পাকিস্তান কেন ভেঙ্গে গেল এবং বাংলাদেশ কিরূপে ভারতের কলোনী হলো?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 14, 2024
- Bangla বাংলা, Bangladesh, English, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
বাংলাদেশী সেক্যুলারিস্টদের delusion
Delusion হলো এমন অবাস্তব, উদ্ভট ও অলীক ভাবনা -যা কখনোই কোন সুস্থ মানুষের ভাবনায় স্থান পায়না। নিজ গৃহে এবং নিজ বিছানায় শুয়ে কোন সুস্থ মানুষই বাড়ী যাবো বাড়ী যাবো বলে চিৎকার করেনা। কিন্তু নিউমোনিয়া বা টাউফয়েডের প্রকোপে গায়ে যখন প্রচণ্ড জ্বর উঠে তখন বহু রোগীকে সেরূপ ধ্বনি তুলে চিৎকার করে। একেই বলা হয় delusion বা বিকারগ্রস্ততা। এরূপ delusion বাঙালি রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের জীবনে বার বার দেখা গেছে। সেটি প্রথম দেখা যায় ১৯৫২’য়ের ভাষা আন্দোলনের সময়। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রেয়ারিতে মারা ৫ জন। কিন্তু delusion’য়ের কারণ আব্দুল গাফফার চৌধুরি সেখানে ছেলে হারা শতমায়ের শত্রু গড়তে দেখলেন। এবং তা নিয়ে কবিতাও লিখলেন। বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সেটি উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার মধ্য দিয়ে। যেন সুলতানী আমলে যখন ফার্সি ভাষা এবং ইংরেজ আমলে ইংরেজী ভাষা রাষ্ট্র ভাষা ছিল তখন বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। Delusion’য়ে আক্রান্ত মানুষ কখনোই সুস্থ ভাবে ভাবতে পারেনা। সেরূপ সুস্থ ভাবনা তাই ১৯৫২ সালে দেখা যায়নি।
অথচ সে রূপ delusion না থাকার কারণে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নেতাজী সুভাষ বসুর মত বাঙালি ব্যক্তিত্ব ভারতের রাষ্ট্র ভাষা রূপে বাংলার বদলে হিন্দির পক্ষে রায় দেন। কারণ, সুস্থ ও সভ্য মানুষেরা কখনোই ট্রাইবাল বা গোত্রবাদী হয়না। তারা ট্রাইবাল বা গোত্রীয় রাষ্ট্রের চৌহদ্দি পেরিয়ে civilisational state নির্মাণের স্বপ্ন দেখে। সেরূপ স্বপ্ন দেখতে দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজী সুভাষ বসুকে। ভারতের বুকে তারা একটি হিন্দু civilisational state’য়ের স্বপ্ন দেখতেন। নিজেদের মাতৃভাষা বাংলার নামে জিদ ধরলে সে স্বপ্ন মারা যেত। তেমন একটি প্যান-হিন্দুত্ববাদী ধারণার কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন প্রখ্যাত বাঙালির বদলে শিবাজীর ন্যায় কট্টোর মুসলিম বিদ্বেষী মারাঠীকে ভারতের অনুকরণীয় রাষ্ট্র নায়কের আসনে বসিয়েছেন। তিনি কলকাতায় শিবাজী উৎসব চালু করেন।
পাকিস্তানকে নিয়ে তেমন এক civilisational state য়ের স্বপ্ন দেখার কারণে শুধু মহম্মদ আলী জিন্নাহ, খাজা নাযিমুদ্দীন ও নূরুল আমীন উর্দুর পক্ষ নেননি, একমাত্র শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ছাড়া পাকিস্তান গণপরিষদের তথা পার্লামেন্টের সকল বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ সদস্য রাষ্ট্র ভাষা রূপে উর্দুর পক্ষে রায় দেয়। অথচ তাদের অধিকাংশের মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। কিন্তু মাতৃভাষা নিয়ে প্রচণ্ড delusion ‘য়ের কারণে বাঙালি সেক্যুলারিস্ট রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ নামে ভাষা আন্দোলেন। এ আন্দোলনের মূল গোল পোস্ট ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা। তাই এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাঙালী কংগ্রসী নেতাকর্মী, কম্যুনিস্টগণ এবং কিছু পাকিস্তান বিরোধী বাঙালি মুসলিম। এদের মধ্যে অনেকেই ভাগ ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিল।
বাঙালি রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের জীবনে সবচেয়ে বড় delusion দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। বাঙালিগণ ১৯০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের অধীনে কলোনী বা উপনিবেশ ছিল। কিন্তু একাত্তরে এসে ভূলে যায় কলোনী কাকে বলে। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের কলোনী বলতে শুরু করে। সেটি কারণ প্রকট delusion। বাংলা যখন ব্রিটিশের কলোনী বা উপনিবেশ ছিল তখন কি কোন বাঙালি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার মন্ত্রী বা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হতে পেরেছিল? পারিনি। কারণ কলোনীর বাসিন্দাদের সে সুয়োগ থাকে না। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরে দুইজন রাষ্ট্রপ্রধান এবং তিনজন প্রধানমন্ত্রী হন বাঙালি। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খাজা নাযিমুদ্দীন, মহম্মদ আলী বোগরা এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তবে অনেকে জানে না যে, জনাব নুরুল আমীন অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এছাড়া পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রী এবং অন্যান্য পদে মন্ত্রী হয়েছেন বাঙালি।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিক সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তা নিয়ে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। সেটি ছিল ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাস। আমি তখন ঢাকাতে কলেজ-ছাত্র। তখন ঢাকায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বৈঠক চলছিল। তখন চলছিল আইয়ুব বিরোধী ছাত্র ও গণ-আন্দোলন। সে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য সংসদে বিতর্কের দিন ধার্য হয়। আমার তখন ইচ্ছা হয় জাতীয় পরিষদে তথা সংসদে বসে সে বিতর্ক দেখার। সে সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের শীতকালীন বৈঠক বসতো তেজগাঁয়ে যেটি প্রধানমন্ত্রীর দফতর সেখানে। তখন জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। উনার বাসায় গিয়ে আব্দার পেশ করলাম জাতীয় পরিষদের আসন্ন বিতর্কের দর্শক হতে চাই। বিতর্কের দিন উনি আমাকে নিজ গাড়ীতে করে নিয়ে গেলেন এবং সংসদের ভিতরে বসার ব্যবস্থা করে দিলেন।
তখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের তথা সংসদের স্পিকার ছিলেন বরিশালের আব্দুল জব্বার খান। বিতর্কে সরকারী পক্ষে বক্তব্য রাখেন সংসদের সরকারী দলের লিডার খুলনার খান আব্দুর সবুর খান। বিরোধী পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিরোধী দলীয় লিডার জনাব নুরুল আমীন। সেদিন স্থির হয়েছিল বিতর্কে দুই পক্ষ থেকে এই দুইজনই মাত্র কথা বলবেন। কিন্তু তাদের ছাড়াও সংসদে সেদিন যাদের সোচ্চার হতে দেখা যায় তাদের দুই জন বাদে সবাই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানী। সমগ্র সংসদের সবচেয়ে তুখোর পার্লামেন্টারীয়ান মনে হলো কক্সবাজারের সংসদ সদস্য মৌলভী এ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ। তাকে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা ১৯৭১’য়ে নৃশংস ভাবে হ্ত্যা করে এবং তার লাশ ডোবায় পচিয়ে দেয়। সেদিন সংসদে সোচ্চার দেখলাম ভাষানী ন্যাপের টাঙ্গাইলের ড. আলীম আল রাজী, আওয়ামী লীগের চাঁদপুরের সদস্য জনাব মিজানুর রহমান। দেখলাম, সংসদে সেদিন যারা সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন তাদের শতকরা ৮০ ভাগই পূর্ব পাকিস্তানী। অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানীরা নীরব শ্রোতা। সংসদের সে অধিবেশন স্বচোখে দেখার পর কোন বিবেকমান মানুষ ভাবতে পারেনা যে, পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানের কলোনী। কলোনীর মানুষ কখনোই সেরূপ কথা বলার সুযোগ-সুবিধা পায়না। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী -এ কথা একমাত্র delusion’য়ের আক্রান্ত ব্যক্তিগণই বলতে পারে। তবে বাংলাদেশে সেদিন সেরূপ বিকারগ্রস্ত মানুষের অভাব ছিল না। এবং এখনো নাই।
বাঙালি মুসলিমদের সৌভাগ্যের বিষয় যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় যেসব বাঙালি মুসলিম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের কেউই delusionalছিলেন না। তাদের ছিল উচ্চ শিক্ষা, দূরদৃষ্টি, গভীর প্রজ্ঞা ও ভিশন। যদি স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের মধ্যে তারা সেদিন বাঙালি মুসলিমদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ দেখতেন তবে ১৯৪৭ সালেই তারা স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করতেন। সে রাজনৈতিক সামর্থ্য তাদের ছিল। কিন্তু ভেবে চিন্তে সে পথে তারা যাননি। তাদের কাছে সেটি স্বাধীনতা হারানো পথ মনে হয়েছে।। বাংলাদেশ পাকিস্তানের ন্যায় পারমানবিক অস্ত্রধারী ৮ লাখ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিশাল ভূ-খণ্ড নয়। সৌদি আরবের ন্যায় বিত্তশালীও নয়। তুরস্ক ও মিশরেরর ন্যায় ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানেও নেই। বরং তিন দিকে ভারতীয় ভূমি দিয়ে ঘেরাও ক্ষুদ্র ভূমি। স্বাধীন রক্ষার বিশাল খরচ আছে। সে খরচ জুগানোর সামর্থ্য পূর্ব বাংলার দরিদ্র ও পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠির ছিল না। সেদিন ক্ষুদার্ত কুমিরের ন্যায় ভারত মুখ হা করে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। Delusion’য়ে আক্রান্ত না হওয়ার কারণে ১৯৪৭‘য়ের মুসলিম লীগের বাঙালি নেতাগণ সে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাটি বুঝতেন। এরই ফল হলো, সে যাত্রায় বাংলার মুসলিমগণ ভারতের গোলামী থেকে বেঁচে যায়।
কিন্তু সেরূপ delusional পাগলামীতে আচ্ছন্ন হয় কাশ্মীরের ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ আব্দুল্লাহ। শেখ আব্দুল্লাহ ভেবেছিলেন, পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে তিনি কাশ্মীর নামে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে পারবেন। তাতে তাঁর নিজের রাজনৈতিক দখলদারী সুরক্ষিত হবে। তিনি কাশ্মীরী মুসলিম জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগকে বিশ্বাস না করে হিন্দুত্ববাদী কংগ্রস ও তার নেতা নেহেরুকে বন্ধ রূপে বেছে নেন। শেখ আব্দুল্লাহর সে delusional পাগলামীর কারণেই কাশ্মীর এখন ভারতের অধিকৃত ভূমি। একাত্তরে এসে শেখ মুজিবও শেখ আব্দুল্লাহর ন্যায় ভারতমুখীতার পথ বেছে নেয়। বাঙালি মুসলিমদের বড়ই সৌভাগ্য যে শেখ মুজিবের ন্যায় দূরদৃষ্টিহীন ক্ষমতালোভী ব্যক্তি ১৯৪৭’য়ের নেতা ছিলেন না। সাতচল্লিশে শেখ মুজিব বাঙালি মুসলিমের নেতা হলে বাংলাদেশ ১৯৪৮ সাল থেকেই আরেক অধিকৃত কাশ্মীর হতো।
বাংলাদেশ হলো ভাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ। সীমান্তের তিন দিকেই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারত। বিশাল হাতিও যদি পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয় -তবে নেকড়ের ক্ষুদ্র একটি দল তাকে সহজেই ঘায়েল করতে পারে। হাতিকে তখন নেকড়ের পেটে যেতে হয়। তেমনি অবস্থা বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি মুসলিম দেশেরও। তাছাড়া নিরেট বাস্তবতা হলো, কুমীরের গ্রাসে একবার পড়লে বাঁচানোর কেউ থাকে না। তাই শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দীন, তমিজুদ্দীন খান, নুরুল আমীন, ফজলুল কাদের চৌধুরির মত উচ্চশিক্ষিত প্রজ্ঞাবান বাঙালি মুসলিম নেতাগণ স্বাধীন বাংলাদেশ বানানোর বিপদটি ষোলাআনা বুঝতেন। তাই ১৯৪৭ সালে তারা সে পথে যাননি।
স্বাধীনতা হারানোর বিপদটি কতটা বেদনাদায়ক -সেটি স্বাধীনতা হারিয়ে প্রমাণ করছে কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, জিংজিয়াং, আরাকান ও ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের পূর্বাংশ। জাতিসংঘ বা অন্য কোন বৃহৎ দেশ তাদের স্বাধীনতা বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। স্বাধীনতা বাঁচাতে অন্যরা কখনো এগিয়ে আসে না, অন্যরা সামরিক বাহিনী নিয়ে আসে স্বাধীনতা হননে -যেমন ভারত পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল ১৯৭১’য়ে। স্বাধীনতা বাঁচাতে হয় নিজ সামর্থ্যে। ভারতীয় হামলার মুখে স্বাধীনতা বাঁচানোর সে সামর্থ্য বাংলাদেশের নাই। নাই বলেই বাংলাদেশীরা যেমন নদীর পানি হারিয়েছে এবং করিডোর ও বন্দর দিয়েছে, তেমনি সীমান্তে দেশটির নাগরিকগণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষিদের গুলীতে লাশ হয় এবং লাশ হয়ে তারকাঁটায় বেড়ায় ঝুলে। এবং প্রতিরোধের সে সামর্থ্য না থাকার কারণেই কবরবাসী হয়েছে বাঙালি মুসলিমদের গণতন্ত্র এবং হারিয়েছে ভোটদানের অধিকার এবং মৌলিক মানবাধিকার।
একাত্তরের সেক্যুলার বাঙালি নেতা-কর্মীদের চেতনায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বাঁচানোর তাড়নাটি কাজ করেনি। বরং তারা ভেসেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, সেক্যুলারিজম ও হিন্দুত্ববাদের জোয়ারে। এসব হারাম মতবাদের জোয়ারে ভাসলে জিদ চাপে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধনে। সে জিদ নিয়ে তারা মুসলিমদের চিহ্নিত শত্রু ভারতের পেটে আশ্রয় নয়। তারা নামে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যায়। তাদেরকে দেখা গেছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র এবং চীন ও ভারতের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে। দেখা গেছে প্রায় ৬ লাখ বিহারীর হাত থেকে তাদের ঘরবাড়ী, দোকানপাট, চাকুরি কেড়ে নিতে। দেখা গেছে বিহারীদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় ও বিহারী নারীদের ধর্ষণে। আজও এই ভারতসেবীদের সে নৃশংসতা দেখা যায় বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে।
একাত্তরে কারা জিতলো এবং কারা হারলো -সে বিচারটি কি এতোই কঠিন? সেটি অতি সহজ হয়ে যায় যদি সে বিচারে একটি ঐতিহাসিক সত্যকে সামনের রাখা হয়। সে সত্যটি হলো, পৌত্তলিক কাফিরগণ কখনোই মুসলিমদের বিজয় নিয়ে উৎসব করেনা। তারা উৎসব করে মুসলিমদের পরাজয় ও প্রকান্ড ক্ষতিগুলি নিয়ে। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বরে দিল্লির হিন্দুত্ববাদী শাসক মহলে যে উৎসব হয় -সে উৎসবের মাত্রা দেখেই বুঝা যায় একাত্তরে ঘটে যাওয়া বাঙালি মুসলিমদের ক্ষতির মাত্রা। কিন্তু যারা বিকারগ্রস্ত তথা delusion‘য়ে আসক্ত, তাদের কি অতি সত্য বিষয়ও বুঝার সামর্থ্য থাকে? পৌত্তলিক মুশরিকদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কি কখনো মুসলিমদের বিজয় ও স্বাধীনতা বাড়াতে ব্যয় হয়? কাফিরদের সেনাবাহিনী কি কখনো মুসলিমদের ঘরে বিজয় তুলে দেয়? শয়তান ও তার অনুসারীগণ কি এতোটা বেকুব? তাদের অস্ত্র, অর্থ ও মেধা সব সময়ই ব্যয় হয়েছে মুসলিমদের পরাধীনতা ও মুসলিম ভূমিতে গণহত্যা বাড়াতে। বাংলাদেশের বুকে সেটি হয়েছে ভারতের ন্যায় হিন্দুত্ববাদী কাফিরদের বিজয়ী বাড়াতে। একাত্তরের যুদ্ধ, গণহত্যা এবং আজকের বাংলাদেশ তো তারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ। একাত্তরের যুদ্ধজয়ই ভারতকে বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছে। এতে দুর্বল হয়েছে উপমহাদেশের মুসলিম শক্তি। এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের কলোনীতে। একাত্তরে অর্জিত ভারতের পদতলে পরাধীনতাকে যারা বিজয় রূপে উৎসব করে -তাদের delusion ‘য়ের মাত্রাটি গভীর। এরাই হলো, ইসলাম থেকে দূরে সরা মুসলিম নামধারী বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ। এদের উৎসব তো ভারতের বিজয় নিয়ে।
এতো বিপর্যয় কেন বাঙালি মুসলিমের?
জীবনে সফল হতে হলে জীবনের ভূল-ভ্রান্তিগুলোকে বার বার পর্যালোচনা করতে হয়। ভূল থেকে শিখতে হয়। যারা ইতিহাস থেকে শেখে না, তারা একই ভূল বার বার করে। তখন তাদের জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ হয়। জাতির সামনে ইতিহাসের পাঠ দেয় দেশের ইতিহাসবিদগণ। তারা জাতীয় জীবনের অতীতের ভূল-ভ্রান্তিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিজ্ঞান, কারিগরি বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের তুলনায় ইতিহাস বিজ্ঞানের গুরুত্ব তাই কম নয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি হচ্ছে না। ইতিহাস চর্চার নামে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হচ্ছে এবং আড়াল করা হচ্ছে সত্যকে।
বাঙালি মুসলিম জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু সে প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর খুঁজতে আজও তেমন গবেষণা বা চিন্তাভাবনা হচ্ছে না। বাঙালি মুসলিমের ইতিহাস একাত্তর থেকে বা ১৯৫২ থেকে শুরু হয়নি। শুরুটি বহু আগে থেকেই। বাঙালি মুসলিমের সর্বকালের সবচেয়ে সেরা অবদান কি ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টি, না একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টি? পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে কি বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো? ১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে কেন পাকিস্তান সৃষ্টি হলো? ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তান সৃষ্টিতে অবাঙালি মুসলিমদের তুলনায় বাঙালি মুসলিমগণ কেন অধিক ও অগ্রণী ভূমিকা রাখলো? ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে পরিকল্পিত পাকিস্তানে বাংলাকে সংযুক্ত করার ঘোষণা ছিল না। ১৯৪৬ সালে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী পার্টির দিল্লি সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাবে সংশোধন এনে বাংলার নাম পাকিস্তানে সংযুক্ত করলেন? বাংলার কোন সংসদ সদস্যই কেন সেদিন পাকিস্তানে যোগ দেয়ার বিরোধীতা করলেন না? কেন সেদিন তাঁদের কেউই স্বাধীন বাংলাদেশের দাবী তুললেন না? অথচ সে সময় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা দিতে একাত্তরের ন্যায় যুদ্ধ করতে হতো না। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান কেন ভেঙে গেল? এদেশে গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবিক অধিকার কেন আজ কবরে শায়ীত? ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়? ভারত কেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শত্রু? বাংলাদেশ কেন ভারতের কলোনী? বাংলাদেশের ইতিহাসে এ প্রশ্নগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিস্ময়! বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে এ প্রশ্নগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা নেই।
বাংলাদেশ হঠাৎ করে ভারতের কলোনীতে পরিণত হয়নি। হঠাৎ করেই এ দেশটির স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র কবরে যায়নি। এবং এর শুরুটি শেখ হাসিনার শাসন থেকে শুরু হয়নি। গণতন্ত্রকে শেখ মুজিব নিজ হাতে কবরে পাঠান এবং প্রতিষ্ঠা দেন তার নিজের ও নিজ দলের ফ্যাসিবাদ। ভারত সেটিকেই সমর্থণ দেয়। গণতন্ত্র ভীতি শুধু মুজিবের ছিল না, ছিল ভারতেরও। দখলদার শক্তির সব সময়ই থাকে গণতন্ত্র ভীতি। কারণ গণতন্ত্র দিলে দখলদারী বাঁচে না। কোন দেশই শত্রু দেশের হাতে অধিকৃত হলে সেদেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বাঁচে না। সেদেশ তখন কলোনীতে পরিণত হয়। গণতন্ত্র হত্যায় ভারত মুজিবের সহযোগী পার্টনারে পরিণত হয়েছিল। এখন ভারতের সে পার্টনারশিপ চলছে শেখ হাসিনার সাথে।
ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের এজেন্ডা ১৯৪৭’য়ের পূর্বে যা ছিল, ১৯৪৭’য়ের পর এবং ১৯৭১’য়ের পরও তাই আছে। তারা একটুও পাল্টায়নি। তারা এখনো বেঁচে আছে অখণ্ড ভারত নির্মাণের এজেন্ডা নিয়ে। কিন্তু পাল্টে গেছে বাঙালি মুসলিমগণ। পাল্টে গেছে তাদের রাজনীতির ভিশন ও মিশন। পাল্টে গেছে তাদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি। ১৯৪৭’য়ের পূর্বে বাঙালি মুসলিম জীবনে গুরুত্ব পেয়েছিল মুসলিমত্ব ও প্যান-ইসলামিক বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্ব। ইবাদত গণ্য হতো অবাঙালি মুসলিমদের সাথে একতা গড়া। তখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা গণ্য হতো শত্রু রূপে। কিন্তু ১৯৪৭’য়ের পর বাঙালি মুসলিম জীবনে গুরুত্ব হারিয়েছে মুসলিমত্ব ও প্যান-ইসলামিজম; এবং গুরুত্ব পেয়েছে বাঙালিত্ব ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এবং হিন্দুত্ববাদীরা গণ্য হয়েছে পরম মিত্র রূপে। সে মিত্রতা দেখা গেছে একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিনাশে। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল নানাভাষীদের নিয়ে পাকিস্তান নামের civilisational state এবং ১৯৭১’য়ে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে ট্রাইবাল স্টেট। বাঙালি মুসলিমগণ বিচ্যুৎ হয়েছে তাদের ১৯৪৭’য়ের এজেন্ডা থেকে।
যুদ্ধের জয়-পরাজয় শুধু জাতির ভূগোল পাল্টায় না, পাল্টিয়ে দেয় ইতিহাস, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্মপালন ও জাতির সামগ্রিক ভাগ্য। কোন মহামারি, ভূমিকম্প বা সুনামীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হলেও এতো পরির্তন আসে না। তাই পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর বিজয় শুধু বাংলার ভাগ্যে বিপর্যয় আনেনি, বিপর্যয় এনেছে সমগ্র উপমহাদেশের জনগণের ভাগ্যে ও ইতিহাসে। একই ভাবে একাত্তরের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর বিজয় শুধু বাঙালি মুসলিমদের জীবনেই বিপর্যয় আনেনি, বিপর্যয় এনেছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জীবনে। ভারতের এ বিজয় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সমীকরণই পাল্টে দিয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধজয়ের ফলে ভারত পরিণত হয়েছে একটি আঞ্চলিক শক্তিতে। এবং পৌছে গেছে বিশ্বশক্তি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এরই ফল হলো, ভারতে এখন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে সে স্থানে মন্দির নির্মাণ করতে পারে। ইচ্ছামত ভারতীয় মুসলিমদের নাগরিকত্বও হরণ করতে পারে। এবং কাশ্মীর, গুজরাত, আসাম, দিল্লি বা ভারতের যে কোন প্রদেশে ইচ্ছামত মুসলিম গণহত্যাও চালাতে পারে। সে ভারতীয় বিজয়ের প্রবল প্রভাব দেখা যায় বাংলাদেশের উপরও। বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা, শাপলা চত্বরের গণহত্যা, পিলখানায় ৫৭ জন সামরিক অফিসার হত্যা, ইসলামপন্থীনেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটডাকাতি -এসবের কোনটাই শেখ হাসিনার একার কর্ম নয়। এর সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ভারতও। বরং এসবই হলো একাত্তরে ভারতীয় বিজয়ের ধারাবাহিকতা। ভারত নিজ দেশের ভিতরে বা বাইরে যাই করুক -সেটি থামানোর কেউ নাই। কারণ, ভারত এখন আমেরিকা, রাশিয়া, চীন এবং ইসরাইলের মতই invincible তথা অপরাজেয়। ভারত সেটি ১৯৭১’য়ের যুদ্ধজয়ে অর্জন করেছে। ইসলামচ্যুৎ বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের অপরাধ হলো তারা ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী ও অপরাধী শক্তির হাতে সে বিজয় তুলে দিয়েছে। ১৯৪৭’য়ে বাংলার প্রজ্ঞাবান, দূরদৃষ্টিবান ও ইসলামপ্রেমী মুসলিম নেতাগণ পাকিস্তান নির্মাণ করেছিলেন এমন এক আগ্রাসী ভারতের হাত থেকে বাঁচার তাড়নায়। কিন্তু ভারতের মিত্র ইসলামবিদ্বেষী বাঙালি দুর্বৃত্তগণ সে প্রকল্প একাত্তরে ব্যর্থ করে দেয়।
হাতছাড়া হলো অপূর্ব সুযোগ এবং বদলা নিল হিন্দুত্ববাদীরা
বাঙালি মুসলিমগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে কখনো নিজ দেশও শাসন করিনি। বাংলার পাল ও সেন রাজারাও বাঙালি ছিল না। সেন বংশীয় শাসকগণ এসেছিল ভারতের কর্ণাটাকা রাজ্য থেকে। সেন রাজাদের পরাজয়ের পর শুরু হয় অবাঙালি মুসলিম শাসন ও ইংরেজ শাসন। ১৯৪৭’য়ের পাকিস্তান আজ বেঁচে থাকলে দেশটি পরিণত হতো চীন ও ভারতের পর ৪৪ কোটি জনসংখ্যার তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক শক্তিধর দেশে। বাংলাদেশের চেয়ে ১৯৪৭’য়ের অখণ্ড পাকিস্তানের আয়োতন ৭ গুণ বৃহৎ। পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে এবং সেদেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী রূপে বাঙালি মুসলিমগণ বিশ্ব রাজনীতিতে ও মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ পেত। সে সুযোগ অতীতে খাজা নাযিমুদ্দীন, মহম্মদ আলী বোগরা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পেয়েছেন। একমাত্র শত্রুগণই বাঙালি মুসলিমের সে সুযোগ বিনষ্ট করার কথা ভাবতে পারে। একাত্তরে বস্তুত সে ষড়যন্ত্রই সফল হয়েছে। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাঁরা পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যেই বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা, গৌরব ও ইজ্জত দেখেছে। অথচ গণতন্ত্রের শত্রু ভারতসেবী কাপালিকগণ তাদেরকে স্বাধীনতার শত্রু বলে। এটি বাঙালি ফ্যাসিস্টদের আরেক delusion।
বস্তুত পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালি মুসলিমদের থেকে বদলা নিয়েছে। কারণ ঢাকায় মুসলিম লীগে জন্ম থেকে শুরু করে পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমদের অবদানের স্মৃতি তারা ভূলেনি। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ -এ ১১টি বছর বাঙালি মুসলিম প্রধানমন্ত্রী শাসন করেছে অবিভক্ত বাংলার উপর। এটি বাংলার গর্বিত হিন্দুদের কাছে অসহ্য ছিল। বাঙালি মুসলিমগণ একক রক্তদানের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল -পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান বা বেলুচ মুসলিমদের নয়। বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ড যুদ্ধটি হয়েছে বাংলার রাজধানী কলকাতার বুকে। ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রসের সাথে সকল আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ বুঝতে পারলেন, আলোচনা করে পাকিস্তান মিলবে না। সর্বশক্তি দিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। তিনি ডাক দিলেন “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” আন্দোলনের। অর্থ: “লড়াই করেই নিব পাকিস্তান”। দিনটি ছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট। ঐদিন কলকাতার গড়ের মাঠে ছিল মুসলিম লীগের বিশাল জনসভা। প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জনসভা থেকে জনগণ যখন সন্ধায় ঘরে ফিরছিল তখন তাদের উপর হামলা করে কংগ্রেসী গুন্ডারা। তাতে ৫ হাজারের বেশী মুসলিম শহীদ হয়ে যায়। মুসলিম বস্তিতে আগুন দেয়া হয়। মুসলিম ছাত্রীদের হোস্টেল হামলা হয়। বহু মুসলিম শিশুকে জীবন্ত আগুনে ফেলে হ্ত্যা করা হয়। সে হিন্দু নৃশংসতার স্বচোখে দেখা বিবরণ দিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বাঙালি প্রফেসর তপন রায় চৌধুরি তাঁর “বাঙাল নামা” বইতে।
সে মুসলিম বিরোধী গণহত্যায় নিহতদের অধিকাংশই ছিল নোয়াখালীর। অনেকে ছিল বিহারী মুসলিম। তারা ছিল কলকাতা বন্দরের দরিদ্র শ্রমিক। এতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীতে এবং পরে বিহারে। ইংরেজগণ দেখতে পায় দাঙ্গা এরূপ চলতে থাকলে নিরাপত্তার সাথে তাদের ঘরে ফেরাই বিপদজনক হবে। কংগ্রস নেতৃবৃন্দ বুঝলো, অভিজ্ঞ ব্রিটিশ প্রশাসক ও পুলিশগণই যখন দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতের কংগ্রস সরকার কিরূপে এটি নিয়ন্ত্রণে আনবে? এরূপ দাঙ্গা চলতে থাকলে ভারত শাসনের অযোগ্য হয়ে পড়বে। কংগ্রসে নেতা গান্ধি তখন তড়িৎ বেগে মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিলেন। সাথে সাথে ব্রিটিশ সরকারও মেনে নিল। বাঙালি মুসলিমের রক্তে এভাবেই প্রতিষ্ঠা পেল পাকিস্তান। এবং এভাবেই ভণ্ড হলো অখণ্ড ভারত গড়ার হিন্দুত্ববাদী স্বপ্ন। এতে বাঙালি মুসলিমগণ পরিণত হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের বদলা নেয়ার টার্গেটে পরিণত হলো। তারা কি ভারতবিরোধী এ বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা দিয়ে পুরস্কৃত করবে? সেটি কি কোন সুস্থ মানুষ ভাবতে পারে? কিন্তু delusion’য়ের শিকার সেক্যুলার বাঙালিরা মনে করে ভারত তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
১৯৭১’সালে পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিয়ে বস্তুত ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা সে বদলা নেয়ার কাজটিই সমাধা করেছে। নইলে পাকিস্তান আর্মির অব্যবহৃত বিপুল অস্ত্র কেন তারা ভারতে নিবে? কেন তারা ক্যান্টনমেন্টগুলোর গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, ফ্যান খুলে নিজ দেশে নিবে। কেন লুটপাটের মধ্য দিয়ে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপহার দিবে? কেন তারা মুজিবকে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উপর বাকশালী ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দিবে? কেন হাসিনাকে দিয়ে ভোটের অধিকার ও মৌলিক মানবিক অধিকার কেড়ে নিবে? বাংলাদেশী জনগণের প্রতি সামান্যতম ভালবাসা থাকলে তাদের আচরণ কি কখনো এরূপ হতো?
বাংলাদেশ এখন ভারতীয় কলোনী
বাংলাদেশে নির্বাচন বলতে বুঝায় জনগণের ভোটের উপর ডাকাতি। পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে মিটিং-মিছিল ও জনগণের ভোটদানে যে স্বাধীনতা ছিল -সেটুকুও আজ বেঁচে নাই। দেশটিতে ইতিহাস-চর্চা বলায় বুঝায় স্রেফ মুজিব বন্দনা। বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণেও চলছে চরম ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদের নমুনা হলো, মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের হত্যাকারি, দুর্নীতির লালনকর্তা এবং ভারতসেবী ফ্যাসিস্টকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলতেই হবে। তাকে নিয়ে অতি সত্য কথা বলাটিও ফৌজদারী অপরাধ -যদি তাতে তাঁর জন্য মর্যাদাহানীকর হয়। রাজনীতি পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। অধিকৃত কলোনীর উপর যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার থাকে দখলদার দেশের। ভারত তাই শুধু বাংলাদেশের নদীগুলির পানিই তুলে নেয়নি, বরং দেশের বুক চিরে নিয়ে করিডোর নিয়েছে, সমুদ্রবন্দরগুলির উপর অধিকার নিয়েছে, এবং দখল নিয়েছে দেশটির বাজারের উপরও। বাংলাদেশ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম বাজার। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলি ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানীর জন্য এলসি বা ছাড়পত্র দেয় শুধু ভারত থেকে পণ্য আমদানীর জন্য; সে অনুমতি পাকিস্তান, তুরস্ক বা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা অন্য কোন মুসলিম থেকে পণ্য আমদানীতে দেয়না। এভাবেই ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা ভারত থেকে পণ্য আমদানীতে। অথচ কোন স্বাধীন রাষ্ট্রে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানীতে এরূপ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অথচ সেটিই হলো অধিকৃত কলোনী রাষ্ট্রের নীতি। ভারত যখন ব্রিটিশের কলোনী ছিল তখন ব্রিটিশের পণ্য আমদানীতে ব্যবসায়ীদের একই ভাবে বাধ্য করা হতো।
বাংলাদেশের স্কুলে কি পড়ানো হবে -সেটিও ভারত নির্ধারণ করে দেয়। যেমন ব্রিটিশ আমলে সেটি নির্ধারণ করে দিত ব্রিটিশ সরকার। ফলে স্কুলের পাঠ্য তালিকা থেকে নবীজী (সা:) ও সাহাবীদের জীবনী বাদ পড়েছে। ইসলামী মূল্যবোধ সৃষ্টি করে এমন কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্পও বাদ দেয়া হয়েছে। এবং যোগ করা হয়েছে বহু হিন্দুয়ানী পাঠ্য। এতো কাল স্কুলে ধর্ম শিক্ষার জন্য প্রতিদিন ক্লাস থাকতো। ইসলামে ধর্ম শিক্ষা ফরজ। অথচ এখন ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাসের সংখ্যা ও সময় কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে প্রতি সপ্তাহে নাচগানের ক্লাসের সময় ও সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়,সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বাংলাদেশের সরকার প্রধান কে হবে -সেটিও ঠিক করে দেয় ভারত। তাই বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, দিল্লির সরকারকে বলেছি তারা যেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখে। বিরোধী দলগুলি সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে দাবী তোলে, অনেক বিদেশী শক্তিও চার কূটনৈতকি চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু সে চাপ থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বাঁচায় ভারতে কুটনৈতিক মিশনগুলি। শেখ হাসিনাও তাই জনগণের ভোটের তোয়াক্কা করে না। জনগণের ভোটের উপর সে ইচ্ছামত ডাকাতি করে নেয়। যাকে ইচ্ছা তাকে গুম, খুন, কারাবন্দী ও অপহরণ করে। এবং ফাঁসিও দেয়। ফলে শুধু গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাও কবরে গেছে।
পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশীদের ধর্মীয় আচারও
পাল্টে দেয়া হচ্ছে, বাংলাদেশীদের ধর্মীয় আচারও। বাংলাদেশে এতোকাল মাটি দিয়ে মুর্তি নির্মাণ করা হতো এবং সেগুলি মন্দিরে রাখা হতো অথবা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হতো। মুর্তির নির্মাণ খরচ পুরোপুরি বহন করতো হিন্দুরা। দেশের মুসলিম নাগরিকগণ কখনোই মুর্তি নির্মাণের খরচ বহন করতো না। এখন মুর্তি নির্মাণ করা হয় রড-সিমেন্ট দিয়ে এবং মুর্তি নির্মাণের খরচ বহন করে দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯১ ভাগ বাঙালি মুসলিম। সেটি রাজস্ব দিয়ে। সে মুর্তিগুলি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও চৌরাস্তায় স্থাপন করা হয়। সে মুর্তির পায়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় -যেমনটি জানানো হয় মন্দিরের মুর্তিকে। এসবই হলো ১৯৭১’য়ে লিগাসী। জনগণকে এভাবে পরিকল্পিত ভাবে শিরকের শরীক বানানো হচ্ছে। বাংলাদেশের বুকে এটিই হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের সাংস্কৃতিক এজেন্ডা।
অথচ বাঙালি মুসলিমের হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলিমদের হাতে একটি মুর্তিও কোথাও নির্মিত হয়নি। সেটি না হওয়ার কারণ, বখতিয়ার খিলজীর হাতে বঙ্গজয়ের পর বাংলাদেশের ভূমি কখনোই কোন হিন্দু সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত হয়নি। ফলে বঙ্গীয় বদ্বীপের মুসলিমগণ কখনোই কোন হিন্দু শাসকের প্রজা হয়নি। একমাত্র ১৯৭১’য়েই বাংলা অধিকৃত হয়েছে হিন্দু সেনাবাহিনীর হাতে। এরপর থেকেই শুরু হয় বাঙালির ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি পাল্টানোর ধারাবাহিকতা। দিন দিন হিন্দুয়ানীর সে স্রোত আরো তীব্রতর হচ্ছে। কারণ সামরিক বিজয় কখনোই একাকী আসে না। সামরিক বিজয় মানেই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয়।
ভারত সরকারের সমর্থনের কারণে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনাকে জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। ভোটডাকাতি করলেও ভারত সেটিকে সুষ্ঠ নির্বাচন বলেছে। তাই বাঙালি মুসলিমের জীবনে ১৯৭১’য়ের যুদ্ধ এসেছে শুধু পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প নিয়ে নয়, বরং বাঙালি মুসলিমদের উপর একটি হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে। দেশের স্বাধীনতার অর্থ দেশের গাছপালা, আলো-বাতাস ও পশুপাখীর স্বাধীনতা নয়, বরং সেটি জনগণের স্বাধীনতা। তাই ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইলে জনগণকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের স্বাধীনতা দিত। এবং কখনোই হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতের পক্ষ নিত না। যারা দেশবাসীর স্বাধীন ভোটদানের পক্ষে নয়, তারা দেশের স্বাধীনতার পক্ষের হয় কি করে? এ থেকেই বুঝা যায়, ভারতের একাত্তরের যুদ্ধটি বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা দেয়ার উদ্দ্যেশ্যে ছিল। এটি ছিল মূলত বাংলাদেশকে ভারতে অধিকৃত কলোনী বানানোর প্রকল্প।
বাঙালি মুসলিমের অবিরাম অধোগতি
বাঙালি মুসলিমের যে অবিরাম অধোগতি -সেটি মূলত ইসলাম থেকে সরার। এতে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল বুদ্ধিবৃত্তিক অধোগতি। এরই ফলে বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য যা কিছু কল্যাণকর ও গৌরবজনক -সেগুলিও তাদের কাছে গুরুত্বহীন ও অকল্যাণকর মনে হয়। ফলে ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও তাদের কাছে এক অনাসৃষ্টি মনে হয়। অথচ বস্তুনিষ্ঠ বিচারে পাকিস্তানের সৃষ্টিই হলো বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক কর্ম। এটি সত্য যে, বাঙালি মুসলিমগণ বাহু বলে মুসলিম উম্মাহর শক্তি ও গৌরব বাড়াতে এক বর্গ মাইল ভূমিও কোথাও জয় করেনি। নিজ ভূ-খণ্ডের বাইরে কোথাও ইসলামের দাওয়াত নিয়েও হাজির হয়নি। কোথাও কোন মজলুম মুসলিম জনগোষ্ঠির উদ্ধারে কোন যুদ্ধও করেনি। অথচ তারাই বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণও সেটি স্বীকার করে। সে কথার বার বার উল্লেখ আসে পাকিস্তানের টিভি টক শো’গুলিতে এবং পত্রিকার কলামে।
অবশ্য এই বাঙালি মুসলিমগণই তাদের নিজ হাত গড়া বিশাল কৃর্তিকে নিজ হাতে ধ্বংস করেছে। এবং বিজয়ী করেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে। সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করতেই ইসলামের চিহ্নিত শত্রু মুশরিকদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ নিয়ে একাত্তরে যুদ্ধ নামে এবং নিজ ভূমিতে পৌত্তলিক সেনাবাহিনীকে ডেকে আনে। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের সাথে এতো বড় গাদ্দারীর অপরাধ আর কোন মুসলিম জনগোষ্ঠির দ্বারাই হয়নি। বাঙালি মুসলিমের হাজার বছেরের ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে কলংকিত অধ্যায়। এতে আনন্দ এবং বিজয় বেড়েছে ইসলামের শত্রুদের। সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে একাজটি এতোই গর্হিত গণ্য হয় যে, কিছু কাফির দেশ ছাড়া কোন মুসলিম দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয়নি। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে কাশ্মীর ও ভারতসহ বহু দেশের মুসলিম গৃহে ক্রন্দন উঠেছে। মুসলিম দেশগুলির স্বীকৃতি মিলেছে বহু বছর পর। অথচ মুসলিম উম্মাহর জন্য গর্বের ও আনন্দের বিষয় হলে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম দিনেই মুসলিম দেশগুলি থেকে স্বীকৃতি মিলতো। মুশকিল হলো, বাঙালি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক অধোগতি এতোই গভীর যে নিজেদের ভয়ানক ক্ষতিগুলি বুঝার সামর্থ্যও তাদের নাই। বুদ্ধিবৃত্তিক অধোগতির কারণ গণতন্ত্রের খুনি, ভারতের সেবাদাস এবং বাকশালী ফ্যাসিবাদের জনক যেমন জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু গণ্য হয়, তেমনি ভোটডাকাত এবং শাপলা চত্বরের খুনিও মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী গণ্য হয়। এগুলি হলো বাঙালির চিত্তের অসুস্থতার লক্ষণ।
বাঙালি মুসলিমদের মনে পাকিস্তান প্রসঙ্গে বহু বিভ্রান্তি যেমন বাংলাদেশীরা নিজেরা সৃষ্টি করেছে, তেমনি বহু বিভ্রান্তি সীমান্তের ওপার থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে এ বিষয়টি কখনোই পড়ানো হয়না যে, ১৯৪৭’য়ে কেন পাকিস্তান সৃষ্টি হলো? এমন কি সেটি পাকিস্তান আমলেও পড়ানো হয়নি। ফলে অধিকাংশ বাঙালি মুসলিম জানে না পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট। ফলে তাদের প্রকৃত বন্ধুদের চেনার কাজটি যেমন হয়নি, তেমনি হয়নি প্রকৃত শত্রুদের চেনার কাজটিও। অথচ বাংলাদেশ কেন সৃষ্টি হলো, সেটি জানা যেমন অতি জরুরি, তেমনি জরুরি হলো পাকিস্তান কেন সৃষ্টি হলো এবং ভেঙ্গে গেল -সেটি জানাও। কারণ বিষয়গুলি বাঙালি মুসলিমদের নিজ ইতিহাসের সাথে জড়িত। অথচ সে বিষয়ে জ্ঞানদান না করে পাকিস্তানের সৃষ্টিকে এক সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি আখ্যা দিয়ে কলকাতা ও দিল্লির হিন্দুত্ববাদীদের বয়ানকে প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে।
বাঙালি মুসলিমদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টিকালে তাদের কাছে বাঙালি হওয়া গুরুত্ব পায়নি; গুরুত্ব পেয়েছিল মুসলিম হওয়াটি। তাঁরা রাজনীতির ময়দানের স্বপ্ন দেখতো মুসলিম রূপে, বাঙলি রূপে নয়। গুরুত্ব পেয়েছিল অন্য ভাষী, অন্য বর্ণের ও অন্য এলাকার মুসলিমদের সাথে একতাবদ্ধ হওয়াটি। এদিক দিয়ে তাদের চেতনাটি ছিল শতভাগ ইসলামী। সেক্যুলার বাঙালিদের কাছে তারা কদর না পেলেও সে বিশ্বাসের জন্য তারা অবশ্যই কদর পাবেন মহান অআল্লাহতায়ালার কাছে। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ সেরূপ স্বপ্ন একাত্তরে যেমন দেখেনি, তেমনি আজও দেখেনা। ফলে মুসলিমদের সাথে একাত্ম না হয়ে একাত্ম হয়েছে মুশরিক কাফিরদের সাথে। একাত্তরের চেতনার সাথে ১৯৪৭’য়ে চেতনার এখানেই মূল পার্থক্য।কিন্তু সে পার্থক্য বুঝার সামর্থ্য বাঙালি মুসলিম চেতনায় গড়ে তোলা হয়নি। এবং সেটিও একটি শত্রুশক্তির স্ট্রাটিজী।
ইসলামী চেতনাশূণ্যদের কাছে আধুনিক যুগে ইসলামের পক্ষে খাড়া হওয়াটি বিস্ময়কর মনে হয়। একই কারণে ইসলামী চেতনাশূণ্য বাঙালি মুসলিমদের কাছে অতি বিস্ময়কর হলো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি। তারা ভেবে অবাক হয়, বাঙালি মুসলিমগণ কিরূপে ১২ শত দূরের অবাঙালিদের সাথে মিলে এক রাষ্ট্রের জন্ম দিল। পাকিস্তানকে তাদের কাছে এক অদ্ভুদ ও অবাস্তব রাষ্ট্র মনে হয়। এরই ফল হলো, যেসব বাঙালি মুসলিমগণ সেদিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাকিস্তানের সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিল -তাদের কথা তারা আজ মুখেও আনে না। বরং যারা সে পাকিস্তান ভাঙ্গলো তাদেরকে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে গর্ব করে। চেতনার জগতে এ এক বিশাল যুগান্তকারী পরিবর্তন। সেরূপ পরিবর্তন থেকে তারাও রক্ষা পায়নি যারা বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলের নেতাকর্মী। ফলে ইসলামপন্থী দলের নেতাকর্মীরাও পাকিস্তানের মত একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা আজ ভাবতেও পারেনা। বরং বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই মুসলিম রাষ্ট্রের বিনাশটিও তাদের কাছে উৎসবজনক মনে হয়। এজন্য ইসলামী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ১৬ ডিসেম্বর এলে ঢাকার রাজপথে পাকিস্তানের পরাজয়ের দিনটি নিয়ে বিজয় উৎসব করতে দেখা যায় -যেমন হিন্দুত্ববাদীরা উৎসব করতে দেখা যায় ভারতে। বাঙালি মুসলিমের চেতনা-জগত এভাবে পাল্টে যাওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সেটি বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনা নিয়ে তাদের বেড়ে উঠায় চরম ব্যর্থতা। শূণ্যতা এখানে কুর’আনী জ্ঞানের। তাদের সে বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতাকে তীব্রতর করেছে একাত্তর পরবর্তী ইসলাম বিরোধী সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চেতনার বিশাল জোয়ার।
এ বিষয়ে অবশ্যই গবেষণা হওয়া উচিত যে, ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টিকালে বাঙালি মুসলিমের চেতনার ভূমিতে বাঙালিত্বের বদলে মুসলিমত্ব কিরূপে এরূপ শক্ত অবস্থান পেল? প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দুদের বাদ দিয়ে তারা কেন ১২ শত মাইল দূরের অবাঙালি মুসলিমদের আপন রূপে গ্রহণ করলো? ইসলামশূণ্য সেক্যুলার বাঙালি মুসলিমের কাছে এটি অবাক করার মত ইতিহাস। প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পিছনে একটি দর্শন কাজ করে। যারা সে দর্শনটি বুঝতে ব্যর্থ হয়, তারা ব্যর্থ হয় সে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি বুঝতে। বাঙালি মুসলিমের ১৯৪৭’য়ে সিদ্ধান্তের পিছনে একটি প্যান-ইসলামিক চেতনা ছিল। সে চেতনা গড়ে উঠার পিছনে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট ছিল। সে প্রেক্ষাপট হলো, ব্রিটিশ যুগে বাংলার প্রতিটি স্কুলে মুসলিম ছাত্রদের জন্য উর্দু অথবা ফার্সি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। এর অর্থ, প্রতিটি বাঙালি মুসলিম তখন তাঁর চিন্তার পুষ্টি ও ইন্ধন পেত ইসলাম-সমৃদ্ধ উর্দু বা ফার্সি সাহিত্য থেকে। এই উর্দু সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালি মুসলিমগণ অবাঙালি বিহারী, পাঠান, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, গুজরাটি, হায়দ্রাবাদী ইত্যাদি নানা ভাষার ও নানা এলাকার মুসলিমদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক অঙ্গণে একতার বন্ধন খুঁজে পেয়েছিল। তাই তারা পেয়েছিল মুসলিম উম্মাহর ধারণা।
সেরূপ একটি প্যান-ইসলামিক বন্ধন নিয়ে বেড়ে উঠাকে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাকর্মীগণ ইবাদত মনে করতো। নবীজী ও সাহাবাদের যুগেও সেটি দেখা গিয়েছিল। তাই ইসলামের সে গৌরব যুগে আরব, ইরানী, তুর্কী, কুর্দি, মুর, আফগানী ইত্যাদি নানা ভাষাভাষী মুসলিম মিলে বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল। ১৯৪৭’য়ে বাঙালি মুসলিম জীবনে নবীজী (সা:) ও তাঁর মহান সাহাবাদের পবিত্র সূন্নত নিয়ে বেড়ে উঠাটি গুরুত্ব পেয়েছিল। রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় এটিই হলো প্যান-ইসলামিজম। ইসলামে এমন চেতনা ধারণ করাটি ফরজ। অবশ্য তখনও বাজারে জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও আঞ্চলিকতাবাদ ছিল। কিন্তু সেদিনের বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সেগুলি হারাম গণ্য হয়েছে এবং সে পথে চলা আত্মঘাতী মনে হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিম সংযোগ হারায় উর্দু ও ফারসী থেকে। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টির জন্য ষোল আনা নির্ভর করে হিন্দুত্ববাদের বিষপূর্ণ বাংলা সাহিত্যের উপর। এ সাহিত্যে ঈমান ধ্বংসের উপকরণ বিশাল। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্র হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের আদিগুরু। ভারতীয় রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হিন্দুত্ব শব্দটিও এসেছে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমট উপন্যাস থেকে। সে উপন্যাসের “বন্দেমাতরম” গানটি হলো ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের “জনগণ মন অধিনায়ক” গানটিও। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক আদর্শ রূপে গ্রহণ করেছিলেন মারাঠী সন্ত্রাসী ও প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী শিবাজী’কে। তার নামে তিনি কলকাতায় শিবাজী উৎসব শুরু করেছেন। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্র বিজিপি ও রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (RSS)’য়ের কাছে এতো পূজনীয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক অপুষ্টি ও অজ্ঞতার নাশকতা
বাঙালি মুসলিমের সকল বিপর্যয়ের শুরু বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা থেকে। জ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম বলেই মহান আল্লাহতায়ালা নামাজ-রোজার আগে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছিলেন। বাঙালি মুসলিমের আগ্রহ সেদিকে নাই। ফলে তাদের নীচে নামা আর শেষ হচ্ছে না। জ্ঞানের গুরুত্ব যেমন ব্যক্তির নির্মাণে, তেমনি জাতির নির্মাণে। শুধু উন্নত অস্ত্র ও বিশাল সেনাদল দেশের স্বাধীনতা বাঁচাতে পারে না। সে জন্য চাই বুদ্ধিবৃত্তিক বল তথা দর্শনের বল। অস্ত্রের বল দেয় ভৌগলিক মানচিত্রের সুরক্ষা, আর দর্শনের তথা বুদ্ধিবৃত্তিক বল দেয় চেতনার মানচিত্রের সুরক্ষা। চেতনার মানচিত্র সুরক্ষিত না হলে ভৌগলিক মানচিত্র বাঁচে না। পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে যতটা অস্ত্রের অভাবে, তার চেয়ে বেশী দর্শনের অভাবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে এমন একটি শক্তিশালী দর্শন ছিল -যার কোন তুলনা হয়না। সেটি ছিল ইসলামের দর্শন। সে দর্শন নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের মাঝে ইস্পাতসম একতা সৃষ্টি করেছিল। সে একতা মুসলিমদের মাঝে এমন এক রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করের্ছিল যে, পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র সৃষ্টিতে কোন সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়নি। এমন কি ইংরেজ ও হিন্দুদের সম্মিলিত বিরোধীতাও তাদেরকে পরাজিত করতে পারিনি।
সাহায্য ও আযাব – উভয়ই আসে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। বিভক্তি যেমন ভয়ানক আযাব আনে, একতা আনে বিশাল রহমত। উপমহাদেশের মুসলিমদের একতা পুরস্কৃত হয়েছিল ২৭ রমযানের পবিত্র রাতে পাকিস্তান প্রাপ্তির মধ্য দিয়। কিন্তু সে পাকিস্তানকে তারা বাঁচাতে পারিনি। কারণ, তারা সুরক্ষা দিতে পারিনি ১৯৪৭’য়ের দর্শনের সে বলকে। পাকিস্তান সরকার ও জনগণ সে দর্শনকে ধরতে পারিনি। কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা -সে ইতিহাসও দেশটির সরকার জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। এ বিষয়ে এক খানি বইও লেখা হয়নি। ফলে দেশটি -বিশেষ করে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্লাবিত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজমের ন্যায় হারাম মতবাদে। সে প্লাবনে ভেসে গেছে বাঙালি মুসলিমের চেতনা থেকে প্যান-ইসলামী দর্শন। ফলে সে দেশকে তারা ১৯৪৭’য়ে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল -সে দেশেরই তারা শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এবং বন্ধুতে পরিণত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের। বাঙালি মুসলিমগণ তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে কোন কালে কি ইসলাম থেকে এতোটা দূরে সরেছে?
বাঙালি মুসলিমের এতো নীচে নামা এবং ইসলাম থেকে এতো দূরে সরার কারণও রয়েছে। সর্বনাশা দুর্ভিক্ষটি তাদের জ্ঞানের রাজ্যে। খাদ্যের দুর্ভিক্ষে দৈহিক মৃত্যু ঘটে। আর জ্ঞানের দুর্ভিক্ষে বিবেক মারা যায়। বিবেক মারা গেলে মানুষ আত্মঘাতী হয়; দেশবিনাশীও হয়। সে আত্মঘাতেরই চরম রূপ হলো, নিজ দেশের বিনাশে চিহ্নিত বিদেশী শত্রুকে ঘরে ডেকে আনা। সেটিই দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। বাঙালি মুসলিমের সাম্প্রতিক ইতিহাস তাই আত্মঘাতের। বাঙালি মুসলিমের জ্ঞানের দুর্ভিক্ষটি বুঝা যায় বইয়ের বাজারে নজর দিলে। বাংলা ভাষায় যারা বইয়ের লেখক তাদের শতকরা ৯৮ ভাগ এসেছে হিন্দু, সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, কম্যুনিস্ট ও নাস্তিকদের মধ্য থেকে। বাংলা সাহিত্যের এ অঙ্গণে তেমন কোন আলেম বা ইসলামী চিন্তাবিদ নাই। বাংলা ভাষায় আল্লামা ইকবাল, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা মওদূদীর ন্যায় বুদ্ধিজীবী একজনও জন্ম নেয়নি। অথচ বাংলাদেশে ১৭ কোটি মুসলিমের বসবাস। পশ্চিম বাংলা ও আসামের বাঙালি মুসলিমের সংখ্যাটি যোগ করলে সে সংখ্যাটি প্রায় ২২ কোটি। অথচ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা ভাষায় ইসলামী বই বলতে বুঝাতো নেয়ামুল কুর’আন, মোকসুদুল মু’মিনিন, বেহশতী জেওয়ার, বিশ্বনবী, বিষাদ সিন্ধু ও আনোয়ারা উপন্যাস। তখনও বাংলা ভাষায় পবিত্র কুর’আন শরীফ ও হাদীস গ্রন্থের অনুবাদ বের হয়নি।
উর্দু ভাষার সাথে বাঙালির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রথম চেষ্টা করেছিল হিন্দুবাঙালিদের পক্ষ থেকে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ। কারণ,বাংলার তৎকালীন ইংরেজ জনশিক্ষা কর্মকর্তা (DPI) Mr. W.W. Hornwell তাদের সে দাবী মেনে নেননি। Mr. Hornwell যুক্তি দেখিয়েছিলেন, উর্দু না শিখলে মুসলিম ছাত্ররা ইসলাম সম্মন্ধে অজ্ঞ থেকে যাবে। কারণ, বাংলা ভাষা গড়ে তোলা হয়েছে মূলত হিন্দুদের দ্বারা হিন্দুদের মননে পুষ্টি জোগানোর জন্য এবং এ ভাষায় মুসলিম ছাত্রদের ইসলাম শেখানোর জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই লেখা হয়নি। ইংরেজ কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়টি অজানা ছিল না। ফলে তাঁর যুক্তি যথার্থ ছিল। তবে লক্ষনীয় হলো এবং সে সাথে পরিতাপের বিষয় হলো, উর্দুর সাথে সংযোগ বিচ্ছন্নতার যে হিন্দু প্রচেষ্টা ব্রিটিশ আমলে সফল না হলেও সফল হয়েছে পাকিস্তান আমলে। এবং সেটি বাঙালি মুসলিম সেক্যুলারিস্টদের দ্বারা। এবং সেটি ঘটে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই। এবং সেটি ঘটানো হয় ভাষা আন্দোলনের নামে। বাঙালি মুসলিম জীবনে সকল নাশকতার শুরু বস্তুত তখন থেকেই।
উর্দুর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বাঙালি মুসলিমের চেতনায় শুরু হয় ইসলামী জ্ঞানে প্রচণ্ড পুষ্টিহীনতা। শুরু হয় হিন্দুদের লেখা পৌত্তলিক সাহিত্যের মাধ্যমে ঈমান ধ্বংসের মহামারি। শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন থেকে আগত কম্যুনিস্ট সাহিত্যের প্রবল স্রোত। নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠে মৃত ঈমান ও ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে। ছাত্র রাজনীতির গুরুতে পরিণত হয় সিরাজুল আলম খানের ন্যায় ইসলামী চেতনাশূণ্য জাহেল কাপালিকগণ। ইসলামের শিকড়ের সংযোগ না থাকায় বাঙালি মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীগণ দলে দলে কচুরিপানার ন্যায় ভেসে যায় জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনিজমের ন্যায় জাহিলিয়াতের স্রোতে। জাহিলিয়াতের সে স্রোত তীব্রতা পায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সেক্যুলার রাজনৈতিক মহলে। চেতনার ভূবনে প্রবল দূষিতকরণের ফলে ভৌগলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন পাকিস্তান তাদের কাছে এক অবাস্তব রাষ্ট্র মনে হয়। তাদের এমন বিশ্বাসের মূলে ছিল প্রচণ্ড ইসলামবৈরীতা। এজন্যই ৫ হাজার মাইলের ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ঔপনিবেশিক ইংরেজ সাম্রাজ্যে ভারতের ১৯০ বছবের অন্তর্ভুক্তি তাদের কাছে অবাস্তব ও অসম্ভব গণ্য হয়নি। কিন্তু অবাস্তব ও অসম্ভব গণ্য হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে মাত্র ১২ শত মাইলের ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা।
ইসলামের সাথে এসব ঘরের শত্রুদের দুশমনির নজির হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে তারা পবিত্র কুর’আনের আয়াতটি সরিয়ে দেয়। আল্লামা মহম্মদ ইকবাল বাঙালির শত্রু ছিলেন না। তাঁর সাহিত্য বাঙালি মুসলিম চেতনায় পুষ্টি জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ছিল। অথচ তাঁর সে নামটি বিলুপ্ত করা হয়। দুশমনিটা এখানে তার ইসলামী চেতনার সাথে। অপর দিকে ইসলামী জ্ঞান-সমৃদ্ধ উর্দু সাহিত্যের সাথে সংযোগ রাখার সুফল পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। অথচ উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রদেশের জনগণেরই মাতৃভাষা নয়। ইসলামী জ্ঞানসমৃদ্ধ উর্দু সাহিত্যের কারণেই কম্যুনিজম ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সেরূপ প্রবল স্রোত পশ্চিম পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়নি। সেটির প্রমাণ হলো করাচী, লাহোর, পেশোয়ার ও ইসলামবাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বামপন্থী বা জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনগুলি বিজয়ী হতে পারিনি; বিজয়ী হয়েছে প্যান-ইসলামিক চেতনার ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান বেঁচে যায় ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে ৪ টুকরো হওয়া থেকে।
উর্দু সাহিত্য, প্যান-ইসলামিজম এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা
এ বিষয়টি নিশ্চিত, ব্রিটিশ আমলে বাংলার স্কুলগুলিতে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের যদি উর্দু বা ফার্সি ভাষা শেখানো না হতো তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙ্গালী মুসলিমগণ কখনোই অবাঙালিদের সাথে একত্রে একই কাতারে যোগ দিত না। তখন বরং অখণ্ড ভারতের নাগরিক রূপে তারা আরেক কাশ্মীরে পরিণত হতো। অনেক বাঙালি মুসলিমই একথা জানে না যে, ব্রিটিশ আমলে সমগ্র ভারত মাঝে সবচেয়ে বেশি উর্দু পত্রিকা বের হতো অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে। সে আমলে কলকাতা থেকেই বের হতো সমগ্র ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক পত্রিকা আল-হেলাল। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় মুসলিম বুদ্ধিজীবী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী গদ্য লেখক।
প্যান-ইসলামিজমের অতি শক্তিশালী আরেক প্রবক্তা ছিলেন আল্লামা মহম্মদ ইকবাল। তিনিই ছিলেন উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে পেশোয়ার পর্যন্ত সে আমলের শিক্ষিত বাঙালি ও অবাঙালি মুসলিমরা তাঁর কবিতা পড়ে আন্দোলিত হতো। সে সাহিত্যের প্রভাবে তখন মুসলিম রাজনীতিতে গুরুত্ব পেত মুসলিম ভাতৃত্ব নিয়ে বেড়ে উঠা; বাঙালি রূপে নয়। প্যান-ইসলামিজমকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ভূমিকাও বিশাল। তাঁর পত্রিকা আল-হিলালের মাধ্যমে তিনি সমগ্র ভারতের শিক্ষিত মুসলিমদের নিজ ভাষা ও নিজ অঞ্চলের উর্দ্ধে উঠে বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্ব নিয়ে বেড়ে উঠতে অনুপ্রেরিত করেন। সে আমলে প্যান-ইসলামিক আন্দোলনের আরেক নেতা ছিলেন উত্তর প্রদেশের মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহার। মুহাম্মদ আলী জওহার ছিলেন অতি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি আলিগড় ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি বৃত্তি পেয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে মুহাম্মদ আলী জওহার কোন সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে “কমরেড” নামে একটি পত্রিকা বের করেন। সে পত্রিকাকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রচারের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেন। ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে রেনেসাঁর সৃষ্টিতে তাঁর লেখনী অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। তিনি হামদর্দ নামে একটি উর্দু পত্রিকাও বের করেন। তার লেখনীর পাঠক ছিল চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে পেশোয়ার পর্যন্ত শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়। ভারতীয় উপমহাদেশ মুসলিমদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ, চিন্তার যোগসূত্র ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে আল-হিলাল, কমরেড ও হামদর্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুসলিম ইতিহাসে আর কখনোই তাদের মত এতো উঁচু মানের শিক্ষিত মানুষ এরূপ কলম যুদ্ধে নামেনি। এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক পরমন্ডলে বাঙালি মুসলিমগণও তখন অবাঙালি মুসলিমদের সাথে ইসলামের অভিন্ন ধারায় একাত্ম হয়ে যায়। সেটিই ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে যখন ঔপরিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার মিত্ররা উসমানিয়া খেলাফতের ধ্বংসে যুদ্ধে নামে তখন ভারতীয় মুসলিমগণ উসমানিয়া খেলাফতের পক্ষে খেলাফত আন্দোলন গড়ে তোলে। ভারতের সমগ্র ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম গণ আন্দোলন। এই আন্দোলনের আগে এমনকি ভারতীয় কংগ্রেস এবং তার নেতা মহাত্মা গান্ধীও এরূপ কোন গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। এতো বড় বিশাল গণআন্দোলন দেখে এমন কি গান্ধীও এ আন্দোলনকে সমর্থন করেন।
পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক নির্মাতা ছিলেন কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি তথা দর্শন পেশ করেন আল্লামা মহম্মদ ইকবাল। তাই ইকবালকে পাকিস্তান প্রকল্পের আর্কিটেক্ট বলা হয়। ১৯৪৭’য়ের মুসলিম চিন্তানায়ক ও রাজনৈতিক নেতাগণ বিশ্বাস করতেন, কোন মুসলিম তাঁর রাজনীতিকে কখনোই ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতা দিয়ে সীমিত করতে পারে না। এরূপ সীমিতকরণ প্রক্রিয়াটি ইসলাম হারাম। মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় বড় এবং ভয়ানক ক্ষতিগুলি করেছে ইসলাম থেকে দূরে সরা জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, গোত্রবাদী, রাজতন্ত্রবাদী ও আঞ্চলিকতাবাদী নেতারা।
সাতচল্লিশের নেতাবৃন্দ ও একাত্তরের নেতৃবৃন্দ
১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুসলিমদের সৌভাগ্য হলো, আধুনিক মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে শিক্ষিত বাঙালি গুণীজন পাকিস্তান আন্দোলনে সাথে যোগ দিয়েছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা যে কোন ব্যক্তির জ্ঞানের ও প্রজ্ঞার পরিমাপ দেয়। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা নাই এমন ব্যক্তিকে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া হয়না। ১৯৪৭’য়ের কিছু বাঙালি মুসলিম নেতার শিক্ষাগত যোগ্যতার কিছু বিবরণ দেয়া যাকে। পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে শক্তিশালী নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দী। তিনি লেখাপড়া করেছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর রাজনীতির শুরু কলকাতা বন্দরের শ্রমিক নেতা রূপে। পরে তিনি কলকাতার ডিপুটি মেয়র হন। তখন চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন কোলকাতার মেয়র। পরে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি বেড়ে উঠেছে কলকাতায়, রাজনীতিও করেছেন কলকাতায়। কলকাতার বাঙালি বাবুদের হিন্দু মানস সম্বন্ধে খুব কম সংখ্যক বাঙালি মুসলিমই সোহরায়ার্দীর মত এতোটা গভীর ভাবে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম লীগকে বাংলার জনগণের সর্বস্তরে সংগঠিত করার কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সোহরাওয়ার্দী।
সোহরাওয়ার্দী মনে করতেন, পাকিস্তানের প্রয়োজন পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের বেশী। কারণ, বাঙলি মুসলিমগণ ছিল মুসলিম উম্মাহর মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন ও আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। এজন্য তিনি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাঝে বাঙালি মুসলিমের ভয়ানক বিপদ দেখতেন। গৃহে সাপ ঢুকলে সাপকে তাড়াতে হয়। সাপ মারতে গৃহ জ্বালানো বেকুবি। পাকিস্তানে বহু সমস্যা ছিল, কিন্তু সেসব সমস্যার সমাধান পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্যে ছিল না। সহরোওয়ার্দীর ন্যায় বিজ্ঞ নেতাদের লড়াই ছিল পাকিস্তান স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছিল, তাঁর সে যুদ্ধ কখনোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলনা। দেশ বেঁচে থাকলে বৈষম্যসহ অন্যান্য সমস্যারই সমাধান করা যায়। দেশ ধ্বংস করা সহজ, সেকাজে শত্রুরাও এগিয়ে আসে। দেশগড়ার কাজটি কঠিন। সে কাজে কেউ এগিয়ে আসেনা, সে কাজ নিজেদেরই করতে হয়।
সহরোওয়ার্দী ভিশনারী নেতা ছিলেন এবং এ দল থেকেই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি কাশ্মীর ইস্যুকে গ্লোবাল পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তিনি চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে মজবুত করেন। তিনি মনে করতেন বাঙালি মুসলিম যেহেতু পাকিস্তান গড়ার দায়িত্ব নিয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। সহরোওয়ার্দীর ইন্তেকাল করনে ১৯৬৩ সালে। তিনি বেঁচে থাকলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব শেখ মুজিবের মত বিচ্ছিন্নবাদী নেতাদের যেত না। ১৯৭১’য়ে একটি যুদ্ধের মুখেও পড়তে হতো না। একটি জাতির জীবনে প্রজ্ঞাবান ও দূরদৃষ্টিবান নেতার গুরুত্ব তো এজন্যই এতো অধিক। কিন্তু একাত্তরে বাঙালিরা সেরূপ নেতৃত্ব পায়নি। বরং নেতা রূপে পেয়েছে গণতন্ত্রের খুনি এক ভারতসেবী বাকশালি ফ্যাসিস্টকে। যিনি একাত্তরের অনেক আগেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন পাকিস্তানের বিনাশে। রাজনীতি ছিল তাঁর মুখোশ মাত্র। তাঁর আসল এজেন্ডা ছিল ভারতের এজেন্ডাপূরণ। এবং সেটিই পূরণ হয় একাত্তরের যুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের মাঝে সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সমর্থকের সংখ্যাটি ছিল বিশাল। এজন্যই শেখ মুজিব যখন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা পেশ করেন তখন ৬ দফার মাঝে পাকিস্তানকে দুর্বল করার ইঙ্গিত দেখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জেলার মাঝে ১৩ জেলার আওয়ামী সভাপতি দল ত্যাগ করেন। আজকের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীগণ সহরোওয়ার্দী নাম মুখে আনে না। কারণটি বোধগম্য। কারণ, সোহরাওয়ার্দীর চেতনায় ছিল অখণ্ড পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার তাড়না, দেশটিকে ভাঙ্গা নয়। ফলে হাসিনার ন্যায় নেত্রীদের সাথে সোহরাওয়ার্দীর চেতনা মিল খায়না।
বাঙালি মুসলমানদের আরেক নেতা ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। তিনিও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি লেখাপড়া করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনিই ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে একসাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী নেতাদের রাজনৈতিক চেতনা ও মুসলিম বিদ্বেষ সম্বন্ধে তাঁর ধারণাটিও ছিল গভীর ও অভিজ্ঞতা-প্রসূত। তাঁর একটি বক্তব্য সে সময় জনমুখে অতি পরিচিত পায়। তিনি বলতেন, “কলকাতার হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা যখন আমার কোন সিদ্ধান্তের পক্ষে পত্রিকায় লেখে, তখন বুঝতে হবে তাতে মুসলিমদের বড় অকল্যাণ রয়েছে। যখন তারা নিন্দা করে তখন বুঝতে হবে তাতে মুসলিমদের বড় কল্যাণ রয়েছে।” অথচ এ বাবুরাই একাত্তরে অতি খুশি হয়েছে মুজিবের রাজনীতিতে। শেরে বাংলার অভিজ্ঞতা থেকে বিচার করলে বুঝা যায়, বাঙালি মুসলিমের কতটা অকল্যাণ হয়েছে শেখ মুজিবের রাজনীতিতে। আজ তো সে অকল্যাণটিই বার বার প্রমাণিত হচ্ছে। সেটি অকল্যাণ প্রমাণিত হয় ১৯৭৪’য়ের দুর্ভিক্ষ, গণতন্ত্র হত্যা, বাকাশালী ফ্যাসিবাদ ও ভারতের কলোনী হওয়ার মধ্য দিয়ে।
তৎকালীন মুসলিমদের আরেক নেতা ছিলেন খাজা নাজিম উদ্দিন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কায়েদে আজমের মৃত্যুর পর তাঁর আসনে তথা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে তিনিই বসেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তিনি লেখাপড়া করেছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাঙালি মুসলিমদের আরেক নেতা ছিলেন ফরিদপুরের মৌলভী তমিজুদ্দীন খান। ইনি পাকিস্তানের গণপরিষদের (পার্লামেন্টের) প্রথম স্পীকার ছিলেন। পড়াশুনা করেছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। আরেক নেতা ছিলেন বগুড়ার মহম্মদ আলী। ইনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার আমলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মজবুত হয়। তিনি লেখাপড় করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনের আরেক নেতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের জনাব নূরুল আমীন। ইনি ১৯৪৭’য়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন; একাত্তরে ১৩ দিনের জন্য তিনি অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ইনিও পড়াশুনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সাতচল্লিশের তুলনায় সেরূপ শিক্ষিত নেতা ১৯৭১’য়ে জুটেনি। উচ্চ শিক্ষা মানুষকে উচ্চ দর্শন, দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দেয়। অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত মানুষদের মাঝে সেগুলি থাকে না। শিক্ষাগত সে দুর্বলতার আলামত দেখা দেয় মৌলানা ভাষানী, শেখ মুজিব, তাজুদ্দীন, সিরাজুল আলম খান ও মেজর জিয়াউর রহমানের মত নেতাদের মাঝে। ১৯৪৭ য়ের নেতাদের মাঝে ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার ছিল। তাদের একটি ইসলামী রাষ্ট্রীয় শক্তি রূপে বেড়ে উঠার vision ছিল। পাকিস্তানকে একটি civilisational state রূপে গড়ে তোলার একটি প্রবল তাড়না ছিল। তাছাড়া তাদের ছিল আগ্রাসী হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক অভিলাষ নিয়ে সুস্পষ্ট ও অভিজ্ঞত-প্রসূত ধারণা। সহোরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল, নাযিমুদ্দীন, মহম্মদ আলী বোগরা নুরুল আমীন, মৌলভী তমিজুদ্দীন -এরা সবাই ক্ষমতার উচ্চ আসনে বসেছেন। কিন্তু তারা দুর্নীতি করেছে -সে সাক্ষী নাই। তারা গণতন্ত্রের হত্যাকারী ছিলেন না। বিদেশী শক্তির এজেন্ট ছিলেন না। কিন্তু একাত্তরের শীর্ষ নেতা শেখ মুজিব সততার মানে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তার আমলেই রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী দুর্বৃত্তায়ন ঘটে। আগরতলা ষড়যন্ত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট হয়েছেন ভারতীয় গুপ্তপর সংস্থার সাথে। সে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রটি যে সত্য ছিল -সেটি সে মামলার অপর আসামী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ডিপুটি স্পীকার লে. কর্নেল শওকত আলী নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন। তাছাড় মুজিব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন গণতন্ত্রের হত্যাকারী ও একদলীয় বাকশালের প্রতিষ্ঠাত রূপে।
অপরদিকে ১৯৪৭ সালের নেতারা বুঝতেন, মুসলিমদের শক্তির উৎস লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসা নয়, সেটি হলো শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র। রাষ্ট্র না থাকলে মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ করে মুসলিম উম্মার স্বাধীনতা, ইজ্জত-আবরু ও জীবনের নিরাপত্তার সুরক্ষা দেয়া যায় না। সেরূপ শক্তিশালী বৃহৎ রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য চাই নানা ভাষী, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণের মুসলিমদের মাঝে একতা। আল্লাহতায়ালা এজন্যই একতাকে ফরজ করেছেন এবং বিভক্তিকে হারাম করেছেন। এটিই তো নবীজী (সা)’র পথ। সাতচল্লিশের নেতারা তাই একতার ফরজ পথটি ধরেছিলেন। কিন্তু মৌলানা ভাষানী, তাজুদ্দীন আহমেদ, জিয়াউর রহমান ন্যায় একাত্তরের নেতারা পথটি বেছে নেয় বিভক্তির হারাম । এবং তারা ভারতের ঘরে উঠে।
ঈমানদারীর পথ ও বেঈমানীর পথ
মহান আল্লাহতায়ালা যেমন পরীক্ষা নেন, তেমনি শয়তানও পরীক্ষা নেয়। মহান আল্লাহতায়ালার পরীক্ষা নেন তাঁর মু’মিন বান্দাদের ঈমানদারীর। যেসব ঈমানদারগণ ঈমানের পরীক্ষার পরীক্ষায় পাশ করে তাদেরকে তিনি বন্ধু রূপে গ্রহণ করেন এবং তাদের জান্নাত দেন। আর শয়তান পরীক্ষা নেয় তার অনুসারীদের বেঈমানীর। যখন কোন বেঈমান জ্বিনাতে লিপ্ত হয় বা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ময়দানে খাড়া হয় অথবা সূদী ব্যাংক থেকে সূদী লেনদেন করে -সে বেঈমানীর পরীক্ষায় পাশ করে। এবং ফেল করে ঈমানদারীর পরীক্ষায়। তেমনি কোন ব্যক্তি যদি কোন কাফির শক্তির বন্ধু হয় এবং কাফির শাসকের অর্থ, খাদ্য, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গার যুদ্ধে অংশ নেয় তবে সে উচ্চ মার্ক নিয়ে পাশ করে বেঈমানীতে। একাত্তরে তেমনি এক বড় পরীক্ষা হয়েছে বাঙালি মুসলিমের ঈমানদারীর ও বেঈমানীর। সেদিন যারা বেঈমানীর পরীক্ষায় পাশ করেছিল -তারাই সেদিন শয়তানের খলিফাদের কাছে কদর পেয়েছিল। আর দক্ষিণ এশিয়ার বুকে শয়তানের সবচেয়ে বড় খলিফা হলো ভারতের হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিকগণ। তাই বাঙালি বেঈমানগণ একাত্তরের দিল্লির শাসকদের কাছে কদর পেয়েছিল এবং পেয়েছিল তাদের অধিকৃত ভূমি বাংলাদেশ শাসনের অধিকার। আর যারা সেদিন বেঈমান হতে ব্যর্থ হয়েছে তারা সেদিন রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে। তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে বা জেলে তুলা হয়েছে। আজও তারা জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছে এবং ফাঁসিতে ঝুলছে।
মহান আল্লাহতায়ালা পরীক্ষা নেন হালাল ও হারাম নির্দিষ্ট করার মধ্য দিয়ে। তিনি দেখেন কারা বেছে নেয় হালাল পথটি। এবং কারা বেছে নেয় হারাম পথটি। ইসলামের হালাল-হারামের বিধান শুধু পানাহারে নয়, বরং সে বিধানটি রয়েছে রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করাকে তিনি হারাম করেছেন। সুরা আল-ইমরানে ২৮ নম্বর আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে:
لَّا يَتَّخِذِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْكَـٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ ٱللَّهِ فِى شَىْءٍ
অর্থ: “মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণ ব্যতীত কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে তাদের সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না।”
সুরা মুমতাহেনার ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ عَدُوِّى وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَآءَ
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, তোমার আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করোনা।”
মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম উপরিউক্ত দুটি আয়াতে অতি সুস্পষ্ট। তিনি যা কিছু নিষেধ করেন -সেটিই হারাম হয়ে যায়। হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিকগণ যেমন আল্লাহর শত্রু, তেমনি শত্রু হলো মুসলিমদের। তাই উপরিউক্ত আয়াত অনুযায়ী হারাম হলো হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে বন্ধত্ব করা। ফলে যাদের হৃদয়ে মাঝে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তারা কি কখনো ভারতের ন্যায় কাফির শাসিত রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় নিতে পারে? সেটি করলে কি ঈমান থাকে? কিন্তু একাত্তরে যারা ভারতীয় শিবিরে গিয়ে উঠেছে তাদের অপরাধ তো গুরুতর। তারা আল্লাহর শত্রুদের শুধু বন্ধু রূপে গ্রহণ করেনি, তারা ভারতীয়দের থেকে অর্থ নিয়েছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে, অস্ত্র নিয়েছে এবং ভারতীয় বাহিনীর সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। কাফিরদের প্রতিটি যুদ্ধই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তারা যারা একাত্তরের হিন্দু কাফিরদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে তাদের সে যুদ্ধটি ছিল মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তাছাড়া যারা সেদিন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেছে তাদের কেউ কখনো একথা বলিনি যে তারা ইসলাম ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। অথচ মুসলিমের প্রতিটি খাবার যেমন হালাল হতে হয়, তেমনি প্রতিটি যুদ্ধকে জিহাদ হতে হয়। ফলে একাত্তরের ভারতে যাওয়া এবং ভারতীয় অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করাটি ছিল মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের সাথে বিশাল বেঈমানী। এজন্যই যাদের হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমান ঈমান ছিল তাদের কেউ একাত্তরে ভারতে যায়নি। এবং ভারতের বন্ধু হয়নি।
মুসলিম নাম ধারণ করা সহজ। মৌলানা খেতাব লাগানোও খুব সহজ। যুগে যুগে একাজ মুনাফিকগণ করে এসেছে। কিন্তু প্রকৃত মুসলিম হতে হলে তো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি নির্দেশ মানতে হয় এবং হারাম কাজ থেকে বাঁচতে হয়। নইলে বেঈমান হতে হয়। কথা হলো মৌলানা ভাষানী, তাজুদ্দীন আহমেদ, মেজর জিয়াউর রহমান এবং আরো অনেকে যারা ভারতে শিবিরে গিয়ে তাদের সেবা নিল, অর্থ নিল, অস্ত্র নিল ও ভারতকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করলো, তাদের সে ঈমানদারীটা কই? মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের প্রতি তাদের সে আনুগত্য কই? নিরাপত্তার দোহাই। মুজিবসহ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী তো ভারতে যায়নি। তাতে কি তারা মারা গেছে?
ভারতীয় এজেন্ডা ও বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের এজেন্ডা
১৯৭১ এর পাকিস্তান ভাঙ্গার পিছনে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের দুটি মূল লক্ষ্য ছিল। এক). ভারতের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানকে ভাঙা ও উপমহাদেশের মুসলিম শক্তিকে দুর্বল করা। দুই). বাংলাদেশকে একটি ভারতীয় কলোনীতে পরিণত করা। বলা যায়, ভারত উভয় লক্ষ্য অর্জনেই পুরোপুরি সফল হয়েছে। অপরদিকে ১৯৭১’য়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং মস্কোপন্থী এবং চীন পন্থী বামপন্থীদের এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা। পাকিস্তান ভাঙ্গার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতেই তারা ভারতের সাথে কোয়ালিশন গড়ে। এসব বামপন্থী, সেক্যুলার এবং জাতীয়তাবাদী ধারার লোকদের কারো চেতনাতেই বাঙালি মুসলিমদের ইসলামী চেতনা, ইসলামী বিধানের বিজয়, মুসলিম উম্মাহর জান-মাল-আবরুর নিরাপত্তা নিয়ে সামান্য কোন ভাবনা বা অঙ্গীকার ছিল না। ফলে ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাজে মাখাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান ভাঙা লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া তাদের মিশনের পরিণত হয়। সোভিয়েত রাশিয়া পাশে থাকায় তারাই বিজয়ী হয় এবং পাকিস্তান পরাজিত হয়। সে যুদ্ধজয়ের জের ধরেই বাংলাদেশে চলছে সেই ভারতীয় আধিপত্যের জের।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের এজেন্ডা হলো, বাংলাদেশের উপর প্রতিষ্ঠিত তার ঔপনিবেশিক শাসনকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখা। ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর কাজটি কখনোই সে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে হয়না। কারণ, জনপ্রতিনিধিদের মনযোগ থাকে তাদের ভোটারদের মনবাসনা পূর্ণ করার দিকে। ফলে বিদেশী প্রভুদের এজেন্ডা পালনে তারা মনযোগী হতে পারেনা। এজন্যই ঔপনিবেশিক শাসন চালানো হয় একান্ত অনুগত viceroy তথা খলিফাদের দিয়ে। তারা যতবেশী নিজ দেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, ততই তারা বিদেশী প্রভুর প্রতি অনুগত হয়। শেখ হাসিনা হলো তেমনি একজন ভারতীয় খলিফা। ভারত শাসনে ব্রিটিশগণ তাই তাদের একান্ত অনুগ viceroy দের পাঠাতো ইংল্যান্ড থেকে। কিন্তু ভারতের সৌভাগ্য হলো বাংলাদেশে তার এজেন্ডা পূরণে দিল্লি থেকে সেরূপ viceroy পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, ভারতীয়দের চেয়েও অধিক ভারতীয় বসে আছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। শেখ হাসিনা তেমনই একজন viceroy; রক্ত-মাংসে তিনি বাঙালি হলেও চেতনায় তিনি ভারতীয়দের চেয়েও অধিক ভারতীয়। তাই তিনি বলেন, “ভারতকে যা দিয়েছি -তা ভারত কখনো ভূলতে পারবে না।” তাই হাসিনা সঠিক ভাবেই দাবী করতে পারেন, তিনি ভারতে যা দিয়েছেন তা ভারতের বহু কোটি ভারতীয়ও ভারত সরকারকে দিতে পারিনি। বিদেশী শক্তির যারা বিশ্বস্ত খলিফা -তাদের এরূপ দেয়া নিয়েই আনন্দ। নিজ দেশের স্বার্থ বাঁচানো নিয়ে নয়। তাই নিজ দেশের নাগরিকদেরকে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা হত্যা করলেও তিনি প্রতিবাদ করেন না। বরং তিনি নিজে ডাকাতের মত হানা দেন জনগণের ভোটের উপর এবং কেড়ে নেন তাদের মৌলিক অধিকার। দেশবাসীর প্রতি সামান্য দরদ থাকলে কি তিনি জনগণের বিরুদ্ধে এতোটা নৃশংস অপরাধে নামতেন?
পাকিস্তা কিরূপে ভেঙ্গে গেল?
পাকিস্তানের শত্রু শুধু দেশটির বাইরে ছিল না, বিপুল সংখ্যায় ছিল দেশের ভিতরেও। শত্রুদের বেশীর ভাগ ছিল দেশটির সেক্যুলার সেনাবাহিনীর মধ্যে। তাদের সংখ্যাটি ছিল বিশাল। কারণ, সেক্যুলার এ সেনাবাহিনী কোন ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা দেয়ার জন্য গড়া হয়নি। গড়া হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাফির শক্তিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার জন্য। তাদের কোন আদর্শিক মটিভেশন ছিলনা। জেনারেল জিয়াউল হকের ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত এ সেনাবাহিনীর অফিসারদের মেসে রাজস্বের অর্থে মদ সাপ্লাই দেয়া হতো। জেনারেল আইয়ুব খান যখন ক্ষমতা দখল করে তখন থেকেই পাকিস্তানের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আইয়ুব খান পার্লামেন্টারী প্রথা বিলুপ্ত করে প্রেসিডেন্টশিয়াল প্রথা চালু করেন। এটি যে পাকিস্তানের ধ্বংস প্রক্রিয়ার শুরু -সে কথাটি আইয়ুব খানকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর বাঙালি আইনমন্ত্রী সাবেক বিচারপতি ইব্রাহীম পদত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্টশিয়াল প্রথার সাহায্যে বস্তুত দেশ শাসনে বাঙালিদের অংশীদারিত্ব বিলুপ্ত করা হয়। কারণ প্রসেডেন্ট পদ্ধতিতে সেরূপ অংশদারিত্বের সুযোগ থাকে না।
সোহরাওয়ার্দীকে আইয়ুব খান পাকিস্তানের গাদ্দার বলে গালি দিয়েছেন; কিন্তু সে গালি খেয়ে তিনি বিচ্ছিন্নতার পথে ধাবিত হননি। সোহরাওয়ার্দী জানতেন, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় আইয়ুব খানের মত লোকদের কোন অবদান নাই। বরং পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আইয়ুব খান তখন কাফির ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর গোলাম সৈনিক। ফলে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর কোন দরদ থাকার কথা নয়। সে সাথে যারা সোহরাওয়ার্দীর মত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অগ্রভাগের নেতা -তাদের প্রতি আইয়ুবের মত স্বৈরাচারি শাসকের সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ না থাকারই কথা। উল্লেখ্য যে, আইয়ুব খান এমন কি কায়েদে আজমের বোন ফাতিমা জিন্নাহকে ভারতের এজেন্ট বলেছেন। ফাতিমা জিন্নাহর অপরাধ তিনি ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দলগুলির একক প্রার্থী রূপে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।
বরং বহু প্রমাণ রয়েছে যে, আইয়ুব খান ছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের শত্রু। তাঁর ছিল প্রচণ্ড বাঙালি ভীতি। বাঙালি মুসলিম শাসনের ভীতি নিয়েই হিন্দু মহসভার প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বলতেন, ভারত ভাগ না হলেও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। কারণ তিনি মনে করতেন, বাংলা যতদিন অবিভক্ত থাকবে ততদিন বাংলার উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের শাসন থাকবেই। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও মনে করতেন যতদিন পাকিস্তান অখণ্ডিত থাকবে ততদিন পাকিস্তানের উপর বাঙালি মুসলিমদের শাসন থাকবেই। আইয়ুব খান তাই পাকিস্তানের বিভক্তি চাইতেন। আইয়ুবের মনের সে বদ্ধমূল ধারণার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর আইন মন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ মুনির তাঁর রচিত “Zinnah to Zia” বইতে। আইয়ুব খান বিচারপতি মুহাম্মদ মুনিরকে বলেছিলেন, তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের বিচ্ছিন্নতার পথ বেছে নিতে বলেন।
বিচারপতি মুনির তাঁর বইতে লিখেছেন, রমিজুদ্দীন নামক একজন বাঙালি নেতাকে যখন সে কথাটি বলা হয় তখন তিনি বলেন, “আমরাই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। বিচ্ছিন্নতা চাইলে তোমরা পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিচ্ছিন্ন হও?” তৎকালীন ন্যাপ নেতা খান আব্দুল ওয়ালী খান বলেছেন, ষাটের দশকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ওয়ালী খানকে ডেকে নিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। ওয়ালী খান সে কাজে রাজী হননি। ১৯৭২ সালে লন্ডনের “Daily Telegraph”য়ে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব খান বলেছেন, তিনি ষাটের দশকে পূর্ব-পাকিস্তানীদেরকে শান্তিপূর্ণ ভাবে পৃথক হতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা সেদিন সফল হয়নি। কারণ, অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে তখনও পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে বিপুল সংখ্যক লোক ছিল।
জেনারেল আইয়ুব খান ছিলেন ইসলামী চেতনাশূণ্য উগ্র সেক্যুলারিস্ট। কর্ম জীবন শুরু করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে প্রতিরক্ষা দেয়ার ব্রত নিয়ে। মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষা ও ইজ্জত নিয়ে তাঁর কোন অঙ্গীকার ছিল না। অঙ্গীকার থাকলে সে কখনোই ব্রিটিশ কাফিরদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিত না। ইসলামে এটি হারাম। অপরদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত যেসব বাঙালি নেতাগণ অখণ্ড পাকিস্তানের ঘোরতর সমর্থক ছিলেন -তাদের ছিল মুসলিম উম্মাহকে স্বাধীনতা, প্রতিরক্ষা ও ইজ্জত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার তাড়না। তারা ভাবতেন, বাংলার প্রতিরক্ষা মজবুত হতে পারতো অখন্ড পাকিস্তানকে বাঁচানো ও শক্তিশালী করার মাধ্যমেই। এবং পাকিস্তান বাঁচলেই বাঙালি মুসলিমগণ পেত বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গণে প্রভাব ফেলার সুযোগ। কিন্তু অখণ্ড পাকিস্তানের ঘরের শত্রুতে পরিণত হয় দেশটির অতি সেক্যুলার সেনাবাহিনী। সে সাথে যোগ দেয় ভুট্রো ও মুজিবের ন্যায় ক্ষমতালোভী ব্যক্তবর্গ। মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা, ইজ্জত ও জান-মালের নিরাপত্তা নিয়ে এদের কারোই কোন ভাবনা ছিল না। ভাবনা ছিল কেবল ক্ষমতা দখল নিয়ে।
বাঙালি মুসলিমদের শত্রুও ছিল পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী সেক্যুলার সেনাবাহিনী। এরাই পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতীয় হামলার মুখে অরক্ষিত রাখে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ১১ বছরের শাসনে সবচেয়ে বেশী বৈষম্য হয় সামরিক বাহিনীতে। গুরুত্ব দেয়া হয় শুধু পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে। ১৯৭১’য়ে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক ডিভিশন সৈন্য ছিল, বাকি সমগ্র রাখা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্যান্টনমেন্ট গড়িনি; বিমান ঘাঁটি এবং নৌঁ ঘাটিও গড়েনি। সেনা বাহিনী মনযোগ দিয়েছে শুধু রাজনীতিতে, দেশের প্রতিরক্ষায় নয়। হামাস তার ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে ৬ মাস লড়ে যাচ্ছে ইসারাইলের বিরুদ্ধে। কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২ সপ্তাহও লড়তে পারিনি, আত্মসমর্পণ করেছে। অথচ ইসরাইল সেনাবাহিনী গাজার উপর যত বিমান হামলা, রকেট হামলা ও বোমা বর্ষণ করেছে, পূর্ব পাকিস্তানের উপর ভারতীয় সেনা বাহিনী ও বিমান বাহিনী তার শতভাগের এক ভাগও করেনি।
আইয়ুব খান তাঁর নিজের শাসন আমলে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার যে প্রজেক্ট সফল করতে পারিনি, একাত্তরে সেটাই সফল হয়েছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টোও পাকিস্তানের অখণ্ডতা চায়নি। তাঁরও ছিল বাঙালি ভীতি। আইয়ুবের মত ভুট্রোও চাইতো পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক। সেটি বুঝা যায়, ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকলেন, ভুট্টো সে বৈঠকে যেতে অস্বীকৃত জানায়। ভুট্টো সে সময় শেখ মুজিবকে বলে, “ওধার তোম, এধার হাম” অর্থ: “ঐদিকে তুমি, এদিকে আমরা।” বস্তুত এটি ছিল ভুট্টোর পক্ষ থেকে সরাসরি বিচ্ছন্নতার ঘোষণা। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান চাচ্ছিলেন, শেখ মুজিব ও ভূ্ট্টো কোয়ালিশনের ভিত্তিত শাসন পরিচালনা করুক। কিন্তু শেখ মুজিব ভূ্ট্টোর সাথে কোন রূপ কোয়ালিশনে রাজী ছিলেন না। তিনি শুধু তার নিজ দল থেকে মন্ত্রী পরিষদ করতে চাচ্ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগ সংসদে একটি আসনও পায়নি। ফলে কোয়ালিশন ছাড়া শেখ মুজিবের শাসন পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে গ্রহনযোগ্য করা অসম্ভব ছিল। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ অবস্থায় কোয়ালিশন হয়। কোয়ালিশন না গড়ার অর্থ পাকিস্তান অচল করে দেয়া এবং অবশেষে বিভক্ত করা। মুজিব ও ভুট্টো উভয়েই সম্ভবত সেটিই চাইতেন। তাই সেদিন কোয়ালিশন সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি।
উভয় পক্ষের মাঝে আলোচনার সুযোগ দিতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবী করেন। কিন্তু বৈঠক মুলতবী করায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গণ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠে। বিচ্ছিন্নতার পক্ষে রাজপথে মিছিল শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো শুরু হয়। অবাঙালিদের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান এবং সেনা বাহিনীর উপর হামলা শুরু হয়। পাকিস্তানের দেশী ও বিদেশী শত্রুরা ২৩ বছর যাবত এমন একটি অবস্থারই অপেক্ষায় ছিল। ফলে পাকিস্তান দ্রুত বিভক্তির দিকেই এগিয়ে যায়। এবং সেটি রক্তাক্ত পথে। ভুট্টো একথাও বলেন, যারা জাতীয় পরিষদের ঢাকার অধিবেশনে যোগ দিতে যাবে তাদের পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। এটি ছিল সন্ত্রাসের হুমকী। ভুট্টো জানতো, পাকিস্তান না ভাঙ্গলে তার পক্ষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অসম্ভব। এবং মুজিব বলতেন, পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজের শুরুটি একাত্তর থেকে নয়, ১৯৪৭ থেকে শুরু করেছিলাম। মুজিব সে কথাটি ১৯৭২’য়ের ১০ জানুয়ারীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলেন। এ প্রবন্ধের লেখক মুজিবের মুখ থেকে সে কথাটি নিজ কানে শুনেছেন। অথচ তারা মুজিব ও ভূট্টো -এ উভয় নেতাই জনসম্মুখে জোর গলায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছেন। এসব ছিল নিছক ভন্ডামী। তারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছেন স্রেফ জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য। মুসলিম উম্মাহর দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানের মত মুসলিম দেশগুলির রাজনীতি চলে যায় এরূপ ধোকাবাজ মুনাফিকদের হাতে।
ভারতের স্বপ্নপূরণ: ভেঙ্গে গেল পাকিস্তান
এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, পাকিস্তানের সংকট কালে শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলী ভুট্টো -তাদের কেউই অখণ্ড পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখায় আগ্রহী ছিলেন না। বরং তাদের উভয়ই একে অপরের ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন মাত্র। সেটি পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্চের শেষ দিকে ঢাকায় মুজিব ও ভুট্টোর মাঝে সমাঝোতার যে শেষ বৈঠক ডাকেন -সেটিই ব্যর্থ হয়ে যায়। শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলী ভুট্রোর নিজেদের স্বপ্ন পূরণের স্বার্থে পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাইলেও দেশ ভাঙ্গার সে সামর্থ্য তাদের ছিল না। কারণ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার সামর্থ্য তাদের ছিল না। সে কাজটি করে দেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী। মুজিব ও ভুট্রো ভারতীয় সে আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় মাত্র।
মুজিব ও ভুট্রোর মাঝে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিক ভাবে সমাধানের সকল পথ বন্ধ হয়ে যায়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তখন শুরু হয় চরম অরাজকতা। অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। বিহারীদের খুন করা ও তাদের দোকানগুলি লুট করা শুরু হয়। কোথাও কোথাও সেনা সদস্যদের উপর হামলা শুরু হয়। ২৫ মার্চ প্রসেডিন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক এ্যাকশনে যায়। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক নামানো হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১৪ হাজার সৈন্য। পাকিস্তান সরকার তখন ভারতের সাথে যুদ্ধের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলনা। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধটি কোন বিদেশী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু এরপরও সেখানে ভারতী সৈন্যের সংখ্যা ৬ লাখের বেশী। কেউ কেউ বলেন ৭ লাখ। অথচ কাশ্মীরের জনসংখ্যা মাত্র ৯০ লাখ – ঢাকার জনসংখ্যার অর্ধেক। তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি।
মার্চের ২৫ তারিখে সামরিক এ্যাকশনের পর মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’য়ের এবং পুলিশের অনেকে সেপাই ও অফিসার পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নামে। এপ্রিলের মধ্য অধিকাংশ জেলা শহরগুলি পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুরু হয় দেশ জুড়ে অবাঙালি নিধন। বিহারী নারী, পুরুষ এবং শিশুরাও সে গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে শুরু হয় মফস্বলের সকল সরকারি ব্যাংক থেকে অর্থলুট এবং সে অর্থ নিয়ে করে ভারত গমন। হিন্দুরাও তাদের অর্থকরি নিয়ে ভারতে যাওয়া শুরুকরে। এভাবে শত শত কোটি টাকা ভারতে চলে যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, সৈয়দপুরের মত যেসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল একমাত্র সেসব শহরের উপর পাকিস্তান সরকারে নিয়ন্ত্রণ ছিল। আবার সমগ্র দেশের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কররে -সেটি তখন অসম্ভব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় নাই। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ ও মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সমগ্র দেশের উপর আবার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। পাকিস্তান আর্মির এরূপ দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনকরী কিসিঞ্জার পর্যন্ত বিস্মিৎ হয়েছিলেন।
মুক্তিবাহিনীর দাবী তারাই বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদানের কথা তেমন উল্লেখ করে না। এটি হলো মুক্তি বাহিনীর delusional তথা অলীক বয়ান। অথচ বাস্তবতা হলো মুক্তিবাহিনী তার ৯ মাসের যুদ্ধে একটি জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাও স্বাধীন করতে পারিনি। তাদের এ ব্যর্থতার কারণে ভারত সরকার বুঝতে পারে, মুক্তিবাহিনীকে যতই অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া হোক -তাদের দিয়ে পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। তাদের দিয়ে ভারতের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। ভারতী সেনাবাহিনী নিজেই যুদ্ধের জ দ্রুত প্রস্তুতি নিতে থাকে। সোভিয়েত রাশিয়াও ভারতের পিছনে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরক্ষা চুক্ত করে। একাত্তরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতীয় সেনা বাহিনী হামলা শুরু করে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান তার সৈন্য সংখ্যা ১৪ হাজার বাড়িয়ে ৪৫ হাজারে বৃদ্ধি করে। কিন্তু ভারত হামলা করে আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে। পাকিস্তানে পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজী বিশাল ভারতীয় সেনা বাহিনীকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব মনে করে মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই ভারত বিজয়ী হয় এবং নিজেদের এজেন্ডা পূরণে সমর্থ হয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি দম্ভ ভরে বলেন, “হাজার সাল কা বদলা লে লিয়া।” অর্থ: হাজার বছরের প্রতিশোধ নিয়ে নিলাম। বুঝতে অসুবিধার কথা নয়, ভারতের এ প্রতিশোধ পাকিস্তানে বিরুদ্ধে ছিল; কারণ, হাজার বছর আগে পাকিস্তান ছিল না। প্রতিশোধ ছিল হাজার বছর আগে মুসলিমদের ভারত জয়ের।
পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের নির্মাণের মূল কৃতিত্বটি তাই ভারতের। ভারত যুদ্ধে না নামলে পাকিস্তান বেঁচে যেত। একটি রাজনৈতিক সমাধানও হয়তো বেরিয়ে আসতো। পাকিস্তান সেদিকেই দ্রুত এগুচ্ছিল। আওয়ামী লীগের বহু নেতা সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান এ যাত্রায় বেঁচে যাক -ভারত সেটি কখনোই চায়নি। ভারত তাই দ্রুত হামলা করে এবং জয়ী হয়। এভাবে হিন্দুত্ববাদী ভারতের এজেন্ডাই সেদিন বিজয়ী হয়েছে এবং ভেঙ্গে গেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে ভারতের ১৯৪৭’য়ের এজেন্ডা যেমন সফল হয়েছে, তেমনি সফল হয়েছে শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা দখলের এজেন্ডা। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ হারিয়েছে তাদের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যত উন্নয়নই হোক, মুসলি উম্মাহ যা হারিয়েছে -তা কি পূরণ হওয়ার?
রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে আসনে খোদ নবীজী (সা:) বসেছেন এবং ১০টি বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, সে আসনে যদি স্বার্থপর ও ধোকাবাজ মুনাফিকগণ বসে -তখন কি কল্যাণকর কিছু আশা করা যায়? তখন তো পরাজয় ও আযাব অনিবার্য হয়। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যু ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটির। সে স্বপ্নটি ছিল ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের উর্দ্ধে উঠে এক civilisational স্টেট নির্মাণের। সে সাথে বাঙালি মুসলিমগণ হারিয়েছে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার অপূর্ব সুযোগ। এবং সে সুযোগ হারানোর সাথে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের অধিকৃত কলোনীতে। তাই ক্ষতি শুধু পাকিস্তানের হয়নি, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয়েছে বাংলাদেশীদের। কিন্তু সে ক্ষতি বুঝার সামর্থ্য কি বাংলাদেশীদের আছে? গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, অর্থপাচার ও সন্ত্রাসের জোয়ার ভাসলে তো সে সামর্থ্য থাকার কথা নয়। ১৫/০৪/২০২৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018