সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম

ফিরোজ মাহবুব কামাল

দেশে আজ স্বাধীনতার আমেজ

গতকাল ৩০শে নভেম্বর একমাস বাংলাদেশে কাটিয়ে আবার লন্ডনে ফিরে এলাম। কি দেখলাম ও কি আমার অনুভূতি -তা নিয়েই আজকের লেখা। মনে হলো, দেশ এখন স্বাধীন। সর্বত্র দেখলাম স্বাধীনতার পূর্ণ আমেজ। নেই কোন পুলিশী হামলা-মামলার ভয়। নেই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের তাণ্ডব। নেই চাঁদাবাজী। জনগণ নিজেরা খুশিমত কথা বলছে। সর্বত্র পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। আলেমদের উপর বাধা নেই জুম্মার খোতবা ও ওয়াজ মহফিলে ইচ্ছামত বক্তব্য পেশে। মুজিবের বিশাল বিশাল মুর্তিগুলি সমগ্র দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাধারণ জনগণ উৎসবভরে কিভাবে সেগুলি ভেঙ্গেছে -সে বিবরণীও শুনলাম। ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গর্তে ঢুকেছে, এতো দিন যাদের ছিল প্রচণ্ড দাপট কোথাও তাদের দর্শন মিলছে না।

ভারত যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল শত্রু -সে কথাটি এখন জনগণের মুখে মুখে। ভারতের কোলে বসে মাঝে মাঝে হাসিনা যে বয়ান দিচ্ছে তা জনগণের ঘৃণাকে আরো তীব্রতর করছে। যারা শিক্ষিত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবেন তাদের অনেকেই বললেন, ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গাই ভূল হয়ে গেছে। বলছে মুজিব তাদের প্রতারিত করেছে। পাকিস্তান ভাঙ্গায় লাভ হয়েছে শক্তি বেড়েছে ভারতের  এবং সম্পদশালী হয়েছে ভারতসেবী আওয়ামীরা। অনেকেই বলছে, বাংলাদেশের স্বাধীনভা বাঁচতে হলে পাকিস্তান ও চীনসহ ভারতবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়াতেই হবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকেই তারা বেশী বিশ্বস্ত মনে করে। কারো কারো অভিমত, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি হওয়া উচিত এবং পারমানবিক মিজাইল বাংলাদেশে বসানো উচিত। তাদের ভয়, সেটি না হলে ভারতের আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশের একার পক্ষে স্বাধীনতা বাঁচানোর ব্যয়ভার বহন করা কঠিন হবে।

 

চলছে নীরব অসহযোগ

শেখ হাসিনার পালালেও দেশের অফিস-আদালতে রয়ে গেছে বিগত ১৬ বছর ধরে চাকুরিপ্রাপ্ত লক্ষ লক্ষ আওয়ামী ঘরানোর লোক। তাদের এজেন্ডা এ সরকারকে যে কোন ভাবে ব্যর্থ করা। লক্ষ্য করলাম, অফিস আদালতে চলছে নিরব অসহযোগ। দায়িত্ব পালনে মনযোগ নাই পুলিশের। কারণ, তাদের মিলছে না ঘুষ।  কাজের প্রয়োজনে দুটি সরকারি অফিসারে আমাকে যেতে হয়েছিল। ‌একটি হলো ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস, অপরটি হলো নির্বাচন ও নাগরিকত্ব নিবন্ধন অফিস। বেলা দুইটার পর দুটি অফিসেই গিয়ে দেখলাম, কর্মকর্তা দুপুরের খানা খাওয়ার বাহনায় এক ঘন্টার বেশি চেয়ারে নেই। দূর-পাল্লার এক ট্রেনযাত্রীর মুখে শুনলাম, ট্রেনের চেকারদের নাই যাত্রীদের টিকেট চেক করায় আগ্রহ। টিটিরা আগে টিকিট চেক করতো বিনা টিকিটের যাত্রীদের থেকে ঘুষের অর্থ আদায়ের লোভে। এখন সে ঘুষ জুটে না, তাই নাই টিকিট চেকে তাদের আগ্রহ। দেশের পত্রিকাগুলো পড়ে মনে হয়, ইসলামের পক্ষে কথা বলার লোকের দারুন অভাব। মিডিয়া জগতের উপর দখলদারীটা সেক্যুলারিস্ট তথা ইসলামের শত্রু পক্ষের।

রাজধানীসহ জেলা শহরেও দেখলাম প্রচন্ড যানজট। শহরের রাস্তাঘাট ধুলোয় পরিপূর্ণ। ঢাকার আকাশ ধুলোর আস্তরে ঢাকা -যেন কুয়াশা লেগে আছে। রাস্তাঘাটে পরিচ্ছন্নতার দারুন অভাব। যেন একাজে বাংলাদেশে লোকের অভাব। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া ঢাকা শহরের কোথাও ট্রাফিক লাইট নাই। সর্বত্র জুড়ে এক জটিল বিশৃঙ্খলা। ট্রাফিক পুলিশদের হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে। বিস্মিত হতে হয় গাড়ি, বেবিট্যাক্সি ও রিকশা চালকদের দক্ষতা দেখে। এমন যানজটের মাঝেও তারা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ না ঘটিয়ে নিজ নিজ যান চালিয়ে যাচ্ছে। বিস্মিত হলাম, কোন গাড়ির গায়ের টোল বা ঘর্ষণের দাগ না দেখে। বিস্ময়ের বিষয়, এতো বিশৃঙ্খলার মাঝেও কারো মুখে তেমন যন্ত্রনা বা আহাজারি নাই।

 

ঢাকার নান্দনিক রূপ ও মেট্রো

ঢাকা শহরের পথে ঘাটে বিপুল গাছপালার নজরে পড়ে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক, বেলি রোড, সহরাওয়ার্দী উদ্যান, শেরে বাংলা নগর, ধানমন্ডি, গুলশান এলাকায় দেখলাম প্রচুর গাছপালা। বিমান বন্দর রোড থেকে ৩০০ ফিট চওড়া বিশ্বমানের রাস্তা দিয়ে দেখতে গেলাম সেনা বাহিনীর গড়া জলসিড়ি পার্ক। ৩০০ ফিট চওড়া রাস্তাও নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। মনে হলো আগামীতে এটিই হবে ঢাকার সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে নান্দনিক এলাকা।

মেট্রোতে উঠলে মনে হয় পার্কের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলছে। লন্ডন বা প্যারিসের পাতাল রেলে এ মজাটা পাওয়া যায়না। কারণে সেখানে ট্রেন চলে অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে। মেট্রো স্টেশনগুলি বিশাল আকৃতির। জাপানীদের গড়া মেট্রোর ট্রেনগুলির মানও ভালো; মনে হলো আন্তর্জাতিক মানের। মেট্রো লাইন নির্মিত হয়েছে সড়ক থেকে অনেক উঁচুতে এবং এর পিলারগুলি সুন্দর ডিজাইনের হওয়ায় তাতে শহরের শ্রীহানী হয়নি। বিজয় স্মরণী ও আগারগাঁ স্টেশনের কাছে পিলারগুলি আরো সুন্দর লাগে। লন্ডন ও প্যারিসের পাতাল রেলের চাইতে মেট্রো আরাদায়ক মনে হলো। ভাড়াও কম। যারা claustrophobic তাদের কাছে পাতাল রেল অসহ্য; ঢাকার মেট্রো রেল নিশ্চয়ই তাদের ভাল লাগবে। এরকম আরো তিন বা চারটি মেট্রো রেল নির্মিত হলে ঢাকার যোগাযোগ অনেক সহজ হবে।

প্রথম বার মেট্রো রেলেই উঠেই অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি। আমার স্ত্রী ও আমার বড় মেয়েসহ আমরা ছিলাম তিনজন।  মেট্রোতে উঠামাত্রই প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে আমাদের বসার জন্য সিট করে দিতে সিটে বসা তিনজন অল্পবয়সী যাত্রী উঠে দাঁড়ালো। লন্ডনে সিনিয়র সিটিজেনদের প্রতি এরূপ সম্মান বহুবার দেখেছি, বাংলাদেশেও দেখলাম। খুবই ভালো লেগেছে।

 

আমার কর্মব্যস্ততা

ঢাকায় কিছু পুরনো বন্ধু, লেখক, কলামিস্ট ও সচিবালয়ের কিছু কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিনটি সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছি। একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে ছিল ফার্ম গেটের খামারবাড়ি কৃষি ইনস্টিটিউশনে । প্রায় ৪০ জন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই বিভিন্ন পদে দায়িত্বশীল এবং উচ্চশিক্ষিত।  বক্তব্য রেখেছিলাম বাঙালি মুসলিমের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে। আমি অভিভূত হয়েছি আমার বক্তব্যের প্রতি তাদের আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখে। আরেকটি সেমিনার ছিল দেওবন্দী আলেমদের নিয়ে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৩০ জন আলেম ও সুধি। তাদের অনেকেই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ঢাকা বিভিন্ন মসজিদের ইমাম। কয়েকজন ছিলেন অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। আয়োজক ছিলেন একজন মুফতি। তিনি ঢাকার একটি দেওবন্দী মাদ্রাসার মোহাদ্দেস এবং ঢাকার একটি আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক। মুফতি সাহেব জানালেন, বহু বছর যাবত তিনি আমার লেখার পাঠক। সে সুবাদেই তিনি আমাকে নিয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করেছেন। আমাকে বক্তব্যের বিষয় ছিল: সেকুলারিজমের নাশকতা। আমি অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি আমার বক্তব্যের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখে। আমার মত একজন অ-আলেমের কথা এতো আগ্রহ নিয়ে কওমী মাদ্রাসার আলেমগণ শুনবেন – সেটি আমি ভাবতেও পারিনি। তাদের মাঝে আমি নতুন ভাবনা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখেছি।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা যে মাথার উপর থেকে নেমে গেছে -তা নিয়ে মানুষের মাঝে দেখলাম বিপুল আনন্দ। তারা মন খুলে বলছে হাসিনার বীভৎস, নৃশংস ও অপরাধী কর্মকাণ্ডের কথা।  রাজধানীসহ মফস্বলে কোথাও দেখলাম না আওয়ামী লীগের পক্ষে কাউকে কথা বলতে। বর্তমান সরকারের অদক্ষতা নিয়ে অনেকেরই নানা অভিযোগ, কিন্তু কেউ এ সরকারের বিলুপ্তি বা অপসারণের পক্ষে কথা বলে না। প্রফেসর ইউনুসের ব্যাপারে সবাই সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল। তিনি যে দুর্নীতির উর্দ্ধে, দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনতার পক্ষে আপোষহীন -তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নাই। হাসিনার পলায়ানের পর স্থানে স্থানে বিএনপি কর্মীরা চাঁদাবাজিতে নেমে দলটির দুর্নাম বাড়িয়েছে। অনেকেই বলে আওয়ামী লীগের শাসন দেখেছি, বিএনপির শাসনও দেখেছি, এখন তারা ইসলামপন্থীদের শাসন দেখতে চায়। ইমসলামপন্থীদের তারা সৎ মনে করে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা ও সামর্থ্য নিয়ে।

 

প্রকট সংকট নেতৃত্বের

স্বৈরাচারী শাসন কোন দেশে দীর্ঘকাল থাকলে যে সংকটি প্রকট ভাবে দেখা দেয় সেটি হলো নেতৃত্বের। ফ্যাসিস্ট শাসন দেশকে নেতৃত্বশূণ্য করে ছাড়ে। বাংলাদেশ সে সংকটে প্রবল ভাবে আক্রান্ত। রাক্ষসী মাছ পুকুরে থাকলে সেখানে ছোট ছোট মাছের পক্ষে বাঁচা ও বেড়ে উঠা অসম্ভব হয়। সে বিপদটি  স্বৈরাচারী শাসনেরও। স্বৈরাচারী শাসকের এজেন্ডা, একমাত্র নিজ নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা। নির্মূল করে বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠার সকল সম্ভাবনাকে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে সবচেয়ে বড় সুফল দিকটি হলো, তাতে নেতৃত্ব গড়ার উর্বর ক্ষেত্র তৈরী হয়। ফলে ১৯৪৭’য়ে যে মাপের রাজনৈতিক নেতা এই বাঙালি মুসলিমের বুকে গড়ে উঠেছিল তা আজ বাংলাদেশে নেই। ১৯৪৭’য়ে বাংলার মুসলিমগণ পেয়েছিল শেরে বাংলা ফজলুল হক, খাজা নাজিম উদ্দিন, হোসনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মৌলভী তমিজউদ্দিন খান ও নূরুল আমীনদের মত যোগ্যবান নেতাদের। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিকল্প নাই। আজকের নেতাদের তূলনায় ১৯৪৭’য়ের নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দেশপ্রেম ছিল অধিক। তাদের ছিল গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি। সে সাথে ছিল, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও আর.এস.এস’য়ের হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র। খাজা নাজিমুদ্দিন লেখাপড়া করেছিলেন সে সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষা প্নতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লেখাপড়া করেছেন বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা তিনজনই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। মৌলভী তমিজ উদ্দিন খান লেখাপড়া করেছেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে। নূরুল আমীন লেখাপড়া করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

১৯৪৭’য়ের বাঙালি মুসলিম নেতাদের ছিল গভীর ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান। ছিল, অদম্য মুসলিমপ্রেম। হিন্দুত্ববাদীদের সাথে লড়াই করে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন। তাদের কারণেই ১৯৪৭’য়ে নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান।  হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারতের বিপদটি তারা যতটা গভীরভাবে বুঝেছিলেন তা একাত্তরের শেখ মুজিব, মাওলানা ভাষানী, তাজ উদ্দিন, সিরাজুল আলম খান বা মেজর জিয়াউর রহমান বুঝতে পারিনি। সে বিষয়টি বুঝার মত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা তাদের ছিল না। পৌত্তলিক কাফিরদের শত্রু গণ্য করার মত ঈমানী বলও ইসলাম থেকে দূরে সরা এসব সেক্যুলার নেতাদের ছিল না। তাই একাত্তরে তারা রাক্ষসী ভারতের কোলে গিয়ে উঠে ও প্রতিপালন নেয় তাদের আশ্রয়ে। ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার এজেন্ডাই তাদের এজেন্ডায় পরিণত হয়।

বাঙালি মুসলিমের আজকের বিপদের কারণ, ১৯৪৭’য়ে বাঙালি মুসলিম নেতাদের চেতনায় যে ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান, দূরদৃষ্টি ও পরিপক্কতা ছিল, সেটি না থাকার কারণে একাত্তরের  নেতারা আগ্রাসী ভারতকে নিঃশর্ত বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং ভারতীয় এজেন্ডার কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে।  বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত আগ্রাসন চালালে স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা পাবে -সে ভাবনা যেমন মুজিবের ছিলনা, তেমনি ভাষানী ও জিয়াউর রহমানেরও ছিল না। সে ভাবনা একাত্তরের এসব ভারত প্রতিপালিত সেক্যুলার নেতাদের  মগজে একবারও জাগেনি। কারণ, গভীর ভারতপ্রেম তাদেরকে বিবেকশূণ্য ও অন্ধে পরিণত করেছিল। তাদের মুখে কেবল শোনা যেত ভারত প্রেম ও বন্দনা। বাঙালি মুসলিমদের আজকের বিপদের কারণ তো একাত্তরে ভারতের বিজয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের উপর ভারতীয় অধিকৃতি।

১৯৭১ সালে বাঙালি মুসলিমদের মাঝে এরূপ নেতৃত্বশূন্যতার মূল কারণ ও প্রেক্ষাপটটি হলো, জেনারেল আইয়ুব খানের ১১ বছরের স্বৈরশাসন। সে স্বৈরশাসন নস্যাৎ করে সুস্থ ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব গড়ে উঠার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আইয়ুব খান ধ্বংস করে মুসলিম লীগকেও। ফলে নেতৃত্বের সে শুণ্যস্থান পূরণ করে শেখ মুজিবের ন্যায় একজন ভারত-প্রতিপালিত ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ফ্যাসিবাদী রাজনীতিবিদ। ভারতের এজেন্ডা পূরণে মুজিবের কাজ হয়, বাঙালি মুসলিমের  গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া -যা পূর্ব বাংলার জনগণ অর্জন করেছিল ১৯৪৭ সালে। সে সাথে আরো এজেন্ডা হয়, ভারতের জন্য শোষণ ও লুণ্ঠনের দরজা খুলে দেয়া এবং একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দেয়া। সে ভারতীয় বাকশালী প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় সভ্য রাজনীতি ও স্বাধীন ভাবে বাঁচাকে অসম্ভব করা হয় হাসিনার দীর্ঘকালীন ফ্যাসিবাদী শাসনে।

 

যে সংকট জামায়াত ও বিএনপি নিয়ে

হাসিনার ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে নেতৃত্বের দারুন সংকটে ভুগছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ন্যায় দেশের দুটি বৃহৎ সংগঠন। জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দলটির মাঝে নেতৃত্বের সংকটকে তীব্রতর করা হয়েছে। বিএনপিও হারিয়েছে সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও ইলিয়াস আলীর ন্যায় তেজস্বী নেতাদের। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ দুটি বড় দলের নেতারাই নানারূপ বিভ্রান্তিকর ও অপরিপক্ক মন্তব্য দিয়ে নিজেদের অযোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছে। এভাবে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো সংকটময় করছে। এখানেই বাংলাদেশের মহা সংকট ও বিপদ। এ দুটি বৃহৎ দলের নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল শত্রুকে সনাক্ত করতে। আওয়ামী লীগের যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল শত্রু এবং ভারতের প্রতি তাদের সেবাদাসী আনুগত্য যে অতি প্রকট -সেটি বুঝতে এ দুটি দলই চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই হাসিনার পলায়নের পরপরই জামায়াতে ইসলামীর নেতা ডাক্তার শফিকুর রহমান অপরাধী আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি -এ দুটি প্রধান দলই। তাদের কথা আওয়ামী লীগ ময়দান না থাকলে নাকি গণতন্ত্র ও নির্বাচন বৈধতা পাবে না। এ দুটি দল ব্যর্থ হয়েছে এমন কি পৌত্তলিক চেতনায় পুষ্ট রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীতকে বাদ দিতে।  

জীবনকে নিরাপদ করতে হলে হিংস্র বাঘ-ভালুককে অবশ্যই চিনতে হয়। নইলে জীবন বাঁচেনা।  তেমনি দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষা দিতে হলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শত্রুদেরও চিনতে হয়। নইলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বাঁচে না। হিন্দুত্ববাদী ভারত যে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার চিরশত্রু সেটি শুধু ১৯৪৭‌’য়েই প্রমাণিত হয়নি, প্রমাণিত হয়েছে ১৯৭১’য়ে এবং আজও সেটি বার বার প্রমাণিত হচ্ছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগ যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শত্রু সেটি যেমন মুজিবের আমলে প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি প্রমাণিত হয়েছে হাসিনার আমলেও। আওয়ামী লীগ ময়দানে থাকলে গণতন্ত্র  ও দেশের স্বাধীনতা বিপদে পড়বে -তা  নিয়ে কি এখনো কোন সন্দেহের অবকাশ আছে? অথচ জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি সে ঐতিহাসিক সত্যকে মানতে রাজী নয়। বাংলাদেশের জন্য এখানেই মহা রাজনৈতিক সংকট।  

যে কোন সভ্যদেশে প্রতিটি নাগরিকের ব্যবসা-বাণিজ্যের  পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু স্বাধীনতার থাকে না চোর-ডাকাতদের। তাদের স্থান হয় কারাগারে। তেমনি রাজনীতির অঙ্গণে যে কোন ব্যক্তির দল গঠনের স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু স্বাধীনতা থাকে না তাদের যারা ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসী। ‌ আওয়ামী লীগ যে সন্ত্রাসী,  ফ্যাসিবাদী ও  স্বাধীনতার শত্রু -তা তারা হাজার হাজার মানুষকে খুন করে, গুম করে এবং দেশবাসীর ভোটডাকাতি করে ও মৌলিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে প্রমাণ করেছে। ফ্যাসিবাদের কারণে জার্মানীতে শুধু হিটলারই অপরাধী গণ্য হয়নি, অপরাধী গন্য হয়েছে তার দলও, তাই বিলুপ্ত করা হয়েছে হিটলারের নাৎসি দলকে। একই কারণে ইতালিতে মুসোলিনী শুধু অপরাধী গণ্য হয়নি, অপরাধী গন্য হয়েছে তার দল ফ্যাসিস্ট পার্টিও। তাই বাংলাদেশে অপরাধী শুধু শেখ হাসিনা নয়, গুরুতর অপরাধী হলো তার ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগও। তাই কোন দেশের সভ্য জনগণই কোন ফ্যাসিবাদী দলকে বৈধতা দেয় না। কিন্তু বিএনপি ও জামাত নেতৃবৃন্দ সেটি মানতে রাজি নয়। এটি তাদের রাজনৈতিক অপরিপক্কতা, অপরিণামদর্শিতা ও অদূরদর্শিতার প্রমাণ।

 

ইসলামপন্থীদের ব্যর্থতা ও দুর্ভাবনার বিষয়

বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের ব্যর্থতাটি বিশাল। রাজনৈতিক দলের মূল কাজটি শুধু দলগড়া, সভা-সমাবেশ করা ও বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া নয়। শুধু কর্মীবাহিনী গড়াও নয়, বরং মূল কাজটি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যোগ্য জনশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে যোগ্য সৈনিক তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে নবীজী (সা:)’র জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয় অনেক। নবীজী (সা:) যা কিছু করেছেন -সেটি করেছেন সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনা অনুযায়ী। নবীজি (সা:) তাঁর নবুয়ত প্রাপ্তিকালে জানতেন না যে তাকে একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা হতে হবে। কিন্তু সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ সেটি জানতেন। বরং সেরূপ একটি রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠাই ছিল মহান আল্লাহতায়ালার মূল এজেন্ডা। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না পেলে তাঁর সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন, দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা শুধু কিতাবেই থেকে যেত। তাই শুরু থেকেই নিজস্ব এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে মহান আল্লাহতায়ালা পদে পদে নবীজী (সা:)কে পথ দেখিয়েছেন। তাই লক্ষণীয় হলো, নবুয়ত প্রাপ্তির পর তেরটি বছর মক্কায় অবস্থানকালে নবীজী কোন মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেননি। কিন্তু সে ১৩ বছর ধরে তিনি  নিজ হাতে ‌গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ গভর্নর, শ্রেষ্ঠ প্রশাসক, শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ, শ্রেষ্ঠ  বিচারপতি, শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। 

কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের কাছে নবীজী সে সূন্নত গুরুত্ব পায়নি। জামায়াতে ইসলামের মত সংগঠনের টার্গেট হয়েছে বেশি বেশি কর্মী ও ক্যাডার তৈরী করা। ফলে আজ যখন দেশের স্কুল-কলেজের কমিটিগুলোর  পরিচালনা কমিটিতে লোক নিয়োগের দাবি উঠেছে তখন দেখা যাচ্ছে তাদের হাতে যোগ্য লোক নেই।  সরকারি আইনবিদ রূপে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাদের হাতে পর্যাপ্ত সংখ্যায় যোগ্য আইনবিদ নাই। যোগ্য লোক নেই ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তির লড়াইয়ে। ক্যাডার দিয়ে অর্থ সংগ্রহ, জনসভায় লোক সংগ্রহ, পুস্তক বিতরণের কাজ হলেও এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কখনোই ক্যাডার দিয়ে হয়না। সে শূণ্যতাটি বুঝা যায় দেশের পত্র-পত্রিকা ও বইয়ের দোকানে  নজর দিলে। দেশের প্রকাশিত বইয়ের শতকরা ৯০ ভাগের বেশী বইয়ের লেখক হলো সেক্যুলারিস্ট, বামপন্থী ও হিন্দুত্ববাদীরা।  এরূপ দুরবস্থা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। বরং সৃষ্টি হয়েছে দলটির জন্ম লগ্ন থেকেই। এ সংগঠনের নেতাদের ভাবনায় রাষ্ট্র নির্মাণ, রাষ্ট্র পরিচালনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ সংগঠনটি বিগত ৭০ বছরের বেশি কাল ধরে তারা কাজ করছে। পুরা সময়কাল এ দলটি ব্যস্ত থেকেছে শুধু ক্যাডার, সমর্থক ও কর্মী গড়া নিয়ে। ব্যস্ত থেকেছে কোটি কোটি টাকার ব্যয়ে পার্টি অফিস, ব্যাংক, বীমা ও হাসপাতাল নির্মাণে।

একই রূপ অবস্থা দেশের আলেম সম্প্রদায়ের।‌ তারা গড়েছে লক্ষ লক্ষ মসজিদ ও হাজার হাজার মাদ্রাসা। কিন্তু তাদের এজেন্ডায় গুরুত্ব পায়নি প্রশাসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও বিচারপতি গড়ে তোলার কাজ। তারা ভাবেনি, তাদেরও রাষ্ট্র নির্মাণে নামতে হবে। তারা ভাবেনি যে, রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটিও নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে হলে রাষ্ট্র নির্মাণের বিকল্প নাই। রাষ্ট্র নির্মাণের এজেন্ডা না থাকায় আলেমদের প্রতিষ্ঠিত ‌মাদ্রাসাগুলির এজেন্ডা হয়েছে স্রেফ মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক, হাফিজ, ক্বারী ও কুর’আন পাঠ শেখানোর গৃহশিক্ষক তৈরি করা। মহান আল্লাতায়ালার এজেন্ডার সাথে নবীজী (সা:) যেভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন সেরূপ সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের আলেমদের নাই। ফলে মহান আল্লাতায়ালার এজেন্ডা, তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর দ্বীন পরাজিত হলেও এসব আলেমদের হৃদয়ে কোন মাতম উঠেনা। তারা সে লক্ষ্য নিয়ে জিহাদেও নামে না। ফলে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লক্ষ মসজিদ ও বহু হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা পেলেও প্রতিষ্ঠা পায়নি নবীজী (সা:)’র ইসলাম। এরূপ এক প্রেক্ষাপটে ১৬ কোটি মুসলিমের দেশে বেঁচে নাই মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরীয়তী বিধান এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। সেগুলি শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। নবীজী (সা:)’র মুসলিমগণ সংখ্যায় অতি নগন্য হলেও এর সবকিছুই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বাংলাদেশের বুকে যারা ইসলামের বিজয় নিয়ে ভাবে তাদের জন্য এটি হলো সবচেয়ে দুর্ভাবনার বিষয়। ০১/১২/২০২৪  

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *