সংস্কৃতির গুরুত্ব ও বাঙালি মুসলিম জীবনে অপসংস্কৃতির নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on August 1, 2022
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
চিত্তের পরিচয় সংস্কৃতিতে
জাতি কতটা সভ্য, ভদ্র, উন্নত ও মানবিক –সে পরিমাপটি সঠিক ভাবে দেয় জাতির সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে প্রকাশ ঘটে একটি জনগোষ্টির ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন, চরিত্র, রুচিবোধ, মূল্যবোধ, চালচলন ও জীবনবোধের। পশু বা উদ্ভিদের জীবনে সময়ের তালে বাঁচার প্রক্রিয়ায় কোন উন্নতি আসে না। ফলে তাদের পরিচয় প্রতি যুগে ও প্রতি দেশে একই রূপ । কিন্তু মানুষ তার নিজেকে ও সমাজকে নিয়ে সামনে এগোয়, পূর্বের চেয়ে উন্নততর ও সভ্যতর হয়। হাজার বছর পূর্বে পশুরা যা খেতো ও পান করতো এবং যে ভাবে বাস করতো, আজকের জন্তু-জানোয়ারের খাদ্য, পানীয় ও বাসস্থান অবিকল একই রূপ। কিন্তু যুগের তালে মানুষ অনেক সামনে এগিয়েছে এবং নিজেদের মাঝে পরিশুদ্ধি এনেছে। এভাবে লাগাতর সামনে এগোনো ও পরিশুদ্ধি আনার যে প্রক্রিয়া -সেটিই হলো সংস্কৃতি। যে কোন জীবন্ত ও সুস্থ জাতির জীবনে এরূপ প্রচেষ্টা ক্রীয়াশীল থাকাটি শুধু কাঙ্খিতই নয়, অপরিহার্যও। সমাজে সে প্রক্রিয়া কতটা সফল এবং কার্যকর -সংস্কৃতি মূলত সেটিরই পরিমাপ দেয়। খনির স্বর্ণ আর দৃষ্টিনন্দন অলংকারের স্বর্ণ এক নয়, উভয়ের মাঝে যে বিশাল পার্থক্য তার পশ্চাতে থাকে দীর্ঘ পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। তেমনি সভ্য মানুষ আর অসভ্য মানুষও এক নয়। এক নয় উভয়ের দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, মূল্যবোধ এবং বাঁচবার রুচিবোধ। এ পার্থক্যের মূলে থাকে একটি পরিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। মানব চরিত্রের সংস্কারের এ ক্রীয়াশীল প্রক্রিয়াকেই বলা হয় সংস্কৃতি। কোন জাতির সভ্যতর রূপে বেড়ে উঠার পিছনে এই প্রক্রিয়াটাই মূল। পরিশুদ্ধির এ প্রক্রিয়ায় যা কিছু সহায়ক ভূমিকা রাখে সেগুলিই হলো সাংস্কৃতিক উপাদান।
প্রশ্ন হলো, কি সেই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া? কি সেই উপাদান যার ভিত্তিতে একটি জাতি অন্য একটি জাতি থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির জন্ম দেয়? কি করে ভিন্নতর হয় নানা জনগোষ্ঠির নানা জীবনবোধ ও চরিত্র? সচারচরই বলা হয়, মুসলিমগণ সংস্কৃতিতে অমুসলিমদের থেকে ভিন্ন। কিন্তু কি সে ভিন্নতা? কেন সে ভিন্নতা? এবং কি ভাবে গড়ে উঠে সে ভিন্নতা? সংস্কৃতি বুঝতে হলে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। জীবন মাত্রই গতিময়, এ গতি যেমন উর্ধ্বমুখী হতে পারে, তেমনি অধোমুখীও হতে পারে। কোন জাতি যেমন বিশ্বশক্তি হতে পারে, তেমনি এক সময়ের বিশ্বশক্তি অন্য জাতির গোলামও হতে পারে। ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনেও স্থিতিবস্থা বলে কিছু নেই। এগোতে না পারলে অবশ্যই পিছিয়ে যেতে হয়। মানবজাতির ইতিহাস এরূপ উত্থান-পতনের ইতিহাসে ভরপুর। এককালের বহু সভ্য জাতি কালের গতিতে পিছিয়ে গেছে। মুসলিমগণ নিজেরাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজকের তুলনায় চৌদ্দশত বছর পূর্বেও তারা শিক্ষা-দীক্ষা, চরিত্র, কর্ম ও আচরণে বহুগুণ উন্নত ছিল। অথচ আজ ইতিহাসে গড়ছে দুর্বৃত্তিতে। এরূপ এগিয়ে ও পিছিয়ে যাওয়ার পিছনে কাজ করে জাতীয় জীবনে একটি সফল সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া যথাযথ সক্রীয় থাকা বা না থাকার বিষয়টি।
ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সংস্কারের প্রেরণা আসে ধর্মীয় বিশ্বাস বা দর্শন থেকে। মুসলিম জীবনে সে ধর্মীয় বিশ্বাস বা দর্শনটি হলো ইসলাম। সভ্য-অসভ্য, ভাল-মন্দ, শ্লীল-অশ্লীল, ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ে ইসলাম কাজ করে একটি মানদন্ড রূপে। সে মানদন্ডের ভিত্তিতে বাঁচবার মধ্যে আসে বিপ্লব, গড়ে উঠে রুচিবোধ। আসে চিন্তা-চেতনা, চরিত্র, কর্ম ও বাঁচবার প্রক্রিয়াতে আমূল পরিশুদ্ধি। ফলে ভূমি,ভাষা, জলবায়ু বা গাত্রবর্ণ একই রূপ হওয়া সত্ত্বেও জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। মানুষ উদ্ভিদ নয় যে ভূমি ও জলবায়ু থেকে তার বাঁচবার উপকরণ সংগ্রহ করবে। ব্যক্তির দৈহিক ও জৈবিক সত্ত্বার চেয়ে নৈতিক সত্ত্বাটিই মূল। এ নৈতিক সত্ত্বার জন্যই মানুষ মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এবং তার নৈতিক শিকড় পুষ্টি পায় আদর্শ ও দর্শন থেকে, ভূমি ও জলবায়ু থেকে নয়। অভিন্ন আরব ভূমিতে একারণেই বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। বহুবিধ অনৈসলামিক সংস্কৃতির পাশে জন্ম হয়েছে ইসলামী সংস্কৃতির। ইসলাম বিপ্লব আনে ব্যক্তির বিশ্বাস, কর্ম, আচরণ ও রুচিবোধে। তখন শুরু হয় মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে বাঁচবার এবং সে সাথে রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের প্রক্রিয়া। তেমন একটি পবিত্র প্রক্রিয়ার কারণেই আরবের প্রাক-ইসলামিক যুগের হানাহানীপূর্ণ অসভ্য বিভক্তির সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় ইস্পাতদৃঢ় প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্বের সংস্কৃতি। এক কালে যারা ইর্ষা, ঘৃণা ও হানাহানী নিয়ে বাঁচতো, তাদের মুখ থেকে উৎচারিত হতে থাকে একে-অপরের প্রতি প্রাণঢালা সালাম তথা শান্তির দোয়া। এভাবেই জন্ম নেয় শ্রেষ্ঠতম মানব, পরিশুদ্ধ সভ্যতা বা শান্তিময় বিশ্ব গড়ার সংস্কৃতি। মুসলিমদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার গড়ার মূল ভিত্তি তো ব্যক্তি ও সমষ্টির পরিশুদ্ধির এই প্রবল সংস্কৃতি।
ইসলামী সংস্কৃতি ও অনৈসলামি সংস্কৃতি
ইসলামকে বাদ দিয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে সেটি আর যাই হোক মুসলিমের সংস্কৃতি নয়। ইসলাম থেকে যেমন মুসলিমকে পৃথক করা যায় না, তেমনি তাকে পৃথক করা যায় না ইসলামী সংস্কৃতি থেকেও। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও চেতনার প্রতীক। ব্যক্তির বিশ্বাস, দর্শন, মূল্যবোধ ও চেতনা দৃশ্যময় হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। রোগের যেমন লক্ষণ থাকে, স্বাস্থ্যেরও তেমনি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালাতে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী উভয়েরই সনাক্তকরণে কিছু লক্ষণ থাকে। আল্লাহতায়ালাতে অবিশ্বাসীর জীবনে বিশ্বাসের বাঁধন থাকে না। ফলে তার জীবনে শ্লীলতার বদলে অশ্লীলতা, ভদ্রতার বদলে অভদ্রতা, সভ্যতার বদলে অসভ্যতার প্রকাশ ঘটবে -সেটিই স্বাভাবিক। কারণ, তার জীবনের লাগামটি থাকে খেয়ালখুশী বা জৈবিক প্রবৃত্তির হাতে। এমন প্রবৃত্তিপরায়ন ব্যক্তির পোশাক-পরিচ্ছদ, আমোদ-আহ্লাদ ও জীবন যাপনে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না, বরং থাকে অশ্লীলতা। থাকে অপরাধপ্রবনতা। এমন ব্যক্তির জীবন উপভোগে থাকে প্রচণ্ড স্বেচ্ছাচারীতা। সে উৎকট স্বেচ্ছাচারীতা দেখা যায় সমুদ্র সৈকত, ক্লাব, ক্যাসিনো, মদ্যশালা ও পতিতাপল্লীগুলোর দিকে তাকালে।
কিন্তু মুসলিমের প্রতিটি কর্ম ও আচরন মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জবাবদেহীতার ভয়ে সদা নিয়ন্ত্রিত। ঈমানদারের চাওয়া-পাওয়ার উপর শক্ত লাগাম পড়িয়ে দেয় সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালার ভয়। তাঁর জীবন হয় শরিয়ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কি আনন্দ-উল্লাস, কি কথা-বার্তা, কি দুঃখ-বিষাদ -সব কিছুতেই থাকে মহান আল্লাহতায়ালার উপর অটল নির্ভরতা। মুসলিমের শোকপ্রকাশ ও উৎসবের প্রক্রিয়া এজন্যই অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। শোকে-দঃখে সে বলে “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হি রা’জীয়ুন”। অর্থ: নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্যই এবং আল্লাহতেই ফিরে যাবো। ফলে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ফিরে যাওয়া ও তাঁর কাছে জবাবদেহীতার গভীর ভাবনা। এমন ভাবনা থেকেই পরিচালিত হয় মুসলিমের জীবন। কিন্তু অমুসলিমের জীবনে সে জবাবদেহীতা থাকে না। ফলে তার রুচিবোধ, জীবনবোধ ও সংস্কৃতি মুসলিম থেকে ভিন্নতর। এজন্যই বাংলাদেশে মুসলিম এবং অমুসলিম প্রায় হাজার বছর পাশাপাশী বসবাস করলেও তাদের উভয়ের আনন্দ-উল্লাস বা উৎসবের দিনগুলি কখনোই একই মোহনাতে মিলিত হয়নি। পানি ও তেলের ন্যয় আলাদাই রয়ে গেছে। বাঙালি সংস্কৃতির নামে কারো স্মরণে দাঁড়িয়ে নীরবতা, বেদীমূলে বা মূর্তির পদতলে বা ফটোতে মাল্যদানের যে সংস্কৃতি -সেটি নিতান্তই পৌত্তলিকদের, সেটি কোন দিনই মুসলিমের হতে পারিনি। মুসলিমগণ বরং মৃত ব্যক্তির আত্মার মাগফেরাতে দোওয়া-দরুদের মজলিস বসায়, কবর জেয়ারত করে, গরীব মিসকিনকে দান খয়রাত করে। এতে মৃত ব্যক্তির রুহের উপর ছওয়াব পৌঁছে। এটিই হলো ইসলামী সংস্কৃতি। শহীদ মিনারের নামে স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা, স্তম্ভে মাল্যদান এবং নগ্ন-পায়ে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের যে সংস্কৃতিকে আপামর বাঙালি সংস্কৃতি বলা হয় -সেটি সত্য নয়। এতে প্রভাব পৌত্তলিক হিন্দুত্বের। ইসলামে অঙ্গীকারহীন বাঙালি হিন্দুত্ববাদী সেক্যুলারিস্টগণ এ সংস্কৃতির জনক, কোন নিষ্ঠাবান মুসলিম নন। কোন কালেই এরূপ পৌত্তলিক আচার ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সংস্কৃতি হতে পারেনি।
তাছাড়া সাংস্কৃতিক কর্ম মুসলিমের কাছে নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছবার মাধ্যম মাত্র। ইসলামের লক্ষ্য: মানুষের মাঝে গুণের উংকর্ষ ঘটিয়ে তাঁকে ফেরেশতার পর্যায়ে পৌঁছানো। ইসলামী সংস্কৃতি হলো সে লক্ষ্যে পৌঁছার প্রক্রিয়া। তাই মুসলিমের জীবনে এ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মানব শিশু মুসলিম রূপে জন্মালেও সে প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বসবাসের কারণে। নইলে অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া। তাই সে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠাটি মুসলিমের কাছে কোন নাচ-গানের বিনোদন নয়, আনন্দ-উল্লাসও নয়, এটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ কাজে মেধাদান, শ্রমদান ও অর্থদান জিহাদের সমতূল্য। এবং এমন কাজে ব্যবহৃত কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে পবিত্র। ঈমানদারের সাহিত্য তাই বিনোদনের মাধ্যম নয়, সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্যও নয়; বরং সেটি যেমন জ্ঞানদানের বাহন, তেমনি চেতনা ও চরিত্রের পরিশুদ্ধির হাতিয়ার। এটিই ঈমানদারের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ।
আল্লাহতে বিশ্বাসী ও অনুগত হলে জীবন অতি শ্লীল ও রুচিশীল হয়, তখন আসে পবিত্রতা। ইসলাম পবিত্রতার প্রতিষ্ঠা চায় শুধু মসজিদে নয়, বরং সমগ্র সমাজে ও রাষ্ট্রজুড়ে। এমনকি আনন্দ-উৎসব ও শোক-দুঃখের আসরগুলোতেও। সমাজের কোন ক্ষুদ্রতর অংশ আনন্দ-উংসব বা সাংস্কৃতিক ক্রীয়াকর্মের নামে অশ্লীলতা ও নোংরামীতে আক্রান্ত হোক -ইসলাম তা চায় না। কারণ এগুলো রোগ। আর চেতনার রোগমাত্রই সংক্রামক। এগুলির শুরু ক্ষুদ্রতর স্থান থেকে হলেও আস্তে আস্তে সমগ্র রাষ্ট্রকে তা গ্রাস করে। তাই যে অশ্লীলতার শুরু নাটকের মঞ্চ, সিনেমা হল, যাত্রা দল বা নিষিদ্ধ পল্লীতে, সেগুলি সেখানে সীমাবদ্ধ থকে না। আগুনের ন্যায় ঘর থেকে ঘর, গ্রাম থেকে গ্রামকে গ্রাস করে। এজন্যই ব্যক্তি ও জাতির পরিশুদ্ধির প্রয়োজনে ইসলাম সমাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গণ থেকেও অশ্লীলতার নির্মূল চায়। সে পরিশুদ্ধির কাজে সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
সংস্কৃতির নির্মাণ কীরূপে?
ব্যক্তি ও সমাজের পরিশুদ্ধিতে ইসলাম শুধু ব্যক্তির মৌখিক কালেমা পাঠ ও নামাজ-রোজায় লিপ্ত করেই দায়িত্ব শেষ করে না, বরং তাকে একটি বিশেষ মডেলের অনুকরণে গড়ে তুলতে চায়। আর সে মডেল হলো, মহান রাসূলে পাক (সা:)’র মডেল। কালেমা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সেটি শুরু হয় বটে, তবে তাতে শেষ হয় না। এজন্য তাকে চিন্তা-চেতনা ও আমল-আখলাক বিশুদ্ধকরণের বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ইসলামী সংস্কৃতি হলো সে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। আরবীতে এটিকে বলা হয় তাহযীব। তাহযীব শব্দটির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শন ও প্রক্রিয়ার কথা। তাহযীব হলো আরবী ব্যকারণের বাবে তাফয়ীলে হাযযাবা শব্দের ক্রিয়া বিশেষ্য। হাযযাবা শব্দের অর্থ কোন কিছুকে পরিশুদ্ধ বা বিশুদ্ধ করা। সমাজে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াটি চালু রাখে তথা পরিশুদ্ধ করণের সে কাজটি করে ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় বিধি-বিধান, কুর’আন-হাদীস শিক্ষা, ইসলামী সাহিত্য, সামাজিক ও পারিবারিক সংগঠন, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, ইত্যাদি। কোন মুসলিম সমাজে এ বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াটি কাজ না করলে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম করার প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ মানুষ বইপত্র বা স্কুল-কলেজ থেকে যা শেখে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী শেখে সংস্কৃতি থেকে। এবং বেড়ে উঠে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এভাবে সংস্কৃতি শুধু শেখায়ই না, বরং জীবন-যাপন, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের সাংস্কৃতিক আবহ বা পরিবেশ সৃষ্টি করে। সে পরিবেশ অবগাহন করে এবং একে অপরের সাথে একাত্ম হয় সাধরণ মানুষ। এভাবেই সমাজের বুকে গড়ে উঠে এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক সংহতি। সে প্রক্রিয়ায় পরিশুদ্ধ মানুষটি তখন নতুন প্রজন্মের সামনে মডেল রূপে কাজ করে। প্রতিটি ব্যক্তি তাঁর জীবনের প্রাথমিক পাঠটি সেখান থেকেই লাভ করে। ধর্ম ও অধর্ম, ভদ্রতা ও অভদ্রতা এবং শ্লীল ও অশ্লীল বলতে কি বুঝায়, কেন সৎ হতে হবে, কিভাবে সৎ হতে হবে, কেন ধর্মে একনিষ্ট হতে হবে, কেন অপরের দুঃখে দুখী এবং সুখে সুখী হতে হবে, কিভাবে বড়দের সম্মান ও ছোটদের সম্মান করতে হবে, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বা মেহমানকেই বা কিভাবে আপ্যায়ীত করবে এবং জীবনের মূল দর্শন কি –এরূপ মৌল বিষয়গুলো প্রতিটি ব্যক্তি শেখে তার সংস্কৃতি থেকে। শেখে পিতামাতা, প্রতিবেশী, মুরব্বী, মোল্লা-মৌলভী ও আত্মীয়স্বজন থেকে। ফলে স্কুলে না গিয়েও সুস্থ সংস্কৃতির একটি দেশে ব্যক্তির চেতনা ও চরিত্র পরিশুদ্ধ হয়। তখন ঘরে ঘরে এবং প্রতিটি জনপদে ভদ্র ও সভ্য মানুষ গড়ে উঠে। পতিতাপল্লী, ডাকাতপল্লী ও সন্ত্রাসীদের দলে সেরূপ একটি প্রক্রিয়া থাকে না বলেই সেখানে ভদ্র ও সভ্য মানুষ গড়ে উঠেনা। সংস্কৃতির সুস্থ প্রক্রিয়াটি কাজ না করলে দেশ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদ-মাদ্রাসায় ভরে উঠলেও মানুষের চরিত্র ও আচরণে পরিশুদ্ধি আসে না। দুর্বৃত্তি থেকে মুক্তিও মেলে না। বরং জোয়ার আসে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, সন্ত্রাস ও ধর্ষণের। তখন দুর্বৃত্তদের দখলে যায় দেশ। তারই উদাহরণ হলো আজকের বাংলাদেশ।
সুস্থ সংস্কৃতির নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো পবিত্র কুর’আন। সে সাথে কাজ করে ইসলামের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি। অপর দিকে সংস্কৃতিতে দূষিতকরণ তথা দুর্বৃত্তায়নের হাতিয়ার হলো ভ্রান্ত ও বিষাক্ত মতবাদ, পতিতাপল্লী, দুষিত সাহিত্য, ক্লাব-ক্যাসিনো, মদ্যশালা, ড্রাগ, নাচ-গানের আখড়া, ইত্যাদি। এগুলো মানুষকে পাপের পথে টানে এবং জন্ম দেয় অপসংস্কৃতির। ইসলাম তাই শুধু কালেমা, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত শেখায় না। ইসলামী রাষ্ট্র, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও গড়তে বলে। সে সাথে নির্মূল করে পাপের প্রতিষ্ঠানগুলিকে। শুধু কালেমা, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে ব্যক্তি ও সমাজের পরিশুদ্ধি সম্ভব হলে আজকের মুসলিমগণও প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের ন্যায় মহামানব রূপে বেড়ে উঠতো। কারণ মুসলিমদের মাঝে সেগুলি কম হচ্ছে না। অথচ সাহাবাদের তূলনায় আজকের প্রায় দেড়শত কোটির মুসলিমের অর্জন অতি সামান্য। অথচ সে আমলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। প্রতি কর্মে তাঁরা নির্দেশনা নিতেন পবিত্র কুর’আন ও হাদীস থেকে। আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতার কারণ অনেক। তবে মূল কারণটি হলো, তাদের মাঝে বিলুপ্ত হয়েছে কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান।এবং বিনষ্ট হয়েছে বা বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামী সংস্কৃতির বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। উঠেনি সুস্থ সংস্কৃতি নির্মাণের ইসলামী প্রতিষ্ঠান। অপর দিকে গড়ে তোলা হয়েছে চেতনা ও চরিত্র দূষিত করণের ব্যাপক ও ভয়ানক প্রক্রিয়া। খোদ রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে। ফলে যে ব্যক্তিটি আগে চুরি করতো না, সরকারি সম্পদের তছরুফ করতো না এবং ঘুষ খেত না, সে সরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়ে ঘুষখোর এবং পেশাদার চোর ও ডাকাতে পরিণত হচ্ছে। তেমনি গ্রামের যে সুবোধ ও ভদ্র ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দলের সন্ত্রাসী ক্যাডার ও খুনিতে পরিণত হচ্ছে। ভদ্রতা, সভ্যতা ও নায়নীতি তাদের চরিত্র থেকেই বিদায় নিচ্ছে। এদের কারণেই এক রাতে সারা দেশ জুড়ে কোটি কোটি মানুষের ভোটডাকাতি সম্ভব হয়। সরকারি প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং শাসক দলের দফতর ডাকাতপাড়ায় পরিণত না হলে কি এমন দেশজুড়ে ভোটডাকাতি কি কখনো সম্ভব হতো? এসবই হলো অপসংস্কৃতির ফসল। অপসংস্কৃতি একটি জাতিকে সভ্য ও ভদ্র হওয়ার কাজটি যে কতটা ব্যর্থ করে দেয় -এ হলো তারই দৃষ্টান্ত। কোন একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য কি এর চেয়ে বেশী কিছু লাগে?
অজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় বাধা
সুস্থ সংস্কৃতির নির্মাণে অজ্ঞতাই হলো সবচেয়ে বড় বাধা। অজ্ঞতায় সভ্যতর মানব গড়া যায় না। মানবের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াত। এজন্যই ইসলামের প্রথম জিহাদটি ছিল জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে। এ জিহাদে মূল অস্ত্রটি হলো কুর’আনী জ্ঞান। এটি এক অপরাজেয় অস্ত্র। প্রতিটি নর-নারীকে এ জ্ঞানের অস্ত্রে সজ্জিত হতে হয়। এজন্যই ইসলামের প্রথম ফরজ বিধানটি হলো জ্ঞানার্জনের, নামাজ-রোজার নয়। মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম ওহীর নির্দেশটি ছিল “ইকরা” অর্থাৎ পড়ো তথা জ্ঞানবান হও। এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট করেছেন প্রতিটি ব্যক্তিকে কি ভাবে তাঁর পছন্দের মানব রূপে বেড়ে উঠতে হয়। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে অজ্ঞতায়। জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার যে পবিত্র কুর’আন -তা থেকে তারা জ্ঞান সংগ্রহের কাজটি ছেড়ে দিয়েছে বহু আগেই। তারা দায়িত্ব সারছে এ পবিত্র কিতাবটি না বুঝে শুধু তেলাওয়াতে। ভাবটি এমন, তারা শুধু সওয়াব চায়, হিদায়েত নয়। হিদায়েত পেতে হলে তো কুর’আন বুঝতে হয়। অথচ বুঝার চেষ্টা করতে তারা রাজী নয়। না বুঝে তেলাওয়াতে যে অজ্ঞতা দূর হয় না, জ্ঞানার্জনের ফরজও যে তাতে আদায় হয় না এবং মহান আল্লাহতায়ালাও যে এরূপ অজ্ঞ থাকাতে খুশি হন না –তা নিয়ে ভাবনা ক’জনের? অমুসলিমের উপর মুসলিমের শ্রেষ্ঠত্ব তো কুর’আন-লব্ধ জ্ঞান ও দর্শনে। কিন্তু অজ্ঞতায় ও দর্শনহীনতায় কি শ্রেষ্ঠত্ব বাঁচে?
ইসলামের শত্রপক্ষের স্ট্রাটেজী মসজিদ-মাদ্রাসাগুলি ধ্বংস করা নয়। সেটি হলো মুসলিমদের কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান থেকে দূরে সরানো। ইসলামের সংস্কৃতিক প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করার এটিই হলো সফল স্ট্রাটেজী। বীজকে গজাতে দেওযার পর তাকে বেড়ে উঠার সুযোগ না দিলে সেটি নিস্ফল আয়ু পায় মাত্র, ফল দেয় না। মুসলিম সন্তানের জন্মরোধ করতে না পারলেও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে শয়তান ও তার অনুসারী বন্ধ করতে চায়। এক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। এবং সেটি ঔপনিবেশিক কাফির শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার পর থেকেই। এরই ফল হলো, আজকের প্রায় দেড়শত শতকোটি মুসলিম ইসলামের বিজয় বা গৌরব বাড়াতে কোন অবদানই রাখতে পারছে না। এহেন নিস্ফল জীবনের সবচেয়ে জাজ্বল্যমান ও নিকৃষ্টতর উদাহরণ হলো বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম। দেশটিতে পবিত্র কুর’আন অক্ষত থাকলেও পশ্চাদপদতায় রেকর্ড গড়েছে। খোদ রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলি পরিশুদ্ধির বদলে কদর্যতা এবং দুর্নীতি বাড়িয়ে চলেছে। ফলে দেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে বার বার প্রথম হওয়ার রেকর্ড গড়েছে। গুম-খুন, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, অর্থপাচার, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও ভিক্ষাবৃত্তি দেশটিতে জাতীয় সংস্কৃতির রূপ ধারণ করেছে। পতিতাবৃত্তি ও উলঙ্গতার ন্যায় পাপাচারকে না রুখে বরং সেগুলিকে ব্যাপকতর করা হচ্ছে। বিশুদ্ধকরণের বদলে যে দূষিতকরণ প্রক্রিয়া ঔপনিবেশিক দখলদার শত্রুরা চালু করেছিল -তাকে উৎখাত না করে সেটির বরং আধুনিকীকরণ হয়েছে। ফলে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও অন্য মুসলিমদের কল্যানে কিছু করা দুরে থাক, নিজেদের কল্যানেও কিছু করতে পারছে না।
বিধ্বস্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও জোয়ার অপসংস্কৃতির
জনগণের বিশ্বাস, কর্ম, চরিত্র, ভাবনা, আবেগ, খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণকে প্রভাবিত ও আন্দোলিত করে এমন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই হলো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অসংখ্য। বহু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অপসংস্কৃতির তথা দূষিতকরণ প্রক্রিয়ার অঙ্গ। এগুলি মানব সমাজকে অসভ্য ও বর্বর করে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান পরিশুদ্ধির অংশীদার। এগুলি সমাজকে সভ্য ও ভদ্র করে। যে সমাজে গুম, খুন, ধর্ষণ, ব্যভিচার, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, চাঁদাবাজী, অপহরণ ও সন্ত্রাসের সয়লাব, বুঝতে হবে সেখানে তাণ্ডবটি অপসংস্কৃতির। ইসলাম শুধু ধর্মীয় বিপ্লবই আনে না, আনে রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবও। ইসলামের সাস্কৃতিক বিপ্লব মূলকেন্দ্র হলো মসজিদ। এটিই ইসলামের দুর্গ। এটিই হলো মর্তের বুকে মহান আল্লাহতায়ালারএকমাত্র নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই দ্বীনের আলো মহল্লার অন্ধকার সরায়। এ জন্যই নবীজী (সা:) মদিনায় হিজরতের পর নিজের ঘর না গড়ে প্রথমে মসজিদ গড়েছেন। কারণ সৈনিক মাত্রই দুর্গ গড়ে এবং সেটিকে শক্তিশালী করে।
শয়তান তার প্রতিপক্ষের মূল ঘাঁটিটি চিনতে ভূল করে না। এজন্যই শয়তানের মূল টার্গেট হলো মসজিদ। শয়তানী শক্তিবর্গ ইসলামী সংস্কৃতির এই প্রাণকেন্দ্রকে বহুলাংশেই প্রাণহীন ও অকার্যকর করতে সমর্থ হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হচ্ছে নিছক নামাজ আদায়ের স্থান রূপে। নামাজের পরই সেখানে তালা লাগানো হয়। ফলে নামাজের সময় ব্যতীত লক্ষ লক্ষ মসজিদের বিশাল বিশাল অঙ্গনগুলি অধিকাংশ সময়ই অব্যবহৃত থাকছে। কুর’আন শিক্ষা, জ্ঞানের লেন-দেনে জলসা-বৈঠক, মানুষের মাঝে ভাতৃত্বের বন্ধন গড়া, সমাজসেবা, জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ সংগঠিত করা এবং জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার যে কাজগুলি একদিন মসজিদের জায়নামাজে হতো -তা আজ অধিকাংশ সময়ই জনশূণ্য। শয়তান এভাবেই ইসলামের মূল দুর্গকে সৈনিকশূণ্য করেছে। ফলে এ দুর্গ থেকে এখন আর ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ সংগঠিত হয় না। অথচ মুসলিমদের গৌরব কালে এসব কাজের জন্য মসজিদ ভিন্ন মুসলিমদের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানই ছিল না। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রূপে ক্লাব, ক্যাসিনো, যাত্রাদল, সিনেমা, নাচঘর ও নাট্যমঞ্চ এগুলির জন্ম ও পরিচর্যা পেয়েছে অমুসলিমদের হাতে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে যে সংস্কৃতি চর্চা হয় সেটিও মুসলিমের নয়। ইসলামের আলোকে এগুলি আদৌ সংস্কৃতি নয়, বরং অপসংস্কৃতি। অথচ বাংলাদেশ ডুবছে এই অপসংস্কৃতির প্লাবনে।
মসজিদের জায়নামাজে যে পবিত্রতা -সেটি অন্যত্র সম্ভব নয়। তাই সমাজীকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনে অন্যরা ক্লাব গড়লেও পবিত্রতার স্বার্থে মুসলিমগণ শুধু মসজিদই গড়েছে। তবে নিছক কয়েক মিনিটের জন্য জায়নামাজে আসাতে ব্যাক্তির জীবনে সে কাঙ্খিত পরিশুদ্ধি আসে না। নবীজী (সা:)’র সাহাবাগণ ঘন্টার পর ঘন্টা মহান আল্লাহতায়ালার এ পবিত্র ঘরে নবীজী (সা:)’র নিবীড় সাহচর্যে কাটিয়েছেন এবং দ্বীনের আলোকে নিজেদের আলোকিত করেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্লাসরুম। শিক্ষক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মহান নবীজী (সা:)। মানব ইতিহাসের সর্বসেরা শিক্ষিত মানবগুলি গড়ে উঠেছেন নবীজী (সা:)’র এই ক্লাসরুম থেকে। কিন্তু আজকের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলিম বিশ্বে আজ লক্ষ লক্ষ মসজিদ। কিন্তু মসজিদের জায়নামাজ থেকে নবীজী (সা:)’র সে পবিত্র সূন্নত বিলুপ্ত হয়েছে বহু আগেই।
পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানই মানুষকে মুসলিম বানায়। মুসলিম সমাজের গাঢ় অন্ধকার দেখেই বলা যায়, দ্বীনের আলো এখানে পূর্ণভাবে জ্বালানো হয়নি। ব্যর্থতাটি এখানে মসজিদের। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অন্ধকার সরাতে আল্লাহর এ প্রতিষ্ঠানটি আদৌ কোন সফলতা দিতে পারেনি। ফলে নির্মিত হয়নি সুস্থ সংস্কৃতি। এবং নির্মিত হয়নি ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ। ফলে মুসলিমদের মুসলিম হওয়াতেই বেজায় ফাঁকি রয়ে গেছে। মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ এই ফাঁকিবাজি। শুধু নামাজ-রোজা দিয়ে কি এই বিশাল ফাঁকিবাজী রোধ করা যায়? ইসলামের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকে রুখতে শত্রুশক্তি মসজিদকে যেমন নিষ্ক্রিয় করেছে, তেমনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নাচগান, যাত্রা, নাটক, সিনেমা, মদ্যপান, জুয়া, ড্রাগ ও বেশ্যাবৃত্তির ন্যায় নানান পাপ ও অশ্লীলতার। এগুলোর ফলে মুসলিমদের চেতনা যেমন অসুস্থ হয়েছে, তেমনি দিন দিন কদর্যতা যোগ করেছে তাদের চরিত্র, রুচিবোধ ও আচার-আচরনে। ফলে অসম্ভব হয়েছে পরিশুদ্ধ চেতনা ও চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠা। বাঙালি মুসলিম জীবনে সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা এজন্যই অতি প্রকট।
অরক্ষিত সাংস্কৃতিক সীমানা ও বিপন্ন স্বাধীনতা
সুস্থ সংস্কৃতির নির্মাণে সাহিত্য অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জ্ঞানের বিস্তারে সাহিত্য পাইপ লাইনের কাজ করে। সাহিত্যের মাধ্যমে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথাগুলো জনে জনে পৌঁছে। কিন্তু সব সাহিত্যই সুসাহিত্য নয়। বিস্তর দুষ্ট ও অশ্লীল সাহিত্যও রয়েছে। দূষিত সাহিত্যের পাইপ লাইন অগণিত মানুষের চেতনায় বিষ ছড়ায় এবং রোগের বিস্তার ঘটায়। দূষিত পানিতে দেহ রোগাগ্রস্ত হয়, দুষিত সাহিত্যে রোগাগ্রস্থ হয় জনগণের বিবেক ও চেতনার জগত। চেতনার এ রোগাগ্রস্ততার কারণেই মানুষ চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, ব্যভিচার ও রাহাজানিতে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে আজ সেটিই হচ্ছে। সংস্কৃতি হলো মানুষকে দিন দিন সভ্যতর ও পরিশুদ্ধতর করার শিল্প। মানুষ সভ্য ও পরিশুদ্ধ হয়, সমাজ সামনে এগোয়, এবং রাষ্ট্র সমৃদ্ধতর হয় -এ শিল্পের গুণেই। বাংলাদেশে আজ যে অবাধ ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, গুম-খুনের সয়লাব, সেটিই প্রমাণ করে এ সৃষ্টিশীল শিল্প এদেশে গড়ে উঠেনি। বরং বেড়েছে মানুষকে অসভ্যতর করার শিল্প অর্থাৎ অপসংস্কৃতি। এটি তো দ্রুত নীচে নামার পথ। এটির টানে আমরা যেন আঁধারের দিকে ছুটছি। আর এরূপ আঁধারের দিকে নেওয়াই তো শয়তানের কাজ, এবং সে বেঈমানদের সুহৃদ। সুরা বাকারা’তে তো সেটিই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, “যারা ঈমানদার তাদের অভিভাবক হলো আল্লাহ, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। এবং যারা কাফের তথা বেঈমান তাদের অভিভাবক হলো শয়তান। সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। এরাই হলো জাহান্নামের বাসিন্দা -সেখানে তারা চিরকাল থাকবে” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৭)। অন্ধকারের পথ মানেই পাপের পথ –বেঈমানগণ এই পথ ধরেই জাহান্নামে যায়। যারা জান্নাতের যাত্রী তাদের সাক্ষণিক চেষ্টা হয় নিজ সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামী করায়। রাষ্ট্রকে তারা নেক আমলে পূর্ণ করতে চায়। এটিই মু’মিনদের জীবনে জিহাদ। সেটি দেখা গেছে মুসলিমদের গৌরব কালে। এবং যারা জাহান্নামের যাত্রী তাদের চেষ্টা হয়, রাষ্ট্রের বুক নানা রূপ পাপ ও দুর্বৃত্তির প্লাবন আনা। এটিই শয়তানের মিশন। বাংলাদেশের বুকে শয়তান ও তার অনুসারীগণ যে কতটা বিজয়ী সেটি বুঝা যায় দেশে গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, অর্থপাচারসহ নানারূপ দুর্নীতির প্লাবন দেখে।
আবহমান লোকজ সংস্কৃতির লেবাসে যুগে যুগে মানুষকে মহান আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত করাই শয়তানের সনাতন ধর্ম। শয়তানের এ ধর্ম ওহীর কিতাব নির্ভর নয়। নবী-রাসূল নির্ভরও নয়। বরং আবহমান লোকজ সংস্কৃতি নির্ভর। সংস্কৃতির ছদ্দবেশে শয়তানী শক্তি ব্যক্তির পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়াকে চিরতরে রুখতে চায়। এটিই হিন্দুত্ববাদী অপসংস্কৃতি। বাংলাদেশে ইসলামের উপর জঘন্যতম হামলা আসছে এই অপসংস্কৃতির কর্মীদের পক্ষ থেকেই। মৌলবাদ নির্মূল করার নামে এরাই ইসলামকে নির্মূল করতে চায়। এদের কারণে জাতিকে সভ্যতর করার মাধ্যমগুলো আজ বিপর্যস্ত। গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা, যাত্রা-নাটক ও সিনেমার নামে এরা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে দিন দিন আরো অসুস্থতর করছে। বাড়ছে উলঙ্গতা, বাড়ছে অশ্লীলতা, বাড়ছে নেশাগ্রস্থতা। এতে পাড়ার ছেলেরা ধর্ষণে উৎসাহ পাচ্ছে। ফলে পাড়ায় পাড়ায় যতই বাড়ছে নাট্যদল, ক্লাব, ভিডিও ক্লাব, সিনেমা হল ততই বেড়ে চলেছে সমাজে অসুস্থ মানুষের ভিড়। এদের কারণে ৭০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের মানুষ নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধের মানদন্ডে যে পর্যায়ে ছিল, তার থেকে অনেক নীচে নেমেছে। সংস্কৃতি চর্চার নামে এ পতন-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ইসলামের নির্মূলে শত্রুশক্তির একটি তীরও ছোড়ার প্রয়োজন পড়বে না।
ধর্মীয় ও আদর্শিক ভিন্নতার কারণেই জনগণের মাঝে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার জন্ম দেয়। সে ভিন্নতার কারণেই দেশবাসী মেরুকরণের শিকার হয় ও ভিন্ন মানচিত্র গড়ে। বাংলাদেশ ভারত থেকে যে ভিন্ন মানচিত্র পেয়েছে সেটি ভিন্ন জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির কারণে নয়, সেটি ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জীবনদর্শন ও ভিন্ন সংস্কৃতির কারণে। বাঙালি মুসলিমগণ এ ভিন্ন জীবনবোধ ও সংস্কৃতি পেয়েছে ইসলাম থেকে। তাই সংস্কৃতি থেকে ইসলামের উপাদান বিলুপ্ত করা হলে ভারত থেকে বাংলাদেশের পৃথক থাকার যুক্তি বা ভিত্তিই বিলুপ্ত হবে। তখন বিপর্যস্ত হবে দেশটির স্বাধীন অস্তিত্ব। তখন দেশ দখলে শত্রুশক্তির যুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে না। ভারত সরকার ও বাংলাদেশের ভারতপন্থী হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক কর্মীরা সে স্ট্রাটেজী নিয়েই দ্র্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ফলে বাড়ছে মুর্তিনির্মাণ ও মুর্তিপূজার সংস্কৃতি। একারণেই এদের প্রতিপালনে ভারতের বিপুল বিনিয়োগ। বাংলাদেশে এ অবধি কোন শিল্পে ভারত তেমন বিনিয়োগ না করলেও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মে ও মিডিয়াতে। দিন রাত মগজ ধোলাইয়ের কাজ করছে ভারতীয় টিভিও। সে সাথে দলে দলে ভারত থেকে আসছে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী, মিডিয়াকর্মী, নাট্যকর্মী, গায়ক-গায়িকা ও সিনেমাকর্মী। একাজে যেসব বাংলাদেশী ভারতের একনিষ্ট সহযোগী রূপে কাজ করছে তাদেরকে তারা পুরস্কৃতও করছে।
দেহকে বাঁচাতে হলে খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যকে দূষিত হওয়া থেকে বাঁচাতে হয়। তেমনি জাতিকে বাঁচাতে হলে চেতনার দূষিতকরণ প্রক্রিয়াকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হয়। নইলে জাতির ধর্ম, সংস্কৃতি ও চরিত্র বাঁচে না। তাই যে পাইপ লাইনগুলি ঘরে ঘরে সংস্কৃতির নামে জনগণের মগজে চেতনা-ধ্বংসের জীবাণু পৌঁছে দিচ্ছে -বিচ্ছিন্ন করতে হয় সেগুলির সংযোগও। নিজ ধর্ম ও নিজ সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচার স্বার্থে জাতিকে তাই শুধু ভৌগলিক সীমানা পাহারা দিলে চলে না, সাংস্কৃতিক সীমানাও পাহারা দিতে হয়। বুঝতে হবে অস্ত্রের যুদ্ধ সীমান্তের রণাঙ্গণে মাঝে মধ্যে হয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ প্রতিদিন ও প্রতিমুহুর্ত হয়। তাই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরক্ষার যুদ্ধে চাই বিপুল সংখ্যক লড়াকু যোদ্ধা। অথচ বাঙালি মুসলিমের জীবনে সে কাজটিই হচ্ছে না। এ যুদ্ধের গুরুত্বই বা ক’জন বুঝছে? ফলে প্লাবনের পানির ন্যায় ধেয়ে আসছে শত্রু শক্তির সাংস্কৃতিক স্রোত। এ মুহুর্তে জরুরি শুধু সংস্কৃতির সংস্কারই নয়, বরং চাই প্রবল সাংস্কৃতিক প্রতিরক্ষাও। নইলে বাঙালি মুসলিমের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকাই যে কঠিন হবে -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? ১ম সংস্করণ ০৩/০৮/২০০৩; ২য় সংস্করণ ১৮/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018