সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ইজ্জত হারিয়েছে অধিকাংশের রায়

বাংলাদেশে এই অবধি যতগুলি নির্বাচন হয়েছে তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের ইজ্জত দেয়া হয়নি। অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি -এই দুই দলের যারাই সরকার গঠন করেছে তাদের প্রয়োজন পড়েনি নির্বাচনে অর্ধেক ভোট অর্জনের। দেখা গেছে নির্বাচনে প্রদত্ত শতকরা ৩৫ থেক ৪৫ ভাগ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠন করেছে এবং সে দলের প্রধানমন্ত্রী সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এভাবে অসম্মান দেখানো হয়েছে দেশের প্রায় শতকার ৭০ বা ৬০ ভাগ জনগণের রায়কে। এটি কোন সভ্য ও ন্যায্য নীতি হতে পারেনা। যারা জনগণের রায়কে ইজ্জত দেয় -তারা সেটি মেনে নিতে পারে না। গণতন্ত্র তো তাই -যেখানে নির্বাচনে প্রতিটি ব্যক্তির রায় গুরুত্ব পায় এবং জনগণ অধিকার পায় সংসদে নিজেদের প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে নিজেদের মতামতকে তুলে ধরার সুযোগ। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচন বিধিমালা জনগণের রায়কে সে ইজ্জত দেয়নি। এটি হলো বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক অবিচার ও অপরাধ। এ ঘৃণ্য সাংবিধানিক অপরাধ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে সংবিধান পরিণত হয়েছে জনগণের শত্রুতে।  

জনগণের রায়কে ইজ্জত দিতে হলে প্রতিটির ভোটাদাতার ভোটকে মূল্য দিতে হয়। আর সেটি করতে হলে সংসদে প্রতিটি দলের সদস্যের সংখ্যা নির্ধারিত হতে হবে সে দলের প্রাপ্ত ভোটের প্রেক্ষিতে। যারা সংসদীয় নির্বাচনে শতকরা ৩০ ভাগ ভোট পাবে, তারা সংসদে মাত্র ৩০ ভাগই সদস্যপদই লাভ করবে, তার একটিও বেশি নয়। অর্থাৎ ৩০০ আসনের সংসদে তারা পাবে ৯০টি আসন।  যারা নির্বাচনে শতকরা ১০ ভাগ ভোট পাবে, তারাও সংসদের শতকরা দশ ভাগ সিট পাবে। অর্থাৎ তারা পাবে ৩০টি আসন। এভাবে সংসদীয় আসনের বন্টন হলে সংসদে দেশের শতভাগ জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এটিই তো গণতান্ত্রিক নীতি; সে সাথে সেটি সভ্য ও ন্যায্য নীতিও । রাষ্ট্রের উপর জনগণের  নিশ্চিত করতে হলে এর চেয়ে উত্তম পদ্ধতি আছে কি? এ পদ্ধতি ভারতে কার্যকর হলে সে দেশের শতকরা ১৫ ভাগ মুসলিম সেদেশের পার্লামেন্টে কমপক্ষে ৮০টি সিট পেত; সরকারে তাদের অংশ্রহনও থাকতো । কিন্তু সেদেশের সংবিধান ও নির্বাচন বিধি মুসলিমদের জন্য সে ন্যায্য অংশগ্রহন অসম্ভব করে রেখেছে। ভারতীয় সংবিধান ও নির্বাচন বিধির এই হলো সবচেয়ে বড় অবিচার ও অসভ্যতা। এরূপ অবিচার ও অসভ্যতা শুধু স্বৈরশাসকদের দ্বারাই হয় না, সেটি হয় গণতন্ত্রের নামেও। ভারত তারই নমুনা।

 

বড় দলের স্বৈরাচার

কিন্তু বাংলাদেশে যারা বড় বড় রাজনৈতিক দল -তারা অতীতে কখনোই এই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সমর্থন করেনি। কারণ, তাতে তাদের দলের রাজনৈতিক শক্তির ক্ষতি হয়। কারণ, তারা জানে দেশের অধিকাংশ ভোটার তাদের দলের নয়। ফলে তারা নিশ্চিত যে, কখনোই কোন সিটে শতকরা ৫০ ভাগ তারাভোট পাবে না। অথচ বর্তমান সাংবিধানিক পদ্ধতিতে শতকরা ৩০ বা ৩৫ ভাগ ভোট পেলেই যে কোন দল ক্ষমতায় যেতে পারে। প্রতি আসনের বাকি শতকরা ৭০ বা ৬৫ ভাগ ভোট বাকি দলে ভাগ হয় যায়।

বুঝতে হবে, বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশী মানুষই কোন বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সদস্য বা নেতাকর্মী নয়। তাদের অধিকাংশই নির্দলীয় বা নানা ক্ষুদ্র দলের সমর্থক।  নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধি বিজয়ের সম্ভাবনা থাকে না, ফলে তারা নির্বাচনে ভোট দিতে যায় না। সেটি দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের বহু দেশেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান দুটি দল হলো রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। সে দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষই এ দুই দলের বাইরে। সে দেশের সংবিধান সুপরিকল্পিত ভাবে এই দুই দলকে পালাক্রমে ক্ষমতা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং প্রতিহত করে তৃতীয় পক্ষের উত্থানের সম্ভাবনাকে। এটি হলো গণতন্ত্রের নামে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির স্বৈরাচার। জনগণ সেটি বুঝে।  তাই যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ ভোটার ভোট দিতে যায় না। বর্তমান পদ্ধতি বাধ্য করে এই দুই দলের কোন একটিকে ভোট দিতে। তারা ভোট কেন্দ্রে হাজির না হয়ে সে আরোপিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। একই অবস্থা বিলেতে। এখানে জনগণ জিম্মি শ্রমিক দল ও রক্ষণশীল দল -এই প্রধান দলের কাছে। এখানেও শতকরা ৪০ভাগের বেশী ভোটার ভোট দিতে যায়না।

বাংলাদেশেও এতকাল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি -এই দুটি বৃহৎ দলের মধ্যে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। অথচ দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এই দুটি দলের কোনটিরও সদস্য নয়। তাদের অনেকেই বিভিন্ন ছোট ছোট দলের সমর্থক। ছোট দলের সমর্থক হওয়া যদি কোন অপরাধ না হয়ে থাকে তবে তারা কেন সংসদে প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার পাবে না? সংবিধানের দায়িত্ব হলো তাদের সে অধিকারকে নিশ্চিত করা।

 

গণবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী যুক্তি

অনেকে যুক্তি দেখায়, প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের সদস্য দেয়া হলে সরকার দুর্বল হবে এবং এতে সরকারের অস্থিতিশীলতা বাড়বে। কিন্তু এটি কোন যুক্তি হতে পারে না। এ যুক্তি যেমন গণবিরোধী, তেমনি গণতন্ত্রবিরোধী। আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি হতে হবে জনগণের রায়কে প্রাধান্য দেয়া এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অধিকারকে সুনিশ্চিত করা। এবং জনগণ তো একমাত্র তখনই ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পায় যখন তারা সংসদে নিজেদের পছন্দমত প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ পায়। এবং তাদের নিজেদের পছন্দকে বড় বড় দলের  রাজনৈতিক পছন্দ থেকে বাঁচাতে হবে।

সরকার পরিচালনায় যতই বাড়ে অধিকাংশ জনগণের অংশগ্রহন, ততই বাড়ে সরকারের শক্তি ও স্থায়িত্ব। সেটি না হলে শুধু বিশেষ একটি দলের দলীয় সরকারের শক্তি বাড়িয়ে জনগণের কি লাভ? সরকারের স্থায়িত্ব বাড়িয়েই বা কি লাভ, যদি জনগণের রায়কেই ইজ্জত দেয়া না হয়? সরকার তো তখন দৈত্যে পরিণত হয়। জনগণ সেসব দৈত্যদের মুজিব ও হাসিনার আমলে দেখিয়েছি। বুঝতে হবে জনগণের অংশগ্রহণমূলক দুর্বল ও অস্থিতিশীল সরকার ঐসব দানবীয় সরকারের চেয়ে শতগুণ ভাল।  শক্তিশালী দেশ তো সেটিই যেদেশের জনগণ  শক্তিশালী। এবং জনগণ তো তখনই শক্তিশালী হয় যখন দেশ পরিচালনায় তাদের অংশীদারীত্ব থাকে। তাছাড়া তারাই দেশের সবচেয়ে বড় stakehoder। সংখ্যানুপাতিক সদস্য পদ দেয়ার অর্থ জনগণের অংশগ্রহন ও তাদের ক্ষমতায়নকে বাড়িয়ে দেয়া।

ইউরোপের জার্মানীসহ অনেক দেশেই এই সংখ্যানুপাতিক সদস্য পদ দেয়ার পদ্ধতি চালু রয়েছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে সেসব দেশের জনগণকে বড় বড় দলের প্রাধান্য থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী নেপালেও এই সংখ্যানুপাতিক সদস্যপদের বিধি চালু হয়েছে। সেখানে নেপালি কংগ্রেসসহ বড় দলের আধিপত্য খর্ব করা হয়েছে। এখন সে দেশের নানা মতের মানুষ নিজেদের প্রতিনিধিদের তাদের সংখ্যার অনুপাতে সংসদে পাঠাতে পারে। আমরাও সরকারের শক্তিমত্তা দেখতে চাই না, আমরা দেখতে চাই জনগণের ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্ব। এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা

 

এখনই সংস্কারের শ্রেষ্ঠ সময়

এখনই সাংবিধানিক সংস্কারের শ্রেষ্ঠ সময়। সে সাথে এটি শ্রেষ্ঠ সময় নির্বাচন বিধি সংস্কারেরও। বর্তমান নির্বাচন বিধি চলতে থাকলে এমন অনেক দল আছে যারা উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও সংসদে ও সরকারে কোন কালেই কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না। বাংলাদেশের এমনক কিছু দল আছে যাদের ভোট ব্যাংক শতকরা ৩ থেকে ১৫ ভাগের মধ্যে। প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সিট দেয়া হলে তারা সংসদে ১০ থেকে ৪০টি আসন অনায়াসেই পাবে। তখন তারা সংসদে নিজেদের অভিমতগুলি তুলে ধরতে পারতো। এমন কি অন্য দলের সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠনেও অংশ নিত পারতো। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পদ্ধতিতে সেটি সম্ভব নয়। বর্তমান পদ্ধতি চলতে থাকলে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ এই অংশকে বছরের পর বছর সরকার পরিচালনা থেকে বঞ্চিত রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটি তাদের প্রতি অতি অন্যায় এবং অবিচার হবে। গণতন্ত্রের নামে এই অবিচার চলতে দেয়া যায় না। 

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৮ থেক ৯ ভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তারা ছিটিয়ে আছে সারা দেশব্যাপী। তারা দেশের কোন আসনেই নিজ সংখ্যা বলে নির্বাচিত হতে পারেনা। ফলে কখনোই তা নিজেদের পছন্দমত প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠাতে পারে না। ফলে তাদের ভোট ব্যাংক হতে হয় বড় বড় দলের। অথচ প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদের সদস্যপদ দেয়া হলে সংখ্যালঘুদের নিজেদের দল সংসদে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। তখন তাদেরকে কোন বড় দলের হাতে জিম্মি হতে হবে না। এবং কোন বড় দলকেও সংখ্যালঘুদের দলে ভেড়াতে গিয়ে দলীয় নীতিতে কোন পরিবর্তন আনতে হবে না -যেমনটি আওয়ামী মুসলিম লীগের ক্ষেত্রে হয়েছে। সংখ্যালঘুদের দলে টানতে তারা দলের নামতে মুসলিম শব্দটিকে নির্মূল করেছে।    

মূল কথা হলো, গণতন্ত্রের লক্ষ্য হতে হবে জনগণের রায়ের প্রতি ইজ্জত দেয়া এবং তাদের অংশদায়িত্বকে সুনিশ্চিত করা। চলমান পদ্ধতিতে সেটি এতো দিন সম্ভব হয়নি; এবং এ পদ্ধতি না বদলালে আগামীতে সম্ভব হবে না। সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়। নইলে বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিজয়ী দল কখনোই ভোটের সংখ্যানুপাতে সদস্য পদ দেয়ার পদ্ধতিকে চালু হতে দিবে না। কারণ, বর্তমান পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশী লাভ তাদেরই। ১৫/১০/২০২৪

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *