসলামী বিধানকে বিজয়ী করার পক্ষে একটি বাক্যও কোন কালে তিনি উচ্চারণ করেননি। বরং আন্দোলন করেছেন সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়; সেটি নাস্তিক কম্যুনিষ্টদের সাথে নিয়ে। ভাষানীর আগ্রহ ছিল না গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা নিয়েও। পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বড় সুযোগ আসে ১৯৬৪ সালে। তখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সকল বিরোধীদলের সম্মিলিত প্রার্থী ছিলেন কায়েদে আযম মহম্মদ আলীর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। তাঁর বিজয়ের সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু মাওলানা ভাষানী ও তার সঙ্গি বামপন্থী মালাউনগণ ফাতেমা জিন্নাহর বিজয়ের চেয়ে স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিজয়কেই বেশী গুরুত্ব দেয়। আইয়ুব খানকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে মাওলানা ভাষানীর কৌশলটি কীরূপ ছিল সেটির বর্ণনাটি এসেছে লন্ডনস্থ পাকিস্তান বংশোদ্ভুত বামপন্থী সাবেক ছাত্রনেতা ও বুদ্ধিজীবী জনাব তারেক আলীর রচিত “Can Pakistan Survive?” বইতে। ১৯৬২ সালে মাওলানা ভাষানী চীন সফরে যান। তার মোলাকাত হয় চেয়্যারমান মাও সে তুংয়ের সাথে। চেয়্যারমান মাও মাওলানা ভাষানীকে কি বলেছেন সেটি জানার জন্যই তারেক আলী ঢাকায় ছুটে যান মাওলানা ভাষানীর সাক্ষাতকার নিতে। মাওলানা ভাষানী তারেক আলীকে বলেন,“চেয়্যারমান মাও বলেছেন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে সমস্যায় আছি। আমরা চাই না যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে অস্থিতিশীল করা হোক।” চেয়ারম্যান মাও সে তুং’য়ের নসিহতে মাওলানা ভাষানীর রাজনীতিই পাল্টে যায়। গণতন্ত্রের স্বার্থের চেয়ে চীনের জাতীয় স্বার্থই ভাষানীর কাছে বেশী গুরুত্ব পায়। তাই তিনি ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কোন নির্বাচনী প্রচার চালাননি। পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ সুযোগ আসে ১৯৬৯ সালে। আইয়ুব খান তখন রাজনীতি থেকে অবসর নিতে রাজি। রাজি হয়েছিলেন পার্লামেন্টারি প্রথার গণতন্ত্র দিতেও। সে বিষয়টি নিয়ে একটি সমাঝোতায় পৌঁছতেই আইয়ুব খান সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সে বৈঠক বানচাল করতেই গোলটেবিলে না গিয়ে বামপন্থীদের নিয়ে মাওলানা ভাষানী জ্বালাও পোড়াও’য়ের আন্দোলন শুরু করেন। অপরদিকে মুজিব সে বৈঠকে রাখেন ৬ দফার দাবী। আইয়ুব খানের তখন বিদায়ের পালা। ফলে ৬ দফা পেশের স্থান গোলটেবিল ছিল না, সেটি ছিল নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়। উভয়ের ষড়যন্ত্রের ফলে গণতন্ত্র ফিরে না এসে প্রতিষ্ঠা পায় রাজনৈতিক কান্ডজ্ঞানশূণ্য মাতাল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন। অথচ আইয়ুবের পর বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পেলে একাত্তরের শাসনতান্ত্রিক সংকট পরিহার করা যেত।পরিহার করা যেত একটি রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধকেও।
বামপন্থী মালাউনদের চাপেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভাষানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলটি শ্লোগান তোলে “ভোটের আগে ভাত চাই”। ভোটদানের মুহুর্তে কে ভাত দেবে সেটি ভাষানী ভেবে দেখেননি। মাওলানা ভাষানীর রাজনৈতিক ছাতাটি দুর্বল হলে কম্যুনিস্টগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং নানা নামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কম্যুনিস্ট পার্টি গড়ে তোলে। তবে জিয়াউর রহমানের আমলে ভাষানীর সহচরদের অধিকাংশই যোগ দেয় বিএনপি’তে ও পরবর্তীতে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। বামপন্থীদের মধ্যে যারা ছিল মস্কোপন্থী তারা জমা হয় মুজিবের দলে। একাত্তরে মুজিব ছিল মূলত বামপন্থীদের হাতেই জিম্মি। মুজিবের ঘাড়ে ভর করেই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ঝান্ডা উড়ায় এবং পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কল্পে গণবাহিনী গড়ে তোলে। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসের জন্মদাতা স্রেফ মুজিব নয়, নানা ব্রান্ডের এ বামপন্থী মালাউনগণও। জেনারেল জিয়াউর রহমান একাত্তরের পাকিস্তানপন্থীদের সাথে সমাঝোতার রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা দেন। শাহ আজিজুর রহমানের মত একাত্তরের পাকিস্তানপন্থীকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করেন। শাহ আজিজ ১৯৭১’য়ে জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য পেশ করতে। জিয়াউর রহমানের এরূপ সমন্বয় ও সংহতি ভিত্তিক রাজনীতির কারণেই তখন পরাজিত হয় আওয়ামী লীগের বাকশালী ফ্যাসিবাদী রাজনীতি। কিন্তু বিএনপি’তে লুকিয়ে থাকা বাম মালাউনদের কাছে জিয়াউর রহমানের সে নীতি ভাল লাগেনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসাতে বামপন্থীদের পোয়া বারো। খালেদা জিয়া জিম্মি হন এই বামপন্থীদের হাতে। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামী সমর্থন না দিলে খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া স্বপ্নই থেকে যেত। জামায়াত সেদিন বিনা শর্তে বিএনপি’র সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু প্রতিদানে খালেদা জিয়ার সরকার জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমকে কারাবন্দী করেছে। নাগরিকত্ব প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার। অপরাধ করলে শাস্তি হয়, কিন্তু নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে কাউকে জন্মভূমিতে নাগরিকত্বহীন করার অধিকার সরকারের থাকে না। শেখ মুজিব অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল অন্যায় ভাবে। সেটি নিছক রাজনৈতিক স্বার্থে। অথচ বিএনপির সে অন্যায় সিদ্ধান্তকেই একই রূপ রাজনৈতিক স্বার্থে বহাল রাখে। অধ্যাপক গোলাম আযম আদালতে গিয়ে প্রমাণ করেন তার উপর জুলুম হয়েছে। সেদিন খালেদা জিয়া তার দলের বামপন্থী মালাউনদের পরামর্শকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং জামায়াতকে নিজের রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত করেছেন। খালেদা জিয়ার সে সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসই পাল্টে দেয়। পাপ কাউকেই ছাড়েনা। খালেদা জিয়াকেও ছাড়েনি। তাঁর সেই সিদ্ধান্তের কারণেই দেশ আজ নৃশংস বাকশালী ফ্যাসিবাদের শিকার। এবং খালেদ জিয়া নিজে আজ কারাবন্দী। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাঁর পুত্র তারেক জিয়া। এবং নিহত ও গুম হয়েছে শত শত বিএনপি ও জামায়াত কর্মী।
খপ্পরে জামায়াতে ইসলামীও
বামপন্থী মালাউনদের খপ্পর থেকে আজ জামায়াতে ইসলামের ন্যায় সংগঠনও মুক্ত নয়। বামদের অনেকে সুকৌশলে জামায়াতের মিডিয়াকে ব্যবহার করছে দলটির নেতাকর্মী ও জনগণকে সেক্যুলারাইজড করার কাজে। এভাবে জামায়াত কর্মীদের দূরে সরাচ্ছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মূল মিশন থেকে। এদের প্রভাবেই জামায়াত ও শিবিবকর্মীগণ একাত্তরের পরজয়কে নিজেদের বিজয় রূপে প্রচার করতে ১৬ই ডিসেম্বরে যে কোন দলের তুলনায় বিশাল বিজয় মিছিল বের করে। ইসলামের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকাটি আদৌ গোপন বিষয় নয়। কম্যুনিজমের পতন হলেও বাঙালী বামপন্থীগণ তাদের মিশন থেকে এক ইঞ্চিও দূরে সরে নাই। বরং তাদের লক্ষ্য, অন্যদেরকে তাদের পথে টানার। সেটির প্রমাণ বহু। সম্প্রতি দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত বামপন্থী লেখক ফরহাদ মাজহারের একটি প্রবন্ধ থেকে উদাহরণ দেয়া যাক। তিনি লিখেছেন: “এ কালে ইসলামসহ ধর্মের কোন পর্যালোচনা বা গঠনমূলক ভূমিকা থাকতে পারে আমরা তা মনে করি না। আমি সব সময়ই এই রাজনীতির বিরোধিতা করে এসেছি।” –(সংকট পেরুবো কিভাবে? ০১/০৩/২০১৫)। উক্ত নিবন্ধে ফরহাদ মাজহার ইসলামের ভূমিকার ব্যাপারে একাল ও সেকালের মাঝে বিভাজন টেনেছেন; এবং একালে ইসলামের ভূমিকাকে অস্বীকার করেছেন। অথচ ইসলাম হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত শ্বাশ্বত বিধান –সেটি যেমন সেকালের জন্য, তেমনি একালের জন্যও। তাই কালের প্রবাহে এ কুর’আনী বিধান কোন কালেই তামাদী হওয়ার নয়। পবিত্র কুর’আন নামাজ-রোজা,হজ্জ -যাকাতের ন্যায় ইবাদতে যেমন পথ দেখায়,তেমনি পথ দেখায় রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও আইন-আদালতের ন্যায় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। মহান আল্লাহতায়ালার এরূপ ইসলামী নির্দেশনাকে কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি ক্ষণিকের জন্যও অস্বীকার করতে পারে? সে কুর’আনী বিধানের প্রয়োগকে কি সীমিত করা যায় কালের সীমারেখায়? সেটি করলে সে কি আর মুসলিম থাকে? অথচ ইসলামের চিহ্নিত শত্রুপক্ষের ন্যায় ফারহাদ মাজহারও রাজনীতির ময়দানে ইসলামের জন্য আধুনিক যুগে কোন স্থান ছেড়ে দিতে রাজি নন। আর সে ঘোষণাটি দিয়েছেন জামায়াতের নিয়ন্ত্রাধীন পত্রিকা “নয়া দিগন্ত”য়ে। জামায়াতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যুদ্ধ লড়ছেন ইসলামের বিরুদ্ধে। অথচ ফারহাদ মাজহার শুধু বামপন্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক গুরু নন, অনেক জামায়াত কর্মীদের কাছেও তিনি গুরু।
লক্ষ্য: ইসলামের বিজয় রোধ
বাঙালী মুসলিমদের হিন্দু বা খৃষ্টান বানাতে সক্ষম না হলেও ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে ইসলামের শত্রুদের সফলতাটি বিশাল। সেটি সরকারের ঘাড়ে বসা রামপন্থী ও বামপন্থী মালাউনদের কারণে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়া তো তাদেরই দখলে। তারা যেমন বার বার মনিব পাল্টিয়েছে, তেমনি বার বার উপসনার ধরণও পাল্টিয়েছে। এখন আর তারা সমাজতন্ত্র বা কম্যুনিজমের কথা বলে না। চীন বা রাশিয়ার নামও তারা মুখে আনে না। তাদের ধর্মগ্রন্থ এখন আর কার্লস মার্কসের প্রণীত দাস ক্যাপিটাল নয়। শত শত এনজিও গড়ে এসব বামপন্থীগণ এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদসেবায় ব্যস্ত। এরা যেমন সরকারের অভ্যন্তরে খেলছে, তেমনি বাইরেও খেলছে।এরা যেমন শেখ হাসিনার দলে আছে, তেমনি আছে খালেদা জিয়ার দলেও। তবে যেখানেই থাকুক শরিয়তের প্রতিষ্ঠারোধ ও ইসলামপন্থীদের নির্মূলের এজেন্ডা থেকে তারা একটু্ও দূরে সরেনি। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের কাছে আজও তাদের প্রচন্ড কদর। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে এরাই এখন সাম্রাজ্যবাদী কোয়ালিশনের ডি-ইসলামাইজেশন প্রজেক্টের পদাতিক সৈনিক।
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনগণ ও তাদের সহযোগী ইউরোপীয় দাতা সংস্থা এসব বামপন্থীদের যে বিপুল অর্থ দেয় তাই নয়, বহুদেশে তাদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণও দেয়। সিরিয়ার মার্কসবাদী-লেলিনবাদী কুর্দিগণ তো মার্কিনী অস্ত্র নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ছে। হাসিনাকে ঘিরেও ইসলামের এই চিহ্নিত শত্রুদের ষড়যন্ত্রটি বিশাল। তাদের ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল।একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলেও ইসলামের শত্রুশক্তির নির্মূলের রাজনীতি এখনো শেষ হয়নি। শেষ হয়নি সে নির্মূলের কাজে সরকারের সহিংস আয়োজনও। বরং রাজপথ ভরে উঠেছে পুলিশ, RAB, বিজিবি ও দলীয় ক্যাডার বাহিনীর অস্ত্রধারীদের ভিড়ে। কখনো কখনো নামানো হয় সেনাবাহিনীকেও। দেশে এখন যুদ্বাবস্থা। ত্রুসফায়ার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারের নামে সরকারি বাহিনী ইচ্ছামত লাশ ফেলছে। অধিকাংশ জনগণ পরিণত হচ্ছে নিরব দর্শকে। পাশে কাউকে জবাই হতে দেখেও গরুছাগল ঘাস খাওয়ায় বিরতি দেয় না, তেমনি অবস্থা অধিকাংশ বাংলাদেশীদের। দেশের এ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে যেন তাদের কিছুই করণীয় নেই। দুর্বৃত্ত ভোট ডাকাতদের সরানোর দায়িত্ব যেন শুধু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের।
জনগণের দায়ভার
গ্রামে আগুন লাগলে যদি গ্রামবাসী ঘুমায় বা নীরব দর্শকে পরিণত হয়, তবে কি সে গ্রামের মানুষ আগুন থেকে বাঁচে? সভ্য মানুষ এমন মুহুর্তে হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই আগুন নেভায়। স্বৈরাচারী জালেমদের শাসন দীর্ঘকাল যাবত চলতে দেয়ার বিপদ টের পাচ্ছে সিরিয়ার জনগণ। প্রায় তিন লাখ মানুষের মৃত্যু ও ৬০ লাখ মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার পরও তাদের বিপদ কাটছে না। বাংলাদেশের বুক থেকে এ ডাকাতদের সত্বর না সরালে ভবিষ্যতে আরো বেশী রক্তব্যয়ে সরাতে হবে। তখন শুধু হরতাল-অবরোধ নয়, জনগণকে একটি প্রকান্ড যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিকে সহ্য করতে হবে। আজ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে এবং তাদের ঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সে আগুন যে অচিরেই অন্যদের ঘরেও ছড়িয়ে পড়বে –তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? এতে বাংলাদেশ দ্রুত পরিণত হবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে। স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদের ধ্বংসাত্মক তান্ডব থেকে দেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য জিহাদ তাই মহান আল্লাহতায়ালার বিধান। ইসলামে এটি ফরজ। মানব জাতির কল্যাণে এ জিহাদেই ঘটে মু’মিনের জীবনে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। এবং পরকালে আনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার –সেটি বিনা বিচারে সরাসরি জান্নাত লাভের। একটি দেশ দুর্বৃত্ত শাসন থেকে মুক্তি পায়, এবং জনগণ শান্তি ফিরে পায় তো জিহাদের বরকতেই, আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নয়।
ভোটডাকাত ও স্বৈরাচারীদের ক্ষমতায় বসিয়ে বাঁচার মধ্যে কোন সম্মান বা ইজ্জত নাই। না ইহকালে ও না পরকালে। মানব সমাজে সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাজটি হলো দুর্বৃত্ত নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠ। ইসলামে এটিই সবচেয়ে পবিত্রতম ইবাদত। দেশের মানুষ কতটা ঈমান নিয়ে বাঁচে সে বিচার মসজিদ-মাদ্রাসা গুণে হয়না। সে বিচারটি তাবলীগ জামায়াতে এজতেমায় কত লাখ মানুষ জমা হলো বা কতজন নামাজ-রোজা আদায় করলো –তা দিয়েও হয়না। নামাজ-রোজা আদায় করার পরও একজন ব্যক্তি যেমন মুনাফিক হতে পারে, তেমনি দুর্বৃত্ত শাসকের সৈনিকও হতে পারে। ঈমানদারদের জীবনের মূল মিশনটি হলো আমিরু বিল মারুফ তথা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও নেহী আনিল মুনকার অর্থাৎ অন্যায় নির্মূলের মিশন নিয়ে বাঁচা। এ মিশনে আত্মনিয়োগের কারণে সে চিহ্নিত হয় মহান আল্লাহর দলের সৈনিক রূপে।এ মিশনের বাইরে যারা, তারা বাঁচে শয়তানের দলের সৈনিক রূপে। তাই যেদেশে ঈমানদার আছে সে দেশে শয়তাদের সৈনিকদের বিরুদ্ধে জিহাদও অনিবার্য। সে অনিবার্যতাটি দেখা যায় সাহাবায়ে কেরামদের জীবনে। হাশর দিনে বিচার হবে অন্যায়ের নির্মূল ও ইসলামের প্রতিষ্ঠায় মু’মিনের নিজ জানমালের বিনিয়োগ কীরূপ -তা নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলিমদের সে বিনিয়োগই বা কতটুকু? বাংলাদেশের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তো এখানেই। দেশে ভোট ডাকাতদের শাসন ও শরিয়তের অনুপস্থিতি সে বিশাল ব্যর্থতাটি ছাড়া কি অন্য কিছু প্রমাণ করে। ১ম সংস্করণ ২০/০৩/২০১৫; ২য় সংস্করণ ২৮/০২/২০২২।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018