যুদ্ধাপরাধী হাসিনার বিচার না করাই হবে বড় অপরাধ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

হাসিনার যুদ্ধাপরাধ

কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে চলছে দক্ষিণ এশিয়ার  ইতিহাসে সর্ববৃহৎ শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন। এখন এটি পরিণত হয়েছে সরকার বিরোধী গণ-আন্দোলনে। সে আন্দোলন থামাতে হাসিনা সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে। এখন এটি নিরেট গণহত্যার যুদ্ধ। হাসিনার অপরাধ,অগণিত নিরপরাধ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা। এটিই তো আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ। হাসিনা রণাঙ্গণে নামিয়েছে পুলিশ, বিজিবি, RAB ও সেনাবাহিনীকে। সে সাথে নামিয়েছে নিজ দলের গুন্ডাবাহিনীকেও।

হাসিনার পরিচালিত এ যুদ্ধের উত্তাপ বুঝা যায় আকাশে হেলিকপ্টার থেকে গোলা বর্ষণ এবং রাস্তায় অসংখ্য ট্যাংক, সাঁজায়ো গাড়ি, বন্দুকধারী সৈনিকদের টহল থেকে। ঢাকার রাস্তায় এতো ট্যাংক, এতো সাঁজায়ো গাড়ি, এতো বন্দুকধারী সৈনিকদের টহল কোন কালেই দেখা যায়নি। এমন কি একাত্তরের যুদ্ধকালেও নয়। একাত্তরে পাক বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫ হাজার। হাসিনার নামানো সৈন্যের সংখ্যা লক্ষাধিক । ফলে এতো স্বল্প সময়ে এতো রক্ত কখনো ঝরেনি। সকল সভ্য দেশে যুদ্ধ হয় সীমান্তের ওপারে শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে, কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে জনগণের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের তীব্রতা বুঝা যায় রক্তাক্ত রাজপথ, অসংখ্য লাশ থেকে পচা দুর্গন্ধ এবং দেশের হাসপাতালগুলিতে হতাহত মানুষের প্রচণ্ড ভিড় দেখে।   

নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ যুদ্ধে যেমন শত শত নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তেমনি হাজার হাজার মানুষকে অন্ধ ও পঙ্গ করা হয়েছে। অন্ধ করা হয়েছে রবার বুলেট চোখে মেরে -যেমন ভারত করে থাকে কাশ্মীরে। আহত এসব ছাত্র-ছাত্রী ও নারী-পুরুষগণ আর কখনোই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। আমৃত্যু বাঁচতে হবে ব্যথা, পঙ্গত্ব ও যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে। বাংলাদেশের নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে এগুলি হলো গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী যেমন শেখ হাসিনা, তেমনি সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও RAB’য়ের অফিসার ও সেপাহীগণ। 

শেখ হাসিনা অসংখ্য অপরাধের আসামি। তার পুরা রাজনীতিই হলো অপরাধের রাজনীতি। তার পরিচয়টি হলো, সে একজন নৃশংস খুনি, ভোটডাকাত, ফ্যাসিস্ট, মিথ্যুক, প্রতারক, দুর্বৃত্ত চক্রের প্রতিপালক এবং আগ্রাসী ভারতের পদলেহী গোলাম। সম্প্রতি তার হুকুমে ইতিমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে শত শত বেশী নিরীহ বাংলাদেশীকে। বিক্ষিপ্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে ঢাকার রাজপথে। তবে নিহতদের সঠিক তথ্য সরকার দিচ্ছে না। অনেকে বলছেন, নিহতদের সংখ্যা দুই হাজারের বেশী।

সমস্যা হলো, সরকারি বাহিনী হত্যা করলেও নিজেরা কখনোই নিহতদের হিসাব রাখেনা। কারণ, নিহতদের পরিসংখ্যানকে তারা নিজেদের জন্য বিপদ মনে করে। সেটিকে তারা নিজেদের অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষী মনে করে। তাই খুনিরা পরিকল্পিত ভাবে সেগুলি বিলুপ্ত করে। অভিযোগ উঠেছে, সশস্ত্র বাহিনী অনেক লাশ গায়েব করেছে। বহু লাশ তারা ডোবায় বা জলাভূমিতে ফেলেছে। নিহতদের সংখ্যা কম করে দেখাতে তারা হাসপাতাল থেকে নিহতদের তালিকা গায়েব করেছে। অপরাধী হাসিনার সরকার লাশ গায়েবের সে কৌশল অবলম্বন করেছিল ২০১৩ সালে ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যার লাশ গায়েব করতে। 

 

খুনি হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখাই গুরুতর অপরাধ 

মহল্লায় বাঘ, ভালুক ও নেকড়ের ন্যায় হিংস্র পশু ঢুকলে সে পশুকে বধ করাই সে সময়েয় সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তেমনি রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা কোন নৃশংস খুনির হাতে অধিকৃত হলে সে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় সে খুনিকে উৎখাত করা। সেটি প্রতিটি ব্যক্তির ঈমানী দায়িত্ব। নইলে গাদ্দারী হয় ঈমানী দায়িত্বের সাথে। এবং অপরাধ হলো সে আন্দোলনকে মাঝ পথে থামিয়ে দেয়া। বিষাক্ত সাপকে আধ-মরা করে ছেড়ে দেয়া যায়না। সেটিকে পুরা মারতে হয়। নইলে সে সাপের ছোবলে মারা যেতে হয়। তেমনি কোন জালেম সরকারকে আহত করার পর আর ক্ষমতায় রাখা যায় না। তারা ক্ষমতায় বেঁচে থাকলে তারা নৃশংস হয় এবং আরো রক্তাক্ত গণহত্যা ঘটায়। তাতে ব্যহত হয় সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণের কাজ। দেশ তখন নীচে নামতে থাকে এবং বসবাসের অযোগ্য হয়।

ইসলামে জালেম শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আলাদা মর্যাদা রয়েছে।  ইসলামে সে লড়াই হলো জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। ব্যক্তির পরিশুদ্ধির জন্য ইসলাম যেমন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের বিধান দেয়, তেমনি রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধির জন্য ফরজ করেছে  জিহাদ। তাই জিহাদ না হলে রাষ্ট্রে গুম, খুন, ধর্ষণ, জুলুম, নির্যাতন ও দুর্বৃত্তির জোয়ার আসে। বাংলাদেশ তারই উদাহরণ। শাসক যেখানে খুনি, প্রতারক, নৃশংস জালেম এবং হিন্দুত্ববাদী ভারতের ন্যায় আগ্রাসী শক্তির পদলেহী দাস -সে শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই মাত্রই বিশুদ্ধ জিহাদ। আর যখন কোন দেশে জিহাদ শুরু হয় তখন প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ হয় জিহাদে যোগ দেয়া; তখন নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকাই মুনাফেকি। তাই জনগণকে মুনাফিকের অপরাধ থেকে বাঁচতে হবে। বুঝতে হবে, মুনাফিকগণ কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ, এরাই হলো ঘরের শত্রু।  তাদের অপরাধ, তারা ভিতরে থেকে শত্রুকে বিজয়ী করে। বাংলাদেশে এদের সংখ্যাটি বিশাল।

নির্বাচনের মাধ্যমে অনাস্থা জানানোর পথ ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় এসেই বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ করেছিল তার স্বৈরাচারী পিতা মুজিবও। বিগত ১৫ বছরে হাসিনা কোন নির্বাচনকে সুষ্ঠ ভাবে হতে দেয়নি; প্রতিবারই জনগণের ভোটের উপর ডাকাতি করেছে। এবার লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে হাসিনার বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে দিয়েছে। যে কোন সভ্য দেশে এরূপ অবস্থায় সরকারের পতন ঘটে। এ পথেই পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী আইয়ুব ও স্বৈরাচারী এরশাদের।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধী হাসিনা নিরস্ত্র জনতার দাবীর মুখে ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নয়। সে চায় অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় থাকতে। সে বেছে নিয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধের পথ। সে নির্ভর করছে দেশের সশস্ত্র বাহিনীগুলির উপর। সেরূপ এক অপরাধী মানসিকতা নিয়ে হাসিনা দেশের  সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ পরিণত হয়েছে তার ব্যক্তিগত চৌকিদার বাহিনীতে। হাসিনার মত এমন নৃশংস অপরাধীকে ক্ষমতায় রেখে তার শাসন মেনে নেয়াই হবে ১৭ কোটি বাংলাদেশীর সবচেয়ে বড় নৈতিক অপরাধ। ইসলামে অপরাধ করাই শুধু অপরাধ নয়, অপরাধীকে মেনে নেয়াও গুরুতর অপরাধ। অপরাধ এখানে জালেম শাসক নির্মূলের জিহাদে অংশ না নেয়ার। মহান আল্লাহতায়ালা জালেমের অপরাধই দেখেন না, দেখেন জনগণের অপরাধও। সে অপরাধের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা আখেরাতে আজকের নীরব ও নিষ্ক্রিয়দের আসামীর কাঠগড়ায় খাড়া করবেন।  কারণ মহান আল্লাহতায়ালা শুধু যুগের ফিরাউন-নমরুদকেই শাস্তি দেন না, শাস্তি দেন তাদেরও যারা তাদের শাসনকে মেনে নেয়।

 

গুরুতর অপরাধ হবে যুদ্ধাপরাধী হাসিনাকে শাস্তি না দেয়া

বিষাক্ত সাপ বা হিংস্র পশু মহল্লায় ঢুকলে তাকে হত্যা না করাই বড় অপরাধ। তেমনি গুরুতর অপরাধ হলো খুনি শাসককে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমতায় রাখা। এবং অপরাধ হলো খুনিদের সাথে আপোষ করা এবং তার ক্ষমতার আয়ু বাড়ানো। অথচ সকল খুনিদের ন্যায় খুনি হাসিনা তো সেটিই চায়। যারা ছাত্র-জনতাকে আন্দোলন থামাতে বলে এবং শান্ত হতে বলে -তারা বস্তুত অপরাধী হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। সভ্য মানুষদের লড়াই শুধু নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায় নয়, বরং লড়াইয়ের লক্ষ্য, অপরাধীদের আদালতে তোলা এবং শাস্তি দেয়া।  কারণ অপরাধীদের শাস্তি না দেয়াও আরেক অপরাধ। সে কাজটি না হলে লড়াই ব্যর্থ হয় এবং বিজয়ী হয় অপরাধীরা। তাই জরুরি হলো, বিশেষ আদালত গড়ে হাসিনা ও তার সহচর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা।  তাকে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলা।  

কোন সভ্য দেশের জনগণই খুনিকেই স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার দেয়া হয় না। রাষ্ট্রের কোন দায়িত্বূর্ণ পদে তাকে বহাল রাখার প্রশ্নই উঠে না। মানবহত্যার অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পেতে হয়। যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড রহিত, সেসব দেশে আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। হাসিনা শত শত নিরীহ মানুষের খুনের আসামি। সেগুলি ছিল ঠান্ডা মাথায় খুন। যাদেরকে খুন করা হয়েছে, তারা সশস্ত্র ছিল না। এবং কাউকে খুন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। এরূপ নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষদের গুলি করে হত্যা করাই হলো ঠান্ডা মাথায় খুন করা। ফলে হাসিনা এখানে খুনের হুকুমের আসামী। সেনা বাহিনী, পুলিশ, বিজেপি ও র‍্যাবের সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে কাউকে খুন করেনি।‌ তারা খুন করেছে খুনি হাসিনার হুকুমে এবং খুনি হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে।‌ ফলে পুরা অপরাধ গিয়ে পড়ে হাসিনার ঘাড়েও।

তবে শুধু হাসিনাকে শাস্তি দিলে দায়িত্ব শেষ হবে না, বিচার করতে হতে হবে এবং বিচারে অবশ্যই শাস্তি হতে হবে পুলিশ, র‍্যাব এবং সামরিক বাহিনীর যেসব সেপাই ও অফিসারদেরও যারা ঠান্ডা মাথায় এ খুনের সাথে জড়িত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উদ্দেশ্য তাই শুধু নিজেদের দাবী আদায় হলে হবে না, সেটিকে হতে হবে অপরাধীদের শাস্তিকে নিশ্চিত করাও। সভ্য দেশের এটিই রীতি। অপরাধীকে বিচারের বাইরে রাখাই আরেক অবিচার।

 

হাতছাড়া করা যাবে না এ সুযোগ

শেখ হাসিনা তার পিতা-মাতা ও ভাই হারানোর বেদনা এখনো ভূলতে পারে না। সুযোগ পেলে সে বেদনা নিয়ে এখনো সে চোখের পানি ফেলে। এখনো সে খুনিদের বিচার চায়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মানুষ কেন ভুলবে তাদের নিহত ও আহত নিরীহ ভাই-বোনদের? কেন চাইবে না তাদের হত্যার বিচার? তাই ছাত্র-জনতার সামনে মাত্র একটাই পথ। সেটি হলো যতদিন হাসিনা ক্ষমতায় আছে, ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। এবং সে সাথে নিশ্চিত করা যুদ্ধাপরাধী হাসিনা ও তার খুনি সহচরদের বিচার করা। এক্ষেত্রে আপোষ চলবে না। আপোষ করলে অপরাধী আরো নৃশংস অপরাধের সুযোগ পাবে। 

এ মুহুর্তে আন্দোলন থামিয়ে দেয়া হলে সেটি হবে শত শত শহীদদের রক্তের সাথে প্রচণ্ড বেইমানি। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কি শহীদদের সাথে সে বেইমানী করতে পারে? পরিতাপের বিষয় হলো, এরূপ বেইমানী অতীতে বহুবার হয়েছে। তাই শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিচার হয়নি। মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী বিচারকে ঘিরে যে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হলো সে গণহত্যারও বিচার হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় যেভাবে গণহত্যার চালানো হলো সে অপরাধেরও বিচার হয়নি। শেখ হাসিনা ৬ শতের বেশী মানুষকে গুম করেছে এবং বহু হাজার মানুষকে বিচার-বহির্ভুত হত্যা করেছে। সেসব নৃশংস অপরাধেরও বিচার হয়নি। এ ঘৃণ্য অপরাধীকে কি আর ছাড় দেয়া যায়? চলমান ছাত্র-আন্দোলন এ ঘৃণ্য অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার মহা সুযোগ হাতে এনে দিয়েছে। দেশের ১৭ কোটি জনগণ কি সে সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে?  ২৬/০৭/২০২৪

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *