ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের স্ট্র্যাটেজি (পর্ব ১)
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 3, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
স্ট্র্যাটেজির গুরুত্ব
স্ট্র্যাটেজি আমরা কী বুঝি? স্ট্র্যাটেজি হলো এমন এক রণ-কৌশল -যা বহুবিধ বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকুল অবস্থার মোকাবেলা করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধকে বিজয়ী করে। মুসলিম জীবনে এমন একটি যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার রণকৌশল অনিবার্য কারণেই এসে যায়। কারণ মুসলিম হওয়ার অর্থই আমৃত্যু একটি যুদ্ধ নিয়ে বাঁচা। কারণ তাকে বাঁচতে হয়, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার এজেন্ডা নিয়ে। ফলে তাকে সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করার স্ট্র্যাটেজিও প্রণয়ন করতে হয়। এক কালে স্ট্র্যাটেজি শব্দের ব্যবহার হতো এবং সেটি পড়ানো হতো সেনা বাহিনীতে। কারণ, শুধু অস্ত্র ও সৈনিকের বলে যুদ্ধজয় ঘটে না। বিজয়ের জন্য চাই উত্তম স্ট্র্যাটেজি। ভাল স্ট্র্যাটেজির কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনীও বিশাল বিশাল বাহিনীর উপর বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু আজ সেটি পড়ানো হয় এবং স্ট্র্যাটেজি প্রণীত হয় রাজনীতি, ধর্ম প্রচার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। কারণ, লাগাতর যুদ্ধ সেসব অঙ্গণেও।
মুসলিম জীবনের মূল লক্ষ্যটি সুন্দর গৃহ, পরিবার ও মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ নয়। মূল এজেন্ডাটি কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠাও নয়। বরং সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করা এবং সে লক্ষ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। ঘর, পরিবার ও ব্যবসা-বাণিজ্য তো অনকেই গড়ে। সে জন্য ঈমানদার হওয়া লাগে না। কিন্তু ইসলামকে বিজয়ী করা এবং ইসলামী রাষ্ট্রনির্মাণের স্বপ্ন একমাত্র ঈমানদারের। এবং সেটি সম্ভব একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এটিই হলো পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। এ কাজ বান্দাকে প্রিয়তর করে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। কারণ, এ কাজ মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজ। এজন্যই নবীজী (সা:)’র অর্ধেকের বেশী সাহবা নিজ গৃহ, নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও মসজিদ-মাদ্রাসার নির্মাণে নিহত হননি, তারা শহীদ হয়েছেন ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে এবং সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায়। এটিই হলো মুসলিম জীবনের পবিত্র জিহাদ। এ জিহাদে আত্মনিয়োগের মধ্যেই প্রকাশ পায় প্রকৃত ঈমানদারী। এ কাজে একমাত্র তারাই নিজ শ্রম, অর্থ, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করে যাদের থাকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা ও তাঁর কাছে প্রিয়তর হওয়ার প্রবল তাড়না।
ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি স্রেফ দোয়া-দরুদে ঘটে না। সে জন্য জরুরি হলো, সুপরিকল্পিত স্ট্র্যাটেজি এবং সে স্ট্র্যাটেজির বাস্তবায়নে আপোষহীন কর্মসূচী। নইলে সে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। ব্যক্তির সাচ্চা ঈমানদারী ধরা পড়ে এরূপ স্বপ্নপূরণের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে বাঁচার মধ্যে। যার জীবনে সে স্বপ্ন ও স্ট্র্যাটেজি নাই এবং সে স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নের কর্মসূচীও নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে সত্যিকার ঈমান বলে কিছু নাই। এমন ঈমানশূণ্য ব্যক্তিরা মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয় নিয়ে ভাবে না। তারা তাঁর খলিফা রূপেও বাঁচেনা। বরং তারা বাঁচে এবং যুদ্ধ করে শয়তানের খলিফা রূপে। নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও তারা অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করে অনৈসলামিক রাষ্ট্র গড়তে ও বাঁচিয়ে রাখতে। তাদের কারণে মুসলিম ভূমিতে বাংলাদেশের ন্যায় অনৈসলামিক রাষ্ট্রগুলির নির্মাণে কাফিরদের ময়দানে নামতে হয়নি। দেশগুলির শাসনতন্ত্রে আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের বিলুপ্তি, স্কুল-কলেজ থেকে কুর’আন-হাদীস শিক্ষার বিলুপ্তি এবং আদালত থেকে শরিয়তের বিলুপ্তির ন্যায় হারাম কাজগুলি তো তারাই করেছে যারা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী। এমন ব্যক্তিগণ যতই কুর’আন তেলাওয়াত করুক এবং যত নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করুক না কেন -সেগুলি কি তাদের ঈমানদার বানাতে পারে? মদিনার মসজিদে নববীতে খোদ নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েছে আব্দুল বিন উবাই ও তার তিন শত সহচর। কিন্তু সে নামাজ তাদেরকে ঈমানদার বানাতে পারেনি। নামাজ-রোজা পালন করেও তারা মুনাফিক রয়ে গেছে। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গুরুত্ব পায়, কারা তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে জিহাদ করলো এবং জান-মালের কুরবানী পেশ করলো।
ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের স্ট্রাটিজি সমূহ নতুন করে আবিস্কারের বিষয় নয়। সেগুলি আজও বেঁচে আছে ইসলামের ইতিহাসের এবং নবীজী (সা:)’র হাদীসে। নবীজী (সা:) শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, ওজু-গোছল শিখিয়ে যাননি। নিজ হাতে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করে এবং ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের চালকের সিটে বসে দেখিয়ে গেছেন কীরূপে সে রাষ্ট্র নির্মাণ ও পরিচালনা করতে হয়। এবং নিজে রণাঙ্গণে নিয়ে দেখিয়ে গেছেন কীরূপে সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দিতে হয়। মুসলিমদের আজকের ব্যর্থতার মূল কারণ, তারা নবীজী (সা:) পূর্ণ অনুসারী হতে পারিনি। তারা নবীজী (সা:)থেকে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের পদ্ধতি শিখলেও ইসলামী রাষ্ট্রনির্মাণের কৌশলটি শেখেনি। ইসলামী রাষ্ট্রনির্মাণের বদলে গুরুত্ব দিয়েছে স্রেফ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে। ফলে খলিফায়ে রাশেদার আমলে বাংলাদেশের চেয়ে ৫০গুণ বৃহৎ মুসলিম ভূমিতে যত মসজিদ ছিল তার চেয়ে বেশী মসজিদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশের একটি জেলাতে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু হাজার মাদ্রাসা। কিন্তু তাতে কি দেশে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? এসেছে কি ইসলামের বিজয়? বরং বিজয় বেড়েছে সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট শক্তির। বনি ইসরাইলের মত আজকের মুসলিমগণও নিজেদের প্রমাণ করেছে ইসলামের ব্যর্থ ছাত্র রূপে।
আজকের অধিকাংশ মুসলিম এ মৌল বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে অসম্ভব হয় পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজ তথা পূর্ণ মুসলিম রূপে বাঁচার কাজ। তখন অসম্ভব হয় ইসলাম ও তার শরিয়তী বিধানকে বিজয়ী করা। তখন মুসলিম ভূমিতে প্রতিষ্ঠা পায় শত্রু-শক্তির দখলদারি। এভাবে মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরায়। সেটির প্রমাণ আজকের মুসলিমগণ। ইসলামী রাষ্ট্র না থাকায় মুসলিমদের জীবনে ইসলামের পূর্ণ প্রয়োগ নাই। তারা বাঁচছে শরিয়তী আইনের প্রয়োগ, প্যান-ইসলামী ঐক্য, দুর্বৃত্ত নির্মূলের জিহাদ, শুরা ভিত্তিক শাসন, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ন্যায় ফরজ কাজগুলি না করেই। বরং মুসলিম নগরগুলিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে শত শত পতিতাপল্লী, সূদী ব্যাংক, জুয়ার আখড়া, মদের দোকান এবং নাচ-গান-সিনেমার নামে অশ্লিলতার প্রদশর্ণী। আজ মুসলিমদের সংখ্যা ১৫০ কোটি হলেও তাদের হাতে কোথাও ইসলামের বিজয় আসেনি -যেরূপ বিশাল বিজয় এসেছিল নবীজী (সা:) ও তাঁর কয়েক হাজার সাহাবীদের হাতে। লক্ষণীয় হলো, সে আমলে বিজয় ও গৌরব অর্জনে মূল হাতিয়ার রূপে কাজ করেছিল ইসলামী রাষ্ট্র ও তার বিশাল সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামো।
ইসলামের বিজয়ের অর্থ: রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হবে -সেটি নয়। মুসলিম নামধারি কোন শাসকের শাসনও নয়। এবং সে রাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ মসজিদ বা হাজার হাজার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাও নয়। বরং সেটি হলো সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের বিজয় এবং তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। ইসলামের বিজয় এলে সে রাষ্ট্রে বিলুপ্তি ঘটে সকল প্রকার দুর্বৃত্তি ও অবিচারের এবং প্রতিষ্ঠা পায় সত্য ও সুবিচার। নবীজী (সা:)’র বিস্ময়কর মোজেজা শুধু এ নয় যে, নিরক্ষর হয়েও তিনি হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছিলন পবিত্র কুর’আনের ন্যায় বিশাল গ্রন্থকে। অথচ সমগ্র কুর’আন মুখস্থ করতে বহু বছর হিফজখানায় কসরত করতে হয়। অসংখ্য বার পড়তে হয় প্রতিটি আয়াত। অথচ হযরত জিবরাইল (আ:) থেকে একটি আয়াত একবার শুনেই নবীজী (সা:) তা নিজ হৃদয়ে বসিয়ে নিয়েছেন। দ্বিতীয়বার শোনার প্রয়োজন পড়েনি। তবে নবীজী (সা:)’র সবচেয়ে বড় মোজেজাটি অন্যত্র। সেটি ইসলামের রাষ্ট্র নির্মাণ। নবীজী (সা:) নবুয়ত পান ৪০ বছর বয়সে এবং নবুয়ত প্রাপ্তির পর মাত্র ২৩ বছর বেঁচেছেন। সে ২৩ বছরের মাঝে প্রথম ১৩ বছর মক্কায় কেটেছে চরম বাধা-বিপত্তির মাঝে। তাঁর জীবন থেকে তিনটি মূল্যবান বছর হারিয়ে গেছে শেবে আবু তালেবের বন্দীজীবনে। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি তাঁর সামর্থ্যকে পুরাপুরি কাজে লাগাতে পারেননি। কিন্ত তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটি করেন মদিনায় হিজরতের পর মাত্র ১০ বছরের মধ্যে। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি সাহাবাদের গড়ে তোলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বেড়ে উঠে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে। সে রাষ্ট্রের উপর প্রতিষ্ঠা পায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।
বিশাল শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে নবীজী (সা:) বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু সে যুদ্ধজয় বিনা যুদ্ধে আসেনি। শুধু নবীজী (সা:)কে নয়, প্রতিটি সাহাবাকে যুদ্ধে নামতে হয়েছে। অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন, এবং রণাঙ্গণে খোদ নবীজী (সা:) আহত হয়েছেন। যারা যুদ্ধে নামেনি তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে। সেদিন এটি প্রমাণিত হয়েছে, নামাজী-রোজাদের মাঝে শুধু মুজাহিদ থাকে না, বিপুল সংখ্যক মুনাফিকও থাকে। কিন্তু নবীজী (সা:) কীরূপে সেদিন কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলেন এবং কি ছিল তাঁর স্ট্র্যটিজি -সেটি হলো সর্বকালের মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। বুঝতে হবে নবীজী (সা:) যা কিছু করেছিলেন -সেগুলি করেছেন মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা ও নির্দেশ মোতাবেক। তিনি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও স্ট্র্যাটেজিকে কার্যে পরিণত করেছেন মাত্র। কিন্তু আজকের মুসলিমদের পরাজয়ের মূল কারণ, তারা নবীজী (সা:)-প্রদত্ত নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের হুকুমগুলি মানতে রাজী, কিন্তু মানতে রাজী নয় ইসলামী রাষ্ট্রনির্মাণে তাঁর অনুসৃত স্ট্র্যটেজিগুলিকে। নবীজী (সা:)’র স্ট্র্যটেজিগুলি ছিল নিম্মরূপ:
এক: বিপ্লব সর্বপ্রথম আনতে হয় দর্শনে
বিপ্লব জন্ম নেয় দর্শন থেকে। যেখানে দর্শন নাই, সেখানে কোন বিপ্লবও নাই। সে বিপ্লব সুফল দিবে, না কুফল দিবে -সেটি নির্ভর করে দর্শনের গুণাগুণের উপর। চোরডাকাত, ভোটডাকাত, দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদেরও দর্শন থাকে। ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে যদি সে দর্শন বা মতবাদটি কম্যুনিজম, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় ভ্রষ্ট, বিষাক্ত ও অসত্য হয়। তাই কোন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির জীবনে বিপ্লব আনতে হলে প্রথমে চিন্তার মডেল তথা দর্শনে বিপ্লব আনতে হয়। দর্শন পাল্টে গেলে ব্যক্তির কর্ম, চরিত্র, আচরণও পাল্টে যায়। তখন পাল্টে যায় জীবনের ভিশন ও মিশন। সমাজ বিজ্ঞানে একেই বলা হয় প্যারাডাইম শিফট। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি বদলাতে হলে জনগণের চেতনার ভূবনে হাত দিতে হয় এবং বিরাজমান বিশ্বাসকে বদলিয়ে দিতে হয়। সে বিশ্বাসটি কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান ও নানারূপ পেশাদারী নিয়ে হলে চলে না, সেটিকে সঠিক হতে হয় আমরা কেন বাঁচবো, কিভাবে বাঁচবো, সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ কিরূপে এবং জীবনের প্রকৃত সাফল্য কিরূপে -জীবনের অতি মৌলিক এ বিষয়গুলি নিয়ে।
প্রশ্ন হলো দর্শন বলতে আমরা কি বুঝি? দর্শনের গুরুত্বই বা কি? দর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম। হাতি কে হাতি রূপে এবং গরুকে গরু রূপে চেনার জন্য চাই চোখের সামর্থ্য। তেমনি সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা, ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় রূপে জানার জন্য চাই মনের সামর্থ্য। মনের সে সামর্থকে বলা হয় দর্শন। চোখের সামর্থ্য মানুষ জন্মসূত্রে পায়। সে সামর্থ্য পশুদেরও থাকে। কিন্তু দর্শনের সামর্থ্য ব্যক্তিকে নিজে অর্জন করতে হয়। সেটি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে। এটিই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একাজ ইসলামের নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ। একাজে ব্যর্থতা মানব জীবনে ভয়ানক ব্যর্থতা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। জন্ম থেকেই যে ব্যক্তি অন্ধ সে হাতি ও গরুর ন্যায় নানাবিধ জীবজন্তু বা বস্তুর চেহারা নিয়ে কেবল কল্পনাই করতে পারে। সেগুলি নিয়ে কখনোই সঠিক ধারণা পায়না। তেমনি অজ্ঞ ব্যক্তিও ব্যর্থ হয় সত্য, মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়কে চিনতে। ধর্মের নামে গরু, সাপ, মুর্তি, পাহাড়-পর্বত পূজনীয় হয় তো দর্শনের ব্যর্থতার কারণে। তেমনি দর্শনের ব্যর্থতার কারণে ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ন্যায় অসভ্য, নৃশংস ও বিষাক্ত মতবাদগুলিও এ পৃথিবী পৃষ্ঠে কোটি কোটি অনুসারী পেয়েছে। দর্শনের ভিন্নতার কারণেই একই দেশ ও একই জলবায়ুতে বসবাস করেও মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচারবোধ ও মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠে। তাই একজন সেক্যুলারিস্ট বাঙালির কাছে নারী-পুরুষের বিবাহহীন যৌন সম্ভোগ প্রেম রূপে নন্দিত হয়। অথচ সেরূপ জ্বিনা একজন ঈমানদার বাঙালির কাছে শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ গণ্য হয়। একজন সেক্যুলারিস্টের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার লড়াই গণ্য হয় সন্ত্রাস রূপে। অথচ একজন ঈমানদারের কাছে সেটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। বাঙালি সেক্যুলারিস্টের কাছে পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিমদেশকে ভাঙ্গা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের পদতলে সঁপে দেয়াটি গর্বের মুক্তিযুদ্ধ। তাদের হাতে নৃশংস ভাবে লাশ হতে হয় আবরার ফাহাদের ন্যায় দেশপ্রেমিকদের। এবং ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ও কারাগারে নির্যাতিত হয় ইসলামপন্থীদের। এসবই হলো নানাবিধ বিষাক্ত দর্শনের নাশকতা।
তাই একটি দেশ ও দেশবাসীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, গার্মেন্ট রপ্তানী ও মানব রপ্তানী নয়। সেটি হলো জনগণের দর্শনের সুস্থতা বিধান। নইলে সভ্য মানব নির্মাণের কাজটি হয়না। তখন মারা পড়ে মানবতা ও ঈমান। তখন দেশ দুর্বৃত্তিতে বার বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়। অতিশয় অপমানের বিষয় হলো, বাংলাদেশ সেরূপ বিশ্বচ্যাম্পিয়ান অতীতে ৫ বার হয়েছে। তাই মহান নবীজী (সা) তাঁর মিশন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দিয়ে শুরু করেননি। শুরু করেছিলেন মানুষের চেতনা বা দর্শনে পরিশুদ্ধি ও বিপ্লব আনার মধ্য দিয়ে। ঈমানদারদের চেতনায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার উপর অটল বিশ্বাস, জান্নাত ও জাহান্নামের উপর বিশ্বাস এবং রোজ হাশরে জবাবদেহীতার ভয়। অসত্য, অসভ্য ও বর্বর মতবাদ দিয়ে কখনোই সুস্থ, সভ্য ও সুশীল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মিত হয়না। তাতে বরং শুরু হয় বর্ণগত, ধর্মগত ও জাতিগত নির্মূলের নৃশংসতা; এবং সংঘটিত হয় রক্তাক্ত যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও বিশ্বযুদ্ধ। বিষাক্ত দর্শনের কারণে একমাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধেই প্রাণ হারিয়েছে ৮কোটির বেশী মানুষ এবং বিধ্বস্ত হয়ে শত শত নগর-বন্দর।
এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর লক্ষাধিক নবী-রাসূলগণকে কৃষি, শিল্প বা বিজ্ঞান শেখাতে পাঠাননি; তাদেরকে তিনি পাঠিয়েছিলেন মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণটি করতে। সেটি ছিল, অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়া এবং তাদের চিন্তার মডেলে তথা দর্শনে পরিশুদ্ধি আনা। ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ি জোড়া যায়না, তেমনি চেতনা ও দর্শনের পরিশুদ্ধির আগে চরিত্র ও কর্মে পরিশুদ্ধি আনা যায়না। চেতনা রাজ্যে পরিশুদ্ধির পথ ধরেই নবীজী (সা:) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়তে পেরেছিলেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ার কাজটিও তিনিই শুরু করেছিলেন। নবীজী (সা:)’র সে অভূতপূর্ব সাফল্যের মূলে কোন অর্থনৈতিক বিপ্লব বা উন্নত প্রযুক্তি ছিলনা, সেটি ছিল দর্শনের বিপ্লব। এবং সে দর্শনের আবিস্কারক নবীজী (সা:) নিজে ছিলেন না। সে বিশুদ্ধ দর্শনটি তিনি পেয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কুর’আন থেকে -যা এসেছিল সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত রূপে। এ কিতাব শুধু শ্রেষ্ঠ মানব গড়ার রোডম্যাপ নয়, ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার গড়ার রোডম্যাপও। সে রোডম্যাপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে গৌরব যুগের মুসলিমদের হাতে।
কুর’আনী দর্শনের মূলে কথা হলো আখেরাতে জবাবদেহীতার ভয়। সেটি জাহান্নামের আগুনে দগ্ধিভুত হওয়ার ভয়। এ ভয় ব্যক্তিকে সতর্ক হতে ও ভাবতে শেখায়। নবীজী (সা:)’র আমলে আরবের জনগণ কে অবিশ্বাস করতো -বিষয়টি তা নয়। আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বকে তারা শুধু বিশ্বাসই করতো না, নিজ সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান রাখতো। কিন্তু বিশ্বাস করতো না মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে তথা আখেরাতে জবাবদেহীতাকে। বিশ্বাস করতো না রোজ হাশরের বিচার দিন এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে। পরকালে পুনরুত্থান নিয়ে তারা কি বলতো -সেটি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি; সেগুলিকে মহান আল্লাহতায়ালা রেকর্ড করে রেখেছেন পবিত্র কুর’আনে। পরকাল নিয়ে তাদের সে অবিশ্বাসের নমুনা হলো:
بَلْ عَجِبُوٓا۟ أَن جَآءَهُم مُّنذِرٌۭ مِّنْهُمْ فَقَالَ ٱلْكَـٰفِرُونَ هَـٰذَا شَىْءٌ عَجِيبٌ ٢
أَءِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًۭا ۖ ذَٰلِكَ رَجْعٌۢ بَعِيدٌۭ ٣
অর্থ: “বরং তারা বিস্মিত হলো যখন তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন সতর্ককারী এলো (এবং মৃত্যুর পর আবার পুনরুত্থানের কথা শোনালো); (সে কথা শুনে) তারা বললো, “এটি তো বড়ই আশ্চর্য বিষয়! আমরা যখন মারা যাবো এবং পরিণত হবো মৃত্তিকায়, আমরা কি আবার পুনরুত্থিত হবো? (তারা আরো বললো) সুদূর পরাহত সে প্রত্যাবর্তন।” –(সুরা ক্বাফ, আয়াত ২-৩)। তারা আরো বলতো:
وَكَانُوا۟ يَقُولُونَ أَئِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًۭا وَعِظَـٰمًا أَءِنَّا لَمَبْعُوثُونَ ٤٧
أَوَءَابَآؤُنَا ٱلْأَوَّلُونَ ٤٨
অর্থ: “এবং তারা বলতো, আমরা যখন মারা যাবো এবং পরিণত হবো মৃত্তিকায় ও অস্থিতে, এরপরও কি আমরা আবার উত্থিত হবো (তথা জীবিত হবো)? (পুনরুত্থিত হবে কি) এমন কি আমাদের পূর্বপুরুষগণও?” –(সুরা ওয়াকেয়া, আয়াত ৪৭-৪৮)।
আখেরাতে বিশ্বাস না থাকায় তাদের সকল প্রচেষ্টা ও সামর্থ্য ব্যয় হতো একমাত্র দুনিয়াবী জীবনকে আনন্দময় করতে। তাদের সকল কর্ম, রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালিত হতো নিরেট স্বার্থপরতা থেকে। সে স্বার্থপরতার কারণে এমন কি নিজ সন্তানও তাদের কাছে আপদ ও শত্রু মনে হতো। ভাবতো, সন্তানেরা তাদের ভোগের আয়োজনে ভাগ বসাবে। আরবের মানুষদের মাঝে তাই কন্যা সন্তানদের জীবিত দাফন করার রেওয়াজ ছিল। এ দিক দিয়ে তারা ছিল নিরেট সেক্যুলার তথা ইহজাগতিক। মহান নবীজী (সা:) বিপ্লব আনেন তাদের সেক্যুলার চেতনার অন্ধকার ভূমিতেই। তাঁর প্রথম যুদ্ধটি ছিল জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধে নবীজী (সা:) হাতিয়ার ছিল পবিত্র কুর’আন। পবিত্র কুর’আনী জ্ঞানের আলোকে তিনি আরব জনগণকে আখেরাতে বিশ্বাসী রূপে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফলে তারা বিশ্বাস করতে শেখে, মৃত্যু এ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায় না, বরং মৃত্যুহীন ও অন্তহীন জীবনে হাজির করে। সেখানে যেমন অফুরন্ত নেয়ামত ভরা জান্নাত আছে, তেমনি আগুনের লেলিহান শিখা ভরা জাহান্নামও আছে। কে জান্নাতে যাবে এবং কে জাহান্নামে যাবে -সেটি নির্ভর করে ঈমান ও আমলের উপর। ঈমান ও আমলের পরীক্ষা নেয়ার জন্যই এ দুনিয়ার জীবন। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা মুলকের ২ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَوٰةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًۭا ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفُورُ
অর্থ: “তিনিই সেই মহান আল্লাহতায়ালা যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্য আমলের দিক দিয়ে কে উত্তম -সেটি পরীক্ষার জন্য; এবং তিনি পরাক্রমশালী ও গুনাহ মাফকারী।” এ পার্থিব জীবন নিয়ে এরূপ ধারণায় বিশ্বাসী হলে পাল্টে যায় ব্যক্তির কর্ম, চরিত্র, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। তখন এ জীবনের আনন্দ-উল্লাস ও আরাম-আয়েশ অতি তুচ্ছ মনে হয়। তখন এ জীবন গণ্য হয় পরীক্ষাস্থল রূপে। পরীক্ষার হলে বসে কেউ আনন্দ-ফুর্তি করে না। তখন প্রতি মুহুর্তে মনযোগী হয় নেক আমল বাড়াতে।
সুরা মুলকের উপররিউক্ত আয়াতটি পবিত্র কুর’আনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এ আয়াতটিতে প্রকাশ পেয়েছে, মানব সৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহতায়ালার মূল উদ্দেশ্য ও দর্শনটি। এ আয়াতটিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী রয়েছে প্রতিটি মানব সন্তানের জন্যও। সে সতর্কবাণীটি হলো, প্রতিটি নর ও নারীর জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামত হলো নানা রূপ দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যে পূর্ণ এ পার্থিব জীবন। এ পার্থিব জীবন পরিণত হতে পারে জান্নাত লাভের চাবীতে। তবে শর্ত হলো, সে জন্য পাশ করতে হয় ঈমান ও আমলের পরীক্ষায়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বেজে উঠে এ পরীক্ষার শেষ ঘন্টাটি। তাই এ জীবনের সবচেয়ে বড় প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তাটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ করা নয়। এমন পাশ তো বহু জালেম, ফাসেক ও দুর্বৃত্ত বেঈমানগণও করে। বরং সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত নেক আমলের পরীক্ষায় পাশ করা। আমানতের ভয়ানক খেয়নাত হয় যদি এ পরীক্ষা পাশে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া নিয়ামত-ভরা জীবনকে কাজে লাগানো না হয়। এক্ষেত্রে খেয়ানতের শাস্তিটি ভয়ানক; সেটি জাহান্নামের আগুন।
বাস্তবতা হলো, আমাদের প্রতিক্ষণের বসবাস পরীক্ষার মধ্যে। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বক্ষণিক নজর আমাদের প্রতিটি কথা ও আমলের দিকে। তিনি শুধু রেজেকদাতা প্রতিপালকই নন, তিনি আমাদের প্রতিটি কর্মের পরীক্ষকও। আমাদের প্রতিটি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য চিন্তার খবর তিনি রাখেন। আমাদের প্রত্যেকের দুই কাঁধে আসীন আছেন দুইজন ফিরেশতা। ফলে কোন মানবই তাঁর রাডারের বাইরে নয়। এ পরীক্ষায় তারাই ভাল ফল পায় যাদের প্রতিক্ষণের ব্যস্ততা এমন কাজে যা মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করে। সে সাথে এমন কাজ থেকে বিরত থাকে -যা তাঁর কাছে অপছন্দের। যে ব্যক্তি নিজ চেতনায় এমন সজ্ঞানতা নিয়ে বাঁচে, সে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে পরীক্ষা দেয়ার আগে নিজেই নিজের পরীক্ষা নেয়। মু’মিন ব্যক্তি এভাবেই পদে পদে নিজেকে যোগ্যতর করে মাগফিরাত লাভে। মু’মিন ব্যক্তির কর্ম ও আচরণে এরূপ বিপ্লব আসে দর্শনের রাজ্যে বিপ্লব আসার কারণে। যে ব্যক্তির চেতনা রাজ্যে সে বিপ্লব ঘটে নাই, তার পক্ষে অসম্ভব হলো এ পরীক্ষায় পাশ করা। এমন ব্যক্তির কাছে পরীক্ষার হল আনন্দ-ফুর্তির সার্কাস বা রঙ্গমঞ্চ মনে হয়।
দর্শনের রাজ্যে আমূল বিপ্লব আনে কুর’আনী জ্ঞান। কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা নিয়ে সেরূপ বিপ্লবের কথা ভাবা যায়না। দর্শনে বিপ্লব এলে ঈমান ও নেক আমলের ধারণাই পাল্টে যায়। অন্যের কল্যাণে অর্থদান, বস্ত্রদান, চিকিৎসাদান, গৃহদান এ সবই নেক আমল। মসজিদ-মাদ্রাসা গড়াও নেক আমল। তবে সবচেয়ে বড় নেক আমলটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্ম হওয়া। যারা তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় একমাত্র তারাই তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার সৈনিকে পরিণত হয়। তখন তাদের জীবনে অবিরাম জিহাদ দেখা যায়। তখন দর্শনের সে বিপ্লবটি খালি চোখেও দেখা যায়। যারা নিয়মিত কুর’আন তেলাওয়াত, কুর’আন মুখস্থ এবং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় না, বুঝতে হবে তাদের চেতনা রাজ্যে কোন বিপ্লব আসেনি। বুঝতে হবে, পাল্টায়নি তাদের দর্শনের মডেল।
প্রশ্ন হলো, মানবকে নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাটি কি? এ পৃথিবী পৃষ্ঠে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, এ বিষয়ে গভীর অজ্ঞতার শিকার এ পৃথিবীর অধিকাংশ মানব। মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে তারা বসবাস করছে তাদের নিয়ে স্রষ্টার এজেন্ডা না জেনেও। এর চেয়ে ভয়ানক অজ্ঞতা আর কি হতে পারে? সে অজ্ঞতাটি শুধু নবেলবিজয়ীদের নয়, এমন কি তাদেরও যারা নিজেদের আলেম, আল্লামা মুফতি, শেখ, ইমাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক রূপে পরিচয় দেয়। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়া লোকের সংখ্যাটি অতি নগন্য। একারণেই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও বেঁচে নাই নবীজী (সা:)’র ইসলাম -যাতে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়তী বিচার ব্যবস্থা, কুর’আন শিক্ষা, দুর্নীতির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার বিরামহীন জিহাদ, ইসলামের সমাজকল্যাণ পলিসির প্রয়োগ এবং প্যান-ইসলামী মুসলিম ঐক্য। ফলে মুসলিমগণ বাঁচছে প্রকৃত ইসলাম ছাড়াই।
তাই প্রতিটি মানবের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাটি জানা। ডাক্তার, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ বা আইনবিদ হওয়া কারো জন্য ফরজ নয়। এসব না হওয়াতে কেউ জাহান্নামে যাবে না। কিন্তু ফরজ হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাটি জানা এবং সে এজেন্ডার সাথে একতাবদ্ধ হওয়া। এজেন্ডা না জানলে তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হবে কিরূপে? একাত্ম না হলে কিরূপে পাবে সিরাতাল মুস্তাকীম? জান্নাতেই বা যাবে কিরূপে? প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এ এজেন্ডা না জানলে কি জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় হয়? পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের মত অধিকাংশ মুসলিম দেশে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা পেলেও জ্ঞানার্জনের সে ফরজ আদায় হচ্ছে না। ফলে দূর হচ্ছে না মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে অজ্ঞতা। এবং সে অজ্ঞতার কারণে বিপুল সংখ্যক নামাজী, রোজাদার, হাজী, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা সাথে একাত্ম না হয়ে একাত্ম হয় সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তির হারাম এজেন্ডার সাথে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার সে এজেন্ডাটি বার বার ঘোঘিত হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। সে এজেন্ডাটি সুরা তাওবা, সুরা ফাতাহ ও সুরা সাফে ঘোষিত হয়েছে এ ভাষায়:
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ
অর্থ: “তিনি সেই মহান আল্লাহ যিনি পথনির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন যেন সকল ধর্ম ও জীবনদর্শনের উপর সেটি বিজয়ী হয়।” সুরা আনফালের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা নিজের সে এজেন্ডাটি ঘোষিত হয়েছে এভাবে:
يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَيَقْطَعَ دَابِرَ ٱلْكَـٰفِرِينَ
অর্থ: “আল্লাহ চান, তাঁর কালামে পাকের দ্বারা সত্যকে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে এবং চান কাফিরদের শিকড় কাটতে।” সুরা আনফালের ৮ নম্বর আয়াতে সে এজেন্ডাটি ঘোষিত হয়েছে এভাবে:
لِيُحِقَّ ٱلْحَقَّ وَيُبْطِلَ ٱلْبَـٰطِلَ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُجْرِمُونَ
অর্থ: “তিনি চান সত্যকে সত্য রূপে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে; এবং যদিও সেটি অপরাধীদের কাছে তা অপছন্দের।”
মুসলিম হওয়ার দায়বদ্ধতা হলো, তাকে পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি এজেন্ডার সাথে একাত্ম হতে হয়। সে এজেন্ডার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা ব্যক্তিকে কাফিরে পরিণত করে। সেরূপ বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা গণ্য হয় মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ রূপে। এমন অবাধ্য ও বিদ্রোহী ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করলে সে চিহ্নিত হয় মুনাফিক রূপে। প্রশ্ন হলো, যার মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার তাড়না, সে কি কখনো এরূপ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে? বরং তাঁর জীবনে তখন বিরামহীন জিহাদ শুরু হয়ে যায়। এমন জিহাদ হলো মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মাগফিরাত লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। সে ঘোষণা পবিত্র কুর’আনে বহুবা এসেছে। যেমন সুরা ইমরানের ১৯৫ নম্বর আয়াত বলা হয়েছে:
فَٱلَّذِينَ هَاجَرُوا۟ وَأُخْرِجُوا۟ مِن دِيَـٰرِهِمْ وَأُوذُوا۟ فِى سَبِيلِى وَقَـٰتَلُوا۟ وَقُتِلُوا۟ لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّـَٔاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ ثَوَابًۭا مِّنْ عِندِ ٱللَّهِ ۗ وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسْنُ ٱلثَّوَابِ ١٩٥
অর্থ: “অতঃপর যারা হিজরত করেছে, নিজ গৃহ থেকে যাদেরকে উৎখাত করা হয়েছে, আমার পথে যারা নির্যাতিত হয়েছে এবং যারা যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি অবশ্যই তাদের পাপকর্মগুলিকে দূরীভূত করে দিব এবং অবশ্যই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাবো জান্নাতে -যার পাদদেশে থাকবে প্রবাহিত নদী। এটিই হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার। এবং আল্লাহর কাছে রয়েছে উত্তম পুরস্কার।”
সুরা তাওবার ২০, ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَهَاجَرُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ ٱللَّهِ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَآئِزُونَ ٢٠
يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُم بِرَحْمَةٍۢ مِّنْهُ وَرِضْوَٰنٍۢ وَجَنَّـٰتٍۢ لَّهُمْ فِيهَا نَعِيمٌۭ مُّقِيمٌ ٢١
خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥٓ أَجْرٌ عَظِيمٌۭ ٢٢
অর্থ: “যারা ঈমান আনলো, হিজরত করলো এবং আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে জিহাদ করলো তাদের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা। তারাই হলো সফলকাম। তাঁদের রব তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে সুসংবাদ দিচ্ছেন রহমত, সন্তোষ ও জান্নাতের -যেখানে তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী সুখশান্তি। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তাদের জন্য রয়েছে মহা প্রতিদান।”
নবীজী (সা:)’র যুগে সাহাবাদের মাঝে প্রতিযোগীতা দেখা যেত মহান আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদে নিজ মেধা, নিজ অর্থ, নিজ শ্রম ও নিজ রক্তের বিনিয়োগে। সেটি ছিল মাগফিরাত লাভের প্রতিযোগীতা। সভ্যতর রাষ্ট্র ও সভ্যতা তো সেখানেই নির্মিত হয় যেখানে শুরু হয় এমন নেক আমলে প্রতিযোগীতা। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবী সে প্রতিযোগিতায় শহীদ হয়ে গেছেন। সেরূপ প্রতিযোগিতার নির্দেশ এসেছে সুরা হাদীদের ২১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
سَابِقُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلْفَضْلِ ٱلْعَظِيمِ ٢١
অর্থ: “(হে ঈমানদারগণ!) প্রতিযোগিতা করো তোমাদের প্রতিপালক থেকে মাগফিরাত লাভে এবং জান্নাত লাভে। আসমান ও জমিনের প্রশস্ততার ন্যায় প্রশস্ত হলো সে জান্নাত। সেটি প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে। এটিই হলো আল্লাহতায়ালার পক্ষে থেকে সেই নিয়ামত যা তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে থাকেন। এবং আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামতের অধিকারী।”
ঈমানদার হওয়ার অর্থ শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস নয়, বরং সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালা থেকে মাগফিরাত লাভ এবং জান্নাত লাভের বিরামহীন তাড়নার নিয়ে বাঁচা। সে তাড়নায় সৃষ্টি হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার তাড়না। তখন আগ্রহ বাড়ে জিহাদের ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে। কারণ জিহাদ হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ঈমানদার তখন আল্লাহর সৈনিকে পরিণত হয়। তাছাড়া জিহাদ হলো শাহাদতের ভূমি -যা শহীদকে বিনাবিচারে জান্নাতে নেয়। তাই যে ব্যক্তি সে জিহাদে নাই, সে একাত্ম নয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে। এমন ব্যক্তি নিজেকে যতই মুসলিম রূপে দাবী করুক না কেন -বুঝতে হবে তার ঈমানে গুরুতর অপূর্ণতা রয়ে গেছে। ঈমানদার হওয়ার অর্থ শুধু মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর নবী-রাসূল, তাঁর কিতাব, পরকাল, ফিরেশতা, রোজ হাশর ও জান্নাত-জাহান্নামের উপর বিশ্বাস নয়। বরং সেটি হলো, তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচা। প্রকৃত ঈমানের অনিবার্য প্রকাশ ঘটে তাই জিহাদে।
ঈমানের পরিমাপে জিহাদের গুরুত্ব যে কত অধিক -সেটি বুঝা যায় সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। উক্ত আয়াতে একমাত্র তাদেরকেই ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী বলা হয়েছে যাদের মধ্যে জিহাদ রয়েছে। ঈমান কাকে বলে সেটি বুঝার জন্য এটি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এ আয়াতটি থেকে বুঝা যায়, প্রকৃত ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা মহান আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ ও সে জিহাদের শহীদ হওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। সে জিহাদ নির্ভুল পরিমাপ দেয়, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে কে কতটা একাত্ম। যাদের মধ্যে জিহাদে আগ্রহ নাই, বুঝতে হবে তাদের আগ্রহ নাই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করায়। তারা আগ্রহী নয় তাদের সার্বভৌমত্ব ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠাতেও। তারা নিজেদের নামাজী, রোজাদার, হাজী, আলেম, আল্লামা, ইমাম, মুফতি, মোহাদ্দেস ও শেখ রূপে পেশ করতে পারে, কিন্তু তারা সত্যিকার ঈমানদার নয়। এবং যারা ঈমানদার নয়, তাদের পক্ষে অসম্ভব হলো শহীদ ও সিদ্দিক হওয়া। অথচ যারা সাচ্চা ঈমানদার তাদেরকে মহান আল্লাহতায়ালা শহীদ ও সিদ্দিকের মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ প্রকৃত ঈমানদার শহীদ না হলেও শহীদ হওয়ার নিয়েত ও পূর্ণ প্রস্তৃতি তার থাকে। ফলে সে সদা সত্যবাদী তথা সিদ্দিকও। ঈমানদারের পক্ষে সে মহা মর্যাদাকর বয়ানটি এসেছে সুরা হাদীদের ১৯ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦٓ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصِّدِّيقُونَ ۖ وَٱلشُّهَدَآءُ عِندَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ
অর্থ: “এবং যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, তারাই হলো তাদের রবের কাছে সিদ্দিক এবং শহীদ। তাদের জন্য রয়েছে প্রতিদান ও নূর। এবং যারা অবিশ্বাস করলো এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বললো তারাই হলো জাহান্নামের বাসিন্দা।”
এ ক্ষেত্রে আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। তারা মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর নবী-রাসূল, তাঁর কিতাব, পরকাল, ফিরেশতা, রোজ হাশর ও জান্নাত-জাহান্নামের উপর বিশ্বাসী হলেও ব্যর্থ হয়েছে আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ নিয়ে বাঁচতে। ফলে তারা ব্যর্থ হয়েছে শহীদ ও সিদ্দিকদের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে। একারণেই তাদের উপস্থিতি নাই মহান আল্লাহতায়ালা থেকে মাগফিরাত লাভ এবং জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতায়। ফলে প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে যেরূপ সফলতা দেখাতে পেরেছিলেন -সেরূপ সফলতার ধারে কাছে নাই আজকের মুসলিমগণ। তাদের জীবনে নানা রূপ ব্যস্ততা থাকলেও তারা জড়িত নয় পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বশ্রেষ্ঠ এ নেক আমলে। আজকের মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ এখানেই। এমন কাজে তো একমাত্র তারাই নিজেদের জান ও মালের বিনিয়োগে আগ্রহী হয় -যাদের থাকে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রবল তাড়না। এখানে শূণ্যতাটি কুর’আনী দর্শনের। সে কালে মুসলিমদের দর্শনে তথা চেতনার ভূবনে পবিত্র কুর’আন যে বিশাল বিপ্লব এনেছিল, আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে সেরূপ একটি বিপ্লব আনতে। ফলে তারা ব্যর্থ হয়েছে সে কালের মুসলিমদের ন্যায় সাচ্চা ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠতে। ফলে লক্ষ লক্ষ মসজিদ গড়লেও ব্যর্থ হয়েছে এক খানি ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে। ফলে দেড় শত কোটি মুসলিম বাঁচছে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা না দিয়ে। তারা আদালতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে কুফুরি আইন। তাদের হাতে মুসলিম ভূমিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদ। মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ ও গাদ্দারী আর কি হতে পারে?
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018