এ জীবন কিরূপে কল্যাণের বদলে অকল্যাণের হাতিয়ার হয়  

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার কারণে মানব জীবনের সামর্থ্যটি বিশাল। সেটি যেমন এ জীবনকে সফল করার, তেমনি ব্যর্থ করার। সে সামর্থ্য যেমন ব্যক্তিকে অনন্ত অসীম কালের জন্য নিয়ামত ভরা জান্নাতে নিতে পারে। তেমনি জাহন্নামের আগুনেও পৌঁছাতে পারে। পৃথিবী অন্য কোন জীবের সে সামর্থ্য নাই। সবচেয়ে ভয়ানক বিপদটি তখন ঘটে, যখন কিসে সাফল্য এবং কিসে ব্যর্থতা -সেটি বুঝতেই ভূল হয়। এখানে ভূল হলে শান্তি ও সাফল্যের বদলে এ জীবন ভয়ানক অকল্যাণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। বিপর্যয় তখন শুধু পার্থিব জীবনে আসে না, আখেরাতেও জাহান্নামে হাজির করে। এ জীবনে শিক্ষণীয় বিষয় অনেক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, এ জীবন কিরূপে জান্নাতে নেয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয় সেটি জানা, তেমনি কিরুপে জান্নাতের বাহন হয় -সেটিও জানা। মানব জীবনে এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় কিছু নাই। অথচ সেটি জানায় অধিকাংশ মানুষের আগ্রহ অতি সামান্যই। সেটি জানতে হলে তো বুঝে কুর’আন পাঠ করতে হয়। সে কুর’আনী জ্ঞান না থাকার কারণে অধিকাংশ মানুষের কাছে এ জীবন নিজেকে ব্যর্থ করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                একজন দুর্বৃত্তের বিশাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পেশাদারী অর্জন দেখে হিংসা ও পরশ্রীকাতরতায় অনেকের মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। সেরূপ অর্জন এ জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা গণ্য হয়। সেরূপ ঈর্ষা সাধারণ মানুষদের জীবনে অতি স্বাভাবিক। নিজের অর্জন যাই হোক, অন্যের অর্জন তাদের মনে প্রচণ্ড ঈর্ষার জন্ম দেয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষই এ পৃথিবীতে অর্থ-সম্পদ ও আনন্দ-সম্ভোগের প্রতিযোগিতায় জিততে চায়। পরাজিত হওয়াটাই তাদের কাছে অসহ্য। ঈর্ষার মূল কারণ তো এই পরাজয়। কিন্তু এমন ঈর্ষা প্রকৃত ঈমানদারদের থাকেনা, অন্যদের এরূপ পার্থিব সাফল্য দেখে তাদের প্রতিক্রিয়া বরং ভিন্নতর হয়। তাদের কাছে গুরুত্ব পায় আখেরাতের পরিণামটি। ঈমানদারদের প্রতিযোগিতা তো আল্লাহর কাছে প্রিয়তর হওয়ায়, তাঁর মাগফিরাত লাভে এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে। মহান আল্লাহ তায়ালাও বান্দাদের মাঝে এরূপ ভাল কাজের প্রতিযোগিতাকে ভাল বাসেন। সেরূপ প্রতিযোগিতার হুকুম এসেছে সুরা হাদিদের ২১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

 

سَابِقُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلْفَضْلِ ٱلْعَظِيمِ

 

অর্থ: “পরস্পরে প্রতিযোগিতা করো তোমাদের রব থেকে মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের জন্য, যে জান্নাতের প্রশস্ততা প্রশস্ত আসমান ও জমিনের ন্যায় -যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান এনেছে। এগুলি হলো আল্লাহর নিয়ামত যা তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামতের অধিকারী।”

     যাদের সকল আগ্রহ এবং সকল প্রতিযোগিতা আখেরাতের জীবনকে সফল ও আনন্দময় করায়, তাদের কাছে পার্থিব সম্ভোগে মোহাচ্ছন্ন দুর্বৃত্তদের অতিশয় হতভাগা মনে হয়। কারণ, সে দুর্বৃত্তদের দেখে মনে হয়, এরাই হলো জাহান্নামের মানুষ -যারা দম্ভভরে এ পৃথিবী পৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ায়। মহান আল্লাহতায়ালা এমন দুর্বৃত্তদের যে জাহান্নামে নিবেন -সে হুশিয়ারি পবিত্র কুর‌’আনে বার বার দিয়েছেন। তাই এ দুর্ভাগাদের দেখে ঈমানদের কোন ঈর্ষা হয়না। বরং দুঃখ হয় তাদের ভয়ানক পরিণতির জন্য।

 মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ যোগ্যতাটি হলো জান্নাতের পথটি চেনা এবং সে পথে চলার যোগ্যতা। সেটি ভাত-মাছে সৃষ্টি হয়না, বড় বড় ডিগ্রি লাভ বা অর্থ লাভেও হয় না। সে জন্য চাই কুর’আন বুঝা  তা থেকে শিক্ষা নেয়ার সামর্থ্য। তাই ইসলামে এ কাজ ফরজ। এ জন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা প্রথমে নামাজরোজাহজযাকাত ফরজ করেননি। ফরজ করেছেন পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনকে। সে ওহীর জ্ঞান তখন সাফল্যের রাস্তা খুলে দেয়। দৈহিক ক্ষুধা মেটাতে তিনি এ পৃথিবীকে সাঁজিয়েছেন নানা রূপ ফল-মূল ও খাদ্যসামগ্রী দিয়ে, তেমনি জ্ঞানের ক্ষুধা মেটাতে নাযিল করেছেন ওহীর জ্ঞানসমৃদ্ধ সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব কুর’আন। সুস্থ ও পরিপূর্ণ সুন্দরতম মানুষ তো তারাই যাদের দেহের ক্ষুধার সাথে মনের ক্ষুধাও মেটানো হয়। কুর’আনী জ্ঞানার্জনের সে ফরজটি আদায় না হলে মুসলিম হওয়াই তখন অসম্ভব হয়। তখন নামাজরোজাও প্রাণহীন হয়। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেনএকমাত্র জ্ঞানবানগণই আমাকে ভয় করে। আল্লাহভীরু মুসলিম হওয়ার জন্য তাই জ্ঞানবান হওয়াটি জরুরী। ভিত ছাড়া যেমন দালান গড়া যায় নাতেমনি কুর’আনী জ্ঞান ছাড়া মুসলিমও যায় না।

                                                                                                                                                     মানব জীবনে  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাটি হলো মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মাগফিরাত লাভের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করা। কারণ যারা মাগফিরাত পায়, একমাত্র তারাই জান্নাত পায়। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে যা অনিবার্য হয়ে উঠে সেটি হলো জাহান্নাম। এ ক্ষেত্রে তারাই ব্যর্থ হয় যাদের সমগ্র সামর্থ্য ব্যয় হয় স্রেফ পার্থিব স্বার্থ হাছিলে এবং ভূলে থাকে বা অবহেলা করে আখেরাতের জীবনকে। এরূপ দুনিয়াবী স্বার্থ নিয়ে বাঁচাকে বলা হয় সেক্যুলারিজম বা ইহজাগতিকতা। সেক্যুলারিস্টদের জীবন যে পুরোপুরি ব্যর্থ -সে কথাটি স্পষ্ট ভাবে জানানো হয়েছে পবিত্র কুর’আনের সুরা কাহাফের ১০৩ এবং ১০৪ নম্বর আয়াতে।

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِٱلْأَخْسَرِينَ أَعْمَـٰلًا ١٠٣

ٱلَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ١٠٤

 অর্থ: “বলুন (হে নবী), আমি কি তোমাদের বলে দিব, কারা কর্মের দিক দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত?

এরা হলো তারা যাদের সকল প্রচেষ্টা পন্ড হয় পার্থিব জীবনের খাতিরে এবং মনে করে তারা কাজকর্মে উত্তম।”  পবিত্র কুর’আনে সেক্যুলারিজম তথা ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে এটি হলো অতি কঠোর আয়াত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *