বাঙালি মুসলিমের অর্জিত পরাধীনতা প্রসঙ্গ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

যারা যুদ্ধ করে কোন দেশ জয় করে  -তারাই সে দেশের প্রকৃত মালিক হয়। অতি প্রাচীন কাল থেকে এটিই দুনিয়ার নিয়ম। নিজ অর্থ, নিজ রক্ত, নিজ অস্ত্র ব্যয়ে দেশ জয় করে কেউই অন্য দেশের লোকদের হাতে সে দেশটিকে তুলে দেয় না। ‌ ভারত সে নীতির ব্যতিক্রম হয় কি করে? ভারত কোন খয়রাতী প্রতিষ্ঠান নয় যে, দেশ জয় করে সে দেশকে দখলে না রেখে অন্যদেরকে দান করে দিবে। একমাত্র বেওকুবগণই সেটি আশা করতে পারে। তবে বাংলাদেশে এরূপ বেওকুবদের সংখ্যাটি বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তূলনায় বিশাল। তারা মনে করে, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।  মীর জাফরও মনে করেছিল, ইংরেজগণ সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করে তাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজা বানাবে।   

এসব বাঙালি বেওকুবগণ বুঝতে ব্যর্থ হয়, ভারতের রয়েছে বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার তীব্র সাধ। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের রয়েছে অখণ্ড ভারত নির্মাণের তীব্র আকাঙ্খা। সেটি কোন গোপন বিষয়ও নয়। সেটি ১৯৪৭’য়ের আগে এবং পরে। নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই ভারত পাকিস্তানের বিনাশ চাইতো। সেটি ১৯৪৭ সাল থেকেই। সে লক্ষ্য পূরণেই ভারত একাত্তরে যুদ্ধ করেছে; বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা দিতে নয়। অন্যদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দেয়ায় ভারতের সামান্যতম রুচি থাকলে তারা কেন কাশ্মীরকে দখলে নিল? কেন তারা শেখ হাসিনার ভোটডাকাতি ও ফ্যাসিবাদী শাসনকে সমর্থন দেয়? দিল্লিতে ভারতের নয়া লোকসভা ভবনে দেশটির যে মানচিত্র টানানো হয়েছে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের কোন ম্যাপ নাই। বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে অখণ্ড ভারতের অংশ রূপে। নাগপুরে RSS’য়ের কেন্দ্রী অফিসে ভারতের যে মানচিত্র টানানো হয়েছে সে মানচিত্রেও স্বাধীন বাংলাদেশ বলে কোন দেশ নাই।  

ভারত তার আগ্রাসী চরিত্রের প্রমাণ রেখে চলেছে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকেই। সে আগ্রাসনের সাধ মেটাতে কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, সিকিম, গোয়া ও মানভাদারকে ভারতের পেটে হজম হতে হয়েছে। এখন সে আগ্রাসনের শিকার হলো ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ। ভারতের সে আগ্রাসী চরিত্রটি ১৯৪৭’য়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন, শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং একাত্তরের রাজাকারগণ বুঝলেও ইসলামশূণ্য বাঙালি কাপালিকগণ সেটি বুঝতে অক্ষম। ভারতকে তারা পরম বন্ধু মনে করে গলা জড়িয়ে ধরেছে। নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও মুলিমগণ বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠুক এবং নিরাপত্তা পাক -সেরূপ ভিশন ও মিশন তাদের নেই। বরং তাদের ভিশনটি হলো শক্তিশালী ভারত নির্মাণের। ভারতীয়দের চেয়েও তারা অধিক ভারতীয়। এজন্যই নিজ দেশের বাজার তুলে দিয়েছে ভারতের হাতে। ভারতে মসজিদ ভাঙ্গা হলে, মুসলিম নির্মূলে দাঙ্গা হলে এবং নবীজী (সা:)’র বিরুদ্ধে কটূক্তি করা হলে সারা মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে; কিন্তু আওয়ামী কাপালিকগণ তখন নিশ্চুপ থাকে। প্রভুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তার ক্ষমতা হারাতে চায়না।

একাত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে নামার আগে প্রায় সাড়ে আট মাসের যুদ্ধে  মুক্তিবাহিনী একটি জেলা দূরে থাক কোন মহকুমা বা থানাকেও স্বাধীন করতে পারিনি। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দখলে আনার সে কাজটি করেছে বিশাল ভারতীয় সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনী। সহরোওয়ার্দী ময়দানে যে আত্মসমর্পণ চুক্তি সাক্ষরিত হয় সেটিও ছিল পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে বিজয়ী ভারতীয় সেনা বাহিনীর মাঝে। মুক্তি বাহিনীর সে চুক্তিতে কোন উল্লেখ পর্যন্ত নাই। এজন্যই ভারত বাংলাদেশকে তার গণিমতের মাল মনে করে। ফলে ভারত বাংলাদেশের সবগুলি নদী, সবগুলি সমুদ্র বন্দর, সকল রেলপথ, জলপথ ও স্থলপথের মালিক হতে চায়। বাংলাদেশ তাদের কাছে পশ্চিম বাংলার ন্যায় আরেক ভারতীয় প্রদেশের অধিক কিছু নয়। অথচ আওয়ামী বাকশালীদের দাবি, ভারত নয়, মুক্তিবাহিনী দেশ স্বাধীন করেছে। অনেক বিএনপি’র লোকেরাও সে দাবী। যেন আড়াই লাখের বেশী ভারতীয় সৈন্য সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বুকে ঘাস কাটতে এসেছিল! একাত্তরে বহু হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে যেন পিকনিক করতে এসে?                                                                                                                                   

স্বাধীনতা দান-খয়রাতের সামগ্রী নয়। যারা স্বাধীন থাকতে চায়, তাদেরকে নিজ শক্তি, নিজ অর্থ ও নিজ রক্ত দিয়ে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। স্বাধীনতার সে লড়াইয়ে তারা কখনোই কোন বিদেশী শক্তির সেনাবাহিনীকে নিজ দেশে ডেকে আনে না। বিদেশী সেনা বাহিনী স্বাধীনতা লুটতে আসে, দিতে নয়। আলজিরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণ তাই কোন বিদেশী শক্তিকে নিজ দেশে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে ডেকে আনেনি।  নিজেদের স্বাধীনতারয যুদ্ধ নিজেরা বহু বছর যাবত লড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ সে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের এছাড়া ভিন্ন পথ নেই। তাই তারা পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছে। ফলে তাদেরকে অন্যদেশের খায়েশ পূরণ করতে নিজ দেশের বাজার করিডোর, বন্দরের সুবিধা এবং রেলপথ ও স্থলপথ দিতে হয়না -যেমনটি বাংলাদেশ দেয়।  

কিন্তু একাত্তরে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরা সে মুরোদ দেখাতে পারিনি। নেতাদের রণাঙ্গণে দেখা যায়নি। নিজেদের ক্ষমতায় বসাতে তারা বরং ভারতকে ডেকে এনেছে। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তারা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে।  ফলে বাংলাদেশীরা এখন ভারতের গোলাম। এ গোলামী আর শেষ হবার নাম নিচ্ছে না। আমরা বাংলাদেশীরা হারিয়েছি গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার -এমনকি জান-মাল ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার অধিকারও। হাজার হাজার বাংলাদেশী প্রাণ বাঁচাতে বিশ্বের নানা দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছে। এর চেয়ে বড় পরাধীনতা আর কি হতে পারে? তবে আওয়ামী কাপালিকরা এ পরাধীনতাকেই স্বাধীনতা বলে। কারণ, ভারত তাদেরকে দিয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। সেটি গুম, খুণ, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, ব্যাংকলুট, ট্রেজারী লুট, সন্ত্রাসের স্বাধীনতা। বাংলাদেশে একমাত্র এ অপরাধীরাই স্বাধীন। পরাধীন হলো দেশের জনগণ।   

বাঙালি মুসলিমদের জীবনে এ রকম পরাধীনতা পাকিস্তান আমলে ছিল না। পাকিস্তান আমলে মুসল্লীদের শাপলা চত্বরের ন্যায় গণহত্যার শিকার হতে হয়নি। আলেমদের পায়ে সেদিন ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়নি। জুম্মার খোতবার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। গণহ্ত্যার শিকার হতে হয়নি সেনা অফিসারদের। দেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর হাতে সেদিন পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়মিত মারা যেতে হয়নি। কোন আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্রকে কুর’আনের বাণী প্রচারের কারণে জঙ্গির তমঘা লাগিয়ে জেলে পূরা হয়নি। নির্বাচনের দিনে কারো ভোটডাকাতি হয়নি। পাকিস্তান আমলে ভোটদানের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল; পরাধীনতার মুখে পড়তে হয়নি। কারণ, পাকিস্তান কোন বিদেশী শক্তি স্বাধীন করে দেয়নি। সেদেশের জনগণ সে স্বাধীনতা লড়াই করে অর্জন করেছিল।

স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীন ভাবে বাঁচার বিশাল খরচ আছে। সে খরচটি রক্ত, অর্থ, শ্রম ও মেধার। বাঙালি ‌ মুসলিমরা যেদিন সে খরচ জুগানোর সামর্থ্য অর্জন করবে -সেদিনই তারা প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করবে। সে খরচ জুগানোর সামর্থ্য না থাকার কারণেই বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হয়ে গেছে ভারত এবং তার পদলেহী আওয়ামী বাকশালীদের হাতে। স্বাধীনতার সত্যিকার সাধ জাগলে বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতার সে লড়াইটি আবার শুরু করতে হবে। বিনিয়োগ ঘটাতে হবে অর্থ, মেধা, শ্রম ও রক্তের। শুরু হোক স্বাধীনতার সে চুড়ান্ত লড়াই। বুঝতে হবে, মুসলিম জীবনে এমন লড়াই নিছক রাজনীতি নয়, বরং পবিত্র জিহাদ। ১৬ কোটি বাঙালি মুসলিমকে বিশ্বমাঝে প্রমাণ দিতে হবে, তাঁরাও আগ্রাসী ভারতের পরাধীনতা মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার সামর্থ্য রাখে। সাড়ে তিন কোটি আফগান যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ৫০টি মিত্র রাষ্ট্রের বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে, ১৬ কোটি বাঙালি মুসলিম কেন ভারত ও তার পদলেহী সেবাদাসদের পরাজিত করতে পারবে না? ভারত কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী? ০৪/০৭/২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *