স্বপ্নের গুরুত্ব ও স্বপ্ন দেখতেই মুসলিমদের ব্যর্থতা

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

স্বপ্নের মাঝেই ঈমান ও বেঈমানী

প্রতিটি মানুষই কোন না কোন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। তবে এ স্বপ্ন সে স্বপ্ন নয় যা মানুষ ঘুমের গভীরে অবতেচন মনে দেখে। এটি সে স্বপ্নের কথা যা মানুষ সজ্ঞানে চোখ কান খোলা রেখে দেখে। এ স্বপ্ন দেখে ব্যক্তি তার সকল জ্ঞান- বুদ্ধি  ও চিন্তা-ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে।  মানব দেহের সুস্থতা ধরা পড়ে তার শারীরিক শক্তির মধ্যে। তেমনি তার চেতনার স্বাস্থ্য ধরা পড়ে তার স্বপ্নের মধ্যে। এজন্যই একজন জ্ঞানী ও অজ্ঞ মানুষের স্বপ্ন যেমন এক হয়না, তেমনি কখনোই এক হয় না বেঈমান এবং ঈমানদারের স্বপ্ন। বস্তুত ব্যক্তির চেতনা, দর্শন, ঈমান এবং বেঈমানি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কথা বলে। বস্তুত স্বপ্নের মধ্যেই প্রকাশ পায় একজন ব্যক্তির সঠিক প্রতিচ্ছবি।

স্বপ্ন দেখার জন্যও সামর্থ্য লাগে। লাগের চেতনার বল। শ্রেষ্ঠ মানুষের পরিচয় মেলে তাঁর শ্রেষ্ঠ স্বপ্নের মাঝে। ব্যক্তির ঈমানদারীরও প্রকৃত পরিচয় মেলে তাঁর স্বপ্নের মাঝে। তাই কোন জাতিকে চিনতে হলে জানতে হয় সে জনগণের স্বপ্নকে। জাতির সে স্বপ্ন ধরে পড়ে সে জাতির রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, সাহিত্য কর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মাঝে। তাই কোন জাতির গোত্রবাদী, জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী স্বপ্নপূরণের রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তি দেখে নিশ্চিত বুঝা যায় সে জাতির মাঝে সঠিক ইসলাম তাদের মাঝে বেঁচে নাই। গৌরব যুগের মুসলিমদের থেকে আজকের মুসলিমদের কর্ম, চরিত্র ও মানবতায় যে বিশাল পার্থক্য সেটি তাদের নাম-পদবী, গায়ের রং, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে পার্থক্যের কারণে নয়। বরং সে পার্থক্যটির কারণ, উভয়ের স্বপ্ন দেখায় পার্থক্য। শ্রেষ্ঠ স্বপ্নই ব্যক্তিকে ও জাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়। তেমনি কোন ব্যক্তি বা জাতির ক্ষুদ্র স্বপ্ন ইতর পরিচিত দেয়। গৌরব যুগের মুসলিমদের বিশাল মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে কাজ করেছিল তাদের বিশাল স্বপ্ন। তাদের স্বপ্নে ছিল মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার তাড়না। কিন্তু আজকের মুসলিমদের ক্ষুদ্রতা  ও ছোটলোকির মূল কারণটি হলো, নিজেদের ক্ষুদ্র চিন্তা, ক্ষুদ্র ব্যক্তি-স্বার্থ, ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থকে বিজয়ী করার স্বপ্ন। এবং তাতে নাই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার তাড়না। এরূপ ক্ষুদ্র স্বার্থ হাছিলের স্বপ্নই তাদের জন্য মহত্বর ও শ্রেষ্ঠতর হওয়া অসম্ভব করছে। বরং দিন দিন নামছে নীচের দিকে।

একজন মানুষ কীরূপ স্বপ্ন দেখবে -সেটি নির্ভর করে তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তার নিজের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দর্শন ও বিবেকবোধের উপর। এসব ক্ষেত্রে বিপ্লব এলে ব্যক্তির স্বপ্নেও বিপ্লব আসে। ইংরেজিতে এরূপ স্বপ্নকে বলা হয় vision। ব্যক্তির vision বলতে বুঝায় সে ভবিষ্যতে কোথায় পৌঁছতে চায় বা কি করতে চায় -সেটি। সে visionটি ব্যক্তির নিজ মনের গভীরে কাঙ্খিত ভবিষ্যতের একটি জীবন্ত চিত্র খাড়া করে। সে স্বপ্ন বা ভিশন নিয়েই তার আমৃত্যু বসবাস। তার সকল চেষ্টা-সাধনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল কারণ সে স্বপ্ন পূরণের প্রবল তাড়না। একজন ঈমানদারের স্বপ্নের জগতে যে চিত্রটি সদা জাগ্রত থাকে সেটি হলো অফুরন্ত নিয়ামত ভরা বিশাল জান্নাতের। সে দিবারাত্র স্বপ্ন দেখে সে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছার। ফলে তাঁর সমগ্র দৈহিক, আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য কাজ করে সে স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার রূপে। সে স্বপ্ন পূরণের জন্যই তাঁর জীবনে আসে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও জিহাদ। সে স্বপ্ন থেকে জিহাদ জন্ম নেয় সেটিই ব্যক্তি ও জাতির জীবনে ইঞ্জিনের কাজ করে। তাই স্বপ্ন না থাকার অর্থ ব্যক্তি ও জাতির জীবনে ইঞ্জিন না থাকা।  তখন যে তাড়নাটি তার মনে সর্বক্ষণ কাজ করে সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কীরূপে প্রিয়তর হওয়া যায় -সেটি। এবং কীরূপে তাঁর  থেকে মাগফিরাত জুটে -তা নিয়ে। এমন একটি স্বপ্নই ঈমানদারের জীবনে লাগাতর পরিশুদ্ধি আনে। জিহাদ এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। জিহাদই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতিকে সভ্যতর ও পরিশুদ্ধিতর করে। নইলে বর্বর ও অসভ্যতর হয়। ইসলামের গৌরব যুগের সকল সাফল্যের মূল ছিল এই জিহাদ।

 

 ঈমানদারের স্বপ্ন ও বেঈমানের স্বপ্ন

 ঈমানদারের স্বপ্নে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার কাছে পূর্ণ আনুগত্যের তাড়না। তাই যেখানেই তাঁর হুকুম, সেখানেই ঈমানদার বলে লাব্বায়েক। তাই সে শরিয়ত নিয়ে বাঁচে। কিন্তু বেঈমানের স্বপ্নে থাকে বিদ্রোহ। তাই আদালত থেকে শরিয়তী আইনকে বিদায় দেয়। ঈমানদারের স্বপ্নের থাকে দু’টি ভিন্ন ক্ষেত্র ও দু’টি রূপ। একটি স্বপ্ন হলো অন্তহীন আখেরাতকে নিয়ে। অপরটি হলো এ পার্থিব দুনিয়াকে নিয়ে। আখেরাত নিয়ে মুমিনের স্বপ্নে চির জাগ্রত থাকে জান্নাত প্রাপ্তির বাসনা। পার্থিব জীবনের সে স্বপ্নটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার একজন অনুগত খলিফা রূপে বাঁচার। তাঁর খলিফা রূপে সে স্বপ্ন দেখে তাঁর প্রভুর সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠায় ও দেশের আদালতে তাঁর শরিয়ত পালনে। তখন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পূরণই তাঁর মূল স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সে স্বপ্নের ভূবনে থাকে কীরূপে জান্নাতে পৌঁছা যায় -সে ভাবনা।

মুমিনের ইহকালীন জীবনের স্বপ্নটি গড়ে উঠে আখেরাতের স্বপ্ন পূরণের অনিবার্য প্রয়োজন থেকে। কারণ, পার্থিব জীবনের স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়েই সে আখেরাতের স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনা দেখে। বরং বলা যায়, আখেরাত নিয়ে ব্যক্তির যে স্বপ্ন, বস্তুত সেটিই তার পার্থিব জীবনের স্বপ্ন ও এজেন্ডা নির্ধারণ করে দেয়। তখন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পূরণই ঈমানদারের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যই যার জীবনে জান্নাতপ্রাপ্তির স্বপ্ন নেই, তার জীবনে মহা আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাপূরণ নিয়ে কোন আগ্রহ থাকে না। কোন স্বপ্নও থাকে না। এখানেই বেঈমানের চরম ভাবনা-শূণ্যতা ও সংকট। আখেরাতের ভয়-ভাবনা না থাকায় তার জীবনে আখেরাতের স্বপ্ন পূরণের তাড়নাও থাকে না। এজন্যই সে ব্যর্থ হয় জান্নাতে পৌঁছতে।

দর্শন ও বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে ঈমানদারের এজেন্ডা এবং বেঈমানের এজেন্ডা কখনোই একই মোহনায় মিলিত হয় না।উভয়ের মাঝে সংঘাত তাই অনিবার্য। রাজনীতি কি? রাজনীতি হলো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অঙ্গণে একটি বিশেষ বিশ্বাস, দর্শন ও এজেন্ডাকে বিজয়ী করার আমৃত্যু লড়াই। ইসলামে এটিই হলো জিহাদ। তাই যার জীবনে স্বপ্ন তথা ভিশন ও এজেন্ডা থাকে তার একটি রাজনৈতিক মিশনও থাকে। এজন্য ঈমানদার মাত্রই যেমন ভিশনারী, তেমনি মিশনারীও। কোন ব্যক্তির জীবনে সেরূপ এক মিশন না থাকার অর্থই হলো কোন বিশেষ বিশ্বাস, দর্শন ও ভিশন না থাকা। ঈমানদারের জীবনে সেটি অসম্ভব। ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো, কুর’আনী দর্শন ও ভিশন নিয়ে বাঁচা। ঈমানদারের রাজনীতিতে এজন্যই একটি মিশনও এসে যায়।

বেঈমানেরও রাজনৈতিক স্বপ্ন থাকে। তার স্বপ্ন হয়, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠা। তাই সে গোত্রবাদী,জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদী হয়। কিন্তু ঈমানদারের স্বপ্নে কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ব হওয়ার তাড়না। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাটি কি? সেটি হলো, “লি‌’ইউযহিরাহু আলাদ্বীনি কুল্লিহি।” অর্থ: সকল ধর্ম, সকল মতবাদ ও সকল জীবন দর্শনের উপর ইসলামের বিজয়। সে স্বপ্নের অঙ্গণে তখন কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করার এজেন্ডা। এজন্যই একজন ঈমানদারের রাজনৈতিক স্বপ্ন হয় মুসলিমদের মাঝে ভাষা ও অঞ্চলের নামে গড়ে উঠা বিভক্তির প্রাচীর ভেঙ্গে একতা প্রতিষ্ঠার তাড়না। ঈমানদারের রাজনীতিতে তখন দেখা যায়, বিদেশী শক্তির গোলমীর জিঞ্জির ভেঙ্গে বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার স্বপ্ন। এজন্যই ঈমানদারের বাঁচাটি শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে শেষ হয় না, তাকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পূরণের স্বপ্ন নিয়েও বাঁচতে হয়।এমন একটি স্বপ্ন দেখা দিয়েছিল মুসলিমদের গৌরব যুগে। ফলে তাদের হাতে নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তির। এবং তাদের হাতেই নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতির। বিপ্লব এনেছিল জ্ঞানের রাজ্যেও। পবিত্র কুর’আনের আগে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ ছিল না। কিন্তু ইসলামের বিজয়ে সে আরবী ভাষা পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায়।

 

কুর’আন শেখায় স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে

পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত বয়ান অনুযায়ী মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এটিই কাঙ্খিত যে প্রতিটি মুসলিম বাঁচবে একটি শাশ্বত স্বপ্ন তথা ভিশন ও মিশন নিয়ে। সে ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচার কারণেই সুরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে মুসলিমদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মুসলিমদের উত্থান ঘটানো হয়েছে বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য। সেটি যেমন দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, তেমনি জান্নাতের পথ দেখানো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলোস, আজকের মুসলিমগণ সে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে না। তারা নিজেরাই বাঁচছে দুর্নীতি ও অকল্যাণ নিয়ে। তাদের মাঝে পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত সে ভিশন যেমন বেঁচে নাই, তেমনি বেঁচে নাই সে কুর’আনী মিশন। তারা বাঁচে শুধু তাদের ব্যক্তি স্বার্থ পূরণের স্বপ্ন নিয়ে। তারা নাই সিরাতাল মুস্তাকীমে।

মু’মিনের চেতনার জগতে পবিত্র কুর’আনের সুরাগুলি জান্নাতের ও সে সাথে জাহান্নামের চিত্র খাড়া করে। সে চিত্রটি দেখা যায় সুরা রহমান, সুরা ওয়াকিয়া, সুরা ইয়াসীন, সুরা কাহাফ এরকম বহু সুরাতে। সে সুরাগুলিতে জান্নাতের অনন্ত-অসীম কালের জন্য শান্তিময় পরিবেশের চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে তেমনি আঁকা হয়েছে জাহান্নামের আযাবপূর্ণ চিত্র। সে চিত্র একজন মু’মিনকে প্রবল ভাবে আগ্রহী করে জান্নাতের দিকে ছুটতে। সে প্রবল স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার তাড়নাতেই ঈমানদারের জীবনে আসে জিহাদ এবং আসে সে জিহাদে শহীদ হওয়ার প্রস্তুতি। সে স্বপ্নই তাকে দূরে রাখে জাহান্নামের পথ থেকে। পবিত্র কুর’আন যে যত বেশি বেশি পড়ে  তার মনে ততই সৃষ্টি হয় সে কুর’আনী ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচার তাড়না।  কিন্তু সেরূপ তাড়না কখনোই কোন বেঈমানের মধ্যে দেখা যায় না। দেখা যায় না তাদের মাঝেও যারা কুর’আন না বুঝে স্রেফ তেলাওয়াত করে।

স্বপ্ন দেখতে অর্থ ব্যয় হয়। শক্তিও লাগে না। কিন্তু লাগে বলিষ্ঠ ঈমান। ‌লাগে দর্শন। লাগে গভীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞান ‌-বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের জ্ঞান তথা ওহীর জ্ঞান। এ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাবে মানুষ ব্যর্থ হয় সঠিক স্বপ্ন দেখতে। এজন্যই ইসলাম যে ইবাদতটি প্রথম ফরজ করা হয়েছিল সেটি নামাজ-রোজা বা হজ্জ-যাকাত নয়। সেটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন। জ্ঞানহীনরাই বেঈমান হয়, তারাই পশুতে বা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়।সে ঘোষণা এসেছে পবিত্র কুর’আনে। পশুর জীবনে স্বপ্ন থাকে না, থাকে পানহার ও যৌন ক্ষুধা নিয়ে বাঁচার জৈবিক তাড়না। পশু চালিত হয় তা প্রবৃত্তির ক্ষুধা দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে নয়। ইবলিস শয়তানও চায়, মানুষ বাঁচুক তার জৈবিক ক্ষুধা নিয়ে। চায়, মানুষের মগজ থেকে বিলুপ্ত হোক জান্নাতপ্রাপ্তির তাড়না। শয়তান আরো চায়, মানুষের সকল সামর্থ্য ব্যয় হোক শুধু তার জৈবিক তাড়না পূরণে।

চোর-ডাকাতদের জৈবিক তাড়নাটি হয় কি করে বেশি বেশি চুরি বা ডাকাতি করা যায় তা নিয়ে। তেমনি একজন স্বৈরাচারি শাসকের মূল তাড়না হয় যে কোন ভাবেই হোক ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে। শেখ হাসিনা তাই ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি ও এক দলীয় নির্বাচনে নামে। এবং সন্ত্রাসের হাতিয়ার বানায় পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ সকল রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে। ক্ষমতায় গিয়ে এরূপ  স্বৈরাচারি সরকারের সর্বক্ষণের তাড়নাটি হয়, কি করে বেশি বেশি অর্থ লুট করা যায় এবং কি করে মানুষের উপরে ফেরাউনের ন্যায় নিজেকে খোদা রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় -তা নিয়ে। তাদের জীবনে জান্নাত পাওয়া বা জাহান্নাম থেকে বাঁচার তাড়না কাজ করে না। ফলে নৃশংস, নির্মম ও বর্বর হতে তাদের জীবনে কোন বাধাই থাকে না। এরূপ শাসকদের নমুনা হলো, গুজরাতের খুনি নরেন্দ্র মোদি, মিশরের খুনি আবুল ফাতাহ আল সিসি,  সিরিয়ার খুনি বাশার আল আসাদ এবং বাংলাদেশের ভোটডাকাত ও শাপলা চত্বরের খুনি শেখ হাসিনা । এরা সবাই তাড়িত হয় নিজেদের প্রবৃত্তির তাড়নায়। প্রবৃত্তির সে তাড়না পূরণে কোন নৃশংস কর্ম করতেই  তারা পিছপা হয় না। ক্ষমতা পেলে তারা গুম, খুন, সন্ত্রাস, অপহরণ গণহত্যা ও গণনির্যাতনের নামে। এরা জাতীয়তাবাদী হয়, বর্ণবাদী হয়, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী হয়।

 

স্বপ্ন কীরূপে নিজে পাল্টায় এবং কীরূপে ভূ-রাজনীতি পাল্টায়?

মানুষের চেতনা, দর্শন ও বিশ্বাস পাল্টে গেলে তার স্বপ্নও পাল্টে যায়। তখন পাল্টে যায় দেশের রাজনীতি। এমনকি দেশের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রও। ইসলামের পূর্বে আরবের জাহেলগণ যে স্বপ্ন দেখতো সে স্বপ্নটি ছিল নিজেদের গোত্রীয় পরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠার। তাদের যুদ্ধ-বিগ্রহে থাকতো প্রবল গোত্রবাদি চেতনা।  তারা অন্য গোত্রের মানুষদের শত্রু মনে করত। ফলে জাহেলী যুগের আরবগণ ছিল গোত্রবাদি চেতনার প্রাচীরে বিভক্ত।  অসম্ভব ছিল সে বিভক্ত আরবদের মাঝে একতা প্রতিষ্ঠা করা। ফলে তাদের কোন রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। কিন্তু ইসলাম তাদের দর্শন পাল্টে দেয়। ফলে পাল্টে যায় তাদের স্বপ্ন। ফলে পাল্টে যায় আরব মুসলিমদের ভূ-রাজনীতি। তাদের চিত্তে স্থান পায় ঈমানের ভিত্তিতে একটি ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ রূপে বেড়ে উঠার স্বপ্ন। সে স্বপ্নে স্থান পায় অন্য গোত্র, অন্য ভাষা ও অন্য ভূগোলের মানুষের সাথে সীসাঢালা প্রাচীরসহ একতার। মুসলিমদের চেতনা রাজ্যে এরূপ বিপ্লব আসাতেই তাদের হাতে জন্ম নিয়েছিল সে আমলের সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তির।

দর্শন পাল্টে গেলে জনগণের স্বপ্ন ও দেশের ভূ-রাজনীতি যে পাল্টে যায় তারই আরেক প্রমাণ হলো বাঙালি মুসলিমগণ। বাঙালি মুসলিমদের চেতনার জগতে ইসলামের জাগরণ এসেছিল ১৯৪৭-পূর্ব কালে। তখন ব্রিটিশদের বিদায়ের দিন। তখন মুসলিমদের জন্য বিপদ বাড়ে হিন্দুত্ববাদী শাসনের। সে বিপদ থেকে বাঁচতেই বাঙালি মুসলিমের মনে স্বপ্ন জাগে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। ঢাকার বুকে তারা প্রতিষ্ঠা দেয় মুসলিম লীগের। সে স্বপ্ন পূরণের অনিবার্য প্রয়োজনেই তাদের মধ্যে প্রবলতর হয়েছিল ভারতের অন্য ভাষা ও অন্য প্রদেশের অবাঙালি মুসলিমদের সাথে একতাবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা। সে স্বপ্ন পূরণ করতেই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা পায় পাকিস্তান।

কিন্তু  পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিমের চেতন রাজ্যে অনুপ্রবেশ করতে থাকে ইসলামশূণ্য সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী দর্শন। তাতে তাদের স্বপ্নও পাল্টে যায়। তাদের মধ্যে জেগে উঠে নিজেদের মুসলিম পরিচয় ছেড়ে বাংলা ভাষা ভিত্তিক বাঙালি পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠার স্বপ্ন। তাদের মুখে তখন ধ্বণিত হতে থাকে ১৯৪৭’য়ের কলকাতা ও দিল্লির বয়ান। ফলে ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন  করেছিল, তারাই ১৯৭১’য়ে এসে মুসলিমদের  বহুলপরিচিত শত্রু ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের সহায়তা নিয়ে সে পাকিস্তানকে খন্ডিত করে। তাই মানবের স্বপ্ন পাল্টাতে হলে প্রথমে তার দর্শনকে পাল্টাতে হয়। মহান নবীজী (সা:) তো সে কাজটিই প্রথমে করেছেন। দর্শন পাল্টানোর সে কাজটি তিনি করেছেন মক্কী জীবনের ১৩ বছর যাবত। চিন্তার মডেল পাল্টানোর এই কাজকে ইংরেজীতে বলে প্যারাডাইম শিফট।

 

স্বপ্নের গুরুত্ব ও মূল্য

 স্বপ্নের অপরিসীম গুরুত্ব ও মূল্য রয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে। তিনি শুধু মানুষের কর্ম দেখেন না, দেখেন কোন স্বপ্ন পূরণের তাড়না নিয়ে সে বাঁচে ও প্রাণ দেয় সেটিও। স্বপ্নের মধ্যেই ধরা পড়ে ব্যক্তির বাঁচা-মরা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের নিয়েত। স্বপ্ন বা নিয়েত যদি ঈমানশূণ্য ও আল্লহতায়ালার এজেন্ডাশূণ্য হয় তবে কোটি কোটি টাকা দানেও কোন সওয়াব নাই। এমন কি যুদ্ধে কষ্টস্বীকার ও নিজের জীবন দানেও কোনো সওয়াব নাই। সে ভ্রান্ত স্বপ্ন ও ভ্রান্ত নিয়েত নিয়ে বাঁচা ও প্রাণ দানের কারণে গোত্রবাদী ও জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার যোদ্ধাদেরকে জাহান্নামের আগুনে গিয়ে হাজির হতে হয়। এজন্যই নিজের কর্ম, ইবাদত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ঠিক করার আগে নিজের নিয়েত ও স্বপ্নকে প্রথমে ঠিক করতে হয়। তাই শুধু নামাজ-রোজায় নিয়েত বাঁধলে চলে না, নিয়েত বাঁধতে হয় প্রতি দিনের বাঁচা ও লড়াইয়েও। পবিত্র কুর’আনে নিয়েতের সে পাঠটি দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। অবশ্যই পঈমানদারকে বাঁচতে হয় সে সর্বজ্ঞানী প্রভুর শেখার নিয়েত নিয়ে। সে নিয়েতটি হলো:  “ইন্নাস সালাতি ওয়া  নুসূকী ওয়া মাহ’হিয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন”। অর্থ: আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার বেঁচে থাকা ও আমার মৃত্যু সবই এ বিশ্ব জগতের মহান প্রতিপালকের জন্য। এজন্যই কোন ঈমাদার কোন গোত্রীয়, দলীয়, জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে তাঁর সামান্যতম শ্রম, সময়, অর্থ, মেধা বিনিয়োগ করে না। কারণ, এমন বিনিয়োগ তাকে জাহান্নামে হাজির করে। তাকে বুঝতে হয়, তার সকল সামর্থ্য মহান আল্লাহতায়ালার নিয়ামত। তাই সেগুলির বিনিয়োগ ঘটাতে হয় একমাত্র তাঁর দ্বীনের বিজয় বাড়াতে।

একজন মানুষ তার নিজের স্বপ্নটি সফল করতে পারবে কিনা -সেটি বিষয়টি কখনোই নিজ সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে না। সকল কাজের সাফল্য তো পুরোপুরি মহান আল্লাহতায়ালার হাতে। তাই স্বপ্ন পূরণের কোন সওয়াব নাই। ব্যক্তি সাওয়াব পায় সঠিক স্বপ্ন দেখার মাঝে এবং সে স্বপ্ন পূরণে তার সামর্থ্যের বিনিয়োগের কারণে। প্রকৃত ঈমানদার মাত্রই স্বপ্ন দেখে নিজ ভাষা, নিজ বর্ণ, নিজ গোত্র ও নিজ আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে। সে নানা দেশ, নানা ভাষা ও নানা ভূগোলের মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একতাবদ্ধ এক উম্মাহর নির্মাণে জিহাদ করে। তাঁর স্বপ্নটি বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর বেড়ে ওঠার। এ কাজ অতি কঠিন। সফল হওয়া আরো কঠিন। এ বিশাল কাজ অনেক ত্যাগ ও কুরবানী চায়। কিন্তু একজন ঈমানদার সওয়াব পাবে এবং জান্নাতে যাবে সে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা এবং সে স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে কুরবানীর জন্য। এজন্যই একজন ঈমানদারকে শুধু স্বপ্ন নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাঁকে বাঁচতে হয় জিহাদ নিয়েও। ‌‌কিন্তু একজন বেইমানের সেরূপ স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না সে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার লড়াই।

তবে এর অর্থ এই নয় যে, বেঈমানদের জীবনে কোন যুদ্ধ নাই। তাদের জীবনে শুধু যুদ্ধ নয়, লাগাতর প্রচেষ্টা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কুরবানীও আছে। এ পথে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণও দেয়। কিন্তু সে ত্যাগ তাদের জীবনে কোন সফলতা দেয় না। বরং শুধু ব্যর্থতাই বাড়ায় এবং আখেরাতে জাহান্নামে হাজির করবে। মহান আল্লাহতায়ালার ভাষায় এরাই হলো মহা ক্ষতির মধ্যে। পবিত্র কুর’আনে সে হুশিয়ারী বার বার এসেছে।  ১০/০৪/২০২৩।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *