বাংলাদেশের বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যর্থ রাষ্ট্র
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on May 13, 2023
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
সকল ব্যর্থতার কারণ ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থা
প্রতিটি মানব সন্তানকে শুধু পানাহারে বাঁচিয়ে রাখাই মহান আল্লাহতায়ালার মূল এজেন্ডা নয়। তিনি চান, মানবকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রূপে গড়ে তুলতে। সে এজেন্ডা পূরণে তিনি শুধু খাদ্যপানীয়’র ব্যবস্থাই করেননি, সর্বোত্তম শিক্ষাদানের আয়োজনও করেছেন। সেরূপ শিক্ষাকে সুনিশ্চিত করতেই তিনি নাযিল করেছেন পবিত্র কুর’আন। পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ও উদ্ভিদের ন্যায় অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে সেরূপ কিতাব প্রেরণ ও জ্ঞানদানের কাজটি ঘটেনি। শিক্ষাদানের কাজটি যথার্থ ভাবে না হলে যে লক্ষ্যে মানবকে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রূপে সৃষ্টি করেছেন -সেটিই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই মানবের সকল সাফল্যের মূলে থাকে যেমন তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থা, তেমনি সকল ব্যর্থতা ও বিপর্যের মূলে থাকে তার ব্যর্থ শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই বাংলাদেশের ন্যায় কোন জাতি যখন গুম, খুন, ধর্ষণ,ফ্যাসিবাদ, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতির ন্যায় দুর্বৃত্তিতে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে তখন তার ব্যর্থতার মূল কারণটি খুঁজতে হয় তার শিক্ষা নীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে।
মানব কীরূপে মানবিক গুণে বেড়ে উঠবে, কীরূপে সে মহান আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালন করবে এবং কীরূপে সে জান্নাতের যোগ্য হবে –সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে কে অধিক জানে? মানব সন্তানদের সুশিক্ষিত করাটি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কতটা গুরুত্ব রাখে -সেটি সুস্পষ্ট বুঝা যায় তাঁর পক্ষ থেকে লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ এবং বহু আসমানী কিতাব নাযিলের মধ্যে। সে লক্ষ্যে পবিত্র কুর’আন হলো সমগ্র মানব জাতির জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্সট বুক। এজন্যই পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানলাভ মুসলিম জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পবিত্র কুর’আনে জ্ঞানদানের যথার্থ আয়োজন ছাড়া কোন মুসলিম দেশের শিক্ষানীতিই প্রণীত হতে পারে না।
বস্তুত একটি দেশ কতটা মুসলিম বা ইসলামী -সেটি বুঝা যায় তার শিক্ষানীতি দেখে; মসজিদ-মাদ্রাসা গণনা করে নয়। পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞান লাভ ছাড়া পশুবৎ ইতর জীব হওয়া থেকে কখনোই পরিত্রাণ মেলে না, তেমনি মুক্তি মেলে না জাহান্নামের যাত্রী হওয়া থেকেও। তাই যাদের কুর’আন বুঝার সামর্থ্য নাই, তাদের বাঁচতে হয় ঈমানে অপূর্ণতা ও দুর্বলতা নিয়ে। তাই শিক্ষাদান ও শিক্ষার্জনের মূল লক্ষ্য হলো কুর’আন বুঝার সে সামর্থ্য অর্জন। মুসলিমদের গৌরবযুগে তো সেটিই গুরুত্ব পেয়েছিল। সেটি শুধু আরবদের মাঝে নয়, অনারব মুসলিমদের মাঝেও। সেটি বুঝা যায় মিশর, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া,সুদান, মরক্কো, তিউনিসিয়া ও আলজিরিয়ার মত দেশে অভূতপূর্ব ভাষা বিপ্লব থেকে। সে বিপ্লবে অনারব এই দেশগুলির ভাষা আরবী হয়ে যায়।
মুসলিমগণ যখন গৌরবের শীর্ষে ছিলেন এবং তাদের হাতে যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল –তখন সে সাফল্যের মূলে ছিল তাদের কুর’আনী জ্ঞান। বস্তুত সে জ্ঞানই ব্যক্তির চেতনা, দর্শন, কর্ম, আচরণ ও সংস্কৃতিতে বিপ্লব আনে। মানব তখন মহামানবে পরিণত হয়। নইলে মানব সন্তান অতি অসভ্য ও নৃশংস কাফেরে পরিণত হয়। মুসলিম বিশ্বে আজ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতি নেই। কমতি নেই ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাতেও। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মুসলিমগণ ইতিহাস গড়ছে ভাতৃঘাতী বিভক্তি, দুর্বৃত্তি, স্বৈরাচার, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। গণতন্ত্র, মানবতা ও মৌলিক মানবিক অধিকার অধিকাংশ মুসলিম দেশেই কবরে শায়ীত। উন্নয়নের সূচকে (development indicators) নীচে নামায় তারা কাফেরদেরও হার মানিয়েছে। ব্যর্থতার কারণটি তাদের ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ, ছাত্ররা তাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন শেষ করে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য অর্জন না করেই। পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানকে সিলেবাসের বাইরে রাখায় ছাত্রদের দর্শন, কর্ম, চরিত্র ও মূল্যবোধে কোন বিপ্লবই আসছে না।
প্রশ্ন হলো, কুর’আনী জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান লাভ ও সে জ্ঞানের অনুসরণ ছাড়াই এ জগতে বিজয় লাভ, সম্মান লাভ ও শান্তি লাভ সম্ভব -সেটি বিশ্বাস করলে কি কাফির হওয়ার জন্য মূর্তিপূজার প্রয়োজন পড়ে? অথচ এমন একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস দখল জমিয়ে আছে মুসলিম দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ণধারদের মগজে। ফলে পবিত্র কুর’আন থেকে শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভের বিষয়টি বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির পাঠ্যক্রমে আদৌ গুরুত্ব পায়নি। ফলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্য়ালয়ে বহু দর্শন, বহু ইতিহাস এবং নানা লোকের বহু সাহিত্য পড়ানো হলেও পড়ানো হয়না পবিত্র কুর’আন ও হাদীস। জ্ঞানার্জন ফরজ। কিন্তু কুর’আন ও হাদীসের জ্ঞানলাভ ছাড়া কি সে ফরজ কখনো আদায় হয়? বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষানীতির এটিই হলো সবচেয়ে ভয়ানক ব্যর্থতা। কুর’আন বুঝার সামর্থ্য অর্জিত না হলে কি কখনো ন্যায়-অন্যায় চেনা, সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার সামর্থ্য সৃষ্টি হয়?
রাস্তার দু্’পাশে যে অসংখ্য সাইন বোর্ড -সেগুলি দেখা ও বুঝার সামর্থ্য না থাকলে পৃথিবীর কোন দেশেই এমন অযোগ্য ব্যক্তিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়না। কারণ, সে সাইন বোর্ডগুলি দেয় বিপদ-আপদের আগাম হুশিয়ারি ও পথের নির্দেশনা। সেগুলি না বুঝে সঠিক পথে ও সঠিক ভাবে গাড়ি চালনা অসম্ভব। সে সামর্থ্য অন্ধ ও অবুঝ ব্যক্তিদের থাকে না। রাস্তায় গাড়ি চালাতে নামলে তারা দুর্ঘটনা ঘটায়। সেরূপ বিপদ ঘটে জীবনচালনার ক্ষেত্রেও। এ পার্থিব জীবনে বস্তুত প্রতিটি ব্যক্তিই ড্রাইভার। নিজ জীবন-গাড়ির স্টিয়ারিংটি তো তারই হাতে। এখানে দায়ভারটি আরো গুরুতর; এখানে পথ হারালে পৌঁছতে হয় অনন্ত অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুনে। তাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্কিল বা দক্ষতাটি ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রশাসনিক বা বৈজ্ঞানিক পেশার নয়, বরং সেটি সঠিক পথে ও সঠিক ভাবে জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা। সে লক্ষ্যে পবিত্র কুর’আন হলো একমাত্র সঠিক রোড ম্যাপ। তাই সঠিক পথে জীবন পরিচালনা করতে হলে পবিত্র কুর’আন বুঝতেই হবে। এছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। কুর’আন থেকে দিক নির্দেশনা না নিলে বিপথগামী হতেই হবে। কুর’আনী জ্ঞানের অপরিসীম গুরুত্ব তো একারণেই।
পবিত্র কুর’আন দেয়, কোনটি হারাম ও হালাল, কোনটি শ্লীল ও অশ্লীল এবং কোনটি ন্যায় ও অন্যায় -সে বিষয়ে সিগনাল। সে সিগনালগুলি দেখা, বুঝা ও অনুসরণের যোগ্যতা না থাকলে পথভ্রষ্টতা অনিবার্য। সে পথভ্রষ্টতা জাহান্নাম নেয়। আজ মুসলিম দেশগুলির রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদলত ও প্রশাসনে যে প্রচণ্ড পথভ্রষ্টতা -তার কারণ তো কুর’আনী বিধি-নিষেধগুলি নিয়ে অজ্ঞতা এবং সেগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্রোহের কারণে বিপুল ভাবে বেড়েছে পথভ্রষ্ট মানুষের সংখ্যা। এদের কারণেই এমন কি মুসলিম দেশেও পরাজয় বেড়েছে ইসলামের। ফলে বেঁচে নাই নবীজী (সা:)’র আমলের ইসলাম। যে ব্যক্তির সমগ্র জীবন কেটেছে কুর’আন অর্থসহ না বুঝে পড়ে, সে সামর্থ্য তার মধ্যে সৃষ্টি হবে কীরূপে? সে যে পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামমুখি -সেটিই বা বুঝবে কীরূপে? সেটি বুঝতে হলেও তো সিরাতাল মুস্তাকীমের রোডম্যাপটি চিনতে হয়। একমাত্র তখনই জানা সম্ভব, তার নিজের অবস্থান সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে কতটা দূরে। সঠিক পথটি জানা থাকলেই তো নিজের পথভ্রষ্টতা টের পাওয়া যায়।
তবে এখানে বিষয়টি শুধু অজ্ঞতার নয়, বরং সেটি ইসলামের বিরুদ্ধে দুশমনির বিষয়ও। সে দুশমনির কারণেই আগ্রহও নেই সিরাতাল মুস্তাকীম চেনায়। ফলে আগ্রহ নাই কুর’আনের জ্ঞানার্জনে। যে ব্যক্তি চীনে যেতে চায়, সে কি কখনো ইংল্যান্ডের পথের খোঁজ নিবে? একই অবস্থা ইসলামের দুশমনদের। জান্নাতের পথে চলায় যাদের আগ্রহ নেই এবং পরকালের উপর যাদের বিশ্বাসও নাই, তারা কেন জান্নাতের পথের খোঁজ নিবে? নইলে জাহান্নামে পথ এবং জান্নাতের পথ –এ দুটি ভিন্ন পথ যে একত্রে চলে না, সেটি বুঝে উঠা কি এতোই কঠিন? এরাই সিলেবাসে কুর’আন শিক্ষার সুযোগ দিতে রাজী নয়। আদালতে আল্লাহ-প্রদত্ত আইনের প্রতিষ্ঠা দিতেও রাজী নয়। এরা নিজেদের ইসলামের অনুসারী রূপে পরিচয় দেয় নিছক অন্যদের ধোকা দেয়ার লক্ষ্যে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেটি জরুরিও। নিজেদের মুসলিম নাম ও মুসলিম পরিচিতিকে তারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সে কপট চরিত্রটি তুলে ধরেছেন সুরা মুনাফিকুনে। সে মুনাফিকিটি আরো সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে যখন সেক্যুলারিজম, ন্যাশনালিজম, সোসালিজম ও স্বৈরাচারের পূজারী এবং শরিয়তের প্রচণ্ড বিরোধী হয়েও তারা মাথায় টুপি দেয়, তসবিহ হাতে জনসম্মুখে হাজির হয়, দাড়ি রাখে, নামাজ-রোজা পালন করে, হজ্জ-উমরাহ করে, মানুষকে ইফতার খাওয়ায় এবং জনসভায় দাঁড়িয়ে বলে “আমিও মুসলিম।”
উপেক্ষিত পবিত্র কুর’আন
পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ -সেটি বুঝতে হলে মানব জীবনের মূল লক্ষ্যটি বুঝতে হয়। মানব জীবনে মৃত্যু বা অন্ত বলে কিছু নাই, আছে স্রেফ ইহকালীন জীবন থেকে পরকালীন জীবনে ইন্তেকাল তথা স্থানান্তর। এরপর শুরু হয় অনন্ত-অসীম কালের পরকালীন জীবন। সে পরকালীন জীবনে যেমন জান্নাত প্রাপ্তির ন্যায় বিশাল প্রমোশন আছে, তেমনি জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হওয়ার ভয়ানক আযাবও আছে। প্রমোশন বা পুরস্কার লাভের জন্য লাগাতর পরীক্ষাও আছে। কারণ, প্রমোশনের জন্য অনিবার্য হলো পরীক্ষা। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা তাই এ পার্থিব জীবনকে পরীক্ষাকালীন জীবন রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। এবং ফল ভোগের জন্য হলো আখেরাত। সে অনিবার্য পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার জন্য যেমন তাগিদ দিয়েছেন, তেমনি হুশিয়ারীও দিয়েছেন। যেমন সুরা আনকাবুতের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে ঈমান এনেছি -এ কথা বললেই তাকে ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ তাদের পূর্বে যারা এসেছিল আমরা তাদেরও পরীক্ষা করেছি; (পরীক্ষার মধ্য দিয়ে) আল্লাহ জেনে নিয়েছেন ঈমানের দাবীতে কে সদ্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।” ইসলামের এই অতি মৌল কথাটি কি বাংলাদেশের কোন ছাত্র তার প্রায় ২০ বছরের ছাত্র জীবনে একবারও কি তার শিক্ষকের মুখ থেকে শুনবার সুযোগ পায়?পবিত্র কুর’আনের সে সত্য বানীকে ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে আড়াল করাই বাংলাদেশের শিক্ষানীতির মূল নীতি। শয়তান সেটিই চায়। বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণও সেটিই চায়। ফলে সে যে পরীক্ষার হলে বসে আছে এবং সর্বক্ষণ সে যে সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালার নজরে আছে -সে বোধটুকুও এ শিক্ষার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় না। অথচ সে বোধটুকুই হলো তার তাকওয়া -যা তাকে জান্নাতের পথে নিবিষ্ট করে।
যেখানেই পরীক্ষায় পাশের প্রশ্ন, সেখানেই প্রয়োজন পড়ে নিবিড় জ্ঞানার্জনের। কারণ অজ্ঞতায় পাশ জুটে না। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাশ করতে সিলেবাস মেনে পড়াশুনা করতে হয়। নির্দেশিত টেক্সট বইগুলি বার বার পড়তে হয়। নির্ধারিত টেক্সট বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই যতই পাঠ করা হোক তাতে পাশ জুটে না। বিষয়টি অবিকল অভিন্ন ঈমান-আমলের যে পরীক্ষাটি মহান আল্লাহতায়ালা নেন -সেক্ষেত্রেও। এ পরীক্ষায় পাশের জন্য নির্ধারিত টেক্সট বইটি হলো পবিত্র কুর’আন। অন্যান্য বই পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি জুটতে পারে। ডিগ্রি দেখিয়ে চাকুরিও মিলতে পারে। কিন্তু তাতে এ পরীক্ষায় পাশ জুটে না। অথচ এ পরীক্ষায় যারা পাশ করে একমাত্র তারাই জান্নাতের যোগ্য বিবেচিত হয়। এবং ফেল করলে জাহান্নাম যেতে হয়। তাই কুর’আনের জ্ঞান না থাকার বিপদটি ভয়াবহ। মহান আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাক। এজন্যই তিনি চান, তারা এ পরীক্ষায় পাশ করুক। যেহেতু একমাত্র কুর’আনের জ্ঞানই সে পাশকে নিশ্চিত করে, সে জন্য পবিত্র কুর’আনই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। ঈমানদারদের মাঝে পাশের সে সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যেই কুর’আন পাঠকে তিনি ফরজ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছেন।
মানব সৃষ্টি নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার স্ট্রাটেজি কি সেটি সুস্পষ্ট বুঝা যায়, মহান নবীজী (সা:)’র উপর সর্বপ্রথম নাযিলকৃত পবিত্র কুর’আনের ৫টি আয়াতের দিকে নজর দিলে। তা হলো সুরা আলাকের ৫টি আয়াত। এ আয়াতগুলি নামাজ-রোজা বা হজ্জ-যাকাত ফরজ করতে নাযিল হয়নি। নবীজী (সা:)’র সাথে প্রথম সংযোগেই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে “ইকরা” তথা পড়ার হুকুম দিয়েছেন। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের হুকুম এসেছে প্রায় এক যুগ পর। লক্ষ্য এখানে নবীজী (সা:) ও তাঁর অনুসারীদের মাঝে পবিত্র কুর’আন পড়া তথা তা থেকে জ্ঞান লাভের সামর্থ্য সৃষ্টি। নবীজী (সা:) নিরক্ষর ছিলেন। কাগজের পৃষ্ঠা থেকে কুর’আন পাঠের সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি পাঠ করতেন তার স্মৃতির পাতায় খোদিত কুর’আন থেকে। লক্ষণীয় হলো, কুর’আন পাঠের সামর্থ্য বাড়াতেই মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সূদান, মরক্কো, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া, মৌরতানিয়ার ন্যায় বহুদেশের জনগণ নিজেদের মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবী ভাষাকে নিজ ভাষা রূপে গ্রহণ করেছিলেন। কুর’আনের জ্ঞানার্জন তাদের কাছে পরীক্ষায় পাশের জন্য প্রায়োরিটি রূপে গণ্য হয়েছিল।
মাতৃভাষা পরিত্যাগ করা মানব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। মানুষ ভাষার জন্য বাঁচে না। বরং ভাষাকে বাঁচতে হয় মানুষের প্রয়োজন মেটাতে। সে সামর্থ্য না থাকলে মানব জীবন থেকে সে ভাষাকে বিদায় নিতে হয়। যেমন কবরে গেছে সংস্কৃত ভাষা। ইউরোপ-আমেরিকায় এসে নানা ভাষার লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে ইরাজী, ফরাসী ও নানা বিদেশী ভাষা শিখছে। সেটি নিছক উপার্জন বাড়াতে। যেমন কোন বাঙালিকে লন্ডনে চাকুরি পেতে ভাল ইংরেজী শিখতে হয়। যত ভাল বাংলাই জানুক তাতে চাকুরি মেলে না। এজন্যই সে তার সন্তানকে বাংলা না শিখিয়ে ইংরেজী শেখায়। কিন্তু মানবের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তো অনন্ত-অসীম কালের পরকালীন জীবনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। সে জন্য অপরিহার্য হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এবং তাঁর নাযিলকৃত কুর’আনের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন। সে জন্য জরুরি হলো কুর’আনের ভাষা শেখা। সে কারণেই প্রথম যুগের মুসলিমগণ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে কুর’আনের ভাষা শিখেছেন। এতে তাদের যেমন সিরাতাল মুস্তাকীম চেনার সামর্থ্য বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সে পথে চলার সামর্থ্য। সে সাথে বেড়েছে ঈমানের পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য। সে কালে তাদের গৌরব ও বিজয় এসেছে তো সে পথেই। আর আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে পথভ্রষ্টতায়। যাত্রাপথের রোডম্যাপটি না জানলে -পথভ্রষ্টতাই তো স্বাভাবিক। আর পথভ্রষ্টতায় কি বিজয় বা ইজ্জত জুটে? সেটি তো অপমান ও জাহান্নামের পথ।
পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচাই তো মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। বিদ্যাশিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে সে এজেন্ডা পূরণে সহায়তা দেয়া। মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যু কি থাকতে পারে? সে এজেন্ডাকে মানব মনে স্থায়ী ভাবে বসাতেই তো ৫ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহা পাঠের বিধান। এবং সুরা ফাতেহাতে যে দোয়াটি নামাজের প্রতি রাকাতে পাঠ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেটি সম্পদ লাভ, সন্তান লাভ, ক্ষমতালাভ বা সুস্বাস্থ্য লাভের দোয়া নয়, বরং সেটি হলো সিরাতাল মুস্তাকীম পাওয়া এবং পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার দোয়া। এটিই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া। এবং এই দোয়াটি শিখিয়ে দিয়েছেন মহা দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালা। শুধু তাই নয়, কোনটি সিরাতাল মুস্তাকীম এবং কোনটি ভ্রষ্টতার পথ –সে জ্ঞানটিও তিনি অতি বিস্তারিত ভাবে দিয়েছেন পবিত্র কুর’আনে। পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন এজন্যই ফরজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের মুসলিম জীবনে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে সিরাতাল মুস্তাকীম খুঁজে পাওয়া এবং কতটা গুরুত্ব পেয়েছে পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার বিষয়টি? সে বিষয়ে ভয়ানক অবহেলা ধরে পড়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। বরং পথভ্রষ্টতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশর ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রমটি পরিচালিত হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত টেক্সট বুক পবিত্র কুর’আনকে পরিহার করার মধ্য দিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থা পরিণত হয়েছে কুর’আনের নির্দশনা থেকে দূরে সরানোর হাতিয়ারে। এভাবে মুসলিমদের রাজস্বের অর্থে কার্যকর করা হচ্ছে শয়তানের এজেন্ডা। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম ও তাঁর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ এবং এর চেয়ে বড় অবাধ্যতা আর কি হতে পারে?
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018